Thursday, September 25, 2025

পবিত্র উরস শরীফ উদযাপন

 

উরস শব্দের মূল আরবী র্উসুন্। এর আভিধানিক অর্থ পরিনয়। পরিনয় সূত্রে মিলিত দুইটি প্রাণ একাত্ম হইয়া স্বামী হয়, অর্ধাঙ্গ আর স্ত্রী হয় অর্ধাঙ্গিনী। নূর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “মৃত্যু একটি পুলের মত আল্লাহর সাধকগণ তাহা অতিক্রম করায় মধ্য দিয়া আল্লাহ্তে মিলিত হন।” অর্থাৎ সসীম দেহের কারণে দেহাবিষ্ট অবস্থায় অলি- গাউসগণ, ফানা ফিল্লাহ্-আল্লাহ্তে বিলিন হন। অর্থাৎ সসীম দেহের কারণে দেহাবিষ্ট অবস্থায় অলি-গাউসগণ ফানা ফিল্লাহ্- আল্লাহ্তে আত্মবিলীন স্তরে অবস্থান করেন এবং দেহান্তরিত হইয়া তাহারা বাক্কা বিল্লাহ্ – আল্লাহর অসীম সত্ত্বায় স্থিতি লাভ করেন এবং আশিক মা’শুকের চরম ও পরম কাঙ্খিত মিলন হয়। এই জন্য অলি গাউসদের দেহান্তরকে রূপক অর্থে উরস বলা হয় এবং ঐ দিবসে পবিত্র উরস মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়।

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ বলেন- “আমি ভালবাসায় অলি গাউসদের সহিত এমন ভাবে একান্ত হই যে, আমি তাঁহাদের কর্ণে পরিনত হই যাহা দ্বারা তাহারা শ্রবণ করেন, আমি তাঁহাদের হাতে পরিণত হই যাহা দ্বারা তাঁহারা ধরেন, আমি তাঁহাদের চক্ষুতে পরিণত হই, যাহা দ্বারা তাহারা দেখেন, আমি তাঁহাদের পদযুগলে পরিণত হই, যাহা দ্বারা তাহারা চলাফেরা করেন এবং তাহারা যাহা চান, তাহাই আমি তাহাদের দান করি”। অর্থাৎ সসীম দেহের কারনে দেহাবিষ্ট অবস্থায় তথা ফানা ফিল্লাহ্ স্তরে অলি- গাউসগনের ক্ষমতায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকিলেও দেহান্তরিত হইয়া বাক্কা বিল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর অসীম সত্ত্বায় স্থিতি লাভ করিবার পর তাহারা অসীম ক্ষমতার অধিকারী হন, পরিণত হন তাহারা “আল্লাহর গুনে গুনান্বিত হও” (আল-কোরআন) এই নির্দ্দেশ মোতাবেক অসীম আল্লাহর পরিপূর্ণ রূপকে এবং লাভ করেন ভক্তের বাসনা-কামনা পূরণ করার সীমাহীন ক্ষমতা। এই অসীমত্ব প্রাপ্তির ফলে অসীমের সর্বময় ক্ষমতাসহ অলি-গাউসগণ সর্বত্র বিরাজমান থাকিলেও তাঁহাদের স্বরণে অনুষ্ঠিত উরস  মাহ্ফিলে অধিকতর সক্রিয় ভাবে নূরী সত্তায় হাজির থাকেন এবং আশিক ভক্ত বৃন্দ স্ব স্ব ভক্তি উৎসর্গ ও চৈতন্য অনুযায়ী তাহাদের ফয়েজ লাভ করিয়া সমৃদ্ধ হয়, লাভ করিয়া থাকে দোজহানের কল্যাণ ও মুক্তি অযাচিত ভাবে। এই কারণে প্রতি বৎসর অনুষ্ঠিত হয় মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফে পবিত্র উরস মাহ্ফিল। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) এর সময় হইতে মিলিত হন  আশিক্কীনে আউলিয়া বৃন্দ অসীম দৈব ক্ষমতার অধিকারী আধ্যাত্ম জগতের অন্যতম মহা সম্রাট রাসূলেনোমা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) এর নূরী সংস্পর্শে আত্মশুদ্ধি আত্ম চেতনা ও সামগ্রিক কল্যাণ লাভের আশায়।

আশিক্কীন এবং ভক্তবৃন্দের আধ্যাত্ম নেশায় ক্রমবর্দ্ধমান তাগিদেই সুরেশ্বর দরবারের উরস মাহ্ফিল তিন দিনের স্থলে বর্তমানে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। এই উরস মাহ্ফিলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে তো বটেই পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি এলাকা হইতেও আশিক্কীন ও ভক্তবৃন্দ যোগদান করেন এবং লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। বর্তমানে সুরেশ্বর দরবার শরীফ ভক্ত ও আশিকদের পবিত্র তীর্থ ভূমি-বাংলার আজমীর শরীফে পরিণত হইয়াছে। লক্ষ লক্ষ লোক, তবে শৃংখলা অটুট। নিয়ন্ত্রনের জন্য কোন বল প্রয়োগ নাই এবং নাই কোন ভলন্টিয়ার। সকলই স্বনিয়ন্ত্রিত। কোন জাগতিক অনুষ্ঠানে এত লোক সমাগম হইলে বহু ভলন্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন হইত শৃংখলা রক্ষার জন্য এবং প্রয়োজন হইত কত আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু এইখানে ইহাদের প্রয়োজন হয় না। ইহাতেই প্রমাণ হয় যে, সুরেশ্বর দরবার শরীফের পবিত্র উরস মাহ্ফিল প্রকৃতই একটি আধ্যাত্মিক ধর্মীয় মাহ্ফিল স্বয়ং রাসূলেনোমা হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা (রাঃ) এবং হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) এর রূহানী শক্তির প্রভাবে সমবেত ভক্তমন্ডলী ইশকে নূরীতে লিপ্ত ও স্বআরোপিত শৃংখলায় থাকিয়া পবিত্র উরস এর ফয়েজ লাভ করেন এবং উক্ত মাহ্ফিলে কোন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। ইহা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পবিত্র সুরেশ্বর দরবার শরীফ মারেফতের এক মহা র্তীথ ভূমি এবং নূরেহক্ব এর অসীম সরোবর। সুরেশ্বরে  উরস মাহ্ফিলে আগত ভক্তদের কান্না ও আহা জানি যাহারা অন্তত দূর হইতে শুনিয়াছেন তাহারা অবশ্যই ইহা বিশ্বাস না করিয়া পারিবেন না।

বলা বাহুল্য যে, আল কোরআনে বান্দাদেরকে নিজেদের মুক্তির জন্য কান্না কাটি করিতে বলা হইয়াছে। কান্না না আসিলে, বলিয়াছে কান্নার ভাব করিতে। কান্না ইশ্ক্ ও প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহর আশিক যখন কাঁদেন, আল্লাহ্ তাহাতে খুশী হন। আসলে কান্না আশিক-মা’শুকের মধ্যাকর্ষন শক্তি।

তবে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) এর রওজা মোবারকের আশে পাশে অর্থাৎ মহান সুরেশ্বর দরবারের আঙ্গিনায় পবিত্র উরস মাহ্ফিলের সময় যেইভাবে কান্নার রোল সৃষ্টি হয়, মর্ম বেদনার যেই আর্তচিৎকার শুন যায়, আশিক মনে আনন্দ বেদনা মিশ্রিত আধ্যাত্মিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাহা আশিক কেবল নিজে নিজেই অনুভব করিতে পারেন, অন্যকে বুঝাইয়া বলা যায় না।

কিন্তু কেন এমন হয়? পবিত্র উরস উপলক্ষে সমবেত মানুষ গুলি বেশ-ভুষায় আকর্ষনীয় বটে। ধর্মজীবি বা ধর্মের ধারক-বাহক কেতাবী আলেমদের দৃষ্টিতে তাহারা ধার্মিকও নয়। তাহা সত্ত্বেও কোরআনের কান্নার নির্দেশের মধ্যে লুপ্ত আল্লাহর ইচ্ছা ও বাসনা-কামনাটি তাঁহাদের মধ্যে কোন পার্থিব কারণ ছাড়া, কেন এমন গভীর ও মর্মভেদীরূপে প্রতিফলিত হইতেছে। ইহার রহস্য কোথায়? এমনিতে কি এমন করিয়া কাঁদা সম্ভব বা সহজ হইত তাহা হইলে এত প্র্যাক্টিস করার পরও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কৃত্রিম অশ্রুপাত ঘটাইবার প্রয়োজন হইত না। ধর্মের তথাকথিত ধারক-বাহকরা কতজন এইভাবে বিনা কারণে কাঁদিতে পারেন?

আসলে এই কান্নার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নাই। ইহাতে ইচ্ছাশক্তির কোন দখল নাই। মনের অজান্তেই তাহারা কাঁদেন। না কাঁদিয়া পারেনা বলিয়াই তাঁহারা কাঁদেন। পাঠক যদি পবিত্র উরস উপলক্ষে মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফে আসেন, দিনে রাতে সর্বদাই মরমীকান্নার আর্তচিৎকার শুনিতে পাইবেন। শুনিলে এবং দেখিলে আপনি নিজেই অনুভব করিবেন, তাঁহারা কেহই কাঁদিতেছেন না; কে যেন তাহাদেরকে কাঁদাইতেছে, বিদ্যুতের মত কোথা হইতে যেন কান্না সরবরাহ হইতেছে অথবা কোথা হইতে যেন অশ্রুর প্রস্রবন নামিয়াছে যাহার উৎস, যাহারা কাঁদিতেছেন, তাহাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাহিরে।

কোরআনে আল্লাহ্কে “নূর” বলা হইয়াছে। আল্লাহর এই নূর আকাশ ও পৃথিবী তথা সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির সহিত বিমুর্তবস্থায় সম্পৃক্ত। সৃষ্টির সেরা মানুষ এই নূরের প্রধান আধার এবং ক্বলব বা অন্তর উহার কেন্দ্র। অন্তরে আল্লাহ্ প্রেম বা ইশ্ক রূপ জ্বলানী সংযোগ হওয়ার সাথে সাথে সেই নূর বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অন্তরে নূর জমা হইতে হইতে অন্ত যখন নূরময় হইয়া যায় তখন হইতে শুরু হয় ফানা ফিল্লাহ্ অর্থাৎ অধ্যাত্মজগতে প্রবেশের যাত্রা। আর যখন এই অন্তরাত্ম নূরময় হইতে হইতে আরো নূররূপে বিকশিত হইয়া আল্লাহ্ তথা অসীম নূরের সহিত একীভুত হইয়া বাকা বিল্লাহ্ তথা অসীমের সহিত একাকার হইয়া যায় তখনই সেই অন্তরাত্মা হইতে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অনিচ্ছাকৃত আওয়াজ বাহির হয় ‘আনা আল্ হক্ব’ অর্থাৎ আমি সত্য-পরম সত্য আমিই। নূর নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) যখন বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে দেখিয়াছে সে আল্লাহ্কেই দেখিয়াছে, যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে সে যেন আল্লাহ্কে ভালবাসিল, যে আমার অনুসরন করিল সে যেন আল্লাহরই অনুসরন করিল”। উহার অর্থ ইহা ছাড়া আর কি হইতে পারে। অনুরূপ আল্লাহর বান্দা এবং রাসূলের উম্মৎ যিনি বা যাহারা অনুরূপ নূরীস্তরে আরোহন করিতে পারিয়াছেন তাঁহারাই আল্লাহর অলি, অভিভাবক এবং হিসাবে পরিচিত। এই সব মহাত্মাদের অন্তর্ধ্যান হয়, কিন্তু নূরীরূপে আল্লাহ্তে মিলিয়া মিশিয়া অসীমের সমস্ত গুনাবলীতে গুনান্বিত হইয়া সর্বত্র বিরাজ করিতে থাকেন। তাঁহাদের আশিক মাত্রই আল্লাহ্র আশিক।

আশিক যদি নূরময় অন্তরের অধিকারী হন এবং তাহার অন্তচক্ষু যদি যথা প্রয়োজন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হয় তাহা হইলে তিনি তাহাকে সর্বত্র অবলোকন করেন, কখনো পাওয়ার আনন্দে আবার কখনো পাইয়া হারানোর বেদনায় আর কখনো না পাওয়ার দুঃখে তিনি কাঁদেন। কিন্তু যাহাদের অন্তরে এখনো নূর সক্রিয় নয় বা অনন্ত অসীম নূরের সহিত সংযুক্ত হইতে পারে, অর্থাৎ এখনো ফানা ফিল্লাহর স্তরে পৌঁছায় নাই, ইশ্করূপ জ্বালানীর ফলে কেবল মাত্র মিলনের নেশায় মজনু, তাহারাও মা’শুকের বিচ্ছেদ জ্বালায় দগ্ধিভূত হইয়া অঝোর ধারায় কাঁদেন। এইরূপ অবস্থায় মনকে একাগ্র করার জন্য তাঁহার সামনে কোন একটি মূর্ত উপলক্ষ্য থাকিলে ভাল হয়। যেমন সদা সর্বত্র বিরাজমান বিমূর্ত আল্লাহ্কে ধ্যান করার জন্য পবিত্র কা’বাকে উপলক্ষ্য করিতে বলা হইয়াছে। তেমনি আল্লাহর অলীদের মাজার বা রওজা মোবারকও আশিককে মনের একাগ্রতা আনয়নে সাহায্য করে। এই কারণেই যাহারা ভক্তি সহকারে অলিদের পবিত্র রওজা যিয়ারতে আসেন অতি সহজেই তাহাদের অন্তর অলিদের ফয়েজে বিদ্যুতের মত তড়িতাহত হয় এবং তাহারা আর্তচিৎকারে ফাটিয়া পড়েন। এই আর্তচিৎকারে যে কি অপার আনন্দ তাহা একমাত্র, ভূক্তভোগীই অনুভব করিতে পারেন। এই অপার্থিব আনন্দের টানেই ভক্তবৃন্দ ‘মন চলেছে সুরেশ্বর, কিসের সাধের বাড়ি ঘর’ গাহিতে গাহিতে প্রতি বৎসর উরস মাহ্ফিলে যোগদান করে। সমাবেশ ঘটে কয়েক লক্ষ ভক্ত ও মুরিদের মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফের সুবিশাল পরিসরে। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) তাঁহার মুর্শিদ ক্বিবলা গাউসে জামান কোত্বোল এরশাদ্ রাসূলেনোমা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) এর আদেশক্রমে আপন নিবাস সুরেশ্বরে পবিত্র উরস মাহ্ফিল অনুষ্ঠানের নিয়ম প্রবর্তন করেন। প্রথম প্রথম ২০শে মাঘ উরস মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হইত। কালক্রমে তাহা ১৯, ২০ এবং ২১ শে মাঘ ব্যাপী অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ভক্তবৃন্দের আগ্রহ এবং দূরদূরান্ত হইতে আগতদের ভিড়ের কারণে বর্তমানে তাহা ১৬-২২ মাঘ পর্যন্ত এক সপ্তাহ চলে। ত্বরিকতের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে উরস মাহ্ফিলের মূল কার্যক্রম উক্ত তিন দিন ব্যাপীয়া অনুষ্ঠিত হয়।

সে যাহাই হউক উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উরস মাহ্ফিলের কার্যক্রম কয়েকটি পর্বে বিভক্ত। নিম্নে ক্রমানুসারে পর্বগুলির আলোচনা করা হইলঃ-

‘উরস’ উপলক্ষে রওজা মোবারক গোসল দেওয়া হয়। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার আওলাদগণের সহিত ভক্তবৃন্দও এই পবিত্র পূণ্য কাজে অংশ গ্রহণ করিয়া থাকে। গোসল দেওয়ার পরে রওজা মোবারকে নতুন গিলাফ পরানো হয়। পরানো হয় বহু মূল্যবান কাপড়ের গিলাফের উপর ফুলর চাদর।

উল্লেখ্য যে, সুরেশ্বর উরসে ফয়েজ লাভের সর্বপ্রধান উৎস এবং ভক্তদের পরম ও চরম আকর্ষণ গায়েবি আষা মোবারক। জানা যায় যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা (রাঃ) আপন মুর্শিদ ক্বিবলা রাসূলেনোমা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রাঃ) এর রওজা মোবারক হইতে এই আষাগুলি প্রাপ্ত হন। ইহাদের মধ্যে একটি ‘আষা’ রৌপ্যনির্মিত ও স্বর্ণমুকুট শোভিত। আর চারটি তামার তৈরী।

উল্লেখ্য যে, রৌপ্যনির্মিত স্বর্ণমুকুট শোভিত সর্ব বৃহৎ আষাটি নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ফয়েজ ও রূহানিয়াত সম্পর্কযুক্ত আর অন্যান্য আষাগুলি যথাক্রমে হযরত মুসা কলিমুল্লাহ্ (আঃ), হযরত গাউছুল আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ), হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তি আজমিরী (রা), হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রাঃ) ও আরও অলী-আউলিয়াদের ফয়েজ এবং রূহানিয়াত সম্পর্কযুক্ত।

সপ্তাহব্যাপী পবিত্র উরসের প্রধান দিবস ১৯শে মাঘ মাগরিবের নামাজের পর এই মহা পবিত্র আষা মোবারক সুরক্ষিত স্থান হইতে জন সম্মুখে বাহির করা হয়। এই সময়ে ভক্তদের মধ্যে যেই হাল ও ওয়াজ্দ সৃষ্টি হয় তাহা নিজ চক্ষে না দেখিলে বুঝানো খুব দুঃসাধ্য। আষা দেখা মাত্র ভক্তদের হৃদয় ফাটা আকাশ ভেদী কান্না ও যিকিরে ভূবন বিদারী আর্তনাদ বহুদূর হইতেও শুনা যায় এবং ভাব ও গাম্ভীর হইয়া উঠে প্রকৃতি। বস্তুতঃ এই আষা মোবারক বাহির হওয়ার মধ্য দিয়াই উরসের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলার (রাঃ) সময় হইতেই এই নিয়ম চালু রহিয়াছে। হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা সময় তিনি নিজে প্রধান আষাটি বহন করিতেন। বাকী চারটি আষা তাঁহার চারজন খলিফা বহন করিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিতেন। সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বার বেছাল হক্ব লাভ করিবার পর তাঁহার যোগ্যতম উত্তরসূরী হযরত শাহ্ সূফী আব্দুল হাই ওরফে নূরী শাহ্ বাবা (রাঃ) প্রধান আষাটি বহন করিতেন। পরবর্তিতে প্রধান আষাটি সুরেশ্বর দরবার শরীফের মুতায়াল্লী কোত্বোল আকতাব, মুর্শিদ ক্বিবলা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ বাবা জালাল নূরী (রাঃ) বহন করিতেন। আর বাকী আষাগুলি হযরত সুরেশ্বরী বাবার অন্যান্য আওলাদদের আওতায় রহিয়াছে।

বলাবাহুল্য যে, আষা বাহির হইবার পর হইতে উরসের অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি তথা ওয়াজ-নসিহত, সামা বা মরমী গান ইত্যাদি যথারীতি চলিতে থাকে এবং ২১শে মাঘ ভোর বেলা হযরত গাউসুল আজমের ফাতেহার শিন্নি বিতরনের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে উরসের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত হয়। তবে, এর পরও দুই এক দিন ভক্তরা থাকেন এবং স্ব-স্ব চেতনা চৈতন্য ও প্রক্রিয়ায় ফয়েজ লাভের চেষ্টা করেন।

এই পবিত্র উরস উপলক্ষ্যে মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফের যোগদান কারীদের বসবাসের জন্য দরবার কর্তৃপক্ষে তরফ হইতে নির্মিত প্রচুর স্থায়ী ঘর বাড়িসহ ভক্ত গোষ্ঠির স্বনির্মিত বাড়িঘরছাড়াও নির্মিত হয় অসংখ্য অস্থায়ী আশ্রম ও তাবু। মা’শুকে মাহ্বুব, মাহ্বুবে আরিফীন ও মাকসুদে আশিক্কীন গাউসুল আজম হযরত বাবা জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ক্বিলা (রাঃ) ও তাঁহার মুর্শিদ ক্বিবলা রাসূলেনোমা বাবা হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলার নূরময় রওজা মোবারকের বিশাল চত্ত্বর সহ আশ-পাশের বিরাট এলাকায়। তাছাড়া, দরবার শরীফের আশে পাশে, পদ্মার পাড়ে পাড়ে অনেক দূর পর্যন্ত বাগানের ভিতরে বিরাটাকারের বৃক্ষাদির ছায়াতলে মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতকে উপেক্ষা করিয়া যাহারা যিকির-আযকারে মত্ত্ব, নূরেহক্ব এর সাধনায় লিপ্ত এবং নূরী আকর্ষনে বিভোর, তাঁহাদের অবস্থা দেখিলে কেহই অভিভূত না হইয়া পারেন না। উল্লেখ্য যে, মাঘ মাসের উরস উপলক্ষে সুরেশ্বর দরবার এলাকার বাহির সংলগ্ন মাঠ জুড়িয়া স্বতঃস্ফর্তভাবে মেলা ও মিনা বাজার গড়িয়া উঠে। বর্তমানে দরবারের গদিনশীন প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভক্ত ও মুরিদদের জন্য স্ব-স্ব নোঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছেন। ইহা ছাড়াও অস্থায়ী ভাবে নির্মিত হয় প্রচুর সংখ্যক হোটেল, রেস্তোরা, মিষ্টির দোকান এবং নানাবিধ হস্থশিল্পের এবং কারুশিল্পের মনোরম প্রদশনী। ফলে, দরবারে আগতদের মধ্যে কাহারো দরবারের সরবরাহের বাহিরেও যদি খানাপিনার আগ্রহ হয়, তাহা হইলেও তাহা পাইতে তাহাদের কোনই অসুবিধা হয় না।

উল্লেখ্য, প্রথমে মাঘ মাসের উরসে সবরকমের খাবারই চালু ছিল। পরবর্তীতে হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ৫ই পৌষ হইতে ২২শে মাঘ পর্যন্ত সবধরনের প্রাণী জবাই করা দরবার শরীফের সীমানায় কঠোরভাবে নিষেধ করিয়া যান। সেই হইতে মাঘ মাসের পবিত্র উরসে নিরামিষ শিন্নির আয়োজন করা হয়। তবে অন্যান্য উরসে কোন বাধ্যবাধকতা নাই।

মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফে প্রতি বৎসর যে সকল পবিত্র উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়।

(লোকনাথ পঞ্জিকা মতে বাংলা মাসের হিসাব করা হয়েছে)

১)বাবা জালাল নূরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত দরবেশী সম্মেলন। ১৮, ১৯ ও ২০ জৈষ্ঠ্য

২)বাবা শাহ্ নূরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর পবিত্র ওফাৎ দিবস।৪ঠা ও ৫ই ভাদ্র

৩)বাবা জালাল নূরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর পবিত্র জন্মদিন। ৭ ও ৮ই কার্তিক

৪)বাবা সুরেশ্বরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর মহা পবিত্র জন্ম ও ওফাৎ একই দিন।১লা, ২রা ও ৩রা অগ্রহায়ণ

৫)পবিত্র নিশান মোবারক উত্তোলন। ৫ই মাঘ

৬)বাবা সুরেশ্বরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত বাৎসরিক উরস শরীফ।১৮, ১৯ ও ২০শে মাঘ

৭)বাবা জালাল নূরী ক্বেবলা কা’বা (রঃ) এর পবিত্র ওফাৎ দিবস।২৪ ও ২৫শে ফাল্গুন

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...