Thursday, September 25, 2025

হযরত সোলায়মান লেংটা শাহ্ চাইতেও ৫০০ বৎসর উর্দ্ধে অবস্থান

 কুমিল্লা জেলার কাশিপুর নিবাসী জনৈক মৌলবী আব্দুল আজিজ হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার বিশিষ্ট মুরীদ ছিলেন। একদা তাঁহার ঘনিষ্ট পরিচিত ঢাকা জেলার খোড়াপাড়া নিবাসী কাবিল মিঞা ও সোবহান শাহ্ তাঁহাকে আসিয়া বলিলেন, ভাই আপনি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানাধীন বেলতলি গ্রামের নেংটা সোলায়মান শাহ্ এর কথা শুনিয়াছেন? বহু লোক তাঁহার দরবারে যাইয়া নানাভাবে উপকৃত হইতেছে। আমরাও ইতিপূর্বে একাধিকবার তাঁহার দরবারে গিয়াছি। তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক কথা বলেন, কিন্তু আমরা উহার মর্ম বা মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিনা। এই জন্য আমরা আপনার নিকট আসিয়াছি। এইবার আপনাকে আমরা নিয়া যাইব। আপনি আলেম মানুষ। তাহা ছাড়া অলিআল্লাহ্দের সহবতে অনেক দিন আছেন। আমরা আশাকরি আপনি তাঁহার কথা বুঝিতে পারিবেন এবং তাহাতে আমাদেরও উপকার হইবে।
মৌলবী আব্দুল আজিজ বলিলেন- ভাই, আসলে আমারও মন চায়, নেংটা শাহ্ এর কাছে যাই। কারণ, অনেকের নিকট তাঁহার বহু কামালিয়াতের কথা শুনিয়াছি। তাঁহার মাধ্যমে নাকি অতি তাড়াতাড়ি আল্লাহ্ ও রসুলের সহিত রূহানী সম্পর্কে স্থাপিত হয় এবং তাঁহার (সাঃ) ভালবাসা পাওয়া যায়। আল্লাহ্র হাবীব মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর প্রেমাকর্ষণ আমাকে প্রায় ব্যাকুল করিয়া তোলে। এই জন্য তাঁহার দরবারে যাওয়ার এরাদা আমরা রহিয়াছে। তবে, আজ তো আমি আপনাদের সহিত যাইতে পারিব না। কারণ, আর মাত্র একদিন পর ২০ মাঘ আমার মুর্শিদ ক্বিবলার দরবার শরীফে পবিত্র উরস মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হইবে আমি সেইখানে যাওয়ার জন্য তৈয়ার হইতেছি। কর্তব্যের খাতিরে হইলেও আমাকে এই উরসে উপস্থিত থাকিতেই হইবে। আমি প্রত্যেক উরসে সাথীবৃন্দ নিয়া দরবারে যাই। আমাকে ছাড়াও তাহাদের অসুবিধা হইবে। সুতরাং আমি এই সময় আপনাদের সহিত কিছুতেই যাইতে পারিব না। তবে, ভবিষ্যতে কোনদিন লেংটা শাহ্ এর দরবারে যাওয়ার এরাদা রহিল। আপনারা যান, শাহ্ সাহেবকে আমার আন্তরিক ভক্তিপূর্ণ সালাম জানাইয়া আমাকে দোয়া করিতে বলিবেন, আমি যেন আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের ভালবাসা পাই।
মৌলভী আব্দুল আজিজ নিজের বন্ধু কাবিল মিঞা এবং সোবহান শাহ্কে বিদায় দিয়া সুরেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলেন। তবে, তাহার মন মাঝে মাঝেই হযরত নেংটা শাহ্ এর দরবারে চলিয়া যাইতেছিল। মৌলভী সাহেব মনে মনে ভাবিলেন, বোধ হয় ভুল করিলাম, ওদের সাথে লেংটা শাহ্ এর দরবারে গেলেই হয়তঃ অধিক উপকৃত হইতাম। এইসব সাতপাঁচ ভাবিতে ভাবিতে তিনি সুরেশ্বর দরবার শরীফে পৌঁছান। এই সময়ে দরবার শরীফের আঙ্গিনায় বসিয়া হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা মুরিদ-ভক্তদের সহিত আলাপ চারিতায় রত ছিলেন। মৌলভী সাহেব হযরতের পদধুলি নিয়া মজলিসে এক কোনে বসিয়া পড়িলেন। তাহার মুখমন্ডলে দোদুল্যমানতা ও চিন্তার ছাপ সুষ্পষ্ট। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা তাহার দিকে তাকাইয়া একটু বিরক্ত ভাবেই বলিয়ালেন, মৌলভী সাহেব, আপনার মনে এতো ডাল খিঁচুড়ি পাকাইতছে কেন? শীঘ্র উহা বাহির করিয়া ফেলুন এবং মনকে পবিত্র করুন। এই বলিয়া হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা অন্দরমহলে চলিয়া যান।
মৌলবী আব্দুল আজিজের বুঝিতে বাকী রহিল না যে, তাহার মন লেংটা শাহ্ এর দরবার আর সুরেশ্বরের মধ্যে আসা-যাওয়া করিতেছে। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার নিকট তাহা ধরা পড়িয়া গিয়াছে। তাহার মনের কথা মুর্শিদ জানিয়া গিয়াছেন এবং মুর্শিদ জানিয়া গিয়াছেন এবং মুর্শিদ তাহার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছেন। এইজন্য দুঃখ, লজ্জা এবং দুশ্চিতায় মৌলবী সাহেব মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত হইয়া নিকটস্থ একটি আমগাছের নিচে বসিয়া ভাবিতেছেন- কি হইয়া গেল। ইত্যবসরে মৌলবী সাহেব গাছতলায় ঘুমাইয়া পড়িলেন।
এই ঘুমন্ত অবস্থায় মৌলভী সাহেব দেখিলেন যে, তিনি সেই কাবিল মিঞা ও সোবহান শাহ্ এর সহিত হযরত নেংটা শাহ্ এর দরবারে হাজির হইয়া, আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহর প্রেম-ভালবাসা পাওয়ার জন্য নেংটা শাহ্ এর নিকট দোয়া প্রার্থনা করিতেছেন। হযরত লেংটা শাহ্ একটু মুচকি হাসি দিয়া বলিলেন, আপনি যাহার প্রেম-ভালবাসার ও দয়া প্রার্থনা করিতেছেন তাহার সেই প্রেম-ভালবাসা এবং দয়ার প্রধান দ্বারই হইলেন আপনার মুর্শিদ হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী আপনি আমার কাছে আসিয়াছেন কেন? আপনি ঐ দ্বারের সহিত নিজেকে বাঁধিয়া রাখুন, জানেন না নিজের মুর্শিদের ব্যাপারে দোদুল্যমানতা বে-আদবী। আপনার মুর্শিদ কেবলা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী আমার হইতেও পাঁচশত বৎসর পথের উপরে আছেন। আমার খেদমতে আজীবন থেকে আপনি যাহা হাসিল করিবেন তাহা এক মূহুর্তে আপনার মুর্শিদের খেদমতে হাসিল হইবে। শাহ্ সাহেব শেষ বাক্যটি একটু ধমকের সুরেই উচ্চারণ করেন। ইহাতে মৌলবী সাহেবের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি দেখিলেন যে, বাবা সুরেশ্বরী তার সম্মুখে উপস্থিত, কোন কিছু বুঝিয়া উঠিবার আগেই মুর্শিদ ক্বিবলা বলিলেন, “হে মৌলভী, এখনও কি তোমার মনের ডাল-খিঁচুড়ি দূর হয় নাই?” হন্তদন্ত ও বেহুশ বেকারার হইয়া মুর্শিদ ক্বিবলার পদ তলে লুটাইয়া পড়িয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিলেন, দয়াল বাবা আমাকে ক্ষমা করুণ, আমি আর কখনও এইরূপ বে-আদবী করিব না। উপস্থিত অন্যান্যগণ কিছু না বুঝার পূর্বেই হযরত মৌলভী সাহেবকে লক্ষ্য করিয়া হুকুম করিলেন, হইয়াছে, হইয়াছে, উঠুন, মনের ভিতরকার ডাল খিঁচুড়ি বাহির হইয়াছে তো? যান, গিয়ে নিজের কাজ করুন। কিছুক্ষণ পর হযরত দরবার ত্যাগ করিলে উপস্থিত সকলে মৌলবী সাহেবকে ঘিরিয়া ধরিল, কী হইয়াছে জানিবার জন্য সকলে উৎসুক হইয়া উঠিল। অতপর মৌলুভী সাহেব আদ্যপান্ত ঘটনা বর্ণনা করিলেন। সুরেশ্বরী বাবার কামালিয়াত ও কাশ্ফীয় শক্তির ক্ষমতা উপলদ্ধি করিয়া প্রত্যেকের মধ্যে এমন ভাবের সৃষ্টি হইল যে, তাহাদের মধ্যে হাউমাউ রবে কান্নাকাটি এবং তড়পাতড়পি শুরু হইয়া গেল। অনেক সময় পর্যন্ত সেই বেহাল অবস্থার তাছির দরবারময় বিরাজ করিয়াছিল।

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...