Sunday, September 28, 2025

মাতলাউল-ঊলূম

 

সূচি
আল্লাহ্ অলীদের আনুগত্য করা ফরয ২৩৫
আলমের বিবরণ ২৩৮
জগতের রূপ ২৩৮
মূল নাম ও তার সংক্ষিপ্ততার বর্ণনা ২৪০
কোরানের সংক্ষিপ্ত রূপ ২৪২
বিস্মিল্লাহ্র ছীন লম্বা হওয়ার কারণ ২৪৩
স্বপ্ন দেখার কারণ ২৪৪
মুর্শিদের দৃষ্টি ২৪৭
শরিয়ত ও ত্বরিকত এর পার্থক্য ২৫১
দ্বীনের আলোর বিবরণ ২৫৪
রাজত্ব পতনের বিবরণ ২৫৬
সম্মানের বিবরণ ২৫৯
ঈমানের বিশ্লেষণ ২৬১
কবর জিয়ারত প্রসঙ্গ ২৬৪
ইবাদতের তাগিদ ও গুরুত্ব ২৭০
ইয়াকিন বা বিশ্বাসের বিভাগ ২৭১
শরিয়তের নিক্তি ২৭৩
ধর্মের প্রহরী ২৭৪
উৎসাদির মূল উৎসের বর্ণনা ২৭৭
ফযীলতের বর্ণনা ২৮০
একাত্মতার বর্ণনা ২৮৩
বাতেনী কথা ২৮৪
তাসাব্বুর অর্থ এবং এর প্রকারভেদ ২৮৫
হাক্বিকত প্রমাণিত হওয়ার বর্ণনা ২৮৬
অজ্দ্ এর পরীক্ষা ২৮৯
নামাজের বিবরণ ২৯০
সাহায্যের বর্ণনা ২৯২
বিবাহের স্থায়িত্ব ২৯৪
স্থায়ী বৈশিষ্ট্য ২৯৫
নিশ্চিত জ্ঞানের বিবরণ ২৯৭
জ্ঞানের প্রকাশ ২৯৯
সিজ্দার আলোচনা ৩০১
পর্দার আলোচনা ৩০৯
ধর্মের শাখা-প্রশাখা ৩২৪
শরিয়তের ব্যাখ্যা ৩২৭
মধ্যবর্তী নামাজের বিবরণ ৩৩২
আত্মীয়তার বিবরণ ৩৩৬
জুময়ার বর্ণনা ৩৩৯
প্রেমের প্রকৃতি ৩৪২
ফায়েজ গ্রহণ ৩৪৯
ফায়েজের বৈশিষ্ট্য ৩৫১
শিক্ষা দানের অনুমতি ৩৫২
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহ্ অলীদের আনুগত্য করা ফরয
আল্লাহ্ তা’য়ালার বাণীÑواصبو نفسك مع الذين يدعون ربهم بالفد وات والعشئ الخ ا (ওয়ার্ছ্বি নাফ্সাকা মাআল্লাযীনা ইয়াদ্উ’না রাব্বাহুম বিল্গুদুওয়্যাতি ওয়াল আ’শিয়্যে) অর্থাৎ, যারা সকাল সন্ধ্যায় আপন প্রভুকে ডাকেÑ আপন মনপ্রাণ তাঁদের সাথে ঠেকিয়ে রাখ। অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্্কে স্মরণ করেন তাঁদের আজ্ঞা পালন কর এবং তাঁদের অনুগত হয়ে যাও। কারণ ফকির ও অলীদের আনুগত্য করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্্ ও রাসূলের আনুগত্য করারই নামান্তর। এ কারণে হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑ تخلقوا باخلاق الله (তাখাল্লাকু বিআখ্লাকিল্লাহ্) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্র চরিত্রে চরিত্রবান হও।” অলী-নবীদের চরিত্রও তাই। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহ্্র চরিত্রগুণ বিদ্যমান, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। আর এটা অলঙ্ঘনীয় ওয়াজিব। এটা ফরজের স্থলে শর্তসাপেক্ষ ওয়াজিব নয় যে, শর্ত অপসারিত হলে ওয়াজিবও অপসারিত হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ যাকাত প্রদান ওয়াজিব, কিন্তু যাকাত আদায় করার পর তা আর ওয়াজিব থাকে না। অপরদিকে অলীদের আনুগত্য করা মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয় ওয়াজিব, ফরজের চেয়েও অধিক গুরুত্ববহ। কারণ এরূপ স্থায়ী ওয়াজিব থেকেই ফরয ও অন্যান্য হুকুম-আহ্কাম বের হয়। কারণ সার্বক্ষণিক ওয়াজিব কখনো অপসারিত হয় না। যেমন আল্লাহ্্-রাসূল এবং অলীদের প্রতি বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব, আর কিয়ামত পর্যন্তই এটা ওয়াজিব। এমনিভাবে প্রমাণিত মৌলিক ওয়াজিবসমূহ পালন করাও সার্বক্ষণিক ওয়াজিব।
মোটকথা, ফকির-অলীদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। তাঁদের কোনো কাজ শরিয়ত বিরোধী মনে হলেও তা কেবল বাহ্যিক, কিন্তু অন্তর্নিহিত শরিয়ত বা আল্লাহ্্ তা’য়ালার বিরোধী নয়। আহলে জাহেরগণ বাহ্যিক শরিয়তের ওপর নির্ভরশীল। অথচ দৃশ্যত যা বৈধ ও ভালো মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা বিপরীতও হয়। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত এবং মণি প্রভৃতি বাহ্যতঃ অপবিত্র। কিন্তু অন্তঃসারের বিচারে পবিত্র। কারণ উহা দ্বারা পবিত্র মানুষ সৃষ্টি হয়। অনুরূপ যে কোনো অবস্থাতেই স্ত্রী সঙ্গম বৈধ এবং কারও কাছে বললে গালির মতো শোনায়। আল্লাহ্ অলীদের কাজকেও এভাবেই বিচার করতে হবে।
হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করুন। সংক্ষেপে তা হল এই যে, হযরত খিজির (আঃ) সতর্কতামূলকভাবে হযরত মূসা (আঃ)-কে অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছিলেন যে, আমার কোনো কাজে আপনি আপত্তি করবেন না। যদি করেন তাহলে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ইনশা আল্লাহ্্ আমি অবশ্যই এ কথায় বহাল থাকব। অতঃপর হযরত খিজির (আঃ) নদীর তীরে গেলেন। সেখান থেকে মালিকের অনুমতি ছাড়াই একটি নৌকা নিয়ে নদী পার হলেন এবং পরে স্বীয় লাঠির আঘাতে নৌকাটি ভেঙে নদীতে ডুবিয়ে দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) দেখলেন এটা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী কাজ। কারণ মালিকের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নেওয়া অবৈধ। তদুপরি উহা ভেঙে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনায় তিন চারটি নিষিদ্ধ কর্ম বা হারাম কাজ হল, তাই হযরত মূসা (আঃ) আপত্তি উত্থাপন করলেন যে, আপনি এসব শরিয়তবিরোধী কাজ করেছেন। তখন হযরত খিজির (আঃ) বললেন, আমার কাছ থেকে আপনি এখনি বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) বিনীতভাবে অপরাধ ক্ষমা চাইলেন এবং কথা দিলেন, আর এমন হবে না। অতঃপর সেখান থেকে এগিয়ে পথে একটি ছেলেকে স্বীয় লাঠির আঘাতে খিজির (আঃ) মেরে ফেললেন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও এতে আপত্তি করেন। নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) রেগে গিয়ে বললেন, আপনি আমার থেকে বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে একটি ভাঙা দেয়াল পেয়ে দিনব্যাপী মেরামত করে দিলেন। এ কাজ কেউ তাঁকে করতেও বলেনি বা এজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিকও পাননি। একান্ত স্বেচ্ছায় কাজটি করেছেন। মূসা (আঃ) আবার প্রতিবাদ করলেন, নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে আলাদা হতে বললেন, এবার আপনার বিদায়ের পালা। কারণ আমার কাজ আপনার অপছন্দ এবং আপনি গোপন জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নবীর ধৈর্যও নেই। তখন হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেন, আপনি নৌকা ভাঙলেন, এর রহস্য কী? উত্তর দিলেন, জনৈক জালিম বাদশা আসছিল, সে নৌকার মাঝি-মাল্লা সকলকে ধরে নিয়ে যেত। তাই এটাকে ডুবিয়ে দিয়েছি যেন বেচারার নৌকা নিজেই পেয়ে যায় এবং এ নৌকা দ্বারা ঐ গরিবরা তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে। নাবালকটাকে হত্যা করার রহস্য হল ছেলেটা ডাকাত হত, তার পিতা-মাতাকে কষ্ট দিত এবং আল্লাহ্্ অবাধ্য হত। এজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। অতঃপর তার আর একটি ভগ্নি জন্মগ্রহণ করবে এবং তার আওলাদদের মধ্যে সত্তর জন নবী জন্ম নিবেন। আর দেয়াল মেরামতের মাধ্যমে আমি জনৈক অনাথকে সাহায্য করেছি। এ দেয়ালের নিচে তার পিতার অনেক সম্পদ লুকায়িত আছে। এ দেয়ালটি পড়ে গেলে সে সম্পদ অন্যে নিয়ে যেত। আক্ষেপ এ সব বিষয়ে আপনি মোটেই অবহিত নন এবং আপনার কোনো অদৃশ্য জ্ঞানও নেই। আপনি যদি আমার কাজে আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহলে অনুরূপ হাজারও বিষয়ে আপনাকে শিক্ষা দিতাম। এখানে চিন্তার বিষয় এই যে, হযরত মূসা (আঃ) নবী হয়েও নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্্ তা’য়ালা গোপন জ্ঞান শিক্ষার জন্য নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি বাহ্যিক শরিয়তের অনুসরণ করেন এবং নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর কার্যাদি খারাপ ও দোষণীয় মনে করেন। তিনি এটা চিন্তাই করেননি যে, যেহেতু আল্লাহ্্ আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন, সেহেতু তাঁর তাক্লীদ বা অনুসরণ করা আমার কর্তব্য এবং তাঁর সাথে বিরোধ করা অনুচিত। এজন্যই ফকির এবং অলীদের কোনো কাজ শরিয়তের ঘোর বিরোধী মনে হলেও, তাঁদের আনুগত্য করতে হবে। কারণ অলীদের হাত আল্লাহ্্র হাতে স্থাপিত। আল্লাহ্্ যা করান তা-ই তাঁরা করেন, যদিও দৃশ্যত তা আপত্তিকর মনে হয়। যেমন কোনো অলী দেখলেন যে কোনো ব্যক্তির ওপর অদৃশ্য বিপদ আসছে, তখন তিনি তার কিছু মালামাল তার অনুমতি ছাড়াই সরিয়ে নিলেন এবং যতদিন না তার বিপদ কেটে যায়, ততদিন তা নিজের কাছে রেখে দিলেন। এটা চুরি হবে না, বরং এটা হবে মালের মালিকের প্রতি দয়া প্রদর্শন। কারণ সে সময় সে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তার মালের কিছু অংশ অলী নেওয়ার বদৌলতে আল্লাহ্্ তা নিরাপদে রেখেছেন। এভাবে আল্লাহ্্র অনেক অলী সময় সময় দৃশ্যত শরিয়তবিরোধী বহু অপ্রয়োজনীয় কাজও করে থাকেন। কখনো লোকদের গালি দেন। এ গালিরও অর্থ আছে। সময় বিশেষে কাউকে লক্ষ করে গালি দিলেও আসলে বিপদ-আপদকেই গালি দেওয়া হয়। উদ্দেশ, যাতে তার বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়। লক্ষণীয়, যে ভালো করতে চাচ্ছে, আমরা তাঁর দুর্নাম করছি। হযরত খিজির (আঃ) নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন, নৌকার মালিক দেখলে অবশ্যই তাঁকে চোর মনে করত। অনুরূপভাবে কোনো কোনো ফকির পতিতার ঘরে যাতায়াত করেন. কখনো কখনো মন্দিরেও যান। এতেও রহস্য আছে। এতে চতুর্দিকে প্রসারিত মূর্তির প্রভাব দমন হচ্ছে, অথবা অন্য রহস্যও আছে। আল্লাহ্্র কোনো কোনো অলী নেংটি পরিধান করেন, এরও তাৎপর্য আছে। বিশেষত এর দ্বারা তাঁরা নিজের নফ্সকে লাঞ্ছিত করেন এবং এ লাঞ্ছনার বিনিময়ে অজস্র রহমত ও নেয়ামত লাভ হয়। স্মরণীয় যে, নেংটি পরিধান করা তথা গুপ্তাঙ্গ ঢাকা মালিকী মাজহাবে ফরজ। অথচ অলীদের মাজহাবে তো ফরজই নেই। কারণ তাওহীদপন্থী যখন তাওহীদের সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকেন, তখন বাহ্যিক শরিয়তের কোনো তোয়াক্কা থাকে না। ‘আওয়ারিফ’ এবং ‘ফচুছ্’ প্রভৃতি তাসাউফের কিতাব দ্রষ্টব্য। তবে আল্লাহ্্র অলীগণ সব সময়ই মঙ্গল করে থাকেন। তাঁরা যেখানে থাকেন সেখানে আল্লাহ্্র রহমত অবতীর্ণ হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহ্্র অলীগণ পানাহার ও কথা বলার সময় রহমত নাযিল হয়। অতএব তাঁদের সব কথাই রহমত মিশ্রিত। তাঁরা যদি কাউকে মারেনও তাও রহমত।
অলী দু প্রকারÑ মুতাসাওফিয়া এবং মালামাতিয়া। মুতাসাওফিয়াগণ কদাচিৎ ছাড়া কখনো বাহ্যিক শরিয়তের খেলাফ কিছু করেন না। কিন্তু মালামাতিয়াগণ দৃশ্যত শরিয়তের খেলাফ করেন। যেমনÑ নেংটি পরা অথবা উলঙ্গ থাকা ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ গাউস-কুতুব-আবদাল এবং উত্তম ব্যক্তিত্ব এদের থেকেই আবির্ভূত হন এবং এরাই পৃথিবীর হিতাকাক্সক্ষী।

আলমের বিবরণ
আলম একটি সুমহান স্থান। যাকে আলম-এ-মুতলাক বলা হয়। কোনো কোনো হিসেবে আলম দু’ভাগে বিভক্ত। যেমনÑ আলম-এ-আমর এবং আলম-এ-খাল্ক। আবার কোনো হিসেবে আলম চার ভাগে বিভক্ত। যেমনÑ ১। নাসুত ২। মালাকুত ৩। যাবারুত ৪। লাহুত। অন্য হিসেবে আলম সাতটিÑ ৫। হাহুত ৬। ইয়াহুত ৭। বাহুত। আর কোনো হিসেবে নয়টিÑ ৮। আহুত এবং ৯। হামিদা। আবার কোনো হিসেবে আঠারোটি। মোটকথা আলম-এ-মুতলাক-এর উৎসের প্রেক্ষিতে নামের পার্থক্য হয়েছে। অর্থাৎ আলম-এ-জাত অর্থাৎ আলম-এ-লাহুতের পরবর্তী স্তরসমূহ নিম্নক্রমে পরস্পর শাখা বিশেষ এবং উপরের আলম তথা হাকীকত-এ-জাত ঊর্ধ্বানুক্রমে একে অন্যের উৎস। কিন্তু এ জাতের শেষ নেই। এর পরিপূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ জাতে যা কিছু রয়েছে, তা জানা এবং দেখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যে নিজেকে জানতে পারে এবং দেখতে পায় তার পক্ষে সব কিছু জানা ও দেখা সম্ভব। কারণ সমগ্র বিশ্ব স্বীয় অজুদের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ অজুদ সমগ্র জগৎই অজুদ। আর জগতের মধ্যে অজুদই জগৎ। উদাহরণস্বরূপ প্রত্যেকটি স্ফুলিঙ্গে আগুন অšে¦ষণ করে, সে তো আগুনের সাথে স্ফুলিঙ্গ এবং স্ফুলিঙ্গের সাথে আগুনও পেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে অজুদ এবং জগৎ একটাই। অজুদের বিচারে জগৎও অজুদ। আর অজুদকে জগতের প্রেক্ষিতে বিচার করলে অজুদও জগৎ। এটা যে জানে না, এমন লোকদের নিকট এসব কথা বলা না বলা সমান।

জগতের রূপ
জগৎ একটি হেকমতময় বীজ। এর মধ্যে ফল, ফুল, বৃক্ষ, মগজ ও তৈল সবই বর্তমান এমনকি তা আঠারো হাজার সৃষ্টির জন্ম-পরিসর। যেমনÑ একটা খোসার মধ্যে শত শত দানা আছে এবং প্রত্যেকটি দানার জন্য পৃথক পৃথক স্থান নির্ধারিত রয়েছে, আবার সে সবগুলো দানা রয়েছে একটি মাত্র সাধারণ স্থানে। অতএব এরা সব মিলে এক আবার একই সব। মৌলিক এবং অমৌলিক, এ প্রেক্ষিতে একের বহু হওয়া এবং বহু-এর এক হওয়া, একে অন্যের পরিপূরক এবং দৃশ্য জগতের মূল হল, আলম-এ-জাত তথা লাহুত। আবার আলম-এ-লাহুত এর মূলকে বলা হয় আলম-এ-হাহুত। অনুরূপভাবে আলম-এ-সিফাত অর্থাৎ, আলম-এ-যাবারুত এবং মালাকুত প্রভৃতিও মূলের শাখা-প্রশাখা মাত্র। অতএব, যা কিছু জগৎ মাঝে বিদ্যমান, তা সবই মানুষের মধ্যে বর্তমান। এ জন্যই হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, “যে নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকেও চিনেছে।” কবর আযাব কথাটিরও এ একই অর্থ। অর্থাৎ কবরের বড় বড় সাপ বিচ্ছু প্রভৃতি সবই স্বীয় দেহের প্রজাতি। অর্থাৎ, স্বীয় দেহে বর্তমান বিষ থেকে বিভিন্ন ধরনের দংশনকারী জীব জন্মিবে এবং তাকে দংশন করবে। মানুষের পেটে যেভাবে কৃমি জন্মগ্রহণ করে, সেভাবে মৃত দেহে নিজে নিজেই অনেক ধরনের পোকার জন্ম হয়। শাস্তি ও শান্তি উভয়ই স্বীয় অজুদ অর্থাৎ সত্তা তথা রুহানী সত্তা জাত। এ সময় তাদের মধ্যে রুহ্ প্রবিষ্ট করানো হলে ঐসব পোকার কারণে তাদের কষ্ট হবে। এ পোকা, সাপ, বিচ্ছু যা কিছুই হবে তা সৃষ্টির বাইরে নয়। ভালো হোক আর মন্দ হোক বীজ এটাই। যেমন, মানুষ যখন শয়তানি করে, তখন তাকে শয়তান বলা হয়। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে শয়তানি এবং কুকুরের স্বভাব দেখা গেলেই তাকে শয়তান বা কুকুর ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ কারণে হাশরের দিন অনেক লোক বানর ও শূকর প্রভৃতির আকৃতিতে কবর থেকে উত্থিত হবে। এর অর্থ হল, বহু আকৃতি-প্রকৃতির বীজ মানুষের স্ব-স্ব অজুদে তথা সত্তায় বর্তমান। উদাহরণস্বরূপ মাটি থেকে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি এবং জঙ্গল প্রভৃতি জন্মলাভ করে। মাটির সাথে সকল জিনিস ও প্রজাতির বীজ হিক্মত তথা বিজ্ঞানসম্মতভাবে একসঙ্গে মিশিয়ে উহাকে আটার রুটির মতো তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে ভূমি সৃষ্টি করে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত উহাতে বৃষ্টিপাত করা হয়। অতঃপর কয়েক হাজার বছর ধরে উহাকে শুকানো হয়। এভাবে বার বার এরকম করা হয়, ফলে সব জিনিসের বীজ পরিপক্ব হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় এবং উহাতে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। পানি থেকে পর্যায়ক্রমে ভূমির উৎপত্তি হয়েছেÑ কথাটির অর্থ ভিন্ন। এ কারণেই ভূ-পৃষ্ঠে নানা রকম বৃক্ষাদি, পাথর, রকমারি উদ্ভিদ এবং নানা শ্রেণীর জীবজন্তু জন্মগ্রহণ করেছে। প্রত্যেকদিন আল্লাহ্্ তা’য়ালা এগুলোকে সৃষ্টি করছেন না। তবে আল্লাহ্্ তা’য়ালা কোনো প্রজাতি থেকেই দূরে নন বা বিচ্ছিন্ন নন। কেউ কেউ লিখেছেন যে, জ্ঞানের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্্ সকল বস্তুর সন্নিকটে। এর অর্থ হল, তিনি সত্তাগত জ্ঞানসূত্রে এসবের কাছাকাছি। কারণ সমস্ত বস্তুতেই অবশ্যম্ভাবীরূপে পরমসত্তা ব্যাপ্ত এবং এ সত্তার সাথে জ্ঞানও রয়েছে। এ বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তির কিছু লেখা না লেখা সমান।
সুতরাং ভূমিকে হেয় জ্ঞান করা কারও উচিত নয়। কারণ ভূমির উপাদান অনেক উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন এবং মৌলিক নূর ও সিজ্দার নূর দ্বারা ভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই গোটা ভূ-বিশ্বকেই আল্লাহ্্ মসজিদ আখ্যা দিয়েছেন। এখানে স্বর্ণ-রৌপ্য-নবী-অলী এবং বিভিন্ন রকমের মূল্যবান প্রস্তরাদি জন্মে। এসব বিষয়ে পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে মাটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু দু একটি কারণেই নয়Ñ সব দিক থেকেই মাটিকে আল্লাহ্্ পছন্দ করেছেন। পবিত্র জগতের সাথে মাটির কী সম্পর্কÑ এটা যারা বলেন, তারা যদি এখানে মাটি দ্বারা ধুলোবালি এবং আবর্জনা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে ঠিক আছে। অন্য কিছু বুঝিয়ে থাকলে তা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ্্ তা’য়ালা মাটি থেকেই তাঁর বন্ধুদের সৃষ্টি করেছেন এবং এতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পবিত্র নূর যুক্ত রয়েছে। এ মাটি সকল মাটির মানুষের কাছে মাতৃতুল্য পবিত্র। সুতরাং মাটিকে ভালোবাস এবং নিজেকে মাটির মতো করে গড়ে তোলো। তাহলে আল্লাহ্্ তোমাদের পছন্দ করবেন।

মূল নাম ও তার সংক্ষিপ্ততার বর্ণনা
যে নামের মধ্যে আল্লাহ্্ তা’য়ালার সমস্ত গুণাবলি এবং পূর্ণতা বিদ্যমান, তা আল্লাহ্্র সত্তাগত বা মূল নাম। যথা ‘আল্-ইলাহু’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ আল্লাহু। আল্লাহু-এর সংক্ষেপ হল ‘হু’। ‘হু’-এর সংক্ষেপ হল এর মর্মার্থ। মর্মার্থে কোনো শব্দ বা ধ্বনি নেই। কিন্তু হু-এর পেশ-এর স্থলে যের এবং যবরও ব্যবহৃত হয়। যেমনÑ হাঃ হিঃ হু। কোনো কোনো কিতাবে ‘আল্লাহু’ এর সংক্ষেপ ‘আহ্’ও করা হয়েছে। আল্লাহু শব্দের প্রথম অক্ষর ‘আলিফ’ এবং শেষ অক্ষর ‘হু’। এ উভয় অক্ষর মিলে যের, যবর ও পেশ সংযোজনে আহ্, ইহ্ এবং উহ্ গঠিত হয়। অনুরূপভাবে যে কোনো যিকিরের শব্দের সংক্ষেপায়নে কোনো দোষ নেই। যথাÑ ‘নামাযে বেলায়েত’-এ উল্লেখ আছে যে, ‘আল-ইলাহু’ সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘ইল্’ হয়েছে। অর্থাৎ হামজাতে যের আর লাম যযমের সাথে এসেছে। যিকির দ্বারা কখনো ‘ইল্’ এর হামজাকে হা-এ-হাউওয়াজ দ্বারা বদল করে হেল্ হেল্ শব্দে যিকির করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক ধ্বনির মধ্যে আল্লাহ্্র নাম পাওয়া যায়। কারণ, এমন কোনো ধ্বনি নেই, যার মধ্যে ‘হু’ এর লেশ নেই; বরং সব ধ্বনির শেষে ‘হু’-এর সংক্ষিপ্তরূপ অনিবার্য। অতএব, তাঁর নাম ব্যতীত কোনো শব্দ বা ধ্বনি নেই। এজন্যই আল্লাহ্্ বলেন, يسبح لله ما فى السموات وما فى آلارض (ইউছাব্বিহু লিল্লাহি মাফিস্ সামাওয়াতি ওয়া মা-ফিল্ আরদি) অর্থাৎ, “আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহ্্কে স্মরণ করছে।” এর দ্বারা সমস্ত সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা প্রত্যেক বস্তু এবং জীবের সাথেই মূল সত্তা সম্পৃক্ত। তাই রূপক নামের সাথে যিকির বৈধ এবং প্রচলিত আছে। যে কোনো আওয়াজের সাথেই আল্লাহ্্র নাম রয়েছে। শেখ সাদী (রাঃ) বলেন,
“বাজিকিরাশ হরচে বিনি দর খোরাশাস্ত
ওয়ালী দানাদ্ দর ইঁ মা’না কেহ্ গোশ আস্ত।”
অর্থাৎ, অন্তরে যা থাকে, আওয়াজে তা-ই আসে। এ অর্থের প্রতি কান রেখে ধ্যান করলে, সব আওয়াজেই আল্লাহ্্র নাম পাবে। আত্মিক শব্দে ‘হু’ ও আত্মিক-ই হবে। সব কথায় আল্লাহ্্র নাম থাকাটা একটা জ্ঞান রহস্য। অনুরূপভাবে সকল কাজেও রহস্য আছে। যেমনÑ চোরের চুরির মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্্র কাজই সম্পন্ন হয়। কিন্তু রূপক অর্থে অপরাধী হয় চোর। যেমনÑ দাবা খেলার সময় কোনো গুটির চাল যদি ভুল হয়, তখন সে গুটিটি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, যেন গুটিটিই অপরাধী। আল্লাহ্্র কোনো কাজই নিরর্থক নয়। এর রহস্যের প্রেক্ষিতে সব কাজই ভালো। কটূক্তি কখনো দোয়াতুল্য হয়। যেমন, আল্লাহ্্র অলীগণ কটূক্তির মাধ্যমে কোনো কোনো বিপদাপদ অপসারণ করে থাকেন। কোনো সময় চুরিও আশীর্বাদস্বরূপ হয়। সময় বিশেষে মাল চুরি হলে ভালো হয়। যেমনÑ হযরত খিজির (আঃ) নৌকা চুরি করাতে মালিকের উপকার হয়েছে। তবে মানুষের অপরাধী হওয়াটা ভাঙা অলংকার এবং অস্ত্রের মতো। খরিদ্দারের কাছে এগুলো ভালো নয়। কিন্তু স্বর্ণকার এবং কামারের কাছে এগুলো ঠিকই আছে। কারণ এর দ্বারা অন্য জিনিস তৈরি হবে। তেমনি মন্দ কথা এবং অশ্লীল শব্দেরও একই অবস্থা। কেউ যখন কাউকে কোনো অশ্লীল কথা বলে, তাতেও আল্লাহ্্র ইচ্ছাই কার্যকরী হয় এবং তারই নাম ও কাজ সম্পন্ন হয়। আল্লাহ্্ কোনো ব্যক্তির মুখ দিয়ে কোনো বিশেষ সময়ে, যে সমস্ত কথা বলাবার ইচ্ছা করেন, তখন সে সব কথার একটি জগৎ সৃষ্টি করা হয়। আর সে অনুযায়ী ব্যক্তির মুখ থেকে তা নিঃসৃত হয়। যেমনÑ তাবিজে লিখিত অক্ষরসমূহের মান অনুযায়ী এর চালে পার্থক্য হয়। অর্থাৎ ঘোড়া অথবা হাতির চালের ওপর সংখ্যা নির্ধারিত হলে তাবিজের নক্শা এবং রহস্য ধরা পড়বে। অনুরূপভাবে প্রত্যেক আওয়াজ, কাজ ও নামের ব্যবহারের প্রেক্ষিতে গুণাগুণে তারতম্য হয়। অর্থাৎ বিশ্বে অলী, আবদাল এবং ফেরেশতাগণ সক্রিয় না থাকলে কোনো বস্তুই বহাল থাকত না। এমনি করে চার পদার্থের সমন্বয়ের বদৌলতে পৃথিবীতে সমস্ত বস্তু বিদ্যমান থাকে। তাছাড়াও ভালোমন্দ না থাকলে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। যেমনÑ তারকারাজির প্রভাবে দুনিয়ার সকল বস্তুর মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, জহল এবং বাহরাম এ-দুটি তারকা সবচেয়ে মন্দ। এদের প্রভাব অত্যন্ত খারাপ। অপরদিকে শাম্স ও কামার সবচেয়ে উত্তম। এদের প্রভাব ভালো। অনুরূপভাবে অনুমেয়।
সময় সম্পর্কেও এ-একই কথা বলা চলে। সময়ে ভালোমন্দের প্রভাবে পৃথিবীতে রোগ-সুখ, ভালো-মন্দ এবং চোর-ডাকাত ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। তবে এর দ্বারা ভারসাম্যও রক্ষিত হয়। যেমনÑ অতিরিক্ত ঠান্ডায় কোনো জিনিস জমাট বেঁধে যায়, আবার অতিরিক্ত গরমে তা শুকিয়ে যায়। তাই ঠান্ডা ও গরমের মাঝামাঝি অবস্থাটি-ই ভারসাম্য। অর্থাৎ পরিমাণের চেয়ে অধিক ঠান্ডা হলে, তাতে কিছুটা উষ্ণতা আনয়ন করাও ভারসাম্য এবং এটা এক প্রকার যাতনা। অনুরূপভাবে গরমকে ঠান্ডায় পরিবর্তন করাটাও তার জন্য শাস্তিস্বরূপ। এটার নামই দোযখ্ এবং আযাব। এ কারণেই মানুষ এবং জ্বিনকে আগুনের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। কারণ তারা সাধারণত পানি, মাটি এবং বাতাসের প্রতি অনুরক্ত এবং বসবাসও করছে মাটির ওপর। এ কারণে আগুন দ্বারাই তাদের ভারসাম্য রক্ষা হবে। কিন্তু সাগরের দ্বারা তা হবে না। অর্থাৎ আগুনের মধ্যে যে সব পোকার সৃষ্টি হয়, তারা আগুনকে ভয় পায় না; বরং পানিতে তাদের ভারসাম্য এবং শাস্তি হবে। অনুরূপভাবে বৃষ্টির পানি সর্বদাই ভালো; কিন্তু পরিমাণের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাত বিপজ্জনক। অনুরূপভাবে রৌদ্র ইত্যাদিরও একই অবস্থা। এজন্যই হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑ الانسان مركب بالخطاء وانسيان (আল ইনসানু মুরাক্কাবুন বিল খাতায়ি ওয়ান নিস্ইয়ানি) অর্থাৎ, মানুষ ভুল-ভ্রান্তির সমন্বয়ে গঠিত তথা ভালোমন্দসহই মানুষের বুনিয়াদ। তবে ভালোর বিজয়ী থাকাটা উত্তম। সুতরাং কোনো ব্যক্তি ভালো করছে এবং মন্দ থেকে বিরত থাকছে এর অর্থ সে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে।

কোরানের সংক্ষিপ্ত রূপ
কোরান-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ এবং বিস্মিল্লাহ্র সংক্ষেপ হল ‘বে’। আর ‘বে’ অক্ষরটির সংক্ষেপ হল উহার নোক্তা বা বিন্দু এবং বিন্দুর সংক্ষেপ হল মর্মার্থ। ফচুছ কিতাবে তাই রয়েছে। অতএব যে নোক্তা বা বিন্দুর মর্মার্থের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত, তাঁর কাছে একটি নোক্তাই সম্পূর্ণ কোরান।

বিস্মিল্লাহ্র ছীন লম্বা হওয়ার কারণ
বস্মিল্লাহ্ মূলত বি-ইস্মিল্লাহ্ ছিল। এ-‘ইস্ম্’ এর আলিফই ‘তাওহীদ’। এর দ্বারা আল্লাহ্্র সম্পূর্ণ তাওহীদ তথা একত্ব প্রমাণিত হয়। শয়তান এটাকে চুরি করে সরিয়ে তদস্থলে বিস্মিল্লাহ্র ‘সীন’-টাকে লম্বা করে দিয়েছে। নবী করীম (সাঃ) যখন দেখলেন যে, শয়তান এটা করেছে, তখন এভাবেই রেখে দিলেন। উদ্দেশ মানুষ যেন সর্বদা শয়তানের চুরির কথা স্মরণ রাখে। ফচুছ প্রভৃতি গ্রন্থে এরূপই উল্লেখ রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা হচ্ছে, সে যুগে শয়তান তাওহীদের আলিফ চুরি করেছিল, আর বর্তমানে মানুষ মিথ্যার জোরে তাওহীদকেই চুরি করছে। অর্থাৎ, তাওহীদের আলোচনা দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ বাংলার কোনো কোনো এলাকায় তাওহীদের আলোচনা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত প্রায়। শয়তান তাওহীদের আলিফ চুরি করেছে আর কয়েকজন আদম সন্তান তাওহীদকে প্রায় ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা তাওহীদকে তর্কবিতর্ক এবং লড়াইয়ের ডান্ডা দ্বারা আঘাত করছে।
আফসোস! কোনো কিতাব পড়ে বা কিতাবের অর্থ শুনে তাওহীদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা কি সম্ভব? অবশ্যই না। কোনো কোনো লোক লিখেছে যে, সাধকের ধ্যান ‘আরশ’ পর্যন্ত পৌঁছাই যথেষ্ট। এটাই মোরাকা’বা এবং মোশাহেদা। আর দেশ ভ্রমণ অর্থও তাই। অর্থাৎ ধ্যানে ‘আরশে’ পৌঁছে গেলেই হল। দুঃখ হয়, এসব লোক যারা তাওহীদের বিন্দুমাত্রও জ্ঞান রাখে না, তারা পুস্তক পুস্তিকা লিখে বাঙালিদের কাছে সত্য পীর হয়ে গেল। এর কয়েকটি পুস্তিকার বিভিন্ন স্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্্র অলীদের কুৎসা করা হয়েছে এবং আলোচনা করা হয়েছে, কোন কোন দল ও সম্প্রদায় খারাপ এবং মন্দ। অলী-আল্লাহ্্দের অন্যের কুৎসা করা কী প্রয়োজন ছিল? তাওহীদ প্রসঙ্গে ইল্মে তাওহীদই আলোচ্য। অন্যের কুৎসা রটনা কি বাঞ্ছনীয়?
এটাকে বলা হয় ইল্মে হুজুরী বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং ইল্মে মোকাশিফা বা দিব্যজ্ঞান এবং ইল্মে রাজ বা গুপ্তজ্ঞান। এ জ্ঞান যার নেই এমন ব্যক্তি একত্ববাদীই নয়, আর হলেও তা রূপক। আর প্রকৃত বা আসলের মোকাবেলায় রূপক তুচ্ছ। রূপক হয়েও কেউ কেউ মাথা উঁচু করে চিৎকার করে বলছে, আমরাও একত্ববাদী, কৃতজ্ঞতা আল্লাহ্্র প্রতি যে, তিনি আমাদেরকেও তাওহীদবাদী করেছেন এবং ঈমান দিয়েছেন। সম্ভবত এ ধারণা থেকেই তারা বলে যে, সাধকের ধ্যান আরশ পর্যন্ত পৌঁছাই যথেষ্ট।

স্বপ্ন দেখার কারণ
স্বপ্নজগৎ একটি রূহানী পরিমন্ডল। মানুষ নিদ্রামগ্ন হলে তার রূহানী দৃষ্টি ও অনুভব ক্ষমতা প্রসারিত হয়। তখন মূল রহস্যের লক্ষণাদি তাঁর কাছে উদ্ভাসিত হয়। অর্থাৎ সর্বত্র বিরাজমান রূহানী সত্তা বিভিন্ন স্থানে স্বীয় অস্তিত্ব প্রদর্শন করে। এর অর্থ এই যে, আগুনের মতো রূহ্্ সর্বত্র বর্তমান। এ কারণেই হাজার হাজার লোক হাজার হাজার স্থানে একই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাথে স্বপ্নে সাক্ষাৎ করতে ও কথা বলতে পারেন, এতে কারও দ্বিমত নেই। রূহ্ সর্বত্র না থাকলে সব স্থানে কী করে একই মুহূর্তে দেখা সম্ভব হচ্ছে? রূহ্সমূহ এবং উহার উৎস যে সর্বত্র বিরাজমান ‘নূরে হাকীকত’ আলোচনা প্রসঙ্গে তা বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন-আপন হাকিকতসহ সর্বত্র বর্তমান এবং এক জায়গায় থেকে শত শত জায়গা স্বীয় আওতাধীনে পায়। অন্যথায় রূহ্সমূহের পক্ষে দৌড়িয়ে বিশ্ব ভ্রমণ কি সম্ভব? মোটেই না।
মোটকথা স্বপ্ন আপন নফ্সের একটি অবস্থা। সমগ্র জগতের সাথে তার সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই যে জগতের সাথে নফ্সের সম্পর্ক অধিক, স্বপ্নে তাই প্রতিভাত হয়। আলম-এ নাসুত তথা সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্কিত স্বপ্নকে দৈহিক স্বপ্ন বলা হয়। রূহ্ যখন স্বীয়দেহের নাছুতি অংশসহ সৃষ্টিজগতে ভ্রমণ করে, তখন সে অনেক অদ্ভুত এবং বিরল দৃশ্য দেখতে পায় ও দৃষ্টিগোচর হয় বহু রহস্য। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের কাছে এটা গোপন নয়। তবে সৃষ্টিজগৎ পর্দায় ঢাকা এবং অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এখানে শয়তানের প্রবঞ্চনার এবং প্ররোচনার আশংকা সদা বিদ্যমান। এ-স্থানটা ভালোমন্দে মিশে রয়েছে। এ কারণে আহলে নাছুতগণ সত্য মিথ্যায় মিলিত থাকেন। তাই এখানের স্বপ্নও ভালোমন্দ মিশ্রিত। সুতরাং স্বপ্নের উপলব্ধি সব সময় সঠিক হতে পারে না এবং এর ফলাফল বিপরীত হয়। কিন্তু অধ্যাত্মবাদীদের অবস্থা এর বিপরীত। তারা যে স্বপ্ন দেখেন তা সঠিক হয়। কখনো যদি বিপরীত হয়, তার কারণ এই যে, সে সময়ে তিনি জাগতিকতার পর্দায় আচ্ছাদিত ছিলেন। তবে অলী আল্লাহ্্গণ জাগতিকতার পর্দা থেকে মুক্ত। ঊর্ধ্বালোকে শয়তানের পক্ষে বাঁধার সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কারণ সেখানে শয়তানের প্রবেশাধিকার নেই। এ কারণেই উম্মতের আশ্রয় হযরত রাসূল (সাঃ) বলেন যে, সত্য স্বপ্ন নবুয়তের চল্লিশতম অংশ। কারণ সত্য স্বপ্ন পবিত্র জগতের অংশ বিশেষ। এটাকে নিদর্শন বিদ্যা ও অবস্থা শাস্ত্র বলা হয় এবং এটাই নবী অলীদের উত্তরাধিকার। তবে যিনি স্বপ্ন দেখেন এবং যাকে স্বপ্নে দেখেন তাদের নিজ নিজ অবস্থা বুঝে স্বপ্নের ব্যাখ্যা এবং অর্থ করতে হবে। ভালো জিনিস স্বপ্নে দেখার ব্যাখ্যাও ভালো। তবে বিচার্য যে, স্বপ্নদ্রষ্টা কোন স্তরের ভালো মানুষ এবং কোন ধরনের বস্তু নিয়ে কাজ-কারবার করেন। তাই স্বপ্নদ্রষ্টার সে-সময়কার গুণাগুণ এবং অবস্থার আলোকে সে-স্বপ্নের ব্যাখ্যা হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো পীর-অলী অথবা মুর্শেদকে স্বপ্নে দেখা ভালো এবং সন্তুষ্ট অবস্থায় দেখা আরও ভালো। কিন্তু অসন্তুষ্ট এবং বিরক্ত অবস্থায় দেখলে স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য কিছুটা ক্ষতিকর এবং হাত-পা পঙ্গু দেখাও অনুরূপ ক্ষতিকর। তবে এ ক্ষতি যাকে স্বপ্নে দেখা গেল তারও হতে পারে। কিন্তু এতে অস্পষ্টতা এবং রহস্যময়তা রয়েছে। তবে ক্ষতিটা স্বপ্নদ্রষ্টার হওয়ার আশংকাই অধিক। সুতরাং আপন মুর্শেদ এবং নবীদের বিকৃত চেহারা ও দুরবস্থায় দেখা স্বীয় অপরাধ। তাঁদেরকে সুন্দর চেহারায় এবং নূরুজ্জ্বলরূপে বা কোনো কারামতসহ দেখা উভয়ের অবস্থার উপর নির্ভর করে। স্বপ্নদ্রষ্টা যদি সে স্তরের হয়, তাহলে স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিজের প্রতি প্রযোজ্য হবে। অন্যথায় যাকে স্বপ্নে দেখা গেল, ব্যাখ্যা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যে কোনো অবস্থাতেই তা ভালো। অনুরূপভাবে কেউ যদি স্বপ্নে দেখে যে, সে আকাশে উঠে গেছে, তাহলে তার অবস্থার আলোকেই এর অর্থ হবে। ঐ সময়ে সে যদি ভালো অবস্থায় থেকে থাকে, তাহলে এটা তাঁর বুুজুর্গির লক্ষণ। অন্যথায় কিছু ক্ষতির পূর্বাভাস। যদি তার মুমূর্ষু অবস্থায় দেখে থাকে, তাহলে সে মারা যাবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি কোনো যানবাহন তথা ঘোড়া, জাহাজ ইত্যাদি স্বপ্নে দেখে এবং স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্নে দৃষ্ট বস্তু উভয়ের অবস্থা যদি ভালো মনে হয় অর্থাৎ যাত্রীর কোনো প্রকার কষ্ট অনুভূত না হয় এবং যানবাহনেও কোনো প্রকার ত্রুটি ভাঙা না থাকে বা উহাকে ডুবে যেতে না দেখে তাহলে ভালো, অন্যথায় বিপদের আশংকা রয়েছে।
অনুরূপভাবে স্বপ্নে দেখা বস্তুর ইঙ্গিতের আলোকে স্বপ্নের ফলাফল অনুমান করতে হবে। যেমন কোনো লোক যদি স্বপ্নে দেখে যে, কোনো বস্তু হারিয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে কোনো দুর্ঘটনা আসন্ন। আর যদি স্বপ্নটা এর বিপরীত হয়, তাহলে বুঝতে হবে শুভ সংবাদ। এটা হল সংকেত বিদ্যা। যেমনÑ কেউ যদি স্বপ্নে পিঁপড়া, চিতা বাঘ অথবা কাক দেখে, তাহলে যেহেতু প্রতারণা এবং লোভ এদের স্বভাব, সেহেতু এ স্বপ্নের অর্থ হবে যে, স্বপ্নদ্রষ্টার এ প্রকৃতির শত্রু রয়েছে। কেউ স্বপ্নে হিংস্র বাঘ দেখলে তার অর্থ তার বড় শত্রু আছে অথবা সে বড় ধরনের বিপদগ্রস্ত হবে অথবা তার মৃত্যু হবে। সে যদি স্বপ্নে দেখে যে, বাঘটি রোগাক্রান্ত বা দুর্বল বা তার অনুগত, তাহলে এর অর্থ হবে যে, তার শত্রু দুর্বল হয়ে গেছে। কেউ যদি স্বপ্নে দেখে যে, বায়ু স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, এটা সর্বদাই ভালোর লক্ষণ। বায়ু মৃদু অবস্থায় দেখাও ভালো; কিন্তু ঝড় দেখা বিপদের লক্ষণ। এটাই হল ‘মধ্যম পন্থা উত্তম’ এর অর্থ। অনুরূপভাবে স্বপ্নে দেখা বস্তুর প্রকৃতি অনুযায়ী স্বপ্নের ব্যাখ্যা হবে। যথাÑ কেউ যদি স্বপ্নে সাগর দেখে এবং দেখে তার পানি ভালো, তাতে কোনো ভয়ংকর তরঙ্গ নেই এবং তা পার হওয়ার জন্য কোনো ব্যস্ততা নেই, তাহলে এটা তার প্রশান্ত চিত্তের লক্ষণ। তাতে যদি ভীতিপ্রদ কিছু দেখা যায়, তাহলে ঐ বস্তুর প্রকৃতির আলোকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা নির্ধারিত হবে।
কোনো কোনো স্বপ্ন উক্ত স্বপ্নের চেয়েও জটিল। এ স্বপ্নেও সংকেত থাকে, তবে তা বোঝা অধিক কষ্টকর। যেমন কেউ স্বপ্নে দেখল যে, সে তার মা অথবা বোনের সাথে সঙ্গম করছে অথবা মা বোন দেখল যে, আপন ছেলে বা বাপের সাথে সঙ্গম করছে, তাহলে বোঝা যাবে উভয় পক্ষেই আকর্ষণ বা দয়া রয়েছে। তবে উক্ত কর্মে অগ্রগামী পক্ষের অনুরাগ অধিকতর বোঝা যাবে। উদাহরণস্বরূপ বিবি যুবায়দা (রাঃ) স্বপ্নে দেখলেন যে, পৃথিবীর সকল মানুষ তাঁর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত। তার অর্থ হল এই যে, বিবি যুবায়দা পবিত্র মক্কায় একটি জলাশয় বা নালা খনন করাবেন এবং তা দ্বারা সকল মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হবে। আর বিবি যুবায়দাও তা দ্বারা অনেক উপকৃত হবেন। কাজেই বোঝা গেল যে, স্বপ্নবিদ্যা একটি সাংকেতিকবিদ্যা। কিন্তু এতে সংকেতের মধ্যেও সংকেত থাকে। এর আলোকেই সকল স্বপ্নের ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ কোনো নারী যদি স্বপ্নে দেখে যে, তার নাক অথবা হাত থেকে কোনো অলংকার খসে পড়েছে। এর অর্থ হল তার স্বামী থাকলে মারা যাবে অথবা তার কোনো সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে। তবে ঠিক সে পরিমাণ সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে, অলংকারে যে পরিমাণ ঔজ্জ্বল্য ছিল। এ সৌন্দর্য আধ্যাত্মিক বা বাহ্যিক সুনামও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি স্বপ্নে দেখে যে, আল্লাহ্্ তা’য়ালা মরে গেছেন, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। কারণ এটাই তার বিশ্বাস। কেউ যদি স্বপ্নে দেখে, নবী করীম (সাঃ) মরে গেছেন, তাহলে তার ধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে। তার ভবিষ্যৎ পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ সংকেতবিদ্যা অন্যান্য বিদ্যার মতোই অন্যতম বিদ্যা। অনেক প্রকার সংকেতবিদ্যা আছে। যেমনÑ কেউ দৃশ্যমান গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতে সে নিজের মনোবাঞ্ছা উপলব্ধি করল। সে দেখতে পেল যে, পাতাগুলো মাথা নেড়ে সংকেত দিচ্ছেÑ এ কাজটা তোমার জন্য ভালো অথবা নিষেধ করছে। এমতাবস্থায় পাতার মাথা নাড়ার যে অর্থ গ্রহণ করা হবে, সে অনুযায়ীই তার ব্যাখ্যা হবে। প্রত্যেকটি ফুল-বৃক্ষ, জীব-জন্তু, চন্দ্র-সূর্য এবং মানুষ, জ্বিন ও ফেরেশতা একইভাবে বিচার্য। যদিও প্রকাশ্য চোখে দেখা শোনা বা শোঁকা যায় ইত্যাদি। অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি দিন, মাস এবং বছরেরও সংকেতবিদ্যা বা শরীর স্থান বিদ্যা রয়েছে। এমনিভাবে কোথাও যাত্রা পথে কোনো বস্তু দেখা বা কোনো বিশেষ শব্দ শোনারও ব্যাখ্যা রয়েছে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কোথাও যাত্রা করার সময়ে সুমধুর আওয়াজ শুনলে বলতেন এটা শুভ লক্ষণ। তাছাড়াও রয়েছে জ্যোতির্বিদ্যা। এ বিদ্যা নবুয়তের সাথে সম্পর্কিত। হযরত দানিয়াল (আঃ)-এর ওপর জ্যোতির্বিদ্যা অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে এর কোনো কোনো অংশ বাতিল হয়ে গেছে আর কোনো কোনো অংশ আজও সকল ধর্মে
প্রচলিত রয়েছে। যেমনÑ দিন, সূর্যমাস, চন্দ্রমাস এবং বছর ইত্যাদি গণনা করা। অমাবস্যা, পূর্ণিমা প্রভৃতি নির্ধারণ করা এবং রবি, সোম ইত্যাকার দিন গণনা করা যা একান্ত প্রয়োজনীয় বরং ফরয। যে অজ্ঞ সম্প্রদায় সাধারণভাবে জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতিকে হারাম এবং বাতিল বলছে, তারা ভুল বুঝেছে।

মুর্শিদের দৃষ্টি
মুর্শিদের দৃষ্টি কী রকম? হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেÑ النظر شفاء (আননাজ্রু শিফাউন্) অর্থাৎ, দৃষ্টিতে আরোগ্য হয়। এর অর্থ শুভ দৃষ্টি। মুর্শিদকে দেখলে মৃত অন্তর সজীব হয় বা রোগাক্রান্ত অন্তর আরাম বোধ করে এবং চিন্তিত হৃদয়ের চিন্তা দূর হয়। মুর্শিদের আসল এবং প্রকৃত রূপ যে দেখে, সে মরে না। যেমন আজরাঈল (আঃ)-এর আসল রূপ যে দেখে, সে বাঁচে না। তবে এ দেখা কয়েক প্রকার হতে পারে, যেমন বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা এবং অন্তর্দৃষ্টিতে বা ধ্যানে দেখা। বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য সামনা-সামনি হওয়া প্রয়োজন। ধ্যানে দেখার ব্যাপারে কাছে বা দূরে, অতি দূরেও কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এটা মুর্শিদের বৈশিষ্ট্য। তবে যার ধ্যানশক্তি উন্মোচিত হয়েছে, তাঁর জন্য মুর্শিদের রূপের ধ্যান একটা বিরাট নিয়ামত। এর ন্যূনতম উপকারিতা হল এই যে, এ ধ্যানে আপন মুর্শিদের সাহচর্যের উপকারিতা পাওয়া যায়। হযরত শাহ্ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস (রঃ) বলেন, واذا غاب الشيخ عنه يخيل صورته فتفيد صورته ما تفيد صحبته (অ-ইজা গা-বাশশাইখু আন-হু ইয়াখিল্লু ছোরাতাহু ফাতাফিদু ছুরাতা-হু মা তাফিদু ছুহবাতা-হু) অর্থাৎ, মুর্শিদের অবর্তমানে মুর্শিদের রূপের ধ্যান মুরিদকে তাঁর সাহচর্যের উপকারিতা প্রদান করতে পারে। উল্লেখ্য, মুর্শিদের আসল রূপ আল্লাহ্্র সত্তার সাথে সম্পর্কিত। নবী করীম (সাঃ) বলেন, من رأني فقد رأي الحق (মান রা-আনি ফাকাদ্ রা-আল হাক্কা) অর্থাৎ, যে আমাকে দেখেছে, বস্তুত সে আল্লাহ্্কে দেখেছে। সুতরাং যে আল্লাহ্্কে দেখেছে, সে আলমে লাহুত বা ঐশী জগতের অধিকারী হয়েছে। আর আলম-এ লাহুতে মৃত্যুর প্রবেশাধিকার নেই। কারণ মৃত্যু রূহ্-কে আলম-এ নাসুত বা বস্তুজগৎ থেকে আলমে মেছাল তথা অনুরূপ জগৎ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এর উপরে তার প্রবেশাধিকার নেই। অতএব যে নশ্বর জগৎ অতিক্রম করে অমর জগতে প্রবেশ করেছে, তার আর মরণ নেই, বরং সে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে যায়। এ জন্য আল্লাহ্্র অলীগণ ছাড়া অন্যরা এ বিষয়টা বোঝে না। না বুঝে ভালো কথা, কিন্তু বিপদ এই যে, তারা এর ঘোর বিরোধী। অথচ এরাই তাদের পুস্তক-পুস্তিকায় লিখে যে, সাধক যখন স্বীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তি করার মানসে ধ্যানে বসেন, তখন তিনি অনুভব করেন যে, একটি কামানের গোলা তার বক্ষভেদ করে চলে গেছে। ফলে তার বক্ষে যেন একটা সুড়ঙ্গ হয়ে গেছে। অতঃপর সাধক অনুভব করেন যে, ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গটি বড় হতে হতে গোটা দেহটি সুরঙ্গের সাথে বিলীন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সুড়ঙ্গটা সমস্ত দেহে ছড়িয়ে গেছে। ফলে গোটা দেহটা সুড়ঙ্গের সাথে বিলীন হয়ে গেছে। এটার নামই ফানা বা আত্মবিলুপ্তি। এটা সাধকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
এখানে স্মরণীয় যে, মুর্শিদের রূপ আল্লাহ্্র গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। যার ধ্যানের মাধ্যমে শত সহস্র সংকেত ও গোপন রহস্য সম্পর্কে আলোক লাভ হয়। তাদের মতে, মুর্শিদের ধ্যান করা র্শিক ও হারাম। তাহলে ধ্যানে কামান, গোলা তথা লোহা কল্পনা করা কী করে পুণ্যের কাজ হয়? তদুপরি অনেক অমূলক চিন্তার মাধ্যমে নিজেকে বিব্রত করা হয়। যেমনÑ ধ্যানে লোহা দ্বারা কামান ও গুলি তৈরি করা, তাতে বারুদ সংযুক্ত করা এবং আগুনের শক্তিতে গুলি সতেজ হওয়া। অতঃপর সে গুলি বক্ষে বিদ্ধ হওয়া আবার তা থেকে সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হওয়া, ধীরে ধীরে সে সুড়ঙ্গ বড় হতে থাকা এবং পরিশেষে তাতে কাল্পনিকভাবে বিলীন হওয়া। অর্থাৎ মিথ্যামিথ্যিভাবে কল্পনায় ফানা বা বিলীন হওয়া।
মাওলানা রুমীর বাণী,
“খেয়ালাতে না-দানে খেলোয়াত নাশিন,
বাহাম বরকুনাদ্ আকেবাত্ কুফরওয়াদিন।”
তিনি আরও বলেন,
“কারে পাকান-রা-কিয়াস্ আজ খোদ্ মগির,
গারচে মান্দ বাশাদ দরনাবেশ্তান সেরও সীর।”
মোটকথা, এটাও তো ফানা নয়, বরং ফানার ওপর একটা অনুমানের বোঝা চাপানো। বলুন তো, ফানার সময় খেয়াল ও কল্পনাকে ফানা করতে হয় কি না? যদি ফানা করতেই হয়, তাহলে কলেমার আঘাতে কেন ফানা করা হচ্ছে না? লোহার শিবলিঙ্গের দ্বারা কী করে ফানা হবে? এটাতো ফানা নয়; বরং ফানা হওয়ার পথে বাধা। কারণ ফানায় স্বীয় দেহ ও ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে হয়। যাতে উহাতে আর কখনো কোনো প্রকার ইন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি না হয় এবং ইহজাগতিকতায় জড়িয়ে না যায়। ধ্যানে যে সুড়ঙ্গের কল্পনা করতে হয়, সেটা তো ইহজগৎ এবং এ স্থানেই। সুড়ঙ্গের মধ্যে যে স্থান অনুমিত হয়, তা আপন দেহের চেয়ে অনেক কঠিন। তার বিলোপ সাধনের জন্য কী ধরনের কামান প্রয়োজন? স্মরণীয় যে, আল্লাহ্্র তাওহীদের ভিতর কোনো প্রকার অসত্যের প্রবেশাধিকার নেই। সেক্ষেত্রে এতসব অবাঞ্চিত কল্পনা কী করে বৈধ হতে পারে? এবং এর দ্বারা কী করে তাওহীদ অর্জিত হতে পারে? অতএব তাওহীদের ক্ষেত্রে যাদের এরূপ চিন্তাভাবনা হতে পারে, উপবিষয়সমূহে অনুরূপ আচরণ করতে তারা কি কখনো ছাড়বে? মুর্শিদের ধ্যানের যদি কোনো উপকারিতা ও প্রভাব না থাকে, তাহলে লোহার কি প্রভাব থাকতে পারে? লোহার কল্পনা কেন করতে হবে? মানসিক উপকারিতার জন্য, না আত্মিক উপকারিতার জন্য? অভ্যন্তরীণ উপকারিতার জন্য, না বাহ্যিক উপকারিতার জন্য, না মানবিক উপকারিতার জন্য? তাতে মৌল রশ্মি, না রূপক রশ্মি কোন্টা আছে যে, তার ধ্যান বা কল্পনা করতে হবে? অথচ যে মুর্শিদের ভিতর উক্ত সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান, তিনি দূরে থাকুন অথবা কাছে থাকুন, তাঁর বাহ্য রূপ কল্পনা করা হোক বা আসল রূপ, সর্বাবস্থায় যার দ্বারা প্রভাবিত বা উপকৃত হওয়া যায়, তাঁর ধ্যান করা যাবে না কেন? মুর্শিদের যদি ধ্যান করা না যায়, তাহলে মুর্শিদ দ্বারা লাভ কী? কামানের কল্পনার সময় শয়তান যদি কামানের রূপ ধারণ করে, তাহলে কী হবে? এক গোলার আঘাতে সমস্ত ধ্বংস করে দেবে। কারণ শয়তান সব রূপ ধারণ করতে পারে, কিন্তু রাসূল (সাঃ) এবং রাসূলের রূপে বিলীন ব্যক্তির রূপ ধারণ করতে পারে না। কারণ রাসূল (সাঃ) এর রূপে বিলীন ব্যক্তির রূপ রাসূলেরই অনুরূপ এবং তিনিই পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর রূপও শয়তান ধারণ করতে পারে না। তাই হাদিস শরীফে আছেÑ يفر الشيطان من ظل عمر (ইয়া ফিররুশ শায়তানু মিন জিল্লি ওমর) অর্থাৎ, হযরত ওমর (রাঃ)-এর ছায়া দেখলে শয়তান পালায়। সুতরাং মুর্শিদ না থাকলে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা নেই। الرفيق شم الطريق (আর রাফিকো ছুম্মাত্ তারিকো) অর্থাৎ, প্রথমে মুর্শিদ পরে সাধনা ও সিদ্ধি।
“চো খালিল আ-মদ খেয়াল ইয়ারে মান
ছোরতাস বুৎ মা’না আও বুৎ শেকান।”
যে ব্যক্তি মুর্শিদের ভিতরের রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয়, সে মুর্শিদ সম্পর্কে কী জানবে? শুধু মুর্শিদের নাম লেখা এবং তাঁর পরিচয়নামা সঙ্গে রাখায় কী উপকার? তাঁর ত্বরিকার নাম জপলেই তা হাসিল হবে না। আর অযথা বার বার নাম জপ করায় নাম বিলুপ্ত হয় মাত্র। এতে আরও কিছু আছে। কিন্তু মুর্শিদের মধ্যে যে মানবিক ফায়েজ বা উপকারিতা পাওয়া যায় তাতে দয়াময়ের মহান দান অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই মুর্শিদে বিলীন হওয়া বেলায়েতের প্রথম সোপান বা সিঁড়ি। মুর্শিদের মধ্যে মানবিক ফায়েজ না থাকলে মুর্শিদের কোনো প্রয়োজনই হত না। সুতরাং এ ফায়েজ বা প্রচুর কল্যাণ অর্জন করতে হলে ভক্তি, ভালোবাসা ও ধ্যান প্রয়োজন। ভালোবাসাহীন ভক্তি বা বিশ্বাসে তেজ নেই এবং স্মরণ ও ধ্যানহীন ভক্তি ভালোবাসা বিস্মৃতিরই নামান্তর। এ তিনটির সমন্বয় হলেই উদ্দেশ সিদ্ধ হয় এবং লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে ভক্তি যত বেশি হবে, ধ্যান ও অনুভব শক্তি তত বাড়বে। তবে যিনি অন্তর্দৃষ্টিবান, তাঁর ধ্যান হবে কাশ্ফ্ পদ্ধতিতে। আর যিনি অনুভূতিশীল বা অনুরূপ তাকে নিজের তরফ থেকে ধ্যান করতে হবে। তবে উভয় অবস্থাই ভালো। মুর্শিদের ধ্যান অর্থ এই যে, মুরিদ যখন আপন মুর্শিদের ফায়েজ প্রাপ্ত হতে থাকবে এবং বুঝতে পারবে, মুর্শিদের ফায়েজ অর্থ কি? তখন সাবধানী সাধক যখনই মুর্শিদকে স্মরণ করবে, তখনই সে আরও অধিক পরিমাণে ফায়েজ লাভ করবে। তার যিকিরের ক্ষমতা বাড়বে, তার অবস্থার উন্নতি হতে থাকবে এবং সে তা উপলব্ধি করতে পারবে। যার এ অবস্থা লাভ হয়নি, সে ধ্যান এবং মুর্শিদের ফায়েজের অর্থ কখনো বুঝবে না। এ কারণেই ধ্যানের ব্যাপারে এদের আপত্তি বা বিরোধিতা।
ধ্যান বিরোধিরা ফায়েজ বা মুর্শিদের মহা দান এবং তাসাউফের অর্থ জিজ্ঞেস করে। বস্তুত তারা জানে যে, ফায়েজের আভিধানিক অর্থ পুরস্কার এবং সংবাদ প্রকাশিত হওয়া। আর তাসাউফ অর্থ কল্পনা বা ধ্যান। কিন্তু এরা এর মর্মার্থ বোঝে না। এ পর্যায়ে অনেক সাধকেরও ধ্যান সাধনায় দ্বিধা ও সংশয় রয়েছে। তারা মুর্শিদের ধ্যানে মুর্শিদের প্রকৃত রূপের ধ্যানও কল্পনা করতে পারছে না। তা হলেও মুর্শিদের ফায়েজ থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় না। এ বিষয়ে সাধকদের কোনো প্রকার সংশয় থাকা উচিত নয়। কারণ যখন মুর্শিদের ফায়েজ লাভ হয় অর্থাৎ নিজের অবস্থাদি দ্বারা বুঝতে পারে যে, এ ফায়েজ মুর্শিদের তরফ থেকে প্রেরিত, তখন যদি মুর্শিদের ধ্যান না করা হয়, তাহলে সে ফায়েজ স্থায়ী হয় না। এটাও এক প্রকার ধ্যান। কেননা ধ্যান-ধারণা অনেক প্রকার। যেমনÑ আবেগের ধ্যান, কাশ্ফের ধ্যান এবং বিশ্বাস ও ভক্তির ধ্যান। কাশ্ফের ধ্যানে দেখতে হবে কাশ্ফের দৃষ্টি দিয়ে। আর আবেগের ধ্যানে দেখতে হবে আবেগের দৃষ্টি দিয়ে এবং ভক্তির ধ্যানে দেখতে হবে ভক্তির দৃষ্টি দিয়ে। এটাও ভালো; বরং এক হিসেবে মৌলিক। কারণ ভক্তির জোরে কাশ্ফ ও ধ্যান ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। ভক্তিমূলক ধ্যানশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ যার কাশ্ফ এবং ধ্যানশক্তি আছে কিন্তু ভক্তি বা বিশ্বাস নেই, সে ব্যক্তি মৃত। কিন্তু যার কাশ্ফ এবং ধ্যান নেই, ভক্তি বা বিশ্বাস আছে, সে ব্যক্তি অকপট দ্বিধাহীন। কোনো কোনো সাধক বা শিষ্যের মধ্যে দ্বিধা এবং হতাশা সৃষ্টি হয়। তারা মুর্শিদ সম্পর্কে অন্যায়ভাবে খারাপ ধারণা করে যে, মুর্শিদ বড় নিষ্ঠুর, হয়ত আমাদেরকে কিছুই দেবেন না। এটা খুবই খারাপ এবং বঞ্চিত হবার লক্ষণ। মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর ভাষায়,
“আগার হোব্বে খোরদে লাহো সাকুক দারাদ্ দরিঁয়ে রাহ্
কদম মানদান হীচ সূদ্মান্দ নিস্ত।”
অর্থাৎ, “এ পথে দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য কোনো কল্যাণ নেই।” এ ধরনের শিষ্যদের অবিলম্বে তওবা করা কর্তব্য। কারণ মুর্শিদের কৃপা লাভ করা উচিত, অসন্তুষ্টি নয়। এ ধরনের হতভাগ্য শিষ্য ব্যক্তিগতভাবেই অপদার্থ। তবুও মুর্শিদ তাকে সুনজরেই দেখেন এবং আশীর্বাদ করেন। বস্তুত সে শিষ্য কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই পাচ্ছে। সে যদি তওবা করে, তবে কুলক্ষণ কেটে যাবে।
কোনো কোনো সময়ে শিষ্যদের মধ্যে আবেগ প্রবণতা এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, প্রেমের কারণেই এটা হয়। কারণ প্রেমিক বিচ্ছেদে স্থির থাকতে পারে না। কবির ভাষায়,
“হাফতে দরিয়া গর বানুশম তর নাকুনাম কামরা
শরবত দিদার বায়াদ্ তেশনায়ে দিদার রা”।
অর্থাৎ, “সাত সাগরের পানি পান করেও তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা মিটে না।” নবী অলীদের এ রকম অবস্থা হয়। এটা ভালো। তবে আল্লাহ্্র সত্তা অসীম বিধায় এ পর্যায়ে নিজেকে সংযত করা উচিত। তা না হলে দেওয়ানা বা মজ্জুব হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু দেওয়ানা এবং মজ্জুবদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ কুতুব ও আবদাল এবং উত্তম ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্য থেকেই আবির্ভূত হন।

শরিয়ত ও ত্বরিকত এর পার্থক্য
জাহেরি শরিয়ত এবং বাতেনী শরিয়ত তথা ত্বরিকতের বিধিবিধানের মধ্যে রাত দিন এবং জীবিত ও মৃতের মতো বিরাট পার্থক্য। মৃতের বিধান হল দাফন কাফন। তবে এটা জীবিতদেরই কর্তব্য। জীবিতদের কোনো কাজে মৃতের শরীক হওয়ার ক্ষমতা নেই। অনুরূপভাবে ত্বরিকতপন্থীগণ জীবিত এবং শরিয়তপন্থীগণ ত্বরিকতপন্থীদের কাছে মৃত। কারণ প্রেমের বদৌলতেই চিরঞ্জীব হওয়া যায়। অতএব যেখানে প্রেম নেই, তাতো মৃতই। যেসব নবী অলী অনন্ত জীবন লাভ করেছেন, প্রেমের বদৌলতেই তা করেছেন। জাহেরি শরিয়তের অনুসারীগণ আল্লাহ্্র প্রেম সম্পর্কে অনবহিত। তাই তারা এ পথের বিরোধী। যাদের মস্তিষ্ক পুড়ে গেছে তারা না নিজেকে চিনতে পারছে, না আল্লাহ্্র সাথে তাদের আত্মিক বা রূহানী কোনো সম্পর্ক আছে, কিভাবে তারা অনন্ত জীবন লাভ করবে?
সকল অলীর নেতা হলেন আমাদের সর্বশেষ নবী। তাঁর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ প্রেমময় বাণী শুনুন। (মেশকাত ও অন্যান্য) إرحمنى يا عأشة (ইরহামনি ইয়া আয়েশাতা) অর্থাৎ, হে আয়েশা আমার প্রতি সদয় হও। অর্থাৎ আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে, আমি মারা যাচ্ছি, তুমি আমার সাথে কথা বলো। তাহলে আমার অন্তরে আল্লাহ্্র যে মহব্বত জমাট বেঁধে গেছে, তা বের হয়ে যাবে। কোনো কোনো সময় তাঁর ঊরুতে হাত রেখে পুনঃপুন এ কথা বলতেন। কখনো কখনো অস্থির অবস্থায় যখন তিনি আচ্ছন্ন থাকতেন, তখন পাহাড়ে উঠে যেতেন এবং লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হতেন। তখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে তড়িৎ ধরে ফেলতেন এবং বলতেন, “অস্থির হবেন না, আপনি যা কামনা করছেন আল্লাহ্্ আপনাকে তা দিবেন। আপনি আল্লাহ্কে পাবেন।” নবী রাসূলদের ব্যাপারে এরূপ শত শত ঘটনা রয়েছে। হাদিস শরীফেও এর সমর্থন রয়েছে।
স্মরণীয় যে, আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যার জন্য চেষ্টা করা শরিয়ত অনুযায়ী হারাম। তাহলে নবী হয়ে তিনি এ কাজ কী করে করলেন? ‘শরহে মেশকাত’ এবং ‘এহ্ইয়াউল উলুম’ প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করলে এর মর্মার্থ জানা যাবে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কান্নার অবস্থা চিন্তা করলে উক্ত আলোচনার অর্থ আরও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এমন চিৎকার করে কাঁদতেন এবং যিকির করতেন যে, দেড় ক্রোশ মতান্তরে তিন ক্রোশ দূর থেকে শোনা যেত। হযরত দাউদ (আঃ) এত বেশি অস্থির হয়ে যেতেন যে, তাঁকে শান্ত করার জন্য সদা দুজন লোক মজুদ থাকত। যেন কোথাও আঘাত পেয়ে কোনো প্রকার অঙ্গহানি না হয় বা মরে না যান। ‘এহ্ইয়াউল উলুমে’ তাই রয়েছে। নবী-অলীদের অবস্থা এবং অজ্দ বা পরম প্রেমানন্দ অবস্থা সম্পর্কে লিখতে হলে গ্রন্থের পর গ্রন্থের প্রয়োজন। কোনো কোনো সাহাবি অজ্দ অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। একদা হযরত ওমর (রাঃ) অশ্বে আরোহিত ছিলেন। এমতাবস্থায় শুনতে পেলেন, এক ব্যক্তি পড়ছেÑ ان عذاب ربك لواقع ماله من داقع (ইন্না আযাবা রাব্বিকা লা ওয়াকেউন্ মা লাহু মিন্ দা-ফেই’ন্)। অর্থাৎ, তোমার প্রভুর শাস্তি অনিবার্য, এর কোনো প্রতিরোধক নেই। হযরত ওমর (রাঃ) একটি চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান এবং লোকেরা তাঁকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দেন। তিনি এক মাস অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। আবু হুরাইয়া তাবেয়ীর (রাঃ) সামনে ছলেহ্মারী কোরান থেকে পাঠ করেন। তিনি চিৎকার দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। হযরত ইমাম শাফী (রাঃ) জনৈক ক্বারীর কণ্ঠেÑ هذا يوم لا ينطقون ولا يؤدن لهم فيعتذرون (হাযা ইয়াওমু লাইয়ান্তিকুনা ওয়ালা ইউজানু লাহুম ফাইয়াঁ তাজিরুনা) এ আয়াত শুনে বেহুঁশ হয়ে যান। একদা হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাঃ) এশার নামায পড়ছিলেন। জনৈক ক্বারী পাঠ করেন, يومئذ يصد الناس أشتاتا ليروا اعمالهم (ইয়াওমা ইজিন্ ইয়াস্দুরুন্নাছু আশ্তা-তালিইউরাও আ’মালাহুম) এতে হযরত আবু হানীফা (রাঃ) বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সারা রাত কান্নাকাটি করেন। আহ্! আহ্! করতে থাকেন এবং বার বার আয়াতটি আওড়াতে থাকেন। এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে ‘তোহ্ফায়ে বরযখী’ এবং ‘এহ্ইয়াউল উলুম’ পাঠ করুন।
হযরত আবু তাইয়েবা (রাঃ) যখন নবী করীম (সাঃ)-কে সিঙ্গা লাগান এবং টেনে বহিষ্কৃৃত রক্ত নিজে পান করেন, তখন রাসূল (সাঃ) তাঁকে বলেন, তুমি বেহেশত পাবে এবং দোযখ থেকে বেঁচে গেছ। অথচ রক্ত পান করা হারাম। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) তাঁকে এ কাজের জন্য তওবা করালেন না; বরং এ রক্ত পান করাকে ভালো মনে করলেন। এটা সত্যিই বড় অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ হযরত আবু তাইয়েবা অজ্দ তথা পরম প্রেমে নিমজ্জিত অবস্থায় রক্ত পান করেছেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তখন অজ্দ অবস্থায় ছিলেন না। অজ্দ অবস্থায় না থেকেও তিনি রক্ত পান করাকে ভালো মনে করেছেন এবং এ কারণে তাঁর জন্য দোয়া করেছেন। অতএব যে কেউ তাঁর উম্মত হলে আহলে অজ্দকে দোয়া ও সম্মান করবে।
অনুরূপভাবে জনৈক সাহাবি রাসূল (সাঃ)-এর পেশাব পান করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁকেও দোয়া করেছেন যে, অর্থাৎ তুমি দোযখ থেকে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললে। অর্থাৎ তুমি আর দোযখে যাবে না। এমনিভাবে শরিয়তপন্থীগণ যা হারাম ও কুফর মনে করে এমন অনেক কাজও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। এর জবাব কী? দারাশিকো (রঃ)-এর ‘রেসালা-এ-হাছানাতুল আরেফীন’ প্রভৃতিতে উল্লেখ আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, انا احمد بلاميم (আনা আহমাদু বেলামীম্)। আরও বলেছেন, আজ আমি আল্লাহ্্কে যুবকরূপে মদিনার বাজারে দেখেছি। অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্্ তায়ালা তাঁর দু হাত আমার কাঁধে
রাখেন এবং আমি এটার শীতলতা অনুভব করি। অনুরূপভাবে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, أنا أخذت العهد على الأرواح في الازل انامناد يهم الست بربكم آنا مخرج من القبور انا حي لايموت انا جاوزت بموسئ البحر وغر قت فرعون وجنوده انا ارسلت الجبال الشامخات فجرت العبون (আনা আখাযতুল আহ্ঁদা আলাল আরওয়াহি ফিল আযালি আনামুনাদিহিম আলাসতু বিরাব্বিকুম? আনা মুখরিজুম মিনাল কুবুরি আনাহাইয়্যুন্ লা ইয়ামুতু। ওয়াআনা জাওয়াজতু বিমুছাল বাহরা ওয়া গোরেকাত ফেরআউনু ওয়া জুনুদুহু আনা আরছালতুল জিবালাশ শামিখাতা ফাজারাতিল ঊ’বূন্।) বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) বলেন,سبحاني ماعظمشانى (সুবহানি মা আ’জাঁমু শানি) (কত উচ্চতর আমার সম্মান)। ‘মাজহারুল আযায়েব’-এ এরূপ উল্লেখ আছে। হযরত বায়েজীদ বোস্তামীর (রঃ) কথা অন্যত্র উদ্ধৃত হয়েছে এভাবেÑ اني انا الله فاعبد وني (ইন্নি আনাল্লাহু ফা’বুদুনি)। হাসানাতুল আরেফিনে আরও উল্লেখ আছে যে, জনৈক ব্যক্তি হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)-এর কাছে এসে বললেন, আমাকে মুরিদ করুন, তিনি বললেন, বলÑ لا اله الا الله چشتى رسول الله (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু চিশ্তী রাসূলুল্লাহ্।) হযরত শাহ্ আলম (রঃ) কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী? বলেন, মোহাম্মদ। তোমার বক্তব্য কী? বলেন, আল্লাহু আহাদ। জিজ্ঞাসা করেন, তোমার অবস্থা কী? উত্তর দেন, আল্লাহুস সামাদ। জিজ্ঞেস করেন, তোমার বৈশিষ্ট্য কী? উত্তর দেন, লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ। জিজ্ঞেস করেন, তোমার মর্যাদা কী? উত্তর দেন, অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।

দ্বীনের আলোর বিবরণ
দ্বীনকে আলোকিত এবং হেফাজত করার জন্য দ্বীনকে সজীব করা ও তা থেকে উপকৃত হওয়া এবং স্বাদ গ্রহণ করার জন্য আপন ঘরে বাতি প্রয়োজন। অর্থাৎ নিজের মধ্যে যে বাণী ও ভাবের উদয় হয়, তাকেই বলা হয় এলহাম, কাশ্ফ এবং খাব বা স্বপ্ন। এগুলোকেই নবীদের হাদিস বা বাণী বলা হয়, যা কোরানের সমার্থক। এগুলোই উম্মতের জন্য দলিল। কিন্তু কেউ কেউ বাতেন অহিকেও হাদিস বলেছেন। মেশ্কাত প্রভৃতিতে তাই আছে। মোটকথা এর দ্বারাই উভয় জগতের সংস্কার ও বিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। এ কারণেই উম্মতগণকে ভালোমন্দ সম্পর্কে অবহিত করার উদ্দেশে সকল নবী নিজ নিজ উম্মতদের মধ্যে হাদিস বর্ণনা করেছেন, যেন উম্মতগণ ভালোমন্দ বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। অর্থাৎ কোরান দ্বারা যা প্রমাণিত হয়েছে, তার বিশ্লেষণ এবং যা কোরানে উল্লেখ হয়নি, তাই হাদীস। এ থেকে দলিল গ্রহণ করা যায় এবং অর্জন করা যায় তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ থেকে পরম নিয়ামত এবং এটা বেলায়েতের বিষয়। নবী করীম (সাঃ) বলেন, آن في امني محدثين وان عمر منهم (ইন্না ফী উম্মতি মোহাদ্দিছিন ওয়াইন্না উমারু মিন্হুম্) অর্থাৎ, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক আছেন যারা এল্হাম প্রভৃতির মাধ্যমে সঠিক সংবাদ দিয়ে থাকেন এবং ওমর অবশ্যই তাঁদের অন্যতম। অর্থাৎ, আমার উম্মতদের মধ্যে হাদীস বলার লোক থাকবে, তাঁরা ভালোমন্দ কাজ সম্পর্কে অবহিত করবে এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অদ্ভুত ঘটনাবলি সম্পর্কে সংবাদ দেবে। আর হযরত ওমর এদেরই একজন। হযরত ওমর (রাঃ) থেকে যত হাদীস উচ্চারিত হয়েছে, তার এক-শতাংশ লিপিবদ্ধ করলেও কয়েক খন্ড হবে। এসব এল্হামই সাধারণের জন্য দলিল। আর সন্ধানী ও সাধকদের জন্য মোজাদ্দেদিয়া, কলন্দরিয়া, ওয়াইছিয়া প্রভৃতি সব ত্বরিকাই এল্হাম ও কাশ্ফ দ্বারা প্রমাণিত। এসব ত্বরিকা ছাড়াও বিভিন্ন যুগে বহু ভালো কাজের প্রচলন হয়েছে। যেমনÑ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানী এবং সে অতীত উম্মতের আযান স্বপ্নের দ্বারা প্রমাণিত। অনুরূপ, উম্মতের হাদীস দ্বারা বহু ভালো কাজ চালু হয়েছে। যেমনÑ কোরানে হরকত দেওয়া, ঈদগাহে মিম্বর নির্মাণ করা, মৌলুদশরীফ পাঠ করা, কেয়াম করা, ফাতেহা এবং নেয়াজ। অলীদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, প্রত্যেক কাজে এবং শিন্নী প্রভৃতি উপলক্ষে সুরা ফাতিহা পাঠ করে তা বিতরণ করা হয়, যেন বিপদ-আপদ দূর হয়, অর্জিত হয় সচ্ছলতা। সাধকদের জন্য এটা অবশ্য কর্তব্য। এতে তাঁদের জন্য প্রচুর কল্যাণ রয়েছে। অলীদের ইজ্মা বা ঐকমত্য দ্বারা ফাতিহা প্রমাণিত। আনোয়ারে সাতেয়া পাঠ করলে এ বিষয়ে আরও জানা যাবে। এ এল্হাম এবং স্বপ্নলব্ধ জ্ঞানই জগদ্বাসীর জন্য সুদৃঢ় প্রমাণ। একেই ইজ্মা বা প্রামাণ্য দলিল বলা হয়। উল্লেখ্য যে, কোরান এবং নবী করীম (সাঃ)-এর হাদীস ছাড়া জাহেরপন্থীরা অন্যদের থেকে প্রমাণিত হাদীসকে প্রামাণ্য দলিল বলে না, অথচ তারা বিভিন্ন কিতাবাদির ওপর বিবেচনা করে যে সব দলিল রচনা করে, তাকে প্রামাণ্য দলিল বলে। বস্তুত অলী-আল্লাহ্্ এবং সাধারণ মানুষেরও স্বপ্নে উপকার আছে। যেমন, ইস্তেখারা ও অনুরূপ বিষয়াবলি। তবে কেবল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সব স্বপ্নই সঠিক হয়। আর সাধারণ মানুষের কোনো কোনো স্বপ্ন সঠিক হয়। তবে আল্লাহ্্র ইচ্ছায় অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ এখনও হাদীস বর্ণনা করেন। অর্থাৎ, তাঁরা কাশ্ফ বা স্বপ্নে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছ থেকে কোনো বিষয়ে সমাধান জেনে নেন এবং তাঁর জীবিত অবস্থার মতোই হাদীস বর্ণনা করেন এবং তা সঠিকই হয়। তাছাড়া বর্ণনাকারীর কারণে দুর্বল বলে বিবেচিত অনেক হাদীসই এভাবেই সুদৃঢ় এবং সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু দুর্বল মনে করা হয় শুধু বর্ণনাকারীর কারণে। যেমনÑ অন্ধের চাঁদ দেখা, অর্থাৎ আকাশে চৌদ্দ তারিখের চাঁদ কিন্তু চক্ষু নাই, কেউ বলে চার দিনের চাঁদ আবার কেউ বলে আদৌ কোনো চাঁদ উঠেনি। অনুরূপভাবে কেউ বলে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) দুর্বল হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। বস্তুত এসব লোক জানেই না যে, হাদীস দুর্বল নয়, বরং হাদীসের সূত্র দুর্বল অথবা নিঃসন্দেহে নবী করীম (সাঃ) এরূপই বলেছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কেউ যদি কারও কাছে শুনে ইয়াকুতকে বাজে বস্তু মনে করে, তাহলে কি কারও বলার জন্য তা সত্যিই বাজে বস্তু হয়ে যাবে? কখনো না।

রাজত্ব পতনের বিবরণ
ফকির-দরবেশদের ক্লেশ প্রদান এবং নবী-অলীদের হত্যা করার কারণে রাজত্বের পতন হয়, মর্যাদা বিনষ্ট হয় এবং হারিয়ে যায় শান্তি। অনুরূপ কারণ ছাড়া কখনো কোনো শক্তিশালী রাজত্ব ধ্বংস হয়নি অথবা অন্য কোনো বাদশাহ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার মতো বিপদে পড়েনি অথবা দুর্ভিক্ষ, মহামারী বা দুর্যোগের শিকার হয়নি। হাদীস ও তাফসীর দ্বারা এটা প্রমাণিত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া ইতিহাসেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কাশ্ফ এবং সংকেতবিদ্যার মাধ্যমে যা জানা যাচ্ছে, তাও এ বিষয়ে পারদর্শীদের কাছে অজানা নয়। কারণ, এ উভয় জগতের পরিচালনা ও কার্যাদি, যারা কাজ করে, তাদের ওপর নির্ভরশীল। যারা কাজ করে না, তাদের দ্বারা কোনো কাজ হয় না। ছোট বড় কোনো কাজই না। কম বেশির কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, বেশিও আরো বেশির তুলনায় কম এবং আরও কমের তুলনায় কমও বেশি। মোটকথা যে সব কর্মবাদী লোক উভয় জগতের ব্যবস্থাপনায় রত আল্লাহ্্ তা’য়ালার কাছে তাঁরাই পছন্দনীয় এবং উত্তম। তাঁদের সুস্থ বুদ্ধির কল্যাণে আল্লাহ্্ তাঁদের কাজকে পছন্দ ও গ্রহণ করেন এবং উক্ত ব্যবস্থাপকদের আকৃতি প্রকৃতির অনুরূপে জাগতিক বিষয়াদি সম্পাদিত হয়। যেমনÑ প্রদীপের কারণে ঘর আলোকিত হয় এবং পিতা-মাতার বর্তমানে সন্তানের সুখ-শান্তি হয়। অনুরূপভাবে ভালো বৃক্ষ এবং বাতাস ও পানির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চিন্তা করুন।
নিয়ম আছে যে, ব্যাঙ বা সাপের মুখে মোতি প্রভৃতি জন্মে। আর মুখ থেকে তা হারিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তা মারা যায় বা পাগল হয়ে যায় এবং নষ্ট হয়ে যায় তার সকল গৌরব। তখন তা সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে অলী এবং আওতাদগণ হলেন, প্রত্যেক শহর বন্দরের ব্যবস্থাপক এবং রক্ষক। তাঁদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্্ অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁদের সন্তুষ্টিতে আল্লাহ্্ সন্তুষ্ট হন। এ অসন্তুষ্টির কারণে অবস্থা ও মর্যাদা পাল্টে যায়। ভালোর বদলে মন্দ ও অনিষ্ট সংগঠিত হয়। তবে যে কোনো লোক এ অলীদের চিনতে পারে না। এ কারণে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, الو لي تحت قبائ (আল্ ওয়ালীউ তাহ্তা কোব্বায়ী) অর্থাৎ, “অলীগণ আমার জোব্বার নিচে।” অর্থাৎ, তাঁদের চেনা দুষ্কর। কারণ তাঁদের চেহারা দুনিয়াদার এবং দোযখীদের মতোই কিন্তু চরিত্র আল্লাহ্্র গুণাবলিতে পরিপূর্ণ।
“চু বায়তুল মুকাদ্দাস দারোঁ পরযেতাব
রাহা র্কদাহ্ দিওয়ারে বিরুঁ খারাব।”
অতএব, হে জগৎবাসী! সতর্ক হও এবং ভয় কর তাদেরকে। তোমাদের কাছে তিনি অবশ্যই একজন ব্যক্তি তোমাদেরই মতো অথবা দেখতে তোমাদের চেয়েও খারাপ অথবা তোমাদের চেয়ে ভালো। অথচ তোমরা জান না যে, চরিত্র এবং গুণাবলিতে তিনি তোমাদের চেয়ে ভালো।
শোনা যায় যে, যখন বাদশা আলমগীরের সময়ে হযরত শাহ সারমাস্ত (রঃ)-কে হত্যা করা হয়, তখন তিনি নিজের মাথা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি অন্যায়ভাবে আমার মাথা কেটেছ, তোমার রাজত্ব ইংরেজদের সমর্পণ করা হল। আজ থেকে হিন্দুস্থানে মুসলমানদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেল। অর্থাৎ, রাজত্বের ব্যবস্থাপক ফিরিঙ্গিদের পক্ষে চলে গেলেন। তখন থেকে দিল্লির মর্যাদা ও সৌভাগ্য নষ্ট হতে শুরু হয়। অনুরূপভাবে যখন জাহেরপন্থীরা মুনসুর হাল্লাজ (রঃ)-কে শূলে চড়ান, তখন থেকে প্রকৃত জ্ঞান এবং এর মর্যাদা বিলুপ্ত হয়ে যায়, জ্ঞানের একটা কল্পিতরূপ কেবল বাকি থাকল। এটাকেই আজ দুনিয়াবাসীগণ দ্বীন-ধর্ম মনে করছে। কারণ, যখন ধর্মের সার্থকতার কথা ভুলে যায় অথবা এ সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই থাকে না, তখন ন্যায়-অন্যায়ের বা ঠিক-বেঠিকের পার্থক্য বোধ কোত্থেকে আসবে?

হযরত মুনসুর (রঃ)-এর বাণীর কথা চিন্তা করুন। তিনি বললেন, ‘আনালহক্ব’ আমি সত্য, অথবা আমি আল্লাহ্্র গুণে গুণান্বিত হয়ে গেছি। অর্থাৎ, আল্লাহ্্ তা’য়ালা যখন তাঁর মৌলরূপে সমুজ্জ্বল, তখন আমি তাঁর গুণের মধ্যে হারিয়ে গেলাম, আমার গুণাবলি তাঁর মধ্যে বিলীন করে দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি উক্ত রূপোজ্জ্বল অবস্থায় রূপক অর্থে একথা বলেন, যা আল্লাহ্্র শানের খেলাপ। অপরদিকে জাহেরপন্থীরা তাঁর কৃতজ্ঞতাসূচক উক্তির রূপক ভাষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত। তা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে আলেম বা জ্ঞানী মনে করে। বস্তুত আলেম বা জ্ঞানী আল্লাহ্্র একটি গুণবাচক নাম। তাহলে আল্লাহ্্র নাম ও গুণের সাথে সমতা দাবি করা কেমন করে বৈধ হবে? এ অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ যখন পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানীদের ওপর চড়াও হয়, তখন এদের বিচার কে করবে? এতদ্সত্ত্বেও তারা অহংকার করে বলে যে, হযরত মুনসুর (রঃ)-কে হত্যা করায় দুটি পুণ্য হয়েছে। এ পুণ্য কি তারা নিজ হাতে তৈরি করেছে? তা না হলে তারা কী করে জানল যে, আল্লাহ্্র অলীদের অবমাননা ও হত্যা করলে পুণ্য লাভ হয়? এ জন্য এ দলের লোকেরা হযরত মুনসুর (রঃ)-এর নাম বলার সময় শুধু মুনসুর বলে থাকে। এভাবে এরা বহু সাধক ও প্রেমিককে কষ্ট দিয়ে থাকে। বন্ধুগণ আশেক বা প্রেমিকদের রক্তকে যারা মেন্দি মনে করে, তাদের থেকে দূরে থাকো। অতএব শয়তান যাদের কাবু করে রেখেছে অথবা নফ্সের ফাঁদে যারা আবদ্ধ, কী করে তারা মুমিন হয়? কোনো মুমিনকে কাফির মনে করা ঈমানের পরিচয় নয়। কারণ ঈমান ও কুফরের মধ্যে বিরোধের সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং যে মুমিনকে মুমিন মনে করে, সে মুমিন এবং যে মুমিনকে কাফির মনে করে সে নিজে কাফির। আর যদি কোনো কাফির মুমিনকে মুমিন মনে করে, তাহলে এটা তার ভালোর লক্ষণ। অপরদিকে কোনো মুমিন যদি কাফিরকে নিকৃষ্ট কাফির মনে করে এবং সে দীর্ঘকাল কাফির থাকবে বলে ধরে নেয়, তাহলে এটা তার জন্য খুবই খারাপ। যেন বদ ধারণাটা নিজের ওপরই বর্তাতে যাচ্ছে। যে ব্যক্তি নিজে ঈমানদার নয়, সে ব্যক্তি ঈমানদারকে চিনতেও পারে না। অজ্ঞতার কারণে কেউ যদি দোযখে যায়, তাহলে সে কখনো বেহেস্ত পাবে না। আর যে ব্যক্তি বেহেশতের আশা রাখে অথচ দোযখের পথে চলে, সে দোযখে পৌঁছবে। কারণ অনারবের পথ দিয়ে আরব কী করে পৌঁছবে?
“তরসম নারসি বা কা’বা আয় আরাবী
কেঁ রাহ্ কেহ্ তু মিরুবি বেহ্ তুরকিস্তানিস্ত্।”
অতএব যার কোনো পথ জানা নেই, তার সকল দাবি মিথ্যা। কারণ যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তা তো অজ্ঞাত। অজ্ঞাত বস্তুর খরিদ-বিক্রি অবৈধ। এমতাবস্থায় হাকিকত এবং মারেফতের বিষয় অজ্ঞতার অনুসরণ করা কী করে বৈধ হবে? যার অনুসরণ করা যায় না তার দাবি কী করে ভালো এবং বৈধ হয়?
“খেয়ালাত নাদানে খেলোয়াত নাশি
বাহাম বরজিন্দা আকেবাত কুফরোদিনা।”
সুতরাং বড়-ছোট নির্বিশেষে সকলের উচিত ভালো লোকদেরকে চেনার পদ্ধতি এবং তাদের কথায় নিহিত ইঙ্গিত ও রহস্য উদ্ঘাটনের ধরনের বিষয়ের কোনো বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে শিখে নেওয়া। যাতে করে অযথা উন্নাসিকতা ও বাড়াবাড়ির মতো কুফরির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসা যায় অতীত পাপ থেকে। আর মশগুল থাকতে পারে সর্বদা ক্ষমাপ্রার্থনায় এবং যে যে অলী ও ফকির দরবেশের সাথে বেয়াদবি করা হয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যে সব অলী-ফকির বাহ্যিক জিন্দেগীতে নেই তাঁদের জন্য সর্বদা দোয়া এবং ফাতিহা করতে থাকবে এবং শিন্নি বিতরণ করবে আর তাঁদের রূহানী ফায়েজের প্রতি মনোনিবিষ্ট রাখতে হবে। তাহলে আল্লাহ্্ তা’য়ালা তাদের মঙ্গল করতে পারেন।
দ্বিতীয় কথা হল আউলিয়াকেরামগণ যেভাবে চলেন, ঠিক সেভাবেই তাদের প্রতি ইনসাফ করা ফরয। তাঁদের সাথে এর বিপরীত আচরণ করা হারাম এবং কুফর। তবে ত্বরিকতপন্থীদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণকারীরও ত্বরিকতপন্থী হয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। যে ব্যক্তি লুদুনী (ঐশী) বক্তব্য এবং কৃতজ্ঞতাসূচক উক্তির মর্মার্থ অবগত হয়েছেন তথা হযরত মুনসুর (রঃ) এবং হযরত শামস্ তিব্রিয (রঃ)-এর সম্পর্কে যথার্থ ধারণা লাভ করেছেন এবং তা মেনে নিয়েছেন, সে আদেল বা ইনসাফকারী যুগ বাদশাকে আল্লাহ্্ তা’য়ালা উক্ত জ্ঞান দান করেন, যাতে করে আল্লাহ্্র অলীগণ সুখে দুঃখে কিছুদিন আল্লাহ্্কে স্মরণ করতে পারেন।

সম্মানের বিবরণ
সম্মান প্রদর্শন করা একটি নফ্স তথা আত্মিক প্রতিক্রিয়া, যার উৎস সত্তা ও গুণ। অর্থাৎ সম্মান প্রদর্শনের ভিতর মূলবস্তু হল আত্মিক প্রতিক্রিয়ার উৎস তথা মৌলিক সত্তা। অতএব কাকেও সম্মান প্রদর্শন করার ইচ্ছা হলে তার স্বরূপকে লক্ষ করে নিজের ভিতর একটি অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ আদি সত্তা থেকে আপন সত্তায় এবং গুণাবলি থেকে আপন গুণাবলিতে সে অনুভূতিকে বিকশিত করা হয়। আল্লাহ্্ তা’য়ালা আদম (আঃ)-কে আত্মিক প্রতিক্রিয়ার মর্যাদার ওপর সৃষ্টি করেছেন। তাই উক্ত মৌলিক বস্তুসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মিক প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত ও সতেজ করার উদ্দেশে সম্মানসূচক সিজ্দার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ইব্লিস উক্ত ক্রিয়াকে অস্বীকার করে সত্তার প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হল। এ কারণেই আজ সে কাফির। এছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই। তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কেউ যদি কোনো একটি মূল বস্তুকে অস্বীকার করে, তাহলে সে তা থেকে দূরে সরে যায়। যেমন কোরানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। তা সত্ত্বেও কেউ যদি কোরানের কোনো একটি সূরাকে সম্মানের যোগ্য মনে না করে, তাহলে তা প্রকৃতই বেয়াদবী হবে। কারণ কোরান খন্ড বা সম্পূর্ণ সর্বাবস্থায়ই কোরান। অনুরূপভাবে আল্লাহ্্র আদেশ-নিষেধ ও নবী-অলী প্রমুখ আল্লাহ্্র সত্তা ও গুণাবলির বাহ্যরূপ। তাহলে সাধারণভাবে সম্মান প্রদর্শনের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হল। অর্থাৎ যাকে যথায় যেভাবেই সম্মান প্রদর্শন করা হোক না কেন, বস্তুত তা সবই আত্মিক প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। যে আত্মিক প্রতিক্রিয়া বা আচরণে সত্তার পূর্ণতাসমূহ বর্তমান তা ফরযের চেয়ে অধিক সুপ্রতিষ্ঠিত। যে সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে গুণাবলীর পূর্ণতা বর্তমান তা অবশ্যই ওয়াজিব বা সুন্নত বলে গণ্য হবে। যে সব লোক এ সুমহান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত তারা মূলত আত্মিক সত্তা সম্পর্কে অজ্ঞ। ইবলিস আদমের বিশ্লেষণে ব্যর্থ হওয়ার দরুন তার অস্বীকৃতির তলোয়ার নিজের ঘাড়েই পড়ল, সে কাফির এবং অভিশপ্ত হল। অনেক জ্ঞান এবং নৈকট্যের মর্যাদার অধিকারী হয়েও শয়তান আদমের বিশ্লেষণ বা রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তা জানার চেষ্টা করল না, বরং অস্বীকার করে মরদুদ হয়ে গেল। অতএব, আদম সন্তানদের উচিত আদমের সত্তা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে, মূল আদমকে সম্মান প্রদর্শন করা। তা না হলে কোনো সন্দেহ নেই যে, তারাও ইবলিসের মতো অস্বীকার করার কারণে তারই দলভুক্ত হয়ে যাবে। সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ হল কৃপার বদলে কৃপা। অর্থাৎ, শুভেচ্ছার দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা পুনঃ পুরস্কার এবং সম্মান। আল্লাহ্্ বলেনÑ هل جزاء اللاحسان إلا الإحسان (হাল জাযাউল ইহ্সানি ইল্লাল ইহ্সান) অর্থাৎ, “এটা প্রতিষ্ঠিত নিয়ামত। উভয় জগৎ এ নিয়ামতে সমৃদ্ধ।” এ নিয়ামতের বদৌলতে উভয় জগৎ সূর্যের মতো উজ্জ্বল। ছোট বড় সকলেই এর দ্বারা উপকৃত ও শাহেনশাহী দরবারে এ কাজ ফরযের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমির ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দরবারেও সম্মান প্রদর্শনের রীতি একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। যারা এ ইহ্সান বা সদাচরণ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের সম্পর্কে তো কোনো কথাই চলে নাÑ هل جزاء اللاحسان إلا الإحسان (হাল জাযাউল ইহ্সানি ইল্লাল ইহ্সান) এর মর্মার্থে এটাও আছে যে, কেউ যদি সম্মান করে, তবে তাকেও সম্মান করতে হবে। এটা সালামের জবাব প্রদানের মতো। তৃতীয়ত ইহ্সান তথা সম্মান প্রদর্শন করার সময় দ্বিতীয় পক্ষের প্রতিও অনুরূপ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। অর্থাৎ, প্রথম পক্ষ যদি সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যায়, তখন দ্বিতীয় পক্ষ সৌজন্যমূলকভাবে বলবে কষ্ট করবেন না, বসুন অথবা যা বলার বলবে। যদি পুনঃ পুনঃ আসা যাওয়া হয় তাহলে সৌজন্যের খাতিরে বারবারই কষ্ট না করার জন্য বলবে। এটা হল পুনঃ পুনঃ সৌজন্য বা দয়া প্রদর্শন। এতে অবশ্যই অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ জন্য শেষ নবী (সাঃ) সৌজন্যের খাতিরে কষ্ট করতে নিষেধ করেছেন, তাজিম বা সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেননি।
তাজিম বা সম্মান প্রদর্শন দু প্রকার। বাহ্যিক এবং আন্তরিক বা যথার্থ। বাহ্যিক হল কারো সামনাসামনি সম্মান প্রদর্শন করা। দ্বিতীয়টি হল আন্তরিক। অর্থাৎ, যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে, তার অবর্তমানে অন্তরে যে আত্মিক প্রতিক্রিয়া হয়, তাকে সম্মান দেখানো। এ সম্মান প্রদর্শন মানসিক বা আন্তরিক হলেও দেহে যখন মনের প্রকাশ ঘটে, তখন তা বাহ্যিক আকার ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে যথার্থতা প্রমাণিত হওয়ায় এটাকে অর্থের বাস্তব রূপ বলা হয়। কারণ, এতে উভয় সম্মান প্রদর্শন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, উভয় প্রকার সম্মান প্রদর্শন পরস্পর সম্পর্কিত এবং বাহ্যিক ও আন্তরিকভাবে সম্মান প্রদর্শন করা সাধারণভাবে বৈধ। অর্থাৎ, চক্ষু, কর্ণ, মুখ, হাত, পা সহ শরীরের যে কোনো অঙ্গের মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন করা বৈধ। আর এর দ্বারাই আদব ও সম্মান প্রদর্শনের রীতি সদা প্রচলিত আছে।
চক্ষু দিয়ে দেখা যায়, কর্ণ দিয়ে শোনা যায়, মুখ দিয়ে কারো নাম উচ্চারণ করা যায় এবং প্রশংসাও করা যায়, হাত দ্বারা লেনদেন করা যায়, প্রশংসা প্রভৃতি লেখা যায় এবং পা দ্বারা চলাফেরা ও উঠাবসা করা যায়। তবে কোনো সম্মানীয় ব্যক্তিত্বের সাথে শারীরিক সাক্ষাতে বা ধ্যান ও কাশ্ফের মাধ্যমে আত্মিক মোলাকাতের সময় এ দেখাশোনা, ওঠাবসা ও বলাবলি সবই সম্মানের সাথে করা যেতে পারে। এসব কার্য সম্পাদনের সময় সম্মান প্রদর্শনের প্রতি যত্নবান হওয়াতে কোনো প্রকার দোষ কল্পনাই করা যায় না; বরং আদবকারীর উপর সৌন্দর্য মাধুর্য সূর্যালোকের চেয়ে সুস্পষ্ট হয়।
এখন বাকি রইল জিদ ও বিরোধিতা। আর তা নিয়ে কোনো কথাই চলে না। এ জিদী সম্প্রদায় যদি কোরানের প্রত্যেকটি অক্ষরকেও অস্বীকার করার জেদ ধরে কে তাকে বাধা দেয়? কেউ কেউ তো কোরানের দু একটি অক্ষরের সাথে নিজেদের গোঁড়ামিকেও বৈধ করছে আবার কেউ তা করে বহু ক্ষেত্রে। যেমন এরা কোরান পাঠে সর্বত্র ‘দোয়াদ’-এর আরবি উচ্চারণরীতি অনুসারে দোয়াদ উচ্চারণ করে। কিন্তু সূরা ফাতিহার শেষাংশে ‘অলাদ দোয়াল্লিন’ এর ‘দোয়াদ’ কে হিন্দি পদ্ধতিতে ‘জোয়াদ’ উচ্চারণ করে। তাদের এ গোঁড়ামির কথা নামাজের মধ্যেও কি স্মরণ হয়?

ঈমানের বিশ্লেষণ

যে জিনিসের প্রতি ঈমান আনা প্রয়োজন, সে জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে ঈমান অর্জিত হয় না। ঈমানের দৃষ্টি দ্বারা তাকে দেখতে হবে, তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হবে এবং অবহিত হতে হবে উহার রকমারি প্রকাশ সম্পর্কে। জানতে হবে আল্লাহ্্ প্রত্যেক বস্তুর সাথে কিরূপে প্রকাশিত হন। এ প্রকাশ বাহ্যিকরূপে হতে পারে আবার অপ্রকাশ্যরূপেও হতে পারে। বস্তুর মৌলসত্তার জ্যোতি থেকে হতে পারে অথবা হতে পারে সে প্রকাশ কর্ম বা অবস্থার বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। যেভাবেই হোক না কেন, তাকে জানতে না পারলে ঈমান অর্জিত হয় না এবং তার মর্মার্থও বোঝা যায় না।
বস্তু মাত্রই আল্লাহ্্র প্রকাশিত হবার আধার। আল্লাহ্্ তাতে প্রকাশিত হন। তা উপলব্ধি করতে জ্ঞান বুদ্ধি বিমূঢ় হয়ে যায়। তাহলে এ বিমূঢ়তা থেকে বাঁচার উপায় কী? অথচ সকল বস্তুতে আল্লাহ্্র প্রকাশ জরুরি এবং অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রত্যেক বস্তুই আপন আপন গুণাবলিসহ বর্তমান। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি বস্তু আল্লাহ্্র গুণাবলি সহকারে বিদ্যমান। তিনি যখন ইচ্ছা করেন, যে কোনো বস্তুর মধ্যে প্রকাশিত হন। যখন যে বস্তুর মধ্যে তিনি প্রকাশিত হন, তখন সে বস্তুর রূপ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার প্রকাশ সংঘটিত হয়। আল্লাহ্্ তা’য়ালা পবিত্র কোরানে বলেন, সূরায়ে তোয়াহায়Ñ هل آتك حديث موسى اذا رأى نارا (হাল আতাকা হাদীসু মূসা ইযা রায়া নারান) অর্থাৎ, হে মুহাম্মদ তোমার কাছে কি মূসার সংবাদ পৌঁছেছে যখন সে আগুন দেখেছিল? فقال موسى لاهله امكثوا إني أنست نارا (ফাকালা মূসা লিআহ্লিহী ইম্কিছু ইন্নি আনাস্তু নারান) অর্থাৎ, তখন মূসা অনুগতদের বললেন যে, তোমরা এখানে দাঁড়াও অবশ্যই আমি আগুন দেখেছি।لعلى آتك منها بقبس او اجد علىالنار هدى (লায়াল্লা আতাকা মিনহা বিক্বাবাছিন আও আজিদু আলান নারি হুদা) অর্থাৎ, সম্ভবত আমি আগুন থেকে পথের সন্ধান পাব।فلما اتها نودي ياموسى اني آنا ربك فاخلع نعليك انك بالوا دا لمقدس طوى (ফালাম্মা আতাহা নূদিয়া ইয়া মূসা ইন্নি আনা রাব্বুকা ফাখলা’আ না’ আলাইকা ইন্নাকা বিলওয়াদিল মুকাদ্দাসি ত্বাওয়া) অর্থাৎ, অতঃপর যখন আগুনের কাছে এল, আওয়াজ এল, হে মূসা! আমি তোমার প্রভু, তোমার পা থেকে জুতা খোলো, অবশ্যই তুমি পবিত্র ও কল্যাণকর ময়দানে রয়েছ।وآنا اخترتك فاسمع لمايوحي أنى انا الله لا اله الا آنا فاعبدنى ( (ওয়ানাআখতারতুকা ফাছমায়া লাম্মা ইউহা ইন্নানি আনাল্লাহু লাইলাহা ইল্লা আনা ফা’ বুদুনি) অর্থাৎ, আমি তোমাকে নির্বাচিত করেছি, তোমার প্রতি যে অহি অবতীর্ণ করা হয়, তা তুমি শোনো অবশ্যই আমি তোমার প্রভু, আমি ছাড়া অন্য কোনো প্রভু নেই, তুমি আমার ইবাদত করো। আগুন মূসা (আঃ)-কে ডেকে বলল, হে মূসা! আমিই তোমার প্রভু! এখানে ‘আগুন’ অর্থ তো অন্যকিছু করা যায় না বস্তুত এটা আল্লাহ্্র বহু ধরনের প্রকাশ রীতির একটি। অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুতে এবং রূপে তার সত্তা থেকে প্রকাশিত হয়। সুতরাং যে বা যে বস্তুতে তা প্রকাশিত হয়, তখন তারই আলোকে এবং বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত হয়। আর যার সামনে প্রকাশিত হয়, তার জ্ঞান অনুযায়ী কথা বলে। মানুষের সামনে প্রকাশিত হলে মানুষ স্বীয় যোগ্যতার মাপকাঠিতে তা উপলব্ধি করে আর জীবজন্তু, জলীয়, বায়বীয়, আগ্নেয় বা মৃত্তিক বস্তুতে প্রকাশিত হলে তারাও নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী সে প্রকাশ সম্পর্কে জানতে পারে। তবে সত্যের প্রকাশ সদা সত্য হয় এবং প্রত্যেক প্রকাশের ফলাফলের প্রভাব চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে উভয় জগৎ হৃষ্টপুষ্ট হয়। তারই ফলশ্রুতিতে কল্যাণ ও অকল্যাণ জগৎময় বিস্তার লাভ করে। কারণ হযরত মূসা (আঃ)-এর সামনে প্রকাশিত আল্লাহ্্র আগ্নেয় রূপ অনেকটা সাদাটে ছিল। লালের মধ্যে এ সাদাটে অবস্থা শুভ লক্ষণ। এ কারণে ঘটনাটি যে স্থানে সংঘটিত হয়, তাকে আল্লাহ্্ পবিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। সময় বিশেষে এ প্রকাশ রঙহীনভাবেও সংঘটিত হয়। তবে এ রঙহীনতা এমন একটি মৌলিক বস্তু যা বহু রঙের সার। বস্তুত সে রঙ সমস্ত রঙের চেয়ে উত্তম। তাতে রঙহীনভাবে আল্লাহ্্র প্রকাশ ঘটে। মোট কথা, আল্লাহ্্র সত্তা কোনো বিশেষ রঙ বা রূপে সীমিত নয়। আল্লাহ্্ সমস্ত রঙ-রূপের উৎস যেখানেই যে রূপ দেখা যাক বা অনুভূত হোক না কেন, সবই তার থেকে। যেমন দোয়াতের কালি থেকে সমস্ত অক্ষরের সৃষ্টি, এমন কোনো অক্ষর বা বাক্য নেই যা দোয়াতের কালি থেকে সৃষ্টি হয় না। রাম অথবা রহিম বাক্য অথবা হ্যাঁ-বাচক অথবা না-বাচক সবই দোয়াতের কালি থেকে সৃষ্টি হচ্ছে। তাই কালি এবং কালির জ্ঞান প্রমাণের জন্য অপর দোয়াত এবং প্রকৃত বা মৌলিক কালির প্রয়োজন।
অতএব যেহেতু একটির জন্য অপর একটির প্রয়োজন হয়, সেহেতু যা প্রয়োজন তার অস্তিত্ব অনিবার্যরূপে জরুরি। সে অবশ্যম্ভাবী সত্তা তথা আল্লাহ্্র অস্তিত্ব ছাড়া কোনো অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব নেই যার বদৌলতে অপর কোনো অস্তিত্বহীন বস্তু অস্তিত্ব লাভ করতে পারে। ওয়াজিব বা অনিবার্য সত্তা বলতে সে আদি সত্তাকে বোঝায়, যা সকল বৈশিষ্ট্যের ও গুণের আধার। এটা সৃষ্টিগুণ। এ গুণের বদৌলতে সমস্ত সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে। এটাকে সৃষ্টি জ্যোতি বলা হয়। এ জন্য হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে প্রকাশ বৈশিষ্ট্য এবং শাব্দিক ভাষায় কথা বলা হয়েছে। বস্তুত তা ছিল একটি শ্বেত রঙের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। কিন্তু এটা প্রকাশের আধার। এ কারণেই অপ্রত্যক্ষ ক্রিয়া ব্যবহার করে ডাকা হয়েছে। কিন্তু বাহ্যত তা আগুন হলেও বস্তুতপক্ষে তা জাত বা মৌল সত্তা। সকল বস্তুতে আবিষ্ট মৌলসত্তাই বস্তুর অভ্যন্তরীণ সত্তা। আর সকল বস্তুর অভ্যন্তরীণ সত্তা আল্লাহ্্র প্রকাশ সত্তা অর্থাৎ আল্লাহ্্ সকল বস্তুর অভ্যন্তরীণ রূপ এবং আল্লাহ্্র অভ্যন্তরীণ রূপ সকল বস্তুর প্রকাশরূপ। তবে স্রষ্টার প্রকাশের আধার সৃষ্টি আর সৃষ্টির প্রকাশের উৎস স্রষ্টা। উদাহরণস্বরূপ বীজের মধ্যে লুপ্ত ও সুপ্ত বৃক্ষ বীজের অভ্যন্তরীণ রূপ। আর এখনও ফলন হয়নি এরূপ বৃক্ষের ফল ও বীজ উহার অভ্যন্তরীণ রূপ। তবে যে বস্তুর মাধ্যমে কোন বস্তু জন্মায় তা সে বস্তুর আধার। যেমন ডাল থেকে ফুল বের হয়। এখানে ডাল ফুলের প্রকাশস্থল। এ যা পার্থক্য। অন্যথায় বস্তুতপক্ষে কোনো কিছুই স্বয়ম্ভু সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই তো হযরত ওয়ালী উল্লাহ্ (রঃ) ‘কাউলুল জামিল’ এ লিখেছেন, চিশ্তিয়া মাশায়েখগণ বলেন, পীরের ফায়েজ লাভ করার প্রধান শর্ত হল মহব্বত ও শ্রদ্ধার সাথে নিজের অন্তরকে মুর্শিদের সাথে যুক্ত ও জড়িয়ে রাখা এবং তার চেহারার ধ্যান করা। আমার কথা হল, আল্লাহ্্র প্রকাশস্থল অসংখ্য। তাই কোনো আবেদ বিজ্ঞ বা বোকা হোক, তিনি তার সামনে প্রকাশিত হয়ে স্বীয় মর্যাদা অনুযায়ী তার মাবুদের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। এ কারণে কেবলামুখী হওয়া এবং আরশে অধিষ্ঠানের কথা শরিয়তে বৈধ। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, তোমরা কেউ যখন নামায পড়, তখন সরাসরি নিজের সামনের দিকে থুথু ফেলবে না। কারণ আল্লাহ্্ তাঁর ও তাঁর কেবলার মাঝখানে থাকেন। অথচ আল্লাহ্্ তা’য়ালা কোন দিকে বা মধ্যে অবস্থান করা থেকে পবিত্র। তা সত্ত্বেও হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ্্ কেবলা ও নামাজির মধ্যবর্তী স্থানে বর্তমান। অপর দিকে বাহ্যিক দৃষ্টিবানরা অনুমান করে লিখেছেন যে, আল্লাহ্্র দিকপাশ বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ এবং রঙ রূপ কিছুই নেই। এখন লক্ষ্যণীয়, যখন বলা হয় যে, আল্লাহ্্ এক এবং বস্তুত তা একটি জাত বা সত্তা, তখন এক বলার সঙ্গে সঙ্গে এর ছটি দিক তথা চার দিক এবং ঊর্ধ্ব ও অধঃ অবশ্যম্ভাবীরূপে আসে। এ ছয় দিক বাদে ‘একের’ অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তাহলে এখানে আধার বা আধেয় তথা কোন স্থানে আল্লাহ্্র অবস্থান বোঝা যায়। এতে আল্লাহ্্র সত্তার থেকে স্থান অধিক বড় বলে প্রমাণিত হয়। হাদীস শরীফের বক্তব্য যে, আল্লাহ্্ কা’বা ও মুসল্লির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এতেও আধার ও আধেয় এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থ থাকা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়। তাছাড়াও হাদীসে প্রমাণ আছে যে, আল্লাহ্্ আরশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং কিয়ামতে প্রেমিকরা তাঁর দিদার লাভ করবে। বস্তুত হাদীসে আল্লাহ্্ তা’য়ালার অবস্থানের কথা উপমা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্্র অসীম শোভা সৌন্দর্য চাঁদ থেকেও উজ্জ্বলতর অনুভূত হবে। আর আল্লাহ্্ তা’য়ালা যখন তাঁর প্রেমিকদের সামনে আপন হাঁটু প্রকাশ করবেন, তখন তাঁর প্রেমিকরা এর শোভা-সৌন্দর্য দেখে বেহুঁশ হয়ে যাবেন। আল্লাহ্্র এ উপমারূপ তাঁর প্রকাশ বৈশিষ্ট্য ছাড়া আর কী? এ কারণেই সাদৃশ্যতাহেতু কিয়ামতের দিন মানব পদাংশ হাঁটু তাদের দেখাবেন।

কবর জিয়ারত প্রসঙ্গ
জিয়ারত অর্থ কবরস্থ ব্যক্তির সাথে রূহানী সাক্ষাৎ। মানুষের চিরন্তন রূহানী সম্পর্কটা কবরেও বর্তমান থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটি রূহ্সমূহের একটি জাত। রূহ্সমূহ জাতি সত্তায় সূক্ষ্ম প্রকৃতির। তাই যে কোনো জগতে তার বিচরণ সম্ভব। বস্তুত ‘রূহ্’ সৃষ্টি রহস্যের অন্যতম। তবে সকল রূহের চেতনা শক্তি এক নয়। উপলব্ধির ক্ষমতা অনুযায়ী উপলব্ধি ও বুদ্ধির তারতম্য হয়, সে অনুযায়ী জ্ঞানলাভ হয়। কিন্তু উপলব্ধির ক্ষমতা কম হোক বা বেশি হোক, যে কোনো সময় প্রকাশ পায় না। স্বীয় অবস্থার প্রেক্ষিতে তা প্রকাশিত হয়। আল্লাহ্্ তা’য়ালার জ্ঞানের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। কারণ স্বীয়সত্তায় লুপ্ত এবং অপ্রকাশিত বস্তুর জ্ঞান তার প্রকাশ লাভের পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্য ইন্দ্রিয়ের আওতায় আসে না। যে বুদ্ধির জোরে যে যে জ্ঞান লাভ হয় এবং যে জ্ঞানের শক্তিতে যে বস্তুর সৃষ্টি হয় তাকে মাখলুক বলা হয়। তবে আল্লাহ্্ তা’য়ালার প্রকাশ জ্ঞান সর্বোত্তম। এ শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আল্লাহ্্র উত্তম গুণাবলির অন্যতম প্রকাশ মর্যাদা আল্লাহ্্র জন্য প্রযোজ্য। তাই আল্লাহ্্ বলেন, والله آحسن الخالقين ( (ওয়াল্লাহু আহ্সানুল খালিকিন)। মোট কথা কোনো বস্তুই মৃত নয়। পয়গাম্বর (আঃ)-দের বাণী এর প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে মাওলানা রুমী মসনবীতে বলেন,
“খাক ও আব ও বাদ ও আতশ মোরদা আন্দ
বা আমান ওয়াতু অলীয়ে বা হক্ব জিন্দা আন্দ।”
অর্থাৎ, তোমার নিকট মৃত বস্তুও আল্লাহ্্র কাছে জীবিত। সুতরাং যে বস্তুর মধ্যে মৃত অবস্থায়ও জীবনী শক্তি বর্তমান থাকে, সে বস্তু ভিন্ন স্থানে চিরঞ্জীব। এ কারণে রূহ্সমূহকে আল্লাহ্্র রহস্য বলা হয়। এ জন্যে সমস্ত জগতে রূহ্সমূহে প্রকাশ ব্যাপ্ত থাকে। কবরেতে ভালোভাবেই বর্তমান থাকে। কারণ কবর হল প্রকাশের দ্বিতীয় মাধ্যমের আরম্ভ। দুনিয়া হল রূহের প্রথম প্রকাশস্থল। আর পরলোক দ্বিতীয় স্তর। অর্থাৎ হাশর এবং কিয়ামতের প্রথম স্তর হল কবর। সুতরাং যে ব্যক্তি কবরের কাছে গেল, সে তো কবরবাসীর মৌলসত্ত্বার কাছে পৌছে গেল এবং শান-শওকাত ও পুর্নতার কাছাকাছি হল। কবরবাসীর প্রকাশের মর্যাদা এবং ইচ্ছা ও সত্তাগত পরিপূর্ণতা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ধরনের হয়ে থাকে এবং কবরবাসীর মানবীয় পর্দা থাকে না। অধিকন্তু বস্তুজগৎ তার কাছে সুস্পষ্টরূপে উদ্ভাসিত হয় এবং وفى انفسكم آفلا تبصرون (ওয়াফি আনফুছিকুম আফালা তুবছিরুন) অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যেই রয়েছে তোমরা কি অবলোকন করতে পারছ? এ কথার মর্মার্থ তখন তার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায়। অতএব উক্তরূপ অবস্থাসমূহে আল্লাহ্্র অবস্থান মুখ্য বা প্রধান এবং বান্দা সেখানে গৌণ। তাই এ সময় তাঁদের নৈকট্যে ও আল্লাহ্্র নৈকট্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এখানে নৈকট্যের হেতু হল মৌল বস্তু। এজন্যই সরহে বরজখে বলা হয়েছে, ,إذاتحير تم فى الأمور فاستعينها باهل القبور (ইযা তা হাইয়ার তুমফিল উমরি ফাসতাইনুহাবি আহ্লিল কুবুরী) অর্থাৎ, তোমরা যদি কোনো বিষয়ে হতাশ হয়ে যাও তাহলে কবরবাসীর মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। অর্থাৎ, কবরবাসী এবং কবর জিয়ারতকারীর মধ্যে স্বজাত্বত্য বর্তমান। এ কারণে আল্লাহ্্ওয়ালাগণ কবর থেকে এমন ফায়েজ লাভ করে থাকেন, যা কেউ দেখেনি বা শোনেনি। এজন্য নবী করীম (সাঃ) প্রত্যেক বছরের শুরুতে কবরস্থানে গমন করতেন। কবরবাসীদের সালাম প্রদান করতেন। তাদের সাথে কথা বলতেন এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতেন। কবরবাসীর সুখে তিনি সুখী হতেন আর তাদের দুঃখে তিনি দুঃখী হতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন। তিনিও নূরানী কবরবাসীর দ্বারা আলোকিত হতেন। যেমন সুগন্ধী বস্তু অপরকে আনন্দিত করে এবং আলোকিত করে প্রদীপ অন্যদের। অনুরূপভাবে নবীগণ অন্যান্য নবী-অলীদের ফায়েজ ও নিয়ামত দান করেন এবং নবী-অলীদের কাছ থেকে ফায়েজ রহমত এবং বরকত লাভ করেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য যে, হযরত বারখ্ (রঃ)-এর কাছ থেকে হযরত মূসা (আঃ) আরাম লাভ করেন। এ ঘটনা ‘এহ্ইয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থে হাদীস শরীফের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবাদ আছে, “লাভ ছাড়া ব্যবসা নেই।” নবী-অলীদের কবরের ন্যায় তাঁরা যে স্থানে বসেন তাতেও ফায়েজ ও উপকারিতা সদা বর্তমান। কবর ও বসার স্থানের পার্থক্য হল যে, কবরে তাঁরা কবরস্থ আর বসার স্থানে তাঁরা রূপক অর্থে বর্তমান। তবে ভিতরের বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব ক্ষমতায় উভয়ই পরিপূর্ণ। কবরের ন্যায় তাতে ফায়েজ ও রহমত বর্তমান। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ্্র অলীদের তিন সময়ে রহমত অবতীর্ণ হয়। কথা বলার সময়, পানাহারের সময় এবং যে স্থানে বসে তাঁরা আরাম করেন। কারণ তাঁদের বিশ্রামস্থল আল্লাহ্্র স্মরণের জায়গা। আর সে জন্যই নূরময় কবর জগদ্বাসীর জন্য রহমতের স্থান। আল্লাহ্্র ঘনিষ্ঠ ফেরেশতা ও রূহ্সকল তাঁকে সদা সম্মান করে থাকেন। এ কারণে শহর গ্রামের সকল লোক নবী-অলীদের কবর ও বিশ্রামস্থলকে সম্মান করে আসছেন। এ সব মাজার থেকে অনেকেই ব্যক্তিগত উপকার এবং আত্মিক প্রেরণা লাভ করছে। যদিও অযোগ্য অধমরা এ রহস্যের বিরোধী। নিয়ম হল যে ব্যক্তি যে বিষয়ে অজ্ঞ, সাধারণত সে ব্যক্তি ঐ বিষয়ে বিরোধী হয়ে থাকে এবং আশ্চর্য মনে করে। বিশেষ করে বাংলার কোনো কোনো অঞ্চল বিরোধিতার ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে তারা আল্লাহ্্ তা’য়ালার রহমত থেকে বঞ্চিত। আল্লাহ্্ যেন তাদের দৃষ্টিশক্তি দান করেন। সত্যানুসারীগণ কবর জিয়ারতের দ্বারা প্রথমত সফলতা, প্রভাব ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার অবলম্বন লাভ করেন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা ঐশীজ্ঞান দ্বারা উপকৃত হন। অর্থাৎ, কবরস্থ ব্যক্তির কাছে পরিস্ফুট বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা জানতে পারেন। তৃতীয় পর্যায়ে তারা মহামিলনে কামিয়াবি অর্জন করেন, যার সাথে কবরবাসী পুরোপুরি সম্পৃক্ত। চতুর্থ পর্যায়ে তারা আল্লাহ্্র মৌলগুণ তথা জ্ঞান যা বস্তুকে বেষ্টন করে আছে, সে সম্পর্কে অবহিত হন। এ কারণে সর্বদা নবী-অলীদের মাজারে ফেরেশতাগণ এবং রূহ্গণের নূর-উজ্জ্বলতা সক্রীয় থাকে, যেন এখান থেকে আল্লাহ্্র সৃষ্টিজগৎ বরকত লাভ করতে পারে। যোগ্য ব্যক্তিগণ এ সব মাজার থেকে নিজেদের জন্য বরকত সংগ্রহ করে থাকেন। দুনিয়াতে যার এতো উপকারিতা, তাঁর পরকালীন উপকারিতা সম্পর্কে আর কী বলব? লক্ষ কর, তোমরা যদি বিচক্ষণ লোক হও দেখতে পাবে, অলীদের মাজারে আরও লাখো সম্পদ রয়েছে। প্রথমত, জাগতিক বিষয় এবং উপকারিতার কথাই ধর, এ দরবারে আল্লাহ্্র তরফ থেকে কত রকমের খাদ্য ও সরঞ্জাম জমা হয় এবং তা দ্বারা আল্লাহ্্র সৃষ্টি জীবন ধারণ করে। এখানে বিভিন্ন ধরনের উপহার-উপঢৌকন সদা বিতরণ হচ্ছে। আদব এবং সম্মান প্রদর্শনের কারণেই এ কল্যাণ লাভ হচ্ছে। আউলিয়ার মাজারে গম্বুজ ছাদ ও দেয়াল তৈরির দ্বারা আদব রক্ষিত হয়। গেলাফ এবং চাঁদোয়াতে শোভা বৃদ্ধি পায়। ঝাড় এবং পর্দা তার সৌন্দর্য বাড়ায়, ফুল এবং চন্দন তাতে সুগন্ধী ছড়ায়। এ সব কাজই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বর্তমানেও অনেক সাহাবি এবং নবী, অলী ও শহীদের মাজারে প্রাসাদ, গম্বুজ ও ছাদ নির্মিত আছে। আমাদের প্রমাণের জন্য এগুলোই যথেষ্ট। হুজুরে পুরনূর মহানবী (সাঃ)-এর মাজারে প্রদীপ ও আলোবাতি সদা জ্বলছে। আমরা এর চেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ আর কী চাই? যদি বলা হয় যে, এটা শুধু নবীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য, তাহলেও বিরোধ কোথায়? এটা যে শুধু নবীর জন্যই প্রযোজ্য বা বৈধ তা কি কোনো কিতাবে উল্লেখ আছে? এ বৈধতা যদি কেবল তাঁদের জন্যই হয়, তাহলে এর পক্ষে প্রমাণ থাকা প্রয়োজন ছিল। তাহলে কেন যারা নবী নন তাঁদের কবরে হাজারো গম্বুজ এবং ছাদ রয়েছে?

এসব মাজারে গম্বুজ ও প্রদীপ, বাতি না থাকলে আজ লোকে তাঁদের কিভাবে চিনত? এবং কিভাবে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত? এসব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে কে সেখানে যেত? কেউ যদি আপত্তি করে বলে যে, ফেকার কিতাবে এসব বেদ’আত বলা হয়েছে। কারণ এগুলো নবী করীম (সাঃ)-এর পর নতুনভাবে প্রচলিত হয়েছে। তার উত্তর হল, স্বয়ং ফেকার কিতাবগুলোও তো বেদ’আত। কারণ নবী করীম (সাঃ)-এর পরে ফেকার কিতাবগুলোর নাম চালু হয়েছে। যথাÑ আলমগীরী, শরহে বেকায়া, হেদায়া, কাজী খান প্রভৃতি। এ সব কিতাবের নাম তো নবী করীম (সাঃ)-এর সময়ে রাখা হয়নি। তাই স্বয়ং নিজেরাইতো বেদ’আত। এরা অন্যকে কিভাবে বেদ’আত আখ্যা দিবে? এ বিষয়ে আরও বেশি বুঝতে হলে ‘রওশনে দ্বীন’ পাঠ করুন। তবে ফেকার কিতাবেও কবরে গম্বুজ এবং ছাদ তৈরি করা বা কবর পাকা করা বৈধ বলা হয়েছে। ‘মাজমাউল বাহার’-এর দ্বিতীয় খন্ডে আছেÑ وقد أباح السليف ان يبنى على قبو رامشائخ وا لعلما إلمشاهير ليزور هم الناس ويستر جونه بالجلوس فيه (অকাত আবাহাছ সালিফু আই ইয়াবনা আলা কবুরীল মাসায়েখী ওয়া আল ওলামাইল মাশাহিরে লে ইয়াজুরু হুমুন নাছু ওইয়াস্তার জুনাহ বিল জুলুসি ফিহি) অর্থাৎ, পূর্বসুরিগণ বুজুর্গ এবং প্রখ্যাত আলেমদের কবর পাকা করাকে বৈধ মনে করেন, যাতে জনসাধারণ জিয়ারত করতে পারে এবং তাহাতে বসে শান্তি কামনা করতে পারে। ‘রূহুল বয়ান’-এর লেখক শায়েখ আব্দুল গণি নাবেলুসীর ‘কাসফুনুর’ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ان البدعة الحسنات المؤفقة المقصود الشرع يسمي مسنة فبناء القباب على قبورا لعلماء ولأولياء والصاحاء أمرجائز – اذا اكان القصد بذالك التعظيم فى عين العامة لا يتحقرا صحاب هذا القبر – – (ইন্নাল বিদায়াতাল হাসানাতাল মোয়াফিকাতুল মাকসুদুস্ শরায়ে ইউসাম্মা মুসান্নাতুন ফা বানাউল কো’বাবি আলা কুবুরিল ওলামায়ী ওয়াল আউলিয়ী ওয়াস সোলাহায়ী আমরুন্ জায়েজুন, ইযা কানাল কাছদু বিযালিকা তাজিমু ফি আইনিল্ আম্মাতি লা তাহ্কিরু আসহাবু হাযাল কুবুরে।) মোটকথা বেদ’আত হাসানা তথা ভালো বেদ’আত নীতিগতভাবে শরিয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ জন্য একে সুন্নাত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং আলিম, অলী এবং পুণ্যবানদের কবরে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশে মিনার ও গম্বুজ নির্মাণ করা বৈধ। তবে সাধারণ কবরবাসীদের কোনো প্রকার অসম্মান করা যাবে না। যেহেতু নবী-অলীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব, সেহেতু এর অন্যথা করা হারাম। অপরদিকে তাঁদের মাজারে দেয়াল পাকা না করা হলে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অসম্ভব। এমতাবস্থায় এসব নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং রাস্তা বা চারণভূমিতে পরিণত করা হারাম এবং নিষেধ হবে না কেন? বরং এটা হবে সে বুজুর্গের সাথে প্রকৃত দুশমনি। কারণ অনুরূপ অপমানজনক আচরণ করলে তাঁদের কষ্ট হবে। বস্তুত সম্মান প্রদর্শনের অর্থ ও উদ্দেশই হল আরাম এবং শান্তি। আর বেয়াদবী হল এর বিপরীত। বেয়াদব ব্যক্তি কাফির, ফাসিক ও জাহেল হয়ে থাকে। ফরয ইবাদত অমান্যকারী কাফির। ওয়াজিব অমান্য করলে হয় ফাসিক। আর নফল অমান্যকারী হয় জাহেল। কিন্তু যে এ তিনটি কাজের মূল ও উৎস তার সাথে বেয়াদবী করা কুফরির চেয়েও খারাপ। অর্থাৎ যে ব্যক্তিত্ব থেকে দ্বীন ও ঈমানের সৃষ্টি বা অর্জন হয়, তাঁর সাথে বেয়াদবী করা কুফরির চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ। এজন্য আপন অলীর সাথে বেয়াদবী করা তার জন্য অধঃপতনের আলামত। আর শত্রুতার বসে তা যদি করা হয়, তাহলে তা কুফরির চেয়েও জঘন্যতম। কারণ তাঁদের কাছ থেকে তার যে, নিয়ামত দ্বীন ও ঈমান লাভ হচ্ছিল তা তার আদব ও সম্মান প্রদর্শনেরই ফল। বেয়াদবী করার সাথে সাথে তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। বেয়াদবী এবং বদআমল ছাড়া অন্য কিছুই হৃদয়ের ঈমানকে বাতিল করতে পারে না। কারণ বেয়াদবীর ফলে আন্তরিকতার মূলোচ্ছেদ হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছেÑ من عاد لولىفاذن له يحرب من الله ورسوله (মান আ’দালি ওয়ালিয়্যিন্ ফাউযযেনা লাহু ইয়্যাহ্রিবা মিনাল্লাহে ওয়ারাসূলিহি) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো অলীর সাথে দুশমনি করে তাকে বলো, সে যেন আল্লাহ্্ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়। এজন্য আদব এবং কবরের আচার বিধি সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেÑ عن ابى هريرة قال قال رسول الله صلعم ان يجلسا حدكم على جهرة فتحرق ثيابه فتخلص الي جلده خيرله من ان يجلس على قبر رواه مسلم (আন আবি হুরাইরাতা (রাঃ) ক্বালা রাসূলাল্লাহি (সাঃ) আই ইয়াজলিসা আহাদুকুম আলা জাহ্রাতিন্ ফাতাহাররাকা ছিয়াবাহু ফাতাখ্লাসা ইলা জিলহিদী খাইরুল্লাহু মিন আইআজলিসা আলা কা’বারিন্ রাওয়াহু মুসলিম) অর্থাৎ, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন যে, তোমাদের কেউ যদি আগুনের ফুল্কির উপর বসে আর সে আগুন যদি কাপড় পুড়ে চামড়া পর্যন্ত স্পর্শ করে তা ও কবরের উপর বসার চেয়ে উত্তম। অন্য হাদীসে আছে, “মৃতের হাড় ভাঙা জীবিত লোকের হাড় ভাঙার সমতুল্য।” এর দ্বারা মৃতের প্রতি আদব এবং সম্মান বোঝা যায়। এ কারণে কবরে পদচারণা নিষিদ্ধ। সুতরাং কবরের উপর বসা এবং উপর দিয়ে হাঁটা ও কবরকে চারণভূমিতে পরিণত করা নিষিদ্ধ, সেহেতু উহার হেফাজত করা আবশ্যক। এখন এ আবশ্যকতা ওয়াজিব বলে গণ্য হবে। কারণ আদবের প্রতিপাদ্য ওয়াজিব। বেষ্টনী ছাড়া কবরের আদব রক্ষা করা সম্ভব নয়। বেষ্টনীর জন্য দেয়াল প্রয়োজন। সুতরাং আল্লাহ্্ওয়ালাগণ গম্বুজ ও দেয়ালযুক্ত মাকবারা বা সৌধ পছন্দ করেন। যেন বুজুর্গদের প্রতি সম্মান সদা বহাল থাকে।
কোনো কোনো জাহেরীপন্থী এ কাজ মাকরুহ লিখেছে। এর উদ্দেশ নিজের নাম জাহির করা অথবা অন্য কিছু। বর্তমানে জাহেল সম্প্রদায় যে মৃতকে কুকুরের মতো মাটিতে পুঁতে দেয় এবং তাতে বেড়া না থাকার দরুন পেশাব-পায়খানা করা হয়, এটা হারাম নয় তো কী? দাফনের সময় কবরের উপর খড়কুটো দিয়ে মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়। তার উপর মাদুর চাটাই লাগানো হারাম মনে করা হয়। আর দু-চার জন মিলে পা দিয়ে দাবিয়ে চলে যায়। এর চেয়ে জঘন্য আর কী আছে? অথচ সকল জীবিত ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল মৃত ব্যক্তির প্রতি আদব ও সম্মান দেখানো। এমনকি সর্বদা নবী-অলীদের মাজারে গমনাগমন করা। কারণ এটা রহমতের স্থান। সদা সেখানে উপহার উপঢৌকন পাঠাবে এবং সেখানে এসব বিতরণ করবে। এতে পরিপূর্ণ আত্মিক প্রতিক্রিয়া বর্তমান। নৈকট্যপ্রাপ্ত রূহ্সমূহ আহার ও বণ্টনে সীমাহীন সন্তুষ্ট হন। যদিও অজ্ঞ সম্প্রদায় এ কাজের বিরোধী তাতেও কোনো পরোয়া নেই। একজন অলী যদি সন্তুষ্ট হন, তাহলে শত মূর্খের কী পরোয়া? এসব বিষয় যদি প্রমাণ দেখতে হয়, তাহলে ‘আনওয়ারে সাতেয়া’ যাতেÑ মক্কা মোয়াজ্জেমা ও মদিনা মনোয়ারা এবং হিন্দুস্থানের বড় বড় আলেমগণ দরবেশ এবং আহ্লে বাতেনের দস্তখত ও মতামত রয়েছে দেখুন। বেশি লেখার প্রয়োজন নেই। যার অন্তর চক্ষু আছে সে নিজেই কবরের অবস্থা জেনে যাবে। তার জন্য কোনো দলিল প্রয়োজন নেই। অজ্ঞাত বস্তুর জন্য প্রমাণ প্রয়োজন হয়। জ্ঞাত বিষয়ে দলিল চাইতে হবে কেন? যেমনÑ স্বপ্ন দেখার দলিল কী? বস্তুত স্বপ্ন বাস্তবিক পক্ষে যে দেখে তার কাছে সত্য, যদিও এর অর্থ বিভিন্ন হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে স্বাদেরও কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু স্বাদগ্রহীতা তা জানেন। সদাসর্বদা দলিলের দাবিতে অটল থাকা আর এর আলোচনায় নিজের অবস্থার কথা ভুলে যাওয়া গোমরাহি। দলিল প্রমাণের দাবি-দাওয়ায় নফ্স খুশি হয়। এজন্য যারা দলিল প্রমাণের পিছনে লেগে থাকে সব সময় তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে এবং নফ্স মাওলার সন্ধানে নারাজ হয়। এ কারণে তার মধ্যে অশান্তি ও দুঃখ বিরাজ করে।

ইবাদতের তাগিদ ও গুরুত্ব
ইবাদতের তাগিদ, গুরুত্ব এবং ইবাদতের সমাপ্তি ও মারেফতের ফলাফল কোরানের বাক্য দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছেÑ واعبد ربكحقى يا قيك اليقين (ওয়াবুদু রাব্বুকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াকিন) অর্থাৎ, “বিশ্বাস তথা পরিপূর্ণ বিশ্বাস অর্জিত হওয়া পর্যন্ত ইবাদত কর।” অর্থাৎ, যথার্থ বিশ্বাস বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করা পর্যন্তই কেবল ইবাদত দরকার। তারপর থেকে পরম সত্তার প্রকাশ প্রত্যক্ষণ শুরু হয়। যদিও এটা যথার্থ বর্ণনা নয় তবুও এ থেকে পরম সত্তার নিদর্শনাদি পরিলক্ষিত হতে থাকবে। কিন্তু বিশ্বাস হওয়া পর্যন্ত ইবাদত করÑ এ কথা দ্বারা যদি সামগ্রিক বিশ্বাস বোঝানো হয়েছে বলে ধরা হয়, তাহলে বিশ্বাসের পূর্বে ইবাদতের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এটা অসম্ভব ও অযৌক্তিক। এতে বোঝা যায়, অন্তরের বিশ্বাসের বিভাগ আছে। বিশ্বাসের বিভাগ সম্পর্কে কোরান ও অন্যান্যতেও উল্লেখ আছে। যথাÑ ‘ইল্মুল ইয়াকিন’ (জ্ঞানগত বিশ্বাস), ‘আইনুল ইয়াকিন’ (চাক্ষুষ বিশ্বাস) ইত্যাদি। এ আইনুল ইয়াকিন চাক্ষুষ বিশ্বাসের বস্তুই উভয় বিশ্বাসের অধীনে ইবাদতকে বাধ্যতামূলক করেছে। এজন্যই এ ক্ষেত্রে আদেশমূলক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। এরূপ না হলে ঈমান ছাড়াই ইবাদত হওয়া সাব্যস্ত হত। এ ইবাদতের সমাপ্তি পরিপূর্ণ বিশ্বাস বা ঈমান অর্জন পর্যন্ত সীমিত। আর এটাই ‘হাক্কুল ইয়াকিন’ বা যথার্থ বিশ্বাস।

ইয়াকিন বা বিশ্বাসের বিভাগ
ইয়াকিনের বা বিশ্বাসের বিভাগ কোরান দ্বারা প্রমাণিত। যেমনÑ ইল্মুল ইয়াকিন ও আইনুল ইয়াকিন প্রভৃতি। এ জন্য ইহ্সানের গ্রন্থসমূহে ইল্মুল ইয়াকিন, আইনুল ইয়াকিন, হাক্কুল ইয়াকিন প্রভৃতি বিভাগ দেখানো হয়েছে।
ইল্মুল ইয়াকিনের দ্বারা উদ্দেশ হল ইল্মে আহ্ওয়াল তথা গুণগত অবস্থা সংক্রান্ত ইল্ম বা জ্ঞান। এ জ্ঞান দ্বারা কর্মের পরিপূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত ও প্রমাণ পাওয়া যায়। এ হল অবস্থা সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রথম সোপান। আইনুল ইয়াকিন হল এর দ্বিতীয় সোপান। সেটাও গুণাবলির মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটা হল প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুষ আস্থার জ্ঞান। এ ক্ষেত্রে গুণরশ্মির উৎসটা স্বয়ং ধ্যানের আওতায় আসে। হাক্কুল ইয়াকিনও গুণাবলি সংক্রান্ত। তবে এতে পরম সত্তার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা হয়। এটাই ইয়াকিন বা বিশ্বাসের চূড়ান্ত পর্যায়। এখান থেকেই তাওহীদ এবং মিলনের শুরু। এ স্তরে এসে আইনুল ইয়াকিনের এবং তার শাখা-প্রশাখা ও অবস্থাদি সব হারিয়ে যায় এবং পরমসত্তার অবস্থাদি প্রাধান্য লাভ করে। অর্থাৎ, যার অনুরূপ বিশ্বাস লাভ হয় তথা অনুরূপ চাক্ষুষ জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তির কর্ম গুণাবলি এবং সত্তা পরম সত্তার মধ্যে ফানা তথা একাঙ্গীভূত হয়ে যায়। বস্তুত ইরফান তথা প্রত্যক্ষ (চাক্ষুষ) জ্ঞান অর্থ ফানার মধ্যে তথা বিলীনের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। এ অবস্থায় কোনো ধ্যান-ধারণা অবশিষ্ট থাকলে মিলন ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। দৃঢ় বিশ্বাস যদিও ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বের বিষয় তাহলেও তাও গুণগত। বিশ্বাসের প্রকৃত অর্থ তাছদীক বা মনের স্বীকৃতি। প্রকাশিত বস্তু ও গুণাবলির পথ ধরে বিশ্বাস অন্তরে স্থান লাভ করে। তাওহীদের স্তরে অন্তরও ফানা হয়ে যায়। তাহলে বিশ্বাস ফানা না হয়ে থাকে কী করে? বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত কেউ আল্লাহ্্র অলী হতে পারে না।
যখন বিশ্বাসের আভিধানিক অর্থ তাছদিক তথা অন্তরের স্বীকৃতি আর এরপরও কোরান দ্বারা এর বিভাগ প্রমাণিত, তাহলেÑ واعبد ربكحقى يا قيك اليقين (ওয়াবুদু রাব্বুকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াকিন), (বিশ্বাস অর্জিত হওয়া পর্যন্ত তোমার প্রভুর ইবাদত কর) উক্ত আয়াত দ্বারা যদি মৃত্যু বোঝানো হয়, তাহলে এতে বোঝা যায় যে, মৃত্যু বিশ্বাসের শেষ স্তর। মৃত্যু তো কাফির ও ফাসেকেরও হয়। তাহলে মৃত্যুর পর কিভাবে ইরফান তথা আল্লাহ্্ সম্বন্ধে জ্ঞান হবে? তবে যদি এখানে রিপু ও প্রবৃত্তির ওপর বিজয় অর্জন এবং এগুলোর বিনাশ তথা এগুলোর মৃত্যু বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। কারণ প্রকারভেদসহ এর আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। واعبد ربكحقى يا قيك اليقين (ওয়াবুদু রাব্বুকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াকিন) উক্ত আয়াত দ্বারা মৃত্যু অর্থ করা হলে ইরফান তথা প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। ইয়াকিন একটি সাধারণ শব্দ। মানুষ, জ্বিন এবং ফেরেশতা সকলের ক্ষেত্রেই এর অর্থ অভিন্ন। তাছাড়া আল্লাহ্্ তা’য়ালা ইয়াকিনের আওতার বাইরে বলে কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং উক্ত বাক্য দ্বারা মৃত্যু উদ্দেশ হতে পারে না। কারণ মিলনের স্তর বিশ্বাস অবিশ্বাসের অনেক ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ বান্দা যখন পরম সত্তায় একাঙ্গীভূত হয়ে যায়, তখন সে ঈমানের স্তর অতিক্রম করে চলে যায়, যাকে দ্বিতীয় বেলায়েত এবং রহস্যলোক পরিভ্রমণ বলা হয়।
উক্ত অর্থের কোনো কোনো বাস্তব রূপকে আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্টি বলা হয়। মোটকথা এর অর্থ রহস্যাবৃত রহস্য ও উৎসাদির উৎসের অভিন্নতা। উল্লেখ্য, ইবাদত গুণগত পূর্ণতার ফল এবং ইরফান বা প্রত্যভিজ্ঞা হল জাত বা আদি সত্তা সংক্রান্ত। অতএব সত্তাগত ফল লাভের পর তা থেকে সরে গিয়ে গুণাবলির স্তরে ইবাদতে লিপ্ত হওয়া কুফরি। এ জন্য হযরত গাউসে পাক (রঃ) বলেছেন, من اردا لعبادت بعدا لوصال فهو كافر (মান আরাদাল ইবাদাতা বা’দাল্ বিসালি ফাহুয়া কাফিরুন) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি মিলনের পর ইবাদত করতে চায়, সে ব্যক্তি কাফির। যেমনÑ চাবি তালার ভিতর ঢুকে বেরিয়ে না আসলে তা নষ্ট হয়ে যায়। তবে ইরফান এবং ইবাদত এর বাহ্যিক রূপ এবং ছবি একই রকম। যেমনÑ আবেদ, যাহেদ এবং আরেফ প্রত্যেকেই যদি নামাজ আদায় করেন, এর বাহ্যিক রূপ এক ও অভিন্ন হলেও এর উদ্দেশ ও ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য আছে। এ কথার অর্থ এই যে, আরেফ তথা আল্লাহ্্র অলীগণ নামাজ আদায় করেন না, বরং তাঁরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে নামাজ, রোযা প্রভৃতি সম্পাদন করেন, তবে আবেদগণ যেরূপ ত্রুটিপূর্ণভাবে নামাজ প্রভৃতি পড়ে থাকেন সেভাবে নয়। অর্থাৎ, আবেদের ইবাদত গুণ বর্ণনাত্মক আর আরেফের হল মূলের সাথে সম্পৃক্ত। যেমনÑ আবেদ ও আরেফ উভয়ই আল্লাহ্্ শব্দ বলেন, এখানে আবেদের বলাটার রূপ বর্ণনাত্মক, আর আরেফের হল মৌলসত্তা। এজন্যই সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, সকলের মুখ এক সমান নয়। এজন্য এহ্সান এর কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে যে, আল্লাহ্্র অলীগণ যখন আল্লাহ্্র নাম স্মরণ করেন অথবা ‘আল্লাহ্্’ বা ‘হু’ শব্দ উচ্চারণ করেন, তখন তাঁর মধ্যে একটি সুড়ঙ্গ এবং প্রসারণ অনুভূত হয়। অর্থাৎ এক প্রকার ভয়ানক ইঙ্গিত ও গভীর সুখ অনুভূত হয়। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অজ্ঞ এবং শিশু, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে, উক্ত শব্দের মধ্যে এ প্রসারণটা কী ও কেন? বস্তুত এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে আবেদ ও আরেফ এর স্বাতন্ত্র্য পরিচয় বোঝা সম্ভব নয়।
সাধারণভাবে আবেদের নামাজ ইত্যাদি না গুণাবলির বিশ্লেষণাত্মক, না মৌলিক, বরং তাকলীদি তথা নিছক অনুকরণ। এর দ্বারা না শরিয়ত রক্ষিত হচ্ছে, না এহ্সানের দায়িত্ব পালন হচ্ছে। কারণ ঈমান এবং মূল ইবাদতের ক্ষেত্রে কারও তাকলীদ বৈধ নয়। অতএব যে ব্যক্তি প্রকৃত আরেফের সামনে হালাল এবং হারামের দলিলাদি পেশ করাকে ভালো ও পুণ্যের কাজ মনে করে, সে ব্যক্তি সালেক তথা সাধক হলেও আনাড়ি এবং অসিদ্ধ। কারণ আরেফের কাছে খুঁটিনাটি মাসলাগুলো শিশুদের আলিফ-বে-র মতো। তাদের কাছে যদি উপ-মূল বিষয়ের যৌক্তিকতা এবং উপকারিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায় আল্লাহ্্র অলীদের সাথে ঠুকাঠুকি করা কেবল হারামই নয়, বরং অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। লক্ষ করো, আশ্চর্যের কিছুই নেই, স্বয়ং আল্লাহ্্ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, من يجادل فى الله بغير علم فهو يتبع كل شيطان مريد (মাই ইউ জাদিলু ফিল্লাহি বিগাইরি ইলমিন্ ফাহুয়া ইয়াত্তাবিয়ু কুল্লা শাইতায়ানিম মারিদ) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্্র সম্বন্ধে না জেনে আল্লাহ্্র বিষয়ে ঝগড়া করে, সে সকল অবাধ্য শয়তানের তাবেদারী করছে। অর্থাৎ, ফানা, বাকা, পরমসত্তা ও মৌলিকত্ব সম্পর্কে যার জ্ঞান নেই, তার কোন আরেফের সাথে ঝগড়া করার অর্থ শয়তানের তাবেদারী করা।
শরিয়তের নিক্তি
যে পরিমাপযন্ত্র বা নিক্তি নবী-অলীদের দিশারী তা প্রভু বৈশিষ্ট্যের প্রকাশিত ফল। যাকে নূরে হেদায়েত, বিশেষ অবস্থা প্রত্যক্ষণ, এল্হাম এবং সত্যস্বপ্ন প্রভৃতি বলা হয়। তা দ্বারা সকল বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত ও অবহিত হওয়া যায়। তা দ্বারা জানা যায় যা জানবার এবং বোঝা যায় যা বুঝবার। অর্থাৎ, তা এক প্রকার নূর। তা দ্বারা চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি এবং কর্ণের শ্রবণ ক্ষমতা প্রখরতা লাভ করে এবং এতে সকল ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান হয়। এ কারণেই হযরত জিবরাঈল (আঃ) যখন নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে অবতরণ করেন, তখন হযরত (সাঃ) তাঁর লক্ষণ দেখে তাঁকে চিনে নেন এবং বিশ্বাস করেন। তাছাড়া কি প্রমাণ ছিল যে, তিনি জিবরাঈল (আঃ)? অর্থাৎ, আসমানী দূত যখন বললেন যে, আমি জিবরাঈল, তখন নূরে এল্হামী দ্বারা খবর পেয়ে তিনি জিবরাঈল (আঃ)-কে চিনে ফেলেন। এ নূর জন্মগত হলেও মুর্শিদের শিক্ষার ফলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। তবে এর বিভিন্ন বিভাগ ও স্তরভেদ রয়েছে। তা ব্যক্তি বিশেষের প্রেক্ষিতে প্রকাশিত হয়। তাকে অবস্থা বিদ্যার ফল বা নিদর্শন বলা হয়। এটা কোনো দলিল বা প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। এ প্রসঙ্গে জাহেরপন্থীগণ হযরত গাউসে আজম (রঃ)-এর সম্পর্কে একটি কাহিনী বলে থাকে। একদিন ইবলিস তাঁর কাছে এসে বলে যে, আমি জিবরাঈল। আল্লাহ্্ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি এতে আশ্চর্য হলেন এবং বললেন তুমি দাঁড়াও, আমি কিতাব দেখে নেই যে, শেষ নবীর পর কোনো লোকের নিকট জিবরাঈল আসবে কি না! তখন তিনি প্রকাশ্য দলিলাদি পড়ে জানলেন যে, যদি কেউ অনুরূপ বলে, তবে সে শয়তান। এটা দেখার পর তিনি নাউজুবিল্লাহি মিনহা বলতেই শয়তান পলায়ন করে। তখন তিনি বললেন, আজ আমাকে কিতাবী বিদ্যা রক্ষা করেছে। আমি যদি তা না জানতাম, তাহলে শয়তান আমাকে নষ্ট করে ফেলত। আক্ষেপ! ছি! এসব অসাড় কথাকে শরিয়ত মনে করা কী করে বৈধ হয়? চিন্তা করুন হযরত খিজির (আঃ) এসে যদি বলতেন যে, আমি খিজির, তাহলে তার ক্ষেত্রেও কি নাউযুবিল্লাহ্ পড়া হত? অথবা শয়তান এসে যদি বলত যে, আমি জোনায়েদ বাগদাদী বা শাইখ্ আকবর, তাহলে তিনি কোন কিতাব দেখে বলতেন, এটা শয়তান? এর উত্তর কী? এমনকি যদি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) শুভাগমন করতেন, তাহলে তাকে কিভাবে চিনতেন? এ ধরনের অসাড় কথাকে যে কিতাব মনে করে, সে কেন গোমরা বা পথভ্রষ্ট হবে না?
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে স্বপ্নে বা কাশ্ফের মাধ্যমে অথবা জাগ্রত অবস্থায় দেখার সঙ্গে সঙ্গে নবী-অলীদের মধ্যে যে অবস্থা ও নূরে হেদায়েত সৃষ্টি হয়, তা দর্শকদের মনে এক চমক সৃষ্টি করে, যার ফলে তাদের মন গ্রহণ করে এবং বিশ্বাস করে যে, এই ব্যক্তি রাসূল বা অলী হবেন। উপরন্তু এ নূরে হেদায়েতের বদৌলতে বান্দার পরলৌকিক সুসংবাদ সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তবে অবিশ্বাসী এবং অপদার্থ ব্যক্তির ওপর নূরে হেদায়েত কোনো ক্রিয়া করে না। কারণ সূর্যের সামনাসামনি না হলে তার উপর সূর্যের প্রভাব পড়ে না। হে মূর্খ! নবী-অলীদের সত্তায় সাধারণভাবে যে নূরে হেদায়েত বর্তমান, তুমি কি তাও অস্বীকার করতে চাচ্ছ? এরপরও নিজেকে সাধু বলে বড়াই করছ? যদি তুমি অজ্ঞতাবশত এসব কথা বলে থাক, তাহলে সাবধান হয়ে যাও। আর যদি অবজ্ঞাভরে বলে থাক, তাহলে তুমি নূরে হেদায়েতের প্রতি অবিশ্বাসী হলে। এখন চিন্তা কর, আসল দ্বীনকে অস্বীকার করা প্রকৃতই কুফরি কি না?
ধর্মের প্রহরী
ধর্ম প্রধানদের কয়েকটি শরিয়তের বিষয় সম্পর্কে যত্নবান হওয়া উচিত। অর্থাৎ, শরিয়তের সংজ্ঞা, তাহ্জীব, আদব, আখলাক, বিধি বিধান বা সীমা চৌহদ্দি, বিভাগ, উত্তম, অধম, প্রাধান্য এবং বাতিল প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী না হলে, সে ধর্মের প্রহরী হতে পারে না। এরূপ ব্যক্তির হাতে ধর্মের নিক্তিকে সমর্পণ করা ধর্মকে বিনষ্ট করার শামিল। কারণ যে ব্যক্তি নিজেই অজ্ঞ সে কী করে ধর্মের ভালোমন্দ পরিমাপ করবে এবং আল্লাহ্্র বাণীÑ الاتخسر الميزان (আলাতুখ্ছিরুল মিজান) অর্থাৎ, “ওজনে কম করো না” তারা কিভাবে পালন করবে?
কূপের মাস্আলা একটি অত্যন্ত ছোট বিষয়। কূপ যখন অপবিত্র হয়ে যায়, তাতে কী পরিমাণ পানি আছে, তা পরিমাপ করার জন্য এ বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হয়। সে কূপের পানি পবিত্র করতে হলে সে যে পরিমাণ পানি তুলে ফেলতে বলে, সে-পরিমাণ পানি কূপ থেকে তুলে ফেলতে হয়। অথচ যে ব্যক্তি ইসলামের ওপর অপবাদ দেওয়ার পথ উন্মোচন করছে, ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, এটা কী করে বৈধ হতে পারে? হযরত সাদী (রঃ)-এর একটি উক্তিকে কোরানের অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে,
“খেলাফে পয়গম্বর কিছিরাহ্ গুজীদ,
কে হরগেজ বা মনজিল না খাহেদ রাসীদ।”
অর্থাৎ, পয়গাম্বরের বিরোধী হলে, সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, যারা কোরান ও হাদীসের বিরোধী, এখানে পয়গাম্বর বিরোধী বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে। ধর্মপরায়ণ লোকেরা কি এর বিরোধী? যে ব্যক্তি ধর্মের সংজ্ঞা এবং এর বিধি বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সে কিভাবে বুঝবে কে পয়গাম্বর বিরোধী? আরও উল্লেখ্য, নবীর বিরোধী সে রাস্তা কোনটি, যা অবলম্বন করলে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না এটা বলবে কি? যদি তা বলতে অক্ষম হয় এমন ব্যক্তিকে কে হিসেবে ধরে? আল্লাহ্্র অলীদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হারাম, বরং বড় ধরনের হারাম। সুতরাং ধর্মপ্রধানদের উচিত এ ধরনের লোকদের ঝগড়া-বিবাদ করতে বারণ করা এবং তাদের সামনে এ ধরনের কথা না বলা যে, কোনো আল্লাহ্্র অলীর মধ্যে একটি চুল বরাবরও যদি শরিয়ত-বিরোধী কিছু দেখ, তাহলে তাকে ত্যাগ করবে এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে যদিও সে বাতাসে উড়তে পারে, পানিতে চলতে পারে এবং বিচরণ করতে পারে আগুনের মধ্যে ইত্যাদি।
এটা কোন কিতাবে আছে যে, একটি চুল বরাবর ব্যতিক্রম দেখলেই আল্লাহ্্র অলীকে ত্যাগ করতে হবে? বরং শরিয়তের কথা হল, কোনো ব্যক্তি যদি ধর্মের শতকরা নিরানব্বইটা কাজই না করে, এবং কেবল একটা মাত্র কাজ করে, তাহলেও তাকে ধর্মচ্যুত মনে করবে না। অপরদিকে নবুয়ত যুগে রাসূল (সাঃ) স্বয়ং এবং বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামগণ পরচর্চা এবং অন্যের কুৎসা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যে ব্যক্তি অলীদের হাল বা অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ তাকে মূর্খ এবং দুনিয়াদারদের মধ্যে গণ্য করেন। যদিও সে ব্যক্তি জাহেরি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। শুধু তাই নয়, রাসূল (সাঃ) জাহেরিবিদ্যা থেকে পরিত্রাণ চাইতেন। দুনিয়াদার আলেম সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে এসব কথা বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় নবী-বিরোধী কে? মাওলানা রুমীর অপর একটি কবিতা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা হয়। কবিতাটি হল,
“আয় বাছা ইব্লিস আদম রুউই হাস্ত
পাছ বাহার দাস্থ নাবায়ীদ ওয়ারেদাস্ত।”
বলা বাহুল্য, যাদের বাতেনী জ্ঞান নেই এবং দৃশ্যত সুন্দর চেহারা তাদের ক্ষেত্রেই এ কবিতায় ইবলিস শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তা না হলে নূরে বাতেন এর অভিজ্ঞতায় যাদের অন্তর পরিপূর্ণ এবং আল্লাহ্্র জ্ঞানের সাহায্যে যারা সঠিক পথ প্রদর্শক ও মুর্শিদের ভূমিকায় লিপ্ত তাঁদের সম্পর্কে তিনি কখনো কি ইবলিস শব্দ ব্যবহার করতে পারেন? মহাবিপদের কথা, সত্যকে গ্রহণ করে তার প্রবক্তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এটাতো কলিকাতার তস্করদের কৌশলÑ তারা চুরি করে ঘরের বাইরে এসে মালিককেই চোর বলে ধরিয়ে দিতে চায়। এটা সেই জামানা।
বর্তমান সময় দুনিয়াটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন, প্রদীপ নিভে গেছে, সাপ বিচ্ছু এবং ইঁদুর প্রভৃতির উপদ্রপে বর্তমান যুগের বাসিন্দারা সীমাহীন কষ্টে জর্জরিত। যে প্রদীপ বাকি ছিল তাও ঝড়ের আঘাতে বিধ্বস্ত এবং কঠোর কষ্টের মধ্যে মানুষ দিবারাত্রি অতিবাহিত করছে। প্রায় একশত বছর পর আল্লাহ্্ তা’য়ালা নিজ কৃপায় ঝড়ের শক্তি শিথিল করেছেন। পৃথিবী থেকে অন্ধকারের যন্ত্রণা দূরীভূত হতে শুরু করেছেÑ اذا جاء نصر من الله والفتح (ইযা জায়া নাছরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্র সাহায্য এবং বিজয় উপস্থিত।” সড়ক প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে। একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে, আপদ বিপদ দূর হয়ে গেছে, ছেলেরা সব দলে দলে চলে এসো, যার যার খেলায় মত্ত হও এবং সানন্দে বিচরণ করো। মনে হয় সুখের তারকা উদিত হয়েছে। হযরত গাউছে আলম অলীদের ইমাম খত্মে বেলায়েত হযরত মেহদী (আঃ)-এর ওপর আল্লাহ্্র অনুগ্রহ স্থায়ী হোক। তার আগমনের নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী তারকা একবার পূর্বাকাশে উদিত হবার পর আবার পশ্চিম আকাশে উদিত হবে এবং একই রমযান মাসে সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ উভয় নিদর্শনই ইতোমধ্যে কার্যকরী হয়ে গেছে (১৩০০ সালের ৯ চৈত্র মোতাবেক ১৩১১ হিজরি ১৩ রমজান বৃহস্পতিবার চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল এবং সূর্যগ্রহণ হয়েছিল ১৩০০ সালের ২৪ চৈত্র মোতাবেক ১৩১১ হিজরি ২৮ রমজান রোজ শুক্রবার)। দারকুত্নী প্রভৃতি হাদীসের গ্রন্থে উক্ত নিদর্শনাদির বর্ণনা রয়েছে। আর উল্লেখ আছে যে, ইমাম মেহদী (আঃ)-এর পূর্বে দুজন মিথ্যা মেহদীর আবির্ভাব হবে। মনে হয় তাদের একজন অনতিপূর্বে আত্মপ্রকাশ করেই ফেলেছে।
তবে হযরত ইমাম মেহদী (আঃ)-এর আগমনের পূর্ব মুহূর্তে জগদ্বাসী বেলায়েতের আলোকে উদ্ভাসিত হতে থাকবে। শহর, গ্রাম এবং অলিতে গলিতে আল্লাহ্্ আল্লাহ্্ যিকির এবং যিকিরের স্থান গড়ে উঠবে। শুধু তাই নয় সকল জাতির মধ্যে তুমুল সাড়া পড়ে যাবে এবং তাদের মধ্যে নূরী মুজাদ্দেদ আবির্ভূত হয়ে জগৎটাকে আলোকে উদ্ভাসিত করে দেবে। অর্থাৎ, সর্বশেষ ইমাম তথা মেহদী (আঃ)-এর আগমনের অনতিপূর্ব সময়ে অবশ্যই নূরী মুজাদ্দেদের আগমন হবে। তাঁরা এ পৃথিবীটাকে নূরের আলোয় উদ্ভাসিত করে দেবেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, কোরানের উল্লিখিত চন্দ্র সূর্যের মিলন আর দারেকুত্নীতে বর্ণিত দু গ্রহণ সমার্থবোধক।

উৎসাদির মূল উৎসের বর্ণনা
আরেফ বা অলীগণ আল্লাহ্্র জ্ঞানের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যান এবং প্রকৃত বা সত্যজ্ঞান তাঁদের মধ্যে উদিত হয়। তাকে ‘এল্মে লাদুনী’ তথা গায়েবী জ্ঞান বলা হয়। কাশ্ফ্ এবং এল্হাম প্রভৃতি এরই শাখা-প্রশাখা। নবীদের বেলায় এটাকে হাদীস বলা হয়। আর অলীদের বেলায় এটাকে বলা হয় উম্মতি হাদীস। এটা হল বিশেষ রাসায়নিক পদ্ধতিতে লৌহকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করার মতো। বলাবাহুল্য, লৌহ যখন একবার স্বর্ণে পরিণত হয়, তখন সর্বাবস্থায়ই তা স্বর্ণ। অর্থাৎ, সত্তা গুণাবলি এবং আকৃতি প্রকৃতি সর্বদিক থেকেই তা স্বর্ণ। অনুরূপভাবে আল্লাহ্্র যে জ্ঞান বান্দার মধ্যে স্থিতি লাভ করে তার সূত্র এবং পরিপক্বতা আল্লাহ্্রই। তাই তিনি আপন কালামে পাকে বলেছেন, ولايحطون بشئ من علمه الابماشهناء(ওয়া লা ইউহিতূনা বিশাইয়্যিম্ মিন্ ইলমিহী ইল্লা বিমাশাআ) অর্থাৎ, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন সে ছাড়া কেউই তাঁর জ্ঞান থেকে আয়ত্ত করতে পারে না। তিনি নিজে কৃপা করে যাকে তা দান করেন, কেবল সেই তা পায়। এ অবস্থায় তাঁর জ্ঞানকে আল্লাহ্্র জ্ঞান বলা হয়। আল্লাহ্্ তা’য়ালা যাকে আপন মৌলিক জ্ঞান দান করেছেন, তাঁর সম্পর্কে তিনি বলেন, الا ان اوليا الله لاخوف عليهم ولاهم يحزنون (আলা ইন্না আউলিয়া আল্লাহি লা খাওফুন্ আলাইহিম্ অলাহুম্ ইয়াহ জানুন্) (সাবধান! আল্লাহ্্র অলীগণ ভয় ও চিন্তা থেকে মুক্ত) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র অলীদের সাথে আচরণের ব্যাপারে সাবধান হয়ে যাও। সত্তা ও গুণে আকৃতি ও প্রকৃতিতে এবং জ্ঞান গরিমায় সর্বদিক থেকে তারা ভয় ও চিন্তামুক্ত এবং সর্বাবস্থায় তারা নির্ভীক। এ শ্রেণীর লোকগণ আল্লাহ্্র জ্ঞান ও পূর্ণতা লাভের যোগ্য হন। অর্থাৎ, তাঁদের থেকে যা কিছুই প্রকাশ পাক না কেন, সবই আল্লাহ্্র জ্ঞানের ফলশ্রুতি। এ ধরনের লোকই তাফসীর ও হেকমত সম্পর্কে আলোচনা বা বর্ণনা করার যোগ্য। তাঁদের থেকে প্রকাশিত জ্ঞান ও বাণী সবই সত্য। অর্থাৎ, মৌলিক (মূল) জ্ঞানের মধ্যে কোনো পর্দা না থাকার দরুন এটাকে এল্মে হক বা সঠিক জ্ঞান বলা হয়। এ জ্ঞান কোনো প্রমাণের মুখাপেক্ষী নয়। তবে তাঁর মন থেকে যাই বের হোক তা সঠিক। এহেন মর্যাদার অধিকারী লোকদের গাউস, কুতুব, আবদাল, আখ্ইয়ার এবং মুজাদ্দেদ প্রভৃতি বলা হয়। তাঁদের বাণী আল্লাহ্্ এবং নবীর বাণী অভিন্ন। অর্থাৎ আল্লাহ্্র বাণীর মতো তাঁদের বাণীও সর্বৈব সত্য। যে ব্যক্তি এর মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য করে, তাহলে সেটা হবে তার গোমরাহী, ব্যর্থতা অথবা অজ্ঞতাপ্রসূত। তাদের যদি রাবুবিয়াতের (ঐশ্বরীক) জ্ঞান প্রাপ্তির সৌভাগ্য হত, তাহলে তারা এতে শরীক হতে পারত এবং এটাকে যুদ্ধে পাওয়া ধনের মতো লুফে নিত। এ পর্যায়ে ‘মোকামে ফানা’ তথা সাধকের আল্লাহ্্তে বিলীনের পর্যায় সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। বান্দা যখন আল্লাহ্্তে ফানা হয়ে যায়, তখন বান্দার জ্ঞান আল্লাহ্্র জ্ঞানের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ সময়ে বান্দার ভিতর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা আল্লাহ্্রই সত্তার বদৌলতে। তবে বান্দার সত্তা পরম সত্তা এক জাতীয় হয়ে বর্তমান থাকে। তা না হলে ইরফান তথা প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের উদ্দেশে অবশিষ্ট থাকে না। প্রত্যেকটি বস্তুই আল্লাহ্্র সত্তায় বিলুপ্তি লাভের পর আর কোথায় যাবে, যা থেকে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি ও অস্তিত্ব সেই সত্তায় প্রত্যাবর্তনের পর তাতে স্থায়ী হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলÑ كل شئي يرجع الي اصله (কুল্লু সাইয়িন ইয়ারজিউ ইলা আস্লিহী) অর্থাৎ, সব বস্তুই তার মূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। যেমন পানি ও চিনি। চিনি পানিতে মিশে যাওয়ার পরও চিনির প্রতিক্রিয়া উহাতে অবশিষ্ট থাকে। এ উদাহরণ ‘ফানার’ সাথে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ না হলেও অস্তিত্বের উৎসের প্রেক্ষিতে এটা আলাদা কিছু নয় এবং এ দুয়ের মধ্যে মিল রয়েছে। হাদীসে কুদ্সীতে এ সমাধান পাওয়া যায়Ñ الانسان سرى واناسره (আল ইনসানু র্সিরী ওয়া আনা র্সিরূহু) অর্থাৎ, আমার রহস্য মানুষ আর মানুষের রহস্য আমি। অর্থাৎ, আমার মূল মানুষ আর মানুষের মূল আমি। অতএব জানা গেল যে, সমস্ত বস্তুই আল্লাহ্্ থেকে তথা সকল বস্তুর উৎস আল্লাহ্্র সত্তা তা থেকে সকল বস্তুর উদ্ভব ও স্থিতি। সাধারণভাবে এটাকে সৃষ্টি মনে করা হয় কিন্তু সাধারণ মানুষ সৃষ্টি কথাটির অর্থ বুঝতে অক্ষম এবং ফানা শব্দের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করাও তাদের জন্য দুষ্কর। অথচ তারা অহরহ ফানা শব্দ উচ্চারণ করছে। অনুরূপভাবে ‘মুহীত’ শব্দের মূল অর্থ থেকে তারা অনেক দূরে।
মোটকথা, বান্দা আল্লাহ্্র সত্তায় বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ হল সত্তায় সত্তা, গুণাবলির সাথে গুণাবলি, রূপের মধ্যে রূপ, প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতি, কর্মের মধ্যে কর্ম আর অবস্থায় অবস্থা, জ্ঞানে জ্ঞান, গরিমায় গরিমা, জাহেরের সাথে জাহের, বাতেনের সাথে বাতেন, কুদরতের সাথে কুদরত, শক্তির সাথে শক্তি, জীবনের সাথে জীবন, এবং মৃত্যুতে মৃত্যু, নূরের মধ্যে নূর, অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার, বুদ্ধির সাথে বুদ্ধি, রূহের মধ্যে রূহ্ আর নাস্তিতে নাস্তির বিলুপ্ত হওয়া। এ ধরনের হাজারো গুণাবলি বান্দার সত্তায় বর্তমান। এগুলো সবই আল্লাহ্্র সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফানা এবং বিলীন হয়ে যায়। ফানার এ অর্থ যার প্রত্যক্ষ করা হয়নি, সে স্বভাবতই এ স্তরকে অস্বীকার করে। এটা তার বোকামি অথবা বিষয়টাকে এভাবে বোঝার চেষ্টা করুন, প্রত্যেক বস্তুই তার উৎস থেকে উৎসারিত আবার তাতেই প্রত্যাবর্তিত হয়। সুতরাং বান্দা আপন উৎস ও প্রকৃতি থেকে, যে রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, ঠিক সেভাবেই আপন উৎস মূলের মধ্যে ফানা হয়ে গেল। প্রসঙ্গক্রমেÑخلق الله ادم على صورته (খালাকাল্লাহু আদামা আলা সুরাতিহী) অর্থাৎ, আল্লাহ্্ আদমকে আপন রূপে সৃষ্টি করেছেন। এ উক্তিটি অনুধাবন করুন। অর্থাৎ, আল্লাহ্্ আপন সত্তা থেকে আদমকে যে রূপ ও গুণে প্রকাশ করেছেন, ঠিক সে পদ্ধতিতেই স্বীয় সত্তায় প্রত্যাবর্তন করিয়ে নেন। সকল বস্তুর উৎসই আল্লাহ্্। প্রত্যেকটি বস্তুর স্বতন্ত্র নাম আছে। প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র নামীয় বস্তুর স্বতন্ত্র শরীর প্রয়োজন। এ স্বতন্ত্র শরীরটাকেই বলা হয় তার সুরত বা রূপ। আবার প্রত্যেকটি সুরতের জন্য সিরাত বা প্রকৃতি তথা আচরণ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে সত্তার বৈশিষ্ট্যাদি তাতে বর্তমান। তবে আদমের সাথে গোপন সাদৃশ্য রয়েছে। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই; বরং মিলন শক্তির কারণেই এ মর্যাদা। অর্থাৎ বিশিষ্ট বান্দাকে আল্লাহ্্র বিশেষ সত্তার পরিচায়ক ও রহস্যাদির উদ্ভাবক বলা হয়। আল্লাহ্্র সুরত এবং আদমের সুরত অভিন্ন একথা বলায় কোনো ক্ষতি নেই। কারণ গোপন উৎস উভয়েরই এক। তবে আদমের সুরত এবং আল্লাহ্্র সুরত এক বলার অর্থ সুরতে মোশাব্বার প্রকাশ।
তোমরা অপক্ব বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ্্র সুরত সম্পর্কে যা ধারণা করছ, প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তোমরা বাক্যের ধরনই বোঝ না। বস্তুত আল্লাহ্্র সুরত প্রভৃতি কথাবার্তা তাঁর সৃষ্টি রহস্যের তথা সত্তা ও গুণের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যে বস্তু যেভাবে হওয়ার হয়ে যাচ্ছে। যেমন ডিমের মধ্যে বাচ্চা, বীজের মধ্যে বৃক্ষের আত্মপ্রকাশ। অনুরূপভাবে উভয় জগতের সমস্ত বস্তুর সৃষ্টির মধ্যেই বিস্মিত হওয়া ও বিস্ময়ের ব্যাপার রয়েছে। অর্থাৎ সুরত ও সিরাত, নাস্তি ও হাস্তি, হাজের ও গায়েব, স্বাদ ও গন্ধ প্রভৃতি সবই আল্লাহ্্র জাত তথা সত্তা ও গুণাবলি থেকে প্রকাশিত হয়। কারণ জাত সকল বস্তুর মূল। অতএব সে জাতের ভিতর বিস্ময়ের ব্যাপার থাকবে না কেন? সুতরাং সকল বস্তু মূলের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্্র জাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলা বৈধ। কারণ এগুলো জাতেরই রহস্য। প্রথমত জাতই স্বয়ং একটি রহস্য। সুতরাং যা রহস্যময়, তাতে বিস্মিত হয়ো না। এ ছেলেমি থেকে বিরত হও, আরেফ হয়ে যাও এবং প্রকাশিত পূর্ণতা সম্পর্কে অবহিত হও। তাহলে- خلق الله ادم على صورته (খালাকাল্লাহু আদামা আলা সুরাতিহী) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্ আদমকে আপনরূপে সৃষ্টি করেছেন” কথার অর্থ নিজেই বুঝতে পারবে। বস্তুতপক্ষে বিশিষ্ট বান্দা আল্লাহ্্র বিশিষ্ট নূর থেকে অর্থাৎ তাঁর সত্তাগত নূরের ধারক। তাদের নবী-অলী বলা হয়। সে কারণেই শেষ নবীর এক নাম নূর যা আল্লাহ্্ তা’য়ালারও নাম। সুতরাং যখন নামে পার্থক্য নেই, তখন নামাধারে পার্থক্য হবে কেন? অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ্্ ও তাঁর রাসূল উভয়ের নাম অভিন্ন, তখন নূরী মর্যাদায়ও এরা অভিন্ন।

ফযীলতের বর্ণনা
ফযীলত দু প্রকার। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। যা প্রকাশ্য তা সাধারণ এবং যা অপ্রকাশ্য তা অসাধারণ। অর্থাৎ, জাতি ফযীলত এবং সিফাতী ফযীলত। এ উভয়ের প্রকৃতি স্বতন্ত্র। জাতি ফযীলতের উৎস হল এখলাস তথা দৃঢ় নিষ্ঠা আর সিফাতী ফযীলতের উৎসও অনিবার্যরূপেই সিফাতী বা গুণাত্মক। যা সত্তা প্রসূত অবশ্যই তার মর্যাদা অধিকতর এবং যার যে সত্তার সাথে সম্পৃক্ত সে সত্তার অবস্থা অনুযায়ী তার প্রকাশ স্থায়ী হবে। যেমন সর্বমোট উচ্চ মর্যাদাবান রাসূলের সংখ্যা ছয়। তাঁদের উৎস এবং উপাদান দৃঢ় এবং অসাধারণ। এজন্য তাঁরা অধিকতর মর্যাদাবান। কারণ তাঁরা জাতি ফযীলতের নূর এবং এখলাছ তথা নিষ্ঠা ও সরলতার মূর্ত প্রতীক। তা মূল ও মর্মসূত্রে প্রাপ্ত অনুকম্পা। এ অনুকম্পাই বেলায়েত যা নবুয়তের মূল ও প্রধান বস্তু। তবে বেলায়েত সুদৃঢ় না হওয়া পর্যন্ত নবুয়তও অপূর্ণ থাকে। তখন এটাকে বলা হয় গুণাত্মক নবুয়ত। যে নবীর নবুয়ত গুণাত্মক এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সুদৃঢ় বেলায়েত অর্জিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর ফযীলতেও পার্থক্য হয়। এখানে উল্লেখ্য এবং স্মরণীয় যে আল্লাহ্্ তা’য়ালা ঐশী জ্ঞান এবং আদব শিক্ষা করার জন্য হযরত মূসা (আঃ) কে নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট পাঠালেন। যখন হযরত খিজির (আঃ) তাঁর এখলাছ তথা আন্তরিকতাপূর্ণ কার্যাদি শুরু করলেন। অর্থাৎ, নৌকা ডুবালেন এবং একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করলেন ইত্যাদি। তখন হযরত মূসা (আঃ) এসব দেখে বিস্মিত হলেন এবং গোপন রহস্যপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিবাদ করে বসলেন। অর্থাৎ হযরত মূসা (আঃ) প্রকৃত ঐশীজ্ঞান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন, এজন্য তিনি তাঁর কাজের প্রতিবাদ করেন। বস্তুত আল্লাহ্্ তা’য়ালা স্বয়ং যার কামালত তথা পূর্ণতার বর্ণনা করছেন, হযরত মূসা (আঃ) পয়গাম্বর হয়েও তাঁর প্রকৃত অবস্থা বুঝতে অক্ষম হন। অথচ নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর পয়গাম্বর হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে।
এতো হল কোরানে বর্ণিত একটি কাহিনী। এখন হাদীসে বর্ণিত অপর একটি ঘটনা শোনো। ঘটনাটি হলÑ হযরত মূসা (আঃ)-এর সময়ে একবার অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মূসা (আঃ) স্বজাতিদের নিয়ে আল্লাহ্্র কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছিলেন; কিন্তু তাঁর প্রার্থনা কবুল হচ্ছিল না, বরং তাঁর কাছে আসমানী দূত অবতীর্ণ হয় এবং জানিয়ে দেয় যে, হে মূসা! আল্লাহ্্ আমাকে পাঠিয়েছেন, বে-এখলাছ তথা আন্তরিকতাহীন মনের প্রার্থনা তিনি কবুল করেন না। তোমার লোকদের মন সরল বা খাঁটি নয়, তাদের প্রার্থনা কী করে কবুল করা যায়? বরং খাঁটি মনের অধিকারী আমার জনৈক অলী বন্ধু আছে তাঁর নিকট যাও। সে যদি তোমাদের জন্য দোয়া করে, তাহলে আমি তা গ্রহণ করতে পারি। তাঁর নাম বারখ্। এ কথায় হযরত মূসা (আঃ) বিস্মিত হলেন এবং তাঁর খোঁজে বের হলেন। ঘটনাক্রমে চলতে চলতে হযরত মূসা (আঃ) একটি জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তিনি দেখতে পান গলায় কাপড় জড়ানো কৃশকায় পাগল প্রায় জনৈক ব্যক্তি পায়চারি করছেন। দেখা গেল তাঁর চেহারায় আল্লাহ্্র সৌরভ চমকাচ্ছে। হযরত মূসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? উত্তর এল, আমি আল্লাহ্্র বান্দা, আমার নাম বারখ্। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, সাহেব একটু লক্ষ করুন। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, সাত বছরের অনাবৃষ্টির ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা ধ্বংস প্রায়। আমরা পর্যায়ক্রমে সত্তর হাজার লোক প্রার্থনায় শামিল হয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রার্থনা কবুল হয়নি, বরং ‘অহি’ এসেছে বারখ্ যদি তোমাদের জন্য দোয়া করেন, তাহলে অবশ্যই বৃষ্টি হবে। তখন হযরত বারখ্ বললেন, আমার সাথে ময়দানে চলো। ময়দানে এসে তিনি আল্লাহ্্র দিকে রুজু হয়ে বলতে লাগলেন, আজ কোথায় তোমার সে-ক্ষমতা যে, বৃষ্টিপাত ঘটাবে এবং বাতাস পানি জমাবে? আজ তোমার ক্ষমতা বিলুপ্ত, বরং তোমার দৃষ্টিশক্তি নেই এবং তোমার কান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। মোটকথা তিনি অনুরূপ বেহুদা কথা বলতে লাগলেন। ইতোমধ্যে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অতঃপর কিছু বলতে না বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। হাঁটু পর্যন্ত পানি হয়ে গেলে বারখ্ হযরত মূসা (আঃ)-কে বললেন, চলো শুকনো স্থানে যাই। উঁচু জায়গায় এসে তিনি হযরত মূসা (আঃ)-কে বললেন, দেখ আমি তোমার প্রভুকে কত গালি দিলাম। এতে হযরত মূসা (আঃ) ক্ষেপে যান এবং তাকে ভালোমন্দ কিছু বলতে চান। তৎক্ষণাৎ ঐশী দূত অবতরণ করেন এবং বলেন, সাবধান মুখ খুলবেন না। আল্লাহ্্ বলেছেন, তাঁকে যদি কিছু বলেন, তাহলে আপনার নবুয়ত ছিনিয়ে নেওয়া হবে। তিনি দৈনিক তিনবার আল্লাহ্্র সাথে এরূপ ঠাট্টা করেন। লক্ষ করো, পার্থক্যটা কোথায়? হযরত মূসা (আঃ) তো একজন পয়গাম্বর আর হযরত বারখ্ একজন ভবঘুরে প্রকৃতির লোক। তা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহ্্র সাথে অসংযম ও তামাশার কথাবার্তা বলেছেন। অপরদিকে হযরত মূসা (আঃ) সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন, প্রার্থনা করেছেন, তা আবার একা নয়, বরং সত্তর হাজার লোককে সাথে নিয়ে সাত বছর পর্যন্ত বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছেন। তবুও তাঁর প্রার্থনা কবুল হয়নি। অপরদিকে হযরত মাহ্বুব অর্থাৎ হযরত বারখ্ মনোযোগ দিতেই বৃষ্টিপাত হল। তাহলে এর মূল উপাদান কোনটি, নবুয়ত না বেলায়েত? যদি বেলায়েত হয়, তাহলে উহা নবুয়ত থেকে শক্তিশালী কি না? এবং বেলায়েত মূল কি না? বরং বেলায়েত উভয় জগতের সমুদয় বস্তু থেকেই উত্তম। কারণ ‘ওয়ালা’ থেকে অলী শব্দের উৎপত্তি। ওয়ালা অর্থ দুস্তি বা বন্ধুত্ব। আর নবী শব্দের উৎপত্তি ‘নব’ থেকে যার অর্থ খবর। সুতরাং নবী শুধুমাত্র সংবাদদাতা। উহাতে বেলায়েত যুক্ত হলে নবুয়ত মজবুত এবং পূর্ণ হয়। অর্থাৎ যে নবীর বেলায়েত মজবুত তিনি অলী থেকে উত্তম। কারণ তাঁর মধ্যে উভয় গুণ একই সঙ্গে বর্তমান। এজন্য বেলায়েত অনির্দিষ্ট (আম) তথা নবী এবং অলী উভয়েরই মূল উপাদান। আর নবুয়ত (খাস) নির্দিষ্ট তথা বিশিষ্ট ব্যক্তির বেলায় প্রযোজ্য। অর্থাৎ সংবাদ দেওয়ার জন্য যে কোনো একজন ব্যক্তিই যথেষ্ট এবং তাতেই সকল দুনিয়াবাসীদের প্রতি যে দায়িত্ব ছিল, তা শেষ হয়ে যায়। অপরদিকে বেলায়েত প্রয়োজন অনুপাতে বড় ছোট নির্বিশেষে সকলের ওপর সদা ফরয। কারণ মনের বিশ্বাস হল বেলায়েতের সর্ব নিম্নস্তর বা ক্ষুদ্রতম অংশ। এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। মিলনের তথা একীভূত হওয়ার ফলে ঈমানের স্তর অতিক্রম করে গেলেও ঈমান থেকে মুক্ত হওয়া বোঝায় না। এটা একটি বিশেষ অবস্থা। এ সময়ে ঈমান চাপা পড়ে যায় মাত্র।
যে নবীর মূল উপাদান সুদৃঢ় বেলায়েত, তাঁর বুজুর্গিও অধিক। এ কারণে আমাদের শেষ নবী সকলের চেয়ে বেশি বুজুর্গ। কারণ তাঁর নবুয়তের ওপর বেলায়েতের প্রাধান্য ছিল। এ কারণেই তাঁর উম্মতদের মর্যাদা বনী ইসরাঈলিদের নবীদের চেয়ে বেশি। এটা হাদীস শরীফে আছে। পৌঁছা এবং পৌঁছানোর আয়াত দ্বারাও তাই প্রমাণিত হয়। আয়াতটি হলÑ فاذا فرغت فنصب والي ربك فارغب (ফাইজা ফারাগ্তা ফান্ছাব্ ওয়া ইলা রাব্বিকা ফারগাব) অর্থাৎ, দীর্ঘ হুকুম আহ্কাম থেকে অবসর হলে তুমি থেমে যাবে এবং রবের প্রতি মনোনিবেশ করবে। এখানে ‘ইলা’ বা ‘প্রতি’ শব্দ দ্বারা রবের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর ‘রুগবত’ বা ‘মনোনিবেশ’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে বেলায়েত। অতএব প্রমাণিত হয় যে, শরিয়ত যদি শুধু হুকুম আহ্কামের ওপর প্রতিষ্ঠিত হত, তাহলে এগুলো সদা পালনীয় হত। অথচ সদা পালনীয় হল এগুলোর মূলনীতি। যা পরিপূর্ণ স্থায়ী নিয়ামত। শরিয়তের হুকুম আহ্কাম স্বস্থানে পালনীয় ও কর্তব্য এবং কখনো সে ফরয বা কর্তব্য রহিত হয়ে যায়। কিন্তু বেলায়েত যা সকল কাজের মূল তা কখনো রহিত হয় না। উল্লেখ্য, হাদিস, কোরান এবং আরও যত শব্দ প্রত্যেকটির অর্থ থাকতে হবে এবং প্রত্যেকটি অর্থের মর্ম ও ‘মেসদাক’ তথা প্রতিপাদ্য থাকা আবশ্যক। মেসদাক তথা প্রতিপাদ্য বিষয়ের জন্যই শব্দ গঠিত হয়। অর্থাৎ, ভাব প্রকাশের ইচ্ছা হলেই শব্দ উচ্চারিত হয়। তাহলে মেসদাক তথা প্রতিপাদ্য বস্তুটি ইচ্ছার লক্ষ্য হিসেবে স্থির হল। যেমন কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্্ শব্দ উচ্চারণ করল, সে বলা মাত্রই শব্দটি উচ্চারিত হল, এর পূর্বে শব্দটি ছিলনা। তবে বাতেনী জগতে এর মেসদাক তথা প্রতিপাদ্য বর্তমান ছিল। এ কারণে তিনি আল্লাহ্্ ওয়ালা হয়েছেন। আর যদি কেবল আল্লাহ্্ শব্দ উচ্চারিত হয় এর মেসদাক তথা প্রতিপাদ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকে, তাহলে সে কাফির এবং মুনাফিকই থেকে যায়। অপরদিকে আল্লাহ্্ শব্দের মেসদাক সম্পর্কে বিশ্বাস থাকলে মুখে তা উচ্চারিত না করলেও সে মুমিন হবে। তবে কোনো কোনো সময় উহা মুখে উচ্চারণ করা ফরয ও ওয়াজিব হতে পারে। তখন তা করতে হবে।

একাত্মতার বর্ণনা
হযরত মূসা (আঃ) প্রার্থনা করলেন, হে প্রভু! আমাকে দেখা দাও। অর্থাৎ, পরোয়ারদিগারকে দেখতে চাইলেন। উত্তর এল, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। অর্থাৎ, এ পর্যায়ে বাহ্যিক দৃষ্টি অচল। প্রকাশ্য মূসা (আঃ) অর্থাৎ, সৃষ্টি রূপের মূসাকে একথা বলা হয়েছে। বাহ্যত সে মাঠে আগুন হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বললেও বাতেনে তাই স্বয়ং আল্লাহ্্। এটা ছিল তাঁর জ্যোতি সৌন্দর্যের অগ্নিরূপে প্রকাশ। তূর পাহাড়ে যে জ্যোতির্ময়তার প্রকাশ ঘটেছিল, তা ছিল জালালী। যার কারণে মূলের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটেছে। যার মাধ্যমে সত্তার প্রকাশ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। মোটকথা, পাহাড় ভেঙে গেল, তূর মজে গেল এবং হযরত মূসা বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তা সত্ত্বেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি প্রখর হয়ে যায়। এ কারণেই পাহাড়ও চোখের সুরমায় পরিণত হয়। তাতে চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ে এবং প্রখর হয়। কারণ যখন প্রত্যক্ষ করার শক্তি নূরে প্রখর হয়, তখন কপালে আলোর ঝলক প্রতিভাত হয়। এতে চক্ষু উজ্জ্বল হয়। তাই যখন তূর পাহাড় ঝল্সে গেল, তখন তূর সাথীদের আকৃতি-প্রকৃতিতে ঝলক সৃষ্টি হবে না কেন? যখন পাহাড় এবং সাথীদের প্রত্যক্ষণ শক্তির ঔজ্জ্বল্যে অন্ধ দৃষ্টিশক্তি লাভ করল এবং বহু অদেখা বস্তু দেখতে পেল, তখন হযরত মূসা কেন দেখবেন না এবং অবহিত হবে না মূল সত্তার প্রকাশ সম্পর্কে? প্রকৃতপক্ষে হযরত মূসা (আঃ) ইতোপূর্বে যা দেখেননি তাই দেখেছেন, যা শোনেননি তাই শুনেছেন এবং যা অনুভব করেননি তাই অনুভব করেছেন।
অর্থাৎ, হযরত মূসা (আঃ)-এর বেহুঁশ অবস্থাটিই ছিল তাঁর প্রকৃত সচেতন অবস্থা। এ সময়ে তাঁর প্রত্যক্ষ দর্শন এবং প্রকৃত দিদার লাভ হয়। এটা ছিল তাঁর সরাসরি দর্শন। এ পর্যায়ের সাক্ষাতে পর্দার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। বহির্দৃষ্টি বা চক্ষু সূক্ষ্মতাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। যে কোন সূক্ষ্ম বস্তুকে অনুবীক্ষণ দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে হয়। অনুরূপভাবে অন্ধকারে কিছু দেখতে হলে আলোর সাহায্যে তা দেখতে হয়। অনুরূপভাবে অদেখা বস্তুকে আরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়। সে যাই হোক হযরত মূসা (আঃ) প্রকৃত দিদার লাভের পর সারা জীবনেও আর রূপক দর্শন লাভের চেষ্টা করেননি। কারণ প্রত্যক্ষ দিদার-ই আসল দিদার। আর চক্ষুর দেখা হল রূপক দেখা, যদি চক্ষুতে প্রত্যক্ষ করার শক্তি বা নূর তীব্রতর না হয়। হযরত মূসা (আঃ) এরই কেবল দিদারের সৌভাগ্য হয়নি; বরং তাঁর সাথীবৃন্দেরও দিদার লাভ হয়েছিল, যদিও তারা মরে গিয়েছিল। পরম সত্তার পরিপূর্ণ প্রকাশের প্রেক্ষিতে এবং তাঁর মহানত্বের কারণেই তা হয়েছিল।
মোট কথা, হযরত মূসা (আঃ) দিদার চেয়েছিলেন বটে; কিন্তু ইত্তেহাদ তথা একাত্মতা বা প্রকৃত দিদার চাননি। চক্ষুর দেখা হয় মিলনের পূর্বে আর মিলনের পরে হয় একাত্মতা। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হল শুরু এবং শেষ। এতে মনে হয় যে, হযরত মূসা (আঃ) ছিলেন প্রাথমিক স্তরের, শেষ স্তরের নয়। যদি তিনি শেষ স্তরের হতেন, তাহলে চক্ষুর দর্শন কামনা করতেন না।
বাতেনী কথা
من قال لا اله الا الله فدخل الجنة (মান ক্বালা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ফাদাখালাল্ জান্নাহ্) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলবে, সে বেহেশ্তবাসী হবে। অর্থাৎ, সাধক বান্দা যখন আপন মগ্ন অবস্থায় নিমজ্জিত হতে থাকে এবং তাঁর সামনে উন্মোচিত হতে থাকে পূর্ণতা প্রাপ্তির দ্বার, তখন সাদৃশ্যময় তথা নূরালোকমন্ডিত স্থানকে সাধকের জন্য বেহেশ্ত আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আপন অবস্থাদির পূর্ণতার সঙ্গে রূহ্ তাতে প্রবেশ করে এবং তখন তা বেহেশ্তের স্বাদ আস্বাদন করে। এ অবস্থায় সাধককে বেহেশ্তবাসী বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে অনুরূপ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বেহেশ্তী। তখন সে সাধক আপন অনুরূপ অস্তিত্ব সহকারে বেহেশ্তে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং ফেরেশতাগণ সাধককে বেহেশ্তে দেখেন। সম্পৃক্ততার কারণে তাঁর এ মর্যাদা লাভ হয়। কিন্তু দর্শকবৃন্দ জানেন না যে, সে কী করে ঊর্ধ্বলোকে গেল। তবে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ তা ঠিকই জানেন। কারণ, এটা আল্লাহ্্র অন্যতম রহস্য।

তাসাব্বুর অর্থ এবং এর প্রকারভেদ
তাসাব্বুর অর্থ কোনো বস্তুর রূপ কল্পনা করা। আবার কিছুর ধ্যান করাকেও তাসাব্বুর বলা হয়। উহা দু’ প্রকারÑ প্রথমত, জাহেরি তথা চক্ষু সর্বস্ব। এটা ধ্যান চক্ষুর দৃষ্টিশক্তির মধ্যে সম্পন্ন হয়। এটা ধ্যান রাজ্যের প্রাথমিক স্তর। দ্বিতীয়ত, বাতেনী তথা অভ্যন্তরীণ অবস্থা সর্বস্ব। অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে এ ধ্যান সম্পন্ন হয়। দৃষ্টিশক্তির যেখানে শেষ সেখান থেকে এর প্রকাশ আরম্ভ হয়। এটাকে বাতেনী অবস্থাগত ধ্যান বলা হয়। যা সাধকের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, এটাও ফায়েজ লাভের অন্যতম উপায়। জাহেরি তাসাব্বুর তিন প্রকার; যথাÑ (১) তাসাখখুছ, (২) তাহামূল এবং (৩) তাজাহুল। জ্ঞাত বস্তুকে তাসাখখুছ বলা হয়। অর্থাৎ, কোনো জ্ঞাত বা দেখা বস্তুর সাদৃশ্য রূপ উহার অবর্তমানে বা আড়াল থেকে ধ্যান বা কল্পনা করাকে তাসাখখুছ বলা হয়। দ্বিধাযুক্ত দর্শন বা সন্দেহযুক্ত শ্রবণের ভিত্তিতে কোনো বস্তুর রূপ কল্পনা বা ধ্যান করাকে তাহামূল বলা হয়। অর্থাৎ, কোনো একটি বস্তু দেখে বা শব্দ শুনে সন্দেহজনকভাবে মনে হল যে, তা অমুক বস্তু হতে পারে। এ ধারণার ভিত্তিতে কোনো বস্তুর রূপ কল্পনা বা ধ্যান করার নাম তাহামূল।
তৃতীয়ত, কোনো অজ্ঞাত বস্তুর রূপ কল্পনা তথা যে বস্তুর চেহারা সুরত সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, সে বস্তুর সাদৃশ্য রূপ কল্পনা করাকে তাজাহুল বলে। প্রকৃতপক্ষে এটা অসম্ভব। কারণ অজানা বস্তু অজ্ঞাত। আর তাঁর সাদৃশ্য রূপ অজ্ঞাত থেকে অজ্ঞাত। অতএব অজ্ঞাত বস্তুর অজ্ঞাত অংশ আরও অজ্ঞাত। এ কারণেই এরূপ বস্তু ধ্যান করাকে তাজাহুল বলা হয়।
অপরদিকে বাতেনী তাসাব্বুরও তিন প্রকার। যথাÑ (১) ইনকেশাফ, (২) ইল্হাম এবং (৩) এতেকাদ। ইনকেশাফ একটি প্রতিবিম্বাত্মক দৃশ্য। উপলব্ধির অদৃশ্য দর্পণে তা প্রতিভাত হয়। এখানে কোনো অনুমান বা কল্পনার অস্তিত্ব থাকে না। তা-ই মূল তাসাব্বুর বা ধ্যান। তা রহস্যালোক থেকে প্রতিভাত হয়। দ্বিতীয়ত, ইল্হাম। তা আয়নায়ে মোদাব্বর থেকে নফ্সে মূলহেমায় তথা মাথার তালু থেকে অন্তরের নির্দিষ্ট স্থানে স্ফুলিঙ্গের মতো প্রতিভাত হয়। এর ফলে অদৃশ্য থেকে অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হয়। এটাকেই ইল্হাম বলা হয়। তৃতীয়ত এতেকাদ। এটা না ধ্যান, না ধারণা, না অজ্ঞতা, না বিস্মৃত; বরং এ একটি নির্দিষ্ট স্থিতাবস্থা। অর্থাৎ এমন একটি পবিত্র বস্তু যা থেকে ইনকেশাফ ও ইল্হাম প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। বলা যেতে পারে যে, এটাই আসল এবং মূল। তবে এতেকাদও দু প্রকার। যথাÑ জাকি এবং গোবী। জাকি এতেকাদ-এর ফলশ্রুতিতে ইল্হাম এবং কাশ্ফ সংঘঠিত হয়। আহলে গোবীদের মধ্যে এর ফলশ্রুতি কম এবং বিরল। কিন্তু এতেকাদ বা বিশ্বাসওয়ালা ব্যক্তি মূলতই যোগ্যতম, পারদর্শী এবং শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি।

হাক্বিকত প্রমাণিত হওয়ার বর্ণনা
আল্লাহ্্ বলেন, الحق حق (আল হাক্কু হাক্কুন) অর্থাৎ, সত্য সত্যই। এটাই সত্যের বৈশিষ্ট্য। সত্যের স্থিতিস্থলে তা আপন অর্থ মর্মসহ বর্তমান। তা না হলে সত্যকে অন্য বস্তুতে স্থিতি লাভ করতে হবে। সত্যের স্থিতি স্থানও উহার বৈশিষ্ট্যেরই অন্তর্ভুক্ত। এমতাবস্থায় আল্লাহ্্র সৃষ্টির মধ্যে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে সত্যের বৈশিষ্ট্যাদি স্থিতিবান নয়। ভালোমন্দ সবই পরমসত্তা থেকে সমস্ত স্থিতি লাভ করেছে। যার মাধ্যমে মন্দ বা অজ্ঞতা প্রকাশ পায়, সে হিসেবেই তাকে মন্দ বা অজ্ঞ বলা হয়। অতএব যেদিকে তাকাও দেখবে, কোনো কিছুই হাকিকত থেকে আলাদা নয় বরং দেখবে সত্যের স্থিতিতে সবই সত্য। তবে উচ্চতর নিম্নতর স্তরভেদে উহার প্রকাশ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে। সত্য যার মধ্যে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত, তাঁর প্রকাশ অনুরূপেই স্থিতিবান। তাই সত্যের পূর্ণতার প্রকাশের ধারক ব্যক্তি এই প্রকাশ বীজের খোসাস্বরূপ। এর ভিতর স্থিতিবান সবই সত্য। কারণ সে সত্যের প্রকাশ মাধ্যম। যে কোন সত্য তাঁর কাছে বর্ণিত হোক, অর্থের প্রেক্ষিতে সে তা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ রহস্য জ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করে সে তাকে পরখ করে নিবে। অর্থাৎ, যার মধ্যে পরম সত্য স্থিতি লাভ করে, সে যদি একজন সাধারণ বা অজ্ঞ লোক হয়, তাঁর নিকট যদি কোরান কিতাব বা নবী-অলীদের বাণী পাঠ করা হয়, যাতে সত্যের বর্ণনা রয়েছে, তাহলে সে স্বীয় অবস্থা সাপেক্ষে উহার মর্মার্থ এমন সুন্দরভাবে বুঝতে সক্ষম হবে, যা অন্য কোনো জাহেরিবিদ্যার অধিকারী ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি অনুরূপ সত্যের আধার ব্যক্তি নিজের দেহ মনে সত্যকে অনুভব করবে এবং সত্য তাঁর সারবস্তুতে পরিণত হবে। আর সকল কথার মধ্যে বিনা তর্কে গণিমতের মালের মতো সত্যকে গ্রহণ করতে থাকবে এবং সত্যের আধার নিজে তার সার বস্তুতে পরিণত হয়ে যাবে, যার মধ্যে সত্য অধিষ্ঠান না করে সে তা বুঝবে না। নিছক হাবাগোবা হয়ে যাবে। আর যদি সে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী হয়, তাহলে তো তা অস্বীকারই করবে। সত্যের আধার ব্যক্তি কোরান কিতাব এবং সত্যবাণী তথা নবী-অলীর বাণীসমূহ গ্রহণ করবেন। আবার যখন তিনি তা থেকে বর্ণনা করবেন অবিকৃতভাবেই করবেন। এ হল তার মূলধন।
উপরের আলোচনার সারমর্ম হল, সত্য সত্যই আর কুফ্র হল বাতিল। কুফ্র অর্থ অস্বীকার করা। অতএব যে সত্যকে অস্বীকার করে, সে কাফির এবং বাতিল। অজ্ঞতার কারণে কেউ যদি সত্যকে অস্বীকার করে, তাহলে সে নিকৃষ্টতম হতভাগা। কারণ অজ্ঞতাবশত কেউ যদি আপন লোকদের হত্যা করে তাহলেও তো তারা মারা যাবে। অনুরূপভাবে অজ্ঞতাবশত সত্যকে যদি বাতিল বলা হয়, তাহলে সে সত্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। তার মধ্যে বর্তমান সামান্যতম সত্য যাকে বেহেশ্ত মনে করছ তাও বাতিল হয়ে যাবে। অতঃপর যথার্থভাবে কুফ্রের অর্থ প্রমাণিত হল। যে ব্যক্তি সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে কিয়ামতে সে বাঘে আক্রান্ত বকরীর ন্যায় ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। যথাসম্ভব এটা মিথ্যা নয়।
সত্যাধারের সত্যতা হল তার জ্ঞান। এ জ্ঞান পর্দা নয়। এ হল রহস্য জ্ঞান, যে ব্যক্তির মধ্যে সত্য অধিষ্ঠান লাভ করে তাঁর পর্দা রূপ জ্ঞান ঢেকে যায়। কিন্তু হাযেব (পর্দায় আবৃত) এ বিষয়ে অবহিত থাকে না। এ প্রসঙ্গে ঘটনার মধ্য দিয়ে আরও দু-একটি কথা শ্রবণ কর। ঘটনাগুলো নিম্নরূপÑ
একদিন হযরত হাবীব (রঃ) নামাজে সূরাÑ الحمد (আল্ হ্যামদু) এর স্থলে الحمد (আল্ হামদু) পাঠ করেন। হযরত ইমাম হাসান বস্রীও তাঁর পিছনে নামাজ পড়ছিলেন। তিনি নামাজ ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি কি অজ্ঞ এবং তিনি একাকী নামাজ পড়লেন। অতঃপর রাতে স্বপ্নে দেখেন আল্লাহ্্ তাকে বলছেন, তোমার সারা জীবনের ইবাদত পন্ড হয়ে গেল। কারণ তুমি আমার প্রকৃত বন্ধুকে হীন জ্ঞান করেছ এবং তুমি ধারণা করেছ যে, তোমার নামাজ তাঁর নামাজের চেয়ে উত্তম হয়েছে। কারণ, তিনি ‘আল্ হ্যাম্দুর’ স্থানে ‘আল-হামদু’ পাঠ করেছেন। তবে আমি তাঁর ‘আল্-হামদু’ পাঠেই সন্তুষ্ট। এরপর তিনি চল্লিশ দিন পর্যন্ত এতেকাফ করেন এবং রোযা রাখেন আর আল্লাহ্্র দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। যতদিন না তিনি আল্লাহ্্র রহমতে ক্ষমার ব্যাপারে আশান্বিত হন।
দ্বিতীয় ঘটনা, একদিন হযরত হাবীব (রঃ) এবং ইমাম হাছান বস্রী দুজনেই ইচ্ছা করলেন, নদীর ওপার যাবেন। তাঁরা নদীর কূলে এসে দেখলেন, পাড়ে কোনো নৌকা নেই। উভয়েই চিন্তা করছিলেন কী করা যায়। এমন সময় হযরত হাবীব (রঃ) বললেন, চলুন নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাই। এতে হযরত ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বললেন, তুমি পাগল হয়েছ? এতে তিনি চুপ করে থাকলেন এবং পরে নদীর উপর দিয়ে রওনা করলেন। নদীর ওপারে গিয়ে নিজের কাজ সম্পন্ন করে একইভাবে ফিরে এসে দেখেন উক্ত ইমাম সাহেব সে স্থানেই বসে রয়েছেন। তিনি তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হাবীব, তুমি কিভাবে নদীর উপর দিয়ে হেঁটে গেলে? উত্তর দিলেন, ওস্তাদ্জী তুমি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছ, তা সত্ত্বেও কলম দিয়ে ঘষে অনেক কাগজ কালো করেছ। আর আমি নিজের অন্তরকে ঘষে পরিষ্কার করে নদী পার হয়ে গেছি। এ কথা শুনে হযরত ইমাম সাহেব বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কয়েক ঘণ্টা পর প্রকৃতিস্থ হয়ে বললেন, আল্লাহ্্ জানেন, হয়ত তুমি কিয়ামতের দিনও এভাবে পার হয়ে যাবে। আমি পড়ে থাকব।
এখানে লক্ষণীয় যে, হাবীব (রঃ) একজন বিদ্যাহীন লোক। তাছাড়া তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সুদখোর এবং কৃপণ ব্যক্তি। কিন্তু তা থেকে বিরত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মধ্যে সত্য স্থিতি লাভ করে এবং তিনি সত্যের পরম পরাকাষ্ঠায় পরিণত হন। তাছাড়া অনুরূপ আরও অনেক ঘটনা বাবা শেখ ফরিদ (রঃ) তাজকেরাতুল আউলিয়াতে উল্লেখ করেছেন। অতএব স্বীকার্য যে, সকল বস্তুসত্তা মৌলিকভাবে স্থিতিশীল সকল বস্তুর উৎস থেকে উৎসারিত। এ এক ধরনের প্রকাশ। যেমনÑ আগুন, যেখানেই আগুন দেখা যাক না কেন, তা আগুনের উৎসকুন্ড থেকে উৎসারিত। এখন সে যেখান থেকেই আগুন সংগ্রহ করুন না কেন, তা মূলত এক এবং অভিন্ন। এখানে ভাগাভাগির কোনো সুযোগ নেই। সত্য যাদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা অলী তাঁদের স্তরেও কোনো ভাগাভাগি নেই। তাঁরা সেখানে পরম সত্তায় একাত্ম। এ ধারণাটা প্রকাশিত হওয়া এবং প্রকাশ করার আবর্তনের ওপর স্থিতিবান। এমতাবস্থায় বিচ্ছুরণ থেকে আগুন সংগ্রহ করা আর তার উৎস কুন্ড থেকে সংগ্রহ করা একই অর্থ। তবে যে ব্যক্তি যে আবর্তনের মুখোমুখি হবে তাকে তা থেকেই নিজের কাক্সিক্ষত বস্তুটি লাভ করতে হবে। কারণ প্রকাশের উৎস থেকে প্রকাশ ঘটে আর প্রকাশ ঘটলে তা থেকে মক্ছুদ হাসিল করতে হয়।
অতএব প্রমাণিত হল যে, প্রতিষ্ঠিত পরম সত্য হল আল্লাহ্্ এবং দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠিত সত্য তাঁর প্রকাশস্থল। আর যে বান্দা সত্যকে আত্মভূত করেছেন, তিনিও সত্যেরই প্রকাশ এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য। তিনি প্রকৃত সত্য। তাঁর কাছ থেকে আলো গ্রহণ না করলে আলো লাভ হবে না। কারণ মাধ্যম ছাড়া প্রকাশ ঘটা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ্ বলেন, كونو مع الصادقين ( (কুনু মাআছ্ ছাদিকীন) অর্থাৎ, সত্যাশ্রয়ী যিনি সত্যকে আত্মভূত করেছেন, তাঁর সাথী হও। অর্থাৎ তাঁকে ডাক, তাহলে আমি শুনব। কারণ তিনি সত্য প্রকাশের মাধ্যম।
এজন্য আপন অলীকে ডাকা আর আল্লাহ্্কে ডাকা একই। অতএব জানা গেল যে, আলোর আধার থেকেই আলো সংগ্রহ করতে হবে। এটা আল্লাহ্্র বাণী দ্বারা প্রমাণিত। তাই মাকছুদ হাসিলের লক্ষ্যে দ্বিতীয় উৎস তথা সত্যের প্রকাশ মাধ্যমের শরণাপন্ন হওয়া ফরয। এর বিপরীত কিছু করা হারাম এবং নিজেকে বঞ্চিত করা। তাই বঞ্চিতরা সাধারণত কাফির, ফাসিক এবং পাপী হয়ে থাকে। কারণ সে অলীকে বাদ দিয়ে আল্লাহ্্কে ডাকে। এটা নিষ্ফল এবং এর দ্বারা কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তার ধারণা, আল্লাহ্্ ছাড়া কাউকে ডাকা শিরক্। এতে করে এ মূর্খ আল্লাহ্্র বাণীকেই সরাসরি অস্বীকার করছে এবং অজ্ঞতাবশত মূলকে ভিন্ন কিছু মনে করছে। সে প্রকাশ ও প্রকাশের স্থলকে অর্থহীন মনে করে। সুতরাং জেহালত তথা অজ্ঞতার প্রেক্ষিতে সে আবু জেহেলে পরিণত হয়, যা যথার্থ অর্থেই কুফরি। এ নিরেট মূর্খ জানে না যে, হাত দ্বারা ধরা আর রূহের ধরা একই কথা।

অজ্দ্ এর পরীক্ষা
কেউ কেউ অজ্দ্ তথা ভাবের সীমা নির্ধারণ করেছে। তাঁরা বলতে চায় যে, অজ্দ্ মগ্ন ব্যক্তিকে তলোয়ার অথবা সুঁই দ্বারা আঘাত করে পরীক্ষা করতে হবে। যদি তাঁর ব্যথা বোধ না হয়, তাহলে মনে করতে হবে সে অজ্দ্ মগ্ন। এ কথায় বোঝা যায় যে, অনুরূপ পরীক্ষা করা আবশ্যক এবং শরিয়তের নির্দেশ। তাছাড়া অজ্দ্ সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং ছেলেকে বাবার দেহে মুরিদকে শাইখ-এর দেহে এবং উম্মতকে নবীর দেহে অথবা এর বিপরীতে ছুরি প্রভৃতি চালাতে হবে। অথবা, প্রত্যেক অজ্দ্ মগ্ন ব্যক্তি অজ্দ্ অবস্থায় নিজের হাতে সুঁই নিয়ে আপন দেহে ঢুকিয়ে তাঁর অজ্দ্ জানার চেষ্টা করবে কি না তাও বল? কোনো নবী-অলী কি এমনটা করেছিলেন, না করেননি? বিশেষ করে বদরী সাহাবাদের অবস্থার ক্ষেত্রেও কি এ হুকুম ছিল? অধিকাংশ নবীদের অজ্দ্ এবং ভাবের উদয় হত, তাঁরাও কি এ কাজ করতেন? বল, উত্তর দাও! আসলে এ হল কোনো গবেট এবং ফালতু লোকের ফালতু প্রলাপ। তা না হলে বল, কোন হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত? এবং এ হাদীসের বর্ণনাকারী কে, বল?
অজ্দ্ একটি অবস্থার নাম, যা যিকিরকারীর সাথে যুক্ত হয়। তা চল্লিশ অথবা চুয়াল্লিশ প্রকার। অজ্দ্ অবস্থায় সর্বনিম্ন পর্যায়ের জজ্বার দ্বারা দেহে এক প্রকার আলোড়নের সৃষ্টি হয়। যেমনÑ গরম অনুভব করা বা কম্পন, অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি। এ জজ্বা খুব শক্তিশালী না হলেও এর মৌল বস্তু অনেক উত্তম। এটাকে সাধকের দরজার চাবি বলা হয়। এহ্সানের কিতাবসমূহে এ ধরনের কম্পনকে সাধারণ কেরামত বলা হয়েছে। এ একটি বিশেষ অবস্থা যা নবী-অলীদের জন্যই কেবল প্রযোজ্য। এর প্রচুর উপকারিতা রয়েছে। অজ্দ্ এর আলোচনায় এর বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে দেখ। মোটকথা অজ্দ্ সাধককে উচ্চতর স্থান ও মর্যাদার দিকদর্শন প্রদান করে। ফলে সাধকও যা পাওয়ার তাই পান এবং অবহিত হন, যা তাঁর অবহিত হওয়া দরকার। তবে উক্ত অজ্দ্সমূহের মধ্যে যেটার প্রতিক্রিয়া তীব্র এবং গরম তাকে গোলবা ও সোক্কর বলা হয়। তা সাধককে অচেতন ও অস্থির করে ফেলে। এ অবস্থায় প্রকাশিত কল্যাণাদি বর্ণনাতীত। যখন অজ্দ্রে উপকারিতা বর্ণনা করতে কলম অক্ষম এবং সকল অজ্দ্রে উৎস বস্তু ও পূর্ণতা অভিন্ন নয়, বরং প্রকারভেদে ফলাফল হয়ে থাকে, তখন কোন অজ্দ্ সম্পর্কে তুমি অবহিত এবং কার ওপর তলোয়ার বা ছুরি চালাবে, বলো?

নামাজের বিবরণ
নামাজ একটি সর্বাঙ্গীণ কল্যাণকর ইবাদতের নাম। নামাজ ‘নিয়ামতে সদরে কোব্রা’ তথা শাহী মালখানার চাবি। যার বহির্ভাগ নবুয়ত এবং মগজ তথা অভ্যন্তর বেলায়েতে পরিপূর্ণ। তাতে ঐ জিনিস রয়েছে যা সদরে কোব্রা তথা শাহী মালখানার বিপরীত অন্য কিছুর প্রতি মুখাপেক্ষী হয় না। অর্থাৎ, কোনো জিনিসেরই মুখাপেক্ষী হয় না। এ-নামাজ আল্লাহ্্ তা’য়ালার সমস্ত পরিপূর্ণতার। অর্থাৎ, এ নামাজের মধ্যে একাধারে ইবাদত, আনুকূল্য, নৈকট্য, সৌন্দর্য এবং ভ্রমণাদি রয়েছে। এতে সাধকের সফর কার্যাদি বিভিন্ন অবস্থা, দোয়া, আত্মসম্বোধন, আত্মমুখী হওয়া এবং অন্যের দিকে মনোনিবেশ না করা, কাশ্ফের প্রদীপ থেকে সফর তথা মিরাজের বিভিন্ন স্তর ও স্থানসমূহকে আলোকোজ্জ্বল করা ইত্যাদি। অর্থাৎ, আপন অন্তর ও নফ্সের প্রতি মনোযোগী হওয়ার সাথে চুড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে আল্লাহ্র প্রতি নিবেদিত হওয়া এবং কা’বা, জমিন এমনকি নবী-অলীদের প্রতিও মনোনিবিষ্ট হওয়ার প্রশিক্ষণ রয়েছে। নামাজের মধ্যে যে সব জিনিসের নাম মুখে উচ্চারণ করতে হয়, তাদের অর্থ-মর্মের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয় ও মনোযোগ দিতে হয়। এমনকি এসবের সাথে উভয় জগতের মধ্যে যে সব বস্তু রয়েছে সব কিছুর নাম জপ করতে হয় এবং ঐগুলোর প্রতি খেয়াল এবং ধ্যান রাখতে হয়। এসব বিষয়ে দৃষ্টি না থাকলে তাকে নামাজ বলা যায় না, বরং তা খেল-তামাসার শামিল।
আর যার অবস্থা এরূপ নয় তার নামাজ অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। কারণ দন্ডায়মান অবস্থায় নামাজির শির ঊর্ধ্বালোকে এবং নূরানী দৃষ্টি জমিনে ঝলসাতে থাকে। আর এটাকে সালাতের দর্পণ বলা হয়। এ দর্পণে পূর্ণ সফর প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হয়। এটা মহাসফর। এ সফরে একবার নিমজ্জিত হলে কিয়ামত পর্যন্ত তা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়। এ কিয়ামই হল মহান অলীদের কিয়াম তথা অবস্থা। তাঁরা এক কিয়াম অবস্থায় পুরো জীবন কাটিয়ে দেন। এ এক কিয়ামেই তাঁদের নামাজ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং তাঁদের আহ্ওয়াল তথা ভাবান্তরসমূহের মাধ্যমে রুকু সিজ্দা প্রকাশ পায়। যেমনÑ বৃক্ষাদির সিজ্দা, তাদের ভাবের মাধ্যমে সিজ্দা সম্পন্ন হয়। রুকু, তথা উপর দিক থেকে মাথা নিচু করা সফর থেকে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করা বোঝায়। অর্থাৎ, এটা এ সফরে পৌঁছার মঞ্জিল। এখানেই এ সফরের ফলাফল এবং উপকারিতা অর্জন হয় এবং ‘আহ্ওয়াল’ তথা ভাবগত সফরে মস্তক অবনত অবস্থায় যে নিয়ামত এবং বরকত রয়েছে, তাও এখানে সংগ্রহ করতে হয়। যেমনÑ গাড়ি অথবা জাহাজ থামিয়ে যার যার দেনা পাওনা দিয়ে অবসর হয়ে যাওয়া। কিন্তু ঐ সময় কুতুবী দর্পণে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয়। এজন্য আপন পায়ের উভয় বুড়ো আঙ্গুলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয়। আর ঐ উভয় আঙ্গুলকে দেহের মধ্যে কুতুব বলা হয়। এখানে কুতুবী দর্পণে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে আহ্ওয়ালে কুতুবিয়া তথা কুতুবদের ভাব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এ কারণে গাউস-কুতুবদের দৃষ্টি সদা জমিনে নিবদ্ধ থাকে, যেন পৃথিবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। উক্ত কারণেই চার জন কুতুব পৃথিবীর চারপাশে সদা দন্ডায়মান থাকেন। এ চার কুতুবের ফায়েজ দেহের চার কুতুবের ওপর প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ হাত ও পায়ের চার বুড়ো আঙ্গুলের উপর থাকে, যাকে আরবিতে ‘এবহাম’ বলে। এ কারণে নামাজে আঙ্গুল জমিনে যুক্ত থাকে এবং খেয়াল রাখতে হবে যেন তা জমিন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না পারে।
মোটকথা রুকুর ভেতরে নামাজী মুসাফির গন্তব্যে যাত্রার পর পূর্ণ নিয়ামত গৃহে পৌঁছে আত্মিক সফরে রত হয়। অর্থাৎ যে সফরে নফ্সের মিরাজ এবং কাশ্ফ বা প্রভুসত্তার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এখানেÑ نحن اقرب اليه من حبل الوريد ( (নাহ্নু আক্রাবু ইলাইহি মিন্ হাব্লিল ওয়ারীদ্) অর্থাৎ, “আমরা তার শাহ্রগের থেকেও নিকটে” এ ঘোষণার মর্মার্থ পুরোপুরিভাবে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ, এ স্তরে নৈকট্য সূত্রে একাত্মতা ঘটে এবং وهو معكم اينما كنتم (ওয়া হুওয়া মাআকুম আইনামা কুন্তুম) অর্থাৎ, (থাকেন তিনিও তোমাদের সাথে যথায় আছ তোমরা) অর্থাৎ, আল্লাহ্্ বলেন, তোমরা নামাজের মাধ্যমে যেভাবে এবং যেরূপে ইবাদত করছিলে, তখন আমিও তোমাদের সাথে এবং নিকটেই ছিলাম। এতে প্রমাণিত হয় যে, নিকট থেকে সাথী সত্তা অধিক উত্তম ও দৃঢ়। অর্থাৎ যা শাহ্রগ থেকে নিকটতম তাই সাথীত্ব অর্জনের স্থান যা কল্বে মুদাব্বির তথা চক্রাকার অন্তরের একেবারে মাথায় অবস্থিত। অতএব নামাজে নিজেকে নিকট করা ভূমি সত্তার সাথে স্বয়ং সম্পৃক্ত হওয়া। যার প্রকাশ ‘নূরে মাহ্মুদা’, যা দু’ভ্রুর মধ্যস্থল তথা মূল কপাল এবং তা আল্লাহ্্ দর্শনের দর্পণ। নাকের মাথা হল রহস্যময় গোপন নালা এবং সত্যতার দর্পণ। এজন্য সিজ্দায় দৃষ্টি নাকে নিবদ্ধ রাখতে হয়। আর দুটি সিজ্দা দুটি বেলায়েতের ফলশ্রুতি। যেহেতু দ্বিতীয় বেলায়েত প্রথম বেলায়েত থেকে উত্তম। সেহেতু প্রথম সিজ্দা থেকে দ্বিতীয় সিজ্দা উত্তম। অর্থাৎ, প্রথম সিজ্দায় নিকটে আর দ্বিতীয় সিজ্দায় নিকটতম হওয়া যায়। দূরত্ব থেকে নৈকট্য আর নৈকট্য থেকে দূরত্বের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্যই নৈকট্য লাভের পর সফরে দূরত্ব ঘটায় আর এ উভয়ের মধ্যে যে মঞ্জিল রয়েছে তা একটিই। তাই রুকু একটি হয়েছে। একটি নৈকট্য ও সাথীত্ব লাভের শুক্রিয়াস্বরূপ আর অপরটি হল আল্লাহ্্র ইবাদতের উদ্দেশে নিবেদিত। এ জন্য সিজ্দা দুটি হয়েছে। অতঃপর সিজ্দার শেষে বৈঠক উভয় দিকের মোসাহেদার ইঙ্গিত, যা বক্ষমধ্যে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, বক্ষমধ্যে সমগ্র জগতের জ্ঞান রহস্যে বিদ্যমান। এ জন্য তাকে জগৎপাত্র বলা হয়। সবশেষে সালামের মাধ্যমে অবসর হওয়ার অর্থ হল অন্যের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। এ অবস্থায় কথা বোধগম্য হয়। অর্থাৎ, ইতিপূর্বে মিরাজের পথে ছিল, এখন তা থেকে অবতরণ হল। এ সালাম কোনো ফেরেশতাকে এবং কোনো লোককেও দেওয়া যেতে পারে। দু রাকাত নামাজের অর্থ হল দু’বার নিয়ামতের ভিতরে প্রবেশ করে তৎসহ বের হয়ে আসা আর চার রাকাত নামাজের দু রাকাত হল আল্লাহ্্র ইবাদত আর বাকি দু রাকাত হল শুক্রিয়া।
সাহায্যের বর্ণনা
সাহায্য দু প্রকারÑ (১) মিলনের সাহায্য, (২) নৈকট্যের সাহায্য। পরম সত্তায় একাত্ম হওয়ার সাহায্যই মিলনের সাহায্য। যা সাহায্যকারীর সত্তার বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত তা সাহায্যপ্রার্থীকে ভাবান্তরের মাধ্যমে সহায়তা করে, এটাই আসল সাহায্য। এ সাহায্যকারীই আসল সাহায্যকারী আর তা হল প্রভুসত্তা।
দ্বিতীয়ত, নৈকট্যের সাহায্য নৈকট্যের সে উৎসকে বলা হয়, যা নৈকট্য অর্জনের পথে রাহ্মানী সত্তা বান্দার গুণগত অবস্থাদির সহায়ক হয়। নৈকট্যের উৎসের সাথে মিলিত ব্যক্তিও নৈকট্যপ্রাপ্ত তেমনি সে উৎসের কাছাকাছি ব্যক্তিও নৈকট্যের উৎস হাসিলের প্রেক্ষিতে নৈকট্যপ্রাপ্ত। কারণ যা মূলের নৈকট্যপ্রাপ্ত তার নিকটতম বস্তুও নৈকট্যপ্রাপ্ত। যে কোনো সাহায্য প্রাপ্তির জন্য উসিলা বা মাধ্যম প্রয়োজন। কারণ, এর মূল হল নৈকট্য ও মিলন। এ কারণে সাহায্য কোনো স্বতন্ত্র বস্তু নয়। সকল প্রজাতির মধ্যেই সাহায্য সাধারণভাবে বর্তমান। অর্থাৎ সত্তাগত সাহায্য সত্তা থেকে, গুণগত সাহায্য গুণ থেকে আর অবস্থাগত সাহায্য অবস্থা থেকে। অর্থাৎ, আল্লাহ্্ তা’য়ালার জাত ও মর্যাদা থেকে সাহায্য বান্দার জাত ও মর্যাদাতে নিপতিত হয়। কোনো সাহায্যপ্রার্থীর পক্ষেই কোনো উসিলা ব্যতীত তা পাওয়া সম্ভব নয়। অপর দিকে সাথীত্ব বলতে মূল সম্পর্ক সূত্রের সাথে অবিরত যোগাযোগ বোঝায়। অর্থাৎ, আল্লাহ্্র সাহায্য বান্দার ওপর এবং বান্দার সাহায্য বান্দার উপর। এটাও আল্লাহ্্র সাহায্য। অতএব, বান্দার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাও পরম সত্তায় মিলিত হওয়ার জন্য নৈকট্য বা সাহায্য প্রার্থনারই অন্তর্ভুক্ত। এজন্য নৈকট্য অর্জনে সাহায্য করা সকল ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। যেমন মাতা-পিতা ও অন্যদের সাহায্য। যে ব্যক্তি এ সাহায্যকে অস্বীকার করে, সে কাফির। স্মরণীয় যে, মানুষের প্রতি মানুষের অনুগ্রহ করা ওয়াজিব। কারণ এক মানুষ অপর মানুষের সাহায্য হিসাবে অনুগ্রহ করবে, অন্যথায় পাপ হবে। এটা নৈকট্য লাভের সাহায্য। এ অনুগ্রহ এবং নৈকট্যের সাহায্য যার নেই তার নৈকট্য লাভ হয়নি। অপর দিকে যে ব্যক্তি নৈকট্যের সম্পর্ক রক্ষা করে সে আল্লাহ্্র নিকট তথা তাঁর মহামহিম ব্যবস্থার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং সাহায্য প্রদান করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি এ সাহায্য চাওয়া বা সাহায্য দেওয়ার কার্যাদি থেকে দূরে থাকে, সে শুধুই কেবল আকাশের দিকে হস্ত প্রসারিত করছে। সে ধারণা করে নিয়েছে যে, আল্লাহ্্র অবস্থান আকাশে। তা না হলে কোন সূত্রে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্্ আকাশে অবস্থান করেন? তাদের হতবাক হয়ে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। এ শ্রেণীর লোকেরা সর্বদাই সৃষ্টিজাত সাহায্যকে অস্বীকার করে। তারা জানেই না যে, উসিলা ছাড়া সাহায্য সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আল্লাহ্্র সমস্ত সৃষ্টি উসিলা বা মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। তথা আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস প্রভৃতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই বাস্তব রূপ গ্রহণ করেনি। তথা আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস প্রভৃতির মধ্যে ব্যবস্থাপক শক্তি নিহিত রয়েছে। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ঐ সকল বস্তু নির্মাণে যা কিছু প্রয়োজন সে বিষয়ে তাদের সাহায্য কর এবং সংযোজন কর তাতে যা সংযোজন করা প্রয়োজন। অতঃপর প্রত্যেক বস্তু অস্তিত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রত্যেক বস্তুই স্ব স্ব শ্রেণী অনুযায়ী আপন দেহকে সাহায্য করে তথা তাতে অবস্থান গ্রহণ করে। মোটকথা এগুলোকেই সাহায্য বলা হয়। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত সাহায্য শুধু অনুমান করেই আল্লাহ্্র উপর ছেড়ে দেয়া হয়। বস্তুতঃপক্ষে তাকে আল্লাহ্্র দায়িত্বভুক্ত করা আল্লাহ্্র অলীদের কাজ। কারণ তাঁরা আল্লাহ্্র সত্তা গুণাবলি প্রভৃতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। তাঁরা আত্মার রহস্য সম্পর্কে অবহিত। উদাহরণস্বরূপ কোনো বেলায়েতপ্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি আল্লাহ্্তে ফানা তথা বিলীন হয়ে গিয়েছেন, তিনি যদি তাঁর মুর্শিদের কাছে ‘বাকাবিল্লাহ’ তথা আল্লাহ্্তে স্থিতিবান হওয়ার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন তাহলে মুর্শিদ আল্লাহ্্র সত্তায় স্থিতিবান অবস্থান থেকে আপন মুরিদকে সাহায্য করবেন এবং যার স্থিতি অর্জিত হয়েছে, তিনি মুর্শিদের মৌলিক বস্তু তথা আল্লাহ্্র ও মূল সত্তা মুরিদকে দান করবেন। অনুরূপভাবে এ পর্যায়ে এসে একক উৎসে মিলিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ, বান্দা একক সত্তায় পৌঁছে স্থিতিবান হয়ে যাবে। এ হাদীস শরীফে তার মর্মার্থ ব্যক্ত হয়েছেÑ الفقو اذاتم فهو الله (আল ফাক্ক্রু ইজা তাম্মা ফাহুয়াল্লাহু) অর্থাৎ, বেলায়েতের সমাপ্তির পরিপূর্ণতার ফলশ্রুতিতে যে ফকিরী তাই আল্লাহ্্ তথা মানবীয় রূপ গুণাবলি থেকে মুক্ত সত্তাই আল্লাহ্্। কারণ তাঁর সত্তা আল্লাহ্্র সত্তায় স্থিতি লাভ করে গেছে। যেমন মাওলানা রুমী বলেন,
“র্গ জোদা বিনি আজ্ হক্ব-ই খাওয়াজ্রা
গম্ কুনি হাম্তন্ ওয়াহাম্ দিবাজ্রা।”
(অর্থাৎ, মুর্শিদকে আল্লাহ্্ থেকে আলাদা দেখলে তাঁর আদ্যোপান্ত সব হারিয়ে গেল)। তাই হযরত মুজাদ্দিদ (রঃ) তাঁর মকতুবাতে বলেন, “পীরে তাস্ত আউয়াল মা’বুদ তাস্ত্।” অর্থাৎ, তোমার পীর-ই তোমার প্রথম মা’বুদ। সুতরাং যার এ যোগ্যতা নেই সে কী করে অন্যকে ফানাফিল্লাহ্র ব্যাপারে সাহায্য করবে? অযোগ্য ব্যক্তি অন্যকে সাহায্য করতেও অক্ষম। তার কাছে সাহায্য চাওয়া অযথা।

বিবাহের স্থায়িত্ব
প্রকৃতপক্ষে বিবাহ একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। কিয়ামত পর্যন্ত এ সম্পর্ক ছিন্ন হয় না, যদি তা রক্ষা করা হয়। যেমনÑ ঈমান ইত্যাদি। তবে প্রকৃত ঈমান কখনো আলাদা হয় না, কিন্তু অপ্রকৃত ইমানের ভিন্ন হওয়া অসম্ভব নয়। অনুরূপভাবে অধিকাংশ নবী-অলীদের মধ্যে প্রকৃত বিবাহ বর্তমান। এজন্য নবী-অলীদের পবিত্র স্ত্রীগণকে কোনো উম্মত বা মুরিদ বিবাহ করতে পারে না, বরং তাঁদের বেলায় মাতৃত্বের বিধানাবলি প্রযোজ্য। তাঁরা পরলোকগমন করার পরও জীবিতদের সঙ্গে তাঁদের রূহানী সম্পর্ক ছিন্ন হয় না। তাই কোরান পাকে বলা হয়েছেÑلاتحسبن الذين قتلوا فى سبيل الله اموات بل احياء (লা তাহ্সাবান্নাল্লাজীনা কুতিলু ফি সাবীলিল্লাহি আমুয়াতান্ বাল্ আহ্ইয়াউ) অর্থাৎ, শহীদদেরকে মৃত বলো না, বরং তাঁরা জীবিত, তাঁরা আহার করছে এবং বিশ্রাম করছে। এখানে বিশ্রাম কথাটি সাধারণ। সমজাতীয়তা সূত্রে আবদ্ধ বিবাহে, জীবিত ও মৃত অবস্থায়ও কোনো পার্থক্য নেই। এজন্য তারা কবর এবং কিয়ামতেও আপন আপন বিবিদের পাবেন। সাধারণ লোকদের বেলায়ও কারও বিবাহই বাতিল হয় না, স্থগিত হয়ে যায় মাত্র। এজন্যই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে উত্তরাধিকারিত্ব থেকে যায়।
অপরদিকে তালাকপ্রাপ্ত হলে উত্তরাধিকারিত্ব থাকে না, বরং তাদের বিবাহ ছিন্ন হয়ে যায়। সুতরাং বিবাহ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে বৈবাহিক সম্পর্কও চলে যায়। কিন্তু বিবাহ যখন স্থগিত থাকে এবং বাতিল করা না হয়, তখন স্বামী-স্ত্রীর রূহ্ যদি সমজাতীয়তার সম্পর্ক রাখে, তাহলে ইহজগতে রূহানী সম্পর্কসূত্রে তথা স্বপ্ন ইত্যাদিতে এবং সত্তা সম্পর্কসূত্রে কবরে ও কিয়ামতে প্রকৃত সম্পর্কসূত্রে পরস্পর ব্যবহৃত হতে থাকবে। উপরোক্ত প্রামাণ্য বিশ্লেষণের পর স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর পরস্পর মুখোমুখি হওয়া, একে অন্যকে গোসল করানো বা কবরে নামানো প্রভৃতি কাজের অবৈধতা সম্পর্কে মজবুত কোনো দলিল প্রমাণ নেই। ফিকার কিতাবে যদি কিছু লিখেও থাকে তা সাধারণ ফেৎনার প্রতিরোধকল্পে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। অন্যথায় প্রাণহীন দেহে ফেৎনার কোনোই আশংকা নেই; বরং তাকে মানুষ অবজ্ঞা করে বা ভয় পায়। হাদীস শরীফে আছে, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক নবী স্ব স্ব উম্মতের সাথে এবং প্রত্যেক দলনেতা আপন আপন দলের সাথে থাকবে। তাঁরা ভালো হোক অথবা মন্দ হোক। শুধু কিয়ামতেই নয়, বরং কবর, রূহের জগৎ এবং মঞ্জিলে সর্বদাই থাকবে। তাছাড়া পিতা-মাতা এবং ভ্রাতা-ভগ্নি ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনের সাথে রূহানী সজাত্য সম্পর্ক বর্তমান থাকে। মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা, ভাইবোনদের অধিকার বাতিল হয় না। তাঁরা সকল পাওনার অংশীদার এবং তাঁদের কোনো অধিকার বাতিল হয় না। তাহলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর অধিকার কী করে বাতিল হবে? নবী-অলীদের ক্ষেত্রে তো এ প্রশ্নই উঠে না, বরং সাধারণ লোকদের ক্ষেত্রেও কোনো স্ত্রীলোক যদি সজাত্যের প্রেক্ষিতে স্থগিত বিবাহকে বাতিল না করে, তাহলে তাঁদের অন্তরঙ্গতার প্রভাব কী করে বাতিল হবে এবং এ প্রভাব বাতিল হওয়ার কী কারণ আছে?

স্থায়ী বৈশিষ্ট্য
স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের বেলায় সকল বস্তুর মূল একই। যেমনÑ গম বা ভূট্টার দানাগুলো থেকে প্রথমত একটি দানা রোপণ করা হয়। তা থেকে বৃক্ষ ও ডালপালা গজানোর পর তাতে আবার দানা উৎপন্ন হয়, শত-সহস্র সংখ্যায়। এসব দানার জাত ও গুণে কোনো খুঁত নেই; বরং সবগুলোরই স্থায়ী বৈশিষ্ট্য এক। এগুলোকে যদি পুনরায় রোপণ করা হয়, তাহলে তা থেকে শত-শত সংখ্যায় উৎপন্ন হবে। যে ব্যক্তি উক্ত স্থায়ী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছেন, তিনি আরেফ এবং মুহাক্কেক। তিনি আত্ম জ্ঞানালোকে আপন রূপ গুণ ও পূর্ণতার মাপকাঠিতে আপন আল্লাহ্্কে চিনতে পারেন। কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আল্লাহ্্র প্রকাশ তাঁর প্রকাশ মাধ্যমের অনুরূপ হওয়া জরুরি। প্রবাদ আছেÑ “যেমন কূপ, তেমন জল। আর যেমন গাছ তেমন ফল।” অর্থাৎ, স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে মিষ্টি ও তেতো বিভিন্ন স্বাদে রকমারি সব ফল আপন মিঠা-তিতা প্রভৃতি স্বাদে অভিন্ন। এগুলো যখন এদের স্থায়ী উৎস থেকে প্রকাশিত হয়, তখন এদের স্ব স্ব গুণাবলি প্রকাশ পায়। প্রকৃতপক্ষে তা স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের-ই প্রকাশ। যেহেতু সকল বৈশিষ্ট্যের মূল উৎস আল্লাহ্্র সত্তা, সেহেতু যে স্থানে অথবা যে মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয় চূড়ান্ত উপলব্ধিতে তাই সত্তা। এ নীতি সম্পর্কে যিনি চিন্তা করেছেন, তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো মিষ্টি ভাষায় আপন পরিচিতকে এভাবে স্মরণ করেনÑ
“গাহে দার সুরতে লাইলী ফেরোশোদ
গাহে আজ সুরতে মজনুন্ র্ব আমদ্।”
অর্থাৎ, কখনো লাইলির পোশাকে আবৃত লাইলির মধ্য দিয়ে সত্য প্রকাশিত হয়েছে আবার কখনো প্রকাশিত হয়েছে মজনুরূপে। প্রকৃতপক্ষে এটা বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ধরন ও দলিল। যার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়নি, সে আরেফ নয়। আর যার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য স্থিতিবান নেই, সেও আল্লাহ্্ নয়। যার ওপর এসব বৈশিষ্ট্যের প্রভাব রয়েছে তিনি মহাপ্রভাবশালী। তিনি কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ্্ থেকে গাফিল নন। চাই তিনি কা’বাতে থাকুন বা মন্দিরেই থাকুন না কেন? যেখানে ধোঁয়া দেখা যায়, সেখানে অবশ্যই আগুনের অস্তিত্ব থাকতে হবে। অনুরূপ আরও একটি নির্দিষ্ট বচন আছে, “যত কল্লা তত আল্লাহ্্।” অর্থাৎ, প্রত্যেক জাতেরই মূল উৎসের বৈশিষ্ট্যের বিচারে আল্লাহ্্র সত্তার প্রকাশ। সকলেই আপন আপন যোগ্যতানুযায়ী তাকে উপলব্ধি করে। আর যারা এ বিষয়ে অজ্ঞ, তাদের একূল সেকূল কিছুই নেই। এরা গাফিলের দল বিভ্রান্ত এবং জড়বুদ্ধি। এরা কোরান কী বুঝবে, হাদীসেরই বা কী জানবে? এরা কোরানের প্রশংসাকারী হতে পারে, কিন্তু এদের দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত কোরানের কোনো মর্ম উদ্ধার হবে না, বরং আল্লাহ্্র আরেফের একটি বাক্যের মর্মেরও সমকক্ষ হবে না তাদের সারা জীবনের লেখা কিতাব ও বক্তব্য। আল্লাহ্্র আরেফ ব্যক্তিবর্গ আল্লাহ্্র পূর্ণতার দৃষ্টিতে কোরান হাদীসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের অবশ্যই যোগ্য।

নিশ্চিত জ্ঞানের বিবরণ
সুনির্দিষ্ট উৎস থেকে এ নিশ্চিত জ্ঞান প্রকাশিত হয়। আপন জীবন ও নফ্সের গুণাবলির মূল বস্তু হল জ্ঞান। তা থেকে রকমারি গুণাবলি ও ক্ষমতা প্রকাশিত হয়। বৃক্ষ বক্ষে দানা ও বীজ যেভাবে লুকায়িত থাকে অনুরূপভাবে আদি সত্তায় লুপ্ত থাকে প্রকৃত জ্ঞান এবং তা থেকে প্রকাশিত হয় নানা প্রকার গুণাবলি। এটা আলাদা কোনো বস্তু নয়, বরং তা আপন ঘর এবং অভ্যন্তরীণ মর্যাদা ও গুণ। যেমন প্রদীপ নিজেই আলো এবং দীপ্ত। কোনো অন্ধ বা আড়াল ব্যক্তি যদি না-ও দেখতে পায়, তাহলেও কারও দেখার ওপর প্রদীপের আলো নির্ভরশীল নয়, বরং দৃষ্টিবানের দেখা ও দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। যার জীবন ও নফ্স যে পরিমাণে শক্তিশালী, তার দেহও সেরূপ আলোকস্তম্ভের মতো। তাতে সে আলো প্রদীপ্ত হয়। তবে প্রথমত কোনো জীবদেহ সত্তাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে দেহের কয়েকটি স্থান তার প্রতিচ্ছায়া এবং তেজে আলোকিত হয়ে যায়। এটা হল কোনো উজ্জ্বল প্রদীপ থেকে কোনো অনুজ্জ্বল প্রদীপের সামান্য আলোকিত হওয়ার মতো। অবশিষ্ট লুপ্ত নফ্সের জ্ঞান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত হবে। এটা হলো দানার মতো, যা বাহ্যত একটি গোটা, কোনো গাছের ফল এবং উৎস যার অভ্যন্তরে রয়েছে হাজারও বৃক্ষ এবং গুণাগুণ। তা প্রকাশের জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন। এর জন্য সময় নির্ধারিত রয়েছে, যখন তা থেকে আরও বৃক্ষ, দানা ও বীজ প্রকাশিত হবে। কিন্তু বাহ্যত তা একটিমাত্র সত্তা হলেও তার মধ্যে লুপ্ত রহস্যাদি ও জ্ঞানের বিষয়ে অবহিত না হওয়া পর্যন্ত কে জানবে যে, তা এক অদ্ভুত সৃষ্টি, বিরল সত্তা এবং মহান অস্তিত্ব। অতএব প্রত্যেক বীজে নিহিত সত্তা, তা দ্বারাই পরিচিত হয় বা পরিচিত হবে অথবা অজ্ঞাত থাকবে বা অস্বীকার করা হবে। এটাও উক্ত বীজের এক অস্পষ্ট প্রান্তিক সত্তা। তা জ্ঞানের বিপরীতে অজ্ঞতা, আলোর বিপরীতে অন্ধকার, পথপ্রাপ্তির বিপরীতে পথভ্রষ্টতা, সচেতনতার বিপরীতে অচেতনতা এবং সুস্থ’তার বিপরীতে অসুস্থতা। মোটকথা এটা এ রকম, যেমনÑ আগুন যদিও উজ্জ্বল এবং গরম, কিন্তু যে জিনিসের মাধ্যমে আগুন প্রকাশ পায় উহার সংস্পর্শে আগুনের ধূম্রান্ধকারাচ্ছন্নতা আগুনের উজ্জ্বলতার মধ্যে ভিন্ন গুণ সৃষ্টি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উহার পার্শ্ব বস্তু বিস্বাদ এবং দুর্গন্ধ হয়ে যায়। অথচ আগুনের প্রভাবে আবার অধিকাংশ জিনিসের দুর্গন্ধ দূর হয় এবং গুণের প্রকাশের সাথে মূল বস্তুও আরও বিকশিত হয়। কারণ সত্তার ফল গুণ, আর গুণের ফল সত্তা। যে বস্তুতে যে গুণ প্রকাশ পায় এবং সমাপ্ত হয়, সে ধারার চূড়ান্ত ফলাফলও সেভাবেই নির্ধারিত হবে। যেমন কোনো বস্তু যদি আগুনের তাপ পেলে সুগন্ধ হয়, তাহলে উহার মূল্যও সেরূপ হবে। আর এতে যদি তা বিস্বাদ হয়, তার সে বস্তুরই ভাগ্য।
উপরের আলোচনায় আমাদের বক্তব্য বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। অর্থাৎ, মানুষের দ্বীন ও ঈমানের নূর এবং প্রদীপকে রওশন করতে হলে ঈমানের জ্ঞান প্রয়োজন। সে জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত ঈমানই হয় না। তা হল অন্ধকার, আবরণ এবং বিভ্রান্তি এর পরিণতি অন্ধকার আর ভ্রষ্টতা। যথাস্থানে নয় এমন বস্তু মাত্রই অপদার্থ। যেমনÑ যে ব্যক্তি হিসাবের খাতায় ভুল করে বা তা বিনষ্ট করে, সে কি কোনো মূল্যবান ব্যক্তি? অনুরূপ কেউ যদি অজ্ঞতা এবং অলসতা দিয়ে ঈমানের পাত্রটিকে বিনাশ করে ফেলে, সে তো নিজেই ধ্বংস হয়ে গেল। তবে ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত ঈমানের জ্ঞান প্রকাশ পাওয়া দুষ্কর। যেমনÑ দুটি বস্তুর ঘর্ষণ ছাড়া প্রজনন অসম্ভব তেমনি ঈমান জন্মের জন্য ঈমানদার প্রয়োজন। জ্ঞান বীজে বৃক্ষ নফ্সের মধ্যে বর্তমান থাকলেও তার প্রকাশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মাটির সহায়তা না পেলে তা থেকে কখনো বৃক্ষ গজাবে না। যেমন অপর কোনো বস্তুর সহযোগ ছাড়া আগুনের প্রকাশ অসম্ভব। অনুরূপ ‘ঈমান’ মুর্শিদ ব্যতীত অর্জন সম্ভব নয়। অর্থাৎ ঈমানি জ্ঞানের কিতাব হল মুর্শিদের নূরী অন্তর। তাঁর দীক্ষার আলোকে মুরিদের প্রদীপটি আলোকিত হয়। তা ব্যতীত যে কাগজের পাতায় এবং মৌখিক গুণকীর্তনে লিপ্ত হয়ে গেছে, সে পর্দার আড়ালে পড়ে যায় এবং পথভ্রষ্ট হয় কারণ, যেখানে পানাহারের ব্যাপার, সেখানে পড়াশুনার কোনো ফায়দা নেই। তাছাড়া ঈমানের বৈশিষ্ট্যই হল সে ঈমানদার দেখলে তার প্রতি আকৃষ্ট হবে, সন্তুষ্ট হবে, শান্ত হবে, ভদ্র হবে, সহাবস্থানকারী হবে, সফরসঙ্গী হবে এবং ভালোবাসবে। তাহলে সে প্রেমাস্পদের সেবার মাধ্যমে একত্বের সাগরে ডুব দিয়ে জ্ঞান ও জ্ঞ্যেয় একই পাত্রে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সে ঈমানে মুহাম্মদী এবং হাক্বিকতে আহাম্মদীর জ্ঞান পাবে এবং অবহিত হবে ঈসার ঔজ্জ্বল্য, মূসার পূর্ণতা, ইবরাহীমের রহস্য এবং আদম (আঃ)-এর হাকিক্বত সম্পর্কে। ফলে হয়ে যাবে সে হাদীসে কুদ্সীর আমলদার এবং পরিণত হবে সেÑ كنت كنز مخفيا (কুনতু কুন্জাম মুখফিইয়ান) (আমি ছিলাম গুপ্ত ধন)-এর প্রকাশ মাধ্যম এবং মর্মার্থে এবং সৃষ্টি করবে আপন প্রকাশের বীজ এবং কর্তা-কর্মে একই ফলাফল দেখাবে। যেমনÑ জ্ঞানের বিষয় অবগত ব্যক্তি জ্ঞানী। জ্ঞান যখন স্থিত হয়ে যায়, তখন সে জ্ঞ্যেয় বস্তুতে পরিণত হয়।
তাছাড়া তোমরা যখন জানলে যে, নিজেকে ফানা বা বিলুপ্ত করা এবং আল্লাহ্্র সত্তায় স্থিতিবান হওয়া আর প্রবেশসূত্রে সত্তায় বর্তমান থাকা অবস্থায় আপন উৎস স্বীয় গুণাবলি সম্প্রসারিত করে এবং বিবেচিত হয় সমস্ত গুণাবলি সারা বিশ্বে শাখা-প্রশাখা হিসেবে। তখন আল্লাহ্্র সত্তার বাইরে কোনো বস্তু থাকে না। সুতরাং তাঁর সত্তার বর্তমান সকল বস্তু সর্বাবস্থায় এবং সকল সৃষ্টিতে তাঁর সত্তায় সম্পৃক্ত। কারণ আল্লাহ্্র সত্তা সকল বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং কোনো বস্তুই সত্তা থেকে মুক্ত নয় এবং সত্তাও কোনো বস্তু থেকে মুক্ত নয়। যদি পরস্পর মুক্ত হয়, তাহলে ‘মোহিত’ বা ব্যাপ্ত শব্দের কোনো অর্থ হয় না। তবে সকল বস্তুতে আল্লাহ্্র সত্তা সম্পৃক্ত থাকলেও নবী-অলীদের সত্তায় তা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। যেমনÑ আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই বর্তমান কিন্তু দিয়াশলাইতে তা আছে পরিপূর্ণরূপে। তা অতাপিত অবস্থায় শীতল থাকে। অনুরূপভাবে আউলিয়া, যিনি আপন মুর্শিদ, তাঁর মধ্যে ফানা হওয়া আর আল্লাহ্্র সাথে ফানা হওয়া একই কথা। তবে তাদের মধ্যে প্রকাশের বিভিন্নতা রয়েছে। যেমনÑ আগুন দিয়াশলাইয়ে। অন্যথায় সব বস্তুতেই আগুন বর্তমান।

জ্ঞানের প্রকাশ
আপামর জনসাধারণের কথা হল, আগামীতে কী হবে, গর্ভস্থ সন্তান ছেলে না মেয়ে, কোথায় কার মৃত্যু হবে এবং কিয়ামত কবে হচ্ছে তা আল্লাহ্্ ছাড়া কেউ জানে না। কেননা কোরানে তাই আছে। এখন প্রশ্ন হল, বিজ্ঞানী এবং কাশ্ফের অধিকারী ব্যক্তিবর্গও তো বলেন, গর্ভস্থ সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, প্রকৃতপক্ষে তাই হয়। এর হাজার প্রমাণ তোমাদের সামনে পেশ করব। তবে এ আল্লাহ্্র জ্ঞানের একবিন্দু মাত্র। এর প্রকৃত অর্থ হল, মূলত আল্লাহ্্ই জ্ঞানী আর মানুষ আল্লাহ্্র জ্ঞান থেকে অংশ বিশেষ পেয়েছে। অর্থাৎ, যখন আল্লাহ্্ ইচ্ছা করেন, তখন নিজের জ্ঞানের বিষয়ে অন্যকে অবহিত করেন। তাই আল্লাহ্্ বলেন, ولايحيطون بشئ من علمه الابما شاء (ওয়ালা-ইউহীতুনা বিশাই ইম্ মিন ই’ল্মিহি ইল্লা বিমা-শা-আ) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র ইচ্ছা না হলে কোনো বস্তুই তার জ্ঞানের কোনো অংশ দ্বারা আবিষ্ট হতে পারে না। অর্থাৎ আল্লাহ্্ যাকে আপন জ্ঞান দান করেন, তিনি আল্লাহ্্র জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করেন এবং অবহিত হন গোপন বস্তু সম্পর্কে। যেমন নূরে ছুদুর (আলোকিত বক্ষ) হযরত খিজির (আঃ)-এর সে জ্ঞান ছিল, যার মাধ্যমে তিনি জ্ঞাত ছিলেন, আগামী দিন বা আগামীতে কী করতে হবে। যথাÑ ছেলেটি হত্যা করা বা নৌকাটিকে ডুবিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এসব বিষয়ে তাঁর পূর্ণ জ্ঞান না থাকলে কী করে এগুলোর উদ্দেশে এগুলেন? মহাজ্ঞানের তুলনায় এতো অতি সামান্যতম কাজ। এ স্তরের লোকদের হৃদয়পটে অনুরূপ হাজারও গুপ্ত-জ্ঞান প্রতি মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়। এটাকে বলা হয় ‘ইল্মে জাত বা লাদুনী’ অর্থাৎ, পরম সত্তার তরফের জ্ঞান। এ শ্রেণীর লোকদের এছাড়া উপায়ই বা কী? তাই কোরান পাকে বলেছেন,اوز عني ان اشكر نعمتك التى انعمت علي وعلي والدى (আওজাআনি আনআসকুরা নিয়ামাতিকাল্লাতি আন্ আম্তু আলা ওয়াআলা ওয়ালিদি) অর্থাৎ হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে এল্হাম বা প্রত্যাজ্ঞান দান কর, তুমি আমাকে এবং আমার পিতাকে যে নেয়ামত দান করেছ, সে জন্য যেন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। এটা ছিল হযরত সিদ্দিক (আঃ)-এর ফরিয়াদ। এতে সুস্পষ্ট যে তাঁর পিতাও বেলায়েতপ্রাপ্ত ছিলেন। এ কারণে নিজের জ্ঞানকে পিতার জ্ঞানের তুলনায় দুর্বল মনে করেছেন এবং নিজের জ্ঞানকে পিতার জ্ঞানের ফলশ্রুতি ঠাউরিয়েছেন অথবা উভয়ের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেছেন অথবা এখানে পিতা অর্থে পূর্ব মুরুব্বী এবং নবী-অলীদের বোঝানো হয়েছে। এ এল্হামের দ্বারা আল্লাহ্্র সত্তা ও পূর্ণতা তথা গোপনের বিষয়সমূহ অবহিত হওয়া যায়।

অদৃশ্য জ্ঞানের অভ্যন্তরে এবং মর্মের সবটাই একক সত্তা এবং হাক্বিকত। অতএব, এ বিষয় যিনি অবহিত, অদৃশ্যে আড়ালে যা কিছু রয়েছে তা তিনি জানেন। তাই আল্লাহ্্পাক বলেনÑ ومن جهد فينا لنهد ينه سبلن ا (অমান জাহাদা ফিনা লানাহ্দিইয়ান্নাহু সুবুলানা) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আমার সত্তায় সচেষ্ট হয় আমি তাকে আমাদের পথ প্রদর্শন করি। আল্লাহ্্পাক বলেন,ولايظهر علئ غيبه احد الامن ارتضى من رسله (অলা ইয়াজহারু আলা গাইবিহি আহাদুন্ ইল্লা মানির তাদা মির রাসূলিহি) অর্থাৎ, যে রাসূলের ওপর আল্লাহ্্ রাজি, তাকে ছাড়া কারও নিকট আল্লাহ্্ নিজের গোপন প্রকাশ করেন না। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যে রাসূলের ওপর আল্লাহ্্ রাজি, তার কাছে তিনি নিজের গোপন প্রকাশ করেন। এখানে রাসূল দ্বারা ইল্মে লাদুনীর অধিকারী ব্যক্তিত্ব বোঝানো হয়েছে। এ শ্রেণীর ব্যক্তিত্বই প্রকৃত রাসূল। এদের জ্ঞানের বদৌলতে গোপনীয়তার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ হযরত খিজির (আঃ) এবং হযরত বারখ্ প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা নবী না হলেও ইল্মে লাদুনীর ক্ষেত্রে খুবই শক্তিধর।
এখানে রাসূল দ্বারা কেবল নবী-রাসূল উদ্দেশ হলে স্বীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আল্লাহ্্র উক্ত বাণীর যথার্থতা বহাল থাকে না। প্রকৃতপক্ষে কিতাবসহ আগত প্রকাশ্য নবী রাসূলগণ এখানে উদ্দেশ নয়। বরং জ্ঞানদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এর উদ্দেশ। যার বদৌলতে বাতেন রূপ প্রকাশিত হয়, তিনি হলেন আত্মনিষ্ঠ রাসূলদের মধ্যে প্রধান। অর্থাৎ, রিসালাতের মর্তবার মধ্যে যে ব্যক্তি শক্তিশালী হয়, সে প্রকৃত রাসূলের মধ্যে গণ্য। কেননা কোনো ব্যক্তি তার জাহেরা কিতাব বা সংবাদসহ আগমন করেন। আর কেউ বাতেনী কিতাব এবং মূল উৎস সহ প্রেরিত হন। যেমন হযরত নূরেছুদুর, যদিও তিনি প্রকাশ্য নবী নন কিন্তু বাতেনে তিনি রাসূল ও নবী।
মোট কথা গোপন জ্ঞান হল সূক্ষ জ্ঞান। যে তা জানে না তার জন্য তা বিরল এবং সূক্ষ্ম বিষয়। এরূপ জ্ঞান বহু প্রকার। যেমন গুটি পোকা প্রভৃতি রেশম তৈরী করে এবং বিজ্ঞান জানে। সকল ব্যক্তি তা জানে না। দেখ, বিস্মিত হবে না, পিঁপড়ার যা জ্ঞান আছে, তোমাদের তা নেই। এরা এমন সব সূক্ষ্ম ও বিরল জ্ঞানের অধিকারী যদি তুমি তা জানতে তাহলে তাদেরকে কাফির আখ্যা দিতে।
তাহলে তোমার কথায় সকল জীব যারা বিভিন্ন প্রকার জ্ঞানে আলোকিত, সব কাফির হয়ে গেল। বস্তুত প্রত্যেক ব্যক্তি স্বতন্ত্র জ্ঞানের অধিকারী। যেমন কোনো কোনো নারীদের মধ্যে কারও বাহ্যিক আকার দেখে চরিত্র চেনার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এর সাহায্যে তারা অনেক কথা বলতে পারে। বস্তুত তা সত্যও হয়। তাছাড়া কোনো কোনো পাখির মধ্যে এমন ক্ষমতা বিদ্যমান, যার দ্বারা সে ভবিষ্যৎ বিষয়ে সংবাদ দিয়ে থাকে। যেমন কুটুম পাখির উঁচু আওয়াজ শুনলেই লোকে বুঝতে পারে যে, অবশ্যই মেহ্মান আসবে। এটাকে বাংলায় কুটুম পাখি বলা হয়। বস্তুত তা সঠিকও হয়। কোনো কোনো পাখির আওয়াজ দ্বারা লোকে জানতে পারে যে, এখানে কিছু আসতে পারে বা মারা যাবে বা কোনো কাজ হবে।

সিজ্দার আলোচনা
সূরা বাকারার প্রথম পারায় তৃতীয় রুকুতে আল্লাহ্্ বলেন,واذ قلنا للملائكة اسجدوا الادم فسجدوا إلا إبليس أبى واستكبر وكان من الكافرين – (অইয ক্কুল্না লিল্ মালা ইকাতিসজুদু লিআদামা ফাসাজাদু ইল্লা ইবলিসা; আবা অস্তাক বারা অকানা মিনাল কাফিরীন্) অর্থাৎ, যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম আদমকে সিজদা করো, তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজ্দা করল, সে সিজ্দা করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। ফলে সে কাফিরদের মধ্যে গণ্য হল। অন্যত্র সূরা আল-আরাফে অষ্টম পারায় প্রথম রুকুতে আল্লাহ্্ বলেন,ما منعك ان لاتسجداذا مرتك (মা-মানাআ’কা আল্লা তাছ্জুদা-ইজা আমারতুকা) অর্থাৎ, আমি যখন তোমাকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন কে তোমাকে সিজ্দা করতে নিষেধ করেছিল। তৃতীয়ত তেইশ পারায় সূরা ছোয়াদ্-এর চতুর্থ রুকুতে আল্লাহ্্ বলেন, ما منعك ان تسجد لما خلقت بيدى (মা মানাআ’কা আন তাছ্জুদা লিমা-খালাক্কতু বিইয়াদি) অর্থাৎ, কোন জিনিস তোমাকে নিষেধ করেছে তাকে সিজ্দা করতে যাকে আমি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি। আল্লাহ্্র কালামে সিজ্দার ব্যাপারে বার বার তাগিদ করা হয়েছে। সিজ্দায় সম্মান প্রদর্শন, আত্মবৈশিষ্ট্য এবং আত্মবিশ্লেষণ বিষয়টি ছাড়া আর কী আছে? বস্তুত কোরানেই উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে কোরানের বক্তব্য এবং সিজ্দার সংজ্ঞা জানা প্রয়োজন। সিজ্দা কাকে বলে? জমিনে কপাল ঠেকালে কি সিজ্দা হয়, না অন্য কিছুও আছে? জমিনের উপর দাঁড়ানোই কিয়াম, না-এর অন্য কোনো অর্থও আছে? প্রথম খন্ডে (জামেনূর) এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মূর্খরা সরাসরি সিজ্দার বিরোধিতা করে কোরানকে পাল্টে দিয়ে কাফির হয়ে গেছে। আক্ষেপ! এ বিষয়ে তার খেয়ালই নেই যে, ইবলিস সিজ্দা না করায় পুনরায় তাকে বলা হল যে, আদমকে সিজ্দা কর। যে মৌল সত্তার বৈশিষ্ট্যযুক্ত নূরের প্রকাশক, ইবাদত এবং প্রার্থনা মঞ্জুরকারী, লক্ষ্য অর্জনের পথ প্রদর্শক এবং পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে বিরতকারী। আল্লাহ্্র জন্য নির্ধারিত সিজ্দা যাতে অশেষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা মানবের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাওহীদে এলাহির ধারণা তথা সালতানাতের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এটা খিলাফতের সূত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে। যারা এটাকে অস্বীকার করে তারা ভ্রষ্ট এবং কাফির। এর প্রমাণ এর সাথেই যুক্ত রয়েছে। যেমনÑ শয়তান তাকে অস্বীকার করে কাফির এবং ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। যে কেউ এটাকে অস্বীকার করলে কাফির হবে। কারণ এটা একটা সজাত্য সম্পর্ক, যার দ্বারা অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয়। যেমনÑ আলোর প্রদীপ, যা থেকে অন্য প্রদীপ আলোকিত হয়। আলোহীন প্রদীপতো অন্ধকারই। এর আশেপাশের লোকেরা আলোর খবরই রাখে না। সে তো অন্ধকারেই আচ্ছন্ন, পথভ্রষ্ট এবং অবিশ্বাসী। যে যেমন সে তাতেই সন্তুষ্ট এবং তাতে মানায়ও তাকে। এজন্য তার সন্তুষ্টি কেবল তার নিজেকেই শোভা পায়। কোরানের ব্যাখ্যা ঐশী জ্ঞানের ওপর
নির্ভরশীল। আর তা হল বেলায়েত এবং আহ্ওয়াল তথা ভাবমগ্ন সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান। অতএব এ জ্ঞান সম্পর্কে তোমরা যখন মোটেই অবগত নও, তখন কোরানের কোনো একটি শব্দের অর্থও তোমাদের জানার কথা নয়। কোরানের মূল বস্তু যখন আহ্ওয়ালে পরিণতি প্রাপ্ত হয়, তখন এ আহ্ওয়াল বা কোনো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কি তোমরা আদৌ অবহিত? যার কোরানের জ্ঞান নেই, সে কী করে ওস্তাদ দাবি করে? এটা তো সে ওস্তাদের কাজ, যে কোরান পাঠের সময় কোরানকে অস্বীকার করছে। অর্থাৎ আল্লাহ্্ যখন ফেরেশতাদের তৌহিদ সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছিলেন, অর্থাৎ আদম (আঃ)-কে সিজ্দা করার বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান তা অস্বীকার করে এবং তা থেকে বঞ্চিত হয়। বস্তুত তৌহিদ থেকে বঞ্চিত হওয়াটাই কুফর। নিয়ম হলো যে-যে বিষয়ে হতাশ সে-সে বিষয়কে অস্বীকার করে। হাদীস শরীফে একটি দীর্ঘ গল্প আছে। সংক্ষেপে গল্পটি হলÑ হযরত মূসা (আঃ)-কে জনৈক মহা হতাশ ব্যক্তি তথা ইবলিস বলল, আপনি যখন তূর পাহাড়ে আল্লাহ্্র সাথে কথা বলবেন, তখন আমার জন্য আল্লাহ্্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তিনি বললেন তোমার জন্য অবশ্যই বলব। মূসা (আঃ) ইবলিস-এর জন্য আল্লাহ্্র কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ্্ বললেন, সে যদি আদমের কবরকে সিজ্দা করে, তাহলে আমি তাকে ক্ষমা করব। মূসা (আঃ) শয়তানকে এ কথা জানালেন, কিন্তু শয়তান তা করতে অস্বীকার করল এবং বলল, যাকে আমি জীবিত অবস্থায় সিজ্দা করি নি তাকে মরার পর কী করে সিজ্দা করি? এর তাৎপর্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এতে বোঝা যায়, আদমের মর্যাদা কবরেও পূর্বের মতো সুউচ্চ। এ কারণেই কবরকে সিজ্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং শয়তান তা অস্বীকার করে। অথচ ফেরেস্তাগণ এর বদৌলতে উন্নত মর্যাদা লাভ করেন। ঐশী বৈশিষ্ট্য এবং আদমের মর্যাদার এই যে সম্পর্ক, এটা জাতি তথা মৌলিক। এ বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে যে বিদ্যা বা জ্ঞান দরকার, তা হল শ্রদ্ধা, মহব্বত ও বিশ্বাস। তা হল প্রেম। এর ভিত্তিতেই ফেরেশতাগণ নূরে কাদিম তথা আদম (আঃ)-কে সিজ্দা করে এবং আল্লাহ্্র নিকট প্রশংসনীয় মর্যাদা লাভ করে। অর্থাৎ, আদম (আঃ)-কে সিজ্দা করার কারণে আল্লাহ্্ও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং এ সিজ্দার কারণে আল্লাহ্্ তাঁর সত্তায় বর্তমান সমস্ত পূর্ণতা, যা পথ প্রদর্শক ও পথপ্রার্থীর মধ্যে যোগসূত্র, তা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করেন। তা না হলে আদমকে কেন সিজ্দা করল, আল্লাহ্্কে কেন সিজ্দা করল না, আর আল্লাহ্্ই বা কেন আদমকে সিজ্দা করার হুকুম দিলেন? এটা কোন শিক্ষা, যে নিজের প্রাপ্য সিজ্দা অন্যের ওপর বর্তায়? হাদীসে কুদ্সীতে বর্ণিত আছে الانسان سرى وانا سره (আল্ ইনসানু র্সিরী ওয়া আনা র্সিরুহু) অর্থাৎ, “মানুষ তথা আদম আমার রহস্য আমি তাঁর রহস্য।” এখানে মানুষ অর্থ পরিপূর্ণ মানুষ আর তিনি হলেন আদি মানুষ। সকল মানুষের আদি পিতা। সকল সৃষ্টির সমস্ত গুণাগুণ ও মর্যাদা এবং বৈশিষ্ট্য আদমের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য তিনি সৃষ্টির রীতি অনুযায়ী সকলের পিতা এবং প্রতিনিধি বলে গণ্য। এমনকি তিনি ফেরেশতাদেরও খলিফা, তা না হলে সিজ্দা করার প্রশ্ন আসত না। মুরব্বি না হলে তাঁকে সিজ্দা বা সম্মান প্রদর্শন করতে হবে কেন? তাই তিনি যে জাতির আদি মুরব্বি সে জাতির অধীনস্থ প্রজাতিসমূহের ওপরও তাঁর প্রভাব এবং আওতা সম্প্রসারিত হয়। গোটা আকাশ এবং পৃথিবী ফেরেশতাদের কর্মক্ষেত্র। তাঁদের কর্মতৎপরতাতে সকল বস্তুর অবস্থান ও অস্তিত্ব, প্রভুর মহান কৃপায় ও ক্ষমতায়। হযরত আদম এ মহান মর্যাদার অধিকারী। এ জন্য ফেরেশতাগণ তাঁকে সিজ্দা করেছে। ফলে এ সিজ্দা সম্পর্কসূত্রে সকল সৃষ্টির জন্য বৈধ। হযরত আদমের মাধ্যমে প্রকাশিত, শাশ্বত মর্যাদা আল্লাহ্্রই মর্যাদা। যেমন গাছের মধ্যেই ফলের অস্তিত্ব। আবার চিন্তা করলে দেখা যায় যে, বীজ থেকেই গাছের উদ্ভব এবং তা পঞ্চবস্তুর মিলিত রূপ। অর্থাৎ, পঞ্চইন্দ্রীয় থেকে বীজের জন্ম এবং আল্লাহ্্র গুণাবলি থেকে তা প্রকাশিত। এটা মূলসত্তার অন্তর্গত। সে সত্তা ও মর্যাদার অধিকারী এক শক্তিমান সত্তাই সকলের আল্লাহ্্।
কোনো ব্যক্তি যে ফল তোলে, তা গাছ থেকেই তোলে আর তা ঐ গাছের নামেই সর্বজনে জানে। এভাবে খিলাফতের মাধ্যমেই যে কোনো ব্যক্তি কবুলিয়াত তথা গ্রহণ যোগ্যতার দরজায় পৌঁছে। সুতরাং খিলাফতের দরুনই সকলে তাঁকে সিজ্দা করে। কারণ গাছ না থাকলে ফল কোথা থেকে আসবে?
এ সিজ্দা অবস্থাগত হতে পারে। যেমনÑ গাছের সিজ্দা। আবার তা রৌহিকও হতে পারে, যেমন রূহের জগতে রূহ্গণ আপন খলিফাকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে, ভালোবাসে এবং সিজ্দাও করে।
শয়তান যখন আদমকে সিজ্দা করা থেকে বিরত থাকল, তখন আল্লাহ্্ তাকে প্রশ্ন করলেন, আমি নিজ হাতে যাকে সৃষ্টি করেছি তাকে সিজ্দা করতে কে তোকে বারণ করল? অর্থাৎ, ফেরেশতাসহ সকল আদিসৃষ্টি আদমকে সিজ্দা করেছে, কিন্তু শয়তানকে কে নিষেধ করেছে? তাই আজও যারা শয়তানের অনুসারী তারাও আদমের সিজ্দার বিরোধী। কিন্তু আল্লাহ্্কে সিজ্দা করার বিরোধী নয়। অথচ তারা জানে না যে, আদমের সিজ্দাই বড় সিজ্দা। কারণ উচ্চ মর্যাদাবানের উদ্দেশে প্রদত্ত সিজ্দাই শ্রেষ্ঠ সিজ্দা। এ কারণেই আল্লাহ্্ আপনরূপ আদমরূপে প্রকাশ করে তাকে খলিফা বানিয়েছেন। অতএব আদমকে সিজ্দা করা আল্লাহ্্কে সিজ্দা করা। বাহ্যিকভাবে এটাকে বৈধ করা হয়েছে, যেন শাখার সূত্র ধরে মূলের সন্ধান পাওয়া যায়।
জাহের পূজারীগণ আদমকে সিজ্দার বিরুদ্ধে কোরানের এ বাক্য উদ্ধৃত করে থাকেÑ لاتسجد وا للشمس ولآ للقمر واسجد والله الذى خلقهن ان كنتم اياه تعبدون – (লা-তাছ্জুদু লিশ্শামছি অলা-লিল কামারি ওয়াস জুদুলিল্লাহিল্লাজি খালাক্কা হুন্না ইন কুনতুম ইয়্যাহু তা বুদু-ন) অর্থাৎ, তোমরা চন্দ্র-সূর্যকে সিজ্দা করবে না, বরং তাহাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন, সে আল্লাহ্্কে সিজ্দা কর। প্রকৃতই যদি তোমরা তাঁর ইবাদত কর।
এর অর্থ হল, ইবাদত হিসেবে চন্দ্র-সূর্যকে সিজ্দা করা নিষেধ। কিন্তু এ বাক্যে সম্মানসূচক সিজ্দা করা নিষিদ্ধ হয়নি। অতএব আল্লাহ্্ ছাড়া আর কাকেও সিজ্দা করা যাবে না, এটা তারা কিভাবে বলেন? কোরানের এ বাক্যটি যথাস্থানে উদ্ধৃত হয়েছে, এর দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, আর কেউ সিজ্দা পাওয়ার যোগ্য না হলেও আদমের সিজ্দা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। সুতরাং তাকে অস্বীকার করা তথা কোরানকে পাল্টে দেওয়ার শিক্ষা তারা কোথায় শিখেছে? এ পদ্ধতি তাদেরকে কে শিখিয়েছে? হ্যাঁ, তাদের বক্তব্য যদি এই হয় যে, পূর্ণ ইবাদতের উদ্দেশে সিজ্দা কেবল আল্লাহ্্র জন্যই নির্ধারিত, অন্য কারও উদ্দেশে তা দেওয়া বৈধ নয়, তাহলে ঠিক আছে। এমতাবস্থায় কোরানকে উল্টাপাল্টা করা কি ঈমানদারের কাজ? অবশ্যই না। সিজ্দার পক্ষে ফেকাহ্্ এবং হাদীস গ্রন্থে বহু প্রমাণ রয়েছে এবং বহু কিতাবে তাকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে এগুলোর আলোচনা করা হবে। মাওলানা জৈনদ্দীন সাহেব (আদামাল্লাহু বোরহানা) আপন গ্রন্থে চল্লিশটি তাফসির গ্রন্থের বরাত দিয়ে সম্মান সূচক সিজ্দার বৈধতার কথা বলেছেন।
নারকীয় শয়তান আপন সম্পর্কসূত্রে সিজ্দার বিরোধীদের কাবু করে ফেলেছে এবং আপন গোঁড়ামিতে তারা আত্মতৃপ্ত। এখন তারা তার প্রিয়পাত্র। সত্য কথা হল, কোরানের বাহ্যিক রূপ তথা চাকচিক্য দ্বারা তাদেরকে আক্ষরিক অর্থ ও টিকাটিপ্পনীতে মুগ্ধ করে পথভ্রষ্ট করা সহজ। আসল কথা হল, লোভী পাখিকে ফাঁদে ফেলার জন্য কয়েক দানাই যথেষ্ট। শয়তানের সত্তাটা অস্বীকৃতির বড় উৎস। বিরোধিতার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান। তার সম্পর্কের ফলে অতি অটল বিশ্বাসও সহজে টলে যায়। সে বিরোধিতার মাধ্যমেই যে কোনো কাজ করে থাকে। সে কারও সম্ভ্রমকেই সুনজরে দেখতে পারে না। সে তা পারবেই বা কিভাবে? সে আল্লাহ্্ প্রদত্ত আদমের পূর্ণ মর্যাদা এবং প্রভুর হুকুমকেই অমান্য করেছে। অহংকার থেকেই অস্বীকৃতি জন্মায়। এর ফল অন্যের অপছন্দ হলেও নিজের খুবই পছন্দ। এটা কুকুরের একটি একান্ত বৈশিষ্ট্য। এ ফলাফল এরই সাথে যুক্ত। কুকুরের ঘেউ ঘেউ তার আত্মতৃপ্তির প্রমাণ। এটাও জানা দরকার, যে সব জিনিসের চামড়া মোটা হয়, মগজ হয় সূক্ষ্ম আর এ দুয়ের সম্পর্ক বৈপরীত্যের। তা সত্ত্বেও এর ফল হালকা সুন্দর এবং ব্যবহার স্বতন্ত্র। যেমনÑ ফলের সারবস্তু ও খোসার সম্পর্ক বিপরীত। এ পার্থক্যটা হল চক্ষু এবং মাংস ও আলো এবং আগুনের পার্থক্যের মতো। কোনো কিছুর বাহ্যিক রূপের সাথে অর্থের মিল থাকলেও তা কেবল সে বস্তুর উপরি কাঠামোর বেলায় প্রযোজ্য হয়। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত রূপের প্রকৃতি নির্ধারিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থ অর্থেই সীমিত থাকে। অর্থ থেকে বস্তু আর বস্তু থেকে এ অর্থ নির্ধারণ চিরায়ত এবং প্রয়োজনীয় মূলনীতি। এ পদ্ধতির কখনো ব্যতীক্রম সম্ভব নয়। এটা উৎস পরম্পরায় কোরানের কথক স্বয়ং আল্লাহ্্ পর্যন্ত পৌঁছে। এটাই মগজ তথা সব কিছুর সার। মূলত তাই কোরান। তাই মাওলানা রুমী বলেন, (মস্নবী)Ñ
“মান আয্ কোরআন মগজরা বরদাস্তাম
এস্তে খাঁওয়া পেশেছাঁগে আন্দাখ্তাম।”
অর্থাৎ, আমি কোরানের মগজ বের করে নিয়ে হাড়গুলো কুকুরদের জন্য ফেলে রেখেছি। মাওলানা রুমী এখানে আত্মঅহংকারীদের কুকুর বলেছেন। বস্তুত জাহেরপন্থীদের মধ্যে আত্মঅহংকার বা আত্মতুষ্টি বর্তমান। আত্মতুষ্টি যাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য তারা সর্বদাই অন্যকে অপছন্দ করে, অন্যদের দোষ অšে¦ষণ করে, কাফির-মোশরেক আখ্যা দেয় এবং শয়তান বা বেদ’আতী বলে গালি গালাজ করে। সকল জাহেরপন্থী একের বিরুদ্ধে অপরে এ কাজ করে থাকে। এবার দেখ যেমন বীজ, তেমন ফল প্রকাশ পেল কি না? তোমরা কোথায় শয়তান তালাশ করছ এবং কোথায় খুঁজছ জাহান্নাম? স্বীয় কর্মের দ্বারাই তো জাহান্নাম প্রমাণিত হচ্ছে। প্রত্যেক বস্তুই নিজের কর্মের দ্বারা পরিচিত হয়। ঘোড়া দৌড়ায়, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, বাঘ হিংস্রতা দেখায়, সাপ দংশন করে ইত্যাদি। বাংলায় একটি প্রবাদ আছেÑ “বৃক্ষের পরিচয় ফলে।” এজন্য যারা এ ধরনের কাজ করে কোরান তাদের খান্নাছ বলেছে।
অপরদিকে মস্তক অবনত করা, বিনয় দেখানো, অন্যকে সম্ভ্রম প্রদর্শন করা, নিজেকে ছোট মনে করা, অন্যকে জ্ঞানী মনে করা ভালো কাজ। এ ভালোত্বকে নিজের চূড়ান্ত পূর্ণতার দিকে অগ্রসর করা আল্লাহ্্র একটি বিশেষ গুণ। অর্থাৎ, আল্লাহ্্র সত্তা পূর্ণ গুণাবলি এবং মহাসম্ভ্রান্ত মর্যাদায় মন্ডিত। তা থেকে অন্যের ওপর প্রকাশের মাধ্যমে তিনি আপন মহিমা প্রদর্শন করেন। যেমনÑ গাছের পূর্ণতা ফলনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর পূর্ণতা হল চন্দ্র-সূর্য। তবে এ সবই মহা প্রভুর পূর্ণতার প্রকাশ এবং প্রকৃত স্রষ্টাই এর সকল সৌন্দর্য এবং মর্যাদার সার। এটা আল্লাহ্্ ও বান্দার রহস্য। এতে (র্শিক্) অংশীবাদিতা অবশ্যম্ভাবী নয়। কারণ এতো হল মূলের বিশ্লেষণ। কোনো বস্তুর মূলের প্রতি তাকালে তার মূলের বিশ্লেষণ এবং বিন্যাসের দিকে অবশ্যই দৃষ্টি সম্প্রসারিত হবে। সুতরাং সমস্ত সৃষ্টিই উৎসের প্রেক্ষিতে প্রকৃত স্রষ্টার পরিচায়ক। মৌলিক স্বাতন্ত্র্যসহ ক্ষমতার প্রকাশক, শক্তির ধারক, সকল কর্মসম্পাদক, অবস্থাদি বিস্তারক, দ্বৈত ও ভিন্নতা সংহারক। অর্থাৎ, দ্বৈতের মূলে যে এক তা দ্বারা একের বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মূলের প্রতি মনোযোগ না থাকা বিস্মৃতি, এটা সর্বদাই মূলের সাথে সংযোগ বিনষ্টকারী। সুতরাং অনুরূপ বিস্মৃত ব্যক্তি সর্বদা বিস্মৃতির সম্মুখীন হয়। ফলে সে হয় কাফির, জাহিল, দুর্ভাগা, বঞ্চিত ও অসহায়। এরূপ সব কিছু থেকে বঞ্চিত এবং অভিশপ্ত অবস্থাই শয়তানের মধ্যে অজ্ঞতার অহংকার সৃষ্টি হয় এবং আদমের মহান মর্যাদাকে অস্বীকার করে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ্্র নির্দেশ এবং নির্দেশিত হিসেবে মূল ও শাখার বিচারে আদমকে সিজ্দা করা মানে আল্লাহ্্কে সিজ্দা করা। আদম তো মৌল উৎসেরই পরিস্ফুট রূপ। যেমনÑ বৃক্ষ বহু বৃক্ষ-বীজের উৎস। এ বীজ প্রথম থেকেই বৃক্ষের মধ্যে সঞ্চারিত পরবর্তী পর্যায়ে তা গাছের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়ে অদ্বিতীয় হয়েছে। বরং বলা যায়, সংরক্ষণের বন্ধন মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ, রঙ-রূপ এবং অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে। বরং এতে করে উক্ত বীজ বা উৎসটি আপন সত্তাকে ক্ষীণ করে বৃক্ষের সাদৃশ্য সত্তায় সমাবিষ্ট ফল-মূল সকল মূল কান্ডের উৎস ও রঙ এর মিলন ক্ষেত্রে এবং বুনিয়াদে পরিণত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে তিনি অতুলনীয় রূপে সাদৃশ্যতার চরম স্থলে পৌঁছে আপন সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটান। আপন বিন্যাসে চতুর্দিকে উদ্ভাসিত হয়, বিকশিত হয় স্বীয় কুদরত, গুণাবলি এবং কর্মধারায়। ফলে সবই হয়ে যায় প্রভুময় এবং প্রভু ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব থাকে না।
আল্লাহ্্ ছাড়া সব কিছুকে লুপ্ত মনে করলে আদি সত্তা ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না এবং নাস্তিকতা টিকে না অর্থাৎ আল্লাহ্্ ছাড়া কোনো জায়গা ও স্থান হয় না। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, তা হয় তাহলে সে আল্লাহ্্র সত্তা ও গুণাবলীর বিরোধী, এতে সন্দেহ নেই। এ ধরনের বিশ্বাস মূর্খতা ও বাতুলতাজনিত কুফরিসুলভ বিরোধিতার জন্মমূলে আপন মূল ও বুনিয়াদকেই বিনষ্ট করে দেয়। তা না হলে শয়তানের অন্য কোনো খারাপ উৎস ছিল? সে তো আল্লাহ্্কে সিজ্দা করে, কিন্তু আদমকে সিজ্দা করে না। তার কথা হল আমি আদমের চেয়ে উত্তম আর আল্লাহ্্ আমার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ্্কে সিজ্দা করব, আদমকে কখনো সিজ্দা করব না। সুতরাং এভাবে যে আদমকে সিজ্দা করার বিরোধী, সেও ইবলিসের জ্ঞানের পরিণতি থেকে মুক্ত নয়। আল্লাহ্্ বলেন, ولقد خلقنا كم ثم صورنا كم ثم قلنا للملائكة اسجدوا لادم فسجد وا إلا إبليس (ওয়ালাকাদ খালাকনাকুম সুম্মা ছওয়ারনাকুম সুম্মা কুলনা লিল মালাইকাতিসজুদু লিআদামা ফাছাযাদু ইল্লা ইবলিস) অর্থাৎ, (আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি, পরে অবয়ব দান করেছি, পরে ফেরেশতাদের বলেছি আদমকে সিজ্দা কর। অতঃপর তাঁরা সকলেই সিজ্দা করেছে কিন্তু ইবলিস ব্যতীত)। কেন এদের পরিণতি তা হবে না, সিজ্দার কথা শুনলেই যে এরা জ্বলে পুড়ে ছাই অঙ্গার হয়ে যায়। আল্লাহ্্ হাফেজ।
আল্লাহ্্ এদেরকে আদমের বিষয়ে কেন অজ্ঞ করে রাখলেন? দেখ হে, আদমের রহস্যাদি স্বীকার করে নিলে আল্লাহ্্র সত্তার পূর্ণতার বিকাশের মধ্যমণি হয়ে যেতে এবং আল্লাহ্্র জ্ঞানের ব্যাখ্যার মৌলিক বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ এবং জ্ঞানী হতে পারতে। তাহলে সকল প্রকার মূর্খতা ও অজ্ঞতার কবল থেকে মুক্তি পেতে। বস্তুত আল্লাহ্্ তা’য়ালা হযরত আদম (আঃ)-কে বৈশিষ্ট্য ও পূর্ণতায় আপন খলিফা বা প্রতিনিধি করেছিলেন। সে সত্তাগত পূর্ণতা বাহ্যিক রূপের সাথে বিকাশ প্রাপ্ত এবং অধিষ্ঠিত। এ থেকে তা সকল সৃষ্টিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং স্থাপিত হচ্ছে প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে এর যোগসূত্র। ফলে নব নবতর রকমারি সৃষ্টিনৈপুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হচ্ছে পৃৃথিবী। উদাহরণস্বরূপ সূর্যের সম্পর্ক রয়েছে এর অধস্তন সৃষ্টিজগতের সাথে। এর আকর্ষণ এবং যোগসূত্রের দ্বারা বস্তুজগতের বৃদ্ধি সমৃদ্ধির চক্র নির্ধারিত। এ ছাড়া কোনো বস্তু নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছাতে কখনো পারবে না। এ আল্লাহ্্র একটি বিশেষ সম্পর্ক যা সৃজন ধারায় আদমকে প্রদত্ত হয়েছে। তাই খলিফা অর্থ পশ্চাতে আগমনকারী। অর্থাৎ, দ্বিতীয় পর্যায়ে আল্লাহ্্ নিজেকে খিলাফতের মাধ্যমেই বিশেষভাবে বিকশিত করেন। তাই হযরত আদম (আঃ) খিলাফতের পর্যায়ে খলিফাই বটে আল্লাহ্্ নন। কিন্তু তা না হলেও রহস্যালোকে তিনি আল্লাহ্্ থেকে আলাদা নন। যেমন ঔজ্জ্বল্য স্বয়ং আগুন না হলেও আগুন ঔজ্জ্বল্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
সুতরাং চকমক বা ঔজ্জ্বল্য অথবা অনুরূপ কোনো বস্তুর অবর্তমানে পৃথিবীর সৃষ্টি অস্তিত্ব অসম্ভব। যেমন সন্তানের জন্য মায়ের প্রভাব একান্ত জরুরি আবার সে সন্তান এক সময় মাতৃত্বের স্থানে পৌঁছে। এটা চিরায়ত রীতি। সার্বিক বিচারে আল্লাহ্্ সবকিছুর উৎস। এতে আল্লাহ্্র সত্তায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। তবে এতে রহস্যালোকের মূল বস্তুটিকে সম্প্রসারিত করতে হয়। সবকিছুর মূল উৎস যদি পবিত্র সত্তাই না হবে, তাহলে আর এমন কোন জিনিস পাওয়া যায় যেখান থেকে মাল-মশলা নিয়ে আল্লাহ্্ তোমাদের জন্য সবকিছু বানাচ্ছেন? যে সব লোক আল্লাহ্্কে সকল বস্তু থেকে পবিত্র মনে করেছে এবং সকল দোষ থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে এবং এভাবে আল্লাহ্্কে সাহায্য করছে তাদের কাছে কি আল্লাহ্্ কখনো সাহায্য চেয়েছে? নিরেট মূর্খের দল হেকমত তথা প্রজ্ঞার বিষয়কে দোষ ভেবে স্বয়ং আল্লাহ্্র জ্ঞান থেকে নিজেরাই বঞ্চিত হল এবং পবিত্র সত্তার মর্মার্থ থেকে দূরে সরে গেল। শুধু তাই নয় অবিশ্বাসের কূপে নিমজ্জিত হয়ে উভয় জগৎই নষ্ট করল।
লক্ষ্যণীয়, পয়গম্বর (সাঃ)-কে বৃক্ষ, উষ্ট্র এবং বক্রী ইত্যাদি সিজ্দা করত। এটা আল্লাহ্্র তরফ থেকেই হত। তা না হলে নবী-অলীদের সিজ্দা করার জ্ঞান-বুদ্ধি পশুদের থাকার কথা নয়। এ সিজ্দা র্শিক হলে আল্লাহ্্ কেন তাদের দ্বারা সিজ্দা করাবেন? এটা র্শিক নয়; বরং এটা আনুগত্যের রীতি। অনেকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, আমি যদি “মানুষ মানুষকে সিজ্দা করার হুকুমদাতা হতাম, তাহলে বলতাম স্ত্রী যেন তার স্বামীকে সিজ্দা করে।” কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত দুর্বল হাদীস। এ দুর্বল হাদীস দ্বারা কোনো অকাট্য প্রমাণ রোধ করা যায় না। এজন্য অকাট্য দলিল প্রয়োজন। সিজ্দা কোরান দ্বারা প্রমাণিত। এটাকে বাতিল করতে হলে আরও মজবুত আয়াত দরকার। কোরানের বিরুদ্ধে হাদীস অকেজো। তাছাড়া এ হাদীসটিও মজবুত নয়। লক্ষ্যণীয়, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হুকুম করলে ওয়াজিব হয়ে যেত। যেমনÑ পূর্ববর্তীদের জন্য সম্মানসূচক সিজ্দা ওয়াজিব ছিল। ওয়াজিব সিজ্দা যদি রহিত হয়েই থাকে তবু মুস্তাহাব তথা বৈধতা নষ্ট হয়নি। অর্থাৎ, সম্মানসূচক সিজ্দা জায়েজ ও বৈধ।
পর্দার আলোচনা

আল্লাহ্্র ফরমান অনুযায়ী চোখের পর্দা করা ফরয। আল্লাহ্্ বলেন, قل للمؤمنين يغضوا من ايصارهم (ক্কুল্লিল্ মু’মিনীনা ইয়াগুদ্দু মিন আবসারিহিম) অর্থাৎ, মুমিনদের বলুন, তারা যেন আপন চক্ষু বিরত রাখে। এ নির্দেশ পুরুষদের জন্য। তারা যেন নিজের চোখের পর্দা করে, তথা খারাপ নজরে না তাকায়। এর পরবর্তী নির্দেশ হলÑ ويحفظ فروجهم (ওয়া ইয়াহ্ফিজু ফুরুজা’হুম) অর্থাৎ, তারা যেন লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে মন্দ থেকে আর আবরণ দ্বারা ঢেকে রাখে। এ সবই পর্দা। এর পর নারীদের পর্দার কথা বলা হয়েছেÑ قل للمؤمنات يغضضن من ابصارهن (ক্কুল লিল্ মুমিনাতি ইয়াগ্দুদ্না মিন্ আবসারিহিননা) অর্থাৎ, ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের চক্ষুকে বিরত রাখে স্বীয় বদনজর থেকে। অর্থাৎ নারীদের চোখে কুদৃষ্টি রয়েছে, তা যেন প্রকাশ না হয়। এজন্য চক্ষু বন্ধ রাখতে হবে তথা চক্ষু থেকে কুদৃষ্টির উপাদানটা সরিয়ে দিতে হবে। অথবা আপন চোখের শয়তানি দৃষ্টিকে সুলতানি পর্দা দ্বারা ঢেকে দিতে হবে। অর্থাৎ চোখের কুঠুরিতে এক প্রকার জলীয় পর্দা দেখা দেয়, তা লজ্জার আবরণও বলা হয়। মা, বোন ও বুজুর্গদের আচরণে সে লজ্জা প্রকাশ পেয়ে থাকে। এ লজ্জার মুখোমুখি হলে যুবকও শিশুর মতো হয়ে যায়। তবে যার লজ্জাবোধ নেই, সে অবশ্যই ফেৎনাবাজ। সে শরিয়তের বিধি-নিষেধের বাইরে। পুনরায় বলা হচ্ছে, يحفظن فرو جهن (ইয়াহ্ফিজ্না ফুরুজা হুন্না) অর্থাৎ, তারা যেন আবরণ দ্বারা নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে এবং লজ্জা আবরণে যেন তাকে সকল দোষ থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও পর্দার আয়াত এবং হাদীস সবই উক্ত মর্মে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত শর্তের বিপরীত একটি আয়াত বা হাদীসও নেই। সুতরাং হারাম থেকে বাঁচার জন্য পর্দা করা ফরয। হারাম থেকে বাঁচাই হল পর্দার চূড়ান্ত উদ্দেশ। কোরানে যেখানে চোখকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে, সে আয়াতে সাধারণভাবে চোখ বোঝানো হয়নি। কারণ, সে আয়াতে ‘মিন্’ পৃথকীকরণ শব্দ। এ দ্বারা একটি বিশেষ অর্থ বোঝায়। প্রধানত নবী-অলীদের পাক ও পবিত্র দৃষ্টি সূক্ষ্ম রূহানী জগতের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় সকল দোষ থেকে মুক্ত। যেমন পরশ পাথরের স্পর্শে তামাও খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। এজন্য কোরানে ‘মিন্’ বা ‘থেকে’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ দ্বারা কোনো কোনো চক্ষু বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে নবী-অলীদের দৃষ্টিতো পবিত্র রহমতস্বরূপ। তাঁকে কাফিরদের জন্যও রহমত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পবিত্র সংস্পর্শে অপবিত্র বস্তুও পবিত্র হয়ে যায়। সাবান, পানি ও আগুনের চেয়ে তা উন্নততর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ জন্যই তাঁকে কাফিরদের জন্য রহমত বলা হয়েছে। কাফিরকে অপবিত্র আর রহমতকে আগুন পানিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রহমত তথা নবী-অলীদের দৃষ্টির উপকারিতা সম্পর্কে হাদীসে কুদ্সীতে বলা হয়েছেÑ كنت سمعه الذى يسمع به وبصره الذى يبصربه الاخ (কুন্তু সামউ’হুল্লাযি ইয়াসমাউ বিহি ওয়াবাসারূহুল্লাযি ইউবছিরু বিহিল্লাযি)। অর্থাৎ, আল্লাহ্্ বলেন, আমি তাঁর কান হয়ে যাই, সে তা দ্বারা শোনে এবং আমি তাঁর চোখ হয়ে যাই, সে তা দ্বারা দেখে অর্থাৎ, আল্লাহ্্ পরিপূর্ণ মানুষের হাত-পা ইত্যাদিতে পরিণত হন, বরং তাঁর গুণাবলি আল্লাহ্্র গুণাবলিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। হতে পারে সে পরিপূর্ণ মানুষটি নবী অথবা অলী, জ্বিন অথবা ফেরেশতা, নারী অথবা পুরুষ। পুরুষদের মধ্যে যেমনি নবী-অলী হতে পারে, যেমন গাউস পাক, বুআলী কলন্দর, হযরত শাহ্ মাদার প্রমুখ Ñ তেমনি নারীদের মধ্যেও হতে পারেনÑ যেমন হযরত উম্মে সিদ্দিকা, হযরত উম্মে বরকত, হযরত রাবিয়া বস্রি, হযরত বিবি কা’বান এবং হযরত বিবি তোহ্ফা প্রমুখ। এদের মর্যাদা অতি উচ্চে এবং সব রকম দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
তবে উক্ত আয়াতে যে চক্ষু বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা যদি অলীদের বোঝানো হয়ে থাকে, তাতো আরও উত্তম। কারণ তাঁরা মুফ্তিদের মতে, চক্ষুকে সংযত রাখার কারণে তাঁদের দৃষ্টি রহমত ও উপশমকারী হয়ে গেছে। অপরদিকে ফেৎনাবাজদের কুদৃষ্টির কারণে তারা মুফ্তি এবং ফাসিকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষের পবিত্র সত্তা যা রহমতস্বরূপ, তাঁর দৃষ্টি আল্লাহ্্র পবিত্র সত্তারই সারাংশ। تخلقوا باخلاق الله (তাখাল্লাকু বি আখ্লা-কিল্লাহ্) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র চরিত্রে চরিত্রবান হও। এ হাদীসের মর্মানুযায়ী তাঁদের কথাবার্তা, ফুঁক বা ছোঁয়া, রহমত এবং অনুকম্পা ছাড়া আর কী? শুধু তাই নয়। তাঁদের পায়ের ধূলা এবং তাঁদের অলিগলির ধূলা-মাটি উপকারী সুরমা এবং মুক্তির উন্নত সাল্সা। এ জন্য কামেল তথা পরিপূর্ণ ব্যক্তিদের কোরানে পাকে বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁদের আশ্রয়ে ও আলোকে মানুষ পূর্ণতা পাচ্ছে এবং তাঁদের পায়ের ধূলায় শত শত অন্ধ-নিজেদের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে। এ ধরনের বহু ঘটনা ইতিহাসে রয়েছে। এ ছাড়া পয়গাম্বরদের পবিত্র সত্তায় অসংখ্য মর্যাদা ও বিশিষ্টতা রয়েছে। অনুরূপ বহু অলীও জগতে আছেন, অসীম সত্তার সাথে যাদের সম্পর্ক বর্তমান।
মোট কথা, ক্ষতির আশংকা থেকে বাঁচার উদ্দেশে সাধারণের পর্দা করা ফরয। তবে সর্বাবস্থায়ই পর্দা পুণ্যের কাজ এবং ভালো। শালীনতা ও শিক্ষার উদ্দেশে যদি নারী পুরুষের দেখাদেখি হয়, তাহলে উক্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার মধ্য দিয়ে কোরানের আরও শিক্ষা ও রহস্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। যেমনÑ নরকবাসীকে স্বর্গবাসী করা, নেহায়েত দুষ্ট, বেকার, নিম্নতম যোগ্যতা নেই এমন ব্যক্তিকেও কয়েকটি গুণে ভূষিত করে উচ্চস্থানে পৌঁছে দেওয়া। একজন নিরেট মূর্খ যে বিশ টাকার লোক নয় সেও শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভের মাধ্যমে হাজার টাকা বেতনের যোগ্য হতে পারে। অনুরূপ গুণীদের সাহচর্য পরশ পাথর স্বরূপ। এর দ্বারা শাস্তি থেকে বাঁচার পথ পাওয়া যায়। সে যদি পরকালের জ্ঞান অর্জন না করে, কেবল পর্দার মধ্যেই বসে থাকে, তাহলে হেদায়েত লাভ করবে কী করে? পৃথিবীর সকল মানুষ, বরং বড় বড় ফেরেশতা এবং জ্বিনদেরও তো হেদায়েত প্রয়োজন। কাফির ও মুনাফিকরা অবশ্য তা চায় না, তাদের মুনাফিকী এ পথে কঠিন অন্তরায়। এ হিসেবে আবু জেহেল এবং কাফিরগণ দুর্ভাগাই রয়ে গেল। অপর দিকে সত্যের ওপর থাকলে মুমিন মুমিনই থাকে। আর সত্য থেকে বিচ্যুত হলে বেঈমান, কাফির এবং মুনাফিকে পরিণত হয়। এরাই হয় সত্য প্রত্যাখ্যানকারী আর পরচর্চায় মুখর। কিন্তু পয়গাম্বরগণ সৌজন্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য মূলত একইরূপ কল্যাণকর। তাঁদের কাছে সৌজন্য প্রার্থনা করা ঈমান এবং প্রশান্তির কাজ। তাঁদের মাধ্যম ছাড়া সুপারিশ লাভ করা অসম্ভব। এ জ্ঞান ঈমান ও শান্তির নৌকার সম্বল। তা ইন্দ্রীয় এবং হালের মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং পাওয়া যায় চক্ষু কর্ণ ও মুখের সাহায্যে। এ কারণে কল্যাণের উদ্দেশে পর্দাকে বৈধতার বিভিন্ন পর্যায়ে রেখে সকল কার্য সম্পাদনে স্বতন্ত্র ফল পাওয়া যায়। যেমনÑ কোন কোন সময় শারীরিক পর্দা ফরজ আবার কোনো সময় তা মোবাহ্ বা বৈধ ইত্যাদি। এ শর্তেই ফকিহ্গণ পর্দার বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলেন, নারীদের আওয়াজও নারীÑ তাহলেও সাধারণভাবে তা হারাম নয়, বরং তা কখনো হারাম, কখনো মাক্রূহ, কখনো মোবাহ্, কখনো মুস্তাহাব আবার কখনো তা সুন্নত বা ওয়াজিব। আবার কখনো এর বিপরীতক্রমে তা সুন্নত, ওয়াজিব এবং ফরয হতে পারে। যেমন কোরান পাঠ করা এবং নিজের পাঠাভ্যাস করা। এটা কখনো সুন্নত বা মোবাহ্ না হয়ে পারে না; বরং বিদ্যা শিক্ষা এবং কাজের প্রয়োজনে নারীদের উচ্চকণ্ঠ হওয়া ফরয এবং ওয়াজিব। কারণ, উচ্চঃস্বরে না পড়লে পাঠ স্মরণ রাখা কঠিন। শুধু তাই নয় আপন শিক্ষক এবং সহপাঠিদের সামনে জোরে বলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুতরাং শর্ত সাপেক্ষে জোরে আওয়াজ করা ফরযও হতে পারে। প্রয়োজনে নারীদের জন্য জোরে আওয়াজ করে অথবা কথা বলে অন্য পুরুষদের শোনানো সুন্নত এবং ফরয। যেমন প্রয়োজনে কাউকে ডাকা অথবা জোরে কথা বলা। উদাহরণস্বরূপ কোনো হিংস্র পশু অথবা ক্ষতিকর প্রাণী কারও ক্ষতিসাধন অথবা মৃত্যু ঘটানোর জন্য ওঁৎ পেতে আছে অথবা আগুন, পানি বা চোর-ডাকাতের আশংকা রয়েছে, এমতাবস্থায় লোকজন ডাকা বা সংবাদ দেওয়া ফরয। অনুরূপ বেচা-কেনার সময় সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে কথা বলা বৈধ। তাছাড়া অচেতন বা আত্মভোলা অবস্থায় পরজাগতিক কারবারেও উচ্চকণ্ঠে বা জোরে কথা বলা নিষেধ নয়। যেমনÑ টেনে আল্লাহ্্ উচ্চারণ করা অথবা উচ্চঃস্বরে আল্লাহ্্-রাসূল, হু-বা-হা বলা অথবা নামাজের মধ্যে আযাবের ভয়ে জোরে কাঁদা বা উচ্চকণ্ঠে আহঃ উহ্ করা, আল্লাহ্্কে স্মরণ করে চিৎকার করা, যিকিরের মধ্যে অজ্দ হওয়া এর কোনোটিই নিষেধ নয়, বরং এতে নামাজ পূর্ণরূপে সফল হয়।
যে আওয়াজে ভিন্ন পুরুষদের যৌন উত্তেজনা বাড়ায়, তা নিষেধ এবং হারাম। এরূপ আওয়াজকে আরবিতে ‘তাম্তীত্’ বলে। এ আওয়াজ হারাম। তাছাড়া মেয়েরা যদি নামাজে জোরে কিরয়াত পড়ে বা উচ্চকণ্ঠে তাক্বীর বলে তাও শরিয়াতের দৃষ্টিতে বৈধ, বরং তা অনুমোদিত এবং প্রমাণিত। জনাব মাওলানা মরহুম আব্দুল হাই তাঁর ‘মাজমুয়া-এ-ফতোয়া’ প্রথম খন্ড ১৮৪ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ফতহুল কাদীর, শরহে হেদায়া, আইনী এবং সুনান আবু দাউদ প্রভৃতি গ্রন্থে অনেক হাদীস উল্লেখ রয়েছে, যাতে মেয়েদের জামাত এবং উচ্চঃস্বরে কিরা’আত এবং তাক্বীরের বৈধতা মিলে। একটি হাদীস হলÑ اى ام ور قة قدقر ات القران فاستذ نت النبى صلعم ان تتخذ فى دارها مؤذنافاذن لها وامرها ان تئم اهل دارها ( (আইউ উম্মি ওয়ারকাতা ক্বাদ কারাআতাল কোরআনা ফাস্তাজানাত নাবিউ (সাঃ) আন তাত্তাখিজা ফি-দারিহা মুয়াজ্জানা ফায়াজ্জানা লাহা ওয়া আমারাহা আন্তাওয়ামো আহ্লে দারেহা) (একদা উম্মে ওয়ারকাহ্ কোরান পাঠ করে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নিকট নিজের ঘরে মুয়াজ্জ্বিন রাখার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন সে যেন তাঁর ঘরের সকলের ইমামতি করে।) তাছাড়া হযরত আয়েশা থেকে ইবরাহীম, তাঁর থেকে হাম্মাদ, তাঁর থেকে আবু হানীফা বর্ণনা করেনÑانما كانت تؤم النساء شهر رمضان فتقوم وسطهن (আন্নাহা কায়ানাত তাওয়াম্মা নিছায়া শাহ্রা রামাদানা ফাতাকুমু ওয়াসাতাহুন্না) (রমজান মাসে আয়েশা (রাঃ) মেয়েদের মাঝখানে দাঁড়ালেন এবং ইমামতি করেন) আবিহাজার আছ্কালানী শরহে রাফিইতে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ইবনে শোবা পরে আল্ হাকেম ইব্নে আবি লায়লী সূত্রে আয়েশা থেকে হাদীসটি এভাবে উদ্ধৃত করেছেন।انها كانت توءم انساء فتقوم معهن فى الصف (আন্নাহা কায়ানাত তায়াম্মান নিছাই ফাতাকুমু মায়াহুন্না ফিস্ সাফ্ফি) (তিনি মেয়েদের সাথে কাতারে দাঁড়ালেন) এবং শাফে-ই ইব্নে শোবা প্রমুখ উম্মে সালমা থেকে উদ্ধৃত করেন। انها امت انساء فقامت وسطهن (আন্নাহা আম্মাতিন্ নিছাই ফাকামাত ওয়াসতাহুন্না) (তিনি মহিলাদের ইমামতি করেন এবং দাঁড়িয়েছেন তাদের মাঝখানে)। আইনীও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অতঃপর উক্ত মাওলানা বলেন যে, এ হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, মহিলাদের জামায়াতে মহিলার ইমামতি করা এবং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়ানো নিয়ম, পুরুষদের মতো এগিয়ে দাঁড়ানো বৈধ নয়। এ হাদীস দ্বারা আরও জানা যাচ্ছে যে, মহিলা ইমামের জন্য জোরে কিরাআত পাঠ ও তাক্বীর উচ্চারণ বৈধ। কোনো কোনো মাযহাবে মেয়েদের আওয়াজকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। কিন্তু এটা পুরুষদের বেলায়, মেয়েদের বেলায় নয়। মোট কথা উক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, মেয়েদের জামাত বৈধ এবং পুণ্যের কাজ।
এতক্ষণ নারীকণ্ঠ, তাদের চলাফেরা, শারীরিক কসরত এবং রূপ প্রকাশের বৈধতা সম্পর্কে আলোচিত হল। কিন্তু দেহ ও অলংকারসমূহের সৌন্দর্য প্রদর্শন সম্পর্কে বিধান ভিন্ন। দেহের বৈধ অংশ খোলা রাখা এবং সৌন্দর্য প্রদর্শনের বৈধতা কোরান দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ্্ বলেন, ولايبدين زينتهن الا لبعولتهن اوابائهن اواباء بعو لتهن او ابناء بعو لتهن اواخواتهن اونسا ئهن اوما ملكت ايمانهن اوالتبعين غير اولى لاربعة من الرجال اوالطفل الذى لم يظهر على عورة النساء (ওয়ালা ইউব্দিনা জিনাতাহুন্না ইল্লা লিবুয়ূলাঁতি হিন্না আও আবাইহিন্না আও আবাই বুউলাতিহিন্না আও আবনাইবুউলাতিহিন্না আও ইখ্ওয়াতিহিন্না আও নিছাইহিন্না আও মা-মালাকাত আইমানুহুন্না আউলিতাবইনা গাইরি আওলা লেআরবারাতা মিনাররিজালি আবিওিফলিল্লাযী লাম ইয়াজহার আলা আওরাতিন নিছাই।) অর্থাৎ, নারীগণ তাদের আবরণ প্রকাশ করবে কেবলমাত্র তাদের স্বামী অথবা বাবাদের কাছে, দাদা এবং পরদাদা-বাবাদের অন্তর্ভুক্ত অথবা স্বামীদের বাপদের কাছে। কারণ নারীদের জন্য তারা বাপতুল্য অথবা আপন পুত্রদের কাছে অথবা পুত্রের পুত্রদের কাছে। এরা মেয়েদের কাছে পুত্রতুল্য অথবা আপন ভ্রাতুষ্পুত্রদের কাছে এরা ভাইতুল্য, অথবা ভগ্নিপুত্রদের কাছে দুগ্ধ সূত্রে মোহ্রেমদের বেলায়ও এ নির্দেশ প্রযোজ্য। চাচা এবং মামাদের উল্লেখ করা হয়নি। কারণ তারা ভাইদের হুকুমের আওতায় রয়েছে। স্বধর্মীয় মহিলাদের কাছে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারবে। ‘তিব্ইয়ান’ থেকে তাফ্সীরে হোসাইনিতে উদ্ধৃতি করা হয়েছে যে, ইহুদি মূর্তিপূজক ইত্যাদি মহিলারা ভিন্ন পুরুষের পর্যায়ভুক্ত। তাছাড়া দাস-দাসীদের কাছেও মহিলাদের পর্দা করতে হবে না। এ দাস-দাসীরা ঈমানদার হোক বা কাফির হোক। এছাড়া মহিলাদেরকে তাদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখতে হবে না যৌন ক্ষমতা রহিত অনুগত পুরুষদের কাছে, যারা আহার চাওয়ার জন্য বাড়িতে আসে এবং যৌন চাহিদা সৃষ্টি হয় না এমন শিশুর কাছে। যৌনতার শর্তের ফলে বৃদ্ধ নপুংসক ব্যক্তিগণও আওতায় এসে যায়। কারণ এরাও সকল ফেৎনার ঊর্ধ্বে।
উক্ত আয়াত দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, পরিচিত বা অপরিচিত পুরুষদের দেখা দেওয়া মহিলাদের জন্য শরিয়ত মতে বৈধ। তাদের দাস বা রান্নাবান্নার কাজে নিয়োজিত পুরুষদের সাথে কথা বলা বা তাদের রূপ প্রদর্শন করাও নিষেধ নয়। তবে তাফসীরে লিখে যে, এদের সরল-সোজা লোক হতে হবে। সে যাই হোক, এ ব্যক্তিগত চাকর বা দাসটি অপরিচিত লোকতো বটে। কোনো কোনো শর্তে দাস-দাসীদের মোহ্রেম ধরা গেলেও চাকর তো কোনোমতেই এদের অন্তর্ভুক্ত নয়। অতঃপর এরূপ পুরুষদের দেখা দেওয়া যখন কোরান দ্বারা প্রমাণিত বরং বলা চলে অনুমোদিত। তখন কোরানের মোকাবিলায় কোন দলিলে তাকে অবৈধ বলা যেতে পারে যে, তার কারণে ধর্মের বিধান পাল্টে যাবে? কারও ধর্মীয় অধিকারকে আত্মস্বার্থে হরণ করা কি কোন ন্যায়বান লোকের কাজ? যারা মনগড়া কথা আওড়িয়ে ধর্মের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তারাতো দ্বীনদার হতে পারে না, বরং তারা দ্বীন তথা ধর্মের ধ্বংসের কাজে লিপ্ত।
প্রকৃতপক্ষে নফ্সের দুষ্টতার কারণে নারীদের জন্য পর্দা ফরয হয়েছে। নফ্সের দুষ্টতার বেলায় নারী-পুরুষ সকলের জন্য একই হুকুম। পুরুষরা পর্দা না করলে কী করে নারীদের বাঁচানো যাবে? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত সিদ্দিকা খাতুন মরহুমাকে কোন অন্ধ থেকেও এড়িয়ে চলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ অন্ধ চোখের অনিষ্টতা থেকে মুক্ত হলেও নফ্সের দুষ্টতা থেকে মুক্ত নয়। এজন্য তাঁকে তার থেকে এড়িয়ে চলার হুকুম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া অন্য কোনো তাৎপর্যও থাকতে পারে। তাছাড়া আল্লাহ্্ বলেন,المؤمنون والمومنات بعضهم اولياء بعض يامرون بالمعروف وينهون عن المنكر (আল মুমিনুনা ওয়াল মুমিনাতি বাযুহুম আওলিয়াও বাযিন্ ইয়া’মুরূনা বিল্ মা’রুফি ওয়া ইয়ানহাওনা আনিল মুনকার) অর্থাৎ, ঈমানদার নারী ও পুরুষগণ পরস্পর অলী। তাঁরা সৎকাজে আদেশ করেন এবং অন্যায় থেকে বারণ করেন। অর্থাৎ, ঈমানদার নারী-পুরুষদের মধ্যে বিদ্যমান বেলায়েত তথা বন্ধুত্ব এবং হৃদ্যতার কারণে এরা পরস্পর আত্মীয় ও বন্ধু। তাই এরা একে অন্যের অলী তথা হিতাকাঙ্খী। অলী শব্দ ‘ওয়ালা’ ধাতু থেকে উৎপন্ন। ‘ওয়ালা’ অর্থ আশেক বা প্রেমিক। সুতরাং বেলায়েত দৃষ্টে অলীই প্রকৃত বন্ধু তথা মুর্শিদ। তাদের কেউ হলেন মুর্শিদ আর কেউ মুরিদ।
উল্লেখ্য, এখানে ঈমানদার বলতে নারী-পুরুষ উভয় সম্প্রদায়কেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো পুরুষ যেমন নারীদের অলী হতে পারে, তেমনি কোনো নারীও হতে পারে পুরুষদের অলী এবং হতে পারে কোনো নারী নারীদের জন্য অলী আর পুরুষ পুরুষদের জন্য। অলী শব্দটি বিশেষভাবে মোমিন বা ঈমানদারের বেলায় প্রযোজ্য, যে ঈমানদার ব্যক্তি একজন পরিপূর্ণ মানুষ, বেলায়েতের বিচারে। এজন্য তাকে অলী বলা হয়। এ অলী বেলায়েতের জ্ঞান দ্বারা ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে যে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাই মুরিদদের জন্য অবশ্য পালনীয় এবং করণীয়। কেননা, তিনি তো ইশ্ক্ এবং এখলাস-এর শরিয়ত দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ হিসেবে প্রেমিকদের পথ হল সরল সোজা। প্রেমিক নিজের প্রেমাস্পদকে আঁকাবাঁকা পথ থেকে উদ্ধার করে তাওহীদ এবং ঐক্যের পথ প্রদর্শন করে। কারণ ইশ্ক্ তথা প্রেমের কাছে আশেক-মাশুক ছাড়া আর কিছুই দাঁড়াতে পারে না। তাই নবী-অলীগণ আল্লাহ্্র প্রকৃত বন্ধু বলে গণ্য। তাঁদের পথ, হেদায়েতের পথ এবং সরল সোজা পথ। তাইতো বলা হচ্ছেÑ اهدنا الصراطا المستقيم (ইহ্দিনাস্ ছিরাতাল মুস্তাক্বীম) অর্থাৎ আমাদের সরল সোজা পথ দেখাও। এ সরল সোজা পথইÑ مخلصين له الدين (মুখলিসীনা লাহুদ্দীন) তথা নিষ্ঠাবানদের ধর্ম। অতএব এখ্লাস তথা নিষ্ঠা ব্যতীত সত্য পথের সন্ধান লাভ করা অসম্ভব। এজন্য আল্লাহ্্র হুকুম হলÑ كونو امعالصادقين (কুনু মায়াস সাদিক্বীন্) অর্থাৎ, সত্যাশ্রয়ীদের সাথী হও এবং তোমার লক্ষ্য ও উদ্দেশের দিশারী বা অলীর রঙ ও রূপের সাথে মিশে যাও। তাঁর ভিতর বাইরের গুণাবলি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে একাত্ম হয়ে যাও। এটাকে বলা হয় ‘কাইনুনাত’। হযরত খাজা আহারার (কুঃ ছেঃ) ‘এছবাত-ই রাবেতা’য় তাই লিখেছেন।
‘কুনু’ আদেশমূলক ক্রিয়া। আদেশ ওয়াজিব প্রমাণ করে। এর সারমর্ম হল সততা এবং শালীনতার জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যা সত্য অলী তথা বিশুদ্ধ বক্ষ তথা মুর্শিদ থেকে বের হয়। এটাই ‘কাইনুনাত’ এর অর্থ এবং সারমর্ম। সুতরাং মুর্শিদের অšে¦ষণ বা সঙ্গলাভে বাধা থাকলে তা দূর করতে হবে। যেন সৎ ব্যক্তি তথা অলীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করা সম্ভব হয়। এটা কোনো প্রকার পর্দার স্থান নয়; বরং এটা হল এমন একটি স্থান যেখানে কোনো পর্দা থাকলেও তা সরিয়ে ফেলতে হবে। কারণ এক্ষেত্রে হুকুম হল সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গী হও। আর পর্দার আয়াতে দুষ্টদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে, সুতরাং ফেৎনার কারণে পর্দা করা ফরয। আর দীক্ষালাভের জন্য পর্দা সরানো ফরয। অর্থাৎ দুষ্ট লোকদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা যেমন ফরয এবং পবিত্র আত্মার সাহচর্যলাভ করা তেমনি ফরয। এ দুয়ের পার্থক্য ব্যাপক। একই হাড়-মাংসের দেহে কোথায় মগজ আর কোথায় গোবর! হেদায়েতের গুরুত্ব সম্পর্কে চিন্তা করুন। তা অনন্ত সত্তায় পৌঁছার মাধ্যম হিসেবে গণ্য। তবে তাকে পরম সত্তার সমকক্ষ ও সমমানের হতে হবে। তা না হলে তাঁর পক্ষে উসিলা হওয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ্্ বলেনÑوابتغوا اليه الوسيلة (ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলাতা) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র নৈকট্য লাভের জন্য উসিলা খোঁজ কর। এটাও সাধারণ নির্দেশ। এর সোজা অর্থ হল, আল্লাহ্্কে পেতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৎ ও সিদ্ধ মুর্শিদ ধর। এ ক্ষেত্রেও পর্দা রক্ষা করা সম্ভব নয়; বরং এখানে কাছাকাছি উপস্থিতি প্রয়োজন যা পর্দার সম্পূর্ণ বিপরীত। এত তাগিদ সত্ত্বেও আল্লাহ্্ তাঁর আশেক ও প্রেমিকদের লক্ষ করে বলেছেন, فا سئلوا اهل اذكر ان كنتم لا تعلمون (ফাস্আলু আহ্লায্-যিক্রি ইন্ কুনতুম লা-তা’য়ালামুন) অর্থাৎ তোমরা যা না জান, তা আহলে যিকিরকে জিজ্ঞাসা কর। এজন্য আদেশটি নির্বিশেষে নারী পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। এর পরিষ্কার অর্থ হল মুর্শিদকে জিজ্ঞাসা কর এবং মুর্শিদের দীক্ষা অনুসরণ কর। এজন্য শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতি প্রয়োজন। এ আয়াতের মর্মার্থ ও দুষ্ট লোকদের ওপর আরোপিত পর্দার আয়াতের বিপরীত তথা এ ক্ষেত্রে মুর্শিদের মুখোমুখি হওয়া শর্ত। আর তার হতে হবে ঈমান, নিষ্ঠা, খেয়াল ও ধ্যান, দোস্তি মহব্বত এবং নৈকট্য ও সাথীত্বের বৈশিষ্ট্য সহকারে। কিন্তু ফেৎনাবাজ তথা দুষ্ট লোকদের মুখোমুখি হওয়া মহিলাদের জন্য হারাম। তাদের সাথে নিষ্ঠা, খেয়াল, ধ্যান, দোস্তি মহব্বত প্রভৃতির তো প্রশ্নই উঠে না; বরং তাদের মুখোমুখি হওয়া তাদের সাথে কথা বলা এমন কি তীক্ষèদৃষ্টিতে তাদের প্রতি তাকানো হারাম। অতএব, দুষ্ট লোকদের কাছে পর্দা না করা হারাম আর বক্ষ পরিষ্কারের বিদ্যালাভের পথে মুর্শিদের কাছে পর্দা করা হারাম। কারণ তাতে পর্দাকারী হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ এজন্য আল্লাহ্্র কঠোর নির্দেশ রয়েছেÑ واصبر نفسك معالذين يدعون ربهم بالغوت والعشئ يريدون وجهه (ওয়াসবির নাফ্সিকা মাআল্লাযীনা ইয়াদউনা রাব্বাহুম বিল-গুদুয়াতি ওয়াল আশিয়্যি ইউরিদুনা ওয়াজহাহু।) অর্থাৎ, নিজ জীবনটাকে তাঁদের সাথে জড়িয়ে রাখ, যারা সকাল সন্ধ্যা তাঁদের প্রভুকে ডাকে তথা স্মরণ করতে করতে আল্লাহ্্তে মিশে গেছে। অর্থাৎ, তাঁদের প্রাণের সাথে প্রাণ, বুদ্ধির সাথে বুদ্ধি, বিদ্যার সাথে বিদ্যা, অন্তরের সাথে অন্তর, আত্মার সাথে আত্মা, ছের এর সাথে ছের এবং খফির সাথে খফি তথা বিভিন্ন অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত তাঁদের চরিত্রে নিজেকে চরিত্রবান করে গড়ে তোল। যাতে মুর্শিদ সত্তার পরিপূর্ণ গুণাবলি আপন সত্তায় উদ্ভাসিত হয়। এটা শতবার মুখোমুখি হওয়ার চেয়েও অধিক কার্যকর। কারণ, সাধারণত মুখোমুখি অবস্থায় মূল সত্তায় এবং গুণাবলির প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় না। তবে আপন মুর্শিদের মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে তাঁর সত্তা ও পূর্ণতার অনুশীলন দ্বারা মুর্শিদের চরিত্র মাধুর্যে মুরিদ অভিভূত হয়ে যায়। এর ফলে মুর্শিদের গুণাবলিসমূহ আপন সত্তায় আকর্ষিত হতে থাকে অনুরূপ বিশ্বাস না থাকলে কোনো মুর্শিদের ফায়েজ আপন সত্তায় আসবে না। বস্তুতপক্ষে মিলন কামনা দ্বারা রহস্যাতিরহস্যময় মৌল মিলন উদ্দেশ। অপরের মাধ্যমে বা দূর থেকে এটা সম্ভব নয় এবং অন্য কারও কথায় বিশ্বাস দ্বারাও এটা সম্ভব নয়। তবে এর কিছু বাহ্যিক আলামত দেখা যেতে পারে। কিন্তু কেউ যদি আপন মুর্শিদ ছাড়া নিজের সিদ্ধ অবস্থা প্রকাশ করে, তাহলে পরিণামে সে তা থেকে বঞ্চিত হবে। এটা সকলেরই জানা যে, অলৌকিক অবস্থা কারও কাছে প্রকাশ করলে, তা বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি মুর্শিদের মহান সত্তার প্রভাব থেকে বঞ্চিত সে-তো আল্লাহ্্র পবিত্র সত্তা থেকেও দূরে। এরূপ ব্যক্তিতো কোরানের প্রসারতা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে-তো ফাসিক এবং মুনাফিক। কারণ সে আল্লাহ্্র আদেশসমূহ থেকে দূরে এবং এর বিরোধী ও অলীদের নিগাহদারী বা তত্ত্বাবধানের সমালোচনা করছে এবং অলীকে ফাসিক ও মুনাফিকদের দলভুক্ত করে নিজেদের মতো অলীর বেলায়ও দেখা-সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধান নিষিদ্ধ করছে। অতএব, অনুরূপ ব্যক্তি নিকৃষ্টতম কাফির। কারণ যে আমানত নষ্ট করলে মানুষ কাফির হয় তা হল ঈমান এবং অন্যের ঈমান ও আমানত নষ্টকারী কাফির ও শয়তান। কারণ এটা খান্নাছ শয়তানের কাজ। এজন্য এ ব্যক্তি নিকৃষ্টতম কাফির। কারণ সে দুপ্রকার আমানত নষ্টের কাজে লিপ্ত। তবে মুর্শিদ এবং মুরিদের মধ্যে যদি কোনো প্রকার ফেৎনার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তা থেকে নিষ্কৃতি হওয়া ফরয। কারণ, তা না হলে হেদায়েতের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। মুর্শিদ পরিপক্ক না হলে এমনটা হয়। এটা বিপজ্জনকও বটে। সর্বোপরি অধিকাংশ নারীর কাঁচা বুদ্ধি। এ জন্য পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তথা ইনসানে কামেল দ্বারা তাদের বিশুদ্ধায়ন প্রয়োজন। অপরদিকে আহ্লে যিকির যারা নিজেরাই নিজেদের সঠিক মুর্শিদ তাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ ভান্ডার থেকে ভাবসূর্যরশ্মি যখন ধ্রুব তারার মতো আল্লাহ্্র প্রেমিকের প্রেমাকাশে উদিত হয়, তখন সেই মহাসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে মহিয়ান গরিয়ান প্রভু অতি মিষ্ট ভাষায় আপন প্রেমিকদের এভাবে সুসংবাদ দেনÑ تقشعر منه جلود الذين يخشون ربهم ثم تلين جلو دهم وقلو بهم الى ذكر الله (তাক্সার্য়িরা মিন্হু জুলুদুল্লা-যীনা ইয়াখ্সাওনা রাব্বাহুম সুম্মা তালিনু জুলুদুহুম ওয়া ক্কুলূবুহুম ইলা যিকরিল্লাহি) (সূরায়ে জুমার দ্বিতীয় রুকু) অর্থাৎ যারা আল্লাহ্্কে ভয় করে সে অবস্থায় তাদের পশম শিউরে উঠে, তাদের চামড়া নরম হয়ে যায় এবং তাদের অন্তর বিগলিত হয় আল্লাহ্্র স্মরণে। অর্থাৎ, সিদ্ধ অবস্থায় আল্লাহ্্ এবং বান্দার মধ্যে যে সম্পর্ক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় তা অনেকটা উত্তপ্ত সীসার মতো। আল্লাহ্্ এবং বান্দার মধ্যকার প্রেমের ফলশ্রুতিতে বান্দার ‘ইনকিসাফ’ তথা হৃদয়ের প্রসারতার
সৃষ্টি হয়। এরূপ অবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঈমান সম্পদের আমানতদার হয়ে থাকে। এজন্য সূরা হাদিদে ঈমানদারদের লক্ষ করে বলা হয়েছেÑ الم يات للذين امنوا ان يخشع قلوبهم لذكر الله (আলাম ইয়াতি লিল্লাযীনা আমানূ আইয়াখ্সাউ কুলুবুহুম লি-যিকরিল্লাহি) অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সে সময় কি আসে নি, যখন তাদের অন্তর আল্লাহ্্র স্মরণে ভীত ও নরম হবে।
যে ব্যক্তি ঈমান সম্পদের পথ এবং নূরে ঈমানের পূর্ণতা লাভ করেছে, সে কি সুপারেশী বক্ষ এবং নির্মল অন্তর ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করবে? বরং এ বিনয় নম্রতার কারণে আল্লাহ্্ সাধকদেরকে উপযুক্ত মুর্শিদের হাওলা করে দেন। এভাবে উস্তাদ এবং মুর্শিদগণের মাধ্যমে বান্দারা আল্লাহ্্র অনুকম্পা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ পীর এবং মুরিদের মধ্যে বিরাজমান আত্মীয়তার সম সম্পর্কের বদৌলতে স্বীয় সৌভাগ্য অনুযায়ী অলী বা মুতাওয়াল্লি ও মুর্শিদ এবং মুরিদের মর্যাদা পেয়ে থাকে। এ সম্পর্কের গুরুত্ব এতই বেশি যে, পৃথিবীর অন্য কোনো সম্পর্কই এর চেয়ে বেশি নয়। কারণ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্্ তায়ালা সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। সুতরাং তাঁর সঙ্গে যে ব্যক্তি সম্পর্ক রাখেন, তাঁর মর্যাদাও সবচেয়ে অধিক এবং উন্নত হবে। অতএব নবী, অলী এবং মুর্শিদ সর্বদাই উন্নত মর্যাদার অধিকারী। তাঁরা ফেরেশতা, জ্বিন এবং মানব, যে কোনো সম্প্রদায় থেকেই হন। তবে আল্লাহ্্ ওয়ালাদের এ উন্নত মর্যাদার পর্যায়ে মনের পর্দা থাকা প্রয়োজন। এর ফলে নফ্সের প্ররোচনায় চোখের দ্বারা যে ফেৎনা থাকার আশংকা থাকে তা দূর হয়। তখন কোনো নারীর প্রতি নজর দেওয়া নিষিদ্ধ নয়। ফতোয়ায়ে শামীতে আছেÑ واجعمعوا على بغير قصد اللذة والنا ظرمع ذلك امن من الفتنة (ওয়াইজ্মাও আলা বিগাইরি কাছদিল্লাজ্জাতি ওয়ান নাজেরো মা’আ যালিকা আমেনুন্ মিনাল ফেৎনাতি) অর্থাৎ, সকল ফিকাহ্বিদগণ একমত যে, ভোগমুক্ত দৃষ্টিতে তাকানোতে কোনো দোষ নেই, আর এটা নজরে সুলতানী থেকে অর্জিত হয়। হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑ النائر شفاء (আননাজরু শিফাউন) অর্থাৎ, দৃষ্টি ঔষধস্বরূপ। অনুরূপ দৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তি সুপারিশকারীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাঁদেরকে জাতির বা সম্প্রদায়ের ত্রাতা বা সুপারিশকারী বলা হয়। অনুরূপ সদয়দৃষ্টির আড়াল ব্যক্তি সুপারিশ থেকে বঞ্চিত। সে নবী এবং অলীদের আমানতের অযোগ্য। উল্লেখ্য, মহিলা মুরিদগণ যখন আপন রাসূলে হাকীকী তথা মুর্শিদের মুখোমুখি হবে, তখন তাদেরকে অভ্যন্তরীণ তথা মনের পর্দা বহাল রাখতে হবে। নিজের পিতা ও চাচাদের সামনে যেভাবে পোশাক পরার নির্দেশ রয়েছে, সে ভাবেই পোশাক ইত্যাদি রক্ষা করতে হবে। কারণ এ সাক্ষাৎ ওয়াজিব। ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য এটা জরুরি। এ সাক্ষাৎ সঠিক পথ প্রদর্শন কর্ম হিসেবে গণ্য। এ কারণে অলীদের জন্য শরিয়ত অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ পর্দা আবশ্যক। এটা শত শত বাহ্যিক পর্দার চেয়ে অনেক উত্তম। বিবি রাবেয়া বস্রী, বিবি তোহ্ফা এবং বিবি কা’বান প্রমুখ শরিয়ত অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ পর্দা করেছেন, যা শত শত বাহ্যিক পর্দার চেয়ে উত্তম এবং কার্যকরী।
বাবা শেখ ফরিদ তাঁর আপন ‘তাজ্কেরাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, অলীকুল মাতা হযরত রাবেয়া বস্রী যতক্ষণ হযরত হাসান বস্রীর দরবারে হাজির না হতেন, ততক্ষণ তিনি ওয়াজ শুরু করতেন না। কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন করত যে, আপনি মহিলা হয়ে অপর পুরুষদের সভায় আসেন কেন? তিনি জবাব দিতেন, হাদীসে বলা হয়েছেÑطالب المولى مذكر طالب العقبى مؤنث طالب الدنيا مخنث (তালিবুল মাওলা মুযাক্কারুন তালিবুল ওক্বা মোয়ান্নাসুন তালিবুদ্দুনিয়া মোখন্নাছুন) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র সাধনকারী পুরুষ, পরকালের সাধক নারী এবং দুনিয়াপ্রার্থী নপুংসক বা খোজা। সুতরাং আমি আল্লাহ্্র সাধক তাই পুরুষ, তোমরা পরকাল সাধক তাই নারী। তোমরা কেন অপর পুরুষদের দরবারে আসছ? শরিয়তি পর্দায় সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের প্রতি লক্ষ কর, তা হল আধ্যাত্মবাদী এবং নবী-অলীদের কাছে আসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য বৈধ। এটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ কারণে নবী-অলীদের কবর ও মাজার জিয়ারত সাধারণভাবে বৈধ ও উপকারী। এ জন্যই আমাদের শেষ নবীর মাজার জিয়ারতে বহু নারীর সমাগম হয়। হযরত উম্মে বরকত জহুরা খাতুনের কবর আজও শত শত নারী-পুরুষ সর্বদা জিয়ারত করে। জিয়ারত অর্থ মোলাকাত বা সাক্ষাৎ। সুতরাং জিয়ারতকারীদের জিয়ারত শত মোলাকাতের চেয়েও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। জিয়ারত অবস্থায় তাদের সাথে মোলাকাত করা কেন বৈধ হবে না? যাদের জিয়ারতের সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো দৃষ্টিহীন অন্ধ। তাদের পক্ষে জিয়ারতের উদ্দেশ ও লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তারাতো কলুর বলদ তথা চক্ষুবন্ধ তৈলের ঘানির বলদ। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় কত চক্কর হল? সে বলবে আমার কাজ শুধু চক্কর দেওয়া এর বেশি আমি জানি না। কিন্তু প্রেমিকগণ যারা জিয়ারত করে তারা সকলেই মনেপ্রাণে তা করে। কাশ্ফ প্রভৃতির মাধ্যমে দীদার সকলের পক্ষে সম্ভব না হলেও অপরিচিতা মহিলার জিয়ারতে উক্তরূপ ধ্যান-খেয়াল করা শরিয়তমতে বৈধ বলে প্রমাণিত আছে। অতএব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য আপন পীর ও মুর্শিদের শালীনভাবে ধ্যান ও খেয়ালের সাথে জিয়ারত করার মধ্যে অবশ্যই অধিক কল্যাণ রয়েছে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এ কল্যাণ ফরযও হতে পারে।
লক্ষণীয়, আরবের মেয়েরা আজও লুলু দেয়। এটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। স্বয়ং হযরত মা বরকত (মা ফাতিমা) অন্য মহিলাদের সাথে লুলু দিতেন। বোখারী শরীফে এর উল্লেখ আছে। আজও তো এটা হারাম নয়। শত শত লোক এ আওয়াজ শুনে থাকে।
মোট কথা, প্রেমাসক্ত ব্যক্তিদের যে প্রহর্ষ বা স্পন্দন হয়, তার কারণ তাদের প্রেম ও মহব্বত। অর্থাৎ, প্রেমানলের উত্তাপ থেকে এক প্রকার বিচ্ছুরণ ঘটে। এ এক অপূর্ব এবং রহস্যময় দৃশ্য। যে ব্যক্তি এ অবস্থার শিকার হয়, তাকে একেবারে জ্বালিয়ে দেয়। তার সংসার বিরান করে দেয়। কখনো এ অবস্থা চোর হয়ে অনুরূপ অবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রাণ চুরি করে এবং ডাকাত হয়ে তার ধন-সম্পদ লুট করে, মন্ত্ররূপে তার বুদ্ধি ছিনিয়ে নেয়। জাদুটোনা হয়ে তাকে চির রোগীতে পরিণত করে, দেও বা ভুত হয়ে তাকে পাগল করে দেয়, প্রেতরূপে তাকে কষ্ট দেয়, তুফানরূপে তাকে মিছমার করে দেয়, ভাবাপ্লুত করে পাগল বানিয়ে ছাড়ে, খামখেয়ালি করে প্রেমে মা-বাপ থেকে আলাদা করে দেয়, আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, ভবঘুরে বানায়, বনের পশুর মতো করে দেয়, নির্লজ্জ বেশরম করে তোলে, সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়, পানাহারে অনীহা সৃষ্টি করে, খাট-পালং থেকে নামিয়ে ধূলায় লুটিয়ে দেয়, কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়, আহ্! উহ্! চিৎকার করে আর আহ্! উহ্!-এর আগুন যাকে পুড়িয়েছে তার অন্তর কা’বার, কলিজা কোপ্তা এবং গুর্দা কয়লা হয়ে গেছে, রক্ত পানি হয়ে অশ্রুর নদী বয়ে গেছে। তবে প্রেম আগুনে পুড়ে যাকে ভস্ম করে দিয়েছে, তার তো হদিস-ই নেই। ইউসুফের আগুনে জুলেখা পাগলিনী হয়ে গেছে। এতো হল নকল প্রেম। এতেই তো ফরহাদ-মজনু বনবাসী হয়েছে। তাহলে প্রকৃত প্রেম যার মাশুকরূপে সৌন্দর্যে শত ইউসুফের চেয়েও উত্তম যার দীদারের জ্যোতি স্ফুলিঙ্গে আত্মহারা শত শত পাগল পাগলামি করছে, সে প্রেম যাকে আঘাত করে তার অন্য কী উপায় আছে?
আহ্লে অজ্দ্ তথা প্রেম প্রহর্ষ ব্যক্তিগণ স্বস্তিহীন তথা মাজুর। প্রিয়া এবং মাশুকের দীদার তথা মোলাকাত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো স্বস্তি থাকে না। যার দর্শনের দ্বারা আল্লাহ্্, রাসূল এবং নবী-অলীদের দীদার লাভ হয়; বরং এতে গোটা সৃষ্টি পরিভ্রমণ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান সম্ভব হয়। এসব অবস্থাদির সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। অনেক সময় এমন হয় যে, আপন মুর্শিদের সাথে দীদার না হলে জীবন রক্ষাই কষ্টকর হয়। এমতাবস্থায় আপন পীর-মুর্শিদের সাথে সাধক ও জাকেরদের মোলাকাত করা অপরিহার্য এবং ওয়াজিব হয়ে পড়ে। কারণ এ সময়ে মোলাকাতে চক্ষু শান্তি করতে না পারলে, হয় তার কলিজা ফেটে যাবে অথবা সে পাগল হয়ে যাবে অথবা আত্মভোলা হয়ে যাবে অথবা হুঁশহারা হয়ে যাবে। এতে সে শরিয়তের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে যা নিষিদ্ধ ও হারাম। সুতরাং আপন মুর্শিদকে আধ্যাত্মিক পিতা মনে করে নেহায়েত আদবের সাথে যেভাবে আপন বাপ-দাদাদের নিকট যাওয়ার হুকুম রয়েছে ঠিক সেভাবে পোশাক-পরিচ্ছদ পরে মুর্শিদের সাথে মোলাকাত করা উচিত। এটা ওয়াজিব। কারণ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটা প্রয়োজন। এর দ্বিতীয় কারণ হল এতে সঠিক হেদায়েত তথা এতে মুরিদ ও মুর্শিদের মূল রহস্য নিহিত এবং এটা চূড়ান্ত বস্তু তথা হাল বা প্রেম প্রহর্ষ অবস্থার লক্ষ্য অর্জনের পথ। এ কারণে আল্লাহ্্ওয়ালাদের আধ্যাত্মিক শরিয়তের পর্দা প্রয়োজন হয়। তাই বিবি রাবিয়া বস্রী, বিবি তোহ্ফা এবং বিবি কা’বান (রঃ) প্রমুখদের আধ্যাত্মিক শরিয়তি পর্দা ছিল যা হাজারও বাহ্যিক পর্দা থেকে উত্তম।
মোট কথা, যখন মনের পর্দা হয় তথা যখন মন নফ্সের প্ররোচনা থেকে মুক্ত হয়, তখন মন হারাম ও সকল শংকার ঊর্ধ্বে চলে যায়। আর যার মনে কালিমা থাকে, শত পর্দার মধ্যে থেকেও সে সুযোগ খুঁজবে। পাকা পূঁজ ভর্তি ফোঁড়া ঢেকে রেখে লাভ কী? বরং একে ফাটিয়ে দাও।
উদ্ধৃত আছে যে, বাবা শেখ ফরিদ তাঁর ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, হযরত রাবেয়া বস্রী যতক্ষণ পর্যন্ত হযরত হাসান বস্রীর দরবারে হাজির না হতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ওয়াজ শুরু করতেন না। এতে বোঝা যায় যে, নারীগণ যোগ্যতায় পুরুষদের সমকক্ষ; বরং ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষদের চেয়ে উত্তমও হয়। এজন্যই হযরত হাসান বস্রীর দরবারে হযরত রাবেয়া বস্রী সকলের চেয়ে মর্যাদাবান ছিলেন। অথচ উক্ত দরবারে শত শত পুরুষ উপস্থিত ছিলেন এবং যাদের অধিকাংশই ছিলেন খায়রুল কুরুন তথা পুণ্যবানদের যুগের মানুষ। মোট কথা, যোগ্যতা অথবা অন্য কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য হোক, প্রত্যেক নারী প্রত্যেক পুরুষের মোকাবিলায় বুজুর্গ। যেমন মা তার নিজের সন্তানের কাছে। অনুরূপ কামেল তথা পরিপূর্ণ ব্যক্তি নাকেস তথা ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তির মোকাবিলায় অধিক বুজুর্গ বা মর্যাদার অধিকারী। রুবুবিয়াত তথা লালন-পালনের দায়িত্বের জন্য অনেকে মর্যাদার অধিকারী হয়। যেমন পিতা-মাতা প্রমুখ। আবার কেউ সাধনায় সিদ্ধির পূর্ণতার প্রেক্ষিতে অনেক মর্যাদা পেয়ে থাকেন। কামেল এবং আরেফ ব্যক্তিত্ব এর অন্তর্ভুক্ত। এদের মোকাবিলায় পৃথিবীর সকল মানুষ নগণ্য এবং ক্ষুদ্র পর্যায়ভুক্ত। এ বুজুর্গ সম্প্রদায় হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে পিতা-মাতার পরিপূর্ণ গুণাবলি অর্জন করে পৃথিবীবাসীর জন্য পিতা-মাতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে আছেন। এ জন্য স্বর্গীয় উপলব্ধির জগতে তথা জ্যোতি ও জ্যোতির্ময় স্তরে দেখা যাবে অলীগণ সকলের চেয়ে উন্নতশির। যেমন হযরত মা বরকত ফাতিমা এবং হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) ও অন্যান্য। অনুরূপ হযরত রাবিয়া বস্রী ও সভাসদদের নিকট মাতৃতুল্য ছিলেন। হযরত বিবি রাবেয়া বস্রীকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করত আপনি নারী হয়ে পুরুষদের দরবারে আসেন কেন? তিনি উত্তরে বলতেন, হাদীস শরীফে আছেÑطالب المولى مذكر طالبعقبى مونث طالب الدنيا مخنث (তালিবুল মাওলা মুজ্জাক্কেরুন তালিবুল ওক্বা মুয়ান্নাছুন তালিবুদ্ দুনিয়া মোখান্নাছুন) অর্থাৎ, আল্লাহ্্ প্রার্থী পুরুষ, পরকালপ্রার্থী নারী এবং দুনিয়াপ্রার্থী খোজা। তোমরা পরকাল প্রার্থী তাই নারী। পুরুষদের দরবারে কেন আস? এ ছিল তাঁর শান্ত-সমহিত অবস্থায় চারিত্রিক পবিত্রতার মান। তবে যারা অজ্দ্ তথা প্রেম-প্রহর্ষের অধিকারী এবং হাল তথা মগ্ন অবস্থাপ্রাপ্ত হন তারা মোবাহ্ তথা অনুমোদিত পর্যায়ে থেকে সাধনার পথের মুসাফির হয়ে যানÑ এ পর্যায়ে তাদের নামাজ সংক্ষেপ করতে হয়। রোজা, নফল ইবাদত এবং জামায়াত প্রভৃতি থেকে রেহাই পান। নেহায়েত জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বৈধ পানাহারে তুষ্ট থেকে হারামের স্তর পেরিয়ে উৎস স্তরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ স্তরটাকে বলা হয় মোবাহ্র স্তর। প্রকৃতপক্ষে এ মহা সফরে বহু কঠিন কাজের সম্মুখীন হতে হয়। এতে রয়েছে ভয় ও সংকট, কঠোরতা ও জটিলতা, যার কারণে হয়ে যেতে হয় জ্ঞানহারা ও বেহুঁশ। এ ভয়ানক নদীর
ভ্রমণতরী আরামদায়ক নয়। এ অবস্থায় তার মাঝি-মাল্লারা এবং খালাসী সবই অস্থির হয়ে থাকে এবং অন্তর পানিশূন্য হয়ে যায়। এ সময় কারো আহার নিদ্রা বা অত্যাচার বা শক্তি-সামর্থ্য সবই বেকার। একমাত্র আহ্! উহ্! আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই এ সময়ে কাজে আসে না। সুতরাং এটা মৃত্যুর সময়ের সাথে তুলনীয়। তাই আশেক এবং প্রেমিকগণ মোবাহ্র পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আপন কাজ সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ, তাদের দ্বারা কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে যেমন অজ্দ্ অবস্থায় শরিয়তের তোয়াক্কা না করা প্রভৃতি ক্ষমা করিয়ে নেন। তবে অজ্দ্ অবস্থায় শরিয়তের তোয়াক্কা না করার মধ্যেও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাহেবে ‘তায়াররুফ’ প্রেমমগ্ন অবস্থায় শরিয়ত লংঘনের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, আবূ তাইয়্যবা রাসূল (সাঃ) এর শিঙ্গা টানেন এবং ভক্তির বশে রক্ত পান করেন। তখন রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি দোজখের আগুন থেকে বেঁচে গেলে। আর এটা হল বড় ধরনের গুনাহর কাজ। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) তাকে এ কাজ থেকে বারণ করলেন না; বরং তাকে দোয়া করলেন। এর কারণ এই যে, ভিতরে তার ইচ্ছা ছিল সঠিক। তা না হলে হারাম রক্ত পান করার ফলে তার বেহেশতের দ্বার প্রশস্ত হতে পারে না। হাদীসে এ ধরনের অনেক কাহিনী আছে। এর কিছু কিছু “তায়াররুফ” ও অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া বদরের সাহাবাদের আল্লাহ্্ যে সুসংবাদ দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে মাওলানা রুমীর মছনবির ব্যাখ্যায় জনাব হাজী এমদাদ উল্লাহ্ (রঃ) লিখেছেনÑ “তাওয়াজ্জু কালাম আনাস্ত কি-ই-শায়েখে বরকদমে আছ্হাবে বদর বাশাদ্, বরুয়ে হামা আশিয়্যা বা মুন্জিলা মোবাহ্ র্গদিদাহ্ বাশাদ্। চে আজ মাচিয়াদ্ বেমাহোয়া মছিয়াত্ ফানিগাস্তাবাসাদ্। ওয়া আজ এরতেকাবে গুনাহ্ হার সাইয়েখ্রা দারার না দারাদ্।” (এ বাণীর মর্মার্থ হল এই যে, শায়েখে বদরী সাহাবাদের পদাঙ্ক অনুসারী হলে সব কিছু তার কাছে মোবাহ্ হয়ে যায়, অপরাধ আবার কী, তখন অপরাধ বলতে আর কিছু থাকে না। পাপের কাজেও শায়েখের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না।) বলা হয়েছেÑ ان الله قد اطلع على قلوب اهل البدر فقال اعملوا ماشئتم لقد غفرت لكم (ইন্নাল্লাহা ক্বাদ আত্লায়া আলা কুলুবি আহ্লিলবাদারী ফাকালা ই’মালূ মা-শি-ই তুম লাক্বাদ গাফারতু লাকুম।) অর্থাৎ, আল্লাহ্্ আহ্লে বদরদের অন্তরে জানিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা যা ইচ্ছা কর, আমি অবশ্যই তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।
হাদীসে আরও একটি কাহিনী পাওয়া যায়, এটা আবি লাবাবা-বিন আবদুল মানজার (রাঃ)-এর ঘটনা। তা হল এই যে, রাসূল (সাঃ), বনী কোরাইজাকে বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের ব্যাপারে সাদ-ইবনি-মায়াজ যা বলবে তোমরা তা মেনে নেবে। একথা মেনে নেওয়ার পর তারা আবু লাবাবার কাছে পরামর্শ চায়। আবু লাবাবা নিজের হাত দিয়ে গলার দিকে ইশারা করেন। অর্থাৎ, সে তোমাদের হত্যা করতে হুকুম দিবে। তোমরা তার ফায়সালা মানবে না। প্রকৃতপক্ষে সে সময় আবু লাবাবা গোলবার হালতে অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন। পরে যখন তাঁর হুঁশ আসে তিনি লজ্জিত হন এই ভেবে যে, আমি আল্লাহ্্ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। অতঃপর সোজা গিয়ে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলেন এবং বলেন যে, যতক্ষণ আল্লাহ্্ আমার তওবা কবুল না করেন, ততক্ষণ আমি এভাবে থাকব। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, সে যদি আমার কাছে আসত তাহলে আমি তাঁর জন্য আল্লাহ্্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। সে যখন এ কাজ করেছে, তখন আল্লাহ্্ তাঁর তওবা কবুল না করা পর্যন্ত আমি তাকে খুলব না। অতঃপর আবু লাবাবার তওবা কবুলের ব্যাপারে আল্লাহ্্ এ আয়াত অবতীর্ণ করেন। সূরা আনফাল্ Ñ يا ايها الذين امنوا ان تتقون الله يجعل لكم فرقانا يكفر عنكم سيئا تكم ويغفكر لكم والله ذوفضل العئيم – – (ইয়া আইউ-হাল্লাযীনা আমানু ইনত্তাকুনাল্লাহা ইয়াজ্আল্ লাকুম্ র্ফুকানান্ ওয়াইয়ূকাফ্ফির আন্কুম ছাইয়্যে আতিকুম ওয়াইয়াগফিরলাকুম ওয়াল্লাহু জুল্ ফাদলিল আজীম) অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্্কে ভয় করবে তিনি তোমাদের মীমাংসা করে দিবেন, তোমাদের অপরাধসমূহ মুছে ফেলবেন, তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন এবং আল্লাহ্্ অনেক অনুকম্পার অধিকারী। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে খুলে দিলেন। ‘তায়াররুফের’ লেখক এ কাহিনীটিকে চৈতন্যহীন ব্যক্তির জন্য শরিয়ত লংঘনের দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু লাবাবা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাথে বেয়াদবি করেছেন এটা অপরাধ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে ক্ষমা না চেয়ে নিজেকে মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে দ্বিতীয়বার অপরাধ করেছেন। তা সত্ত্বেও ভিতর নির্দোষ ছিল বিধায় তা তওবা হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, পাপের ভয়ে, কৃত পাপ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে গিয়ে পবিত্র বক্ষ উন্মোচনের চাবিস্বরূপ হয়েছে। গুনাহ্র সুবাদেই উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছে। ‘নোসখা-এ-জাদুত্তাকোয়াতে’ তাই লেখা হয়েছে। এ বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকলে তাতে দেখতে পারেন। এখন যে উপলক্ষে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ে চিন্তা করলে এ আয়াতে যে পথের প্রতি ঈশারা করা হয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাতে কোনো প্রকার দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব থাকবে না। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রঃ) এ ভ্রমণতরীতে আরোহণ করার দরুনই জাহেরপন্থীদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করেছেন। যদিও তিনি বাহ্যিক রূপকে অনেক গুরুত্ব দিতেন, তথাপি মাকতুবাতে তিনি লিখেছেনÑ “পিরেতাস্ত আউয়াল মাবুদ তাস্ত।” (তোমার পীর তোমার প্রথম মাবুদ)। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আয় দারিগোকি শরিয়াত মিল্লাত আমাই হাস্ত, মিল্লাত মা মিল্লাতে কাফিরু হাম তারসায়ী হাস্ত।’ (অন্ধ মাজহাব এই শরিয়ত হয়, তরসাই মাজহাব মম কাফেরী নিশ্চয়)। বস্তুতপক্ষে আল্লাহ্্ বান্দাদের যে সব পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন, মানুষ যদি ইচ্ছা করে সে কাজ করার পর ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহলে আল্লাহ্্ তাকে ক্ষমা করেন; বরং মনের নিষ্ঠা সাপেক্ষে বান্দাকে আরও অধিক পুণ্য দিয়ে থাকেন। এখানে চিন্তার বিষয় এই যে, কোনো ব্যক্তি অচেতন অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপরাধ বা গুনাহ্ করলে তার গুনাহ্ অনুকম্পার অন্তর্ভুক্ত হবে না কেন? যেমন হাড়িতে পাকের জিনিস আগুনের তাপে তরপাতে থাকে এবং ছুটাছুটি করে এতে তো কোনো ক্ষতি নেই; বরং বাবুর্চির এতে চরম উপকার হয় এবং কার্য সিদ্ধ হয়। আগুন তাতে চাউল ডাল গোস্ত এবং মশলাসমূহ মিশিয়ে একাকার করে দেয়। সে উত্তাপে পানি কাঁপতে থাকে, চাউল ডাল তরপাতে থাকে আর মশল্লা ও গোস্ত গলতে থাকে। অনুরূপ অজ্দ্-এ আনন্দ এবং প্রেমাত্মক হাঙ্গামা ছাড়া আর কী আছে? জাহান্নামের আগুনের চেয়ে উত্তপ্ত এ প্রেম আগুনে জ্বলন্ত অবস্থায় তাঁর কোনো স্বাদ অবশিষ্ট থাকতে পারে যে জন্য তাঁর দ্বারা আবার জাহান্নামের কাজ হতে পারে? আল্লাহ্্ই তো তাদের বলেছেন, اعملوا ما شئتم (আ’মালু মা-শি’তুম) অর্থাৎ, যা ইচ্ছা কর।

ধর্মের শাখা-প্রশাখা

সৎকর্মের আদেশ এবং অন্যায় থেকে বারণ করা সংক্রান্ত ইসলামের বিধি-বিধানসমূহকে ধর্মের শাখা-প্রশাখা বলা হয়। মৌলিক শ্রেষ্ঠত্ব বর্জিত কোনো নির্দেশ পালনীয় নয়। অর্থাৎ, যে নির্দেশের সাথে প্রেমের প্রহর্ষ নেই, যে নির্দেশ আধ্যাত্ম চিন্তা থেকে মুক্ত, তা নির্দেশ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়; বরং ধর্ম ও ধর্মের মূলনীতি পরম উন্নতির সহায়ক যা প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বিধি-বিধান এবং এর চৌহদ্দী পূর্ণাঙ্গ শরিয়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা নিরেট আহ্ওয়াল তথা প্রেম-প্রহর্ষিত অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়Ñ এরই এক অবস্থার নাম ঈমান। অর্থাৎ, ঈমানের ফলশ্রুতি মূলবস্তুর উৎস হলো আহ্ওয়াল তথা পবিত্র প্রেম-প্রহর্ষিত অবস্থা। ঈমান হল প্রহর্ষিত অবস্থার একেবারে প্রাথমিক স্তর। ঈমান থাকলেও কেবল হাল তথা পবিত্র প্রেম-প্রহর্ষিত অবস্থায় উৎস বস্তু অবতরণ করে। তা মূল বক্ষ থেকে ঈমানের স্থান হয়ে সেখান থেকে পবিত্র প্রেম-প্রহর্ষের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশ করতে থাকে। উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্তর্নিহিত শক্তির কাছে ঈমান পরাজিত হলেও প্রেম-প্রহর্ষিত অবস্থার বিচারে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর বাইরে নয়। তবে বিজিত। কারণ ঈমানের ফলাফল প্রেম ও মহব্বত পবিত্র প্রেম-প্রহর্ষ থেকে আসে। তা পরাজিত হলেও আপন সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কারণ তারও তো উৎপত্তি প্রেম-প্রহর্ষ থেকে। অর্থাৎ, প্রেম ও মহব্বত ঈমানের মূল এবং পরিণতি। কারণ শাখা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। মূল থেকেই শাখা-প্রশাখা বের হয়।
যেমন বীজ থেকে গাছ জন্মায় এবং জমি থেকে উদ্গত হয় সমস্ত ভূতলীয় বস্তু। বস্তুত এ জমি বীজেরও বীজ। তা থেকে হাজারও প্রকার বস্তু উদ্গত হয়ে পৃথিবীকে সুশোভিত করে দিচ্ছে। অথচ এগুলো এককভাবে পরস্পর বিরোধী কিন্তু মূলত এগুলো পরস্পর বিরোধী নয়; বরং এটা পূর্ণতার প্রকাশ। বস্তুত এটা মৌলিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ যা বাহ্যত পরস্পরবিরোধী হলেও এর অভ্যন্তরে রয়েছে নানাবিধ রহস্য ও গোপন তত্ত্ব। যেমন ভালো-মন্দ, মিঠা-তিতা, কোনো গাছই বীজ নিরপেক্ষ নয়, তেমনই ধর্মের কোনো শাখা-প্রশাখা বা ধর্ম প্রকৃত ঈমান থেকে মুক্ত নয়, এ ব্যাপারে মাওলানা রুমির ব্যাখ্যাটি পেয়ালায় সাগর ঢুকানোর মতো। তা হল “মারহাবা শুদ্ জুম্লাগি আমিখ্তা, কুজ্হাদর এক্ লগন্ দররিখ্তা ॥ জায়াকে খোদ্ মান্দুদাহ্ জুজ এক্ বেশ্ নিস্থ্, কেশে হাইয়ে জিনে রুইয়ে এক কেশ্ নিস্ত্ ॥”মোট কথা, সকল ধর্মই মূলত এক। কারণ এক আল্লাহ্্ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রভু নেই, তখন তাঁর বাহ্যিক প্রকাশেও অন্য কারও অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তাও এক এবং অভিন্ন। রকমারি বৈশিষ্ট্যে সকল সৃষ্টি এক, তবে প্রত্যেকেই যার যার অনুকূল বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে এবং আহরণ করে আহার ও শক্তি। তবে বস্তুর স্বীয় বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে যা একজনের জন্য খাদ্য তা অন্যের জন্য বিষ। কিন্তু মূল উৎসে এ সবই এক এবং অভিন্ন। লক্ষণীয় যে, সমস্ত বস্তুই মাটি থেকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মলাভ করে কিছুদিন পর আবার তা মাটিতে মিশে যায়। এভাবে এরা আপন স্রষ্টার কাছে ফিরে যায়। আল্লাহ্্ বলেন, كل شئي اليه ترجعون (কুল্লু শাইইন ইলাইহি তুরজাউন) অর্থাৎ, সকল বস্তু আল্লাহ্্র দিকে ফিরে যাচ্ছে। সৃষ্টি পর্যায়ে যে বস্তু যে বৈশিষ্ট্যে বর্তমান ছিল প্রত্যেক বস্তু সে রূপ চরিত্রে পরিণতিপ্রাপ্ত হবে। তবে সে যাই হোক, সর্বাবস্থায়ই এরা আপন আদি উৎসের পরিচায়ক। দোয়াতের কালি থেকে যেভাবে অক্ষর সৃষ্টি হয় ঠিক সেরূপ প্রেম থেকে সৃষ্ট সমস্ত বস্তু উৎস ও লক্ষ্যের বিচারে প্রেমাস্পদেরই নির্যাস।
লক্ষ্যণীয়, আহ্মদ (সাঃ)-এর প্রেম তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য আহাদ তথা পরম সত্তা পর্যন্ত পৌঁছে এবং তাঁর ইশ্ক ওয়াহেদী তথা একক প্রেম বা মুহাম্মদীর গোপন রহস্য তা দ্বারা হযরত গাউসে পাক ঐশ্বরিক মর্যাদা লাভ করেন। বড় বড় গাউস কুতুব এবং অলী আবদালদের, আহম্মদী প্রেম চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। দেখ, মুহাম্মদী প্রেম হযরত ওয়েস করণী (রঃ)-কে রহস্যালোকে পৌঁছে দেয়। অথচ তিনি চোখের দেখা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। যদিও তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বাহ্যিক চক্ষে দেখেননি কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি এতদূর প্রসারিত হয়েছিল যে, বাহ্যিক দৃষ্টি যার ধারে কাছেও পৌঁছার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং যখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ইহধাম ত্যাগের সময় উপস্থিত, তিনি হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, আমার এ জুব্বা আমার বন্ধু ওয়েস করণীকে প্রদান করবে। একথা শুনে তারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন যে তিনি কে? হযরত বললেন, তিনি ‘করণ’ এর অধিবাসী। প্রকাশ্যে তাঁর সাথে আমার মোলাকাত হয়নি।
কাহিনীটি এরূপÑ হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁরা দুজন উক্ত ব্যক্তির অšে¦ষণে ‘করণে’ আসেন এবং লোকের কাছে তাঁর সম্পর্কে জানতে চান। তখন এলাকা’বাসী তাঁদের বলেছিল যে, এ নামের একজন জংলী লোক আছে, সে সব সময় মানুষ থেকে দূরে থাকে। অবশেষে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁরা তাঁকে উক্ত জুব্বা মোবারক হস্তান্তর করেন এবং তাঁরা তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সালাম জানিয়ে বলেন যে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তিনি আপনার জন্য এ উপহার পাঠিয়েছেন। তিনি এ কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা দুজন তাঁর সাথে আন্তরিকভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করেন এবং তিনি শান্ত হন। কথাবার্তা শেষ করে হযরত ওয়েস করনী (রঃ) তাদের বললেন, আপনারা একটু দূরে অপেক্ষা করুন, আমি হুজুরের উম্মতের জন্য দোয়া করব। তারা দুজন হযরত ওয়েস করনী (রঃ) থেকে আলাদা হলেন। তখন হযরত করণী (রঃ) দোয়ায় লিপ্ত হলেন। আল্লাহ্্র কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ্্! মৃত উম্মতদের একেবারে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ্্ কয়েক হাজার লোককে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি আবার দোয়ায় লিপ্ত হলেন, এবারও কয়েক হাজার লোককে ক্ষমা করা হল। তিনি আবার দোয়ায় লিপ্ত হলেন এবং যথেষ্ট পুনরুক্তি করতে লাগলেন। তখন আওয়াজ এল নজদে যত ছাগল আছে তাদের পশম পরিমাণ সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেওয়া হল। আবারও তিনি দোয়ায় লিপ্ত হলেন। ইতোমধ্যে হযরত আলী (রাঃ) তাঁর সাথে কথা আরম্ভ করেন। ফলে তাঁর গোপন কথাবার্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তখন অতি আক্ষেপের সাথে তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেন, আপনি যদি আমাদের গোপন কথাবার্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করতেন, তাহলে সকল মৃত উম্মতদের আজ ক্ষমা হয়ে যেত। এতে তাঁরা উভয়ই লজ্জিত হন এবং বিনয়ের সাথে বলেন, ক্ষমা করুন। বিস্তারিত কাহিনী হযরত বাবা শেখ ফরিদ (রঃ)-এর ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’তে দেখুন।
এখানে গভীরভাবে চিন্তা করলে একটি সূক্ষ্ম বিষয় ধরা পড়ে। তা হল এই যে, হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) দুজনই বিশিষ্ট সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও হযরত ওয়েস করণী (রঃ)-এর সাথে অত্যন্ত বিনীত এবং ভদ্রভাবে কথাবার্তা বলেছেন এবং গোপন দোয়ার সময়ে হযরত আলী কর্তৃক একটু বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়াতে হযরত করণী (রঃ) দুঃখিত হন, যে জন্য হযরত আলী (রাঃ)-কে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল হযরত করণী (রঃ) কিভাবে এই উচ্চ মর্যাদা লাভ করলেন? এটা কি চর্মচোখে দেখার সাথে সম্পর্কিত না অন্তর্দৃষ্টি তথা নূরী দর্শন এবং প্রেম-প্রহর্ষ অবস্থায় সাক্ষাতের ফল? বরং এ মর্যাদা তাঁর প্রেমের ফল। এটা ঈমানি দৃষ্টি এবং প্রেমের ফল না হলে যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে দেখেননি, কী কারণে তাঁর এ মর্যাদা লাভ হবে? আবু জেহেল এবং অন্যান্য কাফিরগণ তো তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছেন। এ জন্য কি তারা কোনো মর্যাদা পেয়েছেন? প্রেম এমন একটি পরশ পাথর যার স্পর্শে লোহা, তামা খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। আসল প্রেমের মধ্যে তো শরিয়ত ও বিধি-বিধান বিলুপ্তই হয়ে যায় এবং পরিত্যক্ত হয় মাশুক ছাড়া অন্য সবকিছুর তোয়াক্কা। এ অবস্থায় সূফীদের জন্য ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নত অথবা মুবাহ্ এর মোকাবিলায় আদেশ নিষেধ অবতীর্ণ হয়। জাহেরপন্থীগণ এটা জানে না তাই তারা এর বিরোধী। ফেকাহ্্বিদও, যেমনÑ ‘দুররুল মোখতার’ এবং ‘শামী’ প্রভৃতি এ রেয়াত তথা অব্যাহতি সম্পর্কে যত্নবান। কিন্তু সূফীগণও তো সর্বশেষ সীমা রক্ষা করার বিরোধী নন; বরং তাঁরা এর প্রকৃত সমর্থক। এ ব্যাপারে প্রমাণ নি®প্রয়োজন। ন্যায়ত বলতে হয়, জাগতিক প্রেমের লক্ষ্য স্বার্থ। এ বিষয়ে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। অপরদিকে লক্ষ করুন, কখনো যদি মজনুর সামনে লাইলি এসে বলেছে যে, আমি লাইলি। মজনু বলেছে, তুমি কোন লাইলি? উত্তর দিয়েছে, আমি তোমার প্রেমিকা। মজনু বলেছে, সে লাইলী দিয়ে আমার কাজ নেই, আমি যে লাইলির সাথে মিলিত হয়েছি, সে আমার থেকে আলাদা নয়।

শরিয়তের ব্যাখ্যা
শরিয়তপন্থীদের উচিত প্রথমে শরিয়তের সংজ্ঞা এবং উহার বিভাগ সম্পর্কে অবগত হওয়া। শরিয়তের বিভাগ সম্পর্কে জানতে পারলে ধর্ম এবং ঈমানের প্রেক্ষিতে ইসলাম, ঈমান এবং ইরফানের সৌন্দর্যসমূহ সুস্পষ্ট হয়ে যাবে আর জানা যাবে কোন বিদ্যার বৈশিষ্ট্য কী? এ জন্য তাদের শরিয়তের সংজ্ঞা ও বিভাগ সম্পর্কে জানা ফরয।
শরিয়ত তিন প্রকার : ১। শরা তাআব্বুদি, ২। শরা তাআ’সুকী এবং ৩। শরা তার্আরুফি। শরা তাআব্বুদি, সর্বসাধারণের শরিয়ত। শরা তাআ’সুকী, আশিক তথা প্রেমিকদের শরিয়ত এবং শরা তার্আরুফি, আরেফদের শরিয়ত। সর্বসাধারণের শরিয়ত সদা তর্ক-বিতর্ক মতানৈক্য এবং ঝগড়া-বিবাদে জর্জরিত। এ কারণে জাহেরপন্থীরা পরস্পরবিরোধী এবং সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়। এটা কোনো মানুষের কাছেই অজানা নয়। অথচ এরা বাতেনী শরিয়ত তথা আশেক এবং আরেফদের শরিয়তের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারে না; বরং সে গোপন তথা রহস্যময় পথ সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও জানার সৌভাগ্য জাহেরপন্থীদের নেই। কেননা জাহেরপন্থীদের কোনো প্রকার কামালত বা পূর্ণতা ভাগ্যে জোটে না; বরং বক্তৃতা এবং শোনার মধ্যেই তাদের ধর্ম সীমাবদ্ধ। অপর দিকে, ইশ্ক বা প্রেমবিদ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত শরিয়তের সমাপ্তি হল হাল তথা পবিত্র প্রেম-প্রহর্ষ অবস্থা। প্রহর্ষ জজ্বা, চৈতন্যহীনতা প্রভৃতি পথে তা অর্জিত হয়। কাশ্ফ, এল্হাম এবং মোশাহেদ প্রভৃতি এর ফলশ্রুতি। এ পথেই অর্জিত হয় প্রকৃত ঈমান ও একিন; বরং এর চূড়ান্ত পর্যায়ে একিনের পরিসমাপ্তির অনুমোদন আল্লাহ্্র বাণী দ্বারা প্রমাণিত। বলা হচ্ছেÑ واعبد ربك حتى يا تيك اليقين (ওয়া’বুদু রাব্বুকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াক্বীন) অর্থাৎ, ইবাদত কর তোমার প্রভুর একিন অর্জিত হওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ, এ স্তর ধ্যান ধারণার ঊর্ধ্বে। এটা পূর্ণাঙ্গ একিন। সুতরাং হযরত গাউস পাক বলেন, من ار ادا لعبادة بعد الوصول فقد اشرك با الله (মান আরাদাল ইবাদাতা বাআদাল ওয়াসূলে ফাক্বাদ আশরাকা বিল্লাহি) অর্থাৎ, মিলনের পর ইবাদত নিঃসন্দেহে র্শিক। হাসানাতুল আরেফিনেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে। হযরত দারাশিকোও উক্ত আয়াতের অনুরূপ অর্থ করেছেন। এরপর র্ইফান তথা মারেফাতের বিষয়সমূহ যা ইল্মে মারেফাতের জন্য আবশ্যক তা প্রকাশিত হয়। এটা ইবাদতের ঊর্ধ্বের স্তর। এ স্তরে ইবাদত করা অবৈধ। এ কারণে মারেফাত এবং ইশ্ক্-এর স্তর সাধারণ ঈমান স্তরের ঊর্ধ্বে এবং উন্নত। জিবরাঈলের একটি হাদীস দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয়। মেশকাতে ঈমানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে উক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। তা হল ঈমান, ইসলাম এবং ইহ্সান। ঈমানের এ সংজ্ঞার ব্যাপারে সূফীগণ মন্তব্য করেছেন যে, এখানে ইসলাম দ্বারা সাধারণের শরিয়ত। ঈমান দ্বারা আশেকদের শরিয়ত এবং এহ্সান দ্বারা সাধারণভাবে প্রেম অর্জন তথা আহ্ওয়াল বা প্রেম প্রহর্ষিত অবস্থা ও ইরফান তথা ঐশী জ্ঞান প্রাপ্তি বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এখানে পরিপূর্ণ হাল্ তথা প্রেম-প্রহর্ষিত অবস্থা দ্বারা ঐশী জ্ঞান লাভের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রেম ও ঐশী জ্ঞানের কাছে সাধারণের ইসলাম ও তার আনুমানিক গুরুত্ব সম্পূর্ণ মূল্যহীন। যেমনÑ কালেমা তাওহীদ, কল্পিত ইসলাম এবং এর কাল্পনিক কাঠামোকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” এর না সূচক “লা” আল্লাহ্্ ছাড়া সব কিছুকেই অস্বীকার করে। অর্থাৎ, বাহ্যিক বিধিবিধান সাধারণভাবে ইবাদতসহ সব কিছুই লা অস্বীকার করে।
সুতরাং এ কালেমা প্রেমের বাণী বলে গণ্য। এ কালেমার অস্বীকৃতিমূলক বক্তব্য দ্বারা প্রমাণ হয় যে, সাধারণের শরিয়তকে অস্বীকার করাও বৈধ। এ কারণে প্রেম অস্বীকৃতির স্তরে উপনীত হয়ে প্রেমিকও এর পথিকদের পরম সত্তার প্রতিষ্ঠার সফরে রূপক বিধিনিষেধের অনুসারী না করে মৌলিক বিশুদ্ধায়নের দিকে নিয়ে যায়, যেন জাহেরপন্থিদেরকে বাতিল করা হচ্ছে। এ কারণে বাহ্যিক শরিয়তের অনুসারীগণ আল্লাহ্্র অলীদের কাফির মনে করে। বস্তুত স্বয়ং কালেমার মধ্যেই এ কুফরির শিক্ষা নিহিত রয়েছে। স্বয়ং কালেমাই তো ফরয, ওয়াজিব, হালাল-হারাম সংক্রান্ত সমস্ত বিধিবিধানসহ আল্লাহ্্ ছাড়া সব কিছুকেই অস্বীকার করে। তা না হলে জাত এবং হাক্বিকত তথা মৌল সত্তা কিভাবে প্রমাণিত হয় এবং লাভ হবে তার সম্পর্কে পরিপক্ব যথার্থ জ্ঞান। অতএব অনুরূপ অস্বীকৃতি প্রকৃতপক্ষেই যথার্থ ইসলাম।
এজন্য কাফিরকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেÑ প্রথমত, কুফরে তায়াব্বুদী, দ্বিতীয়ত, কুফরে তায়াসূকি এবং তৃতীয়ত কুফরে ইরফানী। কুফরে তায়াব্বুদির ক্ষেত্রে যে কুফরি করে, সে ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধী। কারণ এ স্তরে ধর্ম এবং তাদের জ্ঞান ইবাদতের মধ্যেই সীমিত। এর বাইরে তাদের কোনো জ্ঞানই নেই। দ্বিতীয়ত, কুফরে তায়াসূকীর অর্জিত জ্ঞানরাজ্যে প্রেম এবং পরম সত্তার নৈকট্য ব্যতীত অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে সব কিছুকেই অস্বীকার করে আপন সত্তার পরিপূর্ণতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞানের কাছে এটা কুফরি বলেই মনে হয়। কিন্তু আহ্লে হক্ব তথা সত্যের সাধকদের জন্য অনুরূপ কুফরি বাধ্যতামূলক, অন্যথায় দ্বিত্বতা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। এ ধরনের কুফরি করা আল্লাহ্্ওয়ালাদের জন্য বড় ধরনের ফরয কাজ। এর অন্যথা করা তাদের জন্য র্শিক। কারণ পরম সত্যের পাশাপাশি অন্য কিছুকে অস্বীকার করা মারাত্মক র্শিক। জাহেরপন্থিরা এটা জানে না আর শিখালেও বোঝে না। আগুনের বিকাশ তথা সারা পৃথিবীর আগুন একই আগুন এটা যারা জানে না, তারা উক্ত বিষয় কী করে জানবে? তারা জানে না রহস্য জগৎটা কোন বৃক্ষের ফল। তাই তারা একটা মজার কথা বলে। অর্থাৎ, যে বিষয়ে তাদের কিছু বলার থাকে না, তখন তারা বলে যে, এর মধ্যে রহস্য আছে।
যে যাই হোক চূড়ান্ত বিশ্লেষণে প্রমাণিত হল যে, এক প্রকার কুফর আছে যা দোযখের কাজ আর বাকি দু প্রকার কুফর হল ভালো ও পুণ্যের কাজ। পরবর্তী দু প্রকার কুফরের মাধ্যমে পরম সত্তা ও পূর্ণতা নিজের মধ্যে স্থিতিলাভ করে। এটাই ইত্তেহাদ বা একীভূত হওয়া। এখানে আল্লাহ্্ এবং বান্দার মধ্যকার ভিন্নতার অবসান ঘটিয়ে স্বতন্ত্র আল্লাহ্্র সত্তাকে অস্বীকার তথা কুফরির মাধ্যমে আপন সত্তায় আল্লাহ্্কে অধিষ্ঠিত করা হয়। জগতের সকল অলী এবং নবীগণ এ উভয় প্রেক্ষিতে আপন আপন পূর্ণতা প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে কোনো অলী-আল্লাহ্্রই ভিন্নতা নেই। উল্লেখ্য, দারাশিকো (রঃ) তাঁর ‘হাসানাতুল আরেফিন’ কিতাবে উচ্চস্তরের আউলিয়া, প্রধান সাহাবা এবং নবীদের সম্পর্কে এমন কতশত কথা লিখেছেন, জাহেরপন্থিরা যাকে কাফির এবং কুফর বলে থাকেন; বরং এমন কোনো অলী নেই যার এ ধরনের কুফরি বলার প্রমাণ নেই। লক্ষণীয়, হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মাকতুবাত কিতাবে বলেছেন,
আইয়ে দরইগা কে শরিয়াত মিল্লাতে আমাই হাস্ত
মিল্লাতে মা মিল্লাতে কাফিরওয়া হাম্ তরসায়ী হাস্ত॥
কুফ্রে ঈমান জুল্ফ্ ওয়ারুয়ে আঁ পরী জিবাইয়ী হাস্ত॥
কুফ্র ও ঈমান হার দু আন্দর রাহে মা ইয়াক্তায়ী হাস্ত॥
হযরত বু আলী কলন্দর (রঃ) বলেন, “চে মূসা চে ঈসা চে পীর মুরসালান আহমদ। চে তরচা ও চে মগা ইঁজা হামা গাশতাহ বরাবর বিন্” (অর্থাৎ এখানে মূসা ঈসা পীর পয়গাম্বর এবং আহমদ ও মগ ইত্যাদি কোনো ভেদাভেদ নেই, সব মিলে একাকার)। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন,رأيت شيئا الا رأيت الله (রাআইতু শাইআন ইল্লা রাআইতুল্লা) অর্থাৎ, আমি আল্লাহ্্ ছাড়া কোনো বস্তুই দেখি নি। হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বলেন,مارأيت شيئا الا رأيت الله (মা-রাআইতু শাইআন ইল্লাহ রাআই তুল্লাহ) অর্থাৎ, আমি সকল বস্তুতে আল্লাহ্্কেই দেখেছি। অন্যত্র তিনি বলেছেন যে, কোরানে কোনো শক্রর উল্লেখ নেই এবং বলা হয়নি কিছু কাফিরদের লক্ষ করে। এখানে কাফির দ্বারা আসল কাফির তথা আরেফদের কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্নে আরাবী স্বীয় তফসীর গ্রন্থে বলেছেন, ان الذين كفرواسواء عليهم (ইন্নালাযীনা কাফারু ছাওয়াউন আলাইহিম…)

মোট কথা আল্লাহ্্ ও বান্দার একাত্ম হওয়া একটি বড় রহস্য। আল্লাহ্্ এবং বান্দার মধ্যে ভিন্নতা চলে গেলে জ্যোতির প্রকাশ অনুভূত হওয়া বান্দার মর্যাদা এবং মৌলিক বৈশিষ্ট্য হয়ে যায়। যেভাবে বিশ্বব্যাপী আগুনের প্রকাশ বর্তমান, সেভাবেই আল্লাহ্্র মধ্যে বান্দা এবং বান্দার মধ্যে আল্লাহ্্র প্রকাশ বর্তমান। বরং তার চেয়েও হাজারগুণ সুস্পষ্টরূপে প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আল্লাহ্্র প্রকাশ বর্তমান ও জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত। এ প্রকাশের প্রেক্ষিতে বান্দাও সর্ব রকমে অদৃশ্য ও দৃশ্যমান। যারা জানেন তাদের কাছে এটা গোপন নয়। এক আল্লাহ্্র সাধক-মুর্শিদের ফায়েজ  সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখে তারও এ কথা অজানা নয় যে, মুর্শিদের কাছ থেকে ফায়েজ  লাভ করার ক্ষেত্রে নিকট ও দূরের কোনো পার্থক্য নেই। যখনই আপন মুর্শিদকে স্মরণ করবে তখনই অদৃশ্য থেকে এক আশ্চর্য বস্তু প্রত্যক্ষ করবে অথবা কোনো আকর্ষণ অথবা নৈকট্যজনক অবস্থা পরিলক্ষিত হবে। যাকে দেখাশোনার মাধ্যমে চেনা যাবে অথবা সৃষ্টির প্রকাশের মাধ্যমে জানা যাবে। দিয়াশলাই অথবা আগ্নেয়শিখার মধ্যে আগুনের অস্তিত্বের মতোই বান্দা অনুরূপভাবে সর্বত্র বর্তমান ও দৃশ্যমান। তবে এটা আল্লাহ্্র সুস্পষ্ট প্রকাশ। এ ক্রিয়া কৌশলটা জানা-ই আল্লাহ্্র অলীদের কাজ। কালেমাপন্থিরাও এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, আল্লাহ্্ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক শ্রেণীর জ্ঞানবঞ্চিত অযোগ্য লোক যারা নিজেরা কাফির তারা প্রকৃত মুমিনদেরকে কাফির মনে করছে। এরা সদা কাফির এবং সদা মুশরিক। আল্লাহ্্র সত্তার মতো “রূহ্”-ও পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপ্ত ও প্রকাশিত। যে প্রজাতি থেকে কোনো কিছু জন্মায় এমন কোনো প্রজাতি রূহের মূল সত্তা থেকে মুক্ত নয়। এটাকেই পিতৃত্ব তথা পিতা-মাতার সূত্রে স্রষ্টা, সৃষ্টি, সন্তান এবং জন্ম বলা হয়। বিভিন্ন কারণে জন্ম বা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু মূলত প্রথম স্তরে যিনি স্রষ্টা তিনি হলেন আল্লাহ্্ তা’য়ালা। তিনি পরবর্তী সৃষ্টিরও স্রষ্টা এবং সকল অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত সর্বজ্ঞ এবং সকলের স্রষ্টা। তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী। তাইতো আল্লাহ্্ বলেন,تبارك الله أحسن الخالقين (তাবা-রাকাল্লাহু আহ্সানুল খালিক্বীনা) অর্থাৎ, স্রষ্টাদের মধ্যে আল্লাহ্্ উৎকৃষ্ট এবং উত্তম। তিনি আপন পূর্ণ শক্তির দ্বারা বিভিন্ন বস্তু থেকে সৃষ্টি করান। রূহানী জগতের একটা মহৎগুণ ও বৈশিষ্ট্য হল এই যে, সকল জীব ও সৃষ্টি জগৎ থেকে গোটা বিশ্ব চরাচরে প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষ করে ফেরেশতাদের একটি সৃৃষ্টি পর্যায় আলোকিত হওয়ার পর এক সূক্ষ্ম সত্তা থেকে সমস্ত দৈহিক বস্তু আত্মপ্রকাশ করে। যেমন বৃষ্টির দ্বারা ভূমি সঞ্জীবিত হয়। প্রত্যেক বস্তুর পরিপূর্ণতা এবং চূড়ান্তপ্রাপ্তি থাকা বাঞ্চনীয়। যেমনÑ মুরগির ডিমে বাচ্চা পাওয়া যায় এবং বৃক্ষে পাওয়া যায় ফল এবং গোটা। আর গোটা থেকে পাওয়া যায় অন্যান্য বৃক্ষরাজি। অনুরূপভাবে ইবাদতের পরম প্রাপ্তি হল প্রেম, আর প্রেমের প্রাপ্তি হল ইরফান তথা সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন জ্ঞান। যেমন পরিষ্কার দেখা যায়Ñ ডিমের ভেতর বাচ্চা এবং নিশ্চিত জানা যায় গোটা বা বীজের ভিতর বৃক্ষ। তেমনি নিশ্চিত যে, নবী-অলীগণ সত্য, বেহেশতি এবং পুণ্যবান। তাঁদের দ্বারা যে পুণ্য সৃষ্টি হয়, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। যেমনি সন্দেহ নেই যে, পানির দ্বারা পিপাসা দমন হয় এবং অর্জন করে সকল বস্তু পরিচ্ছন্নতা। সাবান কাপড় পরিষ্কার করে তা পানি ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং এমন কোনো বস্তু আছে যে, যা দ্বারা উহা অপবিত্র হবে। যখন সাগরের পানি এবং সাবান দ্বারা সব বস্ত্র পরিষ্কার করা হয়, এমতাবস্থায় সাগরের পানিকে কী দ্বারা ধৌত করবে? সাবানের যদি পরিষ্কার করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে তা কিভাবে অন্যকে পরিষ্কার করবে? 

মধ্যবর্তী নামাজের বিবরণ

আল্লাহ্্র বাণীÑ حافظوأ علي الصلوة والصلوة الوسطئ (হাফিজু আলাছ্ সালাতি ওয়াছ সালাতিল উস্তা) অর্থাৎ, যত্নবান হও সব নামাজ এবং মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। এখানে দু প্রকার নামাজ উদ্দেশ। প্রথম নামাজ দ্বারা পাঁচ বেলার নির্ধারিত ও অনির্ধারিত নামাজ বোঝানো হয়েছে। সালাত শব্দে সাধারণভাবে নির্ধারিত ও অনির্ধারিত সময়ে নামাজ বোঝায়। কারণ হাফিজু আদেশমূলক ক্রিয়া, এটা দৃঢ়তা প্রমাণ করে আর দৃঢ়তা অগ্রাধিকার পায়। অন্যান্য নিয়ম নীতিও এর বিরোধী নয়।

মোট কথা, উক্ত বাণী ওয়াক্তিয়া নামাজের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং উক্ত আয়াত দ্বারা নামাজের অর্থের চেয়ে অধিক অর্থপূর্ণ নামাজ প্রমাণিত হয়। কারণ নামাজের অর্র্থ এবং উদ্দেশ শুধু ইবাদত নয়; বরং তার উদ্দেশ ইবাদত, দোয়া, প্রেমের প্রকাশ, কল্যাণ, নৈকট্য, সুন্দরায়ন, সুদূর সফর, দরূদ ইত্যাদি। সুতরাং এগুলোর মূল নীতি এবং ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে নামাজ বহুমুখী উদ্দেশ এবং ব্যাপক অর্থবহ হয়। এজন্য নামাজকে “সালাত” সময় নিরপেক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সালাত তথা নামাজ দ্বারা যদি ওয়াক্তিয়া নামাজ ধরাও হয়, তাহলে “সালাতে ওস্তা” আল্লাহ্্ কোনটিকে বলেছেন। ওস্তা অর্থ অভ্যন্তরীণ এবং মধ্যস্থিত নামাজ। এর অর্থ বাতেনী নামাজ যা অন্তরের তথা কল্বের জ্ঞান দ্বারা সম্পন্ন হয়। তাই সালাতে ওস্তা তথা মধ্যবর্তী নামাজ। কারণ এটাই মধ্যবর্তী স্থান। তথায় সালাতের ফায়েজ তথা উপকারিতা প্রকাশিত হয় এবং তাতে নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের প্রতিক্রিয়া প্রতিভাত হয়। এতে করেই সফল হয় নামাজের সমুদয় উদ্দেশাবলি তথা ইবাদত, অনুকম্পা, নৈকট্য, সুন্দরায়ন, মহাসফর ইত্যাদি।
এগুলোই নামাজের মূল এবং মাধুর্য। এসব ছাড়া নামাজের পরিপূর্ণতা আসে না, আর এ নামাজই সকল নামাজের মধ্যমণি এবং সময়সমূহের অন্তর্নিহিত নামাজ এ জন্যই এটাকে সালাতে উস্তা তথা মধ্যস্থিত নামাজ বলা হয়েছে। এ নামাজ অবিরত এবং সর্বক্ষণিক। এর বিরতি নেই। তাইতো নবী করীম (সাঃ) বলেন, صلواة الدوام افضل من صلوة الوقت (ছালাতুদ দাওয়ামি আফজালূ মিনাছ্ছালাতিল্ ওয়াক্তি) অর্থাৎ, সার্বক্ষণিক নামাজ ওয়াক্তিয়া নামাজের চেয়ে উত্তম। এতে বুঝা যায় নামাজ দু প্রকার। আল্লাহ্্ বলেন, নামাজ এবং মধ্যবর্তী তথা মধ্যস্থিত নামাজের প্রতি যত্নবান হও। এখানে দু ধরনের নামাজের কথা বলা হয়েছে এবং এ দ্বিতীয় প্রকার নামাজকে আল্লাহ্্ তাঁর বিশেষ বিশেষ বান্দা তথা আহলে যিকিরদের জন্য ফরয করেছেন। কারণ তাঁরা এর ফলাফল এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জ্ঞাত। বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা তা বুঝে নিবেন। আর অজ্ঞ ব্যক্তি দ্বিধাগ্রস্ত হবে এবং অনুমান করে এটা-ওটা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে, তা হবে বিতর্কমূলক। বিতর্ক হয়ে থাকে অনুমানকে ভিত্তি করে। অথচ অনুমান কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। নামাজ উপাস্যতার জগতে বান্দার জন্য একটি বিশেষ অনুগ্রহ। যে নামাজের এ বৈশিষ্ট্য নেই তা নামাজই নয়। তাতো কেবল আবরণ নিঃস্বতা এবং ফাসাদ। আল্লাহ্্ এ জুলুম থেকে রক্ষা করুন।
কেউ কেউ প্রমাণ দ্বারা সালাতে উস্তা অর্থে আছরের নামাজকে বুঝিয়েছেন। তা হলেও তো আসর একটি সময়ের নাম। একটি শক্তিশালী সময়ের নাম আসর। এরই নাম উস্তা। এটি একটি বিশেষ সময় যা দুটি সময়-সীমান্তে বিদ্যমান, সাগরের মধ্যভাগের গভীরতা এবং কোষাগারের সম্পদের মতো এটাই মধ্যস্থান। সর্বাবস্থায় এরইতো হেফাজত এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। বস্তুত এ একটি অন্যতম গোপন বস্তু। যার স্থান একমাত্র অন্তরে। তাই মধ্যবর্তী স্থান এবং অবস্থা যা সমাগত হয় বক্ষে, যার উৎস মাথার মধ্যস্থিত তালুতে। এরই সাহায্যে সকল গোপন বিষয়াদি চূড়ান্ত হয়। গোপন বিষয়সমূহ যারা জানেন তাদের নয়; বরং এ বিষয়ে যারা অজ্ঞ কেবল তাদের কাছেই গোপনীয় বিষয় গোপন থাকে। সচেতন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন অথবা আল্লাহ্্র বিশেষ বান্দা, কারও কাছেই কোনো কিছু গোপন থাকে না। কারণ যার দ্বারা গোপন প্রকাশিত হয় এবং যার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয় স্বয়ং গোপন এ দুয়ের মূল এবং বিষয়বস্তু। এভাবে যে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যে আবার স্বয়ং গুপ্ত ভান্ডারে পরিণত হয়ে যায়। যিনি হৃদয় সিংহাসনে উপবিষ্ট তিনিই আমাদের সকল রহস্যের উৎস। তিনি বলেছেন, كنت كنزا مخفيا (কুন্তু কান্জান্ মাখফিইয়ান) অর্থাৎ, আমিই গুপ্তধন। এটা সূর্যের উদয়-অস্তের সাথে তুলনীয়। কখনো উজ্জ্বল হয়ে উদিত হয় আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। যা প্রকাশ হয়ে গেছে তা আর গোপন রইল না। তা যেন চর্বিত বস্তু। গোপন জ্ঞানীদের কাছে যদি তা কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়, তা বুঝতে হবে এটা অস্ত যাওয়ার সময়। আর গোপন প্রকাশের সময়টাকে মনে করতে হবে উদয়ের সময়। তবে এটা আকাশে দৃশ্যমান নকল সূর্য নয়। কারণ এ সূর্য তো একই সময় পৃথিবীর সব জায়গায় উদয় হয় না। দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়াও অন্ধকার অঞ্চল আছে। সেখানে সূর্যের প্রভাব পড়ে না। সেখানে আসর অর্থ কী হবে? উহা কি কোরানের হুকুমের আওতার বাইরে? না, না; বরং সেখানে সূর্য দ্বারা সদা উদয়মান সূর্য বুঝাবে। সে সূর্য আকাশে সদা ভাসমান। দিবা-নিশি এর বিচিত্র গুণাবলি বর্ণহীনতায় পূর্ণতা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্্ তা’য়ালা বলেন, سلام هى حتى مطلع الفجر (সালামুন হিয়া হাত্তা মাত্লাইল্ ফাজ্রি) অর্থাৎ, কদরের রাতে ফজর পর্যন্ত অগণিত নিয়ামত বর্ষিত হয়। তাহলে যে সব স্থানে সূর্য উদয় হয় না, তারা কি এ বরকত থেকে বঞ্চিত? না, না; বরং এটা সে ফজর যা রহস্যাকাশে উদিত হয়, যা থেকে কোনো স্থান খালি থাকে না। তবে যে ব্যক্তি এ সূর্যের মুখ দেখে না সে এ সূর্য উদয়ের খবরই রাখে না। সেই, صم بكم عمى فهم لاير جعون (সুম্মুম্ বুকমুন উম্ইউন্ ফাহুম লা ইয়ারযিউন) অর্থাৎ, সে মূক, বধির, অন্ধ এবং অজ্ঞ। কিন্তু এই প্রকাশ্য সূর্য যা আমাদের মাথার উপর ঘুরছে এবং আরব ও তার বাইরের ভূ-মন্ডলের কোনো কোনো অংশে যার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমানÑ গবেষণার ফলে সে বিষয় এখন সুস্পষ্টভাবে জ্ঞাত। এর উৎস ও অভ্যন্তরীণ সব কিছুই সকল রহস্যের আধার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এ সবের উৎস অনুরূপ হাজারও সূর্যের বিলুপ্তির পরও বহাল থাকবে। এর মর্যাদা পরকাল পর্যায়ে প্রকাশিত হবে, যা কখনো অস্তমিত বা বিলুপ্ত হবে না। আস্র দ্বারা যদি অনুরূপ তাৎপর্যময় নামাজ উদ্দেশ হয় তাহলে যথার্থ। তবে এ ধরনের নামাজের যথার্থ অন্তর প্রয়োজন, কেবল হুকুম তামিল করা দ্বারা এ শ্রেণির নামাজ আদায় হয় না। আল্লাহ্্ তা’য়ালা বলেন, انا انزلناه فى ليالة القدر (ইন্না আন্যাল্নাহু ফী লাইলাতিল কাদ্রি) অর্থাৎ, আমি কোরানের সারমর্ম কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। অর্থাৎ কোরানের সারমর্ম তথা উভয় জগতের সমস্ত সৃষ্টির ভিতর বাইরের সমস্ত ধারণা মূলবীজ থেকে প্রমাণিত। এজন্যই বলা হচ্ছে, كل شئى اليه ترجعون (কুল্লু শাইইন ইলাইহি র্তুজাউন) অর্থাৎ, সকল বস্তুই তাতে প্রত্যাবর্তন করবে। এ একটি অতি সূক্ষ্ম বিষয়। সকল মৌল বস্তুতে কোরানের পূর্ণতা ও বৈশিষ্ট্য বিকাশমান এবং ভারসাম্য নির্ধারণ পরিমাপ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। মোটকথা আমি কদরের রাতে কোরানের সারবস্তু অবতীর্ণ করেছি, তা ভূমিতে সংঘটিত হচ্ছে। কারণ যে আকাশ চক্রে রাতের অবস্থান হওয়ার কারণে রাত দিনের পার্থক্য হয় এবং ভূকেন্দ্রে চব্বিশ ঘণ্টায় সমাপ্ত হয়। আর আকাশের গ্রহচক্রে পূর্ণ একমাস অর্থাৎ, কমবেশি ত্রিশ দিনে এক মাস হয়। এভাবে আকাশের আবর্তনের প্রেক্ষিতে পৃথিবীতে দিন ও বছর গণনা করা হয়। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে এ রাত দিন নেই। সেখানে হিসেব ভিন্নরূপ। কারণ আকাশে সময়ের কম বেশি পরিমাপ দ্বারা কার্য সম্পাদন হয় না। তাহলে এটা কোন রাত, যার মধ্যে কদর বা মর্যাদা রয়েছে? এ মর্যাদা কি জগদ্বাসীর জন্য, না আকাশবাসীর জন্য, না ফেরেশতাদের জন্য, না ঐশী জগদ্বাসীর জন্যও প্রযোজ্য? বস্তুত সে মর্যাদা যা উৎস ও উৎপত্তিসূত্রে জাগতিক নিয়মে সুরক্ষিত বীজে বর্তমান। কারণ সকল সৃষ্টির বিভাজন সমন্বয় এবং মর্ম যখন মূলাধার থেকে লাওহে মাহ্ফুজে নির্ধারিত হয়, তখন এ রাতও তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। বস্তুতপক্ষে কোরান সে রাতের প্রান্ত যা কালের মগজ ও ভান্ডার তাতে আপন সৌরভ ও ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেয়। কারণ সে মহান কদরের রাত স্বীয় উৎস থেকে আপন কার্যকারিতা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু হিসেবের আবর্তের দরুন কেউ এক বছরে, কেউ প্রত্যেক বছরে, আর কেউ লক্ষ বছরে একবার কদর লাভ করে। তার বছর তার আবর্তনেই সমাপ্ত হবে। আর সেখানের হিসেব সেখানেই শেষ হবে। তাই আল্লাহ্্ বলেন, وما ادرك ما ليلة القدر (ওয়ামা আদরাকা মা লাইলাতুল কাদরি) অর্থাৎ, ক্বদর কি তা জান? উল্লেখ্য, কদরের রাত তাঁর কদরে রহস্য সাগরের এক বিন্দু মাত্র। তাইতো আল্লাহ্্ বলেন, ليلة قدر خيرم من ألف شهر (লাইলাতুল ক্বাদরি খাইরুম মিন আলফিশাহ্রি।) অর্থাৎ, কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কে জানে এসব কী রকম হাজার মাস, যে হাজার মাসের চেয়ে এক রাত উত্তম। তাহলে একমাস কত মাসের চেয়ে উত্তম হবে? তাই আল্লাহ্্ বলেন, تنزل الملائكة والروح فيها بإذن ربهم من كل أمر (তানায্যালুল মালাÑইকাতু ওয়াররুহ্ ফীহা বিÑইয্নি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমরিন) অর্থাৎ, এরা অসীম রহ্মতের সাগর থেকে মাছের মতো চলমান পানিতে চতুর্দিকে ছুটাছুটি করে। যেমনি বর্ষার অন্ধকারে জলস্রোতের উজানে স্রোতকে পিছনে ফেলে মাছ বেরিয়ে আসে উন্মুক্ত স্থানে। তখন তারা নিজেকে ভুলে যায়। এ এক অপূর্ব স্বাদ। এ স্বাদের কারণেই গোটা সৃষ্টি জগৎ, নাস্তি-জগৎ থেকে হাস্তি-জগতে এসেছে। এ স্বাদ ঐশী প্রেমকে এমনভাবে তরঙ্গায়িত করে যা বর্ণনাতীত। এ স্বাদ মধুর সাগরের গভীরে ডুুবাতে থাকে যার প্রাতঃরশ্মির প্রভাবে উভয় জগৎ স্বাদে সৌরভে উদ্ভাসিত হয়। এ কল্যাণ রাশির বদৌলতে অসংখ্য ও নিকটতম ফেরেশতা উদ্ভিদের চারা এবং গাছের পাতার মতো প্রকাশিত হয়ে সারা জগৎ ভরে দেয়। এটা কত না অপূর্ব মোবারক সময়! তাই বলা হচ্ছে, سلام هى حتى مطلع الفجر (সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফাজরে) অর্থাৎ, চতুর্দিকে শান্তির প্রস্রবণ বহে সূর্যোদয় পর্যন্ত। এটাকে ফজরের সময়ও ধরা হয়। এ সময়ের কৃপাময় নূরের বদৌলতে শান্তির পর শান্তি বর্ষিত হতে থাকে। এর ফলে জাগতিক অন্ধকার মানবিক আবরণের আচ্ছন্নতা বিদূরিত হয় এবং খুলে যায় রহস্য জ্ঞানের দ্বার। এ সময়ের প্রাতঃ সমীরণে বুলবুলি ও মালিগণ হৈ চৈ ও প্রেমের ধ্বনি করতে করতে নির্জন থেকে বেরিয়ে আসে ভোর হয়ে গেছে, ভোর হয়ে গেছে বলতে বলতে। আক্ষেপ এই কৃপাময় রাত এবং মাশুকের গন্ধময় নির্জনতা শেষ হয়ে যাচ্ছে যা এক দু করে বহুদিনে এসেছিল। যার মধ্যে উভয় জগতের সৌন্দর্য ঝলসাচ্ছিল তার কালো কেশগুচ্ছের মোহে প্রেমিক মাতাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি আজ নিরাশ হচ্ছেন। শবে কদর যদি কিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ হত তাহলেও তাঁর সে ফজরের আনন্দ এবং চাকচিক্য এক মুহূর্তের জন্যও ব্যাহত হত না। অশান্তি, অশান্তি আক্ষেপ! আক্ষেপ!! কদর কে সরিয়ে নিল, কে তা বিচ্ছেদ করল?

আত্মীয়তার বিবরণ
আল্লাহ্্ সকল জাতি এবং সকল জীবের আপন এবং আত্মীয়। তবে কী ধরনের আপন এবং আত্মীয়? কেবল কি মৌখিক আত্মীয় এবং আপন? এটাতো অসত্য এবং মিথ্যা কথা। তিনি যদি রূপক অর্থে আপন এবং বন্ধু হন তার অর্থ হল তিনি প্রকৃত এবং যথার্থ বন্ধু নন, নকল বন্ধু। এটা সত্যের অপলাপ। যা প্রকৃত এবং সত্য তার কাছে রূপক অর্থহীন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজন আত্ম সম্পর্কের বিষয় অবগত হওয়া। আপন নির্দিষ্ট মূল গন্ডি সম্পর্কে অবহিত হওয়া তথা আমরা কী, কে-ই বা আমাদের, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় ফিরে যাব, কী ছিলাম, কী হয়েছি এবং কোন বস্তু থেকে কী প্রকারে প্রকাশিত হওয়ার নাম আমরা এবং তোমরা? আর কিভাবে সৃষ্টি সম্পর্ক প্রকাশিত হয় এবং কোন ধরনের সম্পর্ক সদা মূল বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এগুলো যদি অনর্থক বা সম্পর্কহীন হয়, তাহলে আল্লাহ্্কে আমরা প্রমাণ করব কিভাবে? যেমন লোকে বলে আমার চোখ, আমার নাক, আমার হাত, এগুলো আমার। এটা তারা কিভাবে বলে? এখানে সম্পর্কটা কি ধরনের এবং এ কথার অর্থই বা কী? এ একটি সম্পৃক্ততার সম্পর্ক। এটা সর্বজনবিদিত মৌলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে কোন ক্রমেই তা স্বীয় মূল থেকে আলাদা হতে পারে না। কারণ এ একটি সত্তাজাত বৈশিষ্ট্যের নাম। সকল জীবের কাছেই আপন বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য। স্রষ্টার এ সম্পর্ক সৃষ্টির মধ্যে আসল অলংকৃত করে ডেকে ওঠে এটা আমার সৃষ্টি। অপরদিকে সৃষ্টি আপন আদি প্রকাশসূত্রে বলে ওঠে তিনি আমাদের স্রষ্টা। এ একটি মহা রহস্য। কেবল প্রেমাসক্ত অবস্থায়ই সে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। যেমন মুখের লালা মুখেরই এক প্রকার রস। তা দ্বারা মুখে স্বাদ সৃষ্টি হয়; কিন্তু বলার সময় বলা হয় যে, এটা লালা। আমার হাত, আমার চক্ষু, কথার অর্থও তাই। অনুরূপ সামগ্রিকভাবে আমরা ও তোমরার মধ্যেও একটা সুস্পষ্ট সম্পর্ক অনুভূত হয় এবং ধারণা হয় যে, এতে বৈপরীত্য রয়েছে। বস্তুত এ সম্পর্ক আপন সৃষ্টিমূল ও প্রকাশগত বৈপরীত্য বা বিরোধের নয়। বরং প্রকাশিত রূপের প্রেক্ষিতে বলা হয় আমরা তোমরা এবং বন্ধু, এরূপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সকল প্রজাতি নিজের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যায়। নিজের মধ্যে নিজের খুশি অনুভব করে, নিজের মধ্যে নিজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়ে, নিজেকে রসসিক্ত করে এবং তার ফলে সৃষ্টি হয় এক প্রকারের স্বাতন্ত্রবোধ। এ কারণে প্রথম আপন মূল বস্তু রসসিক্ত হয় এবং পরে যার মধ্যে আপন রস সঞ্চারিত হয়েছে তার সহযোগে খেলাধুলায় লিপ্ত হয়। এ খেলায় সকল ব্যক্তি জোয়ান, বৃদ্ধ সবই শিশুর মতো। এ এক অদ্ভুত মিল যে শিশুর খেলার মাধ্যমে শিশু জন্মলাভ করে। এখন বলো যে, শিশু কোনটি Ñ পিতা না পুত্র? শিশুটি যদি শিশু হয় তাহলে শিশুর এ শিশুত্বের সম্পর্ক কার থেকে প্রকাশ পেল? মূল বস্তুতে তুমি আর আমি কী? তুমি আর আমি তো আপনাতেই বর্তমান। আমার হাত, আমার পা বা হে আমার হাত, হে আমার পা কথার অর্থ যা, ঠিক সে অর্থেই আল্লাহ্্ বলেন, আমার বান্দা, আর বান্দা বলেন, আমার আল্লাহ্্। এ একাত্মতার অর্থ হলো আমাদের দেহ-মন আল্লাহ্্র আর আল্লাহ্্র দেহ-মন বান্দার। এ চিন্তায় বিভোর হয়ে প্রেমিক প্রেম-সাগরে অবগাহন করে একাত্ম হয়ে যায় এবং প্রকৃত বন্ধুত্বের পূর্ণ সম্পর্ক আত্মস্থ করেই দাবি করে আমিই সে। আমি যখন দূরে ছিলাম, তখন দূরদৃষ্টি আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এ পথের প্রেমিক প্রেমাস্পদ ছাড়া আর কাউকেই চায় না। এ না দ্বীন চায়, না ধর্ম চায়; বরং সে বলে, “আইন কাফির আশিকাম মুসলমানি মেরাদরকারনিস্ত।” অর্থাৎ, আমার প্রেম আল্লাহ্্ ছাড়া সব কিছুকেই অস্বীকার করে এবং মুসলমানি আমার প্রয়োজন নেই। প্রেম আল্লাহ্্ ছাড়া বাকি সব কিছুকেই অস্বীকার করে বলেই প্রেমকে কাফির তথা অস্বীকারকারী বলা হয়েছে। এমনকি এটাই আসল কালেমা তাওহীদ তথা প্রকৃত একত্ববাদের বাণী। এ কালেমার “লা” আল্লাহ্্ ছাড়া সবকিছুর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। অন্যথায় কোনো কিছুই অস্বীকার করা হত না। অতঃপর সালেক যখন একাত্ম হয়ে যায় তখন সবকিছুকেই ইল্লাল্লায় মওজুদ ও প্রমাণিত করে। এর অর্থ হল আল্লাহ্্র জীবনী শক্তিতে সবকিছু জীবিত, আল্লাহ্্র স্থিতিতে সবকিছু বর্তমান, তাঁর প্রকাশে সবকিছু প্রকাশমান আর তিনি সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত, তাঁর জ্ঞানে সকলে জ্ঞানী, তাঁর শ্রবণশক্তিতে সকলে শোনে, তাঁর দৃষ্টিশক্তিতে সব দৃষ্টিবান এবং তাঁর মেহেরবানীতে সকলেই মেহেরবান ইত্যাদি।
উপরের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্্ই প্রকৃত সত্য। বস্তুত আল্লাহ্্ তা’য়ালাই সব কিছুর প্রকৃত সত্তা এবং আদি উৎস। এ কারণেই আল্লাহ্্ বলেন,هوالأول والاخر والظاهر والباطن وهو بكل شئ محيط (হুয়াল আউয়ালু ওয়াল আখিরু ওয়াজ জাহিরু ওয়াল বাতিনু ওয়া হুয়া বিÑকুল্লি শাইইন মোহিত্।) অর্থাৎ, তিনিই প্রথম ও শেষ, তিনি জাহের এবং বাতেন এবং তিনি সব কিছুতেই পরিব্যাপ্ত। অর্থাৎ, আল্লাহ্্ সব কিছুর মূল ও উৎস, সে মূলই সর্বত্র বিরাজিত এবং বেষ্টিত। যেমন বীজের পূূর্ণতা বৃক্ষের মধ্যে সর্বতোভাবে বেষ্টন করে রয়েছে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্্ সকল ধাতুর মূল ধাতু এবং সকল সৃষ্টির আদি। বস্তুতপক্ষে আল্লাহ্্ সকল প্রজাতি এবং সৃষ্টির উৎস। এ কারণেই সব কিছুর শুরুতে বিসমিল্লাহ্ তথা আল্লাহ্্র নাম নিতে হয়। সকল বস্তু বা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্্ সদা বর্তমান বিধায় এ পরম সত্তার উপস্থিতির কারণেই তা ক্রিয়াশীল হয় এবং সে কর্মের উৎসে বা মূলে স্বয়ং আল্লাহ্্র সত্তা দীপ্যমান থাকে। এজন্য তাঁর নামের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে তাঁর নাম এবং নামের মৌল বস্তু তথা সামগ্রিক সত্তা অস্তিত্ব তাঁর প্রকাশের উৎসস্থল। এজন্য তাঁর এক নাম জাহের। অর্থাৎ, উক্ত স্থানে তাঁর সত্তাগত, গুণগত এবং কর্মগত প্রকাশ মূলধাতু এবং রহস্যাদির প্রেক্ষিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ জন্য তাঁর অপর নাম বাতেন। বান্দা দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে যখন কর্মে লিপ্ত হয়, তখন সে বিস্মিল্লাহ্র শক্তিতে কর্ম সম্পন্ন করে। অর্থাৎ, সদা বর্তমান প্রকাশমান ও স্থিতিবান আল্লাহ্্র শক্তি সামর্থ্যে কর্ম সম্পাদন করে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে থাকে। অর্থাৎ, যেহেতু আল্লাহ্্ আখের বা শেষ, সেহেতু সমস্ত কাজের সমাপ্তিও তিনি। যখন নাম সহকারে আল্লাহ্্ বর্তমান, তাই তাঁর কৃতজ্ঞতা ও গুণাবলি তাঁর প্রসারতায় উৎসরূপে বর্তমান। সুতরাং এ সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে আপন সত্তায় এবং অন্য কোন প্রজাতির প্রতি তাকানো যায়, তাহলে তাঁর আদি অন্তেও এ প্রেক্ষিতটি সম্প্রসারিত করলে, সে রূপটিই দেখা যাবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ্্র সন্ধান আপন ক্ষমতার গন্ডির মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে এ বিষয়ে সব কিছু সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। এটা সুস্পষ্টভাবে সত্য প্রকাশের যুগ। ইতিমধ্যে অতিবাহিত বোকা ও অজ্ঞদের যুগ স্বাভাবিক নিয়মেই তেল চাটার মতো তলিয়ে যাচ্ছে। যুগের মানুষরা এটাকে অনেক সময় ধর্ম মনে করে। বর্তমান দুনিয়াবাসী ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে এবং যা নিয়ে তারা গর্ব করে তাঁর যুগ শেষ হয়ে গেছে। অচিরেই জগদ্বাসীর দৃষ্টি ধর্ম পূর্ণতা ও উৎসের দিকে সম্প্রসারিত হবে। দ্বীন ও ইজ্জতের প্রভুর নিষ্ঠাবান বন্ধু, যারা সৃষ্টির সেরা এবং তাঁদের সহযোগীদের ওপর আল্লাহ্্র শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।

জুময়ার বর্ণনা
আল কোরানের আটাশ পারায় সূরায়ে জুময়ার দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ্্ বলেন, يا أيها الذين امنوا اذا نودى للصلوة من يوم الجمعة فاسعوا الى ذكر الله وذروا البيع (ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানু ইযা নুুদিয়া লিছছালাতি মিই ইয়াওমিল জুময়াতি ফাসআও ইলা যিকরিল্লাহি অযারুল বাই-আ) অর্থাৎ, হে বিশ্ববাসীগণ! জুমার দিনে নামাজের জন্য ডাকা হলে বেচাকেনা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ্্র স্মরণের দিকে ধাবিত হও। এ আয়াতে সাধারণভাবে বিশ্ববাসীদের আহবান জানানো হয়েছে, তবে মহিলাদের জন্য জামায়াত ফরয হওয়ার কথা অন্য কোনো সূত্রে জানা যায় না বিধায় তারা এ হুকুমের আওতার বাইরে। তাছাড়াও রুগ্ন ব্যক্তি এবং মুসাফির যারা এ হুকুমের শর্তাবলির আওতার মধ্যে নয়, তাদের বেলায়ও এ হুকুম প্রযোজ্য নয়; বরং রাসূল (সাঃ) এর বাণী মোতাবেক উক্ত ব্যক্তিগণ জুময়া ও জামায়াত থেকে নিষ্কৃতি প্রাপ্ত। এক কথায় আহবানটি সাধারণ হলেও কেবল অধিক প্রযোজ্য ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। উক্ত আয়াতে ‘ইযা’ শব্দটি একটি নির্দিষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। আহবান দ্বারা দিনের কোনো একটি নির্ধারিত সময় বোঝানো হয়েছে। এ কারণে ‘ইযা’ শব্দটি একটি নির্দিষ্ট সময় অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। মিন শব্দ আরও স্পষ্ট করে দিনের একটি বিশেষ সময়কে বুঝিয়েছে। আর তা হলো সূর্য ঢলে পড়ার পরবর্তী তথা যোহরের সময়। ফলে যোহরের নামাজের স্থলে জুময়া ফরয হয়েছে। এর অর্থ হলো ওয়াক্তিয়া নামজের চেয়ে জুময়ার নামাজের মর্যাদা বেশি। যেমন বেশি অন্য সব স্থানের তুলনায় কা’বার মর্যাদা, আদম সন্তান ও অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় নবী-অলীদের মর্যাদা, সকল কিতাবের তুলনায় কোরানের মর্যাদা। যে এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত সে উক্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। সুতরাং অনুরূপ ব্যক্তি বুজুর্গ হতে পারে না, আর যে ব্যক্তি একে অস্বীকার করে সে কাফির। অবজ্ঞার সাথে তা অমান্যকারীও কাফির। এখন আলোচনা করা যাকÑ فاسعوا الى ذكر الله (ফাসআও ইলা যিকরিল্লাহ্) “আল্লাহ্্র স্মরণের দিকে ধাবিত হও” সম্পর্কে। এ হুকুমটিও সাধারণ। অর্থাৎ, আহ্বান শোনামাত্র আল্লাহ্্র স্মরণে সচেষ্ট হও তথা যিকিরে মশগুল হয়ে যাও। এখানে যিকির শব্দটিও সাধারণ তথা অনির্দিষ্ট অর্থবোধক। এর দ্বারা সাময়িক যিকির মনে করা হয়, যাকে নামাজ বলে। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ স্মরণে এলাহী। সুতরাং স্মরণে এলাহীকেই নামাজ বলে। কারণ নামাজের মূলই হল স্মরণে এলাহী। তাকেই এ আয়াতে যিকির বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। সুতরাং নামাজ আর যিকির উভয়ই নামাজ। এখানে উল্লেখ্য, জুময়ার দিনটি খুব মর্যাদাবান এবং কল্যাণময়। এ দিনে আল্লাহ্্ ওয়ালাদের এক ধরনের অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়। জুময়ার রাতের আরম্ভ থেকেই সমস্ত রাত এবং দিন আল্লাহ্্র স্মরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার ফলে তাদের দেহমন তাজা এবং সজীব হয়ে যায়। যেন পরিপূর্ণ পূর্ণিমার রাত। কি মনোরম সে রাতের দৃশ্য। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে তা গোপন নয়। এ কারণেই উক্ত আয়াতে সালাত না বলে যিকির শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সালাতও পড়া হচ্ছে বটে, তবে তা মুখ্য (মুরাদি) মৌলিক বা লক্ষ্য নয়। অমৌলিক বস্তুত মূল্যহীন। তাই নামাজ যিকিরের ওপর নির্ভরশীল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যিকিরই নামাজ। এ কারণেই হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑالصلوة الد ائم افضل من الصلوة الموفتة (আছ্ছালাতুদ্ দায়িমু আফ্জালু মিনাছ্ ছালাতিল্ মাওকুতাতি) অর্থাৎ, সার্বক্ষণিক নামাজ ওয়াক্তিয়া নামাজের চেয়ে উত্তম। এটাই মনের যিকির সার্বক্ষণিক চর্চার ফলে মনস্থ হয়ে গেছে। এটা হাদীস শরীফে এসেছে। কিন্তু অনুরূপ যোগ্যতা সহকারে সময় থেকে সময়ে নামাজের ভঙ্গিতে দন্ডায়মান হওয়া ফরয। এ একটা বিরাট নিয়ামত। এ কারণে পয়গাম্বর (সাঃ) এভাবে নামাজ পড়েছেন। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ যিকির। অতএব, ধাবিত হও দ্বারা বাহ্যিক এবং অপ্রকাশ্য উভয় প্রকার নামাজের কথাই বলা হয়েছে। এজন্য ‘ফাস্আও’ তথা ‘ধাবিত হও’ দ্বারা সর্বদা অনির্দিষ্ট বোঝানো হচ্ছে এবং এর দ্বারা খন্ডনের সমস্ত শর্ত শেষ হয়ে যায়। এর পরই বলা হচ্ছে ‘অ জারুল বাইয়্যা’ অর্থাৎ, বেচাকেনা বন্ধ করে স্মরণে এলাহীতে লিপ্ত হও। তাহলে তোমাদের উপর আল্লাহ্্র রহমত হবে। এখানে বেচাকেনা দ্বারা নিছক ব্যবসায়িক লেনদেন বোঝানো হয়নি। এর দ্বারা সাধারণভাবে সমস্ত জাগতিক কারবার বোঝানো হয়েছে। তা না হলে শহরে যারা দোকানদারি করে না, তাদের উপর জুময়ার হুকুম বর্তাবে না। তাহলে কিতাব পাঠে রত বা অন্য কোনো ধর্মীয় কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে জুময়ার হুকুম প্রযোজ্য হবে না। সে ব্যক্তি শহরের বাসিন্দা হলেও না। এখানে শহরের কোন শর্তই নেই। কারণ শহর ছাড়া যে কোন গ্রামেও বেচাকেনা হয়। তা না হলে যে সব লোক শহরে বাস করে, কিন্তু বেচাকেনায় লিপ্ত নেই, তাদের ওপর কি জুময়ার নামাজ ফরয নয়।
কেনাবেচা হয় বলে জুময়ার জন্য যদি শহর শর্ত করা হয়, তাহলে এমন কোনো গ্রাম আছে যেখানে কোনো কেনাবেচা হয় না। এতো গেল জুময়ার জন্য শহরের শর্ত আরোপ করার ব্যাপার। এর পরও থাকে সুলতান হওয়া এবং দন্ডবিধি চালু থাকার শর্ত। বর্তমানে আমাদের ভারত বাংলায় তো সুলতান রয়েছে তার অধীনে আদল্ ইন্সাফ্ হচ্ছে। আমাদের যুগে কোনো দেশইতো দন্ডবিধি থেকে মুক্ত নয়। হত্যা, চুরি এবং ডাকাতি সব ধরনের মামলার বিচার হচ্ছে। হত্যা ও প্রাণনাশের বদলে ফাঁসি এবং সংশোধনের ক্ষেত্রে জেলে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। তা না হলে মামলায় প্রত্যেকেই তার দাবি কিভাবে পেশ করছে?

আচ্ছা দেখো, সকল মামলায়ই ইনসাফ হয়, কেবল জুময়ার জন্যই কি মুসলিম বাদশা হওয়া শর্ত? এ শর্ত আরোপের ফল হল এই যে, এতে জুময়া রহিত হয়ে যায়। এ দেশে যদি কোনো আমির বা কাজী না-ই থাকে, তাহলে তাদের স্থলে যারা কার্য সম্পাদন করছে তারা কাজীর আওতায় পড়ে কিনা? যদি না পড়ে, তাহলে এটা দারুল হরব্ বা শক্র রাজ্য এবং মুসলিমদের জন্য দারুল হরবে বাস করা বৈধ নয়। তাহলে আমাদের কি এদেশ ছাড়তে হবে? যদি ছাড়তে হয়, তাহলে অবিলম্বে ছেড়ে পালানো ফরজ। আর যদি বলা হয় যে, এটা দারুল আমান বা শান্তির রাজ্য, তাহলে আমির ও কাজী থাকার শর্ত কোথায় অবর্তমান? আসলে এসব হল আল্লাহ্্র আদেশকে বাতিল করার জন্য ফালতু আলোচনা। যদি বলা যায় যে, জুময়ার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। বাহ্যিকভাবে আয়াত বা হাদীস দ্বারা মত পার্থক্য আছে বলে মনে হয় এবং মুফ্তিদের মতামতও যদি তাই হয়, তাহলে এর উত্তর হল এই যে, মতভেদ দ্বারা নিশ্চিত প্রমাণিত কোনো বিষয় বাতিল করতে সুনির্দিষ্ট দলিল দরকার। মতভেদ দ্বারা তা কখনো বাতিল হয় না এটা সাধারণ নীতি। ফিকাহ্, কালামশাস্ত্র এবং সকল বিষয়ের মূলনীতিও এটা। এ নীতিকে যদি অগ্রাহ্য বা বাতিল করা হয়, তাহলে মূল এবং নিঃসন্দেহ আদিষ্ট বস্তু কোরান, খুঁটিনাটি মতভেদ কী করে বাতিল করবে? এটা কখনোই সম্ভব নয়। কোরানের মূল বিষয়বস্তু অবশ্যই রক্ষা করতে হবে এবং কোরানের জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্যÑ يا ايها الذين امنوا اذا نودى للصلوة من يوم الجمعة فسعوا الى ذكر الله (ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানু উযা নুদিয়া লিছছালাতি মিই ইয়াউমিল জুম’য়াতি ফাসয়াও ইলা যিক্রিল্লাহি) কোরানে ব্যবহৃত ‘ইযা নুদিয়া’ শব্দের অর্থ কী তা বুঝতে হবে। ‘আমানু’ দ্বারা মুমিন বোঝানো হয়েছে। তাহলে আহ্বান জানাবে কে? সে মুমিন কিনা ? সে যদি মুমিন হওয়া শর্ত না হয়, তাহলে তার ওপর জুময়া ফরয হবে কিভাবে? তাহলে মুয়াজ্জিনকে মুমিন হতে হবে কি হবে না? তাহলে এবার বলো এ পরিষ্কার নির্দেশের মধ্যে জটিলতার কী আছে?
প্রেমের প্রকৃতি
প্রেমিক যখন আল্লাহ্্র প্রেমে লীন হয়ে যায়, তখন প্রেম অন্তর নূরী সত্তায় সম রঙ ও সমজাতীয় হয়ে যায়, উত্তপ্ত লোহার মতো। উত্তপ্ত হতে হতে লোহা যখন অগ্নিরূপ ধারণ করে, তখন তার ভিতর দিয়ে আগুনের প্রকাশের দরুন লোহাটি স্বয়ং আগুনে পরিণত হয়। তার ভিতর বাহির কোথাও লোহার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বাকি থাকে না। যদি লোহার কোনো বৈশিষ্ট্য অবশিষ্টই থাকল, তাহলে আগুনের চরিত্র রইল কোথায়? আগুনকে উত্তাপ দিলে কোনো বস্তুর মাধ্যমে তা প্রজ্বলিত হয়। কোনো জিনিসের আশ্রয় ছাড়া আগুন জ্বলতে বা কখনো প্রকাশিত হতে পারে না। তাই সম বৈশিষ্ট্যের না হলে সে জিনিসের মাধ্যমে আগুনের আত্মপ্রকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং যে জিনিসের মধ্যে আগুন থাকে সে জিনিস থেকে আগুনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণই প্রকাশিত হবে। তখন আগুনের জ্বালা, তাপ, শোঁ-শোঁ শব্দ, প্রভাব ও উত্তাপই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে; বরং অগ্নিময়তা ছাড়া আর কিছুই তো থাকবে না। এমনকি আগুনের প্রভাবে কাঠগুলো ছাইভস্মে পরিণত হবে। এমতাবস্থায় কাঠ থেকে ‘আমি আগুন’ ছাড়া আর কী শব্দ বের হবে? কাঠ যদি বলে যে, আমি আগুন তাহলে কি তা অসঙ্গত হবে? প্রজ্বলিত কাঠের নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট রইল, যার কারণে সে বলবে না যে আমি আগুন? আগ্নেয় প্রকাশের পর কাঠের কোনো বৈশিষ্ট্যই বাকি থাকে না; বরং তা আগুনে রূপান্তরিত হয়। দশ মণ কাঠ ভস্ম হওয়ার পর একসেরও যখন বাকি থাকছে না, বরং ভস্ম হয়ে এখন কেবল বিলুপ্তি বাকি, তখন কে তাকে কাঠ বলবে? বরং তা আগুনে রূপান্তরিত হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। অনুরূপ আল্লাহ্্র প্রেম, এর চেয়েও আরও অধিক অধিক শক্তিশালী আগুনের মতো। যখন এর মূল স্বয়ং আল্লাহ্্, প্রেমিকের মধ্যে প্রকাশিত হয় সে প্রেমিকের কী অবশিষ্ট থাকবে? বস্তুতপক্ষে আগুন একটি রূপক বস্তু, তার প্রভাবে অন্য বস্তু বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ্্ তা’য়ালা মৌল ও আদি বস্তু। তাঁর উপাদান সকল বস্তুতে সদা বর্তমান, বেষ্টিত, প্রকাশিত ও স্বপ্রমাণিত, ভিতরে বাইরে স্থায়ী। এমন কোন বস্তু আছে যাকে তা প্রভাবিত করবে না? এর বাহ্যিক প্রভাবেরর ফলে কেউ যদি বলে ‘আনালহক্ব’ বা ‘আনাল্লাহ্’ বা আমি আল্লাহ্্ তাহলে তাতে কি আল্লাহ্্র প্রকাশিত হওয়া প্রমাণ হয় না? আল্লাহ্্ তা’য়ালার কি এমন ক্ষমতা নেই যে, তিনি তাঁর কোনো বান্দার ওপর আপন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন? আল্লাহ্্র প্রভাব কি এতই ক্ষুদ্র ও দুর্বল যে, বান্দার প্রভাবে তা লুপ্ত হয়ে যাবে বা হেরে যাবে? এ বাতিল বিশ্বাস এবং ভ্রান্ত ধারণার কবল থেকে আল্লাহ্্ আমাদের রক্ষা করুন। এ কারণে এ বাতিল গোত্রের লোকেরা তাদের পবিত্র বিশ্বাস তথা কালিমা তাওহীদের মৌখিক স্বীকৃতিটাকেও উক্ত ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা নস্যাৎ করে দেয়।
কালিমা তাওহীদের অর্থ মর্মানুযায়ী দুনিয়া আখিরাতের সব কিছুকে অস্বীকার করার পর তারা ঐ সমস্ত বস্তুর মাধ্যমেই আবার আল্লাহ্্কে প্রমাণ করে এর বেহ্শেত এবং আখিরাতের সুখ-শান্তি কামনার মাধ্যমে তাওহীদের ধারণাটাই বিনষ্ট করে ফেলে। এটা একটা বিরাট ধোকা। অপরদিকে তাওহীদের আলোচনা করার সময় ওয়াজিবুল ওয়াজুদ তথা স্বতন্ত্র সত্তার সংজ্ঞায় তারা বলে যে, তাঁর সৃষ্টি কৌশল দ্বারা আমরা তাঁর পরিচয় লাভ করি। অর্থাৎ, বস্তুসমূহ দেখে তারা বলে যে, অবশ্যই এর কারিগর আছে। এখানে কারিগর কথাতো অনির্দিষ্ট, তা একাধিকও তো হতে পারে। এখানে লক্ষণীয়, কালেমা যে সব বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সে সমস্ত বস্তু দ্বারা কারা কালেমার মর্মার্থকে অস্বীকার ও বাতিল করেছে। কালেমা সব কিছুকে অস্বীকার করেই আপন মর্মার্থ ও প্রমাণীয়কে প্রতিষ্ঠিত করছে। এটাই তাওহীদের পথ এবং এটাই স্থায়ী। এটাকে বাতিল মনে করার ফলে ধূম্রজালের মধ্যে জড়িয়ে তারা অন্ধ হয়ে গেছে। আর বিভ্রান্তির ফল তার গাছের পরিচয় দেয়। একদিকে তারা বলছেÑ আল্লাহ্্ ছাড়া সবই লয়যোগ্য, অপরদিকে বলছে, বনজঙ্গল দ্বারা আল্লাহ্্ প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্্র প্রমাণের পূর্বে জঙ্গলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে, কালেমার বক্তব্যকে অস্বীকার করা হচ্ছে কি না? তাই আল্লাহ্্ বলেনÑ أتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تتلون الكتاب افلا تعقلون ( (আতা, মুরুনান্নাছা বিলবিররে ওয়াতানছাওনা আন্ফুছাকুম ওয়া আনতুম তাতলূনাল কিতাবা আফালা-তা’কিল্ন।) অর্থাৎ, তোমরা আত্মবিস্মৃত হয়ে লোকদের সৎ উপদেশ দিচ্ছ, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করছ, তাহলে তোমরা কি বোঝ না? আক্ষেপ! যার ঈমানের প্রাথমিক কোনো জ্ঞান নেই, তার আবার কী যোগ্যতা থাকতে পারে? সুতরাং আখিরাতের ভক্তদের উচিত তাদের পথ শোধরানো এবং মুর্শিদের কাছ থেকে কোরানের মূল বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া। আর কালেমা ও তাওহীদের অনুসরণের মাধ্যমে প্রকৃত মাবুদের বা উপাস্যের পরিচয় লাভ করা। তাহলে তাঁর আবশ্যকীয় জ্ঞান লাভের মাধ্যমে শান্তির সন্ধান পাবে। যারা ফিকাহ্র কিতাবের দ্বারা কুফর ও ঈমান প্রমাণ করছে, তারা যা দ্বারা ঈমান অর্জিত হয়, সে সব বিষয় বা ঈমানের সংজ্ঞা যা ঈমানদারদের জানা দরকার ফিকাহ্র কিতাবসমূহে কি জানতে পারে? ফিকাহ্র কিতাবে যদি তা না থাকে, তাহলে ঈমান বিনষ্ট হওয়ার ব্যাপার তারা কোথা থেকে আমদানি করছে? অর্থাৎ জমা নেই খরচ আছে। হতে পারে ফিকাহ্র কিতাবে ঈমান সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোচনা আছেই বা। কিন্তু ঈমান তো ‘ইল্মে আহ্ওয়াল’ তথা অবস্থা সংক্রান্ত জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তা না জানলে তো ঈমান লাভ হয় না।
ফিকাহ্র সংজ্ঞা ও আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। ফিকাহ্র বিষয়বস্তু হল ইসলামের প্রকাশ্য কার্যকলাপ তথা বৈধতা ও অবৈধতা সংক্রান্ত ইসলামের অমৌলিক ও খুঁটিনাটি বিষয়াদি। ফিকাহ্ শব্দের অর্থ বুদ্ধি ও জ্ঞান। জ্ঞানের নামে তাতে কেবল কয়েকটি অমৌলিক বিষয়ে আলোচনা হয়। ফকীহ্ বা ফিকাহ্বিদ সে ব্যক্তিকে বলা হয়, যে তিনটি ‘মাসআলা’ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। আকাঈদ এবং বাহ্যিক অবস্থাদি সংক্রান্ত বিষয়াদি তার অন্তর্ভুক্ত। আর জ্ঞানী বা আলেম বলা হয় তাকে, যে ধর্মীয় মূলনীতিসমূহ পূর্ণভাবে অবহিত। সূফী তিনি, যার মধ্য থেকে হালাল-হারামের শত সহস্র হেতু প্রকাশিত হতে থাকে। এ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি অন্তিম মুহূর্তে কাফিররূপে মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ ধরনেরই কথা ‘গায়াতুল আওতার’-এ লেখা হয়েছে। তাছাড়া সর্বস্বীকৃত নীতি যার উপর ফিকাহ্শাস্ত্রের ভিত্তি তাও তো এই যেÑلايزال احل با لشك ولابا لظن او با لاختلاف اوبالا حتمال (লাইয়াজালুল আহ্লে বিস্সাক্বি অলাজ্জিান্নি আওবিল এখতিলাফি আওবিল এহতেমালি) অর্থাৎ, দ্বিধা, সন্দেহ মতানৈক্য বা অনুমান ও ধারণা দ্বারা কোন বস্তুর বা বিষয়ের বৈধতা নষ্ট হয় না। সুতরাং এসব নীতি দ্বারা কোনো হালাল বস্তুর মৌলিকত্ব যখন বিনষ্ট হচ্ছে না, তখন শুধু সন্দেহ ও অনুমানের বশে তাকে হারাম আখ্যা দেওয়া বৈধ নয়। কোনো বিষয়ে যদি মতানৈক্য থাকে, তাহলে তা হবে বির্তকমূলক বিষয়। তবে তা হালাল এবং বৈধ হিসেবে গণ্য হবে। তাকে সরাসরি অবৈধ আখ্যাদানকারী পাপী বা কাফির হবে। ফিকাহ্শাস্ত্রে কাফির হওয়ার বিষয়গুলোকে যুক্তিযুক্ততার ভিত্তিতে আলোচিত হয়েছে, কাউকে কাফির হিসেবে স্থির করা হয়নি। সুতরাং এর জোরে কাউকে কাফির বলা মোটেই বৈধ নয়। কারণ ঈমান এবং ঈমানের পূর্ণতা ফিকাহ্র আলোচ্য বিষয়ভুক্ত নয়। এ অজ্ঞাত বিষয়ে ফিকাহ্ কিভাবে রায় দেবে? এ কারণে ফিকাহ্বিদগণ তাদের কিতাবের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, আমরা কিছু শাখা বিষয়ে আলোচনা করি এবং ঈমান ও এহ্সান সংক্রান্ত বিষয়গুলো আকাইদের গ্রন্থে দেখে নিবে। এমতাবস্থায় যে সব লোক ফিকাহর দ্বারা ঈমান বাতিল হওয়ার কথা বলে অথচ ঈমানের উৎপত্তি সম্পর্কে ফিকাহ্ থেকে জ্ঞান লাভ করতে পারে না, তারা কি কোনোমতেই হিসেবের যোগ্য? এ বেহুদা বক বক থেকে আল্লাহ্্ওয়ালাগণ অবিলম্বে বিরত হোন। অন্যথায় মৃত্যুর সময় এ অজ্ঞতাপ্রসূত দ্বন্দ্ব তোমাদের ঈমানের পথ থেকে বিরত রাখবে।
এখানে বাহ্যিক বিষয়ে ফিকাহ্শাস্ত্রের মতভেদ লক্ষণীয়। যারা সাপ ও গুঁইসাপ খায়, তারা কোন দলিলের ভিত্তিতে তাকে হালাল মনে করছে? আর যারা একে হারাম মনে করে, তাদেরই বা দলিল কী? কোরানের আলোকে কোনো বস্তু বৈধ বা হালাল বলে মনে হলে, কোনো হাদীসে তা যদি হারাম বলেও উল্লেখ করা হয়, সে ক্ষেত্রেও বৈধতারই গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, হাদীস কোরানকে বাতিল করতে পারে না। এটা জানার প্রেক্ষিতে احل لكم صيد البر والبحر (অহিল্লা লাকুম সাইদুল বাররি ওয়াল বাহরি) অর্থাৎ, তোমাদের জন্য জলস্থলের শিকার হালাল করা হল। কোরানের এ ঘোষণার আলোকে মালেক এবং হাম্বল (রঃ) সাপ এবং গুঁই সাপ প্রভৃতি খাওয়া হালাল বলেন। তোমরা কেউ যদি তাকে হারাম মনে কর, তাহলে তোমরা বলতে পার যে, এটা আরোপিত হারাম, তাকলিদ তথা অনুকরণের কারণে মেনে নিচ্ছি, বস্তুত এটা হারাম নয়। অজ্ঞ জনসাধারণের তো কোনো কথাই নেই। সামান্য লেখাপড়া জানলেই তারা এটা হারাম, ওটা হারাম বলতে শুরু করে।
ফিকাহ্ শাস্ত্রের আরও দু একটি বিতর্কমূলক বিষয় আলোচনা করা যাক। কোনো কোনো ফিকাহ্র কিতাবে আছে, কোনো পুরুষ যদি কোনো অপরিচিতা নারীকে যৌনভাবে স্পর্শ করে, তাহলে উক্ত নারীর মা স্পর্শকারী পুরুষটির শাশুড়ি হয়ে যায়। অর্থাৎ, উক্ত নারীর মা, দাদি থেকে উপরস্থ সকল ও নীচস্থ বেটির বেটি যত আছে সবই উক্ত পুরুষের জন্য বিবাহ করা হারাম হয়ে যায়। কিন্তু ‘দুররুল মোখতার’ প্রভৃতির গ্রন্থকারগণ এ মতকে বাতিল করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এ অবৈধতা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, এটা শুধু তাদের ঐক্যমত। বস্তুত মূলনীতি অনুযায়ী তাদের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। ‘গায়াতুল আওতার’-এর লেখক বলেন, যেহেতু পর নারীকে স্পর্শ করা বৈধ নয়, সেহেতু তা দ্বারা জামাইয়ের মর্যাদা স্থির করার বৈধতার যৌক্তিকতা নেই। দ্বিতীয় কথাটি সুদ বিষয়ক। কোনো কোনো ফিকাহ্বিদ বলেছেন সোনা, রূপা, আটা, গম, খুরমা ও লবণ ইত্যাদি জিনিসের লেনদেন অতিরিক্ত নেওয়া বৈধ নয় এবং এটা সুদ। কিন্তু তা ছাড়া অন্যসব জিনিসের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গ্রহণ করা সুদ বলে হাদীসে প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও ফিকাহ্বিদদের অধিকাংশের মতে, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত। তবে ‘দুররুল মোখতার’ এর লেখক তাদের মতকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, তাদের এ সিদ্ধান্ত ত্রুটিপূর্ণ। মনে করুন এক থান কাপড়ের দাম দু টাকা আর এক থান কাপড়ের দাম দশ টাকা। এখন যদি এর বিনিময় করতে হয়, তাহলে কি কেউ তা করবে? অনুরূপভাবে ফিকাহবিদদের মধ্যে অনেক বিতর্কমূলক বিষয় রয়েছে। তাই বলে কি আসল প্রতিপাদ্য বস্তুটি ত্যাগ করতে হয়? যদি তাই হয়, তাহলে জুম্য়া এবং ঈদের নামাজ ছেড়ে দাও। কোনো কোনো জাহেরিপন্থী ফিকাহ্বিদ সম্মানসূচক সিজদাকে হারাম বলছে। কেউ বলছে র্শিক। তবে অনেক গবেষক এবং তাফসীরকারক তাকে বৈধ মনে করেন। এটাকে মূলনীতি অনুযায়ী হারাম বলা যাবে না। সর্বদা এটা মোবাহ্ তথা অনুমোদিত বা সুন্নত হিসেবে গণ্য হবে।
বস্তুতঃপক্ষে কাফির হওয়ার জন্য ঈমান বিচ্ছিন্ন হওয়া দরকার। যে ব্যক্তি ঈমানের বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ, সে ব্যক্তি এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে এ অজানা বিষয় জ্ঞান দান করার যোগ্য নয়। সে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা বলছে তাকে বিতর্কমূলক বিষয়রূপে গণ্য করে পরিহার কর। এরই প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ্্ তা’য়ালা বলেন, ولاتطع من اغفلنا قلبه عن ذكرنا (ওয়ালা তাতিউ মান আগফালনা কালবাহু আন যিকরিনা) অর্থাৎ, শুনবে না তাদের কথা আমরা যাদের অন্তরকে আমাদের স্মরণ থেকে নির্লিপ্ত করে দিয়েছি। অর্থাৎ, এসব লোক যদি দলিল উপস্থাপন করে বা ফতুয়া দেয় তার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবে না। অনুরূপ আল্লাহ্্ তা’য়ালা বলেন, ان فى ذا لك لذكرلمن كان له قلب (ইন্না ফী যালিকা লিযিকরুন্ লিমানকানা লাহুু কাল্বুন) অর্থাৎ, নিশ্চয়ই কোরানে যিকির রয়েছে তাঁর জন্য, যার অন্তর আছে। অর্থাৎ, কোরানের বিষয়বস্তু আল্লাহ্্ সম্পর্কীয় জ্ঞান আর তা কাল্ব তথা অন্তরের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং যারা আহ্লে কাল্ব বা অন্তরবাদী তারাই কোরানের বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। তা না হলে কোরান দ্বারা ফতুয়া দেওয়ার যোগ্য হয় না। সহী হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেÑ استفت عن قلبك وان افتاك المفتون (ইস্তাফ্তি আন্কালবিকা ওয়াইন আফতাকাল মুফ্তিউন) অর্থাৎ, বাইরের মুফ্তি ফতুয়া দিলেও তথা বারণ করলেও তুমি তোমার মনের কাছে ফতুয়া চাও। আল্লাহ্্ওয়ালাদের অন্তর হয় প্রসারিত। তাতে আল্লাহ্্র তরফ থেকে অসংখ্য রহস্য উদ্ভাসিত হয়। তার অংশবিশেষও শত প্রমাণের চেয়েও বলিষ্ঠতর। তাইতো আল্লাহ্্ বলেন, والذين جاهد وافينا لنهد ينهم سبلنا (ওয়াল্লাযীনা জাহাদু ফিনা লানাহ্দি ইয়ান্নাহুম ছুবুলানা) অর্থাৎ, যে সব লোক আমাদের সত্তায় সাধনায় লিপ্ত আমরা তাঁদের অবশ্যই স্বীয় পথ প্রদর্শন করি। যার জন্য কোনো কিতাব দলিল প্রয়োজন হয় না। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে আহাম্মদীতে লিখেছেন, اما الكلام فى الاوليا فخارج عن البحث (আম্মাল কালামু ফিল আওলিয়ায়ি ফা খারিজুন আনিল বাহাছি) অর্থাৎ, আউলিয়াদের বিষয়টি তর্ক-বিতর্কের বাইরে।
যে সব লোক মনগড়াভাবে বলছে যে, সিজদা কেবল আল্লাহ্্র জন্যই নির্দিষ্ট, তারা কি দেখাতে পারবে সুস্পষ্টভাবে সিজ্দা শব্দটি কোথায় উল্লেখ আছে? হাদীস তো কোরানের বিরোধী হতে পারে না; বরং কোরানে ফেরেশতাদের জন্য আদম (আঃ) এর সিজ্দা এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জন্য মানুষের সিজ্দার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। নিষেধের প্রমাণ কোথায়? শুধু তাই নয়। কোরানে আরও উল্লেখ রয়েছেÑ ولقد حلقناكم ثم صؤرناكم ثم قلنا للملائكة اسجدوا لادم فسجد والا ابليس لم يكن من الساجدين (ওয়ালাক্বাদ খালাক্বনা কুম ছুম্মা ছাওয়ারনা কুম ছুম্মা কুলনা লিল মালাইকাতিছ্জুদু লি আ-দামা ফাছাজাদু ইল্লা ইবলিছা লামইয়াকুম মিনাছ ছাজিদীন) অর্থাৎ, আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি, পরে আকার দান করেছি। অতঃপর ফেরেশতাদের বলেছি, আদমকে সিজ্দা কর, এতে ইবলিছ ছাড়া সকলেই সিজ্দা করেছে, সে সিজদাকারীদের সাথে শামিল হয়নি। আরও বলা হয়েছেÑما منعك ان تسجدا اذا امرتك (মা মানাআকা আন তাছজুদা ইজা আমারতুকা) অর্থাৎ, আমি যখন তোমাকে সিজ্দা করতে হুকুম দিলাম, তখন কে তোমাকে তা থেকে বারণ করল? অনুরূপ অনেক স্থানে আল্লাহ্্ ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে সিজ্দা শব্দের সুস্পষ্ট ব্যবহার রয়েছে। বিরোধীরা কোথা থেকে বলছেন যে, আল্লাহ্্ ছাড়া কারো জন্য সিজ্দা নেই। যদি বলা হয় যে, সিজ্দার বৈধতা রদ হয়ে গেছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কোরানের খবর বাতিল হয় না, আর এটা খবরের
অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সিজ্দা বলতেই আল্লাহ্্র জন্য সুনির্দিষ্ট উক্ত আলোচনার দ্বারা এ অবরোধ ভেঙে গেছে। যদি বলা হয় যে, সম্মানসূচক সিজ্দা তথা মস্তক অবনত করা কেবল বৈধ ছিল। তাহলে বর্তমানে অনুরূপ সিজ্দা দ্বারা নামাজও বৈধ হবে। কারণ, সেটাও তো সিজ্দা। যদি বলা হয় যে, তা এখন রহিত হয়ে গেছে, তার জবাব হল এই যে, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীস একক বর্ণিত হাদীস। তা অকাট্য দলিল তথা কোরানের মোকাবিলায় গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া হাদীস কোরানকে বাতিল করতে পারে না। অপরদিকে কোরানের হুকুম কোরান দ্বারা রহিত হতে পারে। কিন্তু কোরানের সংবাদমূলক বর্ণনা কোনো কারণেই রহিত হয় না। সিজ্দার আয়াতটি সংবাদমূলক। ‘তাফ্সিরে কালালি’ শাইখুল হিন্দ এর ‘বাহারুল উলু’ম’ এবং ‘এহ্ইয়াউল উলু’ম’ প্রভৃতি বড় বড় গ্রন্থে এর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যদি বলা হয় যে, সম্মানসূচক সিজ্দা শিরক্ না হলেও হারাম। এ বিষয়ে ফিকাহ্বিদদের ঐকমত্য রয়েছে। এর জবাব হল যে ঐ ফিকাহ্বিদদের ঐক্যমত দ্বারা কোনো কিছুকে হারাম আখ্যা দেয়া বৈধ নয়। কারণ কোনো কিছুকে হারাম প্রমাণ করার জন্য কোরানিক দলিল প্রয়োজন। এতে কারও দ্বিমত নেই। এমতাবস্থায় অকাট্য দলিলের মোকাবিলায় এ অনুমানভিত্তিক ঐক্যমত কী করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? সে বিষয়ে অধিকাংশ ফিকাহ্বিদ, তাফসিরকার এবং সূফীর মত বৈধতার পক্ষে রয়েছে, তার বিপরীতে কয়েকজন ফিকাহ্বিদদের মতামত কী করে ইজ্মা তথা অধিকাংশের ঐক্যমত হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারে? যদি বলা হয় যে, যদি কোনো বিতর্কমূলক বিষয়ে কেউ হারামের পক্ষে ফতুয়া দেয় আর কেউ তাকে হালাল বলে, তাহলে হারামের পক্ষের মতকেই গ্রহণ করতে হবে। এর জবাব হল এই যে, প্রথমত, এ কথা ফিকাহ্র মূলনীতিবিরোধী। কারণ মূূলবস্তু সর্বদাই অনুমোদনীয় হয়। যদি বলা হয় যে, জমহুরের মতে, সকল বস্তু মূলত বিবেচনাধীন থাকে, এটাও মারাত্মক ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ তাতে ইজ্মা ও কিয়াস্ এর উৎপত্তি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ বিবেচনাধীন বিষয়ে কোনো নির্দেশ না আসা পর্যন্ত উক্ত বিষয়ে ইজ্মা বৈধ নয়। সুতরাং অনুরূপ মতের অনুসারী ব্যক্তির দ্বারা তো ইজ্মার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় মারাত্মক ক্ষতিকর কারণ এই যে, জগতে এমন কোনো বস্তু নেই শাখা-প্রশাখায় যার প্রভাব পড়ে না। তাকে হারাম বললে জুম্য়া ও দু ঈদের নামাজও হারাম হয়ে যাবে এবং অবৈধ হবে ইমাম শাফেয়ীর পিছনে নামাজ পড়া। কারণ শাফেয়ী মাযহাবে মাথার একটি মাত্র চুল মুছলেই ওযুর ফরয আদায় হয়ে যায়। আর হানাফী মাযহাবে মাথার এক-চতুর্থাংশ মোছেহ্ করা ফরয। এ শর্তানুযায়ী শাফেয়ীদের ওযু হয় না। সুতরাং শাফেয়ীদের পিছনে হানাফীদের নামাজ বৈধ নয়। আল্লাহ্্র বাণীÑ لاتسجد واللشمس ولاللقمر (লা-তাছজুদু লিশ্শামসি ওয়ালা লিল কামারি) অর্থাৎ, তোমরা চন্দ্র সূর্যকে সিজ্দা করবে না। এর আলোকে যদি বলা হয় যে, সম্মানসূচক সিজ্দাও নিষিদ্ধ। এর জবাব হল এই যে, এ আয়াতের শেষেÑان كنتم اياه تعبدون (ইন কুনতুম ইয়্যাহু তায়াবুদুন) অর্থাৎ, “যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর ইবাদত কর” এ বাক্যাংশ যুক্ত রয়েছে। এর পরিষ্কার অর্থ হল যে, তোমরা যখন আল্লাহ্্র ইবাদত কর, তখন চন্দ্র-সূর্যকে ইবাদতসূচক সিজ্দা করবে না। এ আয়াতে কেবল ইবাদতসূচক সিজ্দা অন্যের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে ইবাদত শব্দ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। এতে এমন কী রয়েছে যাতে সম্মানসূচক সিজ্দা নিষিদ্ধ হবে? যারা কোরান দ্বারা সম্মানসূচক সিজ্দাকে নিষিদ্ধ করছে, তারা উক্ত আয়াতের শেষাংশ বাদ দিয়ে দেখাচ্ছে। পুরো আয়াতটি হচ্ছেÑ لاتسجد وا للشمس ولا للفمر واسجدو الله الذى خلقهن ان كنتم اياه تعبدون (লা-তাছজুদু লিশ শামসি ওয়ালা লিল কামারি ওয়াছজুদু লিল্লাহিল্লাযী খালাকা হুন্না ইন কুনতুম ইয়াহু তা’বুদুন।) অর্থাৎ, তোমরা চন্দ্র সূর্যকে সিজ্দা কোরো না এবং তোমরা আল্লাহ্্কে সিজদা করো, যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর ইবাদত কর। কিন্তু এ উক্তি দ্বারা আদম (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) এর সিজ্দা তো নিষিদ্ধ হয়নি; বরং তা একটি সুস্পষ্ট নির্দেশ।
অনুরূপভাবে যারা আল্লাহ্্র কালাম নিয়ে ব্যবসা করে তারা কোরানের মূল বক্তব্যকে এভাবে পাল্টে দেয়। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে আভিধানিক অর্থও বিকৃত করে। উদাহরণস্বরূপ কোরানের আহ্বানÑيا ايها الذين امنوا ادخلوا فى السلم كافة (ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু উদখুলু ফিস্সিল্মি কাফ্ফা) এর দ্বারা অর্থ করেÑ “হে মুমিনগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হয়ে যাও।” অর্থাৎ, ‘সিল্মি’ এর আভিধানিক অর্থ শান্তি, প্রেম ও বন্ধুত্ব পাল্টে দিয়ে তদস্থলে ইসলামের নাম প্রচার করছে। অনুরূপভাবে কোরানের অপর আয়াতÑاذكر ربك فى نفسك تضرعاوخيفة دون الجهر من القول (উজর্কু রাব্বিকা ফিনাস্সিকা তার্দারু আন ওয়াখিফাতান দুনাজ জাহির মিনাল কাওলি) এখানে ‘খিফাতান’ এর অর্থ তারা করে “গোপন”। অথচ এর আভিধানিক অর্থ ভীতি বা ভয়। শুধু তাই নয়, ওহাবিদের বিকৃত করার ধরন আরও মারাত্মক। তারা অনেক ফিকাহ্ ও তাসাউফের কিতাব মুদ্রণের সময় ভালো ভালো বাক্য বাদ দিয়ে ছাপে এবং কোনো কোনো বাক্য জালিয়াতির মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলে। ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন রচনা থেকে অনেক অংশই বাদ দিয়ে দিয়েছে। যেমন ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দিদ আল ফেসানী (রঃ)-এর ‘মাবদাও মায়াদ’ গ্রন্থের এক স্থানে পুরো এক পৃষ্ঠাব্যাপী সম্মান সূচক সিজ্দা বৈধ বলে লেখা ছিল। তারা তা সম্পূর্ণ উধাও করে দিয়েছে। দিল্লীর মুজদাবায়ী প্রেসের ছাপা কপি দ্রষ্টব্য। ‘মাবদ ওয়া মায়াদ’ গ্রন্থ থেকে ওহাবিদের দ্বারা উধাওকৃত সম্মানসূচক সিজ্দার বৈধতা সংবলিত বক্তব্যটি ‘তোহ্ফাতুল আকইয়ার’ গ্রন্থে হুবহু উল্লেখ রয়েছে। তবে কিতাবের মাঝে মধ্যে থেকে, যে সব অংশ বাদ দিয়েছে জ্ঞানীদের কাছে তা গোপন নেই। তাফসীর ‘ফাত্হুল আজিজ’ এর মূল আরবি তাফসীরেÑ ماوهل لغير الله (মা উহিল্লা লি গাইরিল্লাহি) অর্থাৎ, আল্লাহ্্ ব্যতীত হালাল হবে না-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, পশু জবেহ করার সময় আল্লাহ্্ ছাড়া অন্য কিছুর নাম উচ্চারণ করলে, তা হারাম হবে। কিন্তু ওহাবিরা ফারসি তাফসীরে তা বিকৃত করে লিখেছে যে, আল্লাহ্্ ছাড়া অন্য কারও নাম যে কোনো সময় উচ্চারণ করলেই তা হারাম হয়ে যাবে। তারা সম্মানসূচক সিজ্দার বৈধতার পক্ষে লিখিত ‘ফতুয়ায়ে সিরাজিয়া’র কয়েকটি বাক্যও বিকৃত এবং উধাও করে দিয়েছে।

ফায়েজ গ্রহণ
(প্রথম পর্ব)
অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে এমন শায়েখের মনপ্রাণের সাথে মুরিদ তার আপন মনপ্রাণ সম্পৃক্ত করে দিবে বা অনুপ্রবেশ করিয়ে দিবে আর ভাবতে থাকবে, যেন প্রেমাস্পদ তাকে প্রভাবিত করছে। তাহলে দু-চার মিনিটের মধ্যেই সে কমবেশি এ প্রভাব নিজের মধ্যে অনুভব করবে। এ প্রভাবের প্রকৃতি কম্পন, গরম, বা শোঁ শোঁ শব্দের মতো হতে পারে। এর দ্বারাও সে উপলব্ধি করতে থাকবে যে, এক ধরনের বস্তু অবশ্যই আমার জ্ঞাত হচ্ছে। এ থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে তার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। উত্তম ব্যক্তিতো পাঁচ দশ মিনিটেই গলে পরাভূত হয়ে যায়। কারও কারও তো প্রভাবের পর প্রভাব ফায়েজের মতো অথবা বিভিন্ন অবস্থা অনুভূত হতে থাকে। তখন সে বুঝতে পারে যে, অমুক আমাকে আলোড়িত করছে। অতঃপর তার ভিতর অনুভূত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে সে বুঝতে পারবে যে, এটা ইস্মে জাত তথা মহান সত্তার অনুরণন এবং প্রভাব। অনুরূপ প্রভাবাধীন কাল্ব তথা অন্তরের কম্পনটাই ইস্মে জাত তথা মহান সত্তা। অতঃপর সে তাঁর সাহায্যে অদ্ভুত বিরল বস্তুসমূহ সম্পর্কে অবহিত হতে থাকবে। এগুলো হবে আলো বা অন্ধকার ধরনের অথবা চন্দ্র বা তারকা ইত্যাদির মতো। তবে এগুলো স্থায়ী হয় না; কিন্তু তাঁর প্রভাবে অন্তর সচেতন হতে থাকবে এবং ক্রমান¦য়ে সে আল্লাহ্্র দিকে ঝুঁকে পড়বে। ফলে অল্প সংস্পর্শেই তার মনে এক ধরনের অতি মনোহরি আকর্ষণ বোধ হবে। যার বরকতে মানুষ ফলনশীল বৃক্ষের মতো কল্যাণকর হয়। অর্থাৎ তার মানসিক শক্তি দৃঢ়তর হয়ে প্রতিক্রিয়াসমূহ পরিপক্ব হবে এবং এ শক্তি বিভাগের পার্থক্য নিরূপণ, তার উন্নতি ও বলিষ্ঠতার জন্য মুর্শিদের শক্তি সার্বক্ষণিক প্রয়োজন। এটা মূল বা আসল শক্তি। তাঁর থেকে এ শক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, সে হয়ে যাবে মৃতবৎ। তবে তার মধ্যে দৃঢ়তাপ্রাপ্ত প্রভাবটি নষ্ট হবে না। তবে হ্যাঁ, মুর্শিদ যদি তা বাতিল করে দেন, তাহলে কিছুটা তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকলেও তা বরকতহীন ও নিষ্ফল হয়ে যাবে। এর আলোচনা অন্যভাবে হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ ভিন্ন।
মোট কথা, উপরে উল্লিখিত প্রতিক্রিয়াসমূহের বিভিন্ন স্তরের শক্তি এবং জ্ঞান আলাদা। এতে আহ্ওয়াল তথা অবস্থা সংক্রান্ত জ্ঞান হলেও উৎস সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের তারতম্য হয়। ঐ অবস্থায় যার যে পরিমাণ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া লাভের সৌভাগ্য হয়েছে তার শক্তি ও জ্ঞান তার চেয়ে অধিক হবে না। এহেন রুবুবিয়াত সংক্রান্ত জ্ঞানেও অনেক পার্থক্য হয়। সুতরাং গুণগতভাবে প্রত্যেকের নিকট জ্ঞাত না হলেও চূড়ান্ত সত্তার অধিকারীর কাছে জ্ঞাত। কারণ তাঁর মধ্যে এ জ্ঞানের সমস্ত বিভাগ ও শক্তি বিদ্যমান। অর্থাৎ, তিনি সকল প্রকার জ্ঞান ও শক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত। অর্থাৎ, তিনি এর সব ধরনের বিভাগ উপ-বিভাগ সম্পর্কে জানেন। কোন পর্যায়ে কোন ধরনের অস্থিরতা হয় তাও তিনি জানেন। যখন তাদের এই পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভের সৌভাগ্য হবে উক্ত শক্তিকে সে অন্য কিছু মনে করবে না।
মোট কথা মুর্শিদের শক্তি মন থেকে শুরু করে কর্ম ও গুণাবলির জ্যোতি ও নিশানা মুরিদের মধ্যে বিকশিত করতে থাকে, ফানা হোক, বাক্কা তথা স্থিতি পরম সত্তায় হোক বা মূলে হোক সবই মুর্শিদের প্রভাব। অর্থাৎ পরম সত্তায় ফানা তথা বিলীন বা বাক্কা তথা স্থিতি যাই হোক সবই মুর্শিদের প্রভাব। মুরিদের যা কিছুই অর্জিত হোক সবই মুর্শিদের বস্তু নিরপেক্ষ সত্তার অবদান। এটাই হল বক্ষ সম্প্রসারণের সার কথা। তা আল্লাহ্্র পরিপূর্ণ সত্তা থেকে মুর্শিদ সত্তায় বিকশিত হয়ে থাকে। তাই বলে এমনটা প্রয়োজন নেই যে, মুর্শিদের মুর্শিদও থাকতে হবে। কারন মুর্শিদ তাঁহার সিলসিলা বা ধারা ক্রমিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নন। এর অর্থ হল খাঁটি মুর্শিদ অগ্নি উত্তপ্ত সীসার মতো। মূলত তা সীসা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অগ্নিবৎ। সৃষ্টি বৈশিষ্ট্যের ধারায় তা সীসার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

ফায়েজের বৈশিষ্ট্য
(দ্বিতীয় পর্ব)
ফায়েজ এক ধরনের সঞ্চারিত প্রভাব এবং শক্তি। ফায়েজ অর্থ পুরস্কার ইত্যাদি। মুর্শিদের এই পবিত্র ও শাশ্বত ফায়েজ যা মুরিদকে প্রভাবিত করে তা যদি কোনো অলী বা আল্লাহ্্র সাধকের সংস্পর্শ পায় তাহলে সে ফায়েজ স্বীয় পবিত্র বৈশিষ্ট্যাদি সহকারে আতর ইত্যাদি সৌরভের মতো বিচ্ছুরিত হয় এবং তার বদৌলতে ধীরে ধীরে উক্ত অলীর আরও অধিক প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এটা তুলনীয়। কখনো যদি কোথাও ফুঁ দেওয়ার প্রয়োজন হয় আর তা দিলে তাতে নিজ শরীরের আরাম এবং প্রশান্তি আসে। অনুরূপভাবে আপন ফায়েজ ও অন্যের ভিতর প্রবেশ করে তাকে আলোড়িত বা উত্তেজিত করে, যেমনি উত্তেজিত করে হাওয়া আগুনকে। আবার তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাগত হয় নিজের মধ্যে। যেমনি গুলি ফিরে আসে পাথরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে। তখনই বুঝবে যে, এটা আপন মুর্শিদের ফায়েজ । মুরিদের সত্তায় বর্তমান মুর্শিদের প্রভাব যেন স্বয়ং মুর্শিদ। কারণ আগুনের ফুলকিও আগুনই। ‘কুদ্দুসের’ অর্থ এটাই। যে কোনো স্থানই এর গতিবিধির বাইরে নয়। উল্লেখ্য যে, মুরিদ যখন একাদিক্রমে সংস্পর্শে আসে তখন ফায়েজ ও একের পর এক স্বীয় বৈশিষ্ট্যে আপন আপন রূপ প্রকাশ করে এবং প্রদীপের মতো আলোর ঝলক প্রদর্শন করে। দুটি প্রদীপ একত্র হলে আলোও অধিক হয় এবং একটি অপরটি দ্বারা উপকৃত হয়। এ রহস্য জ্ঞানীদের অজানা নয়। ঠিক তেমনই সোহ্বত বা সংস্পর্শতা পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত হয় আপন আপন মুর্শিদের প্রতিষ্ঠিত আওতার মধ্যে। তার মধ্যে এ গুণ না থাকলে কারও তা অনুভব হত না এবং কেউ-ই তাতে পথের সন্ধান পেত না। সুতরাং কোন কবর বা অলীর জিয়ারতের বদৌলতে মুরিদ যদি কোন ফায়েজ অনুভব করে, তাহলে তার উচিত তা তার মুর্শিদ থেকে আগত বলে মনে করা। অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতার সার অর্থ এটাই। সর্বত্র সর্বাবস্থায় তথা বস্তু বা অবস্তু, দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান চেতন অবস্থায় বা অচেতন অবস্থায়, মৃত বা জীবিত সৃষ্টি জগৎ বা সত্তার জগৎ সর্বত্রই মুর্শিদের ফায়েজ বা প্রভাবিত করার ক্ষমতা বিরাজমান। মোট কথা, কেউ যদি কোনো কবর বা অলীর নিকট ফায়েজ প্রার্থনা করে, তাহলেও উক্ত মৌল বস্তুর কারণেই তাকে সাহায্য ও অনুকম্পা করা হবে। উক্ত মূল বস্তু সম্পর্কে যার জ্ঞান নেই এ ফায়েজের সৌভাগ্যও তার হবে না। এ কারণে আমাদের নবী করীম (সাঃ) বলেন, الا انبئكم بخيا ركم قالوا بلى ايا رسول الله قال خياركم اذا رؤ ذكر الله (আলা আম্বাউকুম বি খিয়ারিকুম কালু বালা ইয়া রাসূলাল্লাহ কালা খিয়ারুকুম ইজা রায়াও যিকরিল্লাহ্) অর্থাৎ, আমি কি বলব তোমাদের মধ্যে পুণ্যবান ব্যক্তি কে? সাহাবাগণ বললেন, বলুন হে রাসূলুল্লাহ্। তিনি বললেন, তিনিই তোমাদের মধ্যে পুণ্যবান যাকে দেখলে তোমাদের আল্লাহ্্র কথা স্মরণ হয়। তবে অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে এর মর্মার্থ তারা বুঝবে না। এ জন্য তারা কোনো অলীর দর্শন বা জ্যোতির্ময় কবরের জিয়ারত করতে গেলেও তা থেকে তারা কোনো পথের সন্ধান পায় না। কিছু অজিফা পাঠ করে শ্বাস নিতে নিতে চলে আসে। এ হাদীস দ্বারা মুর্শিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য জানা গেল। তা হল এই যে, তাঁকে দেখলে আল্লাহ্্র নাম স্মরণ হয়। ফায়েজ তথা মুরিদের ওপর মুর্শিদের প্রভাব শক্তিশালী এবং দুর্বল দুরকমই হয়। শক্তিশালী প্রভাবের প্রতিক্রিয়া সর্বক্ষণ আত্মস্থ ও উত্তপ্ত থাকে। কিন্তু দুর্বল প্রভাবে এ বৈশিষ্ট্য থাকে না। তবে তারও কিছুটা প্রতিক্রিয়া হয়।
শিক্ষা দানের অনুমতি
উল্লেখ্য, এটা নবাগতদের যুগ। চারদিকে হেদায়েতের নূর চমকাচ্ছে। ক্ষুদ্র মহান সকলের মুখ থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে খাইরুল কুরুন তথা মহান ব্যক্তিদের কথা। বড় ছোট নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ মারেফতে এলাহীর দিকে আকৃষ্ট এবং মহান আল্লাহ্্র তাওহীদের প্রবক্তা। বিশেষ করে এ পবিত্র যুগে শেষ যুগের ইমাম হযরত মেহদী (আঃ)-এর প্রেরিত হওয়ার ব্যাপারে এ যুগের সকলেই একমত। দ্বীনে মুহাম্মদী স্বীয় সৌন্দর্যে সকল দেশ ও রাষ্ট্রে উদ্ভাসিত হওয়ার পথে। সুদীর্ঘ অতীত থেকে যে সব শুভ প্রথা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ধার্মিকদের পুণ্যলাভের সুযোগ করে দিচ্ছিল কালের প্রলয়ে তাদের কিছু কিছু ভালো কাজ তথা মৃতদের উদ্দেশে ফাতেহা পাঠ, শবে বরাতের আলোকশয্যা, মিলাদ ও কেয়াম বুজুর্গদের কবরে বাতি জ্বালানো প্রভৃতি ওহাবি দাপটে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও অধুনা আল্লাহ্্র ফজলে হেদায়েতের প্রদীপস্বরূপ সম্মানিত অলীদের নির্দেশে ‘আনোয়ারে ছাতেয়া’ প্রভৃতির মতো কতেক গ্রন্থে এ কাজসমূহের বৈধতা ও উপকারিতা সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর ও যোগ্যতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আসলে এসব ছাড়া কোনো উপায় নেই, এগুলোই পরকালের পাথেয়। সুতরাং সকল শিক্ষিত ব্যক্তিরই এসব প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রচারে ও উৎসাহ দানের ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া উচিত এবং প্রত্যেক ধার্মিক ব্যক্তি, সঠিক শরিয়তের অনুসারী এবং আরো যে সব মহান ব্যক্তি এ পথে আছেন তাদের সকলের উচিৎ জানমালসহ এ সব শুভ কাজগুলোর প্রচার এবং প্রসারে প্রয়াসী হওয়া। নিজেরা এসব কাজগুলো করা এবং এগুলোর প্রচারে বিরত না হওয়া। এটা বসে থাকার যুগ নয়। এটাই আল্লাহ্্র অলীদের ইচ্ছাÑ لاخوف عليهم ولاهم يحزنون (লা খাওফুন আলাইÑ হিম অলাহুম ইয়াহ্জানুন) অর্থাৎ, তাদের কোনো ভয় নেই এবং চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণও নেই।
উল্লেখ্য, যারা আল্লাহ্্র সাধনার পথে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তারা হেদায়েত ও পবিত্র ত্বরিকতের পথে নবাগতদের শিক্ষা দিবেন তাঁরা যেন তাঁদের শিষ্যদেরকে আপন মুর্শিদের দিকে নিবিষ্ট করিয়ে যোগসূত্রে আবদ্ধ করেন এবং কেবল কাল্ব তথা মনের কথা বলে আপন মুর্শিদের কাল্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাগিদ করেন ও কখনো নিজের কাল্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে দিবেন না। কারণ তাতে ফায়েজ দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েরই বিরাট ক্ষতি এবং বঞ্চনা রয়েছে। তবে যারা সামগ্রিকভাবে শিক্ষাদানের অনুমতি লাভ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কেবল নবাগতদেরকেই আপন মুর্শিদ ও বুজুর্গদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তা সুদৃঢ় করার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ, ধ্যান, খেদমত এবং উরস প্রভৃতিতে শরীক হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আপন মুর্শিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং মহিলাদের সবক দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু বৃদ্ধ ও আত্মীয়দের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। তবে তাদেরকেও কাল্ব তথা মনের সংযোগ স্থাপনের কথা বলা যাবে না। শুধু মনোনিবেশ এবং যোগসূত্রের কথাই বলতে হবে। অদৃশ্য ওয়াইসিয়া এর অন্তর্ভুক্ত। যে মুর্শিদ ফায়েজে ওয়াইসিয়া প্রদান করার ক্ষমতা রাখেন, তিনি নিকটে বা দূরে থাকুন মুরিদের ওপর তাঁর প্রভাব সদা এক বরাবর। সাধক অনায়াসে নিজের মধ্যে এটা উপলব্ধি করতে পারবে। এটাকে ‘সফীর’ বলা হয়। তখন আল্লাহ্্ আপন দয়া ও রহমতে তাদের পথের সন্ধান দেন। এ সব শর্ত শুধু তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা কেবল তালিম তথা শিক্ষাদানের অনুমতি পেয়েছেন, খেলাফত পাননি। আর যাদের কাছে আপন পীরদের দস্তখত ও মোহরযুক্ত অনুমতিপত্র নেই, তারা তস্কর এবং দাগাবাজ। মুরিদের উচিত তাদেরকে এড়িয়ে চলা। অনুমতি পত্রের ভাষা বা বক্তব্য নিম্নরূপÑ “নাহ্মাদুহু ওয়ানুছাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম।” অতঃপর আগ্রহী সাধক প্রেমিকদের খেদমতে সালাম শুভেচ্ছান্তে আমি ফকির আহমদ আলী ওরফে জানশরীফের আরজ এই যে, মিয়া অমুক সাহেব বিনীত স্বভাব এবং ঐশী প্রেমবৃক্ষের ফল আস্বাদনকারী, সাধনার ক্ষেত্রে তাঁর স্থান জ্যোতির্ময় কর্ম জগতের চূড়ায়। আল্লাহ্্ চাহে তো অনন্য প্রেম অনে¦ষণের পথে আদি একক অন্তর্যামির সদয় মারেফত লাভ তার দেরি নেই। তিনি মুর্শিদের আদেশক্রমে নবাগত মুসলিম উৎসাহীদেরকে মুজাদ্দেদীয়া, মাসুমিয়া ত্বরিকার বিষয়ে শিক্ষাদানে রত। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অদৃশ্য ওয়াইসিয়া ফায়েজ যা শিষ্যদের জন্য প্রয়োজন, সে উদ্দেশে তিনি মুরিদদেরকে কেবল আপন মুর্শিদের প্রতি মনোযোগী করে দিবেন।

Ñ তামাম শোধ Ñ

No comments:

Post a Comment

কালামে সুরেশ্বরী

হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা ছিলেন অত্যন্ত বুৎপত্তিময় কবি ও লেখক। তাঁহার রচিত বাংলা ও উর্দু কিতাবগুলি মারেফত রাজ্যের এক বিশাল ভান্ডার। গ্...