Thursday, September 25, 2025

পীর ও মোর্শেদের নিকট বায়াত গ্রহণ

 

হযরত সুরেশ্বরী বাবা বাতেনী বিদ্যার টানে, হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবার ফয়েজের আকর্ষনে রাত দিন বাবার দরবারে খেদমত করিয়া কাটাইতেছেন। কিন্তু তাহাকে মুরীদ কারবার জন্য হযরত সূফী বাবাকে অনুরোধ করিতে সাহস পান নাই। তবে, সর্বদা হযরত সূফী বাবার ধ্যান ও প্রেমে ফানা হইয়া থাকিতেন। এমনি ফানা অবস্থায় একদিন হযরত সুরেশ্বরী বাবা হৃদয়ের প্রবল আবেগ এবং উন্মাদনা সংবরন করিতে না পারিয়া, নিজের অজান্তেই হযরত সূফী বাবার পবিত্র জ্যোতির্ময় চরণযুগল জড়াইয়া ধরিয়া অঝোর ধারায় প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিয়া তীরবিদ্ধ পাখির মত মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন। আশিকের মনের কথা মা’শুকের বুঝিতে বাকী রহিলনা। হযরত আল্লামা জালালুদ্দিন রুমী বলেন,- “আশিক-মা’শুকের গোপনরহস্য দুই কাধের ফেরেস্তা কেরামন কাতেবীনও রাখে না।” আশিকের কান্নায় মা’শুকের হৃদয়স্থিরত দয়ার সাগরে তরঙ্গ উঠিল। মা’শুকও স্থির থাকিতে পারিলেন না। হযরত সূফী বাবা আপন স্নেহসিক্ত ফয়েজভরা মোবারক হাতে তাঁহাকে অতি আদরে টানিয়া তুলিলেন এবং সান্তনা ও আশ্বাসের আদলে বলিলেন- “বাবা জানশরীফ, আমি তোমাকে আমার রুহানীপুত্র রূপে বহু পূর্বেই গ্রহণ করিয়াছি। তবে তোমার আধ্যাত্মিক দীক্ষা বা বা’য়াত গ্রহনের সময় এখনও হয়নি। যথা সময়ে তোমার মনোবাঞ্চাপূর্ণ হইবে।”

সমকালীন গাউসে আজম, কুতবে এরশাদ হযরত সূফী বাবা তাঁহার স্নেহের জানশরীফকে নিজের যথাসর্বস্ব দান করিবেন বলিয়াই হয়তঃ মুরীদ করিবার পূর্বে আরো খাঁটি করিয়া লইতে চান। তাই তাঁহাকে ধৈর্য্য ধারন করিবার উপদেশ প্রদান করেন।

সে যাহাই হউক, ঋষি বাক্য শিরোধার্য্য করিয়া হযরত সুরেশ্বরী বাবা সেই মাহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষায় দিন গুণিতে লাগিলেন। ইল্মে বেলায়েত ও নূরেহক্ব -এর আকর্ষণে উদ্বেল ভবিষ্যতের কুতবুল এরশাদ বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা ভাবিলেন বুঝি, আমার সেবায় ক্রটি রহিয়াছে, মুর্শিদের সোবায় নিজেকে বিলীন করার ঘাটতি রহিয়াছে অথবা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবার শিষ্য হইবার জন্য যেইসব গুনাবলী প্রয়োজন, আমি তাহা অর্জন করিতে পারি নাই। এই সব কথা ভাবিয়া হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) পানাহার প্রায় ছাড়িয়া দিলেন, দরবারে থাকিয়া দিনের বিশ্রাম ও রাতের ঘুমকে নিজের জন্য অপরাধ মনে করিলেন। তিনি নিজের দেহের খোরাকের কথা ভুলিয়া কেবলই রূহের খোরাক সংগ্রহে দিবানিশি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। ইতিমধ্যে হযরত সূফী বাবা লক্ষ্য করিলেন যে, তাঁহার পরম স্নেহের রূহানী সন্তান জানশরীফ প্রায়ই অনাহার বা অর্ধাহারে থাকে। সুতরাং তিনি তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘বাবা জানশরীফ আমি লক্ষ্য করিতেছি যে, তোমার আর্থিক অভাব রহিয়াছে। অতএব আমি তোমাকে আল-কোরআনের একটি আয়াত বলিয়া দিতেছি। তুমি যাহারা তোমার কাছে রোগ নিরাময়ের জন্য আসিবে, তুমি তাহাদিগতে এই আয়াত দ্বারা পানি পড়িয়া দিবে, তাবিজলিখিয়া দিবে এবং উহার বিনিময়ে মাত্র পাঁচটি পয়সা ছদকা নিবে। আল্লাহর ইচ্ছাতে তোমার আর্থিক অভাব দূর হইয়া যাইবে।’ বস্তুতঃ তাহাই ঘটিয়াছে। পরদিন সকালে মস্জিদ হইতে নামাজ পড়িয়া বাহির হইবার পর দেখা গেল যে বেশ কিছু লোক পানি হাতে দাড়াইয়া আছে। তাহারা কি জন্য পানি হাতে দাড়াইয়া রহিয়াছে জানিতে চাওয়া হইলে উত্তরে বলিল যে, আমারা জানশরীফের নিকট রোগ নিরাময়ের জন্য এই পানি পড়াইয়া নিতে আসিয়াছি। অতঃপর সুরেশ্বরী বাবা আগত সবাইকে পানি পড়িয়া দিলেন। যাহারা পানি পড়া নিতে আসিয়াছিল সকলেই বাবা জানশরীফকে পাঁচটি করিয়া পয়সা নজরানা দিলেন। বাবা জানশরীফ বুঝিলেন ইহা সূফী বাবার একটি কারামত। ঐ দিনই বাবা জানশরীফ তাবিজের নজরানা সমূহ দিয়া অত্যন্ত আদর ভক্তি ও পবিত্রতার সহিত মিষ্টান্ন শিন্নী প্রস্তুত করিয়া আগর বাতি, মোমবাতি এবং অবশিষ্ট টাকা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার জন্য নজরনা নিয়া দরবারে উপস্থিত হইলেন। হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবা রাগিন্বিত হইয়া জানশরীফকে বলিলেন, “তুমি জান না আমি কারো নাজরানা গ্রহন করিনা আর তোমার ক্ষুধা নিবারনের জন্য আল্লাহর তরফ হইতে একটি মাত্র উপায় তোমাকে দান করা হইয়াছে তাহাও তুমি সম্পূর্ণ খরচ করিয়া মিষ্টান্ন ইত্যাদি আনিয়াছ। ইহা কিছুতেই গ্রহন যোগ্য নহে। মোর্শেদের পক্ষ হইতে নজরানা প্রত্যাখ্যান হওয়ায় বাবা জানশরীফ হৃদয়ে কঠিন আঘাত প্রাপ্ত হন। তিনি স্বজোরে চিৎকার দিয়া অঝোর ধারায় কাঁদিতে লাগিলেন এবং তীরবিদ্ধ পাখির ন্যায় মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন। ইহাতে সূফী বাবাও মর্মাহত ও দুঃখীত হইলেন। তিনি বুঝিতে পারেন নাই যে জানশরীফ এই ঘটনায় এত বড় আঘাত প্রাপ্ত হইবেন। আশেকের ব্যাথায় মা’শুক ব্যাথিত না হইয়া পারেনা। সূফী ফতেহ্ আলী বাবার হৃদয় ভারাক্রান্ত হইল এবং তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, ‘বাবা আমি তোমার নজরানা গ্রহণ করিলাম। জানশরীফের মাথা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার কোলে রাখিয়া মাথায় হাত বুলাইয়া আদর করিতে করিতে জানশরীফকে শান্ত করিলেন।’

উল্লেখ্য, দিন দিন হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবার দরবারে জানশরীফের পড়া পানি আর তাবিজের সুফল সুখ্যাতি গোটা এলাকায় ছড়াইয়া পড়িল। যতই দিন যায় জানশরীফ বাবার পানি ও তাবিজের চাহিদা বাড়িয়া গেল। হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) এর বুঝিতে বাকী রইল না যে, ইহাও হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবারই কারামত। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবার কাছে হযরত সুরেশ্বরী বাবার আনুষ্ঠানিক ভাবে আধ্রাত্মিক দীক্ষা বা বা’য়াত গ্রহণের সৌভাগ্য এবং কাংক্ষিত মক্সুদ হাসিল হয়। ঘটনাটি এই রকমঃ-

একদিন আঁতর, আগরবাতি, মোমবাতি, ফলফলাদি, মিষ্টান্ন ও পুষ্পমাল্য কিনিয়া হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার খেদমতে হাজির হন। হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার নির্দেশে আঁতর ছিটানো হইল, আগরবাতি-মোমবাতি জ্বালানো হইল, উপস্থিত ভক্ত-মুরিদগণের মধ্যে ফল ও মিষ্টি বিতরণ করা হইল। উপস্থিত সকলেই ভাব গম্ভীর। সমগ্র দরবারে পিনপতন নীরবতা, হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবাও কোন কথা বলিতেছেন না। দরবারে একদিকে যেমন সন্ধ্যা নামিয়া আসিতেছে অপরদিকে ক্রমান্বয়ে র্জ্যােতির্ময় আভা ফুটিয়া উঠিতেছে। এমতাবস্থায় হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবা একটি মিষ্টি অংশবিশেষ খাইয়া বাকিটা হযরত সুরেশ্বরী বাবার মুখে পুরিয়া দিলেন। উপস্থিত সকলেই বুঝিল, হযরত সুরেশ্বরী বাবাও বুঝিলেন, এই তাঁহার আনুষ্ঠানিক আধ্যাত্মিক দীক্ষা এবং বা’য়াতের প্রতুশ্রুতি মাহেন্দ্রক্ষন। হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার প্রতি বেলায়েতের তাওয়াজ্জুহ্ প্রক্ষেপণ করিলেন এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁহাকে বা’য়াত দান করিলেন। নূরেহক্ব এর জ্যোতির তাজল্লিতে সুরেশ্বরী বাবার ভিতর বাহির পুড়িয়া ছারখার হইয়া যাইতেছিল। তাঁহার জাহের-বাতেন অবস্থায় অভূত পূর্ব পরিবর্তন সুচিত হইল। জজ্বার হালতে বেলায়েতের নূরী মোকাম সমূহ একরে পর এক অতিক্রম করিতে করিতে এক সময় অচেনত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন এবং হাউমাউ করিয়া গগণবিদারী কান্নায় গড়াগড়ি দিতে দিতে বেহুঁশ হইয়া গেলেন। হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবা স্পর্শ করা মাত্র তাঁহার স্নেহের জানশরীফ মৃতবৎ শান্ত হইয়া গেলেন। হযরত সুরেশ্বরী বাবার আসল অবস্থা অনুমান করিতে পারিয়া হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার পুরানো বিশিষ্ট মুরীদগণ কানা-ঘুষা করিতে লাগিলেন। আমরা সুদীর্ঘ সময় বাবার খেদমতে থাকিয়াও এই অমূল্য রতন লাভ করিতে পারি নাই, জানশরীফ আমাদের পরে আসিয়া আজ তাহা হাছিল করিল। হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবা তাহাদের ঘুষার কথা অনুমান করিতে পারিয়া বলিলেন, বাবাগণ, বেলায়েত কোন পৈত্রিক সম্পত্তি নহে, আল্লাহর এই দূর্লভ নিয়ামত মুর্শিদের খেদমত, শদ্ধা, ভক্তি, প্রেম এবং যথাযোগ্য কৃচ্ছতা ও কঠোর সাধনার মাধ্যমে অর্জন করিতে হয়। বাবা জানশরীফ তাহাই করিয়াছেন, তাহার মত কৃচ্ছতাসাধন করো, তোমরাও এই অমূল্য রতন লাভ করিবে।

সে যাহাই হোক, হযরত সূফী ফতেহ্ আলী বাবার প্রতি হযরত সুরেশ্বরী বাবার আত্মবিলীন ভাব,দরবারের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা ও ভক্তি সেবা ও খেদমত ইলমে মা’রেফত তথা পরম জ্ঞান অসীমের পরিচয় লাভের জন্য তাঁহার আহার-নিদ্রাবিহীন অহর্নিশ কঠোর কৃচ্ছ-সাধন এবং ‘নূরেহক্ব’ এ অবগাহনে তাঁহার উম্মাদনা এই সবের আধাঁর হযরত বাবা সূফী ফতেহ্ আলী বাবার নির্বানপ্রপপ্ত চৈতন্যপুরে প্রচন্ড দোলা দিল।

ইতিপূর্বে রূহানী সন্তান রূপে গৃহীত স্নেহের জানশরীফকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দীক্ষা দিয়া প্রকৃতই জানের জান করিয়া নিলেন। হযরত সুরেশ্বরীও মুর্শিদের হাতে আনুষ্ঠানিক বা’য়াত নিলেন। হযরত সুরেশ্বরীও মুর্শিদের হাতে আনুষ্ঠানিক বা’য়াত লইয়া তাঁহার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করিয়া আপন দাসত্বের শৃংখলকে আরো অধিক মজবুত করিলেন এবং নতুন করিয়া শুরু হইল হযরত সুরেশ্বরী বাবার আরো কঠোরএবং নিরবচ্ছিন্ন সাধনার জীবন। ইতিমধ্যে পাঠ শেষ পর্যায়ে আসিয়া পৌছাইয়াছে।

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...