পূর্বেই সুরেশ্বরী বাবার ‘মুর্শিদের সাক্ষাৎ লাভ এবং বায়াত গ্রহণ’ পর্বে বেলায়েত হাসিলের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। জাগতিকভাবে যেমন আমরা অণেকের মধ্যে বিশেষ একজন বিশেষ কোন বিষয় হাসিল করিলে অন্যান্য সবাই তাহার প্রতি কম বেশী ঈর্ষা পোষণ করি, তেমনি অল্পদিনের মধ্যে সুরেশ্বরী ক্বিবলার কা’বা তাঁহার অন্যান পীর ভাইদের চাইতে মুর্শিদের মনের মনি কোঠা দখল করতঃ মারফত রাজ্যের অমূল্য সম্পদ সমূহ হাসিল করায় অনেকেই মনে মনে তাঁহার প্রতি ঈর্ষা পোষণ করিত। একবার হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার মুর্শিদ বাবা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) তাঁহার কতিপয় বিশিষ্ট মুরিদদেরকে লইয়া কলিকাতার চার তলা এক বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়া বসিলেন। প্রত্যেকে আসন গ্রহণ করিবার পর বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) মারেফত সম্পর্কে অতি উচ্চ স্তরের আলোচনা করিলেন,আলোচনার এক পর্যায়ে আসিয়া তিনি রাসূল পাক (সাঃ) এর একটি হাদিস উদ্ধৃতি দিয়া বলিলেন, “যতক্ষন পর্যন্ত তোমরা তোমাদের স্ত্রী-পরিজন, টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত এমনকি নিজের জীবনকে মুর্শিদের খেদমতে উৎসর্গ করিতে না পারিবা ততক্ষন পর্যন্ত মুর্শিদকে অর্জন এবং মু’মিন হইতে পারিবা না।” এই কথা শুনিয়া উপস্থিত প্রত্যেকেই বলিয়া উঠিলেন আমরা আমাদের জীবন মুর্শিদের চরনে উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত রহিয়াছি। উল্লেখ্য, সেই মুহুর্তে বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাকের সহিত তাঁহার বিশিষ্ট মুরিদগণের মধ্যে হযরত মাওলানা আবু বকর সাহেব, হযরত মৌলভী শাহ্ ওয়াজেদ আলী সাহেব, হযরত মাওলানা শাহ্ আমজাদ আলী সাহেব এবং হযরত আহ্ম্মেদ আলী ওরফে বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী উপস্থিত ছিলেন। যাহাই হউক কিছুক্ষন মৌন থাকিয়া বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাক মাওলানা আবু বকর সাহেবকে বলিলেন, ‘বাবা আমি যদি এই মুহুর্তে হুকুম করি মুর্শিদের নামে জীবন উৎসর্গ করিবার জন্য এই চার তলা ইমারতের ছাদ হইতে নীচে লাফাইয়া পড় তাহলে তুমি কি তাহা করিবা?’ উত্তরে আবু বকর সাহেব বলিলেন, আমার মুর্শিদের নির্দেশ পালনার্থে আমি নিশ্চয়ই তাহা করিব তবে আমি নিশ্চিত করিয়া জানি যে, মুরিদের জীবন রক্ষার্থে আপনি নিশ্চয়ই এমন হুকুম দিবেন না। অতঃপর মৌলভী ওয়াজেদ আলী এবং মৌলভী আমজাদ আলী সাহেবকে একই প্রশ্ন করা হইলে তাহারাও ছাদ হইতে লাফ দেওয়াকে এড়াইয়া গিয়া আবু বকর সাহেবের উত্তরের প্রায় একইরকম প্রতিধ্বনি করিলেন। এক্ষনে বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা তাঁহার প্রিয় শিষ্য জানশরীফের উদ্দেশ্যে বলিলেন, ‘বাবা জানশরীফ, তুমি কি তোমার জীবন এই চার তলা হইতে লাফাইয়া পড়িয়া মুর্শিদের নির্দেশে উৎসর্গ করিতে পার?’ নির্দেশ শুনিয়া বাবা জানশরীফ চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, আমার মুর্শিদ ক্বিবলায়ে কা’বার চরনে জীবন উৎসর্গ করিবার জন্য বহুদিন ধরিয়া অপেক্ষা করিতেছি, মুর্শিদের নামে আজ আমার জীবন উৎসর্গ করিবার দিন আসিয়াছে সুতরাং এই সুযোগ হাত ছাড়া হইয়া গেলে জীবনে আর নাও পাইতে পারি। এই বলিয়া কাহাকেও কোন কিছু বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই মুর্শিদের নাম স্মরন করিয়া দৌড় দিলেন। হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাক তাহাকে থামাইবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিলেন। কিন্তু ততক্ষনে সুরেশ্বরী বাবা ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িয়াছেন। অন্যান্য পীর ভাইগণ ভাবিলেন হয়তো আজই জানশরীফের চির বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়া গিয়াছে। বুকের ভিতর সবারই জানশরীফের জন্যে বেদনা অনুভব করিলেন। নীচে জানশরীফের কি হইয়াছে দেখিবার জন্য যখন পীর ভাইগণ সকলে দাড়াইয়া পড়িলেন তখনও বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাক স্থবির হইয়া বসিয়া থাকিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন। মুর্শিদকে এইভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া কেহই জায়গা হইতে নড়িলেন না। ইত্যবসরে অবাক হইয়া সকলে দেখিলেন যে, জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী সিড়ি ভাঙ্গিয়া উপরে উঠিয়া আসিতেছেন। মুর্শিদের চরণে ভক্তি দিয়া প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে বলিলেন, ‘বাবা আমার মনের ঐকান্তিক ইচ্ছাটি আপনি পূরণ হইতে দিলেন না।’ হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাবা জানশরীফ এত উঁচু হইতে লাফইয়া পড়িলেতো কাহারও বাঁচিয়া থাকিবার কথা নহে অন্তত দুই চারটি হাড় গোড়তো ভাঙ্গিয়া যাইবার কথা কিন্তু তোমার তো দেখি কিছুই হয় নাই।’ উত্তরে সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ততোধিক কান্না জড়িত কন্ঠে বলিলেন, ‘বাবা আমি যখন আমার মুর্শিদের চেহারা মোবারক স্মরন করিয়া প্রাণ বিসর্জন দিবার মানষে ঝাপাইয়া পড়িলাম তখন দেখিলাম, আপনার কুদরতি হাত দুইখানি আমার দুইহাত ধরিয়া পরম ¯েœহে মাটিতে নামাইয়া দিল। আমার ভাগ্যে বুঝি কোনদিনই আর আপনার চরণে জীবন পাত করিবার সুযোগ হইল না।’ বহুদিন যাবত মুর্শিদের নামে জীবন উৎসর্গ করিব বলিয়া আশা করিয়া ছিলাম আজ একটি মাত্র সুযোগ দান করিয়াও তাহা কবুল করিলেন না। হয়ত মুর্শিদে বরহক্ব বাবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) মুর্শিদ প্রেমে ফানা হইবার পরীক্ষায় কে কতটা অগ্রগামী তাহার পরীক্ষা এইভাবেই লইবার ইচ্ছা পোষণ করিয়াছিলেন। ইহাছাড়া এমনও হইতে পারে, তিনি লক্ষ্য করিতেন জানশরীফকে অন্যান্য মুরিদগণ ঈর্ষা পোষন করিতেছে যাহা নিতান্তই অনুচিত তাই সকলের সামনে পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করাইলেন।
এই প্রসঙ্গে, হযরত মোজাদ্দে আলফেসানী সেরহিন্দ (রাঃ) বাবার মুর্শিদ ছিলেন ইসলামের অপ্রতিদ্বন্ধি ধারক ও বাহক খাঁজা সাইয়েদ বাকি বিল্লাহ্ ক্বিবলায়ে কা’বা (রাঃ) যখন মুর্শিদের খিদমতে থাকিয়া ধ্যান ও কৃচ্ছতা সাধনের মাধ্যমে মারেফত রাজ্যের বিভিন্ন মোকাম সমূহ জয় করিয়া মঞ্জিলে মক্সুদ হাসিল করিয়াছিলেন তখন তাঁহার অন্যান্য পীর ভাইগণ তাঁহার প্রতি ঈর্ষা পোষন করিতেন। খাঁজা সাইয়েদ বাকি বিল্লাহ্ (রাঃ) ইহা অনুভব করতঃ একদা ভরা মজলিশে তাহাদের সাবধান করিবার জন্য বলিয়াছিলেন, “সাবধান, তোমরা তোমাদের ঈমানকে ধরিয়া রাখিতে চাইলে ফকরুদ্দিন আহ্মেদ আল্ ফারুক ওরফে মোজাদ্দে আলফেসানীর প্রতি হিংসা পোষন করিও না।” হয়তো বাবা খাঁজা সাইয়েদ বাকি বিল্লাহ্ (রাঃ) মত রাসূলে নোমা বাবা সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাক (রাঃ) ও বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, জানশরীফের প্রতি তাহার অন্যান্য মুরিদগণও ঈর্ষা পোষন করে তাই উক্তরূপ পরীক্ষা লইয়াছিলেন।
এইভাবে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা (রাঃ) মুশিদ প্রেমের পরম পরাকাষ্ঠার পরিচয় দিয়া মুর্শিদের এলমে মারেফত ও এলমে তাসাউফের সমস্ত মনি-মুক্তা, ধন-দৌলত আহারন করতঃ নিজের জীবন ধন্য করিয়াছিলেন।
No comments:
Post a Comment