কলিকাতার ফুলতলী গ্রাম। হযরত সুরেশ্বরীর (রাঃ) মুর্শিদ ক্বিবলা ‘রাসূলে নোমা’ হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) এর পবিত্র দরবার আশিক্বীন ও ভক্তবৃন্দ ভরা মজলিস। মুর্শিদের ধ্যানে নিজেদেরকে পরিপূর্ণ ভাবে বিলীন করিয়া দিয়া নতশীরে বসিয়া আছেন তাঁহারা। সভাশীর্ষে আসীন হযরত ‘রাসূলে নোমা’। তিনিও গভীর ধ্যানমগ্ন। কথিত আছে, ধ্যানে তিনি সদা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সাথে দীদার লাভ করিতেন। পুরো দরবার শরীফ জ্যোতির্ময়অলৌকিক প্রভাবে পবিত্র ভাব গম্ভীর পরিবেশ। ভূবনমাতানো গন্ধে সকলেই মোহিত। কারো মুখে কোন কথা নেই। একটি অভুতপূর্ব অনুভ’তিতে সকলেই বিগলিত। হঠাৎ মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা ফতেহ্ আলী (রাঃ) এর আহ্ শব্দে উপস্থিত সকলের ধ্যান ভঙ্গ হয় এবং দৃষ্টি তাঁহার দিকে নিপতিত হয়। তাঁহার দিকে তাকাইতেই ভক্তগণের দৃষ্টি ঝলসিয়া যায়। হযরত ওয়াইসী বাবার মুখমন্ডল পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় দেখাইতেছিল। আর তাহারই জ্যোতিতে উদ্ভাসিত ছিল গোটা দরবার শরীফ । এমতাবস্থায়, মুর্শিদ ক্বিবলা বাবা ফতেহ্ আলী (রাঃ) এইদিক ঐদিক তাকাইলেন। মনে হইলো, তিনি যেন কাহারো সহিত গভীর আলাপপর্ব সারিয়া অবসর হইলেন। চারিদিকে তাকাইয়া উপস্থিত ভক্তবৃন্দকে লক্ষ্য করিয়া গাউসে জামান কুতুবুল এরশাদ হযরত ফতেহ্ আলী কুদ্দেসা সিররুহু (রাঃ) ঘোষনা করিলেন, অসীম করুনাময় আল্লাহ্ তা’য়ালা পরম দয়াপরবশ হইয়া যেইসব আধ্যাত্মিক নিয়ামত আমাকে দান করিয়াছেন; আজ হইতে তাহা সবই তোমাদের মধ্যে আমার এক প্রিয়তম আশিক ভক্ত তথা মুরিদের আধ্যাত্মিক ভান্ডারে স্থানান্তরিত হইল। আল্লাহ্র তরফ হইল রাসূল (সাঃ) আমাকে তাহাই জানাইলেন। মুর্শিদ ক্বিবলার পবিত্র মুখের উক্ত এলহাম বাণীতে উপস্থিত সকলেই উৎকষ্ঠিত ও ঊৎসুক নয়নে একে অন্যের দিকে তাকাইলেন, কে এই সৌভাগ্যবান ভক্ত, যিনি মুর্শিদ ক্বিবলার সমুদয় আধ্যাত্মিক নিয়ামতের অধিকারী হইলেন? তবে তাহাদের বুঝিতে বাকি রহিলনা যে, এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি মাওলানা জানশরীফ শাহ্ ছাড়া আর কেহই নহেন। কারন তাঁহারা জানিতেন যে, মুর্শিদের প্রতি ভক্তি, আদব, ইশ্ক, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য এবং সোবা সাধনায় হযরত বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ছিলেন তাহাদের সকলের অগ্রগামী।
উক্ত ঘটনার পর হইতে হযরত জানশরীফ (রাঃ) এর জজ্বা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ক্রমান্বয়ে তিনি বেখোদ এবং আত্মভোলা হইয়া পড়িলেন। আহারে আগ্রহ নাই, নিদ্রার সময় নাই, দুনিয়ার চিন্তা নাই, কেবল ধ্যান আর ধ্যান, সব কিছু ভুলিয়া একমাত্র মুর্শিদের খেয়ালে আল্লাহ্র প্রেমে পাগল।
এই ভাবে সুদীর্ঘ বহু রাত্র দিন অতিবাহিত হইবার পর হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) এর জীবনে আসে আর এক শুভ মুহুর্ত। নীরব ও নিস্তব্ধ, কোন কোলাহল ও গুঞ্জন নাই। সমগ্র ধরণী গভীর নিদ্রামগ্ন। আল্লাহ্র আশিক, অলি, গাউস, কুতুব এবং আরিফ-খালিকদের জন্য এটাই উপযুক্ত সময় এবং অনুকুল পরিবেশ। আশিক-মা’শুকের পুণ্যময় মধুময় মহামিলনের অথবা মিলন কামনায় প্রেমাশ্রু বিসর্জনের এবং মা’শুকের মন পাইবার উপযুক্ত সময়। হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) তাহা ভাল করিয়াই জানিতেন। তাই তিনি এই রূপ মুহুর্তগুলো তাঁহার মুর্শিদের প্রেমে আল্লাহ্র ধ্যান অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়াই অতিবাহিত করিতেন। এই রাতেও তিনি যথারীতি বিনিদ্র বসিয়া মুর্শিদের ইশ্ক আল্লাহ্র প্রেমাগুনে পুড়িয়া অঙ্গাঁর হইতেছিলেন। কাঁচা লাউকে আঘাত করিলে যেমন তাহার শরীর হইতে নিঃশব্দে পানি গড়াইয়া পড়িতে থাকে তেমনই তাঁহার নয়ন যুগল হইতে প্রেমাশ্রু নির্গত হইতেছিল, অঝোর ধারায়। কিন্তু কে কাহার খবর রাখে। তাইতো কবি বলিয়াছেনঃ
“কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে,
কভু আসি বিষে দংশেনি যারে।”
তবে, যেমন মুর্শিদ, তেমনই মুরিদ। ইশ্কে আকর্ষণ থাকিলে মা’শুক সাড়া না দিয়া পারেন না। ইতিমধ্যে তাঁহার প্রাণপ্রিয় ভক্ত মুরিদ জানশরীফকে হাত ধরিয়া নিজের হুজরা মোবারকে নিয়া গেলেন এবং তাহাকে পূর্ণ বেলায়েত দান পূর্বক তাঁহার সম্মুখে শরিয়ত, ত¦রিকত, হাকিকত ও মা’রেফত রাজ্যের দরজা সমূহ উন্মোচন করিলেন। অতঃপর মারেফতের সকল স্তর ভ্রমন করাইয়া কোত্বোল এরশাদ মর্তবা দান করতঃ তাঁহাকে বলিলেন- বাবা, আজ হইতে আল্লাহ্ ও রাসূলের পক্ষ হইতে তোমার নাম রাখা হইল- ‘শাহ্ আহম্মদ আলী’। ইহার পর ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে খেলাফত দান করিয়া স্বদেশে যাইবার নির্দেশ প্রদান করিলেন। এইখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের প্রিয় হাবীব হুজুর পূরনূর, মাওলায়ে দো’আলম হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এর সহিত প্রয়োজন মাফিক দীদার লাভকারী বাবা শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) তাহার সর্বাধীক প্রাণপ্রিয় আত্মোৎসর্গীকৃত প্রধান খলিফা বাবা হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) কে নিজের আধ্যাত্মিক অর্জনের সবটুকুই উজাড় করিয়া দান করিয়াছিলেন। সেই প্রাপ্তির ধারাবাহিকতায় আল্লাহ্ ও রাসূলের পক্ষ হইতে “শাহ্ আহ্ম্মদ আলী” লকব প্রাপ্তি সুরেশ্বরী বাবার পরিপূর্ণ বেলায়েতের অধিকারী হওয়ারই অনুমোদন। যদিও আধ্যত্মিক রাজ্যের এই গোপনীয় বিষয়গুলি সাধারন মানুষের নিকট বিশ্বাষযোগ্য করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন হয় না, তবু মহাসত্যকে অস্বীকার করিবার ক্ষতি ও অকল্যাণ হইতে রক্ষার জন্য প্রমাণাদি প্রকাশ করা দোষের নহে। হয়তো এই কারনেই রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজের নবুয়্যতের প্রমাণ হিসাবে আল্লাহ্র নির্দেশে আপন শাহাদাৎ আঙ্গুলের ঈশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করিয়া দেখাইয়া ছিলেন। বাবা সুরেশ্বরী তাঁহার রচিত “নূরেহক্ব গঞ্জেনূর” কিতাবে লিখিয়াছেনঃ-
“একা আমি ছিনু আমি হৈনু দুই জন।
দুই আমি একাযুক্তে হনু তিন তন ॥
চতুর্থ আমির মধ্যে যখন আমি যাই।
সব আমি খ্যান্ত দিয়া হইনু কানাই ॥”
তাঁহার এই বাণীই ফানা ফিল্লা আল্লাহ্তে বিলিন প্রকাশ করে।
No comments:
Post a Comment