Thursday, September 25, 2025

উচ্চ শিক্ষার্থে কলিকাতা গমন

 

স্থানীয় মাদ্রাসার লেখাপড়া শেষ হইয়া যাওয়ায় সুরেশ্বরী বাবা সবসময় কি এক অনির্বচনীয় চিন্তায় বিভোর থাকিতেন তাহা পিতা সুফি সাহেব বা অন্য কেহই বুঝিতে পারিতেন না। উচ্চ শিক্ষার্থে কলিকাতা গমনের চিন্তাই যে শুধু বিদগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে তাহাই নহে বরং ইশ্কে ইলাহী তথা আধ্যাত্মিক জগতের এক বিশেষ গভীর টানে সবসময় উদাস হইয়া নির্জন স্থানে একাকি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকিতেন। যুবক জানশরীফের এহেন অবস্থা দর্শন করতঃ পিতা সূফী সাহেব মনে করিলেন হয়তো বয়সের একটা বিশেষ সময়ে ছেলে-মেয়েদের এমন উদাসীভাব দেখা দিতেই পারে। সুতরাং তিনি ঠিক করিলেন ছেলেকে বিবাহ করাইয়া সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল করিয়া তুলিবেন এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য যে ব্যাকুলতা তাহাও ঘুচাইয়া যাইবে।

বিমাতার ইচ্ছাও ছিল তাহাই। সূফী সাহেব সুরেশ্বরের অনতি দূরে দেওজুরি গ্রামে নিবাসী ফয়জুদ্দিন হাওলাদের অপ্রাপ্ত বয়স্কা পরমা সুন্দরী কন্যা মোসাম্মৎ মেহের জানের সহিত জানশরীফের বিবাহ ঠিক করিলেন। শত অবহেলা এবং বিমাতার বৈরী আচরণেও কখনো জানশরীফের দ্বারা পিতা-মাতার অবাধ্যতা বা বে-আদবী প্রকাশ পায়নি। পিতা-মাতার প্রতি স্বভাবসুলভ আনুগত্যের কারণে জানশরীফ পিতার সিদ্ধান্তে রাজী হইলেন। জানশরীফের বিবাহ হইল বটে। তাঁহার মন বদলাইল না। সংসার কর্মে তাঁহার মর ফিরিল না। কলিকাতা থাঁহাকে যাইতেই হইবে। পিতার মত নাই। দুই চাচা রাজী হইয়াছেন। পার্শবতী জনৈক হাজী সাহেবও মত দিয়াছেন। তাঁহার কলিকাতা যাওয়ার খরচ যোগাইবেন। ইতিমধ্যে নিজেও গোপনে কিছু সঞ্চয় করিয়াছিলেন। জানশরীফ কলিকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত মনে মনে পাকাপোক্ত করিয়া ফেলিলেন। এখন সুযোগ খুঁজিতেছেন। পিতা-মাতার অজান্তে তাঁহাকে ঘর ছাড়িতে হইবে। তাঁহারা জানিলে যদি যাইতে না দেন। কারণ, তাঁহার অবর্তমানে তাঁহার সংসারের দায়ভার কে বহন করিবে, এই প্রশ্ন বড় হইয়া দেখা দিতে পারে।

এখানে উল্লেখ্য যে, বিবাহের পরও জানশরীফের সংসার কর্মে অমনোযোগী হওয়ার কারণে পিতা-মাতা তাঁহার প্রতি আরো বিরূপ হইয়া উঠিলেন। তাঁহারা দেখিলেন সংসারের প্রতি ছেলের আগ্রহী ও মনোযোগী করিবার আশায় বিবাহ করাইয়া সংসারের ভার বাড়াইয়াছেন। কেহ কেহ মনে করিলেন, ভিন্ন করিয়া দিলে শরীফ সংসার কর্মে মনোযোগী হইতে পারেন। পিতাও তাহাই মনে করিলেন। বিমাতার ও ইচ্ছা তাহাই। শরীফের মনের প্রকৃত অবস্হা এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতি তাঁহার আপোষহীন আগ্রহ-অনুরাগের বিষয়টি কাহারো উপলব্ধি হইল না। পিতা তাঁহাকে যৎ-সামান্য জমিজমা দিয়া নিজের সংসার হইতে ভিন্ন করিয়া দিলেন। কিন্তু তাঁহার অবস্থা যথাপীর্বং তথা পরনং রহিয়াই গেল। এইভাবে সুযোগের সন্ধান করিতে করিতে দিন, মাস, বৎসর কাটিয়া যায়। ইতোমধ্যে জানশরীফের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করিল। ভবিষ্যতে যিনি হাদী হইবেন, আপন স্ত্রী-কন্যার প্রতি তিনি উদাসীন হইতে পারেন না। তিনি পিতার চাপে বিবাহ করিলেও ইহাতে স্ত্রীরতো কোন দোষ নাই। এই কথা ভাবিয়া ন্যায় ও সত্যের দিশারী জানশরীফ স্ত্রীর প্রতি কখনো অবহেলা প্রদর্শন করেন নাই। শত অভাবের মধ্যেও নীতিগতভাবে আদর্শ স্বামী হিসাবে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। কন্যা সন্তানের জন্মের পর তিনি সংসারের মায়া জালে ঠিক নয়, স্ত্রী-কন্যার প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ববোধে বিচলিত হইলেন বৈ-কি। একদিকে উচ্চ শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিকতার অদম্য আপোষহীন টান অপরদিকে স্ত্রী-কন্যার প্রতি দায়িত্ববোধ, ভাবী সমাজ সংস্কারক, চৌদ্দ শতকের মুজাদ্দেদ বিদ্যানুরাগী জানশরীফকে ভাবাইয়া তুলিল। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। তিনি কোনটা রাখিবেন আর কোনটা ছাড়িবেন অথবা উভয়কূল কী করিয়া রক্ষা করিবেন স্থির করিতে পারিতেছেন না। গভীর ভাবনায় পড়িয়া গেলেন। একাকী বসিয়া থাকেন। সংসারের কাজকর্ম একেবারেই ছাড়িয়া দিলেন। নির্বাক বসিয়া থাকেন আর ভাবেন এই উভয় সংকট হইতে কী ভাবে উদ্ধার পাওয়া যায়। ইমাম গায্যালী (রাঃ) এরও এই রূপ অবস্থা হইয়াছিল। তখন তিনি বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনার দায়িতে¦ ছিলেন। হঠাৎ তাঁহার ভাবান্তর হইল বাগদাদের শান শওকাত, শত শত ছাত্র ভক্তের কোলাহল আর সংসারের আবদ্ধতা কিছুই তাঁহার ভাল লাগিতেছে না। স্থির করিলেন তিনি বাগদাদ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন। আরো জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে মক্কা-মদীনা যাইয়া জ্ঞানচর্চা ও ধ্যান সাধনা করিবেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তাঁহার অনুকূলে ছিল না। কেহই তাঁহাকে বাগদাদ ছাড়িয়া যাইতে দিতে রাজী ছিলেননা। একদিকে অন্তেরের টান, অপরদিকে বাহিরের চাপে তিনি বিমূঢ় হইয়া একেবারে নির্বাক হইয়া গেলেন। অবশেষে অন্তরের টানেরই জয় হইল।

একদা রাতে কাহাকেও কিছু না বলিয়া মক্কা-মদীনার উদ্দেশ্যে বাগদাদ ত্যাগ করিলেন। এই সময় হইতেই তাঁহার অধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ। অবশিষ্ট জীবন তিনি আধ্যাত্মিক জগতেই বিচরণ করেন। ঠিক তেমনি হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার বেলায়ও কলিকাতায় শিক্ষা লাভের আগ্রহের পিছনে মানিক তলার ওয়াইসী বাবার মানিকের আকাঙ্খা ছিল কিনা কে বলিতে পারে। জানু বাবাও তাহাই করিলেন। স্ত্রীকে বুঝাইয়া শুনাইয়া রাজী করিয়া আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া হঠাৎ এক রাতে কলিকাতার উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়িলেন। উল্লেখ্য যে, দুই চাচা-চাচী এবং পার্শ্ববর্তী হাজী সাহেব জানিতেন যে জানশরীফ উচ্চ শিক্ষার জন্য কলিকাতা যাইবেন। কিন্তু যাইবার সময় তাহাদেরও জানান নাই, এই ভয়ে যে জানাজানি হইয়া গেলে উচ্চশিক্ষা লাভে কলিকাতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হইতে পারে।

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা দুই চাচা এবং পার্শ্ববর্তী হাজী সাহেবের দেওয়া অর্থ ও নিজের যৎ-সামান্য সঞ্চয় নিয়া কলিকাতা পৌছাইয়া জনৈক ছাত্রের সহযোগিতায় আলী মাদ্রাসায় ভর্তি হইলেন। বহু চেষ্টা করিয়াও জায়গীরের ব্যবস্থা করিতে না পারিয়া নিকটস্থ এক মসজিদের মুয়াজ্জিনের দ্বারস্থ হইলেন। অনেক অনুরোধ উপরোধ করিয়া মুয়াজ্জিনকে রাজী করান যে তিনি মসজিদে তাহার সব কাজ করিয়া দিবেন বিনিময়ে মুয়াজ্জিন মসজিদ সংলগ্ন তাহার ঘরে তাঁহাকে থাকিতে দিবে।

ইতিমধ্যে পথভাড়া, ভর্তি ফী, কেতাব খরীদ এবং খানাপিনায় বাবা জানুর পুঁজি শেষ। পার্শ্ববর্তী হাজী সাহেব কিছু টাকা পাঠাইতেন। তাহাতে তাঁহার খরচ সংকুলান হইত না। কলিকাতায় আলিয়া মাদ্রাসায় অল্প দিনের মধ্যেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে তাঁহার পরিচিতি হইয়া যায়। অপর দিকে তাঁহার বিনীত ও বিনম্র স্বভাব সকলকে মুগ্ধ করে। সহপাঠি, শিক্ষক এবং পরিচিতরা তাঁহার প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া উঠে। তাঁহার অর্থ কষ্ট দেখিয়া তাঁহাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতেন। এইভাবে অর্থ-কষ্টের মধ্য দিয়া তিনি মাদ্রাসা র পড়া চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। অভুক্ত অবস্থায়ও তিনি অনেকদিন ক্লাস করিয়াছেন। অর্থাভাবে সব কেতাব খরীদ করিতে পারেন নাই। অন্যদের কেতাব ধারে নিয়া পড়িয়া লইতেন অথবা নোট করিয়া লইতেন। এইখানে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ না করিলেই নয়, একবার সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা প্রায় দুই দিন অনাহারে থাকিয়া লেখা-পড়া ও অণ্যান্যকার্যাদি করিতে ছিলেন। অসহ্য ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির অবস্থায় মসজিদের সামনে দিয়া মাদ্রসায় যাইবার পথে দেখিলেন মসজিদে মিলাদ মাহ্ফিল শেষে মিষ্টি বিতরন হইতেছে। মিষ্টি বিতরণকারী হাতের ইশারায় সুরেশ্বরী বাবাকে কাছে ডাকিয়া দুইটি রসগোল্লা দিলেন। হাতের তালুতে করিয়া রসগোল্লা দুইটি নিয়া ভাবিতেছিলেন নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার প্রতি মেহেরবান হইয়া এই খাদ্য দান করিয়াছেন। ইতিমধ্যে তিনি লক্ষ্য করিলেন যে দুটি কাক তাঁহার মাথার উপর দিয়া কী ক রবে চিৎবার করিয়া পাক খাইতেছে এবং মিষ্টি দুইটি নিবার জন্য ছোঁ মারিতেছে তাই কাকের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য মিষ্টি দুইটি মখে পুরিয়া দিলেন কিন্তু তিনি মিষ্টি খাইতে পারিলেন না। বাবা সুরেশ্বরীর হৃদয়ে ভাবান্তর হইল। তিনি ভাবিলেন, নিশ্চয়ই কাক দুইটি আমার চাইতেও অনেক ক্ষুধার্ত। এই ভাবিয়া রসগোল্লা দুইটি মুখ হইতে বাহির করিয়া কাক দুইটিকে দিয়া দিলেন। আল্লাহ্র সষ্টি জীবকে আহার দিতে পারিয়াছেন বলিয়া তিনি হৃদয়ে শান্তি লাভ করিলেন এবং নিজে দুইদিন অনাহারে থাকিবার কষ্টের কথা ভুলিয়া গেলেন। আল্লাহ্র প্রেমেরতো প্রশ্নই উঠে না তাঁহার সৃষ্ট জীবের প্রতি যাহার এত দয়া তিনি আল্লাহ্র মহান অলী হইবেন নাতো হইবেন কে? আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বোধকরি আপন আশিক এবং প্রেমিকদের এইভাবেই কষ্টি পাথরে যাচাই-বাছাই করিয়া খাটি সোনার আদলে গ্রহন করেন। তাহা না হইলে যাহার লঙ্গরখানায় লক্ষ লক্ষ মানুষ পেট ভরিয়া তৃপিÍ সহকারে আহায্য গ্রহন করিবে আজ সেই মানুষটিরই জীবনযাপন অনাহারে অর্ধাহারে কাটিতেছে ভাবিতেও অবাক হইতে হয়। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার এই ঘটনার সহিত হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রাঃ) এর শিক্ষা জীবনের চরম হাহাকারের কথা উল্লেখ করিলেই পারিনা।

হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) যাহার সম্পর্কে বলিয়াছেন, ”আমার পরে যদি নবুয়্যতের দরজা বন্ধ না হইত তাহলে অবশ্যই আবদুল কাদের মহিউদ্দিীন (রাঃ) নবী হইত,” সেই আল্লাহর পিয়ারা মানুষটিও শিক্ষা জীবনে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করিতে না পারিয়া মাদ্রাসার অদুরবর্তী সবুজ জমীনের ঘাসকে খোদার নেয়ামত স্বরুপ গ্রহন করিয় ক্ষুধা নিবারন করিয়াছেন। তবু কাহারো মুখাপেক্ষী বা করুনার পাত্র হন নাই। অলী-আউলিয়া গাউস, কুতুব, কামেল মোকাম্মেলদের জীবনী পর্যালোচনা করিলে এমনই দেখা যায়।

যাহাই হউক এইভাবে তিনি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা চালাইয়া যান। একদিন কলিকাতায় মাদ্রাসায় পাঠ্য অবস্থায় ক্ষুধার যন্ত্রনায় তিনি মূর্ছা গিয়াছিলেন তবুও আর্থিক সংকট, এমনকি অনাহারও তাঁহাকে পড়ালেখার ব্যাপারে এতটুকু নিরুৎসাহ করিতে পারে নাই। এইদিকে তাঁহার স্ত্রী তাঁহার শিশু কন্যাকে নিয়া অর্থাসংকট ও নিদারুন অভাব-অনটনে দিশাহানা। নিরূপায় হইয়া কন্যাকে নিয়া পিত্রালয়ে চলিয়া যান। পিতার অবস্থাও ভাল নয়। বাড়িতেও অভাব। তাই কিছুদিন থাকিয়া স্বামীর বাড়িতে ফিরিয়া আসেন। এই সময় মৌলভী ইসমাইল সাহেবের মাতা, বাবা জানুর উক্ত দুই চাচী ও চাচা এবং পার্শ্ববর্তী হাজী সাহেবের স্ত্রী তাহাদেরকে সাহায্য করিতের।

এইভাবে উভয় সংকটের মধ্যদিয়া চলিয়াছে বাবা জানুর উচ্চ শিক্ষার অগ্রযাত্রা। স্ত্রী-কন্যার ভাবনায় মাঝে মাঝে তাঁহাকে বিচলিত করিলেও উচ্চ শিক্ষার এবং আধ্যাত্বিকতার অদম্য আগ্রহ তাঁহাকে লক্ষ্যচ্যুত করিতে পারে নাই। সব মানসিক ও আর্থিক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া অতি সুনামের সহিত তিনি লেথাপড়া চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। এই সময় তিনি মানিক তলায় কোতবোল এরশাদ রাসূলেনোমা হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) এর পবিত্র আধ্যাত্মিক দীক্ষা কেন্দ্রের সহিত পরিচিত হন। এইবার প্রকৃত বিদ্যা এবং আসল জ্ঞান সিন্ধুর সন্ধান পাইলেন। থাঁহার মধ্যে নূতন করিয়া ভাবান্তর দেখা দিল। মর্শিদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ শিরোনামে এই বিষয়ে আলাকপাত করা হইবে। শুধু এইটুকু এখন বলা যায় যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার কলিকাতা আসিবার পিছনে মানিক তলার দৈব তাগিদই হয়তো মূখ্য ছিল। সুরেশ্বরী বাবার শিক্ষা ও কর্ম জীবন সম্পর্কে তাঁহার পৌত্র শাহ্ সূফী হযরত নূরে আকতার হোসাইন ওরফে চুন্নু মিয়া মিয়া শাহ্ তাহার ফরমায়েসকৃত ‘নূরেহক্ব গঞ্জেনূর’ কাব্য গ্রন্থে অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠকের জন্য হুবহু এখানে তুলিয়া ধরা হইলঃ “হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ) পিত্রালয়ে পিতা-মাতার নিকট বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করেন। পরে তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যায়ন করেন এবং উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা লাভের পর মাদ্রাসা আলিয়ায় মোর্দারেছের পদ প্রাপ্ত হন। এটাই ছিল তৎকালীন সময়ে কোন ভারতীয়দের জন্য সর্বোচ্চ পদ। এর উর্ধতন পদ ছিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, যাহা ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তৎপর তিনি একাদিক্রমে ২০ বৎসর পর্যন্ত হেড মোর্দারেছের পদ অলংকৃত করে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।”

২০০১ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত মাসিক সুরেশ্বর পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দানের সময় ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার সাবেক অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব এক প্রশ্নের জবাবে সুরেশ্বরী ক্বিবলার কা’বা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, তিনি একাধারে আল্লাহ্র মহান অলী ও বিখ্যাত আলেমে দ্বীন। মাওলানা আহম্মদ আলী ওরফে জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ) দীর্ঘদিন মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, কলকাতার হেড মাওলানা। সেখানকার হেড মাওলানাদের তালিকায় আমি স্বচক্ষে তাহার নাম দেখিয়া আসিয়াছি। আর সুরেশ্বর দরবার শরীফ সেই মহান অলীর হাতে গড়া সুতরাং মাওলানা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রাঃ) ও তাহার প্রতিষ্ঠিত দরবার শরীফকে আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি।

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত মাসিক সুরেশ্বর পত্রিকায় লিখিত এক নিবন্ধে আঞ্জুমান-ই-ফার্সী বাংলাদেশের সভাপতি জনাব মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘জাহেরী দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞানের সহস্র প্রথিতযষা মাদ্রাসার সুতিকাগার কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার ২০ বছর মেয়াদী হেড মোদাররেস সাইয়েদ জানশরীফ শাহ্ ওরফে শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী সর্বত্র খ্যাতনামা ওলামা কুল সূর্য শামসুল ওলামা হিসেবে’

যাহাই হউক আমার হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার জাগতিক শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ না করিয়া অত্র পুস্তকে তথা তাহার সমগ্র জীবন পঞ্জীতে গুরুত্ব সহকারে বিচার্যের বিষয়কে স্থান দিব যাহা তাহা হইল তাঁহার বেলায়েত ও কামালিয়াতের অত্যুজ্বল বিষয়কে। কেননা সৃষ্টির মুরু হইতে এই পযর্ন্ত যত আম্বিয়া-আউলিয়া (আঃ) এই ধরাধামে আগমন করিয়াছে, তাঁহাদের বাহ্যিক শিক্ষাকে কখনোনোই গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হয় নাই। এর পিছনে এক মাত্র কারণ যে তাঁহাদের কেহই পূথিঁগত বিদ্যায় বিদ্বানছিলেন না। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) স্বয়ং তাঁহার রচিত “নূরেহক্ব গঞ্জেনূর” কিতাবে লিখিয়াছেন ‘মাদ্রাসা পাশ করিয়া কেহ নবী হন নাই’ তাই অত্র পবিত্র জীবনী মোবারকে আমরাও তাঁহার বেলায়েত ও সূফী দর্শনের দিকেই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুকে নিপতিত করিব।

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...