Thursday, September 25, 2025

বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবন

 

একটি শিক্ষিত পরিবারই সন্তানের প্রাথমিক বিদ্যালয়। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার বেলায় তাহাই হইয়াছিল। তাঁহার পিতা সূফী সাহেব তাঁহার সময়ে শিক্ষিত ব্যক্তি বলিয়াই গণ্য ছিলেন। বিশেষতঃ প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষায় তিনি শিক্ষিতই ছিলেন বটে। তাই তাঁহার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হইয়াছিল পিতা সূফী সাহেবের কাছে।

সূফী সাহেব নিজের হাতে সব কাজ করিতেন। সাংসারিকসহ বিভিন্ন কাজে তিনি ব্যস্ত থাকিতেন। ইতিমধ্যে ছেলে জানশরীফ পড়ালেখায় আগাইয়া গিয়াছে। পিতাও সময় দিতে পারিতেছেননা। তাহা ছাড়া ছেলের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা দরকার। সুতরাং তিনি ছেলেকে নিকটস্থ মুন্সি আলা বক্স মৃধার বিদ্যায়তনে ভর্তি করাইয়া দিলেন।

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা মেধাবী এবং মনযোগী ছাত্র ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বিশুদ্ধভাবে কোরআন পাঠসহ ইসলামের পাঁচটি আনুষ্ঠানিক বিষয়- কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত সম্পর্কিত মাসলা মাসায়েলেন কয়েকটি নির্ধারিত উর্দু কেতাবের পাঠ প্রশংসনীয় কৃতিত্বের সহিত সুসম্পন্ন করেন। মৃধা সাহেবের বিদ্যায়তনে ইহার অতিরিক্ত কিছু পড়ানো হইত না।

সেই সময়ের ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও স্নেহ-মমতার সম্পর্ক ছিল গভীর। মেধাবী ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকগণ বাড়তি যত্ন নিতেন। এখন যেমন নিচের বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে মেধাবী ছাত্রটির কী হইল, কোন শিক্ষক সেই খবর রাখেন না, সেই সময়ে এমন ছিল না। নিজের ছাত্রটি অতঃপর কোথায় ভর্তি হইলে সুশিক্ষা লাভ করিতে পারিবে এবং তাহার পড়ালেখা যাহাতে চালু থাকে সেই ব্যাপারেও শিক্ষক খবরদারি করিতেন।

মেধাবী ছাত্র জানশরীফ কৃতিত্বের সহিত মৃধা সাহেবের বিদ্যায়তনের পাঠ সমাপ্ত করায় তিনি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ঠ হইয়া পড়েন। তিনি তাঁহাকে নিজের বিদ্যায়তন হইতে বিদায় দিলেন বটে, কিন্তু লাগাম ছাড়িলেন না। তিনি তাঁহাকে মুলফতগঞ্জ খারেজী মাদ্রাসায় ভর্তি হইয়া পড়া লেখা চালাইয়া যাইবার জন্য আদেশ করিলেন। তাঁহার আদেশ মত তিনি উক্ত মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মাদ্রাসার নির্ধারিত পাঠ সমাপ্ত করেন। কিন্তু তাঁহার জ্ঞান পিপাসা মিটিল না। ধারে কাছে উচ্চশিক্ষার কোন ব্যবস্থাও নাই। অতৃপ্ত জ্ঞান পিপাসা লইয়া তিনি বাড়ি চলিয়া আসিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার বয়স যখন ছয় বৎসর তখন তাঁহার স্নেহময়ী মাতা ইহধাম ত্যাগ করেন। মমতাময়ী দাদীমার উপর তাঁহার লালন-পালন ও সেবাযত্নের দায়িত্ব বর্তায়। মাতার বর্তমানেও তিনি নাতির সেবা যত্ন করিয়াছেন। কিন্তু তাহাতে তাহার মন ভরিত না। বাধ সাধিতেন মা। মার অবর্তমানে তিনি সর্বক্ষণ নাতির সেবা-যত্ন করিতে পারিতেছেন। কী তাহার আনন্দ। দাদীমা যখন তাহার নাতি জানশরীফকে আদর করিতেন, দেখিলে মনে হইত বাবা জানুর মাতৃবিয়োগ যেন দাদীমার জন্য সাঁপে বর হইয়াছে। দাদীমার আদর যত্নে শিশু জানশরীফও মাতৃবিয়োগের শোকটুকু ভুলিতে পারিয়াছিলেন। মাতৃবিয়োগ তাঁহাকে তেমন একটা পীড়া দিতে পারিত না। প্রখড় সূর্যের অসহনীয় উত্তাপে দগ্ধ মরুচারীর ভাগ্য বটবৃক্ষে ছায়া প্রাপ্তির মত দাদীমার হৃদয় নিংড়ানো স্নেহ মমতা ও সেবা যত্নে মাতৃহীন বালক জানশরীফের জীবন এক প্রকার সুখ ও শান্তিতেই অতিবাহিত হইতেছিল।

আল্লাহ্ যাহাকে হাদী বা সমাজ সংস্কারক বানাইবেন তাহাকে মানুষের বিভিন্ন প্রকার সুখ-দুঃখের অবস্থা, পারিবারিক ও সাংসারিক সমস্যা, মন-মানসিকতা ও কষ্ট-ক্লেশের সহিত পরিচিত করিয়া গড়িয়া তোলেন। বিশ্বনবী, আল্লাহর হাবিব রাহমাতুল্লিল আ’লামীন মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী যাহারা পাঠ করিয়াছেন এই সত্য তাহাদের নিকট দিবালোকের মত সুষ্পষ্ট। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার জীবনও আল্লাহর এই অমোঘ বিধানের অধীনতো হবেই। কারণ, কালে তিনিও যে হাদী হইবেন, সমাজ সংস্কারক হইবেন, শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত এবং মা’রেফতের ধারক-বাহক হইবেন এবং তাঁহাকে সমাজের প্রচুর বাধা বিঘ্ন, অবরোধ-প্রতিরোধ এবং প্রতিকূলতার শিকার হইতে হইবে। সুতরাং প্রথম হইতেই তাঁহাকে সহিষ্ণু করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। তাহাই হইল। মাত্র দশ বৎসর বয়সের সময়ে মাতৃহারা বালক জানশরীফের মমতার ভান্ডার স্নেহময়ী দাদীমাও তাঁহাকে ছাড়িয়া পরপারে চলিয়া যান। নয়নের মনি প্রাণ প্রিয় নাতি জানশরীফের মাতৃস্নেহের শেষ আশ্রয়বৃক্ষটিও উৎপাটিত হইল। তাঁহার আনন্দে হাসিতে, দুঃখে কাঁদিতে, দুনিয়াতে আর কেহই রহিল না। তিনি একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। শুধু তাহাই নহে, শাস্ত্রে বলে ভাঙ্গা পা খাদে পড়ে। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিলার ব্যাপারেও সেই রকম ঘটিল। ইতিমধ্যে পিতা সূফী সাহেব নতুন বিবাহ করিলেন। বালক জানশরীফকে বিমাতা মাতৃস্নেহে গ্রহণ করিতে পারিলেন না।

বিমাতার রূঢ় আচরণ ও অবহেলায় বালক জানশরীফের মন দুঃখে কাঁদিয়া উঠিল। মা-দাদীর অতি আদর ও সোহাগে এবং সেবা যত্নে লালিত জানশরীফকে বিমাতার রূঢ় ব্যবহার ও অযত্ন একটু বেশীই মর্মাহত করিল। পিতা সূফী সাহেব এক রকম সহজ ও সরল স্বভাবের লোক ছিলেন, সেই কথা আগেই বলা হইয়াছে। তিনি জানশরীফের অবস্থা কিছুটা উপলদ্ধি করিতে পারিলেও প্রতিকারের কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিলেন না। কখনও কখনও তিনি পুত্র জানশরীফের সাথে রূঢ় আচরণের ব্যাপারে স্ত্রীকে সাবধান করিয়া দিলেও উহার ফলাফল কি হইল সেই খবরদারি করিবার সময় ও মেজাজ তাঁহার ছিল না। এই অবস্থার মধ্যেই জানশরীফ মুলফতগঞ্জ মাদ্রাসার পাঠ শেষ করিয়া বাড়িতে অবস্থান করিতেছিলেন। দু-একজন হিতাকাংখীর পরামর্শে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলিকাতা যাইবার মনস্থ করিতেছিলেন। পিতার নিকট প্রস্তাবও করিলেন। আর্থিক অনটনের অজুহাত দেখাইয়া পিতা সূফী সাহেব তাঁহার প্রস্তাবে রাজী হইলেন না। জানশরীফ একদিকে উচ্চ শিক্ষা লাভের আকাংখা এবং জ্ঞান পিপাসায় কাতর, অপরদিকে বিমাতার বৈরী আচরনে মর্মাহত। কোন কাজে তাঁহার মন বসিতেছিলনা। তবু চাপে পড়িয়া সংসারের কাজে তাঁহাকে অংশ গ্রহন করিতে হইতেছে। পিতা-মাতার ইচ্ছা জানশরীফ সার্বক্ষনিক সংসারের কাজে আত্ননিয়োগ করুক। কিন্তু জানশরীফ সর্বদা অন্য মনস্ক। তাঁহার একই চিন্তা, তাঁহাকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করিতে হইবে।

উল্লেখ্য যে, সূফী সাহেব ধনী লোক ছিলেন না। তবে অভাবীও ছিলেন না। নিজের আয়ে নিজের সংসার মোটামুটি ভালই চলিত। জানশরীফের উচ্চ শিক্ষা লাভের যেইরূপ আগ্রহ ছিল, ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত বানাইবার জন্য পিতা মাতার মনেও যদি অনুরূপ আগ্রহ থাকিত তাহা হইলে কলিকাতায় পড়ানোর খরচ বহন করা একটু কষ্টকর হইলেও অসাধ্য ছিল না। মাতা জোর দিলে পিতা হয়ত রাজীও হইতেন। কিন্তু বিমাতার আচরণ দৃষ্টে অনুরূপ আশা করা দূরাশা বৈ কি।

তবে যাহার কেহই থাকে না তাহার জন্য আল্লাহ্ থাকেন। বাবা জানশরীফ তো আল্লাহরই মনোনীত এবং সমাজের হাদী ও সংস্কারক রূপে আবির্ভূত। তাঁহার জন্ম বৃত্তান্তে এ রহস্য সুস্পষ্ট। আল্লাহ্ তাঁহাকে সেই লক্ষ্যে গড়িয়া তুলিবেনই। হতাশা-দুর্দশা এবং বিমূঢ়তার অপার মরুভূমে উচ্চ শিক্ষা লাভে অতৃপ্ত পিপাসার আগুনে জানশরীফের হৃদয় যখন পুড়িতেছিল, আল্লাহ্ তাঁহার এই প্রিয় বান্দার হৃদয়ের ব্যাথায় স্থির থাকিতে পারিলেন না। তাঁহার ব্যাথা প্রশমনের ব্যবস্থা করিলেন। তাঁহার দুই চাচা এবং চাচীমাগণ আসিয়া তাঁহার পাশে দাঁড়াইলেন। উল্লেখ্য যে, বিমাতার বৈরী আচরণের প্রতিক্রিয়ায় চাচীদের নারী হৃদয়ে মাতৃহীন জানশরীফের প্রতি স্হেনেহের উদ্রেক হইল। ফলে চাচাগণও প্রভাবিত হন। সেই সময়ে মুন্সিই ছিলেন এলাকার বড় বিদ্যান। সূফী সাহেবের ছেলে মুন্সি হইয়াছে। তিনি তাহাতেই তৃপ্ত। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য জানশরীফের অদম্য আগ্রহ দেখিয়া চাচাদের সহিত আরো অনেকেই তাঁহার প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া পড়িলেন। তাহাদের পরামর্শে জানশরীফ জাফর তালুকদারের আশ্রয়ে ঘড়িসার মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি জাফর তালুকদারের বাড়িতে থাকিতেন। তাঁহার দাদী জানশরীফকে মায়ের স্নেহে আদর যত্ন করিতেন। ইতিমধ্যে তাঁহার মেধা ও শিষ্টাচার এবং পড়া লেখার প্রতি গভীর নিষ্ঠার কথা জানাজানি হইলে অনেকেই তাঁহাকে আর্থিক সাহায্য করিতে আগাইয়া আসিলেন। বলা বাহুল্য যে, এই সময়ে তাঁহার জ্ঞানধারা মাদ্রাসার শ্রেণী সীমা ছাড়াইয়া যায়। শ্রেণী পাঠের সময়ে তিনি শিক্ষকদেরকে অতিরিক্ত প্রশ্নে জর্জরিত করিতেন, শিক্ষকগণ জানশরীফের প্রশ্নবাণে বিরক্ত হইলেও সেই বিষয়ে জানশরীফের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা শুনিলে তাঁহারা হতবাক হইয়া যাইতেন এবং তাঁহার সম্পর্কে অলৌকিক মতামত ব্যক্ত করিতেন। এমতাবস্থায়, তাঁহার জনৈক শিক্ষক তাঁহাকে কলিকাতা মাদ্রাসায় যাইয়া ভর্তি হইবার পরামর্শ দিলেন। উল্লেখ্য যে, কলিকাতা মাদ্রসায় পড়িবার ইচ্ছা তাঁহার পূর্ব হইতেই ছিল। সেই কথা উপরে বর্ণনা করা হইয়াছে। ওস্তাদের এই পরামর্শে তাঁহার সেই ইচ্ছা আবার উথলিয়া উঠিল এবং বহুগুন বাড়িয়া গেল। তিনি চাচাদের স্মরণাপন্ন হইলেন। আল্লাহর ইচ্ছায়, ইহাতে স্মেহময়ী চাচীদেরও সমর্থন থাকিতে পারে, চাচারাও তাঁহার উচ্চশিক্ষার জন্য কলিকাতা যাওয়ার ব্যাপারে রাজী হইলেন। সাথে জুটিলেন, পার্শবর্তী জনৈক হাজী সাহেব। ঠিক হইল, তিনিও তাঁহাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করিবেন।

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...