Thursday, September 25, 2025

সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার কারামত

 

কারামত অলী আউলিয়াগণের খোদায়ী শক্তি। আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামিন বলিয়াছেন, “হে আদম সন্তান আমি আল্লাহ্ আমি ব্যাতিত কোন ইলাহ্ নাই। আমি কোনকিছুকে (সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে) ‘হও’ বলিলেই অমনি হইয়া যায়। আমার আনুগত্য কর, তাহা হইলে তোমাকেও এমন ক্ষমতা দান করিব যে তুমিও কোন কিছুকে ‘হও’ বলিলেই তাহা হইয়া যাইবে।” আল্লাহ্ এক এবং একক। তাই “আমিত্ব” একমাত্র তাহাকেই শোভা পায়। আল্লাহর অলীরা আমিত্ব ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর গুণাবলির বস্ত্র পরিধান করিয়া আল্লাহ গুণে গুণান্বিত হইয়া যান। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ্ বলেন, “আমরা অলীগণ আমরা পোষাকের মধ্যেই অবস্থান করিয়া থাকে, আমি আল্লাহ্ই তাহাদেরকে একমাত্র চিনি”।

সাধারণ মানবকুল জাগতিক, ধর্মীয় বা পার্থিব কোন প্রাপ্তির আশায় অলী আউলিয়াদের দরবারে ছুটিয়া যায়। অলীআল্লাহ্গণও দয়ার সাগর বিধায় বিপদাপন্ন্ সাধারণ মানুষদেরকে দয়া করিয়া থাকেন। আর এই দয়া করিতে গিয়াই কখনো কখনো তাঁহাদের কারামত প্রকাশ পাইয়া থাকে। কোত্বোল এরশাদ্ বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বারও তাই জীবন চলার পথে অসংখ্য কারামত প্রকাশ পাইয়াছে। তিনি এমন এক স্তরের অলী ছিলেন যে, তাঁহার জন্ম-হায়াত শরীফ এবং বেছাল হক্ব সবচেয়ে বড় কারামত হিসাবে পরিগণিত হইয়া রহিয়াছে। আল্লাহর হাবিব, দো’জাহানের বাদশাহ্, সৃষ্টির সূত্র, হুজুর পূরনূর আহম্মদ মোজতাবা মোহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) যেমন ৫৭০ খৃষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার সোব্হেসাদেকের সময় জন্ম গ্রহন করেন এবং ৬৩ বৎসর হায়াত শরীফ প্রাপ্ত হইয়া ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেন ঠিক তেমনি বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরীও ১২৬৩ বঙ্গাব্দে রোজ সোমবার সোব্হেসাদেকের সময় জন্ম গ্রহন করেন এবং ৬৩ বৎসর হায়াত শরীফ লাভ করিয়া ২রা অগ্রহায়ণ রোজ সোমবার সন্ধ্যায় বেছাল হক্ব প্রাপ্ত হন। রাসূল পাক (স্ঃ) এর সহিত জন্ম এবং বেছাল হক্বের এমন সদৃশ আর কোন অলী আউলিয়া জীবনে খুঁজিয়া পাওয়া যায়। বলা যাইতে পারে জন্ম-বেছাল হক্বের এই রহস্যই তাঁহার জীবনের সব চাইতে শ্রেষ্ঠ কারামত।

মেঘ কর্তৃক ছায়া দান

অলি-আউলিয়া গাউস কুতুবগণ যেমন পথভ্রষ্ট, পাপি-তাপি মানুষের জন্য যেমন পথের কান্ডারী হিসাবে আবির্ভুত হন তেমনি তাহারাও  আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে সদা সর্বদা অবস্থান করেন। তাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পাক কোরানে অসংখ্য জায়গায় উসিলা গ্রহনের নির্দেশ দান করিয়াছেন। কোরআন পাকে ঘোষিত এই উসিলা তথা অলি আল্লাহ্ গণ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলঅমীনের রহমত ও বরকত লাভে ধন্য হইয়া এই ধরনী তথা সৃষ্টিকুলকেও করিয়াছেন রহমত ও বরকতময়।

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বাও ছিলেন তেমনি একজন লক্ষ কোটি পথহারা মানুষের উসিলা। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার সমসাময়িককালে ছোট বড় দুরে কাছের অসংখ্য মানুষ তাঁহার প্রচুরকারামত দর্শনে সৌভাগ্যবান হইয়াছেন। পৃথিবীতে অনেক বিষয়ে এমন একটা বিধি থাকে যাহা সর্ব সাধারনের জন্য। সুরেশ্বরী বাবারক্ষেত্রেও তাহার একটা কারামত ছিল সর্বজনদৃশ্য; তাহা হইল মেঘ কর্তৃক ছায়া দান। সর্ব সাধারন ইহা দেখিতেন যে, সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা প্রখর রৌদ্রে যখনই পথ চলিতেন তখন একখন্ড মেঘ তাঁহাকে সর্বক্ষন সূর্য্যরে বিপরীত দিকে থাকিয়া ছায়া দান করিত। নিঃসন্দেহে বলা যায় আল্লাহর অতি পেয়ারা অতি ছাড়া এহেন রহমত কেহই আসা করিতে পারে না।

গুলির মুখ হইতে জীবন রক্ষা

ঘটনাটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার। আব্দুস সালাম নামের জনৈক ভদ্রলোক হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) কা’বার আশেক এবং হযরত জালাল নূরী ক্বিবলা কা’বার (রাঃ) মুরিদ ছিলেন। প্রতিবছর মহান উরস মাহ্ফিলের সময় তিনি সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ রাখিয়া দরবারে হাযির হইতেন। তিনি বরিশালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং কর্ম জীবনে রাজধানী ঢাকার হোটেল আনাম (আবাসিক) এরম্যানেজার ছিলেন। ১৯৭১ সালে একবার পাক হানাদার বাহিনী সালাম সাহেবদের গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়া গ্রামের যুবক বয়সের প্রায় প্রত্যেককেই ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া একমাঠে সারিবদ্ধ ভাবে দাড় করাইয়া রাখিল। অতঃপর হানাদার বাহিনীর অফিসারের নির্দেশ হইল সারিবদ্ধ অবস্থায় প্রত্যেককে ফাঁয়ার করিয়া মারিয়া ফেলিবার জন্য। নির্দেশমত গুলি শুরু হইল একে একে সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িল। সবাইকে সারিবদ্ধ ভাবে দাড় করানোর সময় সালাম সাহেব চোখ বন্ধ করিয়া দয়াল বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বাকে স্মরণ করিলেন। তখন দেখিলেন তাহার সম্মখে দরবার শরীফের গম্বুজ ভাসিয়া উঠিল এবং সেইখান হইতে একটা কুদরতি আলোক রশ্মির সহিত একটি গোলাপ ফুল আমার সামনে ঝুলিয়া রহিয়াছে। ইহার মধ্যে গুলি শুরু হইলে আমার সালাম সাহেব এর দিকে ধেয়ে আসা প্রথম গুলিটি সালাম সাহেব এর গায়ে না লাগিয়া গোলাপের গায়ে লাগিল এবং গোলাপটি ঘুরিয়া গেল। দ্বিতীয় বারের গুলিটিও গোলাপের গায়ে লাগিল এবং সালাম সাহেব প্রাণে রক্ষা পেলেন। তৃতীয় বার যখন গুলি করিল তখন গুলিটি গোরাপের গায়ে লাগিয়া আমার হাটুতে বিদ্ধ হইল। তিনি মৃত্যুর ভয়ে চিৎকার দিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়েন। এইভাবে সকলের মৃত্যু নিশ্চিত করিয়া হানাদার বাহিনী চলিয়া গেল। ইহার পরে গ্রামে এমন কোন মানুষ ছিলনা যে আসিয়া কেহ কাহারো খবর লয়। ইত্যবসরে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। মৃত মানুষ গুলোর রক্তের গন্ধে শত শত শৃগাল হাযির হইল। সালাম সাহেবের শরীর হইতে তখন অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে এতই কাহিল হইয়া পড়িয়াছিল যে,ন্যূনতম নড়াচড়া শক্তি গায়ে ছিলনা। ইতিমধ্যে মরা দেহ গুলি লইয়া শিয়ালের তান্ডব শুরু হইয়া গেল। মনে মনে সালাম সাহেব বিপদের কান্ডারী বাবা জানুকে স্মরণ করিলেন। হঠাৎ দেখিলেন যে, বেশ বড় সড় বাঘের মত দুইটি কুকুর তাহার মাথা এবং পায়ের অনতিদূরে দাড়াইয়া তাহাকে শিয়ালের হাত হইতে পাহারা দিতেছে। যখনই শৃগালগুলো লাশ মনে করিয়া তাহার দিকে আসে তখনই কুকুর দুটি গর্জন করিয়া শৃগাল গুলোকে তাড়াইয়া দেয়। এইভাবে রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল। ইত্যবসরে সালাম সাহেব ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করিতে লাগিলেন এবং ভাবিলেন এইখানে এই ভাবেই বোধহয় না খাইয়া মরিয়া যাইতে হইবে। হঠাৎ গায়েবী আওয়াজ শুনিতে পাইলেন কে যেন বলিতেছে, তোমার পাশে দুইটি রুটি রহিয়াছে উহা খাইয়া লও। হঠাৎই তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। চাহিয়া দেখিলেন সত্যিই কাগজে মোড়ানো শুকনা রুটি তাহার শরীরের ডাহিন পার্শ্বে পড়িয়া রহিয়াছে। তিনি তাহার মুর্শিদ ক্বিবলা এবং বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরীর চরণে লক্ষ কোটি ভক্তি জানাইয়া রুটি খাইয়া শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরিয়া পাইলেন। পরদিন খুব সকালে লোকজন আসিয়া সালাম সাহেবকে উদ্ধার করিল। ১৯৭১ সালের সেই মর্মান্তিক স্মৃতির কথা এবং দয়াল বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার দয়ার কথা স্মরণ করিয়া সালাম সাহেব এই ঘটনা বলার সময় হাউ মাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

গোদ রোগ হইতে মুক্তি এবং ভবিষ্যত বাণী

একবার সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা (রাঃ) সাবেক ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান জামালপুর জেলায় ছফরে বাহির ছিলেন। তথায় মকবুল মুন্সি নামে সুরেশ্বরী বাবার একজন খলিফা ছিল। ঐএলাকায় গেলে জানু বাবা তাহার বাড়িতেই তাশরিফ আনিতেন। তখন অত্র এলাকার তালুকদার ছিলেন জনাব মনফর উদ্দিন। তাহার জৈষ্ঠ্য পুত্র জনাব আব্দুস সালাম তালুকদার সাহেবের গোদ রোগ (পা ফোলা রোগ) হইয়া ছিল। তালুকদার সাহেব ছেলেকে ভাল করিবার জন্য এহেন ব্যবস্থা ছিলনা যাহা তিনি কনের নাই। বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা সম্পর্কে তাহার অল্প বিস্তর জানা ছিল। ছেলের অবস্থা দিন দিন অতিশয় সংকটাপন্ন হইয়া পড়িল। সেই সময়ে গোদ রোগের কোন চিকিৎসা ছিলনা। যক্ষার মত গোদ রোগেও মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। তালুকদার সাহেব বুঝিলেন যে কোন অলি-আউলিয়ার নেক নজর ছাড়া ছেলের জীবন রক্ষা করা যাইবে না। তাই তিনি একদিন মকবুল মুন্সীর নিকট গিয়া বলিলেন, আমি আপনার মুর্শিদ ক্বিবলা মাওলানা জানশরীফ সম্পর্কে শুনিয়াছি এবং এ ও জানি যে, তিনি মাঝে মাঝে আপনার এখানে আসেন। আমি আপনার নিকট আসিবার কারণ এই যে, আমার একমাত্র ছেলের কঠিন গোদ রোগ হইয়াছে। আমি জানি অলি-আউলিয়ার দয়া ছাড়া এই রোগ ভাল হইবার নহে। এখন আপনার মুর্শিদ ক্বিবলা আসিলে আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করিবেন বলিয়া আশা করিয়া আসিয়াছি। সব শুনিয়া মকবুল মুন্সী বলিলেন, আপনার ভাগ্য নিশ্চয়ই ভাল যে আমার মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা জান শলীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ) ছফরে আসিয়া আমার বাড়িতে তাশরিফ আনিয়াছেন। তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল। একমাত্র তাঁহার উসিলায় আপনার ছেলে রোগ মুক্তি পাইতে পারে। আপনি এখনিআপনার ছেলেকে লইয়া তাঁহার পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়ুন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি রোগমুক্তির ব্যাপারে আশ্বস্ত না করিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার পদযুগল ছাড়িবেন না। পুত্রের জীবনে রক্ষার্থে তালুকদার সাহেব তাহাই করিলেন। পরামর্শ অনুযায়ী তালুকদার সাহেব যথাসময়ে দয়াল বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলাকে ধরিয়া বসিলেন। তালুকদার সাহেবের কাকুতি মিনতিতে সুরেশ্বরী বাবার হৃদয়ে দয়ার উর্দ্রেক হইল। তিনি বলিলেন বাবা আমি তোমার সন্তানের রোগমুক্তির দোয়া করিব এবং একটি তাবিজ লিখিয়া দিব কিন্তু তুমি কি উক্ত তাবিজের ছদ্কা আদায় করিতে পারিবা? তালুকদার সাহেব ছদকা আদায় করিতে রাজি হইলেন। বাবা সুরেশ্বরী আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করিয়া একটি তাবিজ লিখিয়া দিলেন। তাবিজটি তালুকদার সাহেবের হাতে দিয়া সুরেশ্বরী বাবা একটি ভবিষ্যত বাণী করিলেন। বলিলেন, “আমি দেখিতেছি এই ছেলের (রোগী) সহিত আমার বংশের আত্মীয়তার সূত্র স্থাপিত হইবে”। ইহার কিছু দিনের মধ্যেই তালুকদার পুত্র আব্দুস সালাম সাহেব গোদ রোগের ভয়াবহ অভিশাপ হইতে মুক্তি পাইয়া ছিলেন।

উল্লেখ্য যে, ঘটনাটি স্বয়ং জমিদার পুত্র আব্দুস সালাম সাহেব বর্ণনা করিয়াছেন। ছদ্কার ব্যাপারে কি বা কত টাকা ধার্য হইয়াছিল তাহা সালাম সাহেবের মনে নাই। তবে শুধু এইটুকু মনে রাখিয়াছেন যে ছদ্কা দিবার জন্য ৮২ মন ধান গোলা হইতে বাহির করিয়া বিক্রি করা হইয়াছিল। এছাড়া ভবিষ্যত বাণীর দিকে লক্ষ্য করিলে দেখা যায় যে, সুরেশ্বরী বাবার নাতি হযরত বাবা জলাল নূরী (রাঃ) এর বড় শাহ্জাদা সাইয়েদ শাহ্ সূফী কামাল নূরীর সহিত তালুকদার পুত্র আব্দুস সালাম সাহেবের কন্যা সাইয়েদা লুৎফা বেগমের শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হইয়াছে। 

হযরত আঃ মজিদ শাহ্ (পাগলা মৌলভী) সর্ম্পকে ভবিষ্যত বাণী

একদা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) কতিপয় শিষ্য আরজ করিলেন বাবা আমাদের এতদাঞ্চলে আর কোন কামেল অলি-আল্লাহ্ আছেন কিনা, জানিতে চাহিলে বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা বলিলেন, “আমার এখন হইতে পশ্চিম দিকে একটি ফুল ফুটিতেছে আশা করি যথা সময়ে ইনশাআল্লাহ্ তাহার সৌরভ ও সুগন্ধ ছড়াইবে।” ভক্তরা পূনরায় তাহার পরিচয় জানিতে চাহিলেন তিনি বলিলেন, “তাহার নাম মজিদ শাহ্, সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হইবে, হাদিস ও ফেকাহ্ শাস্ত্রের উপর তাহার অগাধ জ্ঞান থাকিবে এবং পরিণত অবস্থায় সে মজ্জুব হালাতে থাকিবে”।

যতদুর জানা যায় হযরত আঃ মজিদ শাহ্ ১২৮৬ বাংলা সনে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার কেদারপুর ইউনিয়নের বুন্না গ্রামে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। শেষ দিকে মজ্জুব হালাতে থাকিতেন বলিয়া সবাই তাহাকে “পাগলা মৌলভী” বলিয়া ডাকিত। তাঁহার কন্ঠ অত্যন্ত সুন্দর ছিল। তিনি যখন তখন যেখানে সেখানে দাড়াইয়া আজান দিতেন। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার প্রতি ছিল তাঁহার অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। তিনি সুরেশ্বর আসিয়া জানু বাবার রওজা মোবারকের নিকট যাইয়া ঘন্টার পর ঘন্টা ভক্তিরত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতেন এবং সুরেশ্বরের পবিত্র উরস শরীফে জানু বাবার পুত্র নূরী শাহ্ (রহঃ) বাবার সঙ্গি হয়ে সব সময় তাঁহার পিছন পিছন ছায়ার মত আবিষ্ট হইয়া থাকিতেন। হযরত মজিদ শাহ্ ওরফে পাগলা মৌলভী সাহেবের জীবনের অসংখ্য কারামত প্রকাশ পাইয়াছে। একবার জনৈক বৃদ্ধা মহিলা বিশেষ কারনে সুরেশ্বরী বাবার (রহঃ) দরবারে একটি মোরগ মানত করিয়াছিল। তাহার নিয়ত মোতাবেক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাহাকে দয়া ও কৃপা করিবার পর তাহার মানতের মোরগের কথা মনে পড়িয়া গেল। যথা সময়ে উক্ত বৃদ্ধা মহিলা মোরগ লইয়া সুরেশ্বর দরবার অভিমুখে রওয়ানা হইল। পাগলা মৌলভী সাহেবের বাড়ির সন্নিকটে আসিলে মহিলা ভাবিল অলি-আউলিয়ারা সবাই ই এক, ইহার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। সুতরাং এই খরতপ্ত রোদে সেই সুরেশ্বর দুই মাইল দূরে দরবারে না যাইয়া মোরগটা পাগলা মৌলভী সাহেবের এই খানেই দিয়া যাই। এই ভাবিয়া পাগলা মৌলভী সাহেবের বাড়িতে পৌছাইতেই পাগলা মৌলভী সাহেব রাগতঃ স্বরে সেখান হইতে চলিয়া যাইতে বলিলেন। মহিলা নিত্য পাগলামী ভাবিয়া দাড়াইয়া রহিল। এই সময়ে পাগলা মৌলভী সাহেবের পত্নী কিছু না বুঝিয়া মোরগ নিতে উদ্যত হইলে অত্যন্ত রাগত ভাবে তিনি স্ত্রীকে বলিলেন, “সুরেশ্বরী বাবার মোরগ খাইয়া কেহ হজম করিতে পারে না। এই মোরগ খাইলে হুগা দিয়া লাল সুতা বাহির হইবো”। অতঃপর আগন্তক মহিলাকে মোরগ লইয়া নিয়ত মোতাবেক সুরেশ্বরী বাবার দরবারে দিয়া আসিবার হুকুম করিলেন। বৃদ্ধা মহিলা অত্যন্ত ভয় পাইয়া যথাদ্রুত সম্ভব সুরেশ্বর দরবার শরীফে পৌছাইল। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) রওজা মোবারকে ভক্তি দান করতঃ হযরত নূরী শাহ্ বাবার (রহঃ) স্ত্রীর নিকট মোরগটি তুলিয়া দিয়া মাঝ পথে ঘটিয়া যাওয়া সমস্ত ঘটনা আদ্যপান্ত বর্ণনা করিয়া ছিল।

হযরত আঃ মজিদ শাহ্ (রহঃ) বাংলা ১৩৭৫ সালে অগণিত ভক্ত-মুরিদ রাখিয়া ইন্তেকাল করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁহারই আত্মীয় পুত্রবৎ লালন পালন করিয়াছিলেন। তিনিই বর্তমানে বুন্না পাক দরবার শরীফের গদিনশীন পীর। 

হযরত বাহার শাহের সহিত সম্পর্ক ও তাঁহার মুরিদের প্রতি দয়া

হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) বাবার সময়ে হযরত বাবা বাহার শাহ্ একজন উঁচু স্তরের মজ্জুব অলিয়ে কামেল ছিলেন। রাজধানী ঢাকার বাবু বাজারে (বর্তমান বাবু বাজার ব্রিজের নিচে) তাঁহার মাজার শরীফ রহিয়াছে। হযরত বাবা সুরেশ্বরীর সহিত তাঁহার অত্যন্ত গভীর এবং মধুর রূহানীয়াত সম্পর্ক ছিল। যেহেতু বাবা বাহার শাহ্ মজ্জুব অলি ছিলেন তাই তিনি উলঙ্গ অবস্থায় থাকিতেন। তবে সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার রূহানিয়াত ভাবে আগমনের সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তিনি কাপড় পরিধান করিয়া বাবা সুরেশ্বরীর অপেক্ষায় থাকিতেন। অতঃপর সুরেশ্বরী বাবাকে দেখা মাত্রই আদব ও সম্মানার্থে বাবা বাহার শাহ্ দাড়াইয়া মুক্ত কন্ঠে ঘোষণা করিতেন, “শাহান শাহে অলি, সুলতানুল বাঙ্গাল আসিয়াছেন”। ইহার পর দুইজনে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হইতেন। সুরেশ্বরী বাবা ও বাহার শাহ্ বাবার রূহানীয়াত গভীর সম্পর্কের কথা উভয়ের ভক্ত ও মুরিদদের মধ্যে সকলেই ভাল করিয়া অবগত ছিল।

যাহাই হউক, একবার বেয়াদবির কারনে বাহার শাহ্ বাবা তাঁহার জনৈক মুরিদের প্রতি অত্যন্ত অসন্তষ্ট হইয়াছিলেন।

অনেক কান্নাকাটি করিয়াও তিনি মুর্শিদের নিকট হইতে ক্ষমা লাভ করিতে পারেন নাই। বাহার শাহ্ বাবার উক্ত মুরিদ জানিতেন যে, বাবা বাহার শাহ্র সহিত হযরত সুরেশ্বরী বাবার গভীর রূহানীয়াত সম্পর্ক আছে। এই মহা বিপদ হইতে বাবা সুরেশ্বরীর মাধ্যমেই উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। অবশেষে তিনি নিরুপায় হইয়া বাবা সুরেশ্বরীর জনৈক প্রিয় মুরিদ জনাব করিম খাঁ সাহেবের দ্বারস্থ হন। করিম খাঁ সাহেব বাহার শাহ্ বাবার দরবারে প্রায়ই যাতায়াত করিতেন সেই সূত্রে বাহার শাহ্ বাবার মুরিদের সহিত করিম খাঁ সাহেবের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হইয়া ছিল। করিম খাঁ সাহেবের হাত চাপিয়া ধরিয়া উক্ত মুরিদ বলিলেন, ভাই আমি মহা বিপদে পড়িয়াছি আর এই বিপদ হইতে আপনি এবং আপনার মোর্শেদই আমাকে উদ্ধার করিতে পারেন। উত্তরে করিম খাঁ সাহেব বলিলেন, “আপনার জন্য যাহা কিছু দরকার ইনশাআল্লাহ্ আমি তাহা সবই করিব, বলুন কি করিতে হইবে। উক্ত মুরিদ বলিলেন, আপনার মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা সুরেশ্বরীর দরবারে যাইতে হইবে। অতঃপর যাতায়াত ভাড়া, একখানা পোষ্ট কার্ড এবং এক পূটলি গাঁজা করিম খাঁ সাহেবের হাতে দিয়া বলিলেন “ভাই এই গাঁজা নজরানা স্বরূপ আপনার মুর্শিদ ক্বিবলার হাতে দিবেন এবং গাঁজা তাহার হাতে প্রদানের পরে মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা সুরেশ্বরী যাহা বলেন তাহা অতি সত্তর এই পোষ্ট কার্ড খানায় লিখিয়া পাঠাইবেন। গাঁজার পূটলি হাতে লইয়া করিম খাঁ সাহেব হতবাক হইয়া রহিলেন কেননা তাহার মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা সুরেশ্বরী কখনো গাঁজা খাইতেন না এবং তাঁহার মুরিদানদের জন্য গাঁজা খাওয়া কঠিন ভাবে নিষেধ ছিল। তবে বাহার শাহ্ বাবা এবং তাহার মুরিদাগণ গাঁজা খাইতেন। সে যাহাই হউক ঐ দিনই করিম খাঁ সাহেব সুরেশ্বর দরবার শরীফ পৌছাইলেন। দরবারে যাইয়া মুর্শিদের জ্যোতির্ময় চরণ চুম্বন করতঃ ভয়ে ভয়ে গাঁজার পূটলি হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার হাতে দিলেন। গাঁজার পূটলি হাতে লইয়া সুরেশ্বরী বাবা মুচকি হাসিলেন এবং হাতের আষা মাটিতে মৃদু আঘাত করিয়া বলিলেন, “লে  ব্যাটা তেরাহীতো টো হ্যায়। ইত্না গোস্যা কিউ কিয়া, আভি ক্ষমা কারকে গোদমে লেলে অর বাতচিৎ কার” এই কথা বলিয়া করিম খাঁ সাহেবের সহিত সাধারন আলোচনায় রত হইলেন। অতঃপর সুরেশ্বরী বাবা গাঁজা হাতে পাইয়া মুচকি হাসিয়া যাহা যাহা বলিয়া ছিলেন করিম খাঁ সাহেব হুবহু তাহাই পোষ্টকার্ডে লিখিয়া পাঠাইয়া ছিলেন। করিম খাঁ সাহেব মুর্শিদের খেদমতে কয়েকদিন অতিবাহিত করিয়া দেশে ফিরিয়া আসিলে বাহার শাহ্ বাবার উক্ত মুরিদ করিম খাঁ সাহেবকে জড়াইয়া ধরিলেন এবং সন্তুষ্টি প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ভাই আপনি আমাকে যে উপকার করিয়াছেন, তাহা কখনোই ভুলিব না” সুরেশ্বর হইতে প্রেরিত আপনার লেখা পোষ্ট কার্ডটি পাইয়া আমি আমার মুর্শিদের দরবারে হাজির হই। আমার মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা বাহার শাহ্ আমার পূর্বেকার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন এবং পূর্বাপেক্ষা অধিক মহব্বত করিতেছেন। 

এক বছরের গাছপাকা কাঁঠাল পরের বছরে ভক্তের বাড়িতে প্রেরণ

আশেক ও ভক্ত প্রান সর্বদাই মুর্শিদ প্রেমে বিভোর থাকে। জাহের-বাতেনে সর্বক্ষেত্রেই মুর্শিদের প্রতি অবিচল বিশ্বাষ এবং ভক্তিতে থাকে বিগলিত। দৈনন্দিন জীবনেও ইহার ছাপ সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়। নিত্যকার বিধানের মতই সাধারনত ভক্ত ও মুরিদগণ অধিক দয়া ও রহমতের আশায় গাছের প্রথম ফল অথবা চাকুরির প্রথম মাসের বেতনের সমদয় অর্থ বুঝিবার ক্রটি জনিত অপরাধ হইতে রক্ষা করিবার জন্য হইলেও উল্লেখ করা দরকার যে, বেলায়েতের অধিকারী হাক্কানী পীর ও মুশিদগণ কখনোই কাহারও নিকট হইতে যাচাই কিছু গ্রহণ করেন না।

যাহাই হউক সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার (রাঃ) জনৈক মুরিদের কাঁঠাল গাছে প্রথমবারের মত কুড়ি আসিলে তিনি নিয়্যত করিয়া রাখিয়া ছিলেন যে, প্রথম ফলটি মুর্শিদের খেদমতে লইয়া যাইবেন। আল্লাহর কি ইশারা, সেই বৎসরে মাত্র একটি কাঁঠালই গাছটিতে ধরিয়াছিল। যথাসময়ে কাঁঠালটি গাছপাকা অবস্থায় কাটিয়া নামানো হইল। কিন্তু গৃহকর্তা পড়িয়া গেলেন মহা বিপাকে। স্ত্রী-সন্তানাদি কিছুতেই একমাত্র কাঁঠালটি লইয়া আসিতে দিবে না। বিশেষ করিয়া গৃহকর্ত্রী ছোট ছেলে-মেয়েদের ওজর দেখাইল। কিন্তু গৃহকর্তা কোনকিছুই শুনিলনা। গাছপাকা কাঁঠালটিকে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের সম্মুখ হইতেই মুর্শিদ ক্বিবলার খেদমতে দরবারে লইয়া আসিল। হযরত সুরেশ্বরী বাবা তখন তাঁহার মুরিদ লৌহজং থানার কুড়িগাও গ্রামের কানাই ব্যাপারীর ছেলে করিম বক্সের সহিত কথা বলিতেছিলেন। এই সময়েই কাঁঠালটি লইয়া উক্ত মুরিদ সুরেশ্বরী বাবার সামনে আসিয়া দাড়াইল। কাঁঠালটি বাবার সামনে রাখিয়া তাঁহার পদ চুম্বন করিয়া উঠিয়া দাড়াইতেই তিনি তাঁহার মুরিদ করিম বক্সকে হুকুম করিলেন কাঁঠালটি পুকুরে ফেলিয়া দিবার জন্য। আগন্তক মুরিদ নিজের কোন অপরাধ হইয়াছে মনে করিয়া ব্যথিত মনে মুর্শিদ ক্বিবলার পদ চুম্বন করতঃ বিদায় লইলেন। সুরেশ্বরী বাবাও করিম বক্সের সহিত কথাবার্তা সারিয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করিলেন। যাহা হইক, পরবর্তী বৎসরও উক্ত মুরিদ সেই একই গাছের আর একটি গাছপাকা কাঁঠাল লইয়া সুরেশ্বরী বাবার সামনে যখন হাজির হইল তখনও গতবারের মতই করিম বক্স সাহেব সেইখানে উপস্থিত ছিলেন। কাঁঠাল সমেত পূণরায় উক্ত মুরিদকে দেখিয়া সুরেশ্বরী বাবা করিম বক্সকে বলিলেন, গতবছর পুকুরের যেইখানে কাঁঠালটি ফেলিয়াছিলে সেআখান হইতে কাঁঠালটি তুলিয়া লইয়া আস। করিম বক্স আশ্চর্য হইলেন বটে তবুও মুর্শিদের নির্দেশমত পুকুরের সেইখান হইতে ডুব দিয়া অবিকল গতবছরের কাঁঠালটিই তুলিয়া লইয়া আসিলেন, যাহার বোটায় আগের মতই কষ পরিলক্ষিত হইতেছিল এবং আগের মতই সুঘ্রাণ ছড়াইতে ছিল। অতঃপর দ্বিতীয় বারের আনা কাঁঠালটিকে ভাঙ্গিয়া সবাইকে খাইতে নির্দেশ দিলেন এবং প্রথম কাঁঠালটিকে বাড়ি লইয়া গিয়া স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ খাইতে উক্ত মুরিদকে নির্দেশ করিলেন। মুরিদটির বুঝিতে বাকি রহিলনা যে গত বৎসর আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের কাঁকুতি মিনতি সুরেশ্বরী বাবার অন্তরেও সমবেদনার সৃষ্টি করিয়াছিল। কিন্তু আমার মনে কষ্ট লাগিবে বিধায় গতবারেই বাবা কাঁঠালটি ফেরত পাঠান নাই। সুরেশ্বরী বাবার এহেন কারামত ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় লাভ করিয়া মুরিদটি ধন্য হইল। অবশেষে মুর্শিদের পদ্মচরনে ভক্তি ও চুম্বন দান করতঃ বিদায় লইয়া কাঠালটি কাঁধে করিয়া সুরেশ্বরী বাবার জয়গান গাহিতে গাহিতে বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হইল। 

গোলাম মাওলা হোসাইন চিশতি হুজুরকে হয়াত দান

আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের জাত পাকে ফানা হইয়া যাওয়া তথা “নূরেহক্ব” এর প্রজ্জলিত অগ্নিশিখা বনিয়া যাওয়া অলি-আউলিয়াগণ সব রকমের ক্ষমতার অধিকারী হইয়া যান যাহা সাধারন মানুষের চিন্তা শক্তির অনেক অনেক দূরে অবস্থান করিয়া থাকে। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন তেমটি নূরেহক্ব এর প্রজ্জলিত অগ্নিশিখা। জাহেরে বাতেনে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন নূরে নূরময়। সর্বাবস্থায়ই তিনি ভক্ত মুরিদের সংকট মুহুর্তে পাশে আসিয়া তাঁহার স্নেহ ও দয়ার হাত প্রসারিত করিয়া দিতেন।

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার জামাতা হযরত গোলাম মাওলা হোসাইনী চিশতি ওরফে শামপুরী বাবা তখন তাঁহার শ্বশুর ক্বিবলা বাবা সুরেশ্বরীর জীবনী মোবারক লিখিতে ছিলেন। তাঁহার জীবনের শেষ প্রান্তে আসিয়া এই ভাবনায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, শ্বশুর ক্বিবলা তাহাকে জাগতিক তথা পার্থিব এবং বেলায়েত তথা মারেফত রাজ্যের হীরা-পান্না-মনি-মুক্তা বহু কিছু দান করিয়াছেন। সেই দানের ন্যূনতম প্রতিদানের নিমিত্তে শেষ বয়সে অসুস্থ শরীরে তিনি সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার জীবনী মোবারক লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুরেশ্বরী বাবার কন্যা শামপুরী বাবার স্ত্রী মা আরেফা খাতুন প্রায়ই তাঁহার শরীরের দিকে তাকাইয়া লিখালিখি বন্ধ করিতে বলিতেন, কিন্তু শামপুরী বাবা রাগ হইয়া যাইতেন এবং বলিতেন, যাহার নূরী হস্ত মোবারকের ছোঁয়ায় মারেফতের গভীর সাগরে ডুব দিবার তৌফিক অর্জন করিয়াছি তাঁহার জীবনী মোবারক লিখিবনাতো লিখিব কি? সেই জন্যে কি এই শরীরের দিকে তাকানো চলে? যাইহোক লিখিতে লিখিতে এক সময় তিনি প্রচন্ড অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। তাঁহাকে ঢাকাস্থ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করানো হইল। বাবা শ্যামপুরী একটানা তিনদিন পর্যন্ত ডাক্তারী ভাষায় যাকে বলে কমা’র মধ্যে ছিলেন অর্থাৎ বেহুশ অবস্থায় ছিলেন। এই সময়ে মা আরেফা খাতুন শামপুরী বাবার স্ত্রী তাঁহার পিতা ক্বিবলা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী বাবার দরবারে ভক্তিপূর্ণ প্রেম দ্বারা আবেদন জানাইলেন, “বাবা আমি সারা জীবনে তোমার কাছে কিছুই চাই নাই আজ তোমার দরবারে আমার একান্ত মিনতী ও চাওয়া বাবা, আমি যেন বিধবা না হই”। বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার দরবারে এই আরজ জানাইয়া তিনি উৎকন্ঠিত ভাবে হসপিটালে অবস্থান করিতে লাগিলেন। একটানা তিন দিন পর্যন্ত বেহুস অবস্থায় থাকিয়া শামপুরী বাবার জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে ডাক্তার সাহেবগণ অত্যন্ত কঠোর ভাবে জানাইয়া দিলেন যে রোগীর সহিত যেন কথাবার্তা বা দেখাশুনা করিবার অনুমতি কাউকে দেয়া না হয়। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার পবিত্র জীবনী লেখক হযরত শাহ্ সূফী বেলাল নূরী উক্ত কিতাবে লিখেন আমার দাদা শামপুরী হুজুরের জ্ঞান ফিরিয়াছে শুনিয়া হসপিটালে গিয়াছিলাম তাঁহার সহিত দেখা করিতে। শামপুরী হুজুর ক্বিবলা আমাকে দেখিলেই তাঁহার কথা বলার সাগরে ঢেউ জাগিত। তাই আমি পৌছামাত্রই দাদীজান সহ সকলেই বারণ করিল যেন তাঁহার সামনে না যাই। কিন্তু ততক্ষণে দাদাজান আমাকে দেখিয়া ফেলিয়াছেন এবং হাতের ঈশারায় আমাকে কাছে ডাকিলেন। তখন আর রা করিবরি কাহারো উপায় ছিলনা। যাহা হউক কাছে যাইতেই তিনি বলিলেন, উহারা সবাই বলিতেছে যে আমি নাকি তিনদিন বেহুশ হইয়া ছিলাম আসলে আমি বেহুশ ছিলাম না। এই অবস্থার মধ্যেই আমার শ্বশুর ক্বিবলা বাবা সুরেশ্বরী আসিয়া আমাকে বলিলেন যে, আমার নাকি অন্তিম সময়য় হইয়া গিয়াছিল কিন্তু আমার স্ত্রী আরেফা খাতুনের আরজ কবুল করিয়া হায়াৎ দান করতঃ এই যাত্রায় আমাকে কোলে তুলিয়া না লইয়া ফেরত পাঠাইয়াছেন”। এইটুকু বলিয়াই সুরেশ্বরী বাবার প্রতি ভক্তি, প্রেম ও দয়ার কথা স্মরণ করিয়া দুই চোক্ষের পানি ছাড়িয়া দিলেন।

উল্লেখ্য শামপুরী হুজুর ক্বিবলা সুস্থ্য হইয়া বাড়ি আসিবার কিছুদিন পরই মা আরেফা খাতুন অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অল্প কিছুদিন অসুস্থ থাকিয়া দুনিয়ার মায়া ছাড়িয়া বিদায় নিলেন। মা আরেফা খাতুন বেছাল হক্ব লাভ করিবার প্রায় এক বৎসরের মাথায় শামপুরী বাবা পুনরায় অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। অতঃপর কিছুদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকিয়া হাজার হাজার ভক্ত ও মুরীদদেরকে শোক সাগরে ভাসাইয়া দুনিয়া হইতে পর্দা গ্রহণ করিলেন।

একটু গভীর এবং সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করিলেই দিনের আলোর মত পরিস্কার হইয়া যাইবে যে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা কত উচ্চ স্তরের অলিয়ে মোকাম্মেল ছিলেন। তাঁহার কন্যা মা আরেফা খাতুন শুধু আরজ করিয়াছিলেন যে, তিনি যেন বিধবা না হন। তাঁহার হৃদয়ের ঐকান্তিক চাওয়াকে বাবা সুরেশ্বরী কবুল করিয়া স্বামীর আগেই তাঁহাকে দুনিয়া হইতে টানিয়া কোলে তুলিয়া লইলেন, এবং এক বৎসরের মধ্যে বাবা শামপুরীকেও কবুল করিয়া দুইজনকে মহা সুখের জগতের বাসিন্দা হিসাবে পরিচিত করাইয়া দিলেন।


মেয়ে জন্মাইবার পূর্বেই জামাতা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী

হযরত বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) আল্লাহ্ প্রেমে এতটাই মকবুল ছিলেন যে ইবাদাত আরাধনা ছাড়াও দুনিয়াবী বা জাগতিক কাজের ক্ষেত্রেও তিনি মাঝে মাঝে বেখেয়াল হইয়া যাইতেন। আবার তার যে কোন কাজের দুরদর্শিতা দেখলে মানুষ অবকি হইয়া যাইত। হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) বাবার কাশ্ফ শক্তি এতটাই প্রশস্ত ছিল যে হাজার বছর পরে কি হইবে বা কি ঘটিতে যাইতেছে তাহা অবলীলায় বলিয়া দিতে পারিতেন। সাধারণত অলি-আউলিয়াদের ক্ষেত্রে এমন ধারনাই প্রচলিত যে তাহার যখন সাধনায় লিপ্ত হইতেন বা মোরাকেবা মোসাহেদায় নিজেকে স্থুুল জগৎ হইতে সুক্ষ্ম জগতে নিয়ে আসিতেন তখনই কেবল তাহাদের কাশ্ফ শক্তি জারি হইত এবং যে কোন বিষয়েডরই ভুত-ভবিষ্যত জানিতে পারিতেন। কিন্তু সুরেশ্বরী (রহঃ) বাবা ছিলেন এর থেকে ব্যতিক্রম। কেননা তিনি কামালিয়াতের এমনই এক স্তরে পৌছাইয়া ছিলেন যে কাশ্ফ শক্তিকে জারি করিবার জন্য তাঁহার মোরাকেবা মুসাহেদার দরকার হইতনা বরং নিশ্চিন্তে ইহা বলা যায় যে সর্বাবস্থায় তাঁহার কাশ্ফ শক্তি জারি থাকিত। উল্লেখ্য, একবার সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা তাঁহার অন্যতম মুরিদদেরকে সঙ্গে লইয়া নোয়াখালী জেলায় সফরের শ্যামপুর দরবার শরীফের পার্শ্ব দিয়া যাইতেছিলেন। দরবার শরীফের নিকটবর্তী স্থানে যাইয়া হঠাৎ করিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা যে স্থানে দাঁড়াইয়া গিয়াছিলেন তাহার অনতিদূরেই জনাকয়েক বাচ্চা ছেলে খেলাধুলা করিতেছিল। তিনি তাঁহার মুরিদদেরকে কাছে ডাকিয়া খেলাধুলারত একটি ছেলেকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, দেখতো ঐ ছেলেটিকে কেমন মনে হয়। উত্তরে একজন মুরিদ বলিলেন, দেখে শুনেতো মনে হয় সম্ভান্ত বংশীয়। পুণরায় সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রহঃ) প্রশ্ন করিলেন, তোমরা কি তাহাকে চিনিতে পারিয়াছ? উত্তরে সবাই একবাক্যে ‘না’ সূচক ধ্বনি তুলিল। উত্তর শুনিয়া হযরত বলিলেন তোমরা কেউ তাহাকে চিনিতে পারিলোনা? উনি তোমাদের ‘দুলাভাই’। সমস্ত মুরিদগণ কিছুক্ষণ স্তব্দ হইয়া সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা (রহঃ) এর কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন কেননা বর্তমানে বাবা সুরেশ্বরীতো কোন অবিবাহিত মেয়ে নাই তো উনি কেমন করিয়া আমাদের দুলাভাই হইবেন। সবার মৌনতা ভাঙ্গিয়া দয়াল বাবা আবার বলিয়া উঠিলেন, আমি জানি তোমাদের নীরবতার কারণ কি। কেননা আমারতো অবিবাহিত কোন মেয়েই নাই, তো তোমাদের দুলাভাই কেমন করিয়া হইবে? আসলে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এমনই ইচ্ছা। আল্লাহ্ চাহেনতো আমার আরও একজন কন্যা সন্তান আসিবে এবং সেই ছেলেটির সঙ্গেই তাহার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হইবে। হযরত সুরেশ্বরী বাবার সেই ভাবষৎবাণী সত্যে পরিণত হইয়াছিল। কালের আবর্তে এই ছেলেটিই বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া মহা পন্ডিত এবং আলেম হইয়াছিলেন। তাহা ছাড়া বংশগত ভাবে উনি ছিলেন শ্যামপুর দরবার শরীফের পীরে কামেল হযরত জকি উদ্দিন (রহঃ) এ প্রপৌত্র। পরবর্তীকালে সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার কন্যা আরেফা খাতুন জন্ম লাভ করিবার পর পরিণত বয়সে তাহার সহিত শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয় এবং তাহার সাহচর্য ও সহযোগিতা লাভ করিয়া বেলায়েত গগণের উজ্জল জ্যোতিস্কের মত হযরত শাহ্ সূফী গোলাম মাওলা হোসাইনী চিশ্তী নাম সারা বাংলাদেশে ছড়াইয়া পড়ে।


ভাঁজা কই মাছের প্রাণ ফিরে পাওয়া

একবার হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার শুভাড্ডা ইউনিয়নের চুনকুটিয়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ার ব্যারিষ্টার হাজী রশিদুল আলমের বাড়িতে তাশরিফ আনেন। রশিদুল আলমের বাবা জনাব শাহাজদ্দিন মোল্লা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার মুরিদ ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সুরেশ্বরী বাবা ত্বরিকত প্রচারে আদিষ্ট হইয়া আপন বাসভূমিতে রত হইলে তাহাকে অসংখ্য প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। আর এই সব প্রতিকূলতারও ছিল হরেক রূপ। কখনো ত্বরিকত প্রচারের সময় কথিত পূথিগত বিদ্যায় পারঙ্গম আলেম ওলামাদের বাধা, কখনো সামা ও জলি যিকিরের জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া, কখনো অল্প বিদ্যান জাহেরপন্থী আলেম দ্বারা মৃত্যুর মুখোমুখী হওয়া। অন্যদিকে যাহারা সুরেশ্বরী বাবার হাতে বায়াত গ্রহন করিয়া ত্বরিকত লাভ করিয়াছে তাহাদের ভক্তি এবং বিশ্বাষের প্রাথমিক অবস্থায় কারনে অনেক সময় তাহাদের পক্ষ হইতে অথবা পরিবারের পক্ষ হইতে সূক্ষ্ম পরীক্ষার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। প্রাসঙ্গীক ভাবেই একটা বিষয় উল্লেখ না করিলে নিজের কাছে এবং ত্বরিকত পন্থীদের কাছে, অপরাধী হইয়া থাকিবো তাহা হইল “মুর্শিদের নিকট হইতে কোনরূপ কারামতি দেখিতে চাওয়া প্রকারান্তরে মুর্শিদের কামালিয়াতের প্রতিই অবিশ্বাষের চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দেওয়ার শামিল” যা আধ্যাত্ম জগতে কোন ভাবেই গ্রহনীয় নয়ই শুধু,ভক্ত এবং মুরিদের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ। কারন কারামত দর্শনের আকাংখা কাফেরদের স্বভাব। কাফেরগণ নবী অলিগণের মাজেজা ও কারামত দেখিতে আকংখী থাকে। হযরত বাবা মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহঃ) বলিয়াছেন, ‘মুর্শিদের খেদমেেত আদবের সহিত নিয়োজিত থাকিলে মুরিদ মুর্শিদের অসংখ্য কারামত দেখিতে পায়। ইহাছাড়া মুরিদ জ্ঞানী এবং সচেতন হইলে তাহা অনুধাবন করিতে পারে।

সে যাহাই হউক, সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা তাঁহার মুরিদ শাহাজদ্দিন মোল্লার বাড়িতে আগমনের পর যথারীতি মুর্শিদের চরণের খেদমতে আবনিয়োগ করিলেন। শাহাজদ্দিন মোল্লা সাহেবের স্ত্রী ছিলেন খুবই সুচতুর এবং বুদ্ধিমতি মহিলা। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা সত্যি সত্যিই আল্লাহর পেয়ারা অলি কিনা পরীক্ষা করিবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুপুরে মুর্শিদের খেদমতে আহারের ব্যবস্থা করা হইলে অন্যান্য সকলের থালায় ভাতের উপরে ভুনা কৈ মাছ দিয়া সম্মুখে দিলেন, শুধু হযরত সুরেশ্বরী বাবার থালার ভাজা কৈ মাছটিকে ভাতের নীচে সুন্দর করিয়া রাখিয়া উপরন্ত অন্য বাটিতে আরও দুইটি কৈ মাছ দিয়া তিনি নিজেও দরজার আড়ালে লকাইয়া থাকিয়া সুরেশ্বরী বাবার দিকে নজর রাখিলেন। তাহার এই চাতুরী সুরেশ্বরী বাবার নজর এড়াইলনা। সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন সুরেশ্বরী বাবা আহার্য্য গ্রহন করিলে সকলে শুরু করিবেন। হঠাৎ সুরেশ্বরী বাবা মুচকি হাসিয়া তাঁহার সম্মুখস্ত খাবারের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া বলিলেন “আমার খাবারের ভিতরে যে লুকাইয়া আছ এক্ষুনি বাহির হইয়া যাও”। আল্লাহর কি মহিমা এইটুকু বলিয়া সঙ্গে সঙ্গে ভাতের মধ্যে লুকানো কই মাছটি তৎক্ষনাত জীবিত হইয়া ভাত ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং তর তর তরিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। এই ঘটনা সকলে দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। শাহাজদ্দিন সাহেবের স্ত্রী নিজের বোকামী উপলদ্ধি করিয়া সুরেশ্বরী বাবার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। মূহুর্তে এই খবর গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। ফলে দলে দলে মানুষ আসিয়া সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার হাতে বায়াত গ্রহন করতঃ মুর্শিদের জয়গান গাহিয়া সুরেশ্বরীয়া ত্বরিকার প্রচার এবং প্রসার ঘটাইতে লাগিলেন।

আদব ও কাস্ফের অধিকারী ঘোড়া

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা জীব প্রেমের যে দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহে প্রাতঃস্বরণীয়। তিনি বিভিন্ন রকম প্রাণী পুষতেন। পৃথিবীর সবচাইতে প্রভুভক্ত প্রাণীর নাম ঘোড়া। দয়াল সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বারও একটি ঘোড়া ছিল। জনশ্রুতি আছে যে ঘোড়াটি নাকি কাশ্ফ খোলা ছিল। অবশ্য সুরেশ্বরী বাবার ভবিষৎবানী এবং ঘোড়াটির মৃত্যু সেই ঈঙ্গিতই বহন করে।

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ঘোড়ায় আরোহন পূর্বক শরিয়তপুর জেলার মুরিদ জনাব সফর আলী ব্যাপারীর বাড়িতে (যাহা বড়বাড়ি নামে পরিচিত) তসরিফ আনেন। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ঘোড়ার পিঠ হইতে অবরোহন করতঃ ঘোড়ার পরিচর্যা লইবার জন্য সফর আলী ব্যাপারীর নিকট লাগাম তুলিয়া দেন। ব্যাপারী সাহেবও মুর্শিদের বাহন হিসেবে ঘোড়াটিকে ভক্তি ও আদর যত্নের নিমিত্তে গাছের ছায়ায় বাধিয়া খাবার আনিয়া দেন। অথচ ব্যাপারী সাহেব অবাক হইয়া লক্ষ্য করিলেন যে, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত এবং তৃষার্ত ঘোড়াটি কোনভাবেই খাবার গ্রহণ করিতেছে না। ইহা দেখিয়া ব্যাপারী সাহেব রীতিমত হতবাক হইয়া আদবের সহিত সুরেশ্বরী বাবার নিকট ঘটনা বর্ণনা করিলেন। সব শুনিয়া সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা বলিলেন “মুনিবকে অভুক্ত রাখিয়া ভৃত্যের আহার গ্রহণ আদবের বরখেলাপ বিধায় ঘোড়াটিও আহার গ্রহণ করিতেছেনা। অতিসত্তর তোমরা আমার খাবারের ব্যবস্থা কর। ভক্তগণ বাবা সুরেশ্বরীকে অতি তাড়াতাড়ি খাবার দিলেন। হযরত সুরেশ্বরী বাবা খানা খাইতে আরম্ভ করিয়া বলিলেন, এখন যাইয়া ঘোড়াকে খানা দাও। ভক্তগণ যাইয়া ঘোড়ার সম্মুখে খানা রাখিতেই খাইতে শুরু করিল। সকলেই আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, একটি চতুষ্পদ প্রাণী হইয়া বাবা সুরেশ্বরী প্রতি এত আদব ও ভক্তি রক্ষা করে অথচ আমরা মানুষ হইয়াও আমাদের মুর্শিদ ক্বিবলা হযরত সুরেশ্বরী বাবাকে চিনিলামনা, বুঝিলামওনা। পরশমনির স্পর্শে যেমন সব কিছুই খাটি সোনায় পরিণত হয়, তেমনি কুতবুল এরশাদ বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরীর (রহঃ) নৈকট্য লাভে ধন্য ও বরেণ্য হইয়াছে সৃষ্টিকুল।

হারিকেনের নামাজ ও প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপন 

অলি আল্লাহ্গণ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের গুণে গুনান্বিত হইয়া থাকেন। মহান আল্লাহ্ যেমন অন্তর্যামী, বান্দার মনের সমস্ত বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ অবগত, তেমনি আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত হইয়া আল্লাহর ইচ্ছায় অলি আউলিয়াগণও মানুষের মনের খবর সম্পর্কে সম্যক অবগত হন। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) একটা বিশেষ অবস্থান তথা হালাতের ভিতর বলিয়াছিলেন “আমার কোন ভক্ত বা শিষ্য পৃথিবীর যে প্রান্তেই সে অবস্থান করুক না কেন তাহার যদি ঘুমন্ত অবস্থায় কাপড় হাটুর উপর উঠিয়া সুন্নাত তরক হইয়া যায় তাহা হইলে আমি আব্দুল কাদের মহিউদ্দীন (রহঃ) এই বাগদাদে বসিয়াই তাহা ঠিক করিয়া দেই”। আল্লাহর মহান অলিদের অজানা বা অজ্ঞাত কিছুই নাই নিম্নের ঘটনা দ্বারা তাহা আরও দৃঢ় হইবার দাবী রাখে।

এক সময় দয়াল পাক সুরেশ্বরী (রহঃ) বাবা নৌকাযোগে বৃহত্তর বরিশাল জেলায় সফরে বাহির হন। সফররত অবস্থায় জুম্মাবারে জুম্মার নামাজ আদায়ের নিমিত্তে তিনি নৌকার মাঝিদেরকে নির্দেশ প্রদান করিলেন যে পথিমধ্যে কোন মসজিদ পড়িলে ঐ ঘাটে যেন নৌকা ভিড়ানো হয়। ইতিমধ্যে নামাজের সময় হইয়া আসিলে মাঝিগণ মসজিদ দর্শন করতঃ সেই ঘাটে নৌকা ভিড়াইলে হযরত সুরেশ্বরী বাবা নামাজ পড়িবার নিমিত্তে সাত আটজন মুরিদ সংগে লইয়া মসজিদ সংলগ্ন পুকুরে অযুর জন্য অগ্রসর হইলেন। সেই সময় মসজিদ সংলগ্ন পুকুরের ঘাটে অসংখ্য মুসল্লিগণ অযু করিতে ছিল। হঠাৎ কোথা হইতে কি হইল; সুরেশ্বরী বাবা অযুর মধ্যেই ডান হাতে কিছু পানি লইয়া সম্মুখপানে ছুড়িয়া মারিলেন এবং এই দৃশ্য অযুরত মুসল্লীগণ অবলোকন করিলেন কিন্তু কেউ কিছু বলিলেন না। যাহা হউক, যথা সময়ে নামাজ শুরু হইল এবং নামাজান্তে মসজিদ হইতে বাহিরহইবার সময় সুরেশ্বরী বাবা অত্যন্ত বিরক্তি ও আফসোস প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ‘কি নামাজ পড়িতে আসিলাম, এ দেখি হারিকেনের নামাজ’। স্বভাবতই সুরেশ্বরী বাবার এই কথা দুই জনের কানে পৌঁছাইল এবং হারিকেনের নামাজ কথাটি তাহাদের ক্ষোভ ও কৌতুহলের উদ্রেক করিল। এক দুইজন করিতে করিতে প্রায় সকলেই সুরেশ্বরী বাবাকে ঘিরিয়া ধরিয়া এহেন মতামত সম্পর্কে জানিতে চাহিল। দয়াল সুরেশ্বরী বলিলেন, “গতকাল ইমাম সাহেব কোন এক বাড়িতে দাওয়াত যাইয়া ভুলক্রমে সেই বাড়িতে হারিকেন রাখিয়া আসিয়াছিলেন হঠাৎ এই নামাজের মধ্যে তাহার হারিকেনের কথা মনে পড়িয়াছিল। নামাজ একমাত্র আল্লাহর জন্য, নামাজে দাঁড়াইয়া খোদাকে স্মরণ না করিয়া যদি হারিকেনের কথা স্মরণ করেন তাহা হইলে ইহা হারিকেন সর্বস্ব নামাজ ছাড়া আর কি হইতে পারে। অতঃপর ইমাম সাহেবের নিকট ঘটনার সত্যতা জানিবার পরে সকলে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া পড়িল। এক্ষণে যাহারা অযু করিবার সময় পানি ছিটানো দেখিয়াছিল তাহারা ধরিয়া বসিল। সুরেশ্বরী বাবা বলিলেন, “এখান হইতে প্রায় ৩০ মাইল দূরে একটি বাজারে আমার এক মুরিদের একটি দোকান রহিয়াছে, ঐ বাজারে হঠাৎ করিয়া আগুন লাগিয়াছিল এবং দোকানটি পুড়িয়া গেলে আমার মুরিদ সর্বস্বান্ত হইয়া পথের ভিখারী হইয়া যাইবে ভাবিয়া আমি তিনবার পানি নিক্ষেপ করিয়া তাহার দোকানে আগুনের লেলিহান শিখা আসিবার পূর্বেই আগুন নিভাইয়া দিয়াছি”। উপস্থিত মুসুল্লীগণ উক্ত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, তারিখ এবং সময় লিখিয়া রাখিয়া পরে সেই গ্রামে যাইয়া লোকটিকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া আগুন লাগা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে সে উত্তর করিল, বাস্তবিকই অমুক দিন, অমুক সময়ে আমাদের বাজারে আগুন লাগিয়া পথে বসিবার উপক্রম হইয়াছিলাম হঠাৎ আল্লাহর অসীম কৃপায় তিন পশলা বৃষ্টি আসিয়া আগুন নির্বাপিত করিয়া যায়। সকলেন মধ্যে এই ঘটনা জানাজানি হইয়া গেলে সুরেশ্বরী বাবার এহেন কেরামতিতে বিস্ময় প্রকাশ করিলেন।

বাঘের কবল হইতে রক্ষা পাওয়া

কিংবদন্তি আছে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রহঃ) কা’বার যে কোন ভক্ত বা মুরিদ মহা বিপদে পড়িয়া যেখান হইতেই স্মরণ করুক না কেন তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়া তাঁহার রহমতের পাখনা মেলিয়া ভক্ত ও মুরিদের বিপদ হইতে উদ্ধার করেন।

বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানার ভাইজোড়া গ্রামে সুরেশ্বরী বাবার আলী আকবর পাহলোয়ান নামক একজন ভক্ত ছিল। সুন্দরবন হইতে নল সংগ্রহ করিয়া সে জীবিকা নির্বাহ করিত। জীবিকার নিমিত্তেই আলীআকবর পাহলোয়ান প্রতিবারের মতোই সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করিল। সুন্দরবনে পৌছাইয়া সে তাহার নিত্য কর্মের মত নল কাটা শুরু করিল। তারিখটা ছিল ৮ই মাঘ। একটা ঝোপের নল কাটিতে কাটিতে সম্মুখস্ত একটা নল কাটিতে যখন বাকি ছিল তখনই আলী আকবরের সম্মুখে দৃষ্টি পড়িতে দেখিল পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সাক্ষাৎ যমদূতের মত তাহার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিয়াছে। মৃত্যু নিশ্চিত জানিয়া সে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হইয়া বসিয়া রহিল। হঠাৎই আলী আকবরের মনে পড়িল আপদে বিপদে সর্বক্ষেত্রে মুর্শিদই একমাত্র সহায়। মূহুর্তে আলী আকবর বিপদের কান্ডারী দয়াল সুরেশ্বরী আমাকে রক্ষা কর বলিয়া নলটির পার্শ্বে মূর্তির মত বসিয়া রহিল। ইত্যবসরে আলী আকবরকে হত্যার মানষে বাঘটি লাফাইয়া পড়িল এবং সম্মুখস্থ নলটির প্রচন্ড আঘাতে পড়িয়া গেল। দ্বিতীয়বার বাঘটি লাফ দিলে নলটির প্রচন্ড আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাঘের মস্তিস্কে আগুন ধরিয়া যায়। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এত সহজে শিকার ছাড়িবার পাত্র নহে। তৃতীয়বার বাঘটি জায়গা পরিবর্তন করিয়া পিছন দিক হইতে লাফ মারিলে আলী আকবর লক্ষ্য করিল কে যেন নলটি দ্বারা মাঘের মাথায় সজোরে আঘাত করিল। প্রচন্ড আঘাতে বাঘটির মুখ হইতে লালা বাহির হইয়া গেল এবং পিছন ফিরিয়া গর্জন করিতে করিতে শিকার ছাড়িয়া বনের মধ্যে পলায়ন করিল।

দয়াল সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার এহেন নজরে করমে রক্ষা পাইয়া অবিলম্বে আলী আকবর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে দরবারের খেদমতে আত্মনিয়োগ করিল।

আমের গায়ে পাচঁ আঙ্গুলের ছাপ

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা একবার জৈষ্ঠ্য মাসে মুন্সীগঞ্জের নওপাড়া গ্রামে তাঁহার মুরিদ ওসমান ব্যাপারীর বাড়িতে তাসরিফ আনিয়াছিলেন। মুন্সীগঞ্জের ঐ অঞ্চলে সুরেশ্বরী বাবার অসংখ্য মুরিদ ও ভক্ত রহিয়াছে। মুরিদের আগমনের খবর পাইয়া দলে দলে ভক্ত ও মুরিদেরা ওসমান ব্যাপারীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল, ওসমান ব্যাপারী টচজলদী সুরেশ্বরী বাবার খাবার দাবার এর ব্যবস্থা করিলেন। জৈষ্ঠ্য মাস বিধায় জনৈক মুরিদ একটি ছোট্ট টুকরিতে করিয়া কয়েকটি পাকা আম আনিয়া সুরেশ্বরী বাবার সম্মুখে রাখিল। আমগুলি দেখিতে অত্যন্ত চমৎকার ছিল। সুরেশ্বরী বাবা সেখান হইতে একটি আম পাঁচ আঙ্গুলে ধরিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতেছিলেন। আমটি যথেষ্ট মজিয়া গিয়াছিল বিধায় আমটির গায়ে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসিয়া গিয়াছিল। হঠাৎ কি ভাবিয়া তিনি ওসমান ব্যাপারীর মাকে ডাকিয়া হাতের আমটি তাহার হাতে দিয়া বলিলেন আমটি আপনার বাড়ির আঙ্গিনায় পুতিয়া রাখুন। ব্যাপারী সাহেবের মা সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার নির্দেশ পালন করিলেন। ইহার পর মুরিদের বাড়িতে মাহ্ফিল করিয়া সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা সফর শেষ করিলেন। উসমান ব্যাপারীর বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করা সেই আমটি হইতে চারা বাহির হইয়া পরিপূর্ণ গাছে পরিণত হইল। প্রথম যেইবার গাছে ধরিল দেখা দেখা গেল প্রত্যকটি আমের গায়ে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ রহিয়াছে। আজও ওসমান ব্যাপারীর বাড়িতে সেই আম গাছটি রহিয়াছে এবং পূর্বের মতই সমস্ত আমের গায়ে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়।

 অসংখ্য লোক চক্ষুর সম্মুখ হইতে অদৃশ্য হওয়া 

ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার অন্তর্গত গোলজার বাগ নিবাসীনী মেহের নিগার ও জেন্নেগার নামী সাহেবাগণ হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) বিশিষ্ট মুরিদান ছিলেন। মোজাদ্দেদিয়া- সুরেশ্বরীয়া ত্বরিকা মতে তাঁহার স্থানীয় অন্যান্য ভক্ত ও মুরিদানদের সমন্বয়ে মাঝে মাঝেই জিকির আজকারের মাহ্ফিল করিতেন। উল্লেখ্য, সুরেশ্বরীয়া ত্বরিকায় ছামা ও জলি জিকির মাহ্ফিলের অন্যতম অংশ। তদানীন্তন সময়ে দেশের প্রায় জায়গায়ই ওহাবীদের দূর্দন্ড প্রতাপ। ওহাবীদের কাছে ছামা ও জেকরে জলি ধর্মবিরোধী বলিয়া বিবেচিত হইত। তাই সাহেবানদের উক্ত মাহ্ফিলকে কেন্দ্র করিয়া উক্ত অঞ্চেলের গন্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ ও তথাকথিত আলেমগণ ষড়যন্ত্র করিল যে, এই বিদয়াতী মাহ্ফিলের মূল হোতা সুরেশ্বরের মাওলানা জানশরীফ আসিলে তাহাকে এমন অপমান ও অপদস্থ করা এবং এমন শিক্ষা দেওয়া হইবে যাহাতে এসব ধর্মবিরোধী কাজ কারবার চিরতরে রহিত হইয়া যায়। ইতিমধ্যেই সুরেশ্বরী বাবা একদিন তাঁহাদের বাড়িতে তাশরিফ নিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত মুরিদ ও ভক্তবৃন্দ আসিয়া হাজির হইল। উপস্থিত সকলের সম্মুখে মুর্শিদ ক্বিবলা আল্লাহ্ ও রাসূল প্রাপ্তির সহজ, সরল ও সঠিক পথ সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসর আলোকে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করিয়া ভক্তবৃন্দ লইয়া হালকায়ে ছামা ও জিকরে জলীতে মশগুল ছিলেন। এমন সময় উপরে উল্লেখিত স্থানীয় গনমাণ্য ব্যক্তিবর্গ ও তথাকথিত আলেম সমাজ শিক্ষা দিবার মানসে তাঁহাকে স্থানীয় একটি মসজিদে তাহাদেরকে মোকাবিলা করিতে বলিয়া অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করিতে লাগিল। কৌতুহলী মানুষগুলো কৌতুহল সামলাইতে না পারিয়া দলে দলে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। দৃশ্যতঃ এহেন বিপদের সম্মুখীন হইয়াও সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা অত্যন্ত ধীর স্থির ও শান্ত হইয়া নামাজের চৌকির উপর বসিয়া রহিলেন এবং মাঝে মাঝে হাত উচাঁইয়া বিরোধী দলের লোকদের শান্ত থাকিতে নির্দেশ করিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সমবেত বিরুদ্ধবাদী লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচী ও উত্তেজনা যখন চরমে পোঁছাইল তখন হযরত সুরেশ্বরী বাবা বিসমিল্লাহ বলিয়া ঘর হইতে অত্যন্ত ধীর ও শান্ত পদে বাহির হইলেন। বাড়ির উঠানে আসিয়া হাতের লাঠি দ্বারা মাটিতে একটি বৃত্ত অংকন করিয়া উহার অভ্যন্তরে দাঁড়াইলেন এবং আকাশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুইহাতে তালি বাজাইলেন। ইহার পর হস্তস্থিত আষা মোবারক দ্বারা মাটিতে মৃদু আঘাত করিলেন এবং অতি আবেগ মুখ হইতে ‘আহ্’ শব্দ উচ্চারণ করিবামাত্র সকলের দৃষ্টির সম্মুখ হইতে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। চোখের সামনে এহেন কারামত অবেলোকন করিয়া সকলে হায় হায় করিতে লাগিল। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা (রহঃ) যে অতি উঁচু স্তরের অলিয়ে মোকাম্মেল ছিলেন সে ব্যাপারে আর কাহারো ন্যুনতম সন্দেহ রহিল না।

দেওয়ানজীর মাজার আবিস্কার 

হযরত শাহ্ সূফী মৌলভী শরীফুল্লাহ (রহঃ) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু স্তরের অলিয়ে কামেল। কথিত আছে, যখন ভারত বর্ষে জমিদারী প্রথা চালু ছিল তখন তদানীন্তন ফরিদপুর জেলা বতৃমান শরীয়তপুর জেলার অন্তর্গত নড়িয়া থানার জনৈক জমিদারের (অনেক চেষ্টা করিয়াও নাম পাওয়া যায় নাই) কাচারীতে দেওয়ান হিসাবে কর্মরত ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে সবাই ‘দেওয়ানজী’ নামে সম্বোধন করিত। আবার কেহ কেহ বলেন যে, তিনি রাসূল (সাঃ) এর প্রেমে এতটাই দিওয়ানা হইয়াছিলেন যে লোকে তাঁহাকে দেওয়ানজী বলিয়া অভিহিত করিত। বর্তমান নড়িয়া থানার মানাখান গ্রামে তাহার মাজার শরীফ। পরবর্তীতে পদ্মার ভাঙ্গনের মতই দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে তথাকথিত ওহাবী আলেমদের উথান ও অত্যাচারে মাজার শরীফ ও তৎসংলগ্ন জায়গা বিরান হইয়াপড়ে। কালের তিমিরে এক সময় ঐ জায়গা ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ হইয়া যায় এবং মানুষের মন হইতেও দেওয়ানজির কথা তিমিরে ঢাকা পড়িয়া যায়। “হযরত সুরেশ্বরী বাবার কাশ্ফে কবুর” শিরোনামে তাহার অলি আউলিয়ার মাজার আবিষ্কার সম্বন্ধে বিশদ লিখা হইয়াছে। এইখানে শুধু ঘটনার বর্ণনা করিব মাত্র। দেওয়ানজী সাহেব যে জায়গায় ঘুমিয়ে আছেন সেই ঘন জঙ্গলময় জায়গাটুকু ‘মৌলভীর ভিটা’ হিসাবেই সকলে জানে। ভিটাটি এতটাই ঘন অরন্যে ছাইয়া গিয়াছিল যে, রাতের বেলায়তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও সেখানে মানুষ যাইতে ভয় পাইত। লোক মুখে শোনা যাইত যে তথায় দিনের বেলাতেও হিংস্র বন্য পশু ও বিষধর সাপ চলাচল করিত। কিন্তু এলাকার লোক অবাক হইয়া দেখিত যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা গভীব রাতে ঘোড়ায় চড়িয়া সেই গহীন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে। বিষয়টা এমন হইয়া দাড়াইয়া ছিল যে, গভীর রাতে ঘোড়ার আওয়াজ শুনিতে পাইলে সবাই বুঝিতে পারিত যে সুরেশ্বরী বাবা মৌলভীর ভিটায় যাইতেছেন। অনুসন্ধিৎসু মন মানসিকতা যাহাদের ছিল তাহারা প্রত্যেকেই দেখিয়াছেন যে আকাশ হইতে একটি কুদরতি আলো সুরেশ্বরী বাবার চলার পথে অর্থাৎ ঘোড়ার সামনে পড়িয়া সমস্ত রাস্তা আলোকিত করিয়া রাখিত। উক্ত আলোতে পথ দেখিয়া তিনি ঘোড়া ছুটাইয়া যাইতেন। দয়াল সুরেশ্বরী ক্বিবলা তখন ঐ অরণ্যের একটি বিশেষ স্থানে বসিয়া জলি যিকিরে মসগুল হইয়া পড়িতেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আশ-পাশ মানুষের মধ্যে এই রকম বিশ্বাষ ও ধারণা ছিল যে এই জঙ্গলের মধ্যে একজন কামেল পীরের মাজার রহিয়াছে এবং সেই বিশ্বাষেই তাহারা বিভিন্ন রোগ শোক বালা মছিবতের হাত হইতে রেহাই পাইবার জন্য মানত করিয়া হাঁস-মুরগী উত্যাদিদ জঙ্গলের ভিতরে ছাড়িয়া দিত। অলি আউলিয়ার মনের গতিধারা বোঝা যায় না। একদিন সুরেশ্বরী বাবা জঙ্গলের অনতিদূরে পেয়াদা বাড়ির লোকজন ডাকিয়া বলিলেন এইখানে (মানাখান মৌলভীর ভিটায়) একজন জিন্দা ওলির মাজার রহিয়াছে। যেহেতু আল্লাহর প্রিয় অলির মাজার সুতরাং ইহার আবিষ্কার ও রক্ষনা-বেক্ষন নিতান্তই জরুরী হইয়া পড়িয়াছ । অতঃপর সুরেশ্বরী বাবার নির্দেশ পাইয়া সকলে মিলিয়া খনন কার্য শুরু করিল। খনন কার্যের এক পর্যায়ে প্রায় আট হাত গভীরে গিয়া মাজারের ছাদ দেখা গেল। অতঃপর পেয়াদা বাড়ির লোকজনদের প্রতি মাজারের রক্ষনা-বেক্ষন, শিন্নি-সালাত ও মাহ্ফিল করিবার নির্দেশ দান করিলেন। সেই হইতে আজও প্রতি বৃহস্পতিবার সেইখানে মাহ্ফিল করা হয়। উল্লেখ্য যে, সুরেশ্বরী বাবা দেওয়ানজী বাবার নাম ধাম ও কর্মজীবন সম্পর্কে সব কিছু প্রকাশ করিয়া দিয়া সবাইকে উপকৃত করিয়া ছিলেন।

হযরত গোলাম মাওলা হোসাইন চিশতীকে মৃত্যুর পর স্বশরীরে দর্শন দান 

হযরত গোলাম মাওলা হোসাইন চিশতী (রহঃ) ছিলেন হযরত খাজায়ে খাজেগা, গরীবে নেওয়াজ খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) আজমিরি বাবার ভক্ত ও রূহাানীয়াত মুরীদ। তিনি সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা হযরত শাহ্ আহম্মদ আলী ওরফে বাবা জানশরীফ শাহ্ (রহঃ) এর জামাতা। হাজার হাজার ভক্ত ও মুরিদের মুশিূদ ক্বিবলা তিনি। হযরত খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী মোবারক তিনি রচনা করিয়াছেন। বাংলা ভাষায় রচিত খাজা বাবা (রহঃ) সম্পর্কিত এমন তথ্যবহুল কিতাব দ্বিতীয়টি আর খুজিয়া পাওয়া যায়না।

যাহাই হউক খাঁজা বাবার জীবনী মোবারক রচনা শেষে বাইন্ডিং হইবার পর প্রথম কপিখানী রেশমী কাপড়ে মুড়িয়া সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার পবিত্র জীবনী লেখক এর নিকট প্রেরণ করিয়া বলিয়া পাঠাইয়া ছিলেন, “কিতাবখানী সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার রওজা মোবারকের পবিত্র গিলাফের নীচে রাখিয়া দিও”।

রওজা মোবারকে কিতাবখানী রাখিয়া আসিবার বেশ কিছুদিন পর দাদাজানের সহিত মিলিত হইলে সুযোগ বুঝিয়া তাঁহাকে সরাসরি সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার পবিত্র জীবনী লেখক করিলেন, “দাদাজান হযরত খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এত বড় আল্লাহর অলী অথচ প্রথম কপিখানি কেন সুরেশ্বরী বাবার রওজা পাকে তাহার গিলাফ মোবারকের নীচে রাখিলেন আর কেনইবা তাঁহার জীবনী মোবারক আপনি সুরেশ্বরী বাবার নামে উৎসর্গ করিলেন। আমি ইহার কিছুই বুঝিতে পারিলামনা”। উত্তরে হযরত গোলাম মাওলা চিশতী (রহঃ) বলিলেনঃ

“একদা গভীর রাতে আমি হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজের জীবনী মোবারক রচনায় আবিষ্ট ছিলাম হঠাৎ আমার মনে হইল যে, ঘরময় কি একরকম আলোক জ্যোতিতে আলোকময় হইয়া গিয়াছে এবং বেহেস্তী সুগন্ধীতে ঘরের বাতাস মৌ মৌ করিতেছে। আমি লেখার কাগজ হইতে মাথা তুলিয়া সামনের দিকে তাকাইতেই দেখিতে পাইলাম আমার শ্বশুর হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা লেখার টেবিলের অপর প্রান্তে চেয়ারে বসিয়া আমার দিকে তাকাইয়া মিটি মিটি হাসিতেছেন। আমি চেয়ার হইতে উঠিয়া দাড়াইতেই তিনি তাহদ্বারা ঈশারা করিয়া আমাকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলেন তুমি খাজা বাবার জীবনী মোবারক লিখিতেছ বলিয়া আমি অত্যন্ত খুশি হইয়াছি এবং অলি-আউলিয়াদের রহমত তোমার উপর বর্ষিত হইতেছে। তুমি লিখিয়া যাও এই বলিয়া তিনি অদৃশ্য হইয়া গেলেন। আমি কিছুক্ষন বিহ্বল হইয়া বসিয়া রহিলাম। কিছুক্ষন পর স্বাভাবিকতা আসিলে ভাবিলাম আমার শ্বশুর ক্বিবলা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী জাহেরে থাকা অবস্থায় আমাকে যেমন রহমতের চাঁদরে আবৃত রাখিতেন, রূহের জগতে যাইয়াও তিনি আমাকে রহমত ও বরকতময় দৃষ্টি দ্বারা আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন। সেই মূহুর্তেই আমি নিয়ত করিয়াছিলাম যে, এই জীবনী মোবারক আমি আমার শ্বশুর ক্বিবলা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) বাবার পবিত্র নামে উৎসর্গ করিব। আর ইহার প্রথম কপি সুরেশ্বরী বাবার গিলাফ মোবারকের নীচে রাখিতে বলিয়াছিলাম এই জন্য যেন আমার রচিত জীবনী খানা আরো অধিক ফয়েজ পূর্ণ হয় এবং ইহার প্রতি আরও অধিক পরিমান রহমত নাযিল হয়। ইহা পাঠকরতঃ ত্বরিকত পন্থী তথা তামাম মানুষের যেন উপকার হয় ও অলি-আউলিয়ার শান-মান মানুষ বুঝিতে পারে এই আশায়।”

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...