প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে সাবেক ফরিদপুর বর্তমান শরিয়তপুর জেলায় অর্ন্তগত বাংলার স্বাধীন বারো ভূইয়ার অন্যতম রাজা কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুর সংলগ্ন ঈসাপাশা গ্রামে আরব চাঁন মৃধা নামে জনৈক ভূস্বামী বাস করিতেন। একদিন প্রবল ঝড় তুফান প্রবাহিত হইবার পর এলাকার ক্ষতি দেখিবার জন্য তিনি পদ্মার তীরে আগমন করেন এবং ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঝড়বিধস্ত অবস্থা অবলোকন করিতে থাকেন। হঠাৎ নদী তীরস্থ ঝড়ে বিধ্বস্ত একটি শিমূল গাছ হইতে একটি শিশুর ক্রন্দন ধ্বণি তাঁহার কানে ভাসিয়া আসে। গাছটির দিকে তাকাইয়া তিনি হতচকিত হইয়া গেলেন। তিনি দেখিলেন, গাছের ডালে চাঁদের মত উজ্জল ফুটফুটে একটি শিশু। চাঁদের ন্যায় শিশুটির হাতে-পায়ে স্বর্ণের বলয় ছিল। ইহা দেখিয়া মৃধা সাহেবের বুঝিতে দেরি হইল না যে, এই স্বর্ণকান্ত শিশুটি বন্যাকবলিত কোন হতভাগ্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কারণ প্রাচীনকালে জমিদার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের হাতে-পায়ে সোনার বলয় পরাইবার রেওয়াজ ছিল।
শিশুটিকে দেখিয়া মৃধা সাহেবের অন্তরে পুত্রস্নেহের উদ্রেক হয়। তিনি শিশুটিকে গাছ হইতে নামাইয়া নিজ বাড়িতে লইয়া আসেন। শিশুটির বংশ এবং পিতা-মাতা সম্পর্কে প্রশ্নবান মৃধা সাহেবের অন্তরকে সদা বিদ্ধ করিলেও কখনো তিনি উহার উত্তর পান নাই। তাঁহার নাম শরীফ দীদার আলম এইটুকুই শুধু বলিতে পারিয়াছিল। শিশুটির প্রতি তাঁহার আদর-যত্ন এবং পরবর্তীতে আপন সন্তানের মর্যদায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব প্রদান করায় মনে হয় যে, উক্ত প্রশ্ন সমূহের উত্তর না পাওয়াই তাঁহার কাছে মনঃপুত ছিল।
হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার বংশ পরিচয় সম্পর্কে তাঁহার পৌত্র হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন তাহার ফরমায়েশকৃত ‘নূরেহক্ব গঞ্জেনূর’ গ্রন্থে হযরত সুরেশ্বরী বাবার সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখিতে গিয়া তাঁহার সম্পর্কে যে মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন তাহা নিম্নে হুবহু তুলিয়া দেওয়া হইলঃ
“ভারত বর্ষে ধর্ম প্রচারের জন্য ইসলামের পতাকা নিয়া যাহারা পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জমা ও মদীনা মোনাওয়ারা হইতে এই দেশে আসিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে হযরত আলহাজ্ব মাওলানা শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ দীদার উল্লাহ্ শরীফ অন্যতম। তিনি আওলাদে রাসূল (রাঃ) এবং আহলে সুফফা ও আশেকে রাসূল (সাঃ) ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে আরব দেশ হইতে বর্তমান ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত হইয়া বাংলাদেশে আগমন করেন এবং বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার শরিয়তপুরের নড়িয়া থানাধীন সুরেশ্বর দরবার শরীফের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ইছাপাশায় বসতি স্থাপন করেন।
নবাবদের নিকট হইতে তিনি ৩৫০ বিঘা লা’খেরাজ (নিস্কর) ভূমি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি উহা ভূমিহীন গরীবদের দান করিয়া দিয়া নিঃস্ব হইয়া যান এবং পার্শ্ববতী গ্রাম বর্তমান সুরেশ্বরে স্থানান্তরিত হন। বাংলার আলো-বাতাস পরিবেশ ও জনগণের মহব্বতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং স্থায়ী ভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
তাহার অধঃস্তন (বংশধর) চতুর্থ পুরুষ বাংলা-ভারতের উজ্জলতম জ্যোতিষ্ক জিন্দা অলী শামছুল ওলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ আহম্মদ আলী ওরফে হযরত মাওলানা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ)। ”
সে যাহাই হউক, মৃধা সাহেব পিতৃস্নেহে শিশুটিকে গ্রহন করেন এবং তিনি দিদারকে আপন সন্তান স্নেহে আদর যত্ন সহকারে লালন পালন করেন। শোনা যায়, শরীফ দীদার মৃধা সাহেবের সংসারে আসিবার পর মৃধা সাহেবের একদিকে যেমন আর্থিক উন্নতি হয়, অপরদিকে তেমনই সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে থাকে। সর্ববিষয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইবার কারণ হয়তো মৃধা সাহেব উপলদ্ধি করিতে পারিয়াছিলেন, এই জন্য তিনি দীদারের প্রতি একটু বেশীই দূর্বল ছিলেন। এই কারণে পাড়া প্রতিবেশী তাহাকে মৃধা সাহেবের আপন ছেলে বলিয়াই মনে করিত। বালক দীদার আলমকে মৃধা সাহেব প্রাণাধীক আদর-স্নেহ করিতেন।
বাল্য বয়স হইতেই দীদার ছিল ব্যবহারে নম্র-অমায়িক, কাজেকর্মে ধীরস্থীর, চলনে-বলনে শান্ত-শিষ্ট এবং ভাবুক প্রকৃতির। তাহার আচার-ব্যবহার ভাবভঙ্গি এবং মন মেজাজ সাধারণ বালকদের হইতে আলাদা প্রতীয়মান হওয়ায় গ্রামবাসীগণ তাহার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করিত।
শরীফ দিদার আলমের সমবয়সী দাদন আলী নামে মৃধা সাহেবের আরো একটি ছেলে ছিল। মৃধা সাহেব উভয়কে আবশ্যিক ইসলামী শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি করিয়া দেন। শরীফ দীদার মনোযোগ সহকারে সুনামের সহিত মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করিয়া এবং পবিত্র কোরআন-হাদীস এবং কালেমা, নামাজ-রোজা ইত্যাদি ইসলামের প্রাথমিক বিষয়াদি সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান মোতাবেক ধর্মে-কর্মে লিপ্ত হয়। বালক দীদার আলমের বয়স যতই বাড়িতে লাগিল সংসারের প্রতি তাঁহার আকর্ষণ ততই কমিতে লাগিল। তাঁহার অধিকাংশ সময় কাটিত কোরআন-হাদীসের পাঠ্যভ্যাসে এবং চিন্তা-ভাবনায়, কালক্রমে শরীফ দীদার আলম একজন ধর্মীয় আলেম এবং ধার্মীক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত লাভ করিলেন। অপরদিকে দাদন আলী পড়া-লেখায় অমনোযোগী হইবার কারণে সংসারে জড়াইয়া পড়িলেন। ইতিমধ্যে শরীফ দীদার আলম ও দাদন আলী উভয়ে যুবক বয়সে পদার্পণ করিলে স্নেহময় বৃদ্ধ পিতা আরব চাঁন মৃধা তাহার সমস্ত সম্পত্তি দুই ছেলেকে সমান অংশে ভাগ করিয়া দিয়া মহত্ব ও মমত্বের অবিস্মরণীয় নজির রাখিয়া ইহধাম ত্যাগ করিলেন। স্নেহময় পালক পিতা মৃধা সাহেবের ইন্তেকালের পর শরীফ দীদার আলম পিতা মৃধা সাহেব প্রদত্ত সম্পত্তিতে বাড়িঘর নির্মাণ করিয়া সুরেশ্বর গ্রামে স্বচ্ছন্দে সপরিবারে বসবাস করিতে থাকেন।
হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) উক্ত শরীফ দীদার আলমের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ। তাঁহার সুমহান পিতার নাম হযরত সূফী মেহেরুল্লাহ শরীফ, পিতামহ হযরত শাহ্ সূফী চাঁন শরীফ এবং প্রপিতামহ হযরত শাহ্ সূফী নিয়ামতুল্লাহ্ শরীফের মাধ্যমে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা দিদার আলমের সহিত যুক্ত।
সুরেশ্বরে আগমনের পূর্বে তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের নিবাস বৃহত্তর ফরিদপুরের করমপুরে ছিল বলিয়া জানা যায়। হযরত সুরেশ্বরী বাবা বংশগতভাবে ‘মানিক শাহী’ বলিয়া হযরতের উর্দু ভাষায় রচিত এবং তাঁহারই হায়াত শরীফে প্রকাশিত র্সিরেহক্ব জামেনূর’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ রহিয়াছে।
তাঁহার বংশ পরিচয় সম্পর্কে ইহার চেয়ে বেশী কিছু জানা যায় না।
No comments:
Post a Comment