Sunday, September 28, 2025

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্রন্থসমূহ রচনায় জলের মত তিনি ব্যবহার করিয়াছেন আরবী-ফার্সী-উর্দু এবং বাংলা ভাষাকে। বাংলায় রচিত কিতাবসমূহে যেমন মরমী মুর্শীদী কাব্যের সহজ ও সরলতম বুলি অর্নগল বলিয়া গিয়াছেন তেমনি উর্দু ভাষায়ও সুকঠিন বিষয়াদিকে বয়ান করিয়াছেন সাবলীল গতিতে। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার গদ্য ও পদ্য সাহিত্যেও ফুল বাগীচায় পদচারণা করিলেই মনে হয় রুমী-তাবরীজি-সিরাজীর গজল সামায় জলসা বসিয়াছে। এই গ্রন্থগুলো পাঠকালে পাঠককে এলমে মারেফতের তত্বময়তার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। মারেফতের নিগুড় রহস্যময় এই ধরনের কিতাব বাংলা ভাষায় নিতান্তই দুর্লভ। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা উর্দু এবং ফার্সী ভাষার উপর অতিশয় পান্ডিত্য অর্জন করিয়াছিলেন। উর্দু ভাষায় রচিত তাহার কিতাবগুলি হাকিকত ও তাছাউফের এক অমূল্য রত্নখনি। যে কোন লেখকের পক্ষেই এই ধরনের তথ্যময় কিতাব লিখা শুধু দুঃসাধ্যই নয় রীতিমত অসম্ভব। এশ্কে ইলাহীতে ফানা হইয়া মারেফতের সকল স্তর পার হইয়াই শুধু এই গ্রন্থগুলিই লিখা সম্ভব কেননা তাঁহার রচিত সমস্ত কিতাব সমূহই ইলহামের মাধ্যমে নির্দেশিত ছিল। কিতাব রচনাকালেও তাঁহার অসংখ্য কারামত মানুষ প্রত্যক্ষ করিয়াছে। একবার তিনি রাত্রিকালে মোমবাতি জ্বালাইয়া হুজরা খানায় বসিয়া কিতাব লিখিতেছিলেন। হঠাৎ করিয়াই খাদেম সাহেবের মনে পড়িল যে মুর্শিদ ক্বিবলার আলো জন্য কোন অসুবিধা হইতেছে কিনা খোজ নেওয়া দরকার। তিনি হুজরা খানার ভিতরে উকি দিয়া দেখিলেন যে হযরতের বাম হাতের তর্জনী দিয়া আলো বিচ্চুরিত হইতেছে এবং সেই আলোতেই বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ) কিতাব রচনা করিতেছেন। কখনো কখনো অন্ধকার ঘরে বসিয়াও তিনি কিতাব রচনা করিতেন।  তাঁহার কলম ও কাগজের খস্ খস্ শব্দ শুনিয়া ভক্ত ও খাদেমগণ কিতাব রচনার বিষয়ে অনুমান করিতে পারিতেন। নিম্নে তাঁহার কিতাব সমূহের কিঞ্চিত বর্ণনা দৌয়া হইল। 

নূরেহক্ব গঞ্জেনূরঃ-

এই গ্রন্থটির প্রথম সংস্করন হযরত সুরেশ্বরী স্বয়ং মুদ্রিত ও প্রকাশ করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্কারন তাঁহার পৌত্র হযরত জালাল নূরী প্রকাশ করিয়াছেন। ইহা তাছাউফ বা মারেফাত তত্বের উপর বাংলা ভাষায় নিগুড় ছন্দায়িত একখানি উচ্চাঙ্গে কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেওয়া কেতাবী এলেমের পক্ষে সম্ভব নয়। এই গ্রন্থ পাঠকালে পাঠকের মনে ইমাম গাজ্জালী, আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমির ‘মছনবি শরীফ’, হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবির ‘মফতুহাতে মাক্কিয়া’ এবং হযরত সামছে তাবরেজ, হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও হযরত বু’আলি শাহ্ কলন্দরের মসনবির মারেফত তত্তময়তার কথা স্মরণ করইয়া দেয়। মারেফতের নিগুড়তম রহস্যময় এই ধরনের গ্রন্থ বাংলা ভাষায় দ্বিতীয়টি পাওয়া অসম্ভব। ইহা লিখিতে হইলে মা’রেফত রাজ্যের অতি উচ্চস্তরের অলী ছাড়া সম্ভব নয়। 

ছফিনায়ে ছফরঃ-

এই গ্রন্থখানি ত্বরিকত পন্থির পথ চলার পাথেয়। প্রত্যেক মারেফত পন্থীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উচ্চাঙ্গের একটি গ্রন্থ। একজন ত্বরিকত পন্থীর পথের যাবতীয় প্রযোজনীয় সম্বল এই গ্রন্থে বিদ্যমান রহিয়াছে। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু ইহার নামকরনেই বিদ্যমান রহিয়াছে, জ্ঞানি মাত্রেই তাহা পাঠ করতঃ বুঝিতে পারিবেন।

কাওলোল কেরামঃ-

ইহা একখানি দলিল ও যুক্তিপ্রমাণ সর্বস্য গ্রন্থ। সেজদায় তাজেমী, পীরের রাবেতা, গান-বাজনা, ওয়াজ্দ হাল, পীরের প্রতি কর্তব্য এবং তাছাউফের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বিশদভাবে বিস্তৃত হইয়াছে। ত্বরিকত পন্থীদের জন্য গ্রন্থটি অতীব প্রয়োজনীয়। অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাইতে হইতেছে এই গ্রন্থখানি এখনও মুদ্রিত হয় নাই। 

মদিনা-কল্কী অবতারঃ-

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার বাংলা ভাষায় রচিত এই গ্রন্থখানিতে আখেরী ইমাম হযরত মেহেদী (আঃ) এর আবির্ভাব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্ এর হাদিস এবং বিভিন্ন অলীয়ে বরহক্বদের মতামত অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে। এই গ্রন্থখানী হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা নিজেই মুদ্রিত ও প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।

সিররেহক্ব জামেনূরঃ-

ইহা উর্দু ভাষায় রচিত অমূল্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থের পর্যালোচনা করা দুঃসাধ্য ব্যপার। বর্তমানে এইরূপ উচ্চাঙ্গের হাকিকত ও মারেফতের সু-স্পষ্ট বর্ণনা সহসা অন্য কোন ভাষা অথবা অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। হযরত সুরেশ্বরী নিজেই এই গ্রন্থখানি প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। দ্বিতীয় খন্ড এখনও প্রকাশিত হয় নাই। এই গ্রন্থে নূরে ওহাদানিয়াত, কাইফিয়াত, তকদিরের মিমাংশা, কুদরত, গান-বাজনা, ওয়াজ্দ ও হাল প্রভৃতি তাছাউফের অতিশয় প্রয়োজনীয় ও দুর্লভ পরিচ্ছেদ সমূহ রহিয়াছে। পাঠক মাত্রই এই গ্রন্থের মর্ম ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন। গ্রন্থখানি হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ জালাল নূরী (রাঃ) এর মুরীদ ও খলিফা মাওলানা মোহাম্মদ সাদেক বাংলা ভাষায় তর্জমা করিয়াছেন।

আইনাইনঃ-

উর্দু ভাষায় রচিত সুরেশ্বরী ক্বিবলার এই গ্রন্থখানী অলী আউলিয়ার অমরত্ব, ফাতেহা নেয়াজ, মাজার শরীফের আদব ও হেফাজতের কথা কোরআনের আয়াত দ্বারা অত্যন্ত তীক্ষèভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। এই গ্রন্থখানিও হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী স্বয়ং মুদ্রিত ও প্রকাশিত করিয়া গিয়াছেন। 

ছরহে-ছদুরঃ-

এই কিতাবখানিও উর্দু ভাষায় রচিত। হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ) এই কিতাবে তাহার মুর্শিদ ক্বিবলা, মুর্শিদের দরবার এবং তাহার কতিপয় পীরভাইদের সম্মন্ধে বিষদভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাইতে হইতেছে এই গ্রন্থখানি এখনও মুদ্রিত হয় নাই।

লাতায়েফে শাফিয়াঃ-

উর্দু ভাষায় রচিত এই কিতাবখানিতে। হযরত মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেব রচিত তাছাউফ সংক্রান্ত কতিপয় গ্রন্থের সমালোচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থে তিনি ওহাবী মতবাদের অসারতা নিপুনভাবে প্রমাণ করিয়াছেন। ইহা একখানি সমালোচনা মূলক গ্রন্থ। হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) স্বয়ং অত্র গ্রন্থখানি মুদ্রিত ও প্রকাশ করিয়াছেন। 

মাতলাঊ’ল ঊ’লুমঃ-

শরীয়ত, ত্বরিক, হাকিকত এবং মারেফতের এক বিশাল ভান্ডার এই উর্দু ভাষায় লিখিত গ্রন্থখানি। হযরত শাহ্ সূফী জালাল নূরী (রাঃ) এর মুরীদ ও খলিফা মাওলানা সাদেক সাহেব এই গ্রন্থখানির অনুবাদ করিয়াছেন।

পূর্ন কিতাব সমূহ পাঠের জন্য নিচের মেনুতে প্রবেশ করুন।

আইনাইন

সূচি
আল্লাহ্ জাত ও গুণাবলির মধ্যে পার্থক্য কী? ৪৩৮
আম্বিয়া ও আউলিয়াগণের রুহ মোবারক প্রকাশিত হতে পারেন কি না? ৪৪০
আল্লাহ্ আপন সত্তা থেকে কিছু সৃষ্টি করেন না, এর জবাব কী? ৪৪৫
জায়েদ বলে আল্লাহ্ জ্ঞানের মধ্যে বান্দার কোনো দখল নেই ৪৪৫
আল্লাহ্ জাত বা সত্তাও মজুদ তথা বর্তমান ৪৪৬
তাসদিক কী? ঈমান কাকে বলে? ৪৪৬
আদম (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) এর সিজদা ফরজ ছিল কি না? ৪৪৯
নামাজ আল্লাহ্ জন্যই নির্দিষ্ট তবে তাতে অন্যের তাজিম রয়েছে ৪৫৫
কে তোমাদের নিষেধ করল সিজদা করতে, এ বাণীর মর্মার্থ ৪৫৬
আল্লাহ্র জন্য কি কেবল সিজদাই নির্ধারিত? ৪৫৭
সিজদা, দাঁড়ানো, উঠা, বসা, ইত্যাদি কার্যাদির ব্যাপারে আইন কী? ৪৫৮
ইবাদত দ্বারা উদ্দেশ কী? ৪৫৯
সিজদা সম্পর্কে কোরান শরীফের একটি আয়াত ৪৫৯
সিজদা সম্পর্কে মেশকাত শরীফের একটি হাদিস ৪৬০
সম্মানার্থে সিজদা ৪৬৪
হযরত আদম (আঃ)কে ফেরেস্তাগণ কেন সিজদা করেছিল? ৪৬৪
অন্যকে সিজদা করতে মন চায় না, কারণ এটা আল্লাহ্ জন্য নির্ধারিত ৪৬৪
পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গের চালুকৃত শুভ অনুষ্ঠানাদি ৪৬৪
আদব আচরণাদির মধ্যে সিজদাও অন্তর্ভুক্ত কি না ৪৬৮
সিজদা, সম্মান, অথবা ভক্তি পেতে হলে তাকে বুজুর্গ অবশ্যই হতে হবে। ৪৬৯
নবী না হয়েও মর্যাদায় নবীর চেয়ে বুজুর্গ হতে পারেন কি? ৪৬৯
মিলাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে কেয়াম করা কী? ৪৭১
সম্মান প্রদর্শনের তাৎপর্য কী? ৪৭৩
যা ফরজ বা ওয়াজিব নয় ৪৭৪
কোনো কোনো ফেকার কিতাবে মিলাদ কেয়াম ইত্যাদিকে ৪৭৫
কোরান খতম ও মিলাদ শরীফ পড়ে যে টাকা পয়সা গ্রহণ করা হয় ৪৭৬
নবী-অলী এবং পূণ্যবান বান্দাগণ কখনও কাফের হন কি? ৪৭৬
বার বার যারা ঈমান আনে আবার কাফের হয় ৪৭৭
ফেকাহ্ গ্রন্থাদিতে কুফর অর্থে ব্যবহৃত বাক্য ৪৭৭
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ্ কে দেখেন কি না ৪৭৮
কেউ কেউ বলে আল্লাহ্ কে বাহ্য দৃষ্টিতে দেখার প্রমাণ নেই ৪৭৯
কারো কারো প্রশ্ন যে, হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ্কে দেখতে পাননি ৪৮১
সিজদায় জমিনে মাথা লাগানো হয় এবং কা’বার উপর লাগানো হয় না কেন? ৪৮২
আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে কিছু চাইবে না ৪৮৩
উসিলা হিসাবে জমিনের মালিক অন্যকে তা দান করতে পারেন কি না ৪৮৪
সাধারণ লোকদের ভয় দেখানোর জন্য এসব হাদিস বলা হয়েছে কি ৪৮৫
আল্লাহ্  এবং তাঁর রাসূলদের তাবেদারি কাকে বলে? ৪৮৬
“হাল জাজাউল এহ্সানে ইল্লাল এহ্সান” এর অর্থ কী? ৪৮৯
কোনো বিষয়ে হারাম প্রমাণের জন্য কোরানিক দলিল প্রয়োজন কি? ৪৯৩
আম্বিয়া আউলিয়াগণের জন্য নজর নেয়াজ ৪৯৪
আম্বিয়া আউলিয়াগণের রূহ্ মোবারক পানাহার করেন ৪৯৮
আমাদের রাসূল (সাঃ)-এর মাজার সৌধে এত সৌন্দর্য বিধান কেন? ৫০০

بسم الله الرحمن الرحيم
প্রশ্ন নং ১
আল্লাহ্র জাত তথা সত্তা এবং সিফাত তথা গুণাবলির মধ্যে পার্থক্য কী? বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও প্রকাশ বলতে কী বুঝায়? কোন উৎস থেকে আল্লাহ্্ সৃষ্টি জগতের প্রকাশ ঘটান? এবং জীবন-মরণ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর : সত্তা ও গুণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং যা সত্তা তাই গুণ। অর্থাৎ, গুণাবলির সমষ্টিই সত্তা। অর্থাৎ, যেমন গুণাবলি ছাড়া সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব তেমনি সত্তা ছাড়া গুণাবলির প্রকাশও সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ কোনো ফলকে তখনই ফল বলা হয়, যদি তাতে তার অবিচ্ছেদ্য গুণাবলি বর্তমান থাকে। মিঠা, তিতা, লবণ, অম্ল, সুগন্ধ, দুর্গন্ধ এবং রংঢং ইত্যকার বহু গুণ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে জাত প্রমাণিত হয়। আর যদি এ সকল গুণাবলি জাত থেকে আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে কোনোকিছুই থাকবে না, বস্তুত যাকে সত্তা বলা যায়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে সত্তার ফল গুণাবলি আর গুণাবলির চূড়ান্ত পরিণাম সত্তা। এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই এবং এরা কেউ কারো বদল বা স্থলাভিষিক্ত নয়। এ প্রসঙ্গে যারা বলেন গুণাবলি সত্তাও নয় আর সত্তা বহির্ভূতও নয়Ñ তাদের কাছে আমার প্রশ্ন তাহলে সত্তা ও গুণের সংজ্ঞা কী? এতো একটি অযথা ও অমূলক কথা। বিশ্ব জগতের সৃষ্টিতো সত্তার চরম উৎকর্ষ এবং গুণাবলির সম্পূর্ণ প্রকাশেরই প্রমাণ। অর্থাৎ আল্লাহ্র পবিত্র অনন্ত সত্তায় বর্তমান সমুদয় সৃষ্টির তাবত গুণ চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্বলিত উৎস থেকে সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়। যেমন একটি আটি থেকে বহু ডালপালা বিশিষ্ট বৃক্ষ জন্মায়। বৃক্ষটিতে এমন কোনো বস্তু থাকে না এর আটি সত্তায় যা নেই। বরং বৃক্ষটির মূল থেকে শাখা-প্রশাখা, ফল ও পত্র-পল্লবাদির জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান উৎসই আটিতে বর্তমান রয়েছে। এতে এটাই প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিতে তার উৎসের মূল সত্তাই প্রকাশ হয়। অর্থাৎ মূল সত্তার প্রকাশিত উৎকর্ষে এবং মাহাত্ম্যের দীপ্তলোকে বিশ্বজগতের প্রকাশ হয়। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে মনোযোগের সাথে ‘জামেনূর’-এর প্রথম খন্ড পাঠ করুন। আল্লাহ্র সত্তা থেকে সকল বিশ্বজগতের সৃষ্টি কথাটির অর্থ এই যে, সৃষ্টির উৎসরূপ আল্লাহ্র যে সত্তা প্রত্যেকটি সৃষ্টি মোতাবেক এক একটি জগৎ। তা থেকেই প্রত্যেকটি বস্তু আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়। উদাহরণস্বরূপ আটি থেকে বৃক্ষ উৎপাদিত হয়। আর আটি হয় ভূমি প্রভৃতি থেকে, ভূমির সৃষ্টি হয় পানি থেকে, পানির সৃষ্টি হয় বাতাস থেকে আর বাতাস আগুন থেকে, আগুন আর্দ্রতা অর্থাৎ পদার্থ চতুষ্টয়ের মূল থেকে, আর্দ্রতা স্রষ্টার আদি সৃষ্টির ইচ্ছা থেকে, ইচ্ছার সৃষ্টি সৃষ্টি-নৈপুণ্যের থেকে, সৃষ্টি-নৈপুণ্যের সৃষ্টি এর চূড়ান্ত ভান্ডার থেকে আর চূড়ান্ত ভান্ডারের সৃষ্টি প্রেম থেকে, প্রেমের সৃষ্টি রূহ্ থেকে এবং রূহের সৃষ্টি আল্লাহ্র মূল সত্তা থেকে। আল্লাহ্র এই চূড়ান্ত সত্তাই সব সৃষ্টির মূল উৎস। তা না হলে কিছুই হত না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন,
والله بكل شئ محيط
“ওয়াল্লাহু বিকুল্লি শাইয়্যিন মুহিত”
অর্থাৎ, “আল্লাহ্ সব বস্তুতে আবিষ্ট।” উল্লেখ্য, সৃষ্টিজগৎ, সৃষ্টি-নৈপুণ্য প্রভৃতি পর্যায় অতিক্রম করে যখন আত্মপ্রকাশ করতে থাকে তখন প্রত্যেকটি পর্যায়েই তাকে সুস্পষ্ট পরিপূর্ণ জগৎ মনে হয় এবং মনে হয় এখানেই সৃষ্টির সমাপ্তি। আবার যখন মৌল প্রাণীস্তর হয়ে পর্যায়ক্রমে নানা স্তরে আল্লাহ্র আদি ইচ্ছা রূপান্তরিত হতে থাকে তখনও প্রত্যেক স্তরে উহাকে সুস্পষ্ট এবং পরিপূর্ণ বিশ্ব মনে হয়। এ পৃথিবী তো বিশ্বসৃষ্টির অন্যতম পর্যায়। এটাকেও বৈশিষ্ট্যাদি এবং প্রাণিকুলের প্রকাশ দেখে সৃষ্টিজগতের চূড়ান্ত পর্যায় বলে ধারণা হয়। বস্তুত বিশ্বের মৌলিক এবং আনুষঙ্গিক সবকিছুর সমন্বয়েই এক একটি সৃষ্টিজগৎ ধরা হয়।
মূলের বিচারে এগুলো সবই এক একটি বিশ্ব এবং এর প্রকাশ জাতি উৎস মৌল উপাদান, সবই এর সাথে সম্পৃক্ত। উদাহরণস্বরূপ যেমন বৃক্ষের উৎস আটি। এ বৃক্ষের পর্যায় যেমন উৎস শাখা-প্রশাখার প্রকাশ্য স্থিতি, বৃদ্ধি এবং পূর্ণতা প্রভৃতি প্রত্যেকটি স্তরকেই এক একটি বিশ্ব বলা হয়। এর প্রকাশ হওয়া গোপন হওয়া রূপান্তর ও স্থিতির কারণ তথা বিবর্তন রহস্যের সৌকর্য আদি অন্ত এবং জাহের বাতেন সব পর্যায়ে উন্মুক্ত এবং সদা সর্বত্র বর্তমান রয়েছে। এটাই স্রষ্টা এবং সৃষ্টির রহস্য। হাকিকত ও আল্লাহ্ত্বের প্রেক্ষিতে এ একটি অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বিবর্তনের ধারায় এক জগৎ থেকে অন্য জগতে রূপান্তরই মৃতাবস্থা। এক্ষেত্রে আপন জগৎ ত্যাগ করতে ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। বস্তুত এ প্রকাশ এবং পরিবর্তনই প্রকৃত জীবন। এখানে সৃষ্টির আপন পূর্ণতা ও ব্যর্থতার প্রকাশ এবং ফলাফলের অবস্থান ও স্থিতি রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বৃক্ষের আটিটি যখন মাটিতে পচনপ্রাপ্ত হয়ে তা থেকে ধীরে ধীরে বৃক্ষ উদ্গত হতে থাকে তখন মনে হয় তা যেন জীবন থেকে মরণের দিকে যেতে যেতে আবার জীবন প্রাপ্তির দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। সুতরাং যখনই মৃত্যুবরণ করা তখনই জীবনপ্রাপ্ত হওয়া। বস্তুত মৃত্যুই প্রকৃত নতুন জীবন। এর অর্থ হল আপন আদি উৎস থেকে উদ্গত হয়ে উৎস পরম্পরায় নিজেকে প্রকাশ করা। বরং সে একই সত্তা আউয়াল আখের তথা আদিঅন্ত ভ্রমণান্তে জাহের তথা প্রকাশিত হয়।

گل شئ اليه ترجعون
“কুল্লু শাইয়্যিন ইলাইহী তুরজাউন।”
অর্থাৎ, “সকল বস্তুই স্ব স্ব উৎসে প্রত্যাগমনশীল।” এ শাশ্বত নীতির ফলে বাতেন অর্থাৎ, গোপন পথে আপন আদি সত্তায় প্রত্যাগত হয়। এভাবে আল্লাহ্র সৃজন ইচ্ছার অধীনে তারই আদি সত্তায় লুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী সত্তার প্রকাশ ঘটে। অতঃপর আপন সৃষ্টির সত্তার আওতায় থেকে আদি অনন্য একক উৎসের আলোকে নিজে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়ে একেবারে আদিতে যেরূপে ছিলেন সে রূপ ধারণ করে আল্লাহ্র সত্তায় উন্নীত ও উপনীত হয়। এ স্তরেই আল্লাহ্ গুণাবলিতে মহানরূপে প্রকাশিত হন। এ পূর্ণতা সহকারেই আল্লাহ্ সর্বত্র সকল সৃষ্টিতে দীপ্তিমান। এভাবে বিশ্বজগৎ একেরই বহুবিধ প্রকাশ এবং একেরই মাহাত্ম্যগত বহুবিধ সৌকর্য ও শ্রেষ্ঠত্বের নমুনা। এতে আল্লাহ্র সত্তা বহুবিধ পরিণতিযুক্ত হলেও তা বীজ ও বৃক্ষের মতো। যেমন বীজের প্রকৃত প্রকাশ বৃক্ষ আবার তেমনি বৃক্ষের প্রকৃত পরিণতি বা প্রকাশও বীজ।
উল্লেখ্য, প্রকাশ ও পরিণতির বিচারে বীজে যেমন বহুত্ব বর্তমান অর্থাৎ একটি মাত্র বীজ থেকে হাজারো বৃক্ষ ও বৃক্ষের উৎস উদগত হয় এবং তা থেকে আবার হাজারো বীজ ও বৃক্ষ উদগমন করে, আল্লাহ্র সত্তাও তেমনি বহুত্ব বিশিষ্ট। এটা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সুন্দরের সুস্পষ্ট প্রকাশ। এভাবে সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির জীবনদানকারী ও পরিবর্ধনকারী হওয়ার ফলেই সকল সৃষ্টির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য।
মৃত্যুবরণ করা অথবা রূপান্তরিত হওয়া প্রকৃতই নতুন জীবনলাভ করা। সুতরাং কোনো সৃষ্টি যতক্ষণ আপন উৎসগত হওয়ার সাধনায় বিজয়ী হতে বা সিদ্ধিলাভ করতে না পারে ততক্ষণ সে আত্মবিস্মৃত এবং আপন উৎস থেকে গাফেল অবস্থায় অচৈতন্য ও অপবিত্রতার শিকার হয়ে থাকে। এ অবস্থায় কারও মৃত্যু হলে সে কাফের ও ফাসেক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এখানে কাফের ও ফাসেক অর্থ ব্যর্থ বা উৎসচ্যুত। তার আরও সংস্কার ও সংশোধন বা শুদ্ধায়ন প্রয়োজন। এজন্য তাকে সৃষ্টিরূপে জন্ম-জন্মান্তরে আরও থাকতে হবে।
জমিন থেকে যেমন মিঠা, তিতা বস্তু জন্মে তেমনি একই মৌল উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েও কেউ জ্যোতির্ময় স্রষ্টার কৃপায় উন্নত হয়ে তথাগত হয়, আবার কেউ জ্যোতি বঞ্চিত ও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে তেলাপোকার মতো অপবিত্র ও দূষিত হয়ে যায়। এভাবে একই সৃষ্টিজগৎ বিভিন্ন সৃষ্টি বৈশিষ্ট্যে প্রকাশিত হয়। তা সত্ত্বেও ভূমির মতোই বহু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আল্লাহ্র সত্তা ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোনো উৎস বা উপাদান নেই। তাছাড়া আর কোনো সৃষ্টি-নৈপুণ্য বা সৃষ্টিকল্প নেই যা থেকে সমগ্র বিশ্ব অস্তি¡ত্ব লাভ করেছে, এবং আসবে ও যাবে। এ সৃষ্টিকল্প কেন্দ্রেই সব কিছুর নিয়তি নির্ধারিত ও এ সংক্রান্ত জ্ঞান প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, মৌলিকত্বের বিচারে বা হাকিকতে ভালোমন্দ বলে কিছু নেই। ভূমি থেকে বৃক্ষাদি এবং প্রাণিকুলের সৃষ্টি হয়। এগুলো সম্পর্কে ভালোমন্দের যে ধারণা তার কারণ এগুলোর গুণাবলির পার্থক্য এবং যুগের বিবর্তনে সমাজে রুচির পরিবর্তন। ভূমি থেকে যেসব বস্তু পয়দা হয় তা সবই জীবন, মৃত্যু এবং অন্য বহু
গুণ যুক্ত হয়েই পয়দা হয় এবং মৃত্যুর পরও ভূমির পরশে তা ঐসব গুণাবলি পুনঃপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু আপনার মধ্যে ভূমির জীবন বৈশিষ্ট্য লাভ করে। ভূমি সকল ভূ-বাসীর উৎস। এজন্য ভূমি ভূ-বাসীর কাছে মাতৃমর্যাদায় স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। বস্তুত সৃষ্টির চাদর ভূদেহে লেপটে রয়েছে। তা থেকেই সময়মতো তা প্রকাশিত হয়।

প্রশ্ন নং ২
আম্বিয়া ও আউলিয়াগণের রূহ্ মোবারক নশ্বর পৃথিবীতে প্রকাশ্য স্থানে আপন অর্জিত মর্যাদার বলে প্রকাশিত হতে পারেন কি না? এবং একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে আপন ব্যক্তি সত্তায় গুণাগুণ সহকারে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন কি না?

উত্তর : হ্যাঁ পারেন। রূহ্ অতি সূক্ষ্ম। সুতরাং তা একই সময়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে আপন অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারেন। রূহের এ ক্ষমতার বদৌলতেই সৃষ্টির ব্যাপক প্রসারে স্রষ্টার যে ইচ্ছা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হয়। সদা সর্বত্র বিশ্ব জুড়ে এ প্রক্রিয়াই কার্যকর হচ্ছে। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এবং বেতার পদ্ধতি এক মুহূর্তের মধ্যে গোটা পৃথিবীকে যেভাবে আপন আওতাভুক্ত করে, সৃষ্টি প্রক্রিয়াও সেভাবে মুহূর্তের মধ্যে সর্বত্র কার্যকর হয়। এটা অতি আশ্চর্য ও সূক্ষ্ম জ্ঞান। এ বিশেষ জ্ঞানের সাহায্যে ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলো গরুর খাদ্য ও ঘাস থেকে দুধ উৎপাদন করে এবং কৃত্রিম উপায়ে মুরগির ডিম থেকে এ বাচ্চা জন্মায়। তা মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মানুষ প্রযুক্তির সাহায্যে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়। আর আল্লাহ্র তরফ থেকে তা হতে এক মাস সময় লাগে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
অবিলম্বে আল্লাহ্র তরফ থেকে এসব বাচ্চার হাত-পা সৃষ্টি হয়। এর ব্যাপক বাণিজ্য চলছে। এতে বোঝা যায় যে, এ প্রযুক্তি বা জ্ঞানও কেবল আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত নয়। বরং অন্যরাও এর অধিকারী হতে পারে। বড়ই আশ্চর্য যে, বাপের মধ্যে সন্তান জন্মানোর ক্ষমতা রয়েছে তাও লোকে জানে না। বাপের মধ্যে সে ক্ষমতা না থাকলে সন্তানের জন্ম হয় না। কিন্তু তাও অনেকেরই বুঝে আসে না।
অনুরূপ প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে সৃষ্টি বা জন্ম ক্ষমতা রয়েছে। এজন্যই জন্ম প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কেউ যদি সে বিদ্যা বা জ্ঞান আয়ত্ত করতে পারে তা অতি উত্তম কাজ। তাতে মানুষ কাফের হবে কেন? বরং এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত এবং প্রার্থনা করা উচিত হে আল্লাহ্ আমাদেরকে অনুরূপ উন্নত জ্ঞান দান করো যাতে আমরাও জানতে পারি যে, মানুষও সৃষ্টি করতে পারে।
অজ্ঞরা জানে না যে, সৃষ্টি বা প্রকাশিত হওয়া এ এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া। বোকা হয়ে জন্মগ্রহণকারী এটাও জানে না যে সে বোকা। উল্লেখ্য, জ্ঞানীগণ যে জ্ঞানভান্ডার রেখে গেছেন, তা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত নতুন নতুন জ্ঞান প্রকাশ হতে থাকবে। এরই নাম খুলক বা প্রকৃতি। আসা যাওয়া এবং দৃশ্যমান হওয়া সব সৃষ্টির স্বাভাবিক ও সাধারণ কর্ম। এটা সকলের কাছে পরিষ্কার। আর তাৎক্ষণিকভাবে হাজির হওয়া রূহের প্রকৃতি এবং ক্ষমতাধীন এটাও সকলের জানা।
হয়ত এটাও জানা আছে যে, সূক্ষ্ম দেহ রূহের তাবেদার কিন্তু রূহ্ এবং আল্লাহ্র প্রকাশ বা দৃশ্যমান হওয়ার কথা অনেকেই জানে না। এ বিষয়ে তারা বোকা। এজন্য তারা রুহের প্রকাশিত বা দৃশ্যমান হওয়ার ক্ষমতা অস্বীকার করে। এটা কুফরী এবং অজ্ঞ হঠকারিতা। অজ্ঞতা দূর হলেই তারা তা বুঝতে পারবে এবং তাদের প্রকৃত জ্ঞান লাভ হবে। সে যা হোক রূহ্ আদি সৃষ্টিকল্পের মূল রহস্যভান্ডার বিধায় তা উক্ত উদাহরণের চেয়ে হাজারো গুণ সূক্ষ্ম। তা আল্লাহ্ ভালো জানেন। এ বিষয়ে যার জ্ঞান নেই সেতো তা অস্বীকার করবেই। তবে প্রসারিত অন্তরের অধিকারী স্রষ্টার সৃষ্টি-নৈপুণ্যের সৌকর্য চমৎকার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন, “স্বয়ং তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) স্ব-শক্তিতে শামীল মাহফিলে মিলাদে।” তাদের কাছে নবী-অলীদের রূহের তাৎক্ষণিক প্রকাশ দৃশ্যমান হওয়া অজানা নয়। আল কোরানের বাণী এ বুজুর্গি ও সত্যতা প্রকাশের সম্ভাব্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ্ বলেন, حتى يلج الجمل فى سم الخياط ط
“হাত্তা ইয়ালিজাল জামালু ফি সামমিল খিয়াত।”(সূরা আরাফ : রুকু ৪)
অর্থাৎ, “এমনকি সুইয়ের গর্ত দিয়ে উট বহর গমন করতে পারে।” সুইয়ের গর্তে প্রবেশকারী উট বহরের তুলনায় রূহ্ অতি সূক্ষ্ম। তাপযন্ত্রে সূর্য তাপের প্রকাশ কি আশ্চর্য নয়? আগুনও তো সদা সর্বত্র স্বীয় নিরূপিত প্রকাশ প্রক্রিয়ায় প্রজ্বলিত রয়েছে। সারা বিশ্বে আগুনের এ অস্তিত্বের স্বীকৃতি কি আল্লাহ্র সাথে র্শিক হবে? উল্লেখ্য, চার পদার্থের মূল যা সমস্ত বস্তুর উৎস উপাদান রূহ্ তা থেকে অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
বস্তুত রূহ্ আপন সূক্ষ্মতায় বিশ্ব পরিমন্ডলে আবিষ্ট হয়ে নিজ উৎসমূলে সম্পৃক্ত রয়েছে এবং তা প্রতি মুহূর্তে বিশ্বজগতে জ্যোতি ছড়াচ্ছে। বস্তুত উহার প্রকাশ থেকেই সবকিছু প্রকাশিত হচ্ছে। উহার সৌজন্যেই রূহ্ সদা সজীব। মূলে সম্পৃক্ত না থাকলে রূহ্ মরে যাবে। মূলত এ সূক্ষ্ম সত্তাই সকল বস্তুর উৎস। এটা আল্লাহ্ প্রদত্ত। সৃষ্টি জগতের বিস্তারিত প্রসার হচ্ছে। এ ক্ষমতা আল্লাহ্ কেবল নিজের মধ্যে সীমিত করে রাখেননি। বীজের মধ্যে বৃক্ষাদি উদ্গমনের যে ক্ষমতা রয়েছে এবং পিতার ভেতর প্রজননের যে শক্তি মজুদ আছে তাও তো আল্লাহ্ কেবল নিজের মধ্যেই নিজের জন্য নির্ধারিত ও সীমিত করে রাখেননি। এটাতো বান্দার জন্য বরাদ্দকৃত আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতা। আল্লাহ্ সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন কোনো প্রমাণতো নেই।
সে যাহোক, আলোচ্য জ্ঞানে বঞ্চিত ব্যক্তির অন্তত এটা জ্ঞান করা উচিত যে, আল্লাহ্ তাঁর যা ইচ্ছা এক মুহূর্তে যেমন প্রকাশ করতে পারেন তেমনি পারেন তিনি যে কোনো বস্তু যখন ইচ্ছা ধ্বংস করে দিতে এবং পারেন তিনি কঠিন বস্তুকে নরম আর নরম বস্তুকে কঠিন করে দিতে। আল্লাহ্ যদি সুইয়ের গর্তে পাহাড় প্রবেশ করিয়ে দেন তাতেই বা আশ্চর্যের কি আছে? রূহ্ কি মুহূর্তে সারা বিশ্বে ভ্রমণ করে না? সুতরাং রূহের ভ্রমণ করা যখন প্রমাণিত ও স্বীকৃত তখন এর প্রকাশ বা দৃশ্যমান হওয়া অপ্রমাণিত বা অস্বীকার্য হবে কেন? বস্তুত কোনো ব্যক্তি যখন কোনো স্থানে আগমন করে, তখন সে তার চেহারা-চরিত, জ্ঞান-গরিমা ও পূর্ণতার সব বৈশিষ্ট্যসহই দৃশ্যমান হয়। অন্যথায় তার আগমন বা উপস্থিতি অর্থহীন হয়ে যায়। বস্তুত এমনটা হতে পারে না। চির মূর্খ, অজ্ঞতার অন্ধকারে যে কিছু দেখে না সে কুফরির বোঝাকে জ্ঞান ধারণা করে চির কাফেরই রয়ে যায়। সুতরাং নূরাণী রূহ্ সম্পর্কে তাঁর কোনো জ্ঞান হয় না। আর অন্ধেরতো বাতির দরকারই নেই।
মিলাদ মাহ্ফিলে আম্বিয়াদের রূহ্ কি হাজির হয় না? মিলাদ মাহ্ফিলে আম্বিয়া এবং ফেরেশতাদের এমনকি বিবি আছিয়া, হাজেরা এবং মরিয়ম (আঃ) এর উপস্থিতি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাজির হওয়া কি নিষেধ আছে? কা’বা একটি পাথর, নামাজে তাকে সামনে অতি নিকটে মনে করাও বৈধ এবং পুণ্যের কাজ। এমতাবস্থায় সূক্ষ্ম, সুস্পষ্ট নূরী রূহের অধিকারী যার প্রকাশ স্বয়ং আল্লাহ্র প্রকাশেরই প্রতিচ্ছায়া এবং যে মানুষ আল্লাহ্র লুপ্ত ও গুপ্ত রহস্যতাকে যথেচ্ছ হাজির ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করা কি নিষেধ? স্বয়ং হাদিস কুদসী সাক্ষ্য দেয় যেÑ
كنت سمعه الذى يسمع به و بصره الذى يبصرو به ويده التى يبطش بها و رجله التى يمشى بها والسانه الذى يتكلم به *
“কুনতু শামীয়াহুল্লাজি ইয়াসমাউ বিহি ওয়া বাছারুল্লাজি ইয়াবছিরু বিহি ওয়া ইয়াদাহুল্লাতি ইয়াব তিশু বিহা ওয়া রিজালাহুল্লাতি ইয়ামশি বিহা ওয়া লিসানু হুল্লাজি ইয়া তাকাল্লামু বিহি।”
অর্থাৎ “আমি আমার প্রেমিক বান্দার কর্ণ, চক্ষু, হাত-পা এবং মুখ হয়ে যাই যা দ্বারা তিনি শোনেন, দেখেন, ধরেন, হাঁটেন ও কথা বলেন। আল্লাহ্ যখন কারও গোপন অর্থাৎ, কেউ যখন আল্লাহ্র বিচরণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন তখন একই মুহূর্তে তিনি উভয় জগতে ভ্রমণ করেন।
তাহলে তিনি মিলাদ মাহফিলে হাজির হতে পারবেন না কেন? রূহের প্রকাশ ক্ষমতায় অস্বীকৃতি শয়তানের অজ্ঞতা তুল্য। আদম (আঃ) এর মধ্যে এই গোপন রহস্যের উদ্ঘাটনের জন্যই আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের হুকুম করা হয়। স্থূল বুদ্ধি মেজাজি শয়তান তা বুঝতে না পারার কারণে সিজদা দিতে অস্বীকার করে চির কাফেরে পরিণত হয়েছে। হাজারও খ্যাত-অখ্যাত ব্যক্তি নবী-অলীগণকে স্বপ্নে, কাশ্ফে এবং ধ্যানে প্রত্যক্ষ করে থাকে তাতে র্শিক হয় না।
এমতাবস্থায় কোন দোষে নবী-অলীগণকে সামনে হাজির মনে করা র্শিক হবে? এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোরান ও হাদিসের অতি প্রাকৃতিক তথা রহস্যপূর্ণ বক্তব্যাদি যা নিজের জ্ঞান বুদ্ধি মোতাবেক দার্শনিক প্রচলিত নীতিগ্রাহ্য হয় না তাকে চিরন্তন মিথ্যা মনে করা। আল্লাহ্ বলেন-
بل كذبوا مالم يحيطوا بعلمه ولما ياتيهم تاويله – واذا لم يعتدوا به فيقلون هذا افك قديم *
“বাল কাজজাবু মা লাম ইউহিতু বি ইলমিহি ওয়া লাম্মা ইয়াতিহীম তাবিলুহু ওয়া ইজা লাম ইয়াহ্তাদু বিহি ফায়্যাকুলু না হাজা ইফকুন ক্বাদিম।”
অর্থাৎ, “তারা মিথ্যারোপ করে যখন কোনো কিছু তাদের জ্ঞানের পরিধিতে না আসে। এবং যখন উহার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এবং তাতেও তাদের ভ্রষ্টতা দূর না হয় তখন তারা বলে এটা পুরনো মিথ্যা কথা।”
প্রশ্ন নং ৩
জায়েদ বলে যে, আল্লাহ্ আপন সত্তা থেকে কিছু সৃষ্টি করেন না, এমনিতেই সৃষ্টি করেন। এর জবাব কী?
উত্তর : ‘এমনিতেই’ শব্দের কোনোই অর্থ নেই এবং এটা নিরেট অজ্ঞতা প্রসূত। ‘এমনিতেই’ শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রশ্নকারী একজন চরম মূর্খ। এ অর্থহীন শব্দটি ব্যাখ্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হয় তাহলে সে ব্যাখ্যা করুক।
আল্লাহ্ বলেন,
ولقد صرفنا فى هذا القران من كل مثل وكان الانسان اكثر شئ جدلا *
“ওয়া লাকাদ সোয়ারাফনা ফি হাজাল কুরআনি মিন কুল্লি মাসালিন ওয়াকানাল ইনসানু আকসারা শাইয়্যিন জাদালা।”
মোট কথা, আল কোরানে সব বিষয়ের জ্ঞান বিজ্ঞান বর্ণিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ লোক তা না জেনে ঝগড়া করে।

প্রশ্ন নং ৪
জায়েদ বলে আল্লাহ্র জ্ঞানের মধ্যে বান্দার কোনো দখল নেই?

উত্তর : বক্তব্যটি সুস্পষ্ট ভুল এবং মিথ্যা। কারণ বান্দার নিজে থেকে কোনো জ্ঞান নেই। বরং আল্লাহ্ থেকেই সমস্ত বস্তু প্রমাণিত। সবকিছুর চূড়ান্ত ভান্ডার হিসেবে তা থেকেই সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রকাশ। এ ভান্ডার থেকেই জ্ঞান গরিমা, ক্রোধ, দয়া এবং কার্যাদি ও কথাবার্তা অস্তিত্ব পায়। অর্থাৎ, আল্লাহ্ যাকে যে গুণাবলি দান করেন সে কেবল সেটুকুরই অধিকারী হয়।
আল্লাহ্ যাকে যে জ্ঞান দান করেন, তা সে চূড়ান্ত ভান্ডার থেকেই আসে এবং এটাকেই “ইলমে গায়েব” বা গুপ্ত জ্ঞান বলা হয়। এখানে গায়েব অর্থ অজ্ঞাত এবং অজানা এবং তা থেকে আল্লাহ্ যাকে যে বিষয়ে যতটুকু জ্ঞান দান করেন তা-ই বান্দার জ্ঞান। অতঃপর বান্দার এ জ্ঞানকে উৎসের প্রেক্ষিতে অপ্রকৃত, প্রকৃত এবং রূপক ও মৌলিক বলা হয়। বস্তুত ‘ইলমে গায়েব’ বলে কিছু নেই। কারণ ‘ইল্ম’ অর্থ জানা। আর যা জ্ঞাত বা জানা তা গায়েব হতে পারে না।

প্রশ্ন নং ৫
জায়েদ বলে সমগ্র সৃষ্টিতে আল্লাহ্র জ্ঞান ব্যাপ্ত, জাত বা সত্তা নয়। আর আমরের দাবি হল আল্লাহ্র জাত বা সত্তাও মজুদ তথা বর্তমান। তাহলে কার কথা সঠিক?
উত্তর : আমরের দাবি সঠিক। কারণ সত্তা একটি মৌলিক উপাদান। যার মধ্যে জ্ঞান ও গুণাবলি বর্তমান। অর্থাৎ, সত্তার পরিণতি গুণাবলি, আর গুণাবলির পরিণাম সত্তা। অর্থাৎ, সত্তা ও গুণাবলির অস্তিত্ব পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব সত্তা ছাড়া জ্ঞানের প্রকাশ হতে পারে না। বস্তুত বর্তমান সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার সত্তাসহ গুণাবলি মজুদ রয়েছে। এ বিষয়ে যারা জানেন তাদের নিকট এটা জ্ঞাত। এমনকি একটু অণু বা বিন্দুও তাঁর সত্তার বাইরে নয়। কারণ, যেহেতু আল্লাহ্র সত্তাই সব সৃষ্টির মৌল উৎস, সেহেতু তা ব্যতীত মর্যাদা অথবা জ্ঞান প্রভৃতি কোনো গুণই প্রকাশ লাভ করতেই পারে না। বস্তুত যেহেতু সবকিছুর মূল উৎস আল্লাহ্র সত্তা সেহেতু সবকিছুতেই সর্বাগ্রে সে সত্তার অস্তিত্ব অনিবার্য। এবং তা থেকে প্রকাশিত হয় বিধায় তাঁর অন্যান্য গুণাবলি সে সাথে প্রকাশ লাভ করা অবশ্যম্ভাবী। বীজ ছাড়া বৃক্ষের উদ্গমন যেমন সম্ভব নয় তেমনি জ্ঞান ও তার উৎস ও মৌল উপাদান ছাড়া প্রকাশ লাভ করতে পারে না। জ্ঞানকে যে রূপক ও অযথার্থ বলা হয় তা তার কার্যকারিতার প্রেক্ষিতে। জ্ঞানের উৎস আর এর প্রকাশ মাধ্যমের পার্থক্য বুঝতে হবে। তা না হলে সৃষ্টির মূলে স্রষ্টার ইচ্ছা কার্যকর এ তত্ত্ব অক্ষুণ্ন থাকে না। এ কারণেই বলা হয়েছেÑ
والله بكل شئ محيط *
“ওয়াল্লাহু বি কুল্লি শাইয়্যিম মুহিত।”
অর্থাৎ, “আল্লাহ্ সবকিছুতে আবিষ্ট।” এতে কেবল জ্ঞান গুণই নয়, সত্তাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রশ্ন নং ৬
তাসদিক কী? ঈমান কাকে বলে? ইয়াকিনে যন্নি আর তাক্লিদি ঈমান কী?

উত্তর : ‘তাসদিক’ অর্থ অন্তরে বিশ্বাস করা। এটা অন্তরের ক্রিয়াদির অন্যতম। মুখ অন্যের জন্য তা প্রকাশ করে। নিজের বা আল্লাহ্র জন্য এ প্রকাশ প্রয়োজন নেই। সুতরাং অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থিতি লাভকেই ঈমান বলা হয়। অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন না হওয়া বা না থাকাই কুফর এবং বে-ঈমানি। অন্তরের কার্যাদির দ্বারাই অন্তরে ঈমান পয়দা হয়। এটি একটি অবস্থা। সুতরাং যে এ পূর্ণ অবস্থার অধিকারী তার ঈমানও পরিপূর্ণ। এ পূর্ণ ঈমানের অপর নাম ঈমানে কাসেফী। তা যোগ্য অন্তরে প্রবেশ করে প্রকৃত ঈমানে পরিণত হয়।
ঈমানে যন্নি তা নয়। এক্ষেত্রে অনুমানের পর্দায় এক প্রকার ছায়া পতিত হয় এবং মনের বা ধারণার পরিবর্তনের সাথে সাথে তা চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ জনৈক ব্যক্তি খবর দিল যে, আমি একটি বিরাট বাঘ দেখেছি এবং বার বার বলে মানুষকে তা ভালোভাবে বিশ্বাসও করিয়েছে। আবার কয়েক ঘণ্টা পর জানাল যে, আসলে আমি বাঘ টাঘ কিছুই দেখিনি।
শ্রোতারা তাও বিশ্বাস করে এবং সংবাদদাতার প্রতি তারা স¤পূর্ণ বিশ্বাস হারায়। অনুরূপভাবে যারা অন্যের কথায় বিশ্বাস করে ঈমান আনে তাদের ঈমানও এরূপ অসার এবং ভিত্তিহীন নড়বড়ে।
এভাবে কেউ যদি অন্যের থেকে শুনে বিশ্বাস করে যে এটা হারাম, এ কাজ নিষিদ্ধ, অমুক ব্যক্তি কাফের, অমুক ব্যক্তি মুশরিক, এ কাজে বেহেস্ত পাওয়া যাবে, আর অমুক কাজে খোদা পাওয়া যাবে ইত্যাদি। অতঃপর সে যখন এর বিপরীত কথাবার্তা শুনবে এবং তা তার কাছে ভালো লাগবে তখন যা তার পূর্বে অপছন্দ ছিল সেসব ছেড়ে দিয়ে ধরুন জুম্মা এবং ঈদের নামাজ পড়তে লেগে গেল। তারপর আবার অন্যান্য আলেমদের নিকট অন্য ধরনের কথাবার্তা শুনে ঢোল ও শারেঙ্গী বাজাতে আরম্ভ করল এবং নামাজ রোজা ছেড়ে দিল। কারও কারও ব্রহ্মধর্ম এবং আর্যধর্ম গ্রহণ করার মতো অবস্থাও হয়। এভাবে যন্নি ঈমানদারগণ যে ঈমানের জোরে নিজেদেরকে দ্বীনদার মনে করে, সে ঈমানই তাদেরকে বিপথগামী করে। বস্তুত যে ঈমান ঈমানই নয় তা নষ্ট হবার প্রশ্ন অবান্তর। যার ঈমানই নেই তার ঈমান নষ্ট হবে কোত্থেকে! এ শ্রেণীর ঈমানদারগণ হেদায়েতের নামে হেদায়েতকেই বরবাদ করছে।
মোটকথা, যা ঈমানই নয় তাকে ঈমান আখ্যা দিয়ে এবং এক ফুৎকারে তা উড়িয়ে দেওয়ার পথও প্রশস্ত করে দিয়ে এরা মানুষকে কাফের মুশরিক বানাবার উত্তম হেদায়েতকারী হিসেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। অর্থাৎ, প্রথমে যাদের মুসলমান বানায় পরে তাদেরই আবার কাফের-মুশরিক বানায়। নিজেরা তাদের কাফের মুশরিফ বলে এবং কুফরির ফতোয়া দেয়। আফসোস! কে জানে এদের ধর্ম কী? যা তুড়িতে আসে আরেক তুড়িতে চলে যায়। গাছের পরিচয় তার ফলে, তাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এ উপমাটি যথেষ্ট। নামে ইসলাম আর কাজে বিপরীত। এটাকে কি ঈমান বা ধর্ম বলা যায়? আল্লাহ্ বলেন,
ليس البر ان تولوا وجوهكم قبل المشرق والمغرب ولكن البر من امن بالله *
“লাইসাল বিররা আন তুয়াল্লু উজুহাকুম ক্বিবালাল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি ওলা কিন্নাল বিররা মান আমানা বিল্লাহি।” অর্থাৎ, পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফেরানোতে তোমাদের কোনো কল্যাণ নেই। বরং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যে ঈমান এনেছে তাতেই রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং এ পথে ঈমানে কাসেফী অর্জন করতে হবে। এ ঈমান অন্তরে প্রকাশিত হয়ে এবং উপলব্ধির বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে জ্ঞাত বস্তুতে পরিণত হয়। এটা আর যায় না। আর যাবেই বা কোথায়! এযে আপন আত্মা ও বোধ থেকে এসেছে। যেমন কেউ যদি কোনো বস্তুর স্বাদ নিজে গ্রহণ করে থাকে আর সে সম্পর্কে কেউ যদি বিপরীত কথা বলে সে তাকে মিথ্যুক মনে করবে। নিজের অভিজ্ঞতার বিপরীতে হাজার ব্যক্তির কথাও সে গ্রহণ করবে না। বরং সে আপন অভিজ্ঞতালদব্ধ যোগ্যতার বলে তাদের কথা বাতিল করে দিবে। কি উত্তম এই অন্তরবান অলী-আল্লাহ্ ও আরেফগণ, অনন্য ত্যাগী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তারা নিজেদের জীবনের ব্যাপারেও বেপরোয়া। যন্নি ঈমানের অধিকারী জাহেরপন্থী এবং তাক্লিদি ঈমানদারদের কোনো কথা তারা শোনেন না। বরং অন্তরস্থিত ঈমানের অধিকারী আপনপ্রাপ্ত পূর্ণ যোগ্যতার আলোকে নিরূপিত সত্যকেই যথেষ্ট মনে করেন। এর দ্বারাই তাঁরা ঠিক-বেঠিক আলো অন্ধকার এবং দ্বীনধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু ঐ সকল যোগ্যতার জন্য যে জ্ঞান প্রয়োজন তাই প্রকৃত এবং পূর্ণ জ্ঞান। এটাকে ‘ইলমে আহওয়াল’ তথা অবস্থার জ্ঞান বলা হয়। ইলমে আহওয়াল তথা কোরানের জ্ঞানে যিনি জ্ঞানী তাঁকে আলেমে রাব্বানী এবং ছাহেবে হাক্কানী বলা যায়। অর্থাৎ, প্রভুজ্ঞ ও সত্যের অধিকারী বলা যায়। এজন্য আমাদের নেতা রসূল (সাঃ) বলেন,
“উম্মতদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম, একটি ‘আল কোরান’ এবং দ্বিতীয়টি ‘আল আবা’ অর্থাৎ, যারা তা বোঝেন।”
যারা কোরান বোঝেন তাদের আহলে কোরান বলা হয়। আহলে কোরান না হলে কোরান বোঝা সম্ভব নয়। কারণ অন্তরের ক্রিয়াদি দ্বারা অর্জিত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ওপর কোরানের সারমর্ম উদ্ধার নির্ভর করে। তাইতো কোরানে দ্বীনদারকে অগ্রিম সংবাদ দেওয়া হয় যেÑ
ان فى ذلك لذكرى لمن كان له قلب *
“ইন্না ফি জ্বালিকা লাজিকরা লিমান কানা লাহু কালবুন।”
অর্থাৎ, “অবশ্যই কোরানে জিকির রয়েছে অন্তরবান ব্যক্তিদের জন্য।” ঈমান এবং বিশ্বাসও অন্তরে প্রকাশ পায়। এজন্যই আল্লাহ্ ঈমানকে অন্তরের ভিতরে সমাসীন করেন। আল্লাহ্ বলেন,
قالت الاعراب امناط قل لم تؤمنوا ولكن قولوا اسلمنا ولما يدخل الايمان فى قلوا بكم ط –
“কালাতিল আরাবু আমান্না কুল লাম তুমিনু ওয়ালাকিন কুলু আসলামনা ওয়ালাম্না ইয়াদ খুলিল ঈমানু ফি কুলুবিকুম।” (সূরা হুজুরাত-১৪)
অর্থাৎ, “আরবরা বলে আমরা ঈমান এনেছি। হে মুহাম্মদ আপনি তাদের বলুন যে, তোমরা ঈমান আননি বরং তোমরা বল যে আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। কারণ তোমাদের অন্তরে এখনও ঈমান প্রবেশ করেনি।” তাই তারা মুসলমান হলেও মুমিন নয়।

প্রশ্ন নং ৭

আদম (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) এর সিজদা ফরজ ছিল কি না? একই সিজদায় ইবাদত সম্মান প্রদর্শন এবং অভিবাদন বৈধ কিনা? তাতে সালতানাত আত্মীয়তা গোপন রহস্য এবং মিলন ইত্যাদি উদ্দেশ থাকে কি না?
উত্তর : আদম (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) উভয়ের সিজদাই ফরজ ছিল। এর উদ্দেশ অসীম আদব প্রদর্শন। তবে সাধারণত বুজুুর্গের বেলায় এর উদ্দেশ সম্মান প্রদর্শন, সালতানাত ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ অভিবাদন, ইবাদত অবস্থায় হোক অথবা এর বাইরে হোক। যেমন নামাজে জমিন এবং কা’বাকে সিজদা করা সম্মানসূচক আর আল্লাহ্কে সিজদা করা ইবাদত। বস্তুত সিজদা দেওয়া হয়েছে নামাজের জন্য, যাতে সম্পাদিত হয়েছে আল্লাহ্র জন্য নির্দিষ্ট ইবাদত এবং সাথে সাথে সম্পাদিত হয়েছে জমিন ও কা’বার প্রতি আদব বা সম্মান প্রদর্শন। তবে এ উভয় উদ্দেশই ফরজের অন্তর্ভুক্ত। কারণ জমিনের উপর কা’বার দিকে আল্লাহ্র উদ্দেশে সিজদা করা হয়েছে। অর্থাৎ, এ একই সিজদায় দুটি ফরজÑ একটি ইবাদত যা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র নিকট হাজিরি আর অপরটি আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন। তবে তা ইবাদতের রূপ ও ভঙ্গিতে সম্পাদিত হলেও উদ্দেশ ও মর্যাদায় তা ইবাদত নয়।
সুতরাং খাস ইবাদতেই যখন অন্যের জন্য সম্মানসূচক সিজদা কেবল প্রমাণিতই নয় বরং ফরজ এবং ওয়াজিব, তখন ইবাদতের বাইরে অন্যের সম্মানার্থে সিজদা নিষিদ্ধ হয় কিভাবে?
অতএব নামাজের সিজদায় আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেহেতু ফরজ এবং নামাজের তাশাহুদে নবী-অলী এবং বুজুর্গদের প্রতি সালাম ও দরূদ ওয়াজিব এবং সুন্নত। তবে প্রকৃত ইবাদতের জন্য তাজিম ও সম্মানই প্রকৃত এবং মূল ভিত্তি। কারণ নামাজের সিজদার উদ্দেশই তাই। তা না হলে একই সিজদায় দুটি ফরজ হয় কী করে?
তবে সিজদা কী? যিনি সম্মান পাওয়ার যোগ্য তার ক্ষেত্রে এটা যথার্থ সিজদা। আর সান্নিধ্যের যোগ্য এক্ষেত্রে এর অর্থ ভিন্ন। অর্থাৎ সান্নিধ্য লাভ ও মিলনের উদ্দেশে সম্মান প্রদর্শন। এর অর্থ হল, যে ব্যক্তি সামনাসামনি হওয়ার কারণে কাউকে সিজদা করে সে সান্নিধ্য অবস্থার দিকে অগ্রসরমান আর যে মিলন অবস্থার অনুবর্তী হয়ে সিজদা করে সে পরম সত্তার মিলন পথের যাত্রী। বস্তুত ইবাদত এবং তাজিম বা সম্মান একটি পূর্ণ কর্মেরই বিভিন্ন দিক। আল্লাহ্ বলেন,
ومن يعظم شعائر الله فانها من تقوى القلوب *
“ওয়ামাই ইউয়াজজিম শাইয়ারিল্লাহি ফা-ইন্নাহা মিন তাকওয়াল কুলুব।”
“কেউ যদি আল্লাহ্র নিদর্শনাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাহলে তা তাদের অন্তরের ধর্মানুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ।” (সূরা হজ্জ-৩২)
এতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও আল্লাহ্র ভাষায় অন্তরের ধর্মানুরাগ প্রমাণ হয়। যা আল্লাহ্র শান-শওকতের উচ্চ সম্মানের জন্য। যেমন কোরান কা’বা নবি, অলী, এবং বুজুর্গদের তাজিম ও সম্মান যার মর্তবা প্রমাণিত তা প্রকৃত ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এটা আল্লাহ্ সম্পৃক্ত কর্মের বৈশিষ্ট্য।”
যেমন কোরানকে সম্মান করলে আল্লাহ্ খুশি হন, কারণ এটা আল্লাহ্র বাণী। অনুরূপ পয়গম্বর অথবা কোনো পুণ্যবানকে সম্মান করলেও আল্লাহ্ খুশি হবেন। আর ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত কাজ সম্পাদনেও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ হয়। এটা ইবাদত। বস্তুত ইবাদত ও সম্মান প্রদর্শন দুটোই একইরূপে সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ রুকু, সিজদা, দাঁড়ানো এবং বসা ও অভিবাদন বা মস্তক অবনত করা আর চোখের ইশারা, এসব ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র ইবাদত আর অন্যদের ক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শন। এগুলো বাহ্যত একইরূপে সম্পাদিত হলেও অর্থ ও উদ্দেশ আলাদা। তা না হলে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে মাথা নত করে ইবাদত করাতো সর্বদাই অবৈধ।
সুতরাং ইবাদতের মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে অনিবার্যরূপে ইবাদত সম্পন্ন হচ্ছে, সেহেতু এগুলোর বাণী ও সাধারণ উদ্দেশাদি বুঝে এর বিস্তারিত আলোচনা করতে হলে নির্ভুল জ্ঞানের প্রয়োজন এজন্যই আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,كونومع الصديقين ‘কুনু মায়াছ্সোয়াদেকীন’ (সূরা তওবা-১১৮)। “সৎদের সঙ্গী হও। এটা সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ্র আদেশ। এটা ফরজ। এ ফরজ সম্পাদনে সম্মান প্রদর্শন, ভক্তি প্রকাশ এবং অভিবাদন জরুরি। অর্থাৎ সৎজনদের উক্ত কার্যাদির মাধ্যমে রাজি ও খুশি করে তাদের একাত্ম হয়ে সত্তাগত হতে হবে। এটাই এর উদ্দেশ, এ কাজে চরম ও পরম প্রেমের প্রাধান্য প্রয়োজন। এর উদ্দেশ হবে পরমসত্তার ফায়েজ বা প্রেরণায় আপ্লুত হওয়া। এজন্য আল্লাহ্র প্রকাশ এবং পরমসত্তার বাস্তবরূপ, সৎজনদের অনন্ত অবিনশ্বর সত্তায় নিজেকে ফানা বা বিলীন করতে হবে।
উল্লেখ্য, সাদেক তথা সৎজনদের সত্তা আল্লাহ্র সত্তারই প্রকাশ। এ জন্য আল্লাহ্ সাদেক তথা সৎজনদের সঙ্গলাভ করার আদেশ করেন। তাহলে সঙ্গলাভের ফলে নিজেদের মধ্যে তাদের সত্তা ও গুণাবলির জ্যোতির্ময়তা বিকশিত হবে। যদি তাই না হবে, তাহলে আল্লাহ্ তাঁর আপন সত্তার দিকে সরাসরি আহ্বান জানালেন না কেন? প্রকৃতপক্ষে মানুষই আল্লাহ্র রহস্যের প্রকাশ। মানুষের মধ্যেই নিহীত তাঁর সমুদয় রহস্য। এ রহস্যেরই মূর্ত প্রতীক এবং অভিব্যক্তি মুর্শিদ, সুগন্ধ যেমন সাধারণ তেলকে আতরে পরিণত করে।
উদাহরণরূপ আগুনে পুড়ে কাঠ যখন আগুনের মতোই সূক্ষ্ম অস্তিত্বপ্রাপ্ত হয় তখন তার দহন শক্তি পরিগ্রহণ করে। এটা আগুনের চূড়ান্ত ক্ষমতা এবং পরিপূর্ণরূপ। আগুনে পোড়ার আগে কাঠের এ ক্ষমতা ছিল না বরং তা ছিল নিরেট কাঠ মাত্র। আগুনের সংস্পর্শে এসে কাঠও আগুন হয়ে যায়। তাহলে আগুন কী জিনিস, আগুনই কি কেবল আগুন? অন্য কিছু কি আগুন নয়? কাঠও আগুন হয়, এর একমাত্র কারণ আগুনের সাথে এর সঙ্গত্ব। আগুন যখন অন্যকে পোড়ায় তখন সে নিজেকে অন্যের মধ্যে প্রকাশ করে। এটা আগুনের নিজের কাজ এবং ইচ্ছা। এর ফলে কাঠও আগুন হয়ে যায়। এতে সঙ্গত্বের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয় বৈকি। সুতরাং সঙ্গত্ব দ্বারা সঙ্গীর সত্তাই অর্জিত হচ্ছে বিধায় স্বীকার করতেই হবে যে, সত্তার এ পরিক্রমণে কোনো একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান রয়েছে।
তা সর্ব কর্মের উৎস এবং তাতে কল্যাণ ও মঙ্গল ছাড়া কিছুই নেই। এজন্য আল্লাহ্ সঙ্গযোগ্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, ‘সাদেক’ অর্থাৎ সৎ হিসেবে। কোরানে এ সাদেক তথা সৎজনকে উসিলা ও বন্ধুর মর্যাদা দিয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং তাঁদের আনুগত্য করা আল্লাহ্রই আনুগত্য করা, তাঁদের যিকির করা আল্লাহ্রই যিকির করা, তাঁদের ধ্যান করা আর তাঁদের সাথে একাত্ম হওয়া আল্লাহ্রই ধ্যান আর তাঁরই সাথে একাত্ম হওয়া এবং তাঁদের মধ্যে বিলীন হওয়া আল্লাহ্তেই বিলীন হওয়া। আল্লাহ্ বলেনÑ
يايها الذين اموا كنوا انصار الله *
“ইয়া আইয়্যূ হাল্লাযিনা আমানু কুনু আনসারাল্লাহি।”
“হে ব্যক্তিগণ যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহ্র সাহায্যকারী হও।” (সূরা সাফ্ ২৪ আয়াত) এবং আরও বলেন, كونوا مع الصادقين “কুনু মায়াছ সাদেক্বীন” অর্থাৎ, “সৎদের সঙ্গী হও” (সূরা তওবা)।
উপরে আলোচনা করা হয়েছে যে, ইবাদতের মধ্যে তাজিম ও তাজিমের মধ্যে ইবাদত, সত্তার মধ্যে বিদ্যমান। এজন্য বান্দা ইবাদত আর সম্মান যে নামেই আনুগত্য প্রকাশ করুক তা মূলের উদ্দেশেই নিবেদিত হয়। আল্লাহ্র সত্তায় আত্মলীনই এর চূড়ান্ত উদ্দেশ। এ কারণে আল্লাহ্ বলেন- وابتغو اليه الوسيلة “ওয়াবতাগু ইলাইহিল অসিলাতা” অর্থাৎ, “আল্লাহ্র পথে উসিলা অšে¦ষণ কর।” তাই হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা করা আল্লাহ্রই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়েছে। এ সিজদার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্ তায়ালার প্রকাশের স্থায়ী উল্লেখ ছিল যার মর্যাদা কেয়ামত পর্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আল্লাহ্ বলেন,
ولقد خلقنكم ثم صورنكم ثم قلنا للملئكة اسجدوا لادم فسجدوا الا ابليس –
‘‘ওয়ালাক্বাদ খালাকনাকুম ছুম্মা ছওয়ার নাকুম ছুম্মা কুলনা লিল মালায়্যি কাতিছ জুদু লি আদামা ফাসাজাদু ইল্লা ইবলিশ।’’
অর্থাৎ, “অবশ্যই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করলাম। অতঃপর তোমাদের রূপদান করলাম। তারপর ফেরেশতাদের বললাম আদমকে সিজদা কর। ইবলিশ ব্যতীত সকলেই তাকে সিজদা করল।” (সূরা আরাফ) উল্লেখ্য, উক্ত আয়াতে সৃষ্টি করার অর্থ সত্তার স্পষ্টপ্রকাশ আর রূপদান করার অর্থ রূহের জগৎ থেকে সৃষ্টিজগতে আসা। আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের যখন আদেশ করা হয়, তখন আদম সন্তানদের রূহ্সমূহ সৃষ্টিরূপে আদমের সত্তায় বর্তমান ছিল ফলে ফেরেশতাদের দেওয়া সিজদা আদমের সাথে আদম সন্তানগণও প্রাপ্ত হন। এরূপ সিজদা দেওয়া বড়ই পুণ্যের কাজ। এ কারণে হযরত ইউসুফ (আঃ) কে উপলক্ষ করে তা পুনরায় সংঘটিত হয়।
আর আমাদের শেষ নবীর ক্ষেত্রেও তা পূর্ণমাত্রায় সংঘটিত হয়, যে কারণে বৃক্ষ লতা ও পশুরাও তাকে সিজদা করে। এখানেই এর শেষ নয় বরং এ পরম কল্যাণের কাজটি পৃথিবীময় সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলন হয়। এমনকি মূর্তিকে যারা সিজদা করে তারাও চূড়ান্ত ব্যাখ্যায় এ উত্তম সৌজন্য কর্মটিকে উত্তম ইবাদত মনে করে। তবে যারা সিজদার বিভিন্ন মান সম্পর্কে অনবহিত তারা সিজদাকে এর উৎস থেকে আলাদা করে কেবল এর বাহ্য রূপটাকেই সিজদা মনে করে। তাজিম বা সম্মান প্রদর্শনে সিজদার বিরোধিতা ও তা পরিহার করার ফলে সম্মানার্থে সিজদায় যে ইবাদত সম্পাদন করতে পারত তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সহচরত্বের সিজদা সহচরত্ব থেকে প্রকাশ পায়। সহচরত্ব প্রকাশের জন্য এটা যথেষ্ট। এটা কেবল শির ঝুঁকানো নয় বরং এটা রহস্যলোক। সেখানে দেহ-প্রাণ, কামনা-বাসনা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও অনুভূতি সবই পরাভূত এবং রুকু, সিজদা, কেয়াম ও বৈঠক একমাত্র কাম্য। তবে আহলে হক্ব আপন সত্তা ও গুণাবলি থেকে প্রকাশিত জ্ঞান, ধৈর্য, দয়া, কৃপা, অনুকম্পা, দর্শন, শ্রবণ এবং কথাবার্তা ইত্যাদি পরিপূর্ণ গোপন রহস্যাদি নিজের মধ্যে প্রকাশ করার মাধ্যমে রুকু, সিজদা সম্পাদন করেন। অনুরূপ একটি সিজদা বিশ্বের সব সিজদার সমতুল্য। এটা সিজদায়ে ইত্তেহাদি।
উল্লেখ্য, সিজদাকে তাজিম বা সম্মানার্থে গ্রহণ না করলে কেবল মাথা ঝুঁকালেও কাফের হবে। বরং ইবাদতের ন্যায় অন্য উদ্দেশে দাঁড়ানো ও বসা শেরেক হওয়া উচিত। অথচ সিজদায়ে ইত্তেহাদি জাত এবং সিফাতের প্রকাশের স্থান। কারণ মূলত সারা বিশ্বে একই সত্তা প্রকাশিত ও আবিষ্ট। সুতরাং মূল যদি সিজদাবনত না হয় তাহলে এর গুণ রূপ শাখা সিজদা করে কী করে? সূর্যের আলো দেখা যাবে অথচ সূর্য উদিত হবে না এটাতো হতে পারে না। এ জন্যই কোরানে এসেছে যে, “সারা বিশ্বই আল্লাহ্র উদ্দেশে সিজদারত।” এই অর্থেই সিজদায়ে ইত্তেহাদিতে সারা বিশ্ব সিজদাকারী এবং সিজদাকৃতও বটে। এ পর্যায়ে এরফান এবং ইত্তেহাদের পূর্ণতার প্রকাশ হয়।
আহলে হকের সত্তায় মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা যা-ই হোক তার মধ্যে আত্মলীন হলে প্রকৃত মূলে আল্লাহ্র সত্তার অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। অতএব আহলে হকের সত্তায় আত্মলীন হলে জানতে পারবে আল্লাহ্ কী? আল্লাহ্ কোথায় পাওয়া যায়? আর কোন জিনিসের মধ্যে আল্লাহ্র প্রমাণ পাওয়া যায়? আল্লাহ্র প্রকাশ্য রূপ কী? আল্লাহ্র গোপন প্রকৃতি কী? আল্লাহ্র অদৃশ্য গঠন কী? এবং কিভাবে আল্লাহ্ সৃষ্টিতে আবিষ্ট আছেন? অতএব আহলে হকের সত্তা যা সিজদাযোগ্য এখানে এসে দেখে নাও যে, এজন্য একটি সিজদাই যথেষ্ট এবং সর্বোৎকৃষ্ট যার মধ্যে রকমারি হাজারো রুকু এবং সিজদার প্রকাশ হয়।
এ সিজদার অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। হযরত আদম (আঃ)-কে প্রদত্ত ফেরেশতাদের সিজদা পূর্ণতা ও তাৎপর্যে সর্বাধিক অনন্য। আল্লাহ্র উপস্থিতিতেই আদম (আঃ)-কে সিজদা করা হল। আবার হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে প্রদত্ত সিজদা তাঁর আপন বাবা, যিনি নবী ছিলেন তাকে দিয়ে করানো হল। এটা কি বুদ্ধি সমর্থন করে? ইসমাইলের কুরবানি এবং আমাদের শেষ নবীকে বৃক্ষাদি ও উট বকরির সিজদা করাও আল্লাহ্র ইশারাতেই সম্পাদিত হয়। এতেও তো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা যে বৈধ সুস্পষ্টভাবে তা প্রমাণিত হয়।
তাছাড়া এই রহমতময় ধর্মে নামাজে জমিন ও কা’বাকে যে সিজদা করা হয় তাও তো বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। তা সত্ত্বেও এর মধ্যে অনেক তাৎপর্য ও রহস্য নিহিত রয়েছে। যদিও আল্লাহ্র প্রকৃত বন্ধু যার সাথে আল্লাহ্র চেনা পরিচয় রয়েছে তিনি ছাড়া কেউই তা জানেন না। এজন্য হযরত শাহ আব্দুল আজিজ (রাঃ) তাঁর তাফসির গ্রন্থে লিখেছেন যে, আমাদের নবী করিম (সাঃ)-এর বক্ষে বারোটি কুঠুরি রয়েছে। তাঁর পবিত্র ছিনা মোবারকে গোপন রহস্যাদির মালামালে পরিপূর্ণ। এ কোঠার তালায় যিনি চাবি লাগিয়েছেন তিনি সিজদা পাওয়ার যোগ্য। দূর-দূরান্ত থেকে আল্লাহ্র সৃষ্টিরা এসে তাকে সিজদা করে। হযরত গাউসে পাক (রঃ) এবং হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রঃ) এর উদাহরণ। এ বিষয়ে তোমাদের বক্তব্য কী?
বস্তুত সিজদার উদ্দেশে আবেদের উঠা, বসা এবং চোখ ও মাথা দ্বারা ইশারা করা সবই মাবুদের উপাসনার অন্তর্ভুক্ত। আর তাজিম এবং সম্মানের ক্ষেত্রে এসবের অর্থ কেবল সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন। তা না হলে উঠা বসা দ্বারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত যা আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত তা করা কি বৈধ? অবশ্যই না। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, রুকু সিজদা আর উঠা বসা সবকিছুর অর্থ এবং বৈধাবৈধ উদ্দেশের ওপর নির্ভর করে। সম্মান প্রদর্শন ও মর্যাদাসূচক অভিবাদনের জন্য সিজদা, উঠা-বসা, রুকু ও মাথা ঝুঁকানো বৈধ। বরং ক্ষেত্রভেদে তা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মোবাহ এবং হারাম, মাকরুহ এবং নিষিদ্ধও বটে। এটা নির্ভর করে এগুলোর প্রয়োগের উদ্দেশের ওপর। কিন্তু জমিন ও কা’বাকে সিজদা করা সম্মান বটে এবং তাতে শুধু একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদতের উদ্দেশ থাকা শর্ত। উহাই একমাত্র ইবাদত যা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও জন্য নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, একই নামাজে আল্লাহ্র ইবাদত এবং জমিন ও কা’বার উদ্দেশে সিজদা ইত্যাদি ফরজ করা হয়েছে। স্মরণীয় যে, নবি ও অলীগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বা অভিবাদনও ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতই বটে।
السلام عليك ايها النبى و رحمة الله وبركاته السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين *
“আসসালামু আলাইকা আয়্যুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আসসালামু আলাইনা ওয়ালা ইবাদিল্লাহিস ছোয়ালেহীন।’’
অর্থাৎ, “হে নবী আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহ্র নেক্কার বান্দাগণের উপর সালাম।”
এখানে লক্ষণীয় যে, নামাজে আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত সিজদার মধ্যেও আল্লাহ্ ছাড়া অন্য উদ্দেশও জড়িত রয়েছে। এমতাবস্থায় নামাজের বাইরে সিজদা, রুকু, কেয়াম এবং প্রার্থনা যা আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত নয় তা কী করে নিষিদ্ধ হতে পারে? বরং কেবল আল্লাহ্র উদ্দেশে জমিনে সিজদা করা এবং তাতে জমিন ও কা’বা ইত্যাদির ধ্যান না রাখা হারাম। অপরদিকে জমিন ও কা’বার উদ্দেশে সিজদা, কেয়াম ও রুকু সবই করা হল কিন্তু তাতে মনোযোগ না থাকলে তা মাকরুহ হবে। আর ঘৃণাচ্ছলে জমিন ও কা’বা প্রভৃতিকে সিজদা ইত্যাদি না করা কুফর এবং উভয় দিকে মনোযোগ রেখে তা করা সর্বাধিক উত্তম।
এমতাবস্থায় তাকলিদি ঈমানের লোক, যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের উদ্দেশে সিজদা করা হারাম ও কুফর বলে অথচ কিয়াম বা উঠা-বসা এবং মাথা নত করাকে হারাম বলে না তাদের জবাব কী? এর উত্তরে যদি তাঁরা বলে যে, উঠা-বসাও হারাম তাহলে কেবল সিজদা আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত ইতিপূর্বেকার তাদের এ বক্তব্য টিকল কোথায়?
সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ্র জন্য যা নির্ধারিত তা অন্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। যথাÑ সম্মান, ভক্তি, প্রেম ও বন্ধুত্ব ইত্যাদি। মৌলিক তথা প্রকৃত ইবাদতের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য গুণাবলি ও মর্যাদার ক্ষেত্রে উপাসক ও উপাস্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উদাহরণস্বরূপ প্রেম যেমন আল্লাহ্র জন্য তেমন বান্দার জন্যও প্রয়োজন আর আল্লাহ্র জ্ঞান থেকেই বান্দা জ্ঞান পেয়ে থাকে, আল্লাহ্র দয়া-অনুগ্রহ এবং স্বর্গীয় শক্তি থেকে দয়ার দান হিসেবে বান্দা তা লাভ করে। তা না হলে আল্লাহ্ কোথা থেকে বান্দাকে এসব দেন। সত্য কথা হল যে, অন্তর অন্ধকারে ঢাকা থাকে আর সে সময় যদি কোনো কিছু অšে¦ষণ করা হয় তখন সে বস্তু দেখা যায় না এবং অšে¦ষণকারী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এর প্রমাণতো নিজের মধ্যেই বিদ্যমান। একদিকে জমিন ও কা’বাকে সিজদা করছে অপরদিকে তাকে অস্বীকারও করছে এবং বলছে নামাজে আমরা আল্লাহ্কে সিজদা করছি জমিনকে নয়। অথচ বারবার জমিনে মাথা ঠেকায় এবং কপাল ঘষে তা সত্ত্বেও বলে যে, আমরা আল্লাহ্কে সিজদা করি।

প্রশ্ন নং ৮
নামাজ যখন আল্লাহ্র জন্যই নির্দিষ্ট তবে তাতে অন্যের তাজিম এবং সম্মানও বিদ্যমান রয়েছে। তাহলে কিভাবে তা আল্লাহ্ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট হয়?
উত্তর : আল্লাহ্ তায়ালা আপন সত্তায় একটি মৌলিক ও বিশিষ্ট উদঘাটক সত্তা। সুতরাং তার মর্যাদাকে প্রকাশ করার জন্য যে ইবাদত তাও বিশেষ ধরনের। এটাকে “ইবাদতে মুতামায়্যেন্নাহ্” অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট ইবাদত বলা হয়। এটা প্রকৃত তথা ফরজ ইবাদত। এ ইবাদত সম্পাদনে যে পূর্ণতা প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যাদি ও মাধ্যম হিসেবে মূলমুখী বিধায় মূলের মর্যাদা রাখে। এটাকে বলা হয় বাড়তি মাধ্যম। এর মাধ্যমে সম্পাদিত ইবাদতকে বলা হয় মাধ্যমিক তথা সহায়ক ইবাদত। এই ইবাদতের মর্যাদা অনেক বেশি। এ কারণে নামাজে কোরান এবং কা’বা এবং পীর পয়গাম্বরদের সত্তা, গুণাবলি এবং কার্যাদির প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। নামাজের বাইরে অনুরূপ ভক্তি, সম্মান প্রদর্শন করা হলে তাও আল্লারই উদ্দেশে হবে এবং তাও মাধ্যমিক বা সহায়ক ইবাদত। অর্থাৎ নবী অলীগণের আসন, মাজার, পোশাক, গেলাফ, টুপি এমনকি জুতা ইত্যাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণ তাঁরা আল্লাহ্র প্রিয় পাত্র। তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আল্লাহ্র প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এগুলোও সহায়ক হিসেবে ইবাদত। আল্লাহ্র সৃষ্টিজগৎকে তারই সৃষ্টি মনে করে সম্মান করা উত্তম ইবাদত। কারণ ফরজ কার্যাদির চেয়ে এতে ফজিলত বেশি। তাইতো আল্লাহ্ বলেন,
ومن يعظم شعائى الله فانها من تقوى القلوب –
“ওয়ামাইয়্যিও য়াজ্জিমু শায়ারি‌্যরাল্লাহিফা ইন্নাহা মিন তাকওয়াল কুলুব।”
অর্থাৎ, “আল্লাহ্র নিদর্শনাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন মনের ধার্মিকতার পরিচায়ক।” (সূরা হজ্জ) এর অর্থ হল আল্লাহ্ নিজের তরফ থেকে বান্দার জন্য যা কিছু প্রকাশ করেন তা সবই আল্লাহ্র। এজন্য সেসব বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন বান্দার কৃতজ্ঞতা ও ধার্মিকতার প্রকাশ।
প্রশ্ন নং ৯
مامنعك ان تسجد لما خلقت بيدى
“মা মানায়াকা আনতাছ জুদা লিমা খালাকতু বি-ইয়াদি।”
অর্থাৎ, “কে তোমাদের নিষেধ করল সিজদা করতে। আমি যাকে সৃষ্টি করেছি নিজ হাতে।” (সূরা ছোয়াদ ৪ রুকু)
এ বাণীর মর্মার্থ অনন্তকাল বহাল থাকবে কি?

উত্তর : এটা যেহেতু কোরান, এর মর্মার্থ কেয়ামত পর্যন্ত বহাল ও কার্যকর থাকবে। কারণ ফেরেশতারা কি উক্ত সিজদা পরিত্যাগ করে তওবা করেছে? না, না, করেনি। বরং উক্ত সিজদায় যে কল্যাণ ও বরকত রয়েছে ফেরেশতাগণ তাতে সর্বদা ডুবে থাকবে, যতদিন তাঁরা বর্তমান রয়েছে। কোরানের মর্মার্থ রহিত না হওয়া পর্যন্ত এ সিজদায় কার্যকারিতা এবং বরকতও রহিত হবে না। ফেরেশতাগণ আজও আগের মতোই আদম (আঃ)-কে সম্মান করে। তা না হলে আল্লাহ্র নেয়ামত অস্বীকার করার কারণে তাঁরাও কাফের হয়ে যেত। যে কারণে শয়তান কাফের হয়। এ কারণে উক্ত সিজদার বরকত প্রকাশিত হওয়ার জন্য আদম সন্তানের মধ্যেও সম্প্রসারিত করা হয়। এজন্যই হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পিতা মুরব্বি হয়েও নিজের সন্তানকে সিজদা করেন এবং ফেরেশতারা মুরব্বি হয়েও সিজদা করে কম বয়স্ক আদমকে।
সুতরাং আদম এবং আদম সন্তানদের বড়ই সৌভাগ্য যে, তাদের জন্য সিজদা নির্দিষ্ট হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন,
فى وجو ههم من اثر السجود ط
“ফি উজুহিহীম মিন আছারিছ ছুজুদ।”
অর্থাৎ, “তাদের চেহারায় সিজদার চিহ্ন রয়েছে।” (সূরা আল-ফাতহা-২৯) তবে যাদের মনের ময়দানে বিতাড়িত শয়তানের বসবাস এবং বর্তমানে যারা শয়তানের অধীন তারাও সে নূরে বঞ্চিত হয়ে উক্ত সিজদাকে হারাম ও শিরকের পাল্লায় ওজন করছে।

প্রশ্ন নং ১০
আল্লাহ্র জন্য কি কেবল সিজদাই নির্ধারিত; না রুকু, দাঁড়ানো, বসা, বিনয়, মাথা নত করা, কথাবার্তা, দেখাশুনা এবং কাজকর্ম ইত্যাদি তারই জন্য নির্ধারিত?

উত্তর : ব্যাপক অর্থে এবাদতে উক্ত সব কাজই আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত। ইবাদতের উদ্দেশে উক্ত সব কাজই আল্লাহ্র জন্য এবং ইবাদত হিসেবে গণ্য। সিজদাতো দূরের কথা কেউ যদি চোখের ইশারায়ও আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করে তাহলেও সে কাফের হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি কুফরিমূলক কোনো কথা মুখে উচ্চারণ করে অথবা কান পেতে কুফরির উদ্দেশে তা শুনে বা হাতের দ্বারা কোনো কিছু ধরে তাহলেও সে কাফের। এমতাবস্থায় কী করে অনুরূপ একমাত্র সিজদাই আল্লাহ্র জন্য নির্দিষ্ট হল। আল্লাহ্র সম্পর্কে এ ধরনের কথা নিতান্তই অনিষ্টকর এবং বিভ্রান্তিকরও বটে। বস্তুত আল্লাহ্র জন্য সিজদা ইত্যাদি কোনোটাই নির্ধারিত নয়। বরং এসবের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ বা মর্মার্থই আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত। আল্লাহ্ বলেন,
ماهذه التماثيل التى انتم لها عكفون *
“মা হাজিহিত তামাছিলুল্লাতি আনতুম লাহা আকিফুন।” (সূরা আম্বিয়া-৫২)
অর্থাৎ, “এসব মূর্তি কী যে তোমরা এগুলোর কাছে দাঁড়াও।”
সুতরাং এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইবাদতের উদ্দেশে দাঁড়ানোও কুফরি। সে দাঁড়ানো কোনো মানুষ বা বৃক্ষাদির কাছে হলেও তা কুফরি হবে। তাহলে যে ব্যক্তি সিজদার বিরোধী, অথচ দাঁড়িয়ে ইবাদতে মশগুল সে কাফের হবে না কেন? যদিও সে কাফের নয় তবুও সে নিজের বিচারেই নিজে কাফের হতে বসেছে।

প্রশ্ন নং ১১
পূর্বে উল্লিখিত (সিজদা দাঁড়ানো, উঠা, বসা ইত্যাদি) কার্যাদিতে যদি ইবাদত মকসুদ না হয় তাহলে এগুলোর ব্যাপারে আইন কী?

উত্তর : উক্ত প্রশ্ন থেকে বোঝা যায় যে, ইবাদতের মকসুদ ছাড়াও এসব কার্যাদি হয়ে থাকে, বস্তুত এটাই ঠিক। বরং রুকু, সেজদার অর্থ ব্যাপক। ইবাদত মকসুদ না থাকলে তা ইবাদত হবে না। তেমনি অভিবাদন বা সম্মান প্রদর্শন মকসুদ না থাকলে তাতে আদব বা সম্মান প্রদর্শন বোঝাবে না। এগুলো না ফরজ না সুন্নত। বরং তা সার্বক্ষণিক মোবাহ। এটা যে কোনো বস্তুর মৌলিক অবস্থা। রঙের মূল উপাদানের মতো। এতে যে রঙ মেশানো হবে তা সে রঙ-ই ধারণ করবে। তেমনি সর্বদাই যেমন, দাঁড়িয়ে থাকা অথবা বসে থাকা ইত্যাদি উদ্দেশে ও মকসুদ মোতাবেক ফরয বা সুন্নত হয়ে থাকে। তাছাড়া মূলত এগুলো মোবাহ। তবে এগুলোর প্রয়োগে হারাম বা মাকরযুক্ত হলে এগুলো হারাম ও মাকরুহ হবে। উদাহরণস্বরূপ চুরির মকসুদে বসা আর মিথ্যা বলার জন্য দাঁড়ানো হারাম ও মাকরূহ। এরূপ কারণে নামাজও হারাম এবং মাকরূহ্ হতে পারে। অনুরূপভাবে ক্রোধের বসে এবং হাঙ্গামা সৃষ্টির উদ্দেশে মসজিদ নির্মাণ করা, নামাজ ও জামাতে শামীল হওয়া এবং জাগতিক স্বার্থ ও মনে কালিমা নিয়ে নামাজ আদায় করা যাতে ইবাদতের আস্বাদন নেই তা সবই হারাম। তাইতো আল্লাহ্ বলেন,
فاذا قاموا الى الصلوة قاموا كسالى يرآئون الناس
“ফাইজা কামু ইলাছ্ছালাতি কামু কুছালা ইউরাউনান নাছু।” (সূরা নেছা-১৪২)
অর্থাৎ তোমরা যখন নামাজে দাঁড়াও ক্লান্ত ও অমগ্নচিত্তে দাঁড়াও, মানুষকে দেখাও। অর্থাৎ, গ্লানিযুক্ত মন নিয়ে দাঁড়াও। এজন্য নামাজে চিত্ত স্থির হয় না, একাগ্রতা আসে না এবং মনে পবিত্রতার বদলে ময়লা জমে। এ কারণে রিয়া তথা লোক দেখানো মনোভাব প্রকাশ পায়। এ জন্য উক্ত আয়াতে বলা হয়, তোমরা লোকদেরকে তোমাদের নামাজ প্রদর্শন কর। এরপরও অনুরূপ নামাজিদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে, তোমরা আল্লাহ্র উদ্দেশে নামাজ পড়, না লোকদের দেখাবার জন্য? তাহলে কে বলবে না যে, আমরা আল্লাহ্র জন্যই নামাজ পড়েছি। এমতাবস্থায় মিথ্যুক কে, আল্লাহ্ না নামাজি?
প্রশ্ন নং ১২
ইবাদত দ্বারা উদ্দেশ কী?

উত্তর : ইবাদতের উদ্দেশ আল্লাহ্র বন্দেগি বা আনুগত্য করা। আপন অন্তর যা ইবাদতের স্থান সেখানে আল্লাহ্র প্রকাশ ঘটিয়ে প্রার্থনা ও প্রেমের প্রকাশকে ইবাদত বলে। এক্ষেত্রে বান্দা কর্মের কর্তা আল্লাহ্র সত্তা ও পূর্ণতাকৃত এবং উহার প্রকাশ হল কর্ম। এরই নাম ইবাদত। সে একক সত্তার পূর্ণতা অন্যের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার ফলে সৃষ্ট সর্বোত্তম বিশুদ্ধ কর্মই আল্লাহ্র ইবাদত হিসেবে গণ্য।

প্রশ্ন নং ১৩
কোরানে যে আল্লাহ্ তায়ালা অন্যের জন্য সিজদা সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন তা এই আল্লাহ্্ বলেন,
لاتسجدوا للشمس ولا للقمر واسجدوا لله الذى خلقهن –
“লা তাসজুদু লিসসামছি ওয়ালালিল কামারি ওয়াছ জুদু লিল্লাহীল্লাজি খালাকা হুন্না।”
অর্থাৎ, “তোমরা চাঁদ ও সূর্যকে সিজদা কোরো না, বরং এদের যিনি সৃষ্টি করেছেন সে আল্লাহ্কে সিজদা করো।”

উত্তর : যায়েদ তুমি একজন বড় চোর। তুমি আল্লাহ্র কালামের অংশ বিশেষ গোপন করেছ। তুমি স্পষ্ট কাফের। কারণ আল্লাহ্ বলছেন, “তোমরা চাঁদ ও সূর্যকে সিজদা কোরো না, বরং এদের যিনি সৃষ্টি করেছেন সে আল্লাহ্কে সিজদা করো।” এবং এই আয়াতটির শেষাংশ হল এই যেÑ
ان كنتم ايه تعبدون *
“ইনকুনতুম ইয়্যাহু তায়াবুদুন।”
অথচ প্রশ্নকারী আয়াতের এ অংশটি উল্লেখ করেনি। কোরানের উক্ত আয়াতে যা বলা হয়েছে তা এই যে, আল্লাহ্র ইবাদতের সময় তোমরা চাঁদ ও সূর্যকে সিজদা করবে না। অর্থাৎ, “ইবাদতের নিয়তে চাঁদ ও সূর্যকে সিজদা করা নিষেধ।” সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, কেবল ইবাদতের উদ্দেশে সিজদা করা উক্ত আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হলেও সিজদা নিষেধ নয়। এখানে প্রশ্নকারীগণ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্র কালামের প্রকৃত অর্থ গোপন করছে। আল্লাহ্ বলেন,
ولا تلبسوا الحق بالباطل *
“ওয়ালা তালবিসুল হাক্কা বিল বাতিলি।”
অর্থাৎ “সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কোরো না।”
কথিত আছে যে, যারা নামাজকে অস্বীকার করে তারা কোরান থেকেই নামাজ ত্যাগের দলিল দেয়। তারা কেবল কোরানের আয়াতের অংশ বিশেষ উল্লেখ করে। আর তা হল এই যেÑ
لاتقوبوا الصلوة
“লা তাকরাবুসসালাতা।”
অর্থাৎ, “তোমরা নামাজের কাছেও যাবে না।” এটা অবশ্যই কোরানের আয়াত কিন্তু পূর্ণ আয়াত নয়। পূর্ণ আয়াতটি হলÑ
لاتقوبوا الصلوة وانتمسكر *
“লা তাকরাবুসসালাতা ওয়াআনতুম সুকারা।”
অর্থাৎ, “তোমরা নামাজের ধারেও যাবে না, যখন নেশাগ্রস্ত হও।” এর অর্থ হল নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়া উচিত নয়। এ আয়াতে সর্বাবস্থায় নামাজ পড়াতো নিষেধ করা হয়নি। সেজদার ক্ষেত্রেও তাই বলা হয়েছে যে, ইবাদতের উদ্দেশে তোমরা চাঁদ ও সূর্যকে সিজদা করবে না। সাধারণভাবে সিজদা নিষিদ্ধ করা হয়নি। আদম ও ইউসুফ (আঃ)-এর সিজদার ঘটনা কোরানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। পক্ষান্তরে এই সিজদার নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে কোরানের অন্য কোনো আয়াত নাজিল হয়নি। প্রশ্নকারীকে শয়তান নষ্ট করেছে। এ জন্য সে কোরানের অংশ বিশেষ গোপন করে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যারা উক্ত আয়াত ‘মনসুখ’ বলছে তাঁরাও ঠিক বলছে না। কারণ উক্ত আয়াত ‘মনসুখ’ হয়নি।

প্রশ্ন নং ১৪
মেশকাত গ্রন্থে বর্ণিত আছে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
ان رسول الله صلى الله عليه سلم كان فى نفر من المهاجرين والانصار فجاء بعير فسجد له فقال اصحابه يارسول الله (ص) يسجد لك البهائم والشجار فنحن احق ان تسجد لك فقال اعبدوا ربكم واكرموا اخاكم *
“আন্না রাসূলুল্লাহি (সাঃ) কানা ফিনাফারি মিনাল মোহাজিরিনা ওয়াল আনসারি। ফাজায়া বায়্যিরুন ফাছা জাদালাহু ফাকালা আছহাবিহি ইয়া রাসূলুল্লাহ ইয়াছজুুদু লাকাল বাহায়্যিমু ওয়াস্সাজারু ফানাহ্নু আহাক্কা আনতাছজুদা লাকা ফাকালা আবুদু রাব্বাকুম ওয়া আকরামু আখাকুম।”
অর্থাৎ, “একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মোহাজের ও আনসারদের এক সমাবেশে বসে ছিলেন। এমন সময় একটি উট এসে তাকে সিজদা করে। তখন সাহাবাগণ বললেন, হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পশু এবং বৃক্ষ আপনাকে সিজদা করছে। অতএব আমাদেরও তো আপনাকে সিজদা করা উচিত। উত্তরে রাসূলুল্লাহ বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করো এবং আপন ভাইদের সম্মান করো।” এ হাদিস থেকে তো আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে সিজদা করা নিষেধ বলে মনে হয়। তাছাড়াও হাদিসে রয়েছে যাতে মানুষকে সিজদা করা নিষেধ বোঝা যায়। এসব হাদিসেও উট, বকরি ইত্যাদি কর্তৃক রাসূলুল্লাহকে সিজদা করতে দেখে সাহাবাগণ তাকে সিজদা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বলেন, “আমি যদি মানুষ মানুষকে সিজদা করার হুকুম দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে হুকুম দিতাম সে যেন আপন স্বামীকে সিজদা করে।”

উত্তর : উপরের হাদিসগুলোর দ্বারা অকাট্য ও দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত যে, উট, বকরি ও বৃক্ষাদি রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) সিজদা করেছে। এই দলিল স্বয়ং আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রকাশিত এবং প্রমাণিত, এটা নবুয়তের মাজেজা। এজন্য আর কোনো দলিল প্রমাণের প্রয়োজন নেই। বরং এ স্থলেই নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া এবং খোদা তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় তা প্রত্যাখ্যান এবং শুকুর গুজারি না করার কারণে চির কাফের হওয়া অসম্ভব নয়। কেননা এটা আল্লাহ্র দান এবং তারই গুপ্ত রহস্যময় ব্যাপার যা অতি উত্তম ও সম্মানের স্থান। এর প্রতি সম্মান দেখানো সকল বান্দার ওপর ফরজ। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ বলেন যে, “আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং ভাইদের সম্মান করো।” এ স্থলে পয়গাম্বর (সাঃ) নিজে আত্মগোপন করে উম্মতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, এটি একটি উত্তম নেয়ামত। হুঁশিয়ার বান্দাদের অন্তরে স্বর্গীয় প্রেরণা আসে যার ফলে তারা নিজে থেকেই সে সিজদা গ্রহণ করেন।
লক্ষণীয় যে, হযরত আদম (আঃ) এর অন্তরে যখন উক্তরূপ প্রেরণার সৃষ্টি হয় তখন তিনিও কৃতজ্ঞতার সাথে তা গ্রহণ করেন। অথচ বয়সে তিনি ফেরেশতাদের কাছে শিশুর মতো ছিলেন। ফেরেশতাদের বয়স তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও জ্ঞান ও বুজুর্গির কারণে আদমের সম্মান বেড়ে যায় এবং ফেরেশতাদের দ্বারা তাকে সিজদা করানো হয়। ঘটনাটি বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়।
হযরত ইউসুফের বেলাতেও তাই ঘটানো হয়েছে। নিজের মা বাবা দ্বারা তাকে সিজদা করানো হয়েছে। আর তাঁরাও এ কাজের বিরোধিতা করেননি। বরং হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং তাঁর মা বাবাও কৃতজ্ঞতার সাথে তা মেনে নেন। অপর দিকে আমাদের রসূল (সাঃ) কেও উট, বৃক্ষাদি সিজদা করে এবং তিনিও তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেননি। বরং তিনি নিজে এবং তাঁর সাহাবাগণ কৃতজ্ঞচিত্তে তা মেনে নেন। এমতাবস্থায় কিভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্মানের সিজদা নিষেধ করেছেন? ধরে নিলাম সাহাবাগণ সিজদা করেননি কিন্তু তাঁর বিরোধিতাও তো করেননি। কারণ কোরান এবং অলৌকিক সাক্ষ্য দ্বারা এটা প্রমাণিত। অতএব যে সম্মানের সিজদা অস্বীকার করবে সে কাফের আর এ অনুগ্রহের দানকে যে কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করবে সে হবে আল্লাহ্র শাকের অর্থাৎ কৃতজ্ঞ বান্দা। আর এটা বড় ধরনের ফরজ কাজ। এ কারণেই হযরত আদম, ফেরেশতাগণ হযরত ইয়াকুব প্রমুখ এবং আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ কৃতজ্ঞচিত্তে তা গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, আল্লাহ্র নেয়ামত যারা ভোগ করেন, নেয়ামতের সে সব অধিকারীগণই নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকেন। অর্থাৎ, যিনি নেয়ামত লাভ করেন, নেয়ামতের ভোগ ও স্বাদ আস্বাদনের পর তাকেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হয়। এমতাবস্থায় কী করে সাহাবাগণ সিজদা কবুল না করেন! তা না হলে সাহাবাগণ আর কী জন্য শুকরিয়া জানাবেন?
এখন বলোতো যাদের কথা আলোচনা করা হল তাদের মধ্যে কে সিজদাকে হারাম বা শিরক বলেছেন? রাসূলুল্লাহ তো বলেছেন, “আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং ভাইদের সম্মান করো।” এতেওতো সিজদার উদ্দেশটাই স্পষ্ট করে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, ইবাদতের উদ্দেশে প্রদেয় সিজদা বিশেষভাবে আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত আর সম্মানার্থে সিজদা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের জন্য। তবে একই সিজদায় উভয় বিষয়ে মনোযোগ থাকলে তা আল্লাহ্র জন্য ইবাদত এবং অন্যের জন্য সম্মানের অর্থ বোঝাবে। যেমন নামাজের সিজদা। এতে আল্লাহ্র জন্য ইবাদত আর জমিন ও কা’বার উদ্দেশে সম্মান প্রদর্শন বোঝায়। সিজদা একটি বহু ভাবগর্ভ শব্দ এবং বহু অর্থে এর ব্যবহার হয়।
বস্তুত একমাত্র অর্থবোধক বাক্য কোনো উচ্চাঙ্গের বক্তব্য নয়। দ্বিতীয় হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি যদি সিজদা করার হুকুম করতাম তাহলে স্ত্রীকে হুকুম করতাম সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে।” এ হাদিসটি দুর্বল হলেও এর বক্তব্য অত্যন্ত সফল ও অর্থবহ। রাসূলের বক্তব্য, “আমি যদি মানুষকে হুকুম করি মানুষকে সিজদা করার জন্য”Ñএর অর্থ হল যে, সিজদা করার রীতি ও প্রচলনের কথা কোরানে বার বার বলে এসেছে। তা সত্ত্বেও যদি আমি সে বিষয়ে আবার হুকুম করি তাহলে তাতে বেশ কড়াকড়ি আরোপিত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ তা চাননি। তাছাড়া এতে মুসলিম সমাজে এবং উম্মতদের মধ্যে স্ত্রীদের নিকট স্বামীদের অতিরিক্ত মর্যাদা বোঝানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, সিজদা, সিজদাপ্রাপ্ত ব্যক্তির বুজুর্গি নির্দেশ করে। বুজুর্গির কারণে মানুষ মুরব্বী হয়ে যায়। যেমন নবী এবং অলী, মুরশিদ এবং বাদশাহগণ বয়সে কম হলেও অন্যান্য শ্রেষ্ঠত্ব ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার কারণে তাঁরা বাপ দাদারাও মুরব্বি হয়ে যান। যেমন আমাদের নবী হযরত আদম ও হযরত ইউসুফ (আঃ)। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অধিকারী এবং মুরব্বিদের সিজদা করা কল্যাণের কাজ। এটা আল্লাহ্র আমানত। এটাকে অস্বীকার করার কারণে আল্লাহ্র রোষের স্বীকার হয়ে শয়তান দোজখবাসী হতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া আর যে দুই একটি হাদিস যা সম্মানার্থে সিজদার বিরুদ্ধে পেশ করা হয়ে থাকে সেগুলো এ ধরনেরই এবং সেগুলো সম্পর্কেও অনুরূপ ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে।
যদিও একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিজদা করা সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন, জিরা শহরের বাদশাহকে লোকেরা খাস করে ঐ সিজদা করত। ঠিক ঐ অনুকরণে লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কেও সিজদা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে রাসূল তাদের বলেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরে সর্বদা সিজদা করবে? তখন লোকেরা তা অস্বীকার করল। এর উত্তরে রাসূল (সাঃ) বলেন, তাহলে আমাকে সিজদা কোরো না। এর অর্থ এই যে, তোমরা আমার কবরকে রাজার কবরের মতো যখন সিজদা করবে না, তখন আমাকেও তা কোরো না। এ কারণে অধিকাংশ তাফসীরকার এবং গবেষকগণ উক্ত হাদিসের এই ব্যাখ্যা গ্রহণপূর্বক সম্মানার্থে সিজদাকে জায়েজ এবং কল্যাণপূর্ণ কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। দু/চার জন যদি একে হারাম ও শিরক বলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেও তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ তারা হিসেবের মধ্যে গণ্য নয়। আর এদের বক্তব্যে তেমন কোনো তাৎপর্য নেই।
উল্লেখ্য, হারাম বা শিরক বলাকে ফরজ মনে করা, মূলত কুফরি গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের ক্ষেত্রে হালাল হারামের মনগড়া ফতোয়া জারি হয়ে থাকে। বস্তুত কোনো কিছুই হারাম নয়। এজন্য কোরান ও হাদিসের অকাট্য ও সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুকে হারাম বলার অনুমতি নেই বরং তা সবই হালাল ও জায়েজ। কারণ মূলত সবই হালাল। এজন্য ইমাম আজম (রঃ) বলেন, শত কাজের মধ্যে একটি ইসলামী কাজও কেউ যদি করে তাকেও ইসলামের বাইরে মনে করা বৈধ নয়। হুজ্জাতুল ইসলাম (রঃ) বলেন, ‘আহলে কিবলা’ অর্থাৎ, কা’বার দিকে যে মাথা নত করে সে মুশরিক নয়। সুতরাং যে কাফের নয় তাকে কাফের মনে করার অর্থ হল, ইসলামের ধারা বা রশি কেটে দেওয়া। এটা যে করে সে নিজেই কাফের হয়ে যায়। অতএব যার খুশি সে নিজে নিজে কাফের হোক তোমরা নিজেরা কাউকে কাফের বোলো না।
প্রশ্ন নং ১৫
সম্মানার্থে সিজদা হযরত আদম (আঃ) এবং অন্যান্যের জন্য যা ফরজ ছিল কোরান দ্বারা সে ফরজ কি রহিত হয়ে গেছে?

উত্তর : কখনো না। সম্মানার্থে সিজদার ফরজ বা বৈধতা কোরানে রহিত হয়নি। বরং সে সাথে আদমের সম্মানের বাধ্য-বাধকতা এবং নির্দেশ সাধারণভাবে যুক্ত রয়েছে। যেমন কা’বা এবং জমিনকে সম্মানার্থে সিজদা, রুকু ও কেয়াম ইত্যাদি নামাজের মধ্যেও ফরজ। অর্থাৎ নামাজের মধ্যে সিজদা ইত্যাদি যা ইবাদত হিসেবে আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত সে রুকু, সিজদা ইত্যাদি আবার সম্মানার্থে কা’বা ও জমিনের জন্য ফরজ। এটা নাসেক মানসুখ অর্থাৎ রহিত হওয়া থেকে পবিত্র। অপরদিকে সম্মানের বিষয়টি ওয়াজিব পর্যায়ে বর্তমান। মানুষ মানুষকে সম্মান করে থাকে। কোনো মানুষই এ থেকে মুক্ত নয়। মুখে হলেও তো একে অন্যকে সম্মান করে। মুখও তো মাথারই একটা অংশ।
প্রশ্ন নং ১৬
হযরত আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাগণ কোন সিজদা করেছিল? জ্বিন ও মানুষের জন্য সে সিজদা কি নিষিদ্ধ?

উত্তর : হযরত আদম (আঃ) কে ফেরেশতাগণ সম্মানের সিজদা করেছিল। মানুষও মানুষকে সে সিজদা করতে পারে। সাধারণত এর কারণ এই যে, আদমের সিজদায় ফেরেশতা ও জ্বিন উভয়ই শামীল ছিল। শয়তান ছিল জ্বিনের গোষ্ঠীভুক্ত। অপর দিকে মানুষও মানুষকে সিজদা করেছে। যথা হযরত ইউসুফের সিজদা। কোরানে এর প্রমাণ রয়েছে।

প্রশ্ন নং ১৭
অন্যকে সিজদা করতে মন চায় না, বেশ কষ্ট হয়। কারণ এটা আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত।
উত্তর : শয়তান নরকের যে আগুনে জ্বলছে, তোমাদের এ কষ্ট সে শয়তানি পুত্র শোক যন্ত্রণার চেয়েও অধিক। বস্তুত সিজদা কখনও কি কেবল আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত ছিল? আল্লাহ্ তো হযরত আদম (আঃ) এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) কে ফেরেস্তা, জ্বিন এবং মানুষ দ্বারা সিজদা করিয়েছেন। তাছাড়া আমাদের নবী (সাঃ) কে জীবজন্তু এবং বৃক্ষাদি দ্বারা সিজদা করিয়েছেন। আর আজও ফেরেশতা, জ্বিন এবং মানুষ দ্বারা জমিন ও কা’বাকে সিজদা করাচ্ছেন। আরে মিয়া! তোমরা নামাজ পড় সিজদা কর কাকে? আজ পর্যন্ত তাও জান না। বলো, তুমি জমিন ও কা’বাকে কি করছ?

প্রশ্ন নং ১৮
মিলাদ, কেয়াম, ফাতেহা, নেয়াজ এবং চৌঠা, সপ্তম, দশম, বিশতম, চল্লিশা, ষান্মাষিক ও বার্ষিক ইত্যাদি নির্দিষ্ট তারিখ উদ্যাপন এবং অলী বুজুর্গ শহীদান ও অন্যান্য পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গের চালুকৃত শুভ অনুষ্ঠানাদি পালনের কারণ, উপকারিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা কী?

উত্তর : উক্ত অনুষ্ঠানাদির অভূতপূর্ব কল্যাণাদি ও ফলাফল পূর্ণ মর্যাদাসহকারে এগুলো উদ্যাপনের উপর নির্ভরশীল। এগুলো উদ্যাপনের সূত্রপাত হয় ভাব জ্ঞানের স্রোতধারা থেকে, যা ছাড়া আসমানী কিতাবও অকার্যকর এবং নিষ্ফল হয়ে যায়। লক্ষণীয় যে, হযরত জিব্রাঈল আসমানী কিতাব অবতরণের শুরুতে আমাদের শেষ নবী (সাঃ) কে اقرا باسم ‘একরা বি এসমী’ পাঠ করতে বলেন। কিন্তু হযরত তা পাঠ করতে অপারগ হন। তখন হযরত জিব্রাঈল নিজের হাত দ্বারা হযরত (সাঃ) এর মোবারক বক্ষে তিনবার চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে হযরতের নিকট কোরানের শব্দার্থসহ প্রকৃত কোরান স্পষ্ট হতে থাকে। যাদ্বারা তিনি একজন শিক্ষক হলেন। সুতরাং হযরতের কোরানিক জ্ঞান তাকলিদি বা শোনা বিদ্যা নয়। জিব্রাঈলের কাছ থেকে শোনাতেই যদি মূল কোরান সমাপ্ত হত তাহলে তা হত নিছক শোনা ও ধারণাকৃত। বস্তুত শোনা খবর প্রকৃতপক্ষে কোনো বস্তুই না। তাইতো আল্লাহ্ বলেন,
ان الظن لايغنى من الحق شيئا *
‘‘ইন্নাজোয়ান্না লা ইউগনি মিনাল হাক্কী শাইয়্যা।’’ (সূরা নজম-২৮)
অর্থাৎ, “অনুমান দ্বারা সত্যের কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না এ জন্য আসমানী দূত পড়িয়েছেন এবং বক্ষ দাবিয়েছেন। অর্থাৎ, মৌখিক বিদ্যার সাথে সাথে এলমে আহয়াল তথা ভাব জ্ঞানের ফলন ঘটিয়েছেন। যার ফলে রাসূলের বক্ষ নূরময় হয়েছে। উম্মতের মধ্যে যাদের বক্ষ সেই নূরে আলোকিত ও প্রসারিত তারা আহলে নবী এবং নায়েবে রাসূল। তাদেরই জ্যোতির্ময় বক্ষ থেকে মৌলুদ, কেয়াম, ফাতেহা ও নেয়াজ ইত্যাদি প্রচলন হয়েছে। বস্তুত এসব অনুষ্ঠান শ্রুতি পরম্পরা থেকে আসেনি। বরং এগুলোর গভীর তাৎপর্য ও মৌলিকত্ব রয়েছে। কোরানের মালিক এগুলোর জ্যোতির্ময় রহস্যের কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। বলা হচ্ছেÑ
والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا *
‘‘ওয়াল্লাজিনা জাহাদু ফিনা লা নাহ্দি ইয়ান্নাহুম সোবোলানা।’’
(সূরা আন কাবুত-৬৯)
অর্থাৎ, “যারা আমাদের সত্তায় সচেষ্ট আমরা তাদেরকে আমাদের পথগুলো প্রদর্শন করি।” এজন্য তাদের কোনো কেতাব বা দলিলের প্রয়োজন হয় না। এ নির্দেশনা আসে নূরময় বক্ষ থেকে ‘ইলমে লাদুনি’ এর মাধ্যমে তা কাস্ফ ও এলহামরূপে পথ প্রদর্শন করে। এ বক্ষ আল্লাহ্র অনুকম্পাপ্রাপ্ত মহাসম্পদ ভান্ডার। এটাই কোরান কেতাবের মূল এবং আল্লাহ্র আরশরূপে স্মরণীয়। এ হল সমস্ত জ্ঞানের খনি। এখানে সমস্ত জ্ঞানের সমারোহ এবং ‘ইলমে লাদুনি’ এর প্রকাশও এখানেই হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুকে সুসংবাদ দিচ্ছেনÑ
ولقد اتينك ملدنا علما *
“ওয়ালাকাদ আতাইনাকা মিল্লাদুন্না এলমা।’’
অর্থাৎ, “অবশ্যই আমরা তোমাকে আমাদের তরফ থেকে দান করেছি এলমে লাদুন।” ফলে তুমি হয়েছ আমাদের জ্ঞানভান্ডার।
সুতরাং তোমার অন্তর থেকে যা বের হচ্ছে তা শত শত কেতাব ও প্রমাণাদির চেয়ে উত্তম। বস্তুত যা নিজেই উজ্জ্বল ও নূরময় তাঁর পথ চলার জন্য কোনো কেতাব দলিলের প্রয়োজন নেই। যথাÑ ঈমান, এটা মনের বিশ্বাস কোনো কেতাবের কাজ নয়। এটা কোনো বেদ’আত বা মাকরূহ্ হবে না। কারণ এটা কোরানের মর্ম থেকে প্রকাশিত। সামান্যতম ‘ইলমে লাদুনি’ থেকে যে ঈমান হয় সে জন্য কেতাবের কোনোই প্রয়োজন নেই, সে ঈমানকে কেতাবে স্থাপন করলে তা কোনো কাজে আসবে না। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
استفت عن قلبك ان افتك المفتون *
‘‘ইস্তাফতা আন কালবিকা ইন আফতুকাল মাফ্তুন।’’
অর্থাৎ, “যদি মুফতিরা কোনো বিষয়ে তোমাকে ফতোয়া দেয়, তুমি তা প্রত্যাখ্যান করে নিজের মনের কাছে ফতোয়া চাইবে।” কারণ ফতোয়া হয় দলিলের ভিত্তিতে, আর মন হল জ্ঞানরহস্য ভান্ডার। এজন্য আল্লাহ্ কোরানকে কল্বে তথা অন্তরে সমর্পণ করেছেন। তিনি বলেন,
ان فى ذلك لذكرى لمن كان له قلب *
‘‘ইন্না ফি জালিকা লা জিকরা লিমান কা’না লাহু কালবুন।’’
“অন্তরবানদের জন্য এ কোরান অবশ্যই তাদেরকে আল্লাহ্র স্মরণ করিয়ে দেয়। যারা অন্তরবান নয় তাদের জন্য কোরান অবতীর্ণ হয়নি।
মোট কথা, মুমিন ও আল্লাহ্ ওয়ালাদের মূলধন হল কাল্ব তথা অন্তর। বাকি ঈমান, ইবাদত সম্পদ ও সম্ভ্রম সবই সে বক্ষ ভান্ডারের জ্যোতি ও কর্ম। এমনকি বক্ষ মালিন্য রূপ অন্ধকার এবং পাপ কার্যাদিও তৈলাক্ত আবরণরূপে বক্ষ থেকেই প্রকাশিত হয়। এটাকে মনোরোগ বলা হয়। তাই বলা হচ্ছেÑ
فى قلوبهم مرض *
‘‘ফি কুলুবিহীম মারাদুন।”

অর্থাৎ, “তাদের মনে রোগ আছে।” এমন তো বলা হয়নি যে, কোরানে রোগ আছে অথবা এওতো বলা হয়নি যে, কোরানে ঈমান আছে।

সুতরাং প্রমাণিত যে, মনের সৌন্দর্য স্বচ্ছতা এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি সংক্রান্ত জ্ঞানই নূর। আর তাই ঈমান, সান্ত্বনা, ঐশী প্রেরণা, পূর্ণতা, সত্য এবং তাই প্রকৃত জ্ঞানের মূল উৎস। এসবই সত্য ও প্রয়োজনীয় এবং সর্বরকম দোষমুক্ত। তাইতো আল্লাহ্ বলেন,
ليس لك عليهم سلطان *
‘‘লাইসা লাকা আলাইহিম সুলতোয়ানা।”
অর্থাৎ, “তাঁরা যারা আমার বান্দা তাদের উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নাই। আল্লাহ্ শয়তানকে উদ্দেশ করে এই কথা বলেন।
উল্লেখ্য, উক্তরূপ বক্ষের নূর যা স্বয়ং রবের প্রেরণাদীপ্ত তা থেকে মিলাদ, কেয়াম, ফাতেহা, নেয়াজ ইত্যাদি শুভ অনুষ্ঠানাদির প্রচলন হয়েছে। এটা গবেষণালব্ধ প্রকৃত সত্য। অপরদিকে দলিল দ্বারা যা প্রমাণিত তাতো ধারণামাত্র। সুতরাং যা কেবল ধারণার ফল তাকে আসল মনে করা বড় ধরনের গোমরাহি। উক্ত রূপ নূরি জ্ঞানের মোকাবেলায় কেতাব দলিলের তো কোনো কার্যকারিতা বা গ্রহণযোগ্যতা নেই। বরং যেখানে সত্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত সেখানে কেতাব দলিল হাজির করা প্রকৃতই গোমরাহি। কারণ ভাব গভীর রহস্যজ্ঞানকে দলিলের চক্করে আবদ্ধ করার অর্থ হবে নামাজ পড়ার সাথে নামাজের মসলা-মাসায়েল যা দলিল তা জপ করা।
প্রশ্ন নং ১৯
যাদের ঈর্ষামুক্ত পবিত্র বক্ষ থেকে ইলমে লাদুনি (দিব্যজ্ঞান) এবং অন্তর জ্যোতি প্রকাশিত হয় তাঁদের আদব ও সম্মান করা কী? এবং আদব আচরণাদির মধ্যে সিজদাও অন্তর্ভুক্ত কি না?

উত্তর : এমন লোকদের প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শন ফরজ এবং ওয়াজিব। কারণ তাঁদের অন্তরে প্রদীপ্ত নূর পরকাল সংক্রান্ত জ্ঞানের সারাংশ এবং প্রভুর গোপন জ্ঞানভান্ডার। সুতরাং তাঁদের সম্মান করা আল্লাহ্কেই সম্মান করা, এবং তারই সন্তুষ্টি লাভ করা। যেমন কোরানের সম্মান আল্লাহ্রই সম্মান ও ইবাদত। বস্তুত দিব্যদৃষ্টিতে গোপন রহস্যলোকে এটাই প্রকৃত এবং আসল ইবাদত। উক্তরূপ পবিত্র মনের বদৌলতেই সকল পুণ্যকর্ম আল্লাহ্র ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় যদিও তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের বরাবরে সম্পাদিত হয়।
এ প্রসঙ্গে হযরত আদম (আঃ) এর সিজদা কিরূপে সম্পাদিত হল তা লক্ষণীয়। আল্লাহ্র সৌন্দর্য রহস্য উজ্জ্বলরূপে আদমকে গৌরবদীপ্ত করে এবং সারা বিশ্বে তা প্রতিবিম্বিত হয়। তখন ফেরেশতাগণ তার সম্মানে মাথা নত করে এবং সিজদায় অবনত হয়। এটা উৎকৃষ্ট ইবাদত। সারা বিশ্বের জন্য এটা মহোৎসব। এ মহোৎসব বা ঈদের শোভা সৌন্দর্য ও মাধুর্য সম্পর্কে কোরান কেয়ামত পর্যন্ত ঢাকঢোল পেটাতে থাকবে।
কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি সৌন্দর্য যে, তত্ত্ব জ্ঞানের বা রহস্যলোকের পূর্ণতা প্রাপ্তি আদম জাতির জন্যই নির্ধারিত। কোনো ফেরেশতা বা জ্বিনের এ সৌভাগ্য হয়নি। জ্বিন জাতি যখন জানতে পারল যে, উক্তরূপ অভূতপূর্ব গৌরব আদম ও আদমসন্তানদের দান করা হয়েছে। তখন তাদেরই বংশোদ্ভূত ইবলিশ ঈর্ষান্বিত ও ক্রোধান্বিত হয়। ক্রোধের আগুন তার গোটা শরীরকে দাহ করে এবং সে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে থাকে। অপরদিকে আল্লাহ্র ইচ্ছায় সে গৌরব রহস্য ধীরে ধীরে আদম সন্তানদের মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকে। এ ধারারই এক পর্যায়ে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে তাঁর পিতা-মাতা ও ভাইদের দ্বারা সিজদা করানো হল। অবশেষে সিজদা করানো হল আমাদের শেষ নবীকে পশু, প্রাণী ও বৃক্ষাদি দ্বারা। এসব করানো হল এজন্য যে, ভবিষ্যতে কোনো অধম যেন এর বিরোধিতা না করে এবং না ভাবে যে, এরূপ সিজদা করা উচিত নয়। অপরদিকে আমাদের নবীকে বৃক্ষাদি এবং পশু প্রাণী দ্বারা সিজদা করানো হল যাতে এ সিজদাকারীরাও আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের প্রতি প্রদত্ত আল্লাহ্্র আদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। উদ্দেশ আদম ও আদম সন্তানগণ সারাবিশ্বে প্রভুর খলিফা বা প্রতিনিধিÑ এ চূড়ান্ত রহস্য প্রকাশ করা। সুতরাং এ রহস্যপূর্ণ সিজদা খেলাফতের প্রেক্ষিতে ক্ষেত্রবিশেষে ফরজ কল্যাণকর পরহেজগারী; ওয়াজিব এবং সুন্নত। খলিফা, পীর, বুজুর্গ এবং আউলিয়া প্রমুখ আহলে রাসূলদের প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শন করা ফরজ। পুণ্য ও কল্যাণ কর্ম হিসেবে এটা উত্তম। কারণ আদমের সত্তা উত্তম এবং আদম রহস্যের উৎস উত্তম। অপরদিকে সম্মান প্রদর্শন এবং সিজদাও উত্তম কাজ। এর চর্চা কোরান কেয়ামত পর্যন্ত চালু রেখেছে এবং তা রহিত করেনি এটা উত্তম।
সুতরাং হে অনুগত সচেতন বান্দারা, প্রভুর প্রেমে আসক্ত হয়ে নতশির হয়ে যাও, আদববান হয়ে যাও, নিজেকে বিনীত করে দাও, মুখে কান্নার ভাব করো, মনকে হাসাও এবং চোখ দিয়ে দেখ যে এটা কোন গাছের ফল।

প্রশ্ন নং ২০
সিজদা, সম্মান, অথবা ভক্তি পেতে হলে তাকে অবশ্যই বুজুর্গ হতে হবে। কেবল হযরত আদম (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্যই এ বুজুর্গি বিশেষভাবে নিধারিত না অন্য কাউকেও আল্লাহ্্ উক্ত বুজুর্গি দান করেছেন?

উত্তর : বুজুর্গি একটি অদৃশ্য ও সর্বজনীন নেয়ামত বা আল্লাহ্র অনুকম্পা। আল্লাহ্র যে বান্দা সে নেয়ামত লাভ করেন তিনি বুজুর্গ অলী এবং কামেল অর্থাৎ, পূর্ণ মানুষ হন। এর মোকাবেলায় নবুয়ত ও মাতৃপিতৃ মর্যাদাও পরাজিত। নবুয়তও মাতৃপিতৃ মর্যাদার চেয়ে বুজুর্গির মর্যাদা বেশি। হযরত ইউসুফ (আঃ) কে তাঁর মাতা-পিতার সিজদা করার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বুজুর্গির এ মর্যাদার রহস্য সর্বজনীন। আল্লাহ্্ তাঁর যে বান্দাকে তা দান করেন তিনি এ মর্যাদার অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শন ওয়াজিব। অনুরূপ মুর্শিদ ও মুরব্বিদের প্রতি আদব দেখানোও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ যে বুজুর্গির মর্যাদা নবুয়তের মর্যাদার চেয়েও অধিক আল্লাহ্র যে কোনো বান্দা তা অর্জন করতে পারেন।
প্রশ্ন নং ২১
নবী না হয়েও মর্যাদায় নবীর চেয়ে বুজুর্গ হতে পারেন কি?

উত্তর : বুজুর্গি এবং মর্যাদা কেবল নবুয়তের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বুজুর্গি হল পরিপূর্ণতা। বেলায়েতের পথে তা অর্জিত হয়। রহস্যলোক ও অদৃশ্য জগৎ এর পরিমন্ডল। এখানে যার ক্ষমতা বেশি তিনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বুজুর্গ। রাসূল (সাঃ)-এর বাণী দ্বারা একথা বহুভাবে প্রমাণিত।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হযরত মূসা (আঃ) এর সময় একাধারে সাত বছর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। এ সময় এলাকায় বৃষ্টিপাত বন্ধ ছিল। হযরত মূসা (আঃ) তাঁর সত্তর হাজার লোক নিয়ে বৃষ্টির জন্য আল্লাহ্্র নিকট প্রার্থনা করছিলেন, এমন সময় দৈব আওয়াজ এল বাররাখ নামে আমার এক বিশিষ্ট বান্দা আছেন, তিনি যদি তোমাদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করেন তাহলে বৃষ্টি হবে। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) হযরত বাররাখের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় আবার আওয়াজ এল, তিনি মাঠে বেড়াতে গেছেন। এমন সময় দেখা গেল জনৈক ব্যক্তি গায়ে কাপড় জড়ানো অবস্থায় একটি অন্ধ গলিপথে দ্রূত পথে চলমান।
বস্তুত তার চেহারায় দীপ্ত দৈবজ্যোতি দেখে হযরত মূসা কালিমুল্লাহ্ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কে? জবাব এল আমি আল্লাহ্্র বান্দা কালিমুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করেন আপনার নাম কি? বললেন বাররাখ। তখন কালিমুল্লাহ্ বলেন আপনার নিকট আমার একটি নিবেদন আছে, তখন আরিফ বিল্লাহ্ হযরত বাররাখ বললেন, বলুন যা বলার আছে। তখন হযরত মূসা (আঃ) তাঁর প্রাপ্ত ওহীর কথা তাকে জানান। অতঃপর মাহবুবে সোবহানী হযরত বাররাখ বললেন, চলুন ময়দানে যাই। ময়দানে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হযরত বাররাখ বলতে শুরু করেন, হে আল্লাহ্ আজ তোমার শক্তি কমে গেছে। তোমার দৃষ্টি কাজ করে না, কান শুনে না, হাতও চলে না এবং বাতাস ও পানি তোমার কথা মানে না। এজন্য বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেছে। অনুরূপ অর্থহীন প্রলাপ করতে করতে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে; কিছুক্ষণের মধ্যেই এ প্রলাপের ফলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। ফলে মাঠে হাঁটু সমান পানি প্রবাহিত হলে তিনি হযরত মূসা (আঃ) কে নিয়ে উঁচুতে উঠেন এবং তাকে বলেন দেখেছেন আমি আপনার আল্লাহ্্কে কত গালমন্দ করলাম। এতে গোশশা হয়ে হযরত মূসা (আঃ) তাকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এসে হযরত মূসা (আঃ) কে বলেন, আল্লাহ্্ বলেছেন তার মরমী বন্ধুর সাথে বেয়াদবি করলে আপনার নবুয়ত কেড়ে নেওয়া হবে। তাঁর এ বন্ধু দৈনিক তিনবার তাঁর সাথে এরূপ হাসি তামাশা করেন। (‘এহ্ইয়াউল উলুম’ থেকে)
অতএব উপরিউক্ত ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বুজুর্গি কেবল নবুয়তের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বুজুর্গি পরিপূর্ণতা এবং ইচ্ছাশক্তি যা বেলায়েতের পথে অর্জিত হয় যার পরিমন্ডল রহস্যলোক ও অদৃশ্য জগৎ। এর সূক্ষ্ম মাধুর্য ব্যাখ্যায় জনৈক আরিফ বিল্লাহ্ বলেন,
صد هزاران هموز موسى در هر گوشى
ربى ار نى گ وشوده ديدر جو امده
“ছোয়াদো হাজারান হামছো মূছা দরহর গোসা।
রাব্বি আরিনি গোসোদা দীদার জু ইয়া আমাদা।”
অনুবাদ : অনুরূপ মূসা আছেন হাজার হাজার প্রত্যেক হুজরাখানায়
বলছেন যারা দেখা দাও হে প্রভু তারা তাঁর দেখা পায়।
এ প্রসঙ্গে হযরত খিজির (আঃ)-এর মর্যাদার কথা স্মরণ কর। তাঁর কাজকর্ম বাহ্যত নবুয়তের জ্ঞানের বিপরীত ছিল। এজন্য হযরত মূসা কালিমুল্লাহ্ তাঁর কাছে লজ্জিত হন। তবে এ দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, নবীগণ বুজুর্গ নন। বরং এ দ্বারা যে কথাটা পরিষ্কার প্রমাণিত হল তা এই, যে নবুয়ত বেলায়েত জয়ী হয় তা উত্তম। কারণ বেলায়েত নবুয়তের মূল উৎস। বস্তুত নবুয়ত বেলায়েতেরই প্রকাশ। তাও আবার আপন প্রকাশের গুণগতমানের বিচারে উত্তম ও সাধারণ হয়।
এ প্রসঙ্গে হযরত ঈমাম গায্যালী (রঃ) আপন গ্রন্থ ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’-এ বলেন, বেলায়েত হল ব্যাপক। অর্থাৎ অলী নবুয়তপ্রাপ্ত হলে নবী হন। তা না হলে তিনি অলী থাকেন। জামেনূরের দ্বিতীয় খন্ড তথা মাতলাউল উলুমে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

প্রশ্ন নং ২২
মিলাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে কেয়াম করা কী? এর উপকারিতা কী? এতে আমাদের অনীহা বোধ হয়?

উত্তর : হে চাঁদ শরীফ মিয়ারা, তোমাদেরতো অনীহাই পছন্দ। বেশ তোমরাতো নামাজ পড় তাতে তোমরা কী কর? তাতে তোমরা অনেক রংঢং কর। মিলাদ অনুষ্ঠানেতো কেবল একবারই কেয়াম করা হয়। আর কেয়াম তথা দাঁড়ানো ও বসা ইত্যাদি নামাজের দীপ্তিমান কার্যাদির অন্তর্ভুক্ত বটে। বস্তুত নামাজে কেয়াম তথা দাঁড়ানো ফরজ। মিলাদের কেয়ামও সেই একই রহস্যের দীপ্তিমানরূপ। এর মধ্যে হাজারও রহস্যের প্রকাশ ও অবগতি হচ্ছে। এ থেকে পবিত্র নূরী প্রেরণা আয়ত্ত করার চেষ্টা করা সর্বক্ষণিক ফরজ। তা যদি না হবে, তাহলে নামাজে বার বার রুকু ও সিজদার প্রয়োজন কী? এটা কী এমন যে, কাজ করব অথচ ভাত পাওয়া যাবে না। অথবা এটা কি ভূতের বেগার যে, আলিফ-বা পড়বে আর এর নামও জানবে না বা নামাজে এমন তেমন করবে আর এসবের অর্থের ব্যাপারে উদাসীন রবে। এ প্রসঙ্গে শেখ সাদী (রঃ) বলেন,
بخبر دياند چند جوخود بخبر
عيب پسنداند بزعم نونور

উচ্চারণ : বে খবরদি চান্দে জো খোদ বেখবর।
আয়েব পছন্দান্দ বোজ আম হুনুর।
অনুবাদ : সমস্যা অজ্ঞ উদাসীন ভ্রান্ত ধারণায়,
দোষারোপ করে তারা জ্ঞানীর কথায়।

আরে নামাজ তো এক প্রকার শাসন প্রক্রিয়া। বান্দার সত্তা ও গুণাবলিতে তার মাবুদের জন্য যা কিছু মজুদ আছে নামাজভুক্ত কার্যাদির মাধ্যমে তা সবই প্রকাশিত ও নিবেদিত হয়। বান্দার সত্তা ও গুণাবলি নিবেদনের এ এক বিস্ময়কর পদ্ধতি। এখানে বাঁশি ও সারেঙ্গী যেমন অন্যের পেষণে বাজে ঠিক তেমনি আরদ্ধের পেষণে বান্দার যা কিছু আছে সবই নিবেদিত হয়।
উল্লেখ্য, সুন্নত, মোস্তাহাব, ফরজ এবং ওয়াজেব সব বান্দার কার্যাদির অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি একটি সুন্নত নামাজও সম্পাদন করতে শুরু করে তাহলে তার জন্যও রুকু সিজদা ফরজ হয়ে যায়। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও নামাজের রীতিনীতি, কেরাত এবং সঠিক উচ্চারণ ওয়াজিব। এক্ষেত্রে ইবাদত শর্ত। এখানে নিয়ত করা ফরজ। সুন্দরভাবে কার্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা সুন্নত ও মোস্তাহাব। এগুলো সব বান্দার কাজ।
অনুরূপভাবে মিলাদের অনুষ্ঠানে বরকতের উদ্দেশে যখন রাসূলের (সাঃ) জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়, তখন মোস্তাহাব, সুন্নত, ওয়াজিব এবং ফরজ ইত্যাদি সুন্দরভাবে পালন করতে হয়। যেমনি পালন করতে হয় মুরব্বি ও বুজুর্গদের সামনে নেহায়েত আদবের সাথে বসা ও দাঁড়ানোর মতো কার্যক্রম। নবীর মিলাদ অনুষ্ঠানে নবীর আদব এবং বেলায়েতের অনুশাসন পালন করা ওয়াজিব ও ফরজ। উত্তমরূপে তা পালন করা অর্থাৎ, উত্তম স্থানে উত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করে উত্তম আওয়াজ ও মনোমুগ্ধকর কণ্ঠে ভালো আলোচনা এবং আনন্দঘন পরিবেশে ইত্যাদির প্রতি যত্নসহকারে মিলাদের অনুষ্ঠান করা সুন্নত ও মোস্তাহাব হলেও এতে ফরজের ফজিলত রয়েছে। এতসব কিছুর পরও কেয়ামের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার মাধ্যমে পরম সৌজন্য ও সম্মানবোধ প্রকাশ পায়।
উল্লেখ্য, রূহ্ যখন আপন বৈশিষ্ট্য মোতাবেক পরস্পর মুখোমুখি হয় তখন যে সব বান্দা সাক্ষাৎ ও দর্শন পর্যায়ে বিকশিত, তাদের উপর রূহের ফায়েজ ও বরকত প্রকাশ পেতে থাকে। যেমন আন্তরিক বন্ধুর বিরহের কথা স্মরণ হলে তার মধ্যে শোক ও মাতম সৃষ্টি হয়, সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর বিরহ বেদনায় অস্থির করে ফেলে। একথা কে না জানে? বরং একথা জানে না পৃথিবীতে এমন মানুষ বিরল। লক্ষণীয় যে, কেউ যদি নিজের কোনো দেখা শহরের ছবি কল্পনা করে তার মনের পর্দায় সে শহরের দৃশ্যাদি স্পষ্ট দেখতে পায় এবং সেই শহরের বিস্তারিত বিবরণ সে নির্ভুলভাবে বলতে পারে ও তাতে কোনো প্রকার মিথ্যা বা ভুলের অবকাশ থাকে না। অনুরূপভাবে কেউ যদি আলিফ, বে, তে শিখে এবং সে অক্ষরগুলো লিখতে চায় তাহলে উক্ত অক্ষরগুলোর যে ছবি তার মনে আসবে হুবহু তাই সে লিখবে অথবা পড়বে। ঠিক তেমনি অতি সূক্ষ্ম নূরময় রুহ যাকে কোনো পর্দা আড়াল করতে পারে না এবং যা সারা বিশ্বে সদা বর্তমান কেয়ামের ফলে কেয়ামের সময় তা প্রতিভাত হয়। কারণ এ কেয়াম নবির আদব এবং মহব্বতের গোপন প্রকাশের দলিল। এটা ফরজ এবং ওয়াজিব থেকে উত্তম। এতে কোনো মিথ্যা বা মন্দের লেশ নেই। এটা নবুয়ত সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ প্রমাণ।
বৎস, তুমি কি কখনো টেলিগ্রাফ দেখনি? তা কত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়। রূহের ক্ষমতা কি এর চেয়েও কম? মিয়া! যদি ফুল হওতো সুগন্ধি ফুল হও, কাজে আসবে।

প্রশ্ন নং ২৩
বসার মাধ্যমেই তো সম্মান প্রদর্শন হয়, আরও সম্মান প্রদর্শনের তাৎপর্য কী?

উত্তর : সম্মান প্রদর্শনের সাথেও বান্দার শারীরিক কার্যক্রম ও মানসিক অবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। যেমন মুখের সম্মান প্রদর্শন হল মুখে বলা ও হাসিখুশি চেহারা। চোখের সম্মান প্রদর্শন হল কান্না ও বিনীত দৃষ্টি। কানের সম্মান প্রদর্শন হল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা। হাতের আদব হল ইশারা করা এবং বক্ষ ও কোমরে হাত বান্ধা ইত্যাদি। তেমনি মিলাদের অনুষ্ঠানে দাঁড়ানোর মাধ্যমে পায়ের দ্বারা সম্মান দেখানো হয়। এটা কেন নিষেধ হবে? তাহলে কি পা ভেঙে দিতে হবে? কোরানে তো জিকিরের ক্ষেত্রে কেয়ামের উল্লেখ রয়েছে। বলা হচ্ছেÑ
فاذكروا الله قياما وقمعودا وعلى جنوبكم ج
“ফাজ কুরুল্লাহা কিয়ামাওঁ ওয়া কুউদান ওয়াআলা জুনুবিকুম।”
অর্থাৎ, “তোমরা আল্লাহ্র জিকির কর দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায়।” (সূরা নিসা-১০৩) উক্ত তিন অবস্থায় অথবা এর যে কোনো অবস্থায় আল্লাহ্র জিকির হতে পারে। এতে প্রমাণিত হয় যে, দাঁড়ানো, বসা এবং শয়ন ইত্যাদি আল্লাহ্কে স্মরণ করার উপাদান। এগুলোর অবলম্বন ছাড়া আল্লাহ্র জিকির বা স্মরণ সম্ভব নয়। বস্তুত এগুলোর অবলম্বন ছাড়া কোনো কাজই সম্পন্ন হতে পারে না। কোনো জ্ঞানী লোককে বলত যে, দাঁড়ানো, বসা বা শোয়া চলবে না। বসা থাকলে দাঁড়ানো চলবে না, আর দাঁড়ানো থাকলে শয়নে যেতে পারবে না। আর শোয়া বা বসা থাকলে দাঁড়াতে পারবে না। এসব কথা কেউ গ্রহণ করবে না। কারণ ধর্মীয় অথবা জাগতিক কোনো কাজই এই তিন অবস্থা ছাড়া সম্পাদন করা সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় মিলাদ অনুষ্ঠানে কিয়াম ইত্যাদি নিষেধ বা হারাম হয় কী করে? এ ধরনের মনগড়া কথাবার্তা কিসের ভিত্তিতে বলে তা আমাদের জানা নেই।

প্রশ্ন নং ২৪
মিলাদ, কেয়াম, ফাতেহা, নেয়াজ এবং কোরান ও তাসবিহ্ খতম ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদি যা ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাকে ফরজ বা ওয়াজিব মনে করে সর্বদা আদায় করা হচ্ছে, এটা কি মাকরুহ কাজ হচ্ছে না?

উত্তর : যা ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাকে ফরজ বা ওয়াজিব মনে করা হচ্ছে, এ অভিযোগ সত্য নয় বরং মিথ্যা। যা ফরজ বা ওয়াজিব নয় এটা যে জানে, সে কি কখনো তাকে ফরজ বা ওয়াজিব করতে পারে? না জেনে যা ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাকে কেউ যদি ফরজ বা ওয়াজিব মনে করে, সেটাতো তার অজ্ঞতা। সুতরাং নিজের অজ্ঞতার কারণে কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ করে যে, যা ফরজ নয় তাকে ফরজ মনে করা হচ্ছে, এটাতো নিছক বিভ্রান্তি ছড়ানো বৈ কিছু নয়। জানি না যা ফরজ নয় তাকে ফরজ মনে করা হচ্ছে এ অভিযোগের উৎস কোথায়? তবে উক্ত কার্যাদিতে ফরজ, ওয়াজেবের চেয়ে অধিক কল্যাণ ও ফজিলত রয়েছে। উক্ত কার্যাদির দ্বারা যেসব কল্যাণ ও বরকত লাভ হয় তা ফরজের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বহুবিধ কল্যাণ ও বরকতের উৎস। যা ব্যতীত ফরজ, সুন্নত সবই নিষ্ফল। কারণ সেটাই সকল কর্মের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য হাসিলের আশাতেই সব ভালো কাজ করা হয়।
বস্তুত প্রশ্নে উল্লিখিত কাজগুলো ফরজ, সুন্নত ইত্যাদির মূল বটে। এগুলোতে অবশ্যই অনেক কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। এমতাবস্থায় এগুলোর গুরুত্ব ফরজের চেয়ে কম নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে এর একটি মাত্র ফজিলত শত ফরজ, ওয়াজেবের চেয়েও উত্তম। কারণ এসব কাজের ফজিলত স্থায়ী এবং তাছাড়া মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই।
উল্লেখ্য, লোকের সাথে ভালো কথা বলা সর্ব-নিম্নতম ভালো কাজ আর এটা সব সময়ই ভালো। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে মন্দ কথাও কি বলা দরকার? অপরদিকে কোরান পাঠে মধুর কণ্ঠ, মিষ্টি সুর এবং বিশুদ্ধ পাঠরীতি ইত্যাদি বেশ প্রশংসনীয় এবং সুন্দর জিনিস। এগুলো মোস্তাহাব ও সুন্নত। এমতাবস্থায়, সর্বদা মধুর কণ্ঠে, মিষ্টি সুরে ও বিশুদ্ধ পাঠরীতিতে কোরান পাঠ করা অথবা সুন্দর সুশ্রী অক্ষরে কোরান লেখা কি দোষের হবে? না নিষেধ হবে? মাঝে মাঝে কি কর্কশ সুরে অশুদ্ধ উচ্চারণে কোরান পাঠ করতে হবে? না অসুন্দর অক্ষরে তা লিখতে হবে? তা না হলে কি কোরান পাঠ বা তা লেখা মাকরুহ হবে? সর্বদা সুন্দর সুশ্রী অক্ষরে কোরান লেখা কি নিষেধ? এটা কে না জানে যে, সাধারণভাবে পাঠ্য একটি অজিফাও যদি সর্বদা পাঠ না করা হয় তাহলে তাঁর যোগসূত্র থাকে না এবং এর ফলে উক্ত অজিফার ফায়েজ বা শুভপ্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত এর কোনো উপকারিতাই আর থাকে না। নির্ধারিত অজিফা সর্বদা পাঠ করতে হয় এবং সব সময়ে অন্তরে আল্লাহ্র জিকির স্মরণ জারি রাখতে হয়। এগুলো মাঝে মাঝে করলে কোনো উপকার হয় না। তোমরা তো মাদ্রাসায় যাও এবং লাগাতার যাও। তাও ছেড়ে দাও এবং মাঝে মধ্যে যাবে।
আরে মিয়া! মিলাদ, ফাতেহা এবং নেয়াজ ইত্যাদির মাহফিল তো মাঝে মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক দিন তো আর হয় না। অথচ তোমরা এসব নিয়ে সারাক্ষণ বক বক করছ। এগুলো নিয়ে আলোচনা না করে পার না? এ ধরনের বকবকানি তো হারামের চেয়েও ক্ষতিকর। এ ধরনের বকবকানি, সমস্ত পুণ্য কর্মের প্রধান দ্বার যে অন্তর তাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়।

প্রশ্ন নং ২৫
কোনো কোনো ফেকার কিতাবে উপরে আলোচিত বিষয়গুলোকে মাকরুহ বলা হয়েছে। এর উত্তর কী?
উত্তর : ঐ সব কিতাব তাকে তুলে রাখো। কারণ যাদের ফেকাহ্ শাস্ত্রের পরিভাষা, মতভেদ এবং আলোচ্য বিষয়গুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছ জ্ঞান নেই, তারা যদি কোনো বিষয়ে বাহ্যদৃষ্টিতে কিছু বলে তা অর্থহীন এবং গ্রহণযোগ্য নয়। উল্লেখ্য, ইমাম মালেক (রঃ) এবং ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল (রঃ) সাপ ও গুইসাপ হালাল বলেন এবং ইমাম আবু হানিফা বলেন এগুলো খাওয়া হারাম। এখন বলো এটা কোন ধরনের হারাম? এটা যে জানে না তার মুফতি সেজে ফতুয়া দেওয়ার অধিকার নেই। শুধু তাই নয়, ‘ফতোয়ায়ে সিরাজিয়া’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, এ শ্রেণীর ফতোয়া দাতার ওপর আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদের তরফ থেকে অভিশাপ বর্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর একটি বাণীর বরাত দিয়ে একথা লেখা হয়েছে।

প্রশ্ন নং ২৬
যে কোনো খতম এবং মিলাদ শরীফ ইত্যাদি নানা ধরনের অনুষ্ঠানাদি পরিচালনায় অংশগ্রহণকারীগণ যে টাকা-পয়সা গ্রহণ করেন, তা কি বৈধ পারিশ্রমিক না নিষিদ্ধ অথবা হারাম?

উত্তর : এটা না হারাম না নিষিদ্ধ। কারণ এটা আল্লাহ্র উদ্দেশে আল্লাহ্র পথে খরচ। যার পক্ষে সম্ভব তিনি গ্রহিতাকে তা দান করেন। এমনকি এ উপলক্ষে রুটি, খাদ্য, পানীয় এবং পান-তামাক, পোশাক-আশাক, টাকা-পয়সা, ইত্যাকার যা কিছুই খরচ হয় তা সবই আল্লাহ্র উদ্দেশে আল্লাহ্র পথে দান। এসব পারিশ্রমিক নয়। পারিশ্রমিকে প্রস্তাব ও গ্রহণ শর্ত। অর্থাৎ, মিলাদ বা খতম পরিচালক এ কাজের জন্য যদি কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাবি করে আর মিলাদ বা খতমের আয়োজক যদি সে দাবি মেনে তাকে কোনো টাকা-পয়সা প্রদান করে তাহলে তা নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন নং ২৭
নবী-অলী এবং পুণ্যবান বান্দাগণ কখনো কাফের হন কি? কখনো তাদের ঈমান নষ্ট হয় কি?

উত্তর : না, তাঁরা অবশ্যই কখনো কাফের হন না। কারণ তাঁদের ঈমান মৌলিক এবং তাঁরা হাকিকি ঈমানের অধিকারী যা কখনো তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা হয় না। ঈমান তাঁদের অন্তরে প্রবেশ করে গেছে এবং তা মিশে গেছে তাঁদের সমগ্র সত্তায়। সুতরাং তা আর যাওয়ার নয়।

প্রশ্ন নং ২৮
বার বার যারা ঈমান আনে আবার কাফের হয় এবং শিরক করে আবার তওবা করে এবং কলেমা পড়ে এটা কোন ঈমান এবং কী ধরনের কাজ?

উত্তর : আরে বুদ্ধিমান সাহেব! ঈমান কি কোনো গোখাদ্য যে, যেমন খরিদ তেমন বিক্রি হবে অথবা যেমন মহাজন তেমন খরিদ্দারের মতো। ঈমান আসা-যাওয়ার কথা যারা বলে তাঁরা যেন নতুন নতুন চালানে ঈমান ও আমল আমদানি ও রপ্তানির কাজ করেছে। তা না হলে, ঈমান যায় আবার আসে কী করে? বাংলা ভাষায় একটি মশহুর প্রবাদ আছেÑ
চালাকের ধোকা ঔজ্জ্বল্ল ঠক,
থুক দিয়ে আটক করে বক।
অর্থাৎ, “ঠকের জিনিস কাঁচের মতো চক চক করলেও আসলে তা মাটির পুতুল।”
প্রশ্ন নং ২৯
ফেকাহ্ গ্রন্থাদিতে কুফর অর্থে ব্যবহৃত বাক্য দ্বারা প্রকৃত কুফর এবং কাফের প্রমাণিত হয় কি?

উত্তর : ফেকাহ্র গ্রন্থাদিতে কুফর অর্থে ব্যবহৃত বাক্য দ্বারা ঈমান বিনষ্টকারী কারণাদি বর্ণনা করা হয়। এটা ঠিক আছে। কিন্তু ঈমান কি জিনিস এবং তা কিভাবে অর্জিত ও স্থায়ী হয় সে কথাতো ফেকাহ্র কিতাবাদিতে নেই। তাহলে যার আমদানি নেই তার রপ্তানি কোথা থেকে হয় তাতো আমাদের জানা নেই। এমনকি ফেকাহ্র কোনো কিতাবে ঈমান, ঈমানের উৎস এবং ঈমান কাকে বলে তার কোনো বর্ণনা নেই। কোথাও যদি এসব বিষয়ে কিছু আলোচনা হয়েও থাকে তাও হয়েছে নেহায়েত প্রসঙ্গক্রমে। মূল বিষয় হিসেবে নয়। এ ধরনের মৌলিক বিষয়ে নেহায়েত প্রাসঙ্গিক আলোচনা বিবেচনার যোগ্য নয়। বরং ফেকাহ্বিদগণ উক্ত বিষয়াদি সংক্রান্ত আলোচনা তাসাউফবিদদের উপরই ছেড়ে দিয়ে থাকেন। কারণ ঈমান সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ের সুস্পষ্ট এবং সঠিক বর্ণনা তাসাউফবিদদের পক্ষেই সম্ভব। ‘দূররে মুখতার’ এবং ‘শামী’ ইত্যাদি কিতাবে আছে কুফর অর্থে ব্যবহৃত বাক্যাদি দ্বারা কাফের সাব্যস্ত হয় না। বরং তাতে যেসব কারণে কাফের হতে পারে তার কোনোটিকে বোঝায়। কুফরি কথা বললেই কাফেরি সাব্যস্ত হয় না। বরং কুফরটাই সাব্যস্ত হয়। এবং কুফর সাব্যস্ত হওয়াতে কেউ কাফের হয় না। বরং কুফর হওয়ার উদ্দেশে কুফরি কথা বললে সে কাফের হয়।
প্রশ্ন নং ৩০
মোমিন ব্যক্তি আল্লাহ্কে দেখেন কি না; যদি দেখেন তাহলে সে দেখাটা কী বা কী রকম?

উত্তর : মুমিনের ঈমানি চোখের দৃষ্টি যখন প্রসারিত হয়, তিনি তখন আল্লাহ্কে দেখতে পান। তিনি যদি তাকে না দেখেন তাহলে কার ওপর তিনি ঈমান আনলেন? তবে কাফের আল্লাহ্কে দেখতে পায় না। উল্লেখ্য, ঈমানি চোখের দৃষ্টি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বপ্ন, কাশ্ফ (স্বর্গীয় প্রেরণা), এলহাম (স্বর্গীয় বাণী) এবং বোধিজ্ঞান সহায়ক অনুসঙ্গি ও উপাদান হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, ঈমানের অনুশাসনের আওতায় স্বপ্ন ও কাশ্ফযোগে মুমিন আল্লাহ্কে দর্শন করেন। ঈমানি নূরের কিরণের গুণে অর্জিত কাশ্ফ তথা অতি প্রাকৃত বোধিলোকে আল্লাহ্কে তাঁর সত্তা ও গুণাবলি সহকারে দেখা যায়। অনুরূপভাবে এলহামি দৃষ্টি তথা আল্লাহ্র তরফ থেকে প্রাপ্ত প্রজ্ঞালোকে ও আল্লাহ্কে তাঁর সর্বত্র প্রকাশিত ও সবকিছুতে আবিষ্ট সত্তা ও গুণাবলি সহকারে দেখা যায়। এ ঈমানী চোখ এবং এলহামি দৃষ্টি বাহ্য চোখের উৎস। অতএব বাহ্য চোখের উৎসমূলে যা পরিপূর্ণরূপে পরিদৃষ্ট হয় তারই সম্প্রসারিত দৃষ্টিতে বা বাহ্য চোখে তাকে দেখা যাবে না কেন? হ্যাঁ, মূল চোখ তথা কাশ্ফ শক্তি এবং এলহামি দৃষ্টি যার নেই তার পক্ষে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, কোনো কিছু দেখতে হলে দৃষ্টির মূল উৎস থেকে দৃষ্টি ধ্যানলোকে প্রসারিত হয়ে মূলের সম্প্রসারিত দৃষ্টি শাখার মাধ্যমে তা বাহ্যদৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়। দৃষ্টিশক্তির উৎস থেকে দেখার সূত্রপাত্র হয়। তা না হলে চক্ষু থাকলেও দেখা যায় না।
ঈমানি চোখের দৃষ্টি সক্রিয় ও প্রসারিত হয়ে ঈমানদারের বাহ্য চক্ষুকে সক্রিয় করে। তাই তাঁর উৎস থেকে উৎসারিত দৃষ্টি সমেত বাহ্য চোখে দেখা মূল চোখের দেখা বলেই গণ্য হয়। মূল থেকে দৃষ্টি যখন অন্তর্দৃষ্টিতে আসে তখন তা দ্বারা দুনিয়াতে আল্লাহ্কে দেখাই মুমিনের কাজ। আর তাকে না দেখা বা তাকে দেখা অপছন্দ ও অস্বীকার করা কাফেরের কাজ। তাই কোরান ঘোষণা করছেÑ
من كان فى هذه اعمى فهو فى الاخرة اعمى واضل سبيلا *
“মান কানা ফি হাজিহি আমা ফাহুয়া ফিল আখিরাতি আমা ওয়ায়াদাল্লু সাবিলা”
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অন্ধ সে পরকালেও অন্ধ এবং পথভ্রষ্ট।”
(সূরা-বনী ইসরাইল, ৭২)
উক্ত আয়াত দ্বারা দু প্রকার গোমরাহির কথা জানা গেলÑ এক অন্ধত্ব এবং দুই পথভ্রষ্টতা। পথভ্রষ্টতা অর্থ কুফরির দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়া। এ থেকে অন্ধত্ব আসে। এ আয়াতের আসল ব্যাখ্যা এই যে, অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে প্রদীপ্ত ও আলোকময় হওয়া যায় দুভাবে। এক ঈমানি দৃষ্টি আর দুই হাকিকি দৃষ্টি। ঈমানি দৃষ্টির প্রসারিত আলোকে আল্লাহ্ ও তাঁর গুণাবলি এবং কার্যাদি দেখা যায়। আর হাকিকি দৃষ্টি দ্বারা আল্লাহ্্র সত্তা ও তাঁর প্রকৃতি অবলোকন করা যায়। সুতরাং ঈমানী দৃষ্টি সক্রীয় ও স্বচ্ছ সে তো ঈমানদারির সাথেই বলবে এবং বলবেই যে, তিনি আল্লাহ্কে দেখেছেন বা দেখছেন। আর যার তা নেই সে তো এ দাবি করবে না। তবে শুভচেতনার বশে সে যদি অন্যের দেখার কথা স্বীকারও করে তা হবে তাকলিদ বা পরানুস্মরণ। আর নিজে দেখে না বলে অন্যের দেখাকে অস্বীকার করার অর্থ হবে অন্যের প্রতি মিথ্যারোপ করা। অপরদিকে যার ঈমানি চক্ষু খোলা নেই সে নবজাত চড়ুই পাখির বাচ্চার মতো দেখার জন্য ছটফট করবে। সুতরাং তাকে কাফের বলা যাবে না।
প্রশ্ন নং ৩১
কেউ কেউ বলে আল্লাহ্কে বাহ্য দৃষ্টিতে দেখার প্রমাণ নেই?

উত্তর : বস্তুত এ একটি অর্থহীন প্রশ্ন। অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি মূলত বাহ্য চোখের মাধ্যমে প্রকাশ হয়। স্বপ্ন ও কাশ্ফ ইত্যাদি বাহ্য চোখের দেখা না হলেও বস্তুত তা বাহ্য চোখের মূলেরই সম্প্রসারিত দৃষ্টি। অর্থাৎ, বাহ্য চোখে অন্তর্দৃষ্টির সম্প্রসারণ শেষ হলে এর মূল থেকে স্বপ্নের প্রকাশ ঘটে। আর নিদ্রাচ্ছন্ন চোখ নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়লে মূল থেকে কাশ্ফ দৃষ্টি সক্রিয় হয়। আর কাশ্ফের প্রকাশ পর্যায়ের সমাপ্তি হলে মূল থেকে এলহামের নূর প্রদীপ্ত হয়। আর এর ক্ষমতা যেখানে শেষ সেখানে প্রদীপ্ত হয় নূরে হাকিকত অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টি।
বিষয়টা এ রকম যে, গাভীর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা এর সত্তার মধ্যে বর্তমান। বের হওয়ার সময় হলেই কেবল তা বের হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, যার মধ্যে যা নেই, তার থেকে সে জিনিস কখনো বের হবে না। উদাহরণস্বরূপ যে বীজে বৃক্ষের মূল, কান্ড আর শাখা-প্রশাখা মজুদ নেই, কখনো তা থেকে এসব বের হয় না। এটাই সমস্ত বস্তুর মৌলিক ও পরিপূর্ণ অবস্থা বিভিন্নভাবে যার প্রকাশ চলছে। চক্ষু, কর্ণ, নাক, জিহ্বা প্রভৃতি সবই পানির মতো। কারণ এগুলোর মাধ্যমে সব কার্যাদি প্রতিবিম্বিত হয়। যথাÑ দেখা ও দৃষ্টির দ্বার চক্ষু, শ্রবণের দ্বার কান, শোঁকার জন্য নাক এবং স্বাদ গ্রহণের জন্য মুখ। এগুলোর মূল এক এবং এরা পরস্পর শাখা-প্রশাখা। এ কারণে মূল ও শাখার মধ্যে পারস্পরিক যোগ সম্পর্ক অপরিহার্য।
মূল বিনে যেমন শাখা অসম্ভব তেমনি মূলের জন্য শাখা অবশ্যম্ভাবী। এ কারণে শাখার মধ্যে মূলেরই প্রকাশ ঘটে। তাই শাখাও মূলই বটে। শাখার মাধ্যমে প্রকাশিত বস্তু মূলের সূত্রেই পরিচিত হয়। পুণ্যবান এবং প্রদীপ্ত অন্তরের অধিকারী ব্যক্তিত্বের আল্লাহ্ দর্শনের ক্ষেত্রেও এ একই নীতি প্রযোজ্য। তারা আল্লাহ্কে বাহ্য চোখে এবং মৌল চোখে দেখেন। স্বপ্ন এবং কাশ্ফ-এর অন্তর্ভুক্ত। এ শ্রেণীর বুজুর্গদের বেলায় ইহকাল এবং পরকাল সমার্থবোধক। হযরত রাসূলে করিম (সাঃ)-এর বাণী মোতাবেক তাই হয়। তিনি বলেন, موتوا قبل ان تموتوا “মোতু কাব লা আন তামুতু” অর্থাৎ, “মরণের পূর্বেই মর।” অতএব জীবিত অবস্থাতেই তারা মৃতবৎ হয়ে যান। ফলে সর্বদা তারা মরণের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল থাকেন। এজন্য তাদের জীবন-মরণের কোনো পার্থক্য নেই। তাঁদের দুনিয়ার জীবন মৃত্যুতুল্য। আর তাঁদের দুনিয়ার মৃত্যু যেন প্রকৃত জীবন লাভ। এমর্মেই কোরানে বলা হচ্ছে-
لاتحسبن الذين قتلوا فى سبيل الله امواتا ط بل احياء عند ربهم يرزقون *

“লা তাহছাবান্নালাজিনা কোতিলু ফি সাবিলিল্লাহ আমওয়াতান বাল আহ্ ইয়ায়ুইনদারাব্বি ইয়ারজুকুন।”
অর্থাৎ, “আল্লাহ্র পথে শহীদদের তুমি মৃত মনে ক’রো না। বরং তাঁদের পালনকর্তার নিকট তাঁরা জীবিত এবং জীবিকাপ্রাপ্ত হয়ে আরামে আছেন।” (আল ইমরান-১৬৯)।
মোট কথা, যারা আল্লাহ্র পথে জীবন তলোয়ারে শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে মৃত মনে ক’রো না বরং তাঁরা জীবিত এবং জীবিকাপ্রাপ্ত হয়ে আনন্দিত আছেন। সুতরাং মুমিনকে মৃত মনে করা আর মৃত্যু হলে জীবিত মনে করা একই কথা এবং যথার্থ। এমতাবস্থায়, মুমিন বাহ্যচক্ষু অথবা কাশ্ফ ইত্যাদি যেকোনোভাবে আল্লাহ্কে দেখতে পান এবং তাকে দেখতে দিন। হাদিস শরীফে আছে, মুমিনগণ কেয়ামতের দিন আল্লাহ্কে পূর্ণিমার চাঁদের মতো দেখবেন। সুতরাং দুনিয়াতেও তাঁদের অনুরূপ দেখতে দিন। তোমরা যারা তা বিশ্বাস করো না, তারা বাদুরের মতো চক্ষু বন্ধ করে থাক। তবে, من كان فى هذه اعمى فهو فى الاخرة اعمى
“মান কানা ফি হাজিহি আমা ফাহুয়া ফিল আখিরাতি আমা।”
অর্থাৎ, “এখানে যারা অন্ধ পরকালেও তারা অন্ধ থাকবে।”
কোরানের এ বাণী যাদের সম্পর্কে ঘোষিত হয়েছে তাদের দলভুক্ত হয়ো না। এবং নবী-অলীগণকে মৃত মনে করে তাঁদের নিকট নিজের বাসনা প্রার্থনা তথা তাঁদের তাবেদারি করার সৌভাগ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত ক’রো না।

প্রশ্ন নং ৩২
কারো কারো প্রশ্ন যে, হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ্কে দেখতে পাননি, এমতাবস্থায় অন্য কারো পক্ষে কী করে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব?

উত্তর : আরে মিয়া! তোমরাতো বড় সংশয় সৃষ্টিকারী। আল্লাহ্ বলেনÑ
من كان فى هذه اعمى فهو فى الاخرة اعمى
“ফালাম্মা তাজাল্লা রাববাহু লিলজাবালি জায়ালাহু দাক্কাওঁয়াখাররা মূসা ছায়াঈকা।” অর্থাৎ, “তার প্রতিপালক যখন পাহাড়ে জ্যোতি বিকিরণ করেন পাহাড় বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং মূসা (আঃ) বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়।” (সূরা আরাফ, ১৪৩) কোরানের অর্থ বোঝেন এমন কারও কাছে বুঝে নাও এখানে তাজাল্লী তথা জ্যোতি বিকিরণ বলতে কী বোঝায়? আর এ জ্যোতি বিকিরণের পর মূসা (আঃ) আল্লাহ্কে দ্বিতীয় বার দেখতে চেয়েছিলেন কিনা বা ঐ ঘটনার পর মূসা (আঃ)-এর আল্লাহ্্কে দেখার বাসনা মিটে গিয়েছিল কিনা? যারা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী তাদের এরূপ বাসনা হয় না। মসনবী শরীফে তোমরা পড়নি যে, জনৈক ব্যক্তি তার মাশুক আল্লাহ্কে উদ্দেশ করে বলছিল যে, আমি তোমাকে পেলে সিঁথি করে দিতাম, নথ পরাতাম, কানে কর্ণফুল পরাতাম এবং হাতে চুড়ি পরাতাম ইত্যাদি। এ সময়ে হযরত মূসা (আঃ) পিছন থেকে এসব কথা শুনছিলেন এবং বললেন যে, আপনি কুফরি কথা বলছেন। হযরত মূসা (আঃ)-এর কথায় তাঁর মধ্যে অত্যধিক বিচ্ছেদ-বেদনা সৃষ্টি হয় এবং তিনি জঙ্গলে চলে যান। পরে মূসা (আঃ) যখন আল্লাহ্র সাথে কথা বলতে যান তখন আল্লাহ্ তাঁকে আশেক বিচ্ছেদে ধমকাতে থাকেন। এ ধমকের কথাটি হযরত মাওলানা রুমী বর্ণনা করেছেন এভাবেÑ
از براى وصل كردن امدى
نه براى فصل كردن امدى
“আজ বরাইয়ে অছল কারদান আমদি।
না বরায়ে ফছল কারদান আমদি।
এসেছ কি তুমি মানস মিলনে,
না, এসেছ তুমি বিচ্ছেদ সাধনে।”
অর্থাৎ, আমার আন্তরিক আশিক যেভাবে আমার সাথে কথা বলে, তাই আমার মিলনের পথ; তুমি তাতে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছ।
এ প্রসঙ্গ মাওলানা রুমী বলেনÑ
استلاح هندى را هند هند
استلاح سنديه راسندرهند
ইসতালাহে হিন্দে ইয়ারা হান্দ হিন্দ।
ইসতালাহে ছান্দে ইয়ারা ছান্দে হিন্দ।
হিন্দি সিন্দি কথা বলে তার আপন ঢঙ্গে।
আশেক আপন কথা বলে তার প্রেমের ঢঙ্গে।
অর্থাৎ, আশিক আপন প্রেমের ঢঙে কথা বলেন আর আবেদ কথা বলেন নিজস্ব অবস্থার প্রেক্ষিতে। এখানে লক্ষণীয় যে, বিষয়টি বেশ গুরুতর এবং পয়গাম্বর (আঃ) পর্যন্ত এখানে নীরব রইলেন।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যখন তিনি আল্লাহ্কে দেখতে চান তখন তিনি প্রেম ইশক সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এবং তখনও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয়নি ও উন্মোচিত হয়নি তাঁর নিকট হাকিকতের পূর্ণরূপ। জ্যোতির বিকিরণে পাহাড় জ্বলে পুড়ে চোখের জ্যোতি সুরমায় পরিণত হয়। তাতে কি হযরত মূসা কালিমুল্লাহ এবং সাথীবৃন্দ জ্যোতিপ্রাপ্ত হননি? বস্তুত সেদিন থেকেই হযরত মূসা কালিমুল্লাহর অন্তর্দৃষ্টি লাভের পথ এবং বেলায়েতের শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান হতে শুরু করে। এটা আল্লাহ্্ তায়ালাকে পরিপূর্ণরূপে দেখার স্তর। এটা আল্লাহ্্কে দেখার বাসনা প্রকাশের অনেক ঊর্ধ্বের স্তর। ربى ارنى (রাব্বি আরিনি) অর্থাৎ, “আল্লাহ্ আমাকে দেখা দাও” Ñ এতো হল দুধের শিশুর চাহিদার মতো। আরে মিয়া সত্যের পূজারী, আল্লাহ্ যদি তোমাকে প্রেম প্রবাহে অনুপ্রাণিত করেন আর তাতে যদি তোমার চর্ম চোখের দৃষ্টি প্রসারিত হয় তাহলে তুমিও স্পষ্টতই আল্লাহ্ এবং তাঁর পূর্ণরূপ দেখতে পাবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখবে যে, হাজারও অন্ধের আনুমানিক বক্তব্যের চেয়ে একজন দৃষ্টিমানের দেখা কথাই যথেষ্ট এবং অকাট্য।
প্রশ্ন নং ৩৩
সিজদায় জমিনে মাথা লাগানো হয় এবং কা’বার উপর লাগানো হয় না?

উত্তর : জমিন বুজুর্গ তথা সম্মানিত এবং আল্লাহ্র এক মহান নিদর্শন। এরই রহস্যলোক থেকে কিবলা, কা’বা, মসজিদ, দরগাহ এবং খানকাহ্ প্রভৃতি প্রকাশ হয়। এমনকি আদম রহস্যও জমিনেরই অন্যতম প্রকাশ। জমিন থেকেই হযরত আদম (আঃ) এর সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, নবী-অলীগণও জমিনেরই দৃশ্যপট। জমিনের কল্যাণেই জমিনবাসীর জীবন-মরণ, জ্ঞানবুদ্ধি, দান-দয়া ও প্রজ্ঞা, রহস্যাদি, খেলাফত এবং আধ্যাত্মিক পরম পরিচয় লাভ হচ্ছে। এর বুজুর্গি এজন্য যে, ইবাদতের সময় হাজারও উন্নত শির এতে অবনত হয়। উপরন্তু জমিনবাসীর বুজুর্গি, উন্নতি এবং জীবন-মৃত্যু সবই জমিনের পোশাকে আবৃত। এ জমিন তাঁর বাসিন্দাদেরকে মাতৃচাদরের মতো তাবত সম্ভ্রম দান করছে, সম্পদ ও আহার যোগাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র বস্তুটিও সে আল্লাহ্র কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে। অনেকেই হয়ত এ সম্পর্কে খবর রাখে না, সিজদায় জমিনে কেন মাথা লাগানো হয়? জন্মে আর জীবনে এমনকি মৃত্যুর পরও এ জমিনে মিশে থাকবে। জমিন আমাদের আরাম ও সুখে রাখবে এবং ঘর ও আলো দান করবে। ফলে জমিনবাসী জমিনের সমস্ত গুণের সাথে একাত্ম হয়ে জমিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। সে সময়ে কিবলা সামনে থাকবে। এ জন্য কিবলা সদা সামনের দিকে হয়। এ একটি জ্যোতির বিকিরণের স্থান। যেন প্রদীপ্ত প্রদীপ। এ প্রদীপ ঈমানি নূরে নূরময়।

প্রশ্ন নং ৩৪
মেশকাত শরীফে র্শিক অধ্যায়ে কয়েকটি হাদিস রয়েছে, যেগুলোতে বলা হয়েছে আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে কিছু চাইবে না এবং একটি সুই বা সুতাও অন্যের কাছে চাওয়া র্শিক?

উত্তর : এ হাদিসগুলোর মর্মার্থ চূড়ান্ত এবং মৌল অর্থে প্রযোজ্য। সমস্ত বস্তু আল্লাহ্্র, আল্লাহ্ সব বস্তুর স্রষ্টা, দাতা এবং যাকে ইচ্ছা তা দিতে ও নিতে পারেন একথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। বর্তমানে এ কথা কারও কাছেই গোপন নেই এবং সকলেই এটা জানে। ধরুন কেউ যদি বলে যে, কোনো বস্তু আল্লাহ্র নয় এবং তিনি তা দেওয়ারও মালিক নন তাহলে এর প্রতিবাদে জ্ঞানী ও অজ্ঞ নির্বিশেষে হাজারও লোক দাঁড়িয়ে যাবে। সুতরাং একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, সব কিছুরই প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ্। তবে রূপক অর্থে যে বস্তু যার মালিকানাধীনে আছে সে বস্তুর দরকার হলে তার কাছে চাওয়া ওয়াজিব। যেমন দোকানদারের কাছে লবণ, তেল, কাপড় আরও যা যা দরকার চাইতে হবে। তা না হলে বাজারে গিয়ে কি আল্লাহ্র কাছে চাইবে যে, হে আল্লাহ্ আমাকে দু টাকার লবণ আর পাঁচ টাকার কাপড় দাও? আর চাইলেও কি আল্লাহ্ দিবেন? কখনই দিবেন না। বরং এটা বোকামি হবে। এ ধরনের কাজের দ্বারা মানুষকে বোকা হতে হয়। এ ধরনের বোকামি শরিয়ত অনুমোদন করে না বরং তা নিষেধ ও হারাম।
এমতাবস্থায় মেশকাত শরীফে উল্লিখিত আলোচ্য হাদিসগুলোর দু রকম ব্যাখ্যা হয়। প্রথমত প্রকৃত অর্থে, দ্বিতীয়ত রূপক অর্থে। প্রকৃত অর্থের ব্যাখ্যাটি ইতিপূর্বে আলোচিত হল। তবে রূপক অর্থে যে যার মালিক তার নিকট চাওয়া ওয়াজিব এবং ক্ষেত্রবিশেষে রূপক মালিককে বস্তুর মূল্য পরিশোধ করা ওয়াজিব।
অন্যথায় যদি মনে করা হয় যে, সবই আল্লাহ্র জিনিস আর আমরাও আল্লাহ্র বান্দা, তাই জিনিস নিয়ে গেলাম মূল্য আল্লাহ্কে পরিশোধ করব অথবা আল্লাহ্র নামে খরচ করব। অনুরূপ চিন্তা করে কেউ যদি কারও কোনো জিনিস নিয়ে যেতে চায় তাহলে তৎক্ষণাৎ সে ধৃত হবে এবং চোর হিসেবে গণ্য হবে। আর চোরের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন,
والسارق والسارقة فاقطعوا ايديهما *
“ওয়াছছারিকু ওয়াছছারিকাতু ফাক তোয়াউ আইদিয়াহুমা”
অর্থাৎ, “তোমরা চোর ও চোরনি উভয়ের হাত কেটে দাও।” (সূরা মায়েদা-৩৮) এমতাবস্থায় চোর বা চোরনি যদি বিচারককে বলে যে, হাদিসে আছে সব কিছুর মালিক আল্লাহ্ এবং অন্যের মনে করা বা অন্যের কাছে কিছু চাওয়া র্শিক। তাহলে বিচারক তাকে আহাম্মক ও বোকা বলবে এবং চুরি ও বোকামির জন্য তাকে শাস্তি দিবে। সুতরাং ঐসব হাদিসের সরল অর্থ গ্রহণ করে তা দ্বারা অন্যের নিকট কিছু চাওয়াকে র্শিক প্রমাণ করতে গেলে তাতে দুটি হারাম একই সঙ্গে সংঘটিত হয়। যথা হাদিসের প্রকৃত অর্থ নষ্ট করা একটি হারাম আর দ্বিতীয়টি হল চুরির মতো বোকামি করা।

প্রশ্ন নং ৩৫
উসিলা হিসেবে জমিনের মালিক ও নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ অন্যকে তা দান করতে পারেন কি না? এবং নেয়ামত প্রাপ্তির আশায় তাঁকে ডাকা বিধেয় কি না?

উত্তর : উসিলা হিসেবে জমিন ও অন্যান্য নেয়ামত যা আল্লাহ্র তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে তা থেকে জমিন ও অন্যান্য জিনিস আপন বংশধরকে দেওয়া যায়। এটা জমিনের মালিকানা। এ প্রক্রিয়ায় দুনিয়ার সমস্ত বস্তুতে মালিক মহাজনের অধিকার নীতি চালু রয়েছে। এভাবে ইহলৌকিক সমস্ত কিছুরই দ্বিতীয় পর্যায়ের মালিক জমিন অতঃপর জমিন যাকে যা দিয়েছে সে তার তৃতীয় পর্যায়ের মালিক। এভাবে ক্রমান্বয়ে স্তরে স্তরে মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। এমনি যে ব্যক্তি যে বস্তুর মালিক হয়, প্রয়োজনে তার নিকট সে বস্তু চাওয়া ওয়াজিব। এর অন্যথা করা হারাম ও নিষেধ। সুতরাং যাকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তার কাছে তা চাওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ মানুষকে সংশোধন করার বিদ্যা আল্লাহ্ মুর্শিদকে দান করেছেন। সুতরাং এর সাথে সম্পৃক্ত সব কিছু মুর্শিদের কাছে চাওয়া ফরজ।
উল্লেখ্য, চাওয়া দু প্রকার। প্রকৃত ও বাহ্যিক। বাহ্যিক চাওয়া যেমন বিপদ মুক্তির জন্য আছহাবে কাহাফের নাম লেখা, জপ করা, ডাকা। বস্তুত র্শিক স্থানীয় হলেও এগুলো র্শিক নয়। বরং তাতে আল্লাহ্রই কাছে দয়া ও আরাম প্রার্থনা করা হয়। এমনকি আছহাবে কাহাফের নামে সব রকম বিপদ দূর হয়। এ কথা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। লক্ষণীয় যে, আল্লাহ্র নামের বর্তমানেও আছহাবে কাহাফের নামের তাবিজ এবং অজিফাতে পুণ্য ও কল্যাণ এবং সাফল্য লাভ হয়।
অনুরূপ তাদের ডাকলেও পুণ্য ও বিপদ মুক্ত হয়। তাই বুজুর্গ পীর মুর্শিদকে পবিত্র উদ্দেশে ডাকলেও পুণ্য ও কল্যাণ লাভ হয়। কারণ তাঁরা আল্লাহ্তায়ালার ফায়েজ, রহমত ও নেয়ামতের অধিকারী। এজন্যই কোরানে বলা হয়েছেÑ
وابتغوا اليه الوسيلة *
“ওয়াবতাগু ইলাইহীল অসিলাতি।”
অর্থাৎ, “তোমরা উসিলা অšে¦ষণ করো।” এ আয়াতের মর্মার্থ মোতাবেক, নবী, অলীগণ জীবিত অথবা পরলোকগত। তাঁদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা ওয়াজিব। কারণ প্রকৃত অর্থে তাঁদের জীবন ও মৃত্যু সমার্থবোধক। নিম্নে উল্লিখিত কোরানের আয়াত দ্বারা তাই বোঝা যায়Ñ
لاتحسبن الذين قتلوا فى سبيل الله امواتا ط بل احياء عند ربهم يرزقون * فرحين *
“লা তাহসাবান্নাল্লাযিনা কুতিলু ফি সাবি লিল্লাহি আম ওয়াতান বাল আহইয়াউ ইনদা রাব্বি হিম ইউর জাকুন। ফারেহিন।”
অর্থাৎ, “শহীদদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না বরং তারা জীবিত; এবং খেয়ে দেয়ে আরামে আছেন।” (সূরা আল ইমরান-১৬৯)
প্রশ্ন নং ৩৬
কেউ কেউ বলে যে, সাধারণ লোকদের ভয় দেখানোর জন্য এসব হাদিস বলা হয়েছে। যাতে তারা র্শিক ও বেদাতের দিকে না যায়।
উত্তর : সত্যকে নিখাদ করার জন্য স্বচ্ছ গবেষণা প্রয়োজন। মিথ্যা দিয়ে সত্য প্রমাণ করা যায় না। সোনারূপার কেনাবেচায় সোনারূপাই থাকতে হবে। তাতে বারলি বিক্রি আর গম প্রদর্শনই হারাম। বস্তুত জনসাধারণের নিকট হালালকে হারাম হিসেবে প্রচার করা বড় পাপকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা পাপকর্ম। কারণ পক্ষপাতমূলক মাসলার কথাবার্তার কারণে দু পক্ষের মধ্যে পরস্পর দোষারোপ এবং বিরোধ থেকে মারামারি পর্যন্ত হয়। এটা কখনো বৈধ ও অনুমোদনযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের বাজে কাজের কারণে এক মুসলিম অপর মুসলিমকে মুশরিক ও কাফের বলছে। আর এসব কথার অনুসরণই হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ্র আদেশ মোতাবেক এ ধরনের মাসলা বা কথাবার্তা পরিহার করা ফরজ। আল্লাহ্ বলেন,
ولاتلبسوا الحق بالباطل *
“ওয়ালা তালবিসুল হাক্কা বিল বাতিলি।”
অর্থাৎ, “সত্যকে অসত্যের সাথে মিশ্রিত করো না।” (সূরা বাকারা-৪২)

প্রশ্ন নং ৩৭
আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলদের তাবেদারি কাকে বলে? এর মর্মার্থ কী? এবং কোন ব্যক্তি তাবেদার?

উত্তর : তাবেদারি একটি কলবি তথা আন্তরিক ক্রিয়া। যেমন বিশ্বাস বা ঈমান আনা অন্তরের একটি কাজ যা অনেক অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত এবং যা থেকে সকল শারীরিক ও মানসিক কার্য সম্পন্ন হয়। বস্তুত কল্ব তথা অন্তরই সকল অবস্থা ও কর্মের উৎস। মোট কথা, মনের সংযোগ ছাড়া কোনো কাজ সঠিক হয় না। অর্থাৎ, কোনো কাজের সাথে দৃঢ় বিশ্বাসরূপ মনের অবস্থা যুক্ত না হলে আল্লাহ্ ও রাসূলের তাবেদারির নামে যে কাজেই করা হোক তা নিষ্ফল। তাই আল্লাহ্ বলেন,
ليس البر ان تولوا وجوهكم قبل المشرق والمغرب ولكن البر من امن بالله واليوم الاخر والملئكة والكتب والنبين *
“লাইছাল বিররা আনতুয়াল্লু উযুহাকুম কিবালাল মাসরিকি ওয়াল মাগরিবি ওয়ালা কিন্নাল বিররাহ মান আমানা বিল্লাহি ওয়াল ইয়াওমিল আখিরে ওয়াল মালায়্যিকাতি ওয়াল কিতাবি ওয়ান্নাবিয়্যিনা।”(সূরা বাকারা-১৭৭)
অর্থাৎ, “এতে কোনো কল্যাণ নেই যে, পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করবে বরং কল্যাণের কাজ হল আল্লাহ্, পরকাল, ফেরেশতা, কেতাব এবং নবীদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।” অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিমমুখী হওয়াটাই নেক তথা কল্যাণের কাজ নয়। যেমন পশ্চিম প্রান্তের লোকদের কেবলা পূর্বদিক এবং পূর্ব প্রান্তের লোকদের কেবলা পশ্চিম দিক। বরং আল্লাহ্, রাসূল, ফেরেশতাগণ, কেতাবসমূহ এবং কেয়ামতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করাই প্রকৃত কল্যাণের কাজ। সুতরাং তাবেদারির জন্য ঈমান শর্ত। আর ঈমানের জন্য শর্ত হল কল্ব তথা আন্তরিক কাজ। কারণ অন্তরই ঈমানের স্থান। তাই আল্লাহ্ বলেন,
قالت الاعراب امناط قل لم تؤمنوا ولكن قولا اسلمنا ولما يدخل الايمان فى قلو بكم ط ط
“কালাতিল আরাবু আমান্না কুল্লাম তু’মিনু ওয়ালাকিন কুলু আসলামনা ওয়ালাম্মা ইয়াদ খুলিল ঈমানু ফি কুলু বিকুম।”
অর্থাৎ, “আরবরা বলে আমরা ঈমান এনেছি, তখন আল্লাহ্ আপন বন্ধুকে বলেন, আপনি তাঁদেরকে বলুন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করেছ, কিন্তু তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি।”
অর্থাৎ, তোমরা শুষ্ক শীর্ণ মুসলিম এবং আল্লাহ্র তাবেদার বা অনুগত হতে পারনি কারণ এখনও তোমরা জানতেই পার নি ঈমান কী? যারা ঈমান কী জিনিস তাই জানে না তারা আল্লাহ্ এবং রাসূলের তাবেদার হতেই পারে না। আল্লাহ্ বলেন,

ومن يطع الله و الرسول فاولئك مع الذين انعم الله عليهم من النبين والصدقين والشهداء والصلحين وحسن اولئك رفيقا * ذلك الفضل من الله وكفى بالله عليما *
“ওয়ামাইউতি ইল্লাহু ওয়ার রাসূলাহ্ ফা উলায়্যিকা মায়াল্লাজিনা আনা মাল্লাহু আলাইহিম মিনান্ নাবিয়্যিনা ওয়া সিদ্দিকীনা ওয়া শুহাদায়্যি ওয়া সালিহিনা ওয়া হাসুনা উলাইকা রাফিকা, জালিকাল ফাদলু মিনাল্লাহি অকাফা বিল্লাহি আলিমা।”
অর্থাৎ, “যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের তাবেদারি করে তারা আল্লাহ্র অনুকম্পাপ্রাপ্ত নবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মশীলদের সঙ্গীও বটে। তাঁরা উত্তম সাথী। তাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহের দান এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী।
মোট কথা, নবী, সত্যবাদী, শহীদ এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর আল্লাহ্র অনুগ্রহের দানে পরিপূর্ণ এবং সুশোভিত হেদায়েত লাভ বা সঠিক ধর্মচর্চার পথে তাঁরা সর্বাধিক সহায়ক। তাঁদের দ্বারা যাদের বক্ষ আলোকিত হয়েছে এবং যারা ভবিষ্যৎ পথ প্রদর্শনের শিক্ষার ‘ইলমে লাদুন’ বা আল্লাহ্র তরফের বিদ্যার শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের অনুগত বা তাবেদার ব্যক্তিগণ আল্লাহ্ এবং রাসূলেরও তাবেদার বটে। সুতরাং আল্লাহ্ ও রাসূলের তাবেদার হওয়ার জন্য বর্ণিত মহান ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে হেদায়েতের শিক্ষা গ্রহণ করা ফরজ। তাই তো আল্লাহ্ বলেন,
وابتغوا اليه الوسيلة
“ওয়াবতাগু ইলাইহিল অসিলাতা”
“আল্লাহ্র পথে উসিলা অšে¦ষণ করো।”
অর্থাৎ, আল্লাহ্র পথে চলতে চাইলে মাধ্যম অšে¦ষণ করো আর খোঁজ করো বন্ধু। তাঁদের ডাকো দূর থেকে এবং অগোচরে যতক্ষণ তারা হাজির না হন। ডাকো তাদের উচ্চস্বরে যতক্ষণ তোমার ডাকে তাঁরা সাড়া না দেন। ডাকো তাঁদের বিনীত ও নম্রভাবে যতক্ষণ তাঁরা তুষ্ট না হন। ডাকো তাঁদের সামনে এবং অগোচরে যতক্ষণ তারা তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং আপন না হন। ডাকো তাঁদের দমে দমে সর্বাবস্থায় যতক্ষণ না তাঁরা তোমাদের অজিফায় পরিণত হন। তাঁদের নাম আল্লাহ্র নামের জ্যোতি এবং আল্লাহ্র সত্তারই দ্বিতীয় পর্যায় এবং সারাংশ।
সন্তান যখন আন্তরিকতার সাথে নিজের মাকে মা, মা বলে ডাকে তখন মা-বাপ- ভাই সবাই সন্তুষ্ট হয়। তাতে আল্লাহ্ও খুশি হন। ফলে আল্লাহ্র রহমতের সাগরে ঢেউ সৃষ্টি হয় এবং তা মা ও অন্যান্যদের অন্তরে মহব্বতরূপ মিষ্টি জলের চিরন্তন স্রোতধারার সৃষ্টি করে। তা না হলে সন্তানের জন্য মাতা-পিতার অন্তরে এত স্নেহ কোথা থেকে আসে। সন্তান তাদের মা-বাবাকে সামনে পিছনে এতবেশি ডাকে যেন অজিফা জপে। এটা সন্তানের জন্য ইবাদতই বটে। আল্লাহ্ বলেন,
وبالوالدين احسانا
“ওয়াবিল ওয়ালিদাইনি এহ্সানা।”
পিতা-মাতার প্রতি বিনীত হও। এহ্সান বা বিনীতভাব একপ্রকার নমনীয়তা যাতে দেহমন এক হয়ে যায়। এজন্যই শিশুদের কথা এত মধুর লাগে। বস্তুত এমন কোনো যুবক এবং বৃদ্ধও নেই, যে বিপদ আপদে মনের গভীর থেকে নিজের মা-বাবাকে স্মরণ না করে। এটা আল্লাহ্র রহমত যে, মা-বাবার মাধ্যমে সন্তানরা আল্লাহ্র দয়া লাভ করে।
এজন্য আল্লাহ্র পথের সাধকবৃন্দও আল্লাহ্র দয়া লাভের মাধ্যম তথা উসিলা হিসেবে আপন আপন যোগসূত্র মোতাবেকÑ হে আমার শাইখ, হে আমার মুর্শিদ, হে বাবাজান, হে গাউসুল আজম, হে শেখ ফরীদ, হে মাদারপীর, হে আল্লাহ্র নবী; হে আল্লাহ্র রসূল, এমনকি ইয়া আলী, ইয়া আলী বলেও তাঁদের সামনে অথবা দূরেও ডেকে থাকে। এর বরকতে আল্লাহ্ই এরূপ সাধককে একজন কামেল মুর্শিদের ফায়েজ দান করেন। এটা পরশ পাথর এবং সর্বরোগ নিরোধক ওষুধের মতো, যার আকর্ষণে লোহাও সোনা হয়ে যায়। সুতরাং অনুরূপ কামেল এবং মোকাম্মেল মুর্শিদের সত্তা ও গুণাবলিতে বিদ্যমান প্রদীপ্ত জ্যোতির ক্ষমতার প্রতি আল্লাহ্ তায়ালা মনোযোগ আকর্ষণ করে হুকুম করছেন,
كونوا مع الصدقين
“কুনু মায়াছ ছাদেক্বীন”
অর্থাৎ, “সৎদের সঙ্গী হয়ে যাও।” অর্থাৎ, মুর্শিদগণই সৎ এবং তাঁদের সাথী হয়ে যাও। আল্লাহ্র এ হুকুম পালন করা বড় ধরনের ফরজ কাজ।
উল্লেখ্য, মুর্শিদের সত্তা ও গুণাবলিতে হেদায়েতের নূর তথা আলোকবর্তিকা রয়েছে। তা তোমাদের সত্তা ও গুণাবলিকে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল করে দিবে। তখন তোমাদের অবস্থা হবে অন্ধের দৃষ্টি লাভ করার মতো। যার কাছে সারা বিশ্ব অদৃশ্য ছিল সে তখন সবকিছু সুস্পষ্ট দেখতে পাবে। এটাকে বলা হয় আল্লাহ্র নেয়ামত বা অনুকম্পার দান। নবী-অলী সৎকর্মশীল এবং শহীদগণ আল্লাহ্র তরফ থেকে এ সম্পদের অধিকারী। এর মাধ্যমেই আল্লাহ্ ও বান্দার যোগসূত্র রক্ষিত হচ্ছে এবং মুর্শিদের সত্তা এ সম্পদ দ্বারা পরিপূর্ণ এবং সমুজ্জ্বল। সুতরাং এ মুর্শিদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, তাঁরা ভাল মানুষ, আল্লাহ্র তরফের উত্তম বন্ধু এবং আল্লাহ্র সাথী হওয়ার জন্য এরাই যথেষ্ট। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ এবং তাঁর কথাই চূড়ান্ত। অতএব মাহবুবে সোবহানি এবং আলমে রাব্বানী যার বক্ষ আল্লাহ্র

নেয়ামত দ্বারা পরিপূর্ণ তিনিই তো হেদায়েতের মূলধন। সুতরাং যারা হেদায়েত পেতে চায়, তাকে ছাড়া হেদায়েত পাওয়া এবং তাঁর তাবেদারি ছাড়া আল্লাহ্র তাবেদার হওয়া অসম্ভব। অতএব যে মুর্শিদের তাবেদারি করেনি সে তো হেদায়েতই পায়নি। সুতরাং তার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন নং ৩৮
هل جزاء الاحسان الا الاحسان
‘‘হাল জাজাউল এহ্সানে ইল্লাল এহ্সান’’ এর অর্থ কী?
উত্তর : প্রশ্নে উদ্ধৃত আয়াতাংশের অর্থ এহ্সানের প্রতিফল এহ্সানই বটে। কারণ এহ্সান শব্দের মূল হল ‘হাসান’ যার সাধারণ অর্থ উত্তম তথা ভালো। এ দ্বারা এখানে সাধারণভাবে ভালো কাজ বোঝানো হয়েছে এবং ব্যাপক কাজের দিকে আহবান করার উদ্দেশেই এখানে এহ্সান শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন রোজা, নামাজ তো নিজের জন্য এহ্সান বা ভালো কাজ। এছাড়াও ঐচ্ছিকভাবেও বান্দা যেসব ভালো কাজ করে সেসব কাজকে নীতিশাস্ত্রে সর্বদাই ‘হুসনুল আমাল’ তথা ভালো কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে সমস্ত ভালো কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কেয়ামত পর্যন্ত বান্দা যেসব ভাল কাজ করবে তা তার প্রতিফল পাওয়ার যোগ্য হবে। এ ক্ষেত্রে কাজের কোনোরূপ বর্ণনা করা হয় নি। অনুরূপভাবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
قل كل يعمل على شاكلته
‘‘কুল কুল্লাইয়ামালু আলা শাকিলাতি।’’
“বলে দিন, প্রত্যেকেই নিজের রুচিমতো কাজ করে।”
অর্থাৎ, আল্লাহ্ বলেন, হে দোস্ত আপনি বলে দিন যে, প্রত্যেকেই আপন আপন রুচিমতো কাজ করে থাকে। এখানে কাজের কোনো ধরন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। বরং এতে যে কেউ নিজের তরফ থেকে যে কোনো ভালো কাজ উদ্ভাবন করবে তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে। আর যে সব সুস্পষ্টভাবে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং কোরান ও হাদিসের আওতায় এসেছে সেগুলো আদিষ্টকর্ম যা ফরয ও ওয়াজিব, অপরদিকে এহ্সান হল সীমাহীন যে কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করা তা কখনো খারাপ বা মন্দ হয় না, কারণ
الاصل فى الاشياء اباحة
“আল আসলু ফিল আসইয়ায়্যি আবাহাতি।”
সকল বস্তুই মূলত হালাল এবং মোবাহ্Ñ এ নীতির ভিত্তিতে এখানে মোবাহ শব্দ দ্বারা ভালো কর্মের সীমাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
অর্থাৎ সাধারণভাবে ভালোর বদলে ভালো বলার মাধ্যমে পরম ভান্ডারের একটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তা হল এই যে, বিনিময়ের কোনো সর্বোচ্চ সীমা নেই তবে এহ্সানের বিনিময়ে যা পাওয়া যাবে তার সর্বনিম্ন হার হল একের বিনিময়ে দশ। উভয় দিকের ভালো বা এহ্সানের সর্বোচ্চ সীমা অনির্দিষ্ট। লক্ষ লক্ষ বার পুনরাবৃত্তি করলেও ভালোই থাকবে। নীতিগত মৌলিকভাবে যে কাজ ভালো বা যে কাজে লক্ষ লক্ষ কল্যাণ নিহীত, কোনো আনুষঙ্গিক দোষত্রুটির জন্য তা কখনো মৌলিকভাবে খারাপ বা মন্দ হতে পারে না। কারণ মন্দ কাজের প্রতিফল একের অধিক হয় না। সুতরাং কোনো মন্দ কাজ বহুগুণ বিনিময় কোনো কাজকে পরাভূত বা নষ্ট করতে পারে না। বরং অল্পই বেশির কাছে পরাভূত এবং মূল্যহীন। সুতরাং যেসব বস্তু মূলত কল্যাণকর তথা সুন্নত, হালাল ও নেক তথা ভালো তা আপন অস্তিত্বেই হালাল। তা কখনো হারাম হতে পারে না। তা সব সময়ই সুন্নত এবং ভালো। এ ভালো কর্মের বদৌলতেই কোরানের মর্মার্থ অনন্তকাল সারাবিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ গণ্য। এহ্সান কোনো কারণে হারাম হতে পারে বলে মেনে নিলে কোরানের মর্মার্থ যে কল্যাণকর গুণাবলি তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সমস্ত ভালো ও পুণ্য কর্মের পথই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, একটি হাদিসে আনুষঙ্গিক মন্দের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। হাদিসটি এইÑ
كل بدعة ضلالة وكل ضلالة سبيلها الى النار
‘‘কুল্লু বেদাতুন দালালাতুন ওয়া কুল্লু দালালাতুন সাবিলুহা ইলান্নার।”
“সমস্ত বেদ’আত গোমরাহী আর সব গোমরাহীর গন্তব্য হল নরক।” এর অর্থ হল, যে কোনো নতুন কাজ গোমরাহীর হলেই তা গোমরাহী বলে গণ্য হবে। অন্যথায় যে কোনো নতুন কাজকে গোমরাহী বলে আখ্যায়িত করা হলে, যেসব হাদিসে নতুন কাজকে উৎসাহিত করা হয়েছে সে হাদিসের কী জবাব দিবে? যথা হাদিসÑ
من سن فى الاسلام سنة بها فعمل بها بعده كتب له مثل اجر من عمل بها ولاينقص من اجرهم بشئ –
‘‘মান সুন্নাহ ফিল ইসলামী সুন্নাতু বিহা ফায়ামালা বিহা বায়াদাহু কিতাবুলাহু মিসলু আজ্রি মিন আমালা বিহা ওয়ালা ইয়ানকুদু মিন উজরাহুম বি শাইয়্যিন।’’

অর্থাৎ “কেউ যদি ইসলামে কোনো ভালো নিয়মনীতি চালু করে, অতঃপর তা অনুসরণ করা হয়, তাহলে সে উক্ত নিয়মনীতির অনুসারীদের সমপরিমাণ পুণ্য পাবে কিয়ামত পর্যন্ত। তবে তা অনুসারীদের পাওয়া থেকে কাটা হবে না।” (মুসলিম শরীফ)। আল্লাহ্র আপন ভান্ডার থেকে উক্ত নিয়মনীতি চালু কর্তাকে এটা দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, উক্ত হাদিসটি বদান্যতা এবং এহ্সানের মৌলিকত্ব এবং মর্যাদার দলিল। অতএব এহ্সান সূত্রে উদ্ভাবিত বদান্যতা এবং ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মোস্তাহাবের মতো বিশেষ ধরনের কার্যাদি সবই বদান্যতা এবং এহ্সান। বরং এহ্সান ও কল্যাণ তাতে মৌলিকভাবে যুক্ত। অতএব এহ্সান থেকে এহ্সান তথা কল্যাণ থেকে কল্যাণ কিয়ামত পর্যন্ত বহাল ও চালু থাকবে। অপরদিকে খারাপ ও মন্দ কাজ এর প্রতিদ্বন্দ্বী যা তেলাপোকার মতো আচড়ায়, এগুলো মূল বস্তুর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অন্ধকার। এজন্য এহ্সানকে বাতুল প্রমাণ করতে হলে এর গ্রহণযোগ্যতার অকাট্য দলিল প্রয়োজন। আর এহ্সান তথা বদান্যতামূলক কাজের জন্য কোনো দলিল প্রয়োজন নেই। কারণ তা নিজে ভালো এবং উত্তম। এর বাস্তবায়ন সর্বদা উত্তম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একে হারাম বলে ফেকাহ্বিদদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এর উদ্দেশ ক্ষতি এড়ানো। উদাহরণস্বরূপ সমকামিতা। এতে বড় রকমের দুর্ঘটনার আশঙ্কা বিদ্যমান। এখানে অপরিষ্কার ও অপবিত্রতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।
তবে সুদের ব্যাপারে কোনো কোনো ফেকাহ্বিদ যে চানা, মটর ইত্যাদিকে সোনা, রূপা, আটা, গম, খুরমা ও লবণ ইত্যাদির সাথে তুলনা করেছেন, তা অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এতে বড় রকমের ক্ষতি রয়েছে। এজন্য ‘দূররে মোক্তার’ গ্রন্থে ফেকাহ্বিদদের সে মতকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কারণ এক জাতের বস্তু দ্বারা অন্য জাতের বস্তু কি বদল হতে পারে? উদাহরণস্বরূপ দু টাকা দামের এক থান কাপড়ের বদলে কেউ কি দশ টাকা দামের একথান কাপড় দেবে? দেবে না। বরং হাদিসে যে ছয়টি অসম বিনিময়কে হারাম করা হয়েছে সে ক্ষেত্রেও নীতিগত ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে এহ্সান বা পারস্পরিক কল্যাণ বিবেচিত হয়। এতে সাধারণভাবে বস্তুর লেনদেনের হারাম প্রমাণ হয় না। যেমন বিশটাকার এক ভরি সোনার বদলে কেউ আশি টাকা দামের এক ভরি সোনা দিতে রাজি হবে? অবশ্যই হবে না। কারণ এ ক্ষেত্রে কেবল ওজনে সমান হলে হবে না মূল্য সমান হতে হবে। এবার প্রকৃত কল্যাণের প্রতি লক্ষ করোÑ কোনো বস্তুর মূল্য নির্ধারণ ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে তার গুণাগুণ, মর্যাদা ও উপকারিতাই বিচার্য বিষয়। এ জাতীয় সমমানের বস্তুগুলোই কেবল সমজাতীয় বলে গণ্য হবে অন্যথায় গুণে মানে সমান না হলে, একই জাতের হলেও তাদেরকে সমজাতীয় ধরা হবে না। তাকে অন্য বস্তুর উপর নির্ভর করতে হবে। তা না হলে ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যথায় যেসব অঞ্চলে সোনা দিয়ে সোনা এবং রূপা দিয়ে রূপা বিনিময় হয়, সেসব অঞ্চলে বিনিময় বা বেচাকেনায় তার মূল্য-মানের প্রতি লক্ষ রাখা একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু ওজনের প্রতি নয়। পণ্যের মূল্য ও মান তত্ত্বের প্রতি গুরুত্ব প্রদানের দিকেই ইশারা করে হাদিসটিতে বলা হয়েছে স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ। এজন্য অবৈধ লেনদেন থেকে বাঁচতে হলে সোনা রূপা বা যে কোনো বস্তু বা পণ্যের বিনিময়ের ক্ষেত্রে তাদের উপযোগ এবং মূল্যমান বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় ভালো বা উত্তম স্বর্ণের বদলে নিম্নমানের স্বর্ণের বিনিময় বা আশঙ্কা রয়েছে যা বৈধ নয়।
সুতরাং কেউ কেউ উক্ত হাদিসের উদাহরণ দিয়ে সমস্ত বস্তুর ক্ষেত্রে কেবল ওজনে যা পরিমাণে কম বেশির বিনিময়কে সুদের অন্তর্ভুক্ত করছে তা বড়ই ক্ষতিকর। এক শ্রেণীর বাহ্যদর্শী ফেকাহ্বিদ এভাবে সুদের ভয় দেখিয়ে মুসলিম সমাজকে একেবারেই গরিব করে ফেলেছে। ব্যাপক জনগণ তাদের দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা হালালকে হারাম মনে করছে। সুদ দেওয়া এবং নেওয়া উভয়ই নিষিদ্ধ। তা সত্যেও যা নিশ্চিত সুদ তারা তা দিচ্ছে, আর যা সুদ হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই তাকে সুদ আখ্যা দিয়ে হারাম করে রেখেছে।
উল্লেখ্য, কোরানের অনুসরণ করতে হলে এর গূঢ় এবং ভাবার্থ জানতে হবে। এরা তা উপেক্ষা করে কেবল শব্দার্থের প্রতি ঝুঁকে রয়েছে। এরা জানে না যে, সোনা কেবল একটি শব্দ নয়, রঙ ও রূপ বা গুণাগুণও এর অন্তর্ভুক্ত। কোনো কিছুর নামতো মুখের ধ্বনি বা আওয়াজ। কিন্তু তাকে কলমবন্ধ করতে হলে কলম কালি প্রয়োজন হয়। অপর দিকে রঙ হল এক প্রকার নমুনা।
স্বর্ণের মতো পিতলের রঙও হলুদ। সুতরাং বুঝতে হবে আসলে কিসের নাম স্বর্ণ বাইরের রঙটার নাম স্বর্ণ, না এর প্রকৃত উপযোগ ও মূল্যমানের নাম স্বর্ণ। আসলে পণ্যের মান ও উপযোগটাই বিনিময়ের ক্ষেত্রে উদ্দেশ। স্বর্ণ বা যে কোনো পণ্য সমমান এবং সম উপযোগিতা বিশিষ্ট হলেই কেবল তাদের বিনিময় কমবেশি করা উক্ত হাদিসের মর্মমতে হারাম হবে। অপরদিকে যেসব পণ্য মানে ও উপযোগিতায় সমান নয়, সেসব পণ্যের সম পরিমাণ বিনিময় ও বৈধ নয় এছাড়া এ ধরনের বিনিময়ে কেউ রাজি হবে না। সুতরাং সুদের প্রশ্ন কোথা থেকে আসবে? মোট কথা সমমান ও সম উপযোগ বিশিষ্ট সোনা-রূপা, আটা-ময়দা ইত্যাদির কম বেশি বিনিময়ই কেবল সুদ হবে, অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়। এ সিদ্ধান্তই সর্ব চূড়ান্ত।
প্রশ্ন নং ৩৯
কোনো বিষয়ে হারাম প্রমাণের জন্য কোরানিক তথা সুস্পষ্ট দলিল প্রয়োজন কি?

উত্তর : হ্যাঁ, কোনো বিষয়ের হারাম প্রমাণের জন্য সুস্পষ্ট কোরানিক দলিল অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কেউ যদি নিজের তরফ থেকে হারামের কারণ আবিষ্কার করে, কোনো কিছুকে হারাম বলে তাহলে সে নিজেই হারামের শিকার হবে। অর্থাৎ তার কাজটি হারাম কাজ বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয় তাতে তার কুফর, আল্লাহ্দ্রোহীতা, অজ্ঞতা, মূর্খতা, কোরানে হস্তক্ষেপ, ভ্রষ্টতা এবং সত্য প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি প্রমাণিত হবে। উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি বলে যে, অলী-আল্লাহ্গণের নিকট প্রার্থনা করা এবং প্রচলিত ফাতেহা অনুষ্ঠান বেদ’আত ও হারাম। এর কারণ সে নিজে থেকে আবিষ্কার করল যে, উক্ত কাজের সাথে হিন্দুদের অমুক কাজের সাথে মিল রয়েছে এবং কোনো কাজের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা হলে তা ফরজ-ওয়াজেবের মতো হয়ে যায়, এজন্য তা নিষেধ। তাছাড়া শিন্নির খানা সামনে রেখে দোয়া পাঠ
করা এবং ফাতেহা অনুষ্ঠানের জন্য কোনো জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত করা ইত্যাদি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আর যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় তা সবই হারাম, শিরক ও কুফর। এসব অন্যায় ধারণার পাপ থেকে আল্লাহ্ আমাদের ক্ষমা করুন। আরে মিয়া সোনার চাঁদ হঠধর্মী, বলতে পার হাদিসটিসহ কোরানের কোথায় উক্ত কার্যাদির নিষেধাজ্ঞা আছে।
এ প্রসঙ্গে তোমাদের কিয়াস বা অনুধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা অনুমান ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বস্তুত উক্ত পদ্ধতিতে যারা কোনো কিছুকে হারাম করে তারা নিজেরাই কোরান হাদিসের বিরোধিতা করছে। ফলে তারাইতো কোরান হাদিসের আওতার বাইরে চলে গেছে। তাদের কথা গ্রহণীয় নয়। এ ধরনের মনগড়া কারণে কী করে হারাম প্রমাণিত হতে পারে?

প্রশ্ন নং ৪০
আম্বিয়া আউলিয়াগণের জন্য নজর-নেয়াজ, খানাপিনা, আসবাবপত্র ও রসদ ইত্যাদি উৎসর্গরূপে বিতরণ করে তাঁদের রূহ্ মোবারকের ওপর যে সওয়াব রেসানি হয় এবং খানাপিনা, রুটি ইত্যাদি সামনে রেখে সূরা ফাতেহা এবং দোয়াদরুদ পাঠ করা হয় ও তাঁর ওপর ফুঁক দেওয়া হয়, উহা কী? এবং লোকদের দাওয়াত করে তা খাওয়ানোর তাৎপর্যই বা কী?

উত্তর : ফাতেহা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে খানা ও সিন্নি সামনে রেখে দোয়া দরুদ পাঠ করলে বরকত হয়। এজন্য খাওয়ার শুরুতে বিস্মিল্লাহ পাঠ করতে হয় এবং এটা কোরান এবং ফাতেহা ও নেয়াজের অনুষ্ঠানে যাদেরকে মিলনের আহ্বান জানানো হয় তাঁরা গুপ্ত রহস্যের পথে টেলিফোনের মতো সমগ্র পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের রূহ্সমূহ দাওয়াত ও উৎসর্গ গ্রহণ করেন। আর খাদ্যে ফুঁক দিলে তাতে বিষ বা ক্ষতিকর কিছু থাকলে নষ্ট হয়ে যায় এজন্য রসূলুল্লাহ (সাঃ) রোগীদের পানি ইত্যাদি ফুঁক দিয়ে পান করাতেন। এতে তাঁরা খুশি হন, কারণ তারাও তা খান এবং আরাম অনুভব করেন। আল্লাহ্ বলেন,
لاتحسبن الذين قتلوا فى سبيل الله امواتا ط بل احياء عند ربهم يرزقون * فرحين *
“লা তাহসাবান্নাললাজিনা কুতিল ফিসাবিলিল্লাহি আমওয়াতান বাল আহ্ ইয়ায়ু ইনদা রাব্বিহিম ইয়ারজুকুনা। ফারীহিন।”
“আল্লাহ্র পথে শহীদদের তোমরা মৃত মনে করো না, তাঁরা জীবিত তাঁদের প্রভুর নিকটে তাঁরা আহার করেন এবং আরামে আছেন।”
মোট কথা, শহীদগণ মৃত নন। অর্থাৎ আম্বিয়া আউলিয়াগণ জীবিত। তাঁরা আহার করেন এবং আরাম করেন। এখানে আরাম কথাটি ব্যাপক। প্রথমত এর অর্থ হতে পারে তাঁদের সত্তার মধ্যেই সান্ত্বনা রয়েছে, তা থেকে খুশি প্রকাশিত হয় এবং তদ্বারাই তাদের রূহ্ আরাম উপভোগ করে। দ্বিতীয়ত এর অর্থ এও হতে পারে যে, অন্য বস্তু যথা পানাহার বা উপঢৌকন ইত্যাদির কারণে তাঁরা আরাম বোধ করেন। যিনি আরামে আছেন পানাহার ও উপহার উপঢৌকনে তাঁর আরও আরাম হয়। আর যিনি কষ্টে আছেন তাতে তার কষ্ট দূর হয়। কারও যদি খাদ্যের অভাব থাকে আর কেউ যদি তাকে খাদ্য দান করে সে খুশি হয়। শুধু তাই নয়, খাদ্যের অভাবে যে মরার পথে, খাদ্য পেলে সে বেঁচে যায়। এটা চাট্টিখানি কথা নয়।
উল্লেখ্য, দান করা সব সময় সুন্নত অর্থাৎ উত্তম ধর্মীয় নীতি। কিন্তু অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার করানো ফরজ অর্থাৎ বাধ্যতামলূক। এভাবে এহ্সান অর্থাৎ যে কোনো শুভ কাজ যা ঐচ্ছিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তা ফরজ ও ওয়াজিবরূপেও গুরুত্ব লাভ করে, এর কারণও মূলেই নিহিত। আল্লাহ্্ বলেন,
قل ما انفقتم من خير فللو الددين والاقربين واليتمى والمسكين وابن السبيل *
“কূল মা আনফাকতুম মিন খাইরিন ফালিল অলীদাইনে ওয়াল আকরাবিনা ওয়াল ইয়াতামা ওয়াল মাসাকিনি ওয়াব নিস সাবিল।”
“বলুন তোমরা যে উত্তম বস্তু দান করো তা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয়, অনাথ, নিঃস্ব ও মুসাফিরদের জন্যই বটে।” (সূরা বাকারা) অর্থাৎ, হে রসূল (সাঃ) বলে দিন যে, তোমরা দান খয়রাতের দ্বারা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয়, অনাথ, নিঃস্ব ও মুসাফিরদের প্রতি এহ্সান কর। এ একটি সাধারণ হুকুম। যা সব সময়ই দুটি অবস্থা হতে পারে। একটি ফরজ তথা বাধ্যতামূলক অপরটি ঐচ্ছিক উপকার বা দয়া প্রদর্শন। অসহায় ব্যক্তিকে এহ্সান বা দান করা ফরজ আর স্বাভাবিক অবস্থায় এহ্সান করা ঐচ্ছিক দান বা দয়া। যেসব ক্ষেত্রে এহ্সান দয়া এবং ফরজও বটে সেসব ক্ষেত্রে ফরজ সম্পাদনের সাথে সাথে দয়াও সম্পন্ন হয়।
উল্লেখ্য, এহ্সানকারী এবং এহ্সানপ্রাপ্ত এ দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক থাকার শর্ত নেই। মাতা-পিতা যদি মুসাফির গরিব, অনাথ ও নিঃস্ব হয় তাহলে তাদের প্রতি এহ্সান করা বড় ফরজ। এ এহ্সানে দয়া ও ফরজ দু-ই শামীল। সাধারণত মৃত ব্যক্তিগণ এ শ্রেণীভুক্ত। এরা প্রকৃতই শত শত বছরের মুসাফির মাতা-পিতাহীন, অনাথ এবং সহায় সম্বলহীন। আল্লাহ্ বলেনÑ
ويطعمون الطعام على حبه مسكينا ويتيما واسيرا *
“ওয়া ইউতয়িমুনা তোয়ামা আলা হুববিহি মিসিকিনাও ওয়া ইয়াতিমাও ওয়া আসিরা।”
“তোমরা নিঃস্ব অনাথ এবং বন্দিদের মহব্বতের সাথে আহার দান কর।” (সূরা দাহর)। অতএব মৃতদের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের মুসাফির কঠোরভাবে বন্দী এবং অনাথ ও নিঃস্ব আর কে আছে। সুতরাং তাদের কল্যাণে দান সদকা প্রার্থনা ও শুভ কামনা করা দরকার। আল্লাহ্ বলেন, وقولو للناس حسن “ওয়া কুলু লিন্নাসি হুসনা” “মানুষের জন্য কল্যাণের কথা বল।” অর্থাৎ, মানুষের জন্য কল্যাণের কথা বলো যাতে তাদের মঙ্গল হয়। অর্থাৎ তাদের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করো যার বরকতে তাদের কষ্ট লাঘব হয় এবং তাদের প্রতি আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়। ঐরূপ মৃত ব্যক্তিগণ জীবিতদের প্রেরিত ও শুভকর্মের বরকতের উসিলায় আরাম পেয়ে থাকে। এছাড়া মৃতদের আরতো কোনো সহায়ক নেই। অপর দিকে যারা কবরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত তাদের উদ্দেশে এহ্সান বা শুভ কার্যাদি সম্পাদন করা হলে, যারা তা করেন তাঁরা আল্লাহ্র রহমতরূপ অমূল্য নেয়ামতপ্রাপ্ত হন। এজন্য উক্ত মুক্ত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের এহ্সান রীতি চালু রাখা কেবল ফরজ নয় বড় ধরনের ফরজ।
এটি একটি বড় ধরনের নেয়ামত। কারণ কবরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত ব্যক্তিগণ হলেন আম্বিয়া, আউলিয়া, শহীদ এবং পুণ্যাত্মা ও পুণ্যবান মহামানবগণ। তাঁরা আল্লাহ্্র প্রতিচ্ছবি এবং তাঁরই নূরে নূরময়। এজন্য আল্লাহ্্ তাঁদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের সর্দার, শৃঙ্খলা বিধায়ক এবং তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। তাঁদের খুশিতে আল্লাহ্্ খুশি তাঁদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্্র অসন্তুষ্টি ও গজবের কারণ। তাঁদের খুশি করলে আল্লাহ্্ খুশি হন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন,
ان الله وملئكته يصلون على النبيى يايها الذين امنوا صلوا عليه وسلموا تسليما *
“ইন্নাল্লাহা ওমালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলাননাবিয়্যে ইয়া আয়্যিউহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাহি ওয়াসাল্লিমু তাসলিমা।”
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরুদ করেন, হে বিশ্বাসীগণ তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ কর।” এর মর্মার্থ হল, আল্লাহ্্ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর এহ্সানের জ্যোতিতে নেয়ামতযুক্ত কালাম প্রকাশ করেন। হে মুমিনগণ তোমরাও তা কর। তাতে আমার গর্ববোধ হয়। এটা তোমাদেরও আনন্দ ও গর্বের বিষয় বটে। কারণ এর মধ্যে আমার হাকিকতের প্রকাশ এবং রহস্য সমগ্রের নির্দেশনা রয়েছে। যারা তাদের প্রতি মনোসংযোগ সহকারে তাদের কল্যাণ কামনায় এহ্সান তথা শুভ কার্যাদি করা পছন্দ করে তাঁরা আমার (আল্লাহ্্র) মনোপুত বন্ধু।
অতএব এহেন ঔজ্জ্বল্যময় কাজের রশ্মি হতে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে। এরই বদৌলতে পয়গম্বরিসূত্রে বেলায়েতি ধারার কল্যাণে সারাবিশ্ব আজ পুষ্পোদ্যানে পরিণত হয়েছে।
তোমরা আল্লাহ্র রহমত ও নেয়ামতের দানের ব্যাপারে উদাসীন বা গাফেল থেকো না। তোমরাও সে দানের আকাক্সক্ষী ও আশিক হও। কারণ নবুয়তের আধার এবং প্রকাশের মাধ্যম, যে অলী এবং সদাত্মা ও সৎজন তারা আল্লাহ্র নেয়ামত এবং রহমতস্বরূপ কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বে বিরাজমান থাকবেন। তারা যেখানে শুভ পদার্পণ করেন সেখানে তাদের পুণ্য ও পূর্ণ সত্তা থেকে দয়া ও রহমত বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়। যেখানে তাদের দয়া ও রহমতের বৃষ্টিপাত হয় সে স্থান পরম সত্তার আলোকরশ্মি এবং অদৃশ্য বরকতে ফুলের বাগানে পরিণত হয়। এটা কোনো বস্তুতে স্বচ্ছ কাচের ছায়া পড়লে ঝলমলিয়ে উঠার মতো। বস্তুতপক্ষে এটা ছায়ার ছায়া। স্বচ্ছ কাচে সূর্যের ছায়া পতিত হওয়ার ফলে তা আলোকোজ্জ্বল হওয়ার পর উক্ত কাচের সে আলো যখন অন্য বস্তুর উপর পড়ে তখন তা ঝলমলিয়ে উঠার মতো। অনুরূপভাবে নবী, অলী, সদাত্মা ও সৎজনদের ছায়া সমস্ত জগতের জন্য রহমতস্বরূপ। তারা ইহলোকে থাকেন আর পরলোকে থাকেন সর্বাবস্থাতেই তাঁরা সারা বিশ্বের জন্য রহমত। তবে রহমতের বিচারে বিশ্ববাসীর জন্য ইহলোকের তুলনায় তাঁদের অপরলোকের জীবন অধিক উপকারী।
উল্লেখ্য, যারা তাঁদের বিরোধী এ রহমত তাদের জন্য নয় বরং তাদের জন্য রয়েছে দুঃখ। আল্লাহ্ বলেন,
وللاخرة خير لك من الاولى *
“ওয়াল আখিরাতু খাইরুল্লাকা মিনাল উলা।” (সূরা আদ্দোহা)
“আপনার প্রথম থেকে পরের অবস্থা উত্তম।” এজন্য এ শ্রেণীর পরলোকবাসীদের কাছে দয়া ও সাহায্য প্রার্থনা করা এবং ঐশী দয়ার আশায় প্রতীক্ষায় থাকা উত্তম কাজ।
তাঁদের বিশ্রামাগার ও বৈঠকখানাও রহমতের স্থান। কারণ এসব স্থানও বরকতের ও রহমতের উৎস পরম সত্তাÑ সূর্যরশ্মি যেমন কাচকে আলোকোজ্জ্বল করে তেমনি জ্যোতির্ময় করে রাখেন। এজন্য পৃথিবীতে বর্তমান তাঁদের মাজার, দরগাহ্ ও আস্তানাসমূহকে আল্লাহ্তায়ালার রহমতের স্থান বলা হয়। ফেরেশতাগণ সর্বদা এগুলোর তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত। এসব স্থান আল্লাহ্র নিদর্শন। আল্লাহ্ বলেন,
ومن يعظم شعائر الله فانها من تقوى القلوب
“ওয়ামাই উই আজীম শায়াইরাল্লাহি ফা ইন্নাহা মিন তাকওয়াল কুলুব।”
অর্থাৎ, “আল্লাহ্র নিদর্শনাদির যারা সম্মান করে এটা তাদের আন্তরিক আল্লাহ্ প্রীতি ও মনের ধার্মিকতার পরিচায়ক।”

প্রশ্ন নং ৪১
আম্বিয়া আউলিয়াগণের রূহ্ মোবারক যে পানাহার করেন তা কিভাবে?

উত্তর : আউলিয়া আম্বিয়াগণের রূহ্ মোবারক রূহ্দের পানাহারের নিয়ম এবং অবস্থা অনুযায়ী পানাহার করেন। রূহ্ অতি সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম নিয়মেই তাঁদের পানাহার সম্পন্ন হয়। আহার্যের প্রতি সাগ্রহে তাকালেই তাঁদের পানাহার সম্পন্ন হয়। যেমন কোনো বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দিলেই তাঁদের চোখ তৃপ্ত হয় এবং সে সাথে তাঁদের জিহ্বাও স্বাদ গ্রহণ করে। এভাবে চোখের দ্বারা জিহ্বার মাধ্যমে তাঁদের পেট ভরে যায়। এতে করে অদৃশ্য সান্নিধ্যের অনুভূত তৃপ্তিতে রূপক ধরনের এক প্রকার পানাহার সম্পন্ন হয়। অন্যভাবেও রূপক পানাহার হতে পারে। যেমন কোনো এক ব্যক্তি যার নিজের আহার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার সন্তানদের আহার প্রয়োজন আছে, এমতাবস্থায় আপনি যদি তার সন্তানদের আহার করান তাহলে সে খুশি হবে। এটাও প্রকারান্তরে বা রূপক অর্থে তারই পানাহার। আত্মার সাথে আত্মার সম্পর্ক মূলগত এবং মূল থেকে উৎপন্ন। এ কারণে অনাথ, নিঃস্ব এবং অসহায়দের কেউ খাওয়ালে তার অভিভাবকগণ খুশি হয়। সুতরাং শাখা যখন মূলের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রকারান্তরে তাঁরা একীভূত। ফলে শাখা খেলে মূলের খাওয়া হয়। এমতাবস্থায় পানাহার পোশাক এবং টাকা-পয়সা দান অথবা সওয়াব পৌঁছানো শাখা বা মূল যার উদ্দেশেই করা হোক ফায়দা একই।
তবে সওয়াব পৌঁছানোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য এত বেশি যে, বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, কেউ যদি কারও নামে সওয়াব পৌঁছায়, তখন তা বিভিন্নরূপে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট পৌঁছে। যেমন কেউ যদি কারও নামে একটি পোশাক দান করে তাহলে যার নামে এ দান করা হল তার নামে একটি নূরী পোশাক, অথবা এর সাথে আরও অনেক পোশাক এবং বেহেশত, বাগে জান্নাত, হুর, গেলমান প্রভৃতি আনুষঙ্গিক উপকরণাদি সে পায়। এগুলো হল যে, যাকে সওয়াব পৌঁছায় তাদের মধ্যে আন্তরিক মহব্বত ও সম্মানবোধের প্রতিফল। মহব্বত ও সম্মানবোধ যার যত বেশি তার পুণ্যকর্ম ও ছওয়াব পৌঁছানোর বিনিময়ও তত বেশি ও উত্তম।
উল্লেখ্য, “এহ্সানের বিনিময় এহ্সানই প্রাপ্য” Ñকোরানের এই মূল নীতির ভিত্তিতেই ছওয়াব রেসানির উক্তরূপ প্রতিদান হয়ে থাকে। ইহজগৎ থেকে যখন অপর জগতে কিছু পৌঁছানো হয়, তখন যার জন্য তা পাঠানো হল তার তরফ থেকে প্রেরণকারীও কিছু প্রাপ্য হয়ে যায়। এটা প্রেরকের উদ্দেশে প্রাপকের দান। এটা সালামের জবাবের মতো। সালামের জবাবে যেমন রূহের জগৎ থেকে পুরস্কারস্বরূপ রহমত বর্ষিত হয়, ছওয়াব রেসানির ক্ষেত্রেও তেমনি, যে সওয়াব পৌঁছায় সে প্রতিদান পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যাদের নামে সওয়াব প্রেরণ করা হয় তারা যদি আম্বিয়া ও আউলিয়া অথবা যথার্থ মুর্শিদ হন তাহলে তাঁদের তরফ থেকে যে রহমত ও বরকত উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া যায় তা দুনিয়া ও আখেরাতের মূলধন। তাতে উভয় জগতে সুখ ও শান্তি হয়। তাঁদের এসব প্রতিদান ফেরেশতা হয়ে সওয়াব প্রেরকের জন্য দোয়া করে, কখনো তার সম্পদ ও ঈমানের হেফাজতকারীরূপে কাজ করে কখনও দুনিয়া আখেরাতের সম্পদ এবং বন্ধুরূপে কাজ করে, কখনো শত্রুর তলোয়ার এবং চরিত্রকে তাঁর সামনে স্পষ্ট করে দেয় আর কখনো মৃতের জীবন ও রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
মোট কথা, আলোচ্য রহস্যালোক থেকে দুনিয়া ও আখেরাতের বহু ক্রিয়াকর্ম প্রকাশিত হয়। আল্লাহ্র ফজলপ্রাপ্ত তথা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারীগণ জানেন যে, তার কত বড় ফজিলত। সারা পৃথিবীর হাজারও দেহপ্রাণ মিলেও এর প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়। তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের বলতেই হয় যেÑ

هل جزاء الاحسان الا الاحسان *
“হাল জাজাউল এহ্সান ইল্লাল এহ্সান।”

অর্থাৎ, “কল্যাণের বিনিময়ে অবশ্যই কল্যাণ লাভ হয়।” বস্তুত এহ্সান একটি মহৎ কাজ। এর গুরুত্ব ও মর্যাদা অসীম। এবার নিয়াজের মূল বিষয়, নিয়াজমন্দি তথা প্রার্থনাকারীর নিকটে আস এবং ঐশী দানকে বুঝবার চেষ্টা করো। তাহলে জানতে পারবে যে, ঐশী দান একটি প্রকৃত সত্য তা মিথ্যা আর ক্ষণস্থায়ী নয়। যেমনি মিথ্যা নয় পিতা-মাতার মধ্যে বর্তমান সৃষ্টির উৎস। প্রকৃত গবেষকদের নিকট এটাও স্পষ্ট প্রমাণিত সত্য।

প্রশ্ন নং ৪২
আমাদের রাসূল (সাঃ)-এর রওজা মোনাওয়ারা এবং পবিত্র মাজার সৌধে এত সৌন্দর্য বিধান এবং জাঁকজমক কেন? এতে সোনারূপা, দামি মুক্তা, হীরকচূর্ণ, জড়োয়া রেশম, তশর গদি এবং গেলাফ ও চাদোয়া ঝাড়বাতি প্রভৃতিসহ ধারণাতীত সজ্জা সামগ্রী দ্বারা এই রওজা মোনাওয়ারার এত শাহী জাঁকজমক কেন?

উত্তর : সকল সম্মানের মালিক প্রভুর আদেশক্রমেই তাঁর রাসূলের (সাঃ) রওজা মোনাওয়ারার জাঁকজমক সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ্্ বলেন,
وللاخرة خير لك من الاولى*
“ওয়ালাল আখিরাতু খাইরুল্লাকা মিনাল উ-লা। (সূরা আদ্দোহা)
“আপনার পূর্বাবস্থা থেকে পরের অবস্থা অবশ্যই উত্তম”। অর্থাৎ, আপনার ইহজাগতিক অবস্থাদি যা ছিল, তার তুলনায় অপর জগতের অবস্থা আর ভালো হবে। রওজা মোনাওয়ারার অবস্থা তাঁর অপর জগতের অবস্থাদির একটা। রসূল (সাঃ) ইহজগতে খুবই গরিব অবস্থায় জীবনযাপন করেন। সে তুলনায় তাঁর বর্তমান অবস্থা ভালো। কোরানের উক্ত ঘোষণা তারই অগ্রিম সুসংবাদ। আলোচ্য জাঁকজমক তারই বাস্তবরূপ। তাছাড়া রাসূল (সাঃ) নিজেই বলেছিলেন, হে আল্লাহ্ মদিনা-মোনাওয়ারাকে মক্কা বরং তাঁর চেয়েও অধিকতর বরকতময় করুন। বস্তুত তাই হয়েছে। কোরানের ভাষ্য মোতাবেক হযরতের রওজা মোনাওয়ারা তথা মদিনা মোনাওয়ারা আজ নূরে নূরে নূরময়। যদি তাই না হবে তাহলে কে এ পবিত্র রওজাকে পুষ্পোদ্যানে পরিণত করেছে? আরে, এতো মূলে যা আছে তাঁরই প্রকাশ। নূরে পয়গাম্বরি তো সকলের জন্যই ভক্তি ও সম্ভ্রমের স্থান। এতে খান্নাসের প্রচারণার কোনো সুযোগ নেই। সত্তর হাজার ফেরেশতা সর্বদা এর হেফাজতে নিয়োজিত, এটা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কাফের আর ফাসেক ছাড়া কেউ এর বিরোধী হতে পারেন না। কারণ রওজা মোবারকের এ জাঁকজমক নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এ রীতি চলে এসেছে।
এবং তারকার মতো উজ্জ্বলরূপে তা আজও বিদ্যমান। পয়গাম্বরগণের মাজার বহু জাঁকজমকের সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বর্তমান রয়েছে। ফেরেশতাগণ সর্বদা এর হেফাজতে রত। এরই বদৌলতে নবী-অলীগণের মাজার সবসময় জাঁকজমকপূর্ণ থাকে। যারা এর বিরোধিতা করে তারা হল সে শ্রেণীর যারা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধিতে যা উপলব্ধি করতে পারে না তাকে অস্বীকার করে এবং সে সম্পর্কে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন,
بل كذبوا بما لم يحيطوا بعلمه ولما ياتهم تاويله*
“বাল কাজ্জাবু বিমা লাম ইউহিতু বি-ইলমিহি ওয়াল্লাম্মা ইয়াতিহীম তাবিলাহু।”
অর্থাৎ, “কোনো বিষয় যখন তাদের জ্ঞানে ধরে না তখন তারা তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে।” অন্যত্র এক আয়াতে বলা হয়েছেÑ
واذ لم يهتدوا به فسيقولون هذا افك قديم*
“ওয়া ইজ লাম ইয়াহতাদুবিহি ফাসাইয়াকুলুনা হাজা ইফকুন কাদিম।”
অর্থাৎ, “তারা যখন কোনো দিশা না পায় তখন বলে যে এটাতো পুরনো মিথ্যা।” সে যা হোক পুণ্যবান ব্যক্তিদের রওজা সর্বদা ফেরেশতাদের তত্ত্বাবধানে থাকে। এজন্য এগুলোকে সম্মান ও ভক্তি করা ওয়াজিব। তদুপরি অনুরূপ কবরবাসীদের প্রতি আদব দেখানো অত্যন্ত জরুরি। পুণ্যবান ব্যক্তিগণ নিজেরাই পুণ্যবান। তার পরও তাঁদের প্রতি রয়েছে সদা সর্বদা নবী-অলীগণের পুণ্য দৃষ্টিÑ যাঁরা আল্লাহ্র দয়াপ্রাপ্ত তাঁদের মাধ্যমে সব সময়ই আল্লাহ্র রহমত ও বরকত অদৃশ্যভাবে জারি হয়। এজন্য তাঁদের সম্মান করা ওয়াজিব। এ কারণেই মাজার জিয়ারতের রীতি ধারা চলমান রয়েছে। আশিকগণের নিকট এর রহস্য ও তাৎপর্য আয়নার মতো পরিষ্কার। কারণ কোরান ও হাদিসের মর্মার্থ তাঁদের নিকট সুস্পষ্ট। তাই তাঁরা বেয়াদব নয়। তাঁরা সবসময় মাজারের নূরের প্রতি সম্মান দেখায়। এমনকি তাঁরা জুতা পরিধান করে বাহাদুরির সাথে মাজারে প্রবেশ করে না। তাসাউফের হাদিসে তা হারাম বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে যারা আদববান তাদের জন্য আদব ও সম্মানই দলিল। কারণ তাদের অন্তরে কোরানের বক্তব্য সার প্রবেশ করেছে।

তামাম শোধ

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...