১৩২৬ সনের কার্তিক মাসের শেষের দিকে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা তাঁহার বিশেষ ভক্ত ও মুরিদদের পত্র মরফত খবর পাঠাইলেন যে তিনি অগ্রহায়ণ মাসের ২ তারিখে ছফরে যাইবেন সুতরাং সকলকে দরবারে উপস্থিত হইবার জন্য নির্দেশ দান করিলেন। বিশেষ করিয়া নোয়াখালী জেলার (বর্তমান লক্ষিপুর) রায়পুর নিবাসী ডাঃ আব্দুল হামিদ সাহেবকে স্বহস্তে চিঠি লিখিয়া পাঠাইলেন যে ২রা অগ্রহায়ণ তিনি ছফরে যাইবেন সুতরাং পত্রপাঠ তিনি যেন দরবারে চলিয়া আসেন। ডাঃ আব্দুল হামিদ মুর্শিদের স্বহস্তে লিখিত পত্র পাইয়াই যথাশ্রীঘ্র দরবারে আসিয়া হাজির হইলেন। ইহার আগে পরেও ডাক্তার সাহেব এমনটি ধরনের চিঠি পাইয়াছেন। বাবা সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা যখনই কোথাও কোন সফরে যাইতেন, ডাঃ সাহেব প্রায়শঃই তাঁহার সফর সঙ্গী হইতেন বিধায় এইবারেও মুর্শিদের চিঠি পাইয়া সফরের প্রস্তুতি মূলক নিত্য প্রয়োজনীয় যাহা কিছু দরকার তাহা তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন। দরবারে আসিয়া তিনি দেখিলেন যে সুরেশ্বরী বাবা অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে। অসুস্থ অবস্থা দেখিয়া তিনি মুর্শিদের নিকট জানিতে চাহিলেন যে এই অসুস্থ শরীর নিয়া সফরে যাওয়া হইবে কেমন করিয়া। উত্তরে সুরেশ্বরী বাবা বলিলেন যে দয়াল চাহেতো কোনই অসুবিধা হইবেনা। দুই একদিন যাইতে শরীর আরও খারাপ হইয়া পড়িল। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎগতিতে মুরিদগণ জানিয়া ফেলিলেন যে সুরেশ্বরী বাবা অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। দলে দলে আশেক, ভক্ত ও মুরিদগণ দরবারে আসিয়া উপস্থিত হইল। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার শ্বাষ-কষ্ট ছিল। এই সময়ে ইহা আরও বাড়িয়া গেল। অসুস্থ হইবার পর প্রথম দিকে তিনি দরবারে আসিয়া বসিতেন কিন্তু কার্তিক মাসের দুই একদিন থাকিতে তিনি শরীর যারপর নাই অসুস্থ হইয়া পড়িবার দরুন ভিতর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। একমাত্র ডাঃ আব্দুল হামিদ সাহেব অন্দর মহলে গমন করিয়া মুর্শিদ ক্বিবলার শারীরিক অবস্থার কথা সবাইকে অবহিত করিতেন। ইতিমধ্যে দয়াল পাকের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি দেখা দিল। উৎসুক আশেক ভক্তের দল বাহির বাড়ির দরজায় আসিয়া ভীড় জমাইতে লাগিল। সবাই বিনিদ্র থাকিয়া ডাঃ আব্দুল হামিদের খবরের অপেক্ষায় বসিয়া াকিত। অবশেষে আসিল সেই মহা বিচ্ছেদের দিন, যেইদিন ভোর হইতেই সুরেশ্বর দরবার শরীফের সমস্ত প্রকৃতিই থমথমে হইয়া উঠিল। কাতারে কাতারে হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় দরবার প্রাঙ্গন মহা শোকের মিছিলে পরিণত হইল। সমস্ত আশেক ও ভক্তদের অন্তরের উদ্বিগ্নতা ও শংকা তাহাদের মুখমন্ডলে স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিল। চারিদিকে একটা চাপা দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা সমগ্র দরবারে বিরাজ করিতে লাগিল। ২রা অগ্রহায়ণ সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচ টায় সুরেশ্বরী বাবার প্রাণ প্রিয় খলিফা ডাঃ আব্দুল হামিদ সাহেব যাহার অন্দরে যাইবার একমাত্র অনুমতি ছিল তিনি আলু-থালু মস্তিস্কে কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া বাহির বাড়ির সিংহ দরজার কাছে দাড়াইলেন। তাহাকে দেখিয়া সকলে বাবার খবর লইবার জন্য হুমড়ি খাইয়া পড়িল। সমস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন বাবার কি খবর? উত্তরে ডাঃ আব্দুল হামিদ নিজে মস্তকে দুইহাত দ্বারা আঘাত করিয়া বলিলেন “বাবার খবর আমার কপাল” সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ভক্ত মুরিদেরা গগণ বিদারী চিৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বেহুস-বেক্বারার হইয়া পড়িল। মূহুর্তেই সমগ্র দরবারে যেন কিয়ামতের মাতম শুরু হইয়া গেল। হায় জানু হায় জানু রবে দরবারের বাতাস ভারি হইয়া উঠিল। মহাকালের গর্ভে পদ্মানদীর যত উর্মি মালা লুক্কায়িত ছিল তাহারও আজ বাধভাঙ্গা ফনা তুলিয়া হায় জানু হায় জানু রবে সুরেশ্বরের পাড়ে আছড়ে পড়িতে লাগিল। বনের পশু পাখিরাও এতদিনকার প্রাণাধিক বন্ধুর বিয়োগ ব্যথায় হায় জানু হায় জানু রবে মুখরিত হইয়া উঠিল। দরবারের গাছপালা গুলোও বুঝি বাবা জান ক্বিবলার মহা ছফরের কথা বুঝিতে পারিয়া হায় জানু হায় জানু রবে শাখা প্রশাখা দোলাইতে লাগিল। জলে, স্থলে স্বর্গে-মর্ত্য, ঈশান-নৈঋত সর্ব দিক হইতে একই আওয়াজ ভাসিয়া আসিতে লাগিল হায় জানু, হায় বাবা সুরেশ্বরী। ইতিমধ্যে গভীর রাত্রে গোসল সারিয়া ও কাফন আবৃত করিয়া তাঁহার দেহ মোবারক যখন দরবার প্রাঙ্গনে আনিয়া রাখা হইল, শোক সন্তপ্ত তখনকার সার্বিক অবস্থার কথা বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। ইহা সকলেরই জানা যে সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা একটি ঘোড়া ও একটি শালিক পুষিতেন। শালিকটি খুব সুন্দরভাবে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলিতে পারিত। যখন সুরেশ্বরী বাবার দেহ মোবারক ভিতর বাড়ি হইতে দরবার প্রাঙ্গনে আনা হইল তখন খাঁচার পাখিটি ডানা ঝাপটাইতে ঝাপটাইতে এবং জানু বাবা জানু বাবা বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িল। আর ঘোড়াটি দড়ি ছিড়িয়া দৌড়াইয়া জানু বাবার কাফনে ঢাকা দেহ মোবারকের নিকট উপস্থিত হইয়া পা হইতে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার ঘ্রান লইয়া একছুটে সম্মুখস্ত খোলা মাঠে পা তুলিয়া প্রচন্ড আওয়াজ করিয়া গড়াগড়ি খাইয়া চোখের পানি ঝরাইতে ঝরাইতে মৃত্যুবরণ করিল। দূর-দূরান্ত হইতে দলে দলে আশেক ভক্তগণ যতই আসিতে লাগিল গগণ বিদারী কান্নার আওয়াজে ততই দরবারের বাতাস ভারী হইতে লাগিল। প্রিয় মা’শুকের বিয়োগ ব্যাথায় ভক্ত ও মুরিদদের অবস্থা এমন হইয়া উঠিল যে, শান্তনা দিবার মত কেহই আর বাকি রহিলনা। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার বিয়োগ ব্যাথা সহ্য করিতে না পারিয়া আটজন মুরিদান হায় হুতাশ করিতে করিতে মৃত্যুবরণ করিল।
বিশিষ্ট খলিফা ও মুরিদেরা যাহারা সুরেশ্বরী বাবার দেহ মোবারকের সন্নিকটে ছিল। হঠাৎ তাহারা দেখিলেন যে সুরেশ্বরী বাবা কাফনের ভিতরে ডান পায়ের হাটুর নিকট ভাজ করিয়া হাটু উচু করিয়া রাখিয়াছেন। এই অবস্থায় অনেক সময় অতিবাহিত হইল এবং পূণরায় পা সোজা করিয়া দিলেন। ইহা দরশন করতঃ তাহারা সকলে চিৎকার করিয়া সাধারণ ভক্ত-মুরিদদের কান্না থামাইতে বলিয়া পাক কোরআনের সেই অমিয়া বাণী শোনাইলেন- “নিশ্চই আল্লাহর অলীদের মৃত্যু নাই”। ইহা ছাড়াও তাঁহার নামাজে জানাজায় কোথা হইতে স্বর্গীয় চেহারার অসংখ্য লোক আসিয়া শরীক হইয়াছিল তাহা কেহই বলিতে পারে নাই।
যুগশ্রেষ্ঠ মোজাদ্দেদ, গাউসে আলম, কুতুবোল এরশাদ, বেলায়েতের মধ্যমনি, এলমে মারেফতের গহীন সাগর, দশ লক্ষাধিক ভক্ত-মুরিদের ক্বিবলা তদানীন্তন পাক ভারত উপ-মহাদেশের এই অলীকুল শিরমনি বাংলা ১৩২৬ সনের ২রা অগ্রহায়ণ সন্ধ্যা ৫টা ২৭ মিনিটে ৬৩ বৎসর হায়াৎ শরীফ লাভ করিয়া মর্ত্যধামে শোকের মাতম সৃষ্টি করিয়া আপন প্রভুর আহ্বানে এই নশ্বর ধরাধাম ত্যাগ করিয়া জাত পাকে বিলীন হইলেন।
No comments:
Post a Comment