Thursday, September 25, 2025

আল্লাহর অলিদের আনুগত্য করা ফরয

 


بسم الله الرحمن الرحيم

আল্লাহর অলিদের আনুগত্য করা ফরয

আল্লাহ্ তা’য়ালার বাণী واصبو نفسك مع الذين يدعون ربهم بالفد وات والعشئ الخ ا (ওয়াছবির নাফসাকা মাআল্লাযীনা ইয়াদ্উ’না রাব্বাহুম বিলগুদুওয়্যাতি ওয়াল আ’শিয়্যে) অর্থাৎ, যারা সকাল সন্ধ্যায় আপন প্রভুকে ডাকে: আপন মনপ্রাণ তাঁদের সাথে ঠেকিয়ে রাখ। অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্কে স্মরণ করেন তাঁদের আজ্ঞা পালন কর এবং তাঁদের অনুগত হয়ে যাও। কারণ ফকির ও অলিদের আনুগত্য করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করারই নামান্তর। এ কারণে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে: تخلقوا باخلاق الله (তাখাল্লাকু বিআখ্লাকিল্লাহ্) অর্থাৎ, “আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।” অলি-নবীদের চরিত্রও তাই। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহর চরিত্রগুণ বিদ্যমান, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজেব। আর এটা অলঙ্ঘনীয় ওয়াজেব। এটা ফরজের স্থলে শর্তসাপেক্ষ ওয়াজেব নয় যে, শর্ত অপসারিত হলে ওয়াজেবও অপসারিত হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ যাকাত প্রদান ওয়াজেব, কিন্তু যাকাত আদায় করার পর তা আর ওয়াজেব থাকে না। অপরদিকে অলিদের আনুগত্য করা মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয় ওয়াজেব, ফরজের চেয়েও অধিক গুরুত্ববহ। কারণ এরূপ স্থায়ী ওয়াজেব থেকেই ফরয ও অন্যান্য হুকুম-আহ্কাম বের হয়। কারণ সার্বক্ষণিক ওয়াজেব কখনো অপসারিত হয় না। যেমন আল্লাহ্-রাসূল এবং অলিদের প্রতি বিশ্বাস রাখা ওয়াজেব, আর কিয়ামত পর্যন্তই এটা ওয়াজেব। এমনিভাবে প্রমাণিত মৌলিক ওয়াজেবসমূহ পালন করাও সার্বক্ষণিক ওয়াজেব।

মোটকথা, ফকির-অলিদের আনুগত্য করা ওয়াজেব। তাঁদের কোনো কাজ শরিয়ত বিরোধী মনে হলেও তা কেবল বাহ্যিক, কিন্তু অন্তর্নিহিত শরিয়ত বা আল্লাহ্ তা’য়ালার বিরোধী নয়। আহলে জাহেরগণ বাহ্যিক শরিয়তের ওপর নির্ভরশীল। অথচ দৃশ্যত যা বৈধ ও ভালো মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা বিপরীতও হয়। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত এবং মণি প্রভৃতি বাহ্যতঃ অপবিত্র। কিন্তু অন্তঃসারের বিচারে পবিত্র। কারণ উহা দ্বারা পবিত্র মানুষ সৃষ্টি হয়। অনুরূপ যে কোনো অবস্থাতেই স্ত্রী সঙ্গম বৈধ এবং কারও কাছে বললে গালির মতো শোনায়। আল্লাহর অলিদের কাজকেও এভাবেই বিচার করতে হবে।

হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করুন। সংক্ষেপে তা হল এই যে, হযরত খিজির (আঃ) সতর্কতামূলকভাবে হযরত মূসা (আঃ)-কে অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছিলেন যে, আমার কোনো কাজে আপনি আপত্তি করবেন না। যদি করেন তাহলে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ইনশা আল্লাহ্ আমি অবশ্যই এ কথায় বহাল থাকব। অতঃপর হযরত খিজির (আঃ) নদীর তীরে গেলেন। সেখান থেকে মালিকের অনুমতি ছাড়াই একটি নৌকা নিয়ে নদী পার হলেন এবং পরে স্বীয় লাঠির আঘাতে নৌকাটি ভেঙে নদীতে ডুবিয়ে দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) দেখলেন এটা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী কাজ। কারণ মালিকের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নেওয়া অবৈধ। তদুপরি উহা ভেঙে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনায় তিন চারটি নিষিদ্ধ কর্ম বা হারাম কাজ হল, তাই হযরত মূসা (আঃ) আপত্তি উত্থাপন করলেন যে, আপনি এসব শরিয়তবিরোধী কাজ করেছেন। তখন হযরত খিজির (আঃ) বললেন, আমার কাছ থেকে আপনি এখনি বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) বিনীতভাবে অপরাধ ক্ষমা চাইলেন এবং কথা দিলেন, আর এমন হবে না। অতঃপর সেখান থেকে এগিয়ে পথে একটি ছেলেকে স্বীয় লাঠির আঘাতে খিজির (আঃ) মেরে ফেললেন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও এতে আপত্তি করেন। নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) রেগে গিয়ে বললেন, আপনি আমার থেকে বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে একটি ভাঙা দেয়াল পেয়ে দিনব্যাপী মেরামত করে দিলেন। এ কাজ কেউ তাঁকে করতেও বলেনি বা এজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিকও পাননি। একান্ত স্বেচ্ছায় কাজটি করেছেন। মূসা (আঃ) আবার প্রতিবাদ করলেন, নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে আলাদা হতে বললেন, এবার আপনার বিদায়ের পালা। কারণ আমার কাজ আপনার অপছন্দ এবং আপনি গোপন জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নবীর ধৈর্যও নেই। তখন হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেন, আপনি নৌকা ভাঙলেন, এর রহস্য কী? উত্তর দিলেন, জনৈক জালিম বাদশা আসছিল, সে নৌকার মাঝি-মাল্লা সকলকে ধরে নিয়ে যেত। তাই এটাকে ডুবিয়ে দিয়েছি যেন বেচারার নৌকা নিজেই পেয়ে যায় এবং এ নৌকা দ্বারা ঐ গরিবরা তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে। নাবালকটাকে হত্যা করার রহস্য হল ছেলেটা ডাকাত হত, তার পিতা-মাতাকে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর অবাধ্য হত। এজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। অতঃপর তার আর একটি ভগ্নি জন্মগ্রহণ করবে এবং তার আওলাদদের মধ্যে সত্তর জন নবী জন্ম নিবেন। আর দেয়াল মেরামতের মাধ্যমে আমি জনৈক অনাথকে সাহায্য করেছি। এ দেয়ালের নিচে তার পিতার অনেক সম্পদ লুকায়িত আছে। এ দেয়ালটি পড়ে গেলে সে সম্পদ অন্যে নিয়ে যেত। আক্ষেপ এ সব বিষয়ে আপনি মোটেই অবহিত নন এবং আপনার কোনো অদৃশ্য জ্ঞানও নেই। আপনি যদি আমার কাজে আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহলে অনুরূপ হাজারও বিষয়ে আপনাকে শিক্ষা দিতাম।

এখানে চিন্তার বিষয় এই যে, হযরত মূসা (আঃ) নবী হয়েও নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’য়ালা গোপন জ্ঞান শিক্ষার জন্য নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি বাহ্যিক শরিয়তের অনুসরণ করেন এবং নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর কার্যাদি খারাপ ও দোষণীয় মনে করেন। তিনি এটা চিন্তাই করেননি যে, যেহেতু আল্লাহ্ আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন, সেহেতু তাঁর তাক্লীদ বা অনুসরণ করা আমার কর্তব্য এবং তাঁর সাথে বিরোধ করা অনুচিত। এজন্যই ফকির এবং অলিদের কোনো কাজ শরিয়তের ঘোর বিরোধী মনে হলেও, তাঁদের আনুগত্য করতে হবে। কারণ অলিদের হাত আল্লাহর হাতে স্থাপিত। আল্লাহ্ যা করান তা-ই তাঁরা করেন, যদিও দৃশ্যত তা আপত্তিকর মনে হয়। যেমন কোনো অলি দেখলেন যে কোনো ব্যক্তির ওপর অদৃশ্য বিপদ আসছে, তখন তিনি তার কিছু মালামাল তার অনুমতি ছাড়াই সরিয়ে নিলেন এবং যতদিন না তার বিপদ কেটে যায়, ততদিন তা নিজের কাছে রেখে দিলেন। এটা চুরি হবে না, বরং এটা হবে মালের মালিকের প্রতি দয়া প্রদর্শন। কারণ সে সময় সে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তার মালের কিছু অংশ অলি নেওয়ার বদৌলতে আল্লাহ্ তা নিরাপদে রেখেছেন। এভাবে আল্লাহর অনেক অলি সময় সময় দৃশ্যত শরিয়তবিরোধী বহু অপ্রয়োজনীয় কাজও করে থাকেন। কখনো লোকদের গালি দেন। এ গালিরও অর্থ আছে। সময় বিশেষে কাউকে লক্ষ করে গালি দিলেও আসলে বিপদ-আপদকেই গালি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, যাতে তার বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়। লক্ষণীয়, যে ভালো করতে চাচ্ছে, আমরা তাঁর দুর্নাম করছি। হযরত খিজির (আঃ) নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন, নৌকার মালিক দেখলে অবশ্যই তাঁকে চোর মনে করত। অনুরূপভাবে কোনো কোনো ফকির পতিতার ঘরে যাতায়াত করেন; কখনো কখনো মন্দিরেও যান। এতেও রহস্য আছে। এতে চতুর্দিকে প্রসারিত মূর্তির প্রভাব দমন হচ্ছে, অথবা অন্য রহস্যও আছে। আল্লাহর কোনো কোনো অলি নেংটি পরিধান করেন, এরও তাৎপর্য আছে। বিশেষত এর দ্বারা তাঁরা নিজের নফ্সকে লাঞ্ছিত করেন এবং এ লাঞ্ছনার বিনিময়ে অজস্র রহমত ও নেয়ামত লাভ হয়। স্মরণীয় যে, নেংটি পরিধান করা তথা গুপ্তাঙ্গ ঢাকা মালিকী মাজহাবে ফরজ। অথচ অলিদের মাজহাবে তো ফরজই নেই। কারণ তাওহীদপন্থী যখন তাওহীদের সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকেন, তখন বাহ্যিক শরিয়তের কোনো তোয়াক্কা থাকে না। ‘আওয়ারিফ’ এবং ‘ফছুছ্’ প্রভৃতি তাসাউফের কিতাব দ্রষ্টব্য। তবে আল্লাহর অলিগণ সব সময়ই মঙ্গল করে থাকেন। তাঁরা যেখানে থাকেন সেখানে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহর অলিগণ পানাহার ও কথা বলার সময় রহমত নাযিল হয়। অতএব তাঁদের সব কথাই রহমত মিশ্রিত। তাঁরা যদি কাউকে মারেনও তাও রহমত।

অলি দু প্রকার- মুতাসাওফিয়া এবং মালামাতিয়া। মুতাসাওফিয়াগণ কদাচিৎ ছাড়া কখনো বাহ্যিক শরিয়তের খেলাফ কিছু করেন না। কিন্তু মালামাতিয়াগণ দৃশ্যত শরিয়তের খেলাফ করেন। যেমন: নেংটি পরা অথবা উলঙ্গ থাকা ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ গাউস-কুতুব-আবদাল এবং উত্তম ব্যক্তিত্ব এদের থেকেই আবির্ভূত হন এবং এরাই পৃথিবীর হিতাকাঙ্খী।

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...