সূচি
কালামে এলাহি তথা নূরের বিবরণ ১৪১
নূরের প্রকৃতি ১৪৩
আধ্যাত্মিক তথা পরকালের অভিভাবক ১৫০
ঈমানের বর্ণনা ১৫৫
শরিয়তের বর্ণনা ১৫৭
ঈমানে তাকলিদী ও ঈমানে তাহ্কিকী ১৫৮
জিকিরের বিবরণ ১৬৩
প্রকৃত জিকির ১৬৫
অজ্দ ও তার উপকারিতা ১৭২
কুদ্রত ১৭৭
তকদীর ১৭৯
সুরের আলোচনা ১৮১
প্রত্যেক ইবাদতে আনুগত্যের নিয়ত শর্ত ১৮৫
সিজ্দার বিবরণ ১৮৯
সালামের বিবরণ ১৮৯
খেলাফতের বিবরণ ১৯৪
সৃষ্টি রহস্যের বিবরণ ১৯৮
ব্যর্থতার বিবরণ ১৯৯
‘র্উস’ এর বিবরণ ২০১
শাইখে কামেল পাপ হতে পবিত্র ২০৪
কেরামতের একটি ঘটনা ২০৪
সূফী পরিভাষা (জাওহারে গোবী) ২০৫
বিবিধ উপকারিতা ২০৬
মোকামসমূহের বিস্তারিত বিবরণ ২০৯
নক্শবন্দিয়া ত্বরিকার লতিফাসমূহ ২১০
ফয়েজের বিশদ বিবরণ ২১১
দৃষ্ট নূরের বিবরণ ২১২
বেলায়েতের বিবরণ ২১২
কাদেরিয়া ত্বরিকার পার্থক্য ২১৩
চিশ্তিয়া ত্বরিকার কতিপয় লতিফার বিবরণ ২১৩
ধর্মের শৃঙ্খলা ২১৭
দুনিয়াদার আলেমের পরিচয় ২১৯
بسم الله الرحمن الرحيم
কালামে এলাহি তথা নূরের বিবরণ
কালামে
এলাহি قل من أنزل الكتاب الذى جاءبه موسى نورا وهدى للناس تجعلونه قراطيس
تبدونها وتخفون كثيرا (কুল্ মান্ আন্জালাল্ কিতাবাল্লাজি যাআ বিহি মূসা
নূরান্ অ হুদাল লিন্ নাসি তাজ্ আলুনাহু কারাতিসা তুব্দুনাহা অ তুখ্ফুনা
কাছিরা)-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তফসীরে হোসাইনীতে বলা হয়েছেÑ “‘বল’ মূসা
কর্তৃক মানুষের জন্য আলোদায়ক ও পথ প্রদর্শকরূপে আনীত কিতাবটি তথা
তাওরাতকে, কে অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা তাকে পৃষ্ঠাবলি সংবলিত নিছক গ্রন্থে
পরিণত করেছ, তোমরা তা থেকে যা খুশি প্রকাশ কর আর অধিকাংশ গোপন রাখ।”
আমি
ফকিরের মতে, এখানে ‘নূর’ অর্থ ক্ষিপ্রগতি সূক্ষ্ম ঝলক। প্রদীপ, চন্দ্র,
সূর্য ও তারকার আলোর সাথে এ তুলনীয়। এ বর্ণহীন অতি সূক্ষ্ম ও নির্মল আলো,
আয়নার ঝলকের সাথে তুলনীয়। এ সাবান জাতীয় পদার্থের মধ্যকার সর্বাধিক
পরিষ্কার ও পবিত্রকারী শক্তি বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ। এগুলো সবই নূরের মৌলিক ও
কল্যাণকর বৈশিষ্ট্য। এ নূরই অন্ধকারের মোকাবিলায় আলো, অস্বচ্ছতার
মোকাবিলায় স্বচ্ছতা, পর্দার মোকাবিলায় পর্দা উন্মোচনকারী, অপবিত্রতার
মোকাবিলায় পবিত্রতা এবং গোমরাহী তথা পথভ্রষ্টতার মোকাবিলায় হেদায়েত বা
পথ প্রদর্শনকারী। এ নূরই হচ্ছে কালামে নূরীর মূল ও তার স্বাদ। কালামুল্লাহ্
ও আম্বিয়া এবং অলীগণের বাণী এ নূরেরই অভিব্যক্তি এবং তাঁদের নূরী
অভিজ্ঞতা উপলব্ধির ফলশ্রুতি ও নির্যাস মাত্র। নবী-অলীগণ এ নূরের সাহায্যেই
অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টির রহস্য অবলোকন করেন। নূরী অন্তরই কেবল এ নূরের
আস্বাদন, ফলাফল ও বরকত লাভ করতে পারেন। এ নূরই সত্য সন্ধানী এবং আরিফ
বিল্লাহর উপায় অবলম্বন ও মাকছুদ। সাধক ছাড়া কেউই এ নূর সম্পর্কে অবহিত ও
পরিচিত নন। তাই আল্লাহ্্পাক তাঁর আপন কালাম পাকে জানিয়ে দিচ্ছেনÑ جاءبه
موسى نور (যাআ বিহি মূসা নূরান)। অর্থাৎ, তাওরাতের সারবস্তু ‘নূরই’ মূসার
উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এখানে ‘নূর’ শব্দ দ্বারা তাওরাত
উদ্দেশ নয়। বরং নূর হল কালামে এলাহি তাওরাতের স্বাদ ও সৌরভ এবং সৌন্দর্য ও
সারবস্তু। এ নূরই হল পথ প্রাপ্তদের অবলম্বন ও হাতিয়ার। হেদায়েত
প্রাপ্তির পর এ নূরই আবার মারেফাত ও মাকছুদে পরিণত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ্্্র
অন্যতম নাম ‘নূর’। সকল বাধা ও বিচ্ছিন্নতার পর্দাকে ছিন্ন ভিন্ন করে এ নূরে
অবগাহন পূর্বক এর সাথে নামে কামে রঙ ও রূপে একাত্ম হওয়ার নামই মারেফাত ও
মাকছুদ। এ মাকছুদ হাছিলের জন্যই আল্লাহ্্্ পাক কোরানে তাওরাত শব্দটি
সাক্ষীরূপে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, جاء به موسى نورا وهدا للناس (যাআ
বিহি মূসা নূরান্ অ হুদাললিন্ নাস) অর্থাৎ, মূসার ওপর ‘নূর’ই অবতীর্ণ করা
হয় এবং এ নূরই গোমরাহদের জন্য হেদায়েত ও মারেফাতপন্থীদের মাকছুদ। কারণ
নূর অর্থ স্বাদ ও শক্তি প্রভৃতি। যেমন প্রত্যেক বস্তুর স্বাদ ও তৃপ্তি থাকা
প্রয়োজন, তা না হলে স্বাদ ও শক্তিহীন বস্তু পানাহারের যোগ্য হয় না। এ
বিশ্লেষণ সত্ত্বেও লোকেরা তাওরাতকেÑ تجمعلونه قرا طيس (তাজ আলু নাহু
কারাতিসা) পৃষ্ঠাবলি সম্বলিত গ্রন্থ ও তাবিজ তুমারে পরিণত করেছে। অর্থাৎ
কালামে এলাহি কোনো কাগজ এবং তাবিজ ও পুস্তকের নাম নয় বরং প্রত্যেক কালামে
এলাহি এক একটি নূরময় সাগর। এ নূরের সাগরে নিমজ্জমান ব্যক্তিগণ হলেন এ
সাগরের মাছ। এ দুর্বল মানুষের মধ্যে যখন নূরের শক্তির সৃষ্টি হয় তখন তাঁর
দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয় এবং শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বৃদ্ধি পায় এবং বেহেশত ও
বেহেশতবাসীগণ তাঁর গোচরীভূত হয়। কেননা বেহেশত প্রভৃতি নূরী ও সূক্ষ্ম
জিনিস, তাই এ সাগরের মাছ নূরময় হলেই নূরময় জিনিসগুলো দেখতে পান। তখন
নূরের ভান্ডার তথা আল্লাহ্্র সাথেও দিদার লাভ হয় এবং তিনি তাঁকে দেখতে
সক্ষম হন। কারণ তাঁর এক নাম নূর। জাত ও সেফাত এবং মহত্ত্ব ও মহিমা সব দিক
দিয়েই তিনি নূর। আর এ নূরই কালামে এলাহির সারবস্তু। এতদসত্ত্বেও تبد ونها
وتخفون كشيرا (তুবদুনাহা অতুখফুনা কাছিরা) অর্থাৎ, “যা ইচ্ছা প্রকাশ কর এবং
অধিকাংশ গোপন রাখ।” সত্তাগত নূর যখন আপন বৈশিষ্ট্যের স্তরে স্তরে সকল
বস্তুর মূল বলে স্বীকৃত তখন তোমরা তা গোপন করছ। প্রকৃতপক্ষে এ নূরই
শরিয়তের সার ও নির্যাস তথা ত্বরিকত। কেননা শরিয়ত হল নির্দেশ সংক্রান্ত
শব্দ ও কালাম। আর যখন এর গহীনে নূর থাকে তখন তাকে বলা হয় কালামে নূরী।
নূরহীন শব্দ ও বাক্য মাত্রই অকেজো ও অনর্থক। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধুমাত্র
শব্দগুলোকে তাওরাত ও কোরান বুঝেছেন, তিনি এর গূঢ় তাৎপর্য সম্বন্ধে অবগত
নন। এজন্যই আল্লাহ্্্ তায়ালা তাদের এ ভুল ভেঙে দিয়েছেন এবং তাদেরকে সতর্ক
করে দিচ্ছেনÑ “তোমরা আপন আপন অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কালামে এলাহির অর্থ
নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাক।” সকল আহলে কিতাবের জন্যই এ সতর্ক
বাণী প্রযোজ্য।
নূরের প্রকৃতি
নূর দু প্রকারÑসেফাতি (গুণগত) ও
জাতি (সত্তাগত)। সেফাতি নূর প্রাকৃতিক ও অতি প্রাকৃতিক উভয় জগতে সর্বত্র
ব্যাপ্ত, একে নূরে ইমকানীও বলা হয়। প্রতিটি সূক্ষ্ম স্তরে এ নূর মিশে আছে।
সে স্তর আলমে খালক বা সৃষ্টি জগতের হোক অথবা আলমে আমর বা অদৃশ্য জগতের হোক।
দ্বিতীয় প্রকারের নূর হচ্ছে ‘নূর-এ-জাতি’ অর্থাৎ, আল্লাহ্্্ তায়ালার মূল ও
সত্তাগত নূর। এ নূর সমস্ত নূরের উৎস। অর্থাৎ জাত হতে সেফাত, লামাকান হতে
মাকান, বর্ণহীন হতে বর্ণ, আকারহীন হতে আকার এবং বেনিশান হতে নিশান। কিন্তু
মূল এককের একাকিত্বে কোনো অংশীদারিত্বের অবকাশ নেই। এজন্য আল্লাহ্্্ তায়ালা
বলেন,الله نورا لسموات والارض (আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতে অল আরদে) অর্থাৎ,
আল্লাহ্্্ তায়ালা আকাশ ও জমিনের নূর। আকাশ ও জমিন সমূহের উৎসের নামই নূর
এবং তাই আল্লাহ্্্। আল্লাহ্্্ তায়ালার জাত বা মূল প্রত্যেক সৃষ্টির মূলেই
ভাস্বর। যেমন কোনো বস্তু থেকে উৎপাদিত জ্বলন্ত আগুনে সে বস্তুটি নিক্ষিপ্ত
হলে তৎক্ষণাৎ সে আগুন তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে এবং সবই রূপান্তরিত হবে
আগুন আর আগুনে। তখন আগুন ছাড়া কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু এ আগুন যখন
কোনো বস্তুর মধ্যে স্বরূপে সুপ্ত ছিল তখন আপেক্ষিক অর্থেই তা সুপ্ত ছিল।
অন্যথায় প্রকৃত অর্থে আগুন তার সত্তা, গুণ ও পূর্ণতা নিয়ে সদা বর্তমান
রয়েছে। আগুন কখনো তার স্বীয় সত্তায় উজ্জ্বল আবার কখনো স্বীয় নফসের জুলমত ও
অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এভাবেই শীতলতা ও উষ্ণতা উভয়ই তার সত্তার জাতে
অন্তর্ভুক্ত। আগুনের প্রকাশ ও গোপন হওয়া উভয়ই তার বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতপক্ষে
আগুন গোপন বা প্রকাশ হওয়া কোনোটাই হয় না বরং সর্বদাই বর্তমান। কিন্তু যিনি
দেখছেন, তার দৃষ্টিশক্তির অভাবেই এত কথা। কেননা তিনি জানেন না যে, কাঠ ও
পাথর থেকে যে আগুন উৎপাদিত হয়, সে কাঠ ও পাথর ঐ আগুনে নিক্ষিপ্ত হলে কিভাবে
তা সম্পূর্ণ আগুনে
রূপান্তরিত হয় এবং বৃহদাকার কাঠ ও পাথরগুলো কিভাবে
আগুনের রূপ ধারণ করে। অনুরূপভাবেই আল্লাহ্্্ তায়ালা স্বীয় সত্তা ও গুণে,
আগুন এবং সকল বস্তুর মধ্যে সদা বর্তমান ও ব্যাপ্ত। কিন্তু রঙ ও রূপের
বিচারে সেফাতি নূর একটি ভারী ও স্থূল গুণ। যেমন ফুল ও ফল, বৃক্ষ ও প্রস্তর
এবং চন্দ্র-সূর্য ও তারকা প্রভৃতি। এদের দেখা যায় চক্ষু দ্বারা, এগুলোর
গন্ধ পাওয়া যায় নাসিকা দ্বারা, শব্দ শোনা যায় কান দ্বারা, স্বাদ পাওয়া যায়
জিহ্বা দ্বারা, এদের স্পর্শের জন্য রয়েছে হাত প্রভৃতি। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের
সাহায্যে উক্ত প্রকাশ্য নূরের কতিপয় অবস্থা জানা গেল। নূর স্বাদের মতো
রূপহীন হলেও প্রকৃতপক্ষে মূলের তুলনায় এগুলো নূরের প্রতিচ্ছায়া। অর্থাৎ,
নূর-এ-জাতি সকল নূরের মূল ও উৎস এবং সকল বস্তুর উৎসই স্বচ্ছ ও সূক্ষ্ম হয়।
যেমনি সূক্ষ্ম ফল, বৃক্ষ, ডালপালা, পাতা ও ফুল প্রভৃতির উৎস বীজ ও অঙ্কুর।
একটি ক্ষুদ্র বীজের মধ্যেই বর্তমান থাকে গোটা বৃক্ষটি, তার ডালপালা আকৃতি
প্রকৃতি ফুল-ফল সব কিছু নিয়ে। মোট কথা রঙিন রঙহীন সব নূরই আল্লাহ্্্র
সত্তায় বর্তমান। তাঁর পবিত্র সত্তাই সকল বস্তুর মূল ও সারবস্তু এবং রূপ ও
আকৃতি। স্বয়ং আল্লাহ্্্ তাঁর পাক কালামে এরশাদ করেন, صبغة الله ومن احسن من
الله صبغة (ছিব্গাতুল্লাহি ওয়া মান্ আহসানু মিনাল্লাহি ছিবগাহ্) অর্থাৎ,
“আল্লাহ্্র রূপের চেয়ে উত্তম কোনো রূপ নেই।” তাঁর অন্যতম নাম নূর। এর মধ্যে
তাঁর জাত, সিফাত এবং মহত্ত্ব ও মহিমা সবই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সমস্ত
সৃষ্টিতে বিদ্যমান রূপ ও আকৃতি সবই তাঁর জাতের বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ্্্র
কালামে বর্ণিত আছেÑ هو الأ ول والاخرو الظاهر والباطن وهو على كل شئ محيط
(হুয়াল্ আউয়ালু ওয়াল্ আখেরু ওয়াজ্ জাহেরু ওয়াল্ বাতেনু ওহুয়া আলা কুল্লি
শাইয়িম্ মুহিত)। অর্থাৎ “আল্লাহ্্্ তায়ালাই সকল বস্তুর আদি ও অন্ত, বাহির ও
ভিতর এবং আল্লাহ্্্ সকল বস্তুতে ব্যাপ্ত।” আল্লাহ্্্ স্বীয় জাত ও সিফাত
এবং পরিপূর্ণতা সহকারে সকল বস্তুতে বর্তমান। তিনি স্বীয় সত্তায় মজুদ না
থাকলে তাঁর সর্বত্রই ব্যাপ্ত থাকার কোনো অর্থ হত না। যেমন আগুন দুনিয়ার সব
কিছুতেই ব্যাপ্ত রয়েছেÑ এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আগুন নেই। দুটি কাঠকে
ঘর্ষণ করলে তৎক্ষণাৎ সে কাঠ থেকে আগুন বেরিয়ে পড়বে। অনুরূপভাবে পাথর বা
অন্য কোনো জিনিসেও সজোরে আঘাত করলে সেখান থেকে আগুন বেরিয়ে আসবে। আগুন এমন
এক বস্তু যার বিভাজন ও পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে আগুনের
উৎকর্ষ ও বৃদ্ধি তার সত্তার মধ্যেই বর্তমান এবং আগুন নিজেই আপন সূক্ষ্ম
রূপকে ভারী রূপে রূপান্তরিত করে। অর্থাৎ অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয় এবং কখনো
দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনুরূপভাবে প্রদীপ জ্বালানো নিভানোর মাধ্যমেও
আগুনের প্রকৃতি অবহিত হওয়া যায়। আল্লাহ্্র পূর্ণ নূর যা আগুন, পানি, মাটি
এবং বায়ুর উৎস, তা বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে কখনো স্বীয় সত্তার বিকাশ ঘটায় আবার
কখনো অদৃশ্য হয়ে নাস্তিরূপ প্রদর্শন করে। কখনো স্বীয় সত্তার উষ্ণ ভাবকে
পরিবর্তন করে ঠান্ডা ও শীতলতাকে স্বীয় সত্তায় ধারণ করে, আবার কখনো সাকারের
সিফাত ত্যাগ করে নিরাকার রূপ ধারণ করে। কোথাও ভূগর্ভে তিনি বৃক্ষ এবং বীজ
প্রভৃতির উৎকর্ষতা ও সজীবতা এবং ফল-ফলাদি পরিপুষ্ট ও মিঠা-খাট্টার উৎস।
কখনো জলবায়ুর অবস্থার সাথে সংযুক্ত হয়ে স্বর্ণ রৌপ্য খনির স্রষ্টারূপে
আত্মপ্রকাশ করেন। আবার ঊর্ধ্ব জগতের উত্তাপের সাথে সংযুক্ত হয়ে সকল বস্তুর
মূল রূপ ধারণ করেন। কখনো জল বিন্দু, ঠান্ডা বায়ু ও অগ্নিশিখায় নূররূপে
সংযুক্ত হয়ে দৃশ্যমান বিশ্বের অস্তিত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন, কখনো উক্ত
সূক্ষ্ম নূর-নূরের দেহও সম্মানিত ফেরেশতার আকার ধারণ করেন, কখনো তিনি বিরাট
আরশ, আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সমস্তের আধার হয়ে যান। কী গভীর
তাৎপর্যপূর্ণ আল্লাহ্্্র নূরের এ বর্ণনাÑÑ Ñ مثل نوره كمشكوة فيها مصباح
المصباح فى زجا جة الزجاجة كانها كو كب درى يوقد من شجرة مباركة زيتونة
لاشر قية ولا غربيه (মাছালু নূরিহি কামিশকাতিন্ ফিহা মিসবাহুন্ আল্
মিস্বাহু ফি যুজা যাতিন্ আয্ যুজাযাতু কা’আন্ নাহা কাউকাবুন দুররিইউ ইউকাদু
মিন শাজারাতিম্ মোবারাকাতুন যাইতুনাতুল্লা শরাকিয়্যাতুন অলা গারবিয়াহ্)
অর্থাৎ তাঁর নূরের উপমা Ñ “কুলঙ্গি যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি
কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ, এ
প্রজ্জ্বলিত হয় পূত পবিত্র জয়তুন বৃক্ষের তৈল হতে যা প্রাচ্যেরও নয়
প্রতীচ্যেরও নয়।” অর্থাৎ যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানেরও নয় এবং যেখানে
সূর্য অস্তমিত হয় সেখানেরও নয়।
আল্লাহ্্্র জাতপাকে মৌজুদ গুণাবলিসমূহ
বিশিষ্ট ও সাধারণ, এ দু রকম। তবে ‘সিফাতে মাশিয়্যাৎ’ যাকে ইরাদা বা ইচ্ছা
বলা হয়, তাই আল্লাহ্্্র সকল গুণের সেরা। অবশিষ্ট সকল গুণ তার অধীন।
আল্লাহ্্্ কোনো কাজের ইচ্ছা করা মাত্র তা হয়ে যায়। কোনো কাজ হওয়ার পূর্বে
তা শুরু হয় এবং সে কাজের পরিপূর্ণতায় তার সমাপ্তি ঘটে। যেখান থেকে কোনো কাজ
শুরু বা আরম্ভ হয় তারই নাম উক্ত আয়াতে ‘শারক’ বা প্রাচ্য এবং যেখানে কাজের
সমাপ্তি ঘটে তাকেই বলা হয় ‘গারব’ বা প্রতীচ্য। জয়তুন বৃক্ষটি প্রাচ্যেরও
নয়, প্রতীচ্যেরও নয়। যে জিনিসের শুরু ও সমাপ্তি আছে তা স্থায়ী ও চিরন্তন
নয়। সুতরাং ইচ্ছা গুণও স্থায়ী এবং চিরন্তন নয়। কিন্তু এছাড়াও আল্লাহ্্্র
একটি বিশিষ্ট গুণ রয়েছে। এ গুণ ইচ্ছার অধীন নয়। বরং এর কাছে ইচ্ছা একেবারেই
বেকার হয়ে যায়। সে গুণটি হল ‘সিফাতে-হুব্বি’ তথা প্রেম গুণ। এ একটি আদি
নূর। উক্ত আয়াতে বিবৃত জয়তুন বৃক্ষ দ্বারা এ প্রেমকেই বোঝানো হয়েছে। যার
প্রাচ্য ও প্রতীচ্য তথা আরম্ভ ও শেষ, কোনোটাই নেই। একেই আল্লাহ্্্ জয়তুন
বলেছেন। এটাই ইশক বা প্রেম। তাই প্রেমের স্থলে ইচ্ছার কোনো কার্যকারিতা
নেই। কারণ অন্য সব গুণই প্রেমের অধীন। এমন কি প্রেমের মোকাবিলায় অন্য সব
গুণের অস্তিত্বই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য আল্লাহ্্্ তায়ালা বলেন, لاشرقية
ولاغربية (লার্শাকিয়ীতু অলা গারবিয়া) অর্থাৎ, “প্রাচ্যেরও নয় এবং
প্রতীচ্যেরও নয়।” অর্থাৎ, প্রেম এমন একটি শাশ্বত নূর সে পবিত্র সত্তায়
বর্তমান ও ক্রিয়াশীল। যার স্তুতিকার স্বাদানেবশীই আদিম সত্তার শাশ্বত
প্রেমিক।
এ জন্যই প্রেমকে জয়তুনের তৈল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ রহস্যের
কারণেই আশিক ও মাশুকের মধ্যে প্রেমই হচ্ছে প্রকৃত মণিরত্ন, যা উভয়েরই
মধ্যমণি ও মৌলবস্তু। এ প্রেম আপন প্রেমিকের ও প্রেমাস্পদের মধ্যকার যাবতীয়
গুণাবলি একে একে বিলুপ্ত করে রহস্যালোকে আবৃত করে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন
স্বাদ আস্বাদন করিয়ে আপন সত্তায় মিলিয়ে এক করে নেয় এবং দ্বৈত সত্তার
বিলুপ্তি ঘটায়। তখন প্রেমিক নিজেকে প্রেমাস্পদের রূপে এবং প্রেমাস্পদ
নিজেকে প্রেমিকের রূপে দেখেন এবং এ দুয়ের যে কোনো পক্ষ থেকেই “আনালহক্ব”
আওয়াজ উঠুক না কেন তা উভয়েরই অভিব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে উম্মতের আশ্রয় হযরত
মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন, ان الله خلق ادم على صورته (ইন্নাল্লাহা খালাকা আদামা
আলা ছুরাতিহি) অর্থাৎ, আল্লাহ্্্ তায়ালা আদমকে আপন রূপে অর্থাৎ, আল্লাহ্্্
তায়ালার হাকিকী সুরতে বানিয়েছেন। অন্য হাদিস শরীফে বলা হয়েছে من رأنئ فقد
رأى الحق (মান রাআনি ফাকাদ রা আল হাক্কা) অর্থাৎ, “যে আমার প্রকৃতরূপ
দেখেছে অবশ্যই সে আল্লাহ্্কে দেখেছে।” তবে এ পর্দার বা স্থূলচোখে তা দেখা
সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে শামসুল হক তাবরেজী বলেন, “দ্বৈত সত্তার বিলোপ
ঘটিয়েছি, তাই দুবিশ্বকে একই দেখি, এককেই দেখি, একেরই অন্বেষণ করি, এককেই
জানি, একেরই আকাক্সক্ষী। হে শামস তাবরিজি, এখানে কিসের উন্মাদনা! মগ্নতা ও
আসক্তি ছাড়াতো কিছুই হয় না।”
মোট কথা উক্ত আয়াতে বৃক্ষ দ্বারা উদ্দেশ
প্রেমিক, তৈল তার প্রেম ও সলিতা তার প্রেমাস্পদ। স্বয়ং আল্লাহ্্্ই এখানে
প্রেমাস্পদ। প্রেমিকের প্রেমে আল্লাহ্্্ তায়ালা অন্তরে খুশি ও আরাম অনুভব
করেন এবং এ খুশি নূরে এলাহির আভায় বিশেষভাবে প্রদীপ্ত ও আলোকোজ্জ্বল হয়।
কালামে রব্বানীর ভাষায় এর সৌন্দর্যকে তৈল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বলা
হচ্ছেÑ يكاد زيتها يضئ (ইয়া কাদু যাইতুহা ইউযিউ) অর্থাৎ, “অচিরেই এ গাছের
তৈল প্রদীপ্ত হবে। ولو لم تمسسه نار (ওলাও লাম্ তাম্সাস্হু নারুন্) “যদিও
আগুন তাকে স্পর্শ করেনি।” এতে এতই চমক ও স্বচ্ছতা এবং ঔজ্জ্বল্য রয়েছে যে
আগুন ছাড়াই তা প্রদীপ্ত হয়। এ কারণেই বলা হচ্ছে, نور علي نور (নূরুন্ আলা
নূর) অর্থাৎ, “নূরের উপরে নূর।” জয়তুনের স্বচ্ছতা প্রদীপের শিখায় মিশেছে,
নূরাধারের দীপ্তি নূরের ঝলককে আরও প্রখরতর করেছেÑ যেমনি আলোকিত হয় বিজলী
বাতির দ্বারা ধরণী। ফানুস রঙিন হলে প্রদীপের আলোও অনুরূপ রঙিন হয়, সুতরাং
ফানুস যখন প্রদীপের আলোকে স্বরূপে রূপান্তরিত করতে পারে এবং এর বিচ্ছুরণে
প্রতিবেশ আলোকোজ্জ্বল হয়, তখন প্রেমিকের অন্তর তো এ নূরে এলাহির জন্যই
নির্দিষ্ট। আল্লাহ্্্ অনন্ত সত্তা, তাঁর জাতি নূর দ্বারা কামেল মানুষের
অন্তর আলোকিত। অনন্ত সত্তার গুণাবলির শুরু এবং শেষ কিছুই নেই। তা সদা
সর্বদা বর্তমান। সুতরাং প্রেমিকের অন্তরের নূর নিঃসন্দেহে আদি-অনন্ত নূর। এ
প্রাচ্যেরও নয় প্রতীচ্যেরও নয়। আর এর পতনও নেই এবং নেই ক্ষয় আর বৃদ্ধি। এ
স্বীয় সত্তায় স্বয়ং বৃদ্ধি পায় এবং নিজেই সংকুচিত হয়। সাদা, কালো, মিঠা,
লবণাক্ততা, আলো, অন্ধকার, ছোট, বড় হওয়া, সবই তার সত্তাগত। যেমনÑ বীজরূপে
একটি দানা ক্ষুদ্র হলেও বৃক্ষ ও ডাল-পালার বিচারে তা-ই বৃহৎ। এক হিসাবে
তিনি এক, অন্যরূপে তিনি একক। যথা-একটি প্রদীপ হতে যতই প্রদীপ জ্বালানো হবে
তাতে প্রদীপের সংখ্যা বাড়বে কিন্তু মূল প্রদীপের কোনোই ক্ষয়-বৃদ্ধি হবে না।
তবে একে একটি মূল প্রদীপই সর্বসমন্বয়ে একক প্রদীপরূপে গণ্য হয়। সুতরাং
তিনি কখনো আহাদ তথা এক আবার কখনো ওয়াহেদ তথা একক। অতএব তাতে বিদ্যমান
ভালোমন্দ সমস্ত গুণাবলিতেই তাঁকে ডাকা যায়। যেমন একই ব্যক্তি সময় বিশেষে
পবিত্র, অপবিত্র, শান্ত, অশান্ত, সন্তুষ্ট, অসন্তুষ্ট প্রভৃতি ভালো মন্দ
যখন যে গুণ তার মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে তখন সে সেই গুণে ভূষিত হয় এবং
অনুরূপ নামে তাকে ডাকা হয়। যথাÑ রহিম, করিম এবং কাহ্হার প্রভৃতি। করিম ও
রহিমের বিপরীত নাম হলো কাহ্হার। প্রতীয়মান হচ্ছে যে আপন সত্তায় আত্মবিরোধী
গুণাবলি বিদ্যমান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একই সত্তায় আত্মবিরোধী গুণের অস্তিত্ব
সম্ভব নয়। এ সব গুণই রূপক ও আপেক্ষিক। উদাহরণস্বরূপ লাল রঙের সাথে হলুদ
মিশানো মাত্রই তা কালো হয়ে যায়, অনুরূপ এক রঙের সাথে অন্য রঙ মিশালে তা
নূতন রং ধারণ করে। এভাবে এক বস্তুর সাথে অন্য বস্তু মিশ্রিত করলে ভিন্নরূপ ও
গুণ সৃষ্টি হয়, যথা-ঔষধ, বারুদ এবং দিয়াশলাই প্রভৃতি। তবে সৃষ্টি হওয়ার
বৈশিষ্ট্য তার সত্তাগত। এ জন্যই তিনি আপনা আপনি সৃষ্টি হন। আর এ নূরী
বৈশিষ্ট্যই তার মূল সত্তা। এ কারণেই কোরান মজীদে ঘোষণা করা হচ্ছে, ماخلقت
هذا باطلا (মাখালাক্তা হাযা বাতিলা) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্ তায়ালা কোনো কিছুই
অনর্থক ও অকারণে সৃষ্টি করেননি।” অতএব বলা হচ্ছে- يهدى الله لنوره من يشاء
(ইয়াহদি আল্লাহু লিনুরীহি মাইয়াশাউ) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্ যাকে ইচ্ছা
আধ্যাত্মজ্ঞান ও ঈমানের আসল নূর দেখান অর্থাৎ নূরের অন্তরকে জাতি নূরে
নূরময় করেন।” যদিও অন্তরের আকৃতি সনুবর বৃক্ষের মতো। হাদীস শরীফে আছেÑ
القلب هى مضغة اللحم فيها بطن حتى سبعة بطن (আল্কালবু হিয়া মোজ্গাতুল্
লাহমে ফিহা বাতনুন্ হাত্তা ছাব্য়াতা বাতনুন্) অর্থাৎ, “অন্তর হচ্ছে এক
টুকরা মাংস, তাতে একটি পেট রয়েছে, এমনিভাবে সাতটি পেট রয়েছে। অর্থাৎ একটি
পেটের ভিতরে আরেকটি এবং তার ভিতরে আর একটি, এভাবে সাতটি পেট রয়েছে। এর
মধ্যে যেটি সর্বশেষ এবং অন্য সব কটির গভীরে রয়েছে তাকে কলবে মোদাব্বির ও
মূল মানব সত্তা বলা হয়। মাথার তালুর সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। সেখানেই
চিরন্তনের রত্ন ভান্ডারের বিরাজস্থান। তিনি তাঁর যাবতীয় সত্তাগত গুণসহ তথায়
বিদ্যমান। তাই আল্লাহ্্্ তায়ালা পবিত্র কালামে এরশাদ করেন, نحن اقرب اليه
من حبل الوريد (নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন্ হাবলিল ওয়ারিদ) অর্থাৎ, “আমি তার
ঘাড়ের সাহারগ হতেও অতি নিকট।” সাধারণত মানব সত্তা ও আল্লাহ্্র সত্তার
ব্যবধান অনেক। তবে মানুষের সৎগুণাবলির প্রেক্ষিতে তিনি মানুষের অতি নিকটে।
বস্তুত, মানুষ নিজের নফস থেকে যেমনি নিকটে তেমনি দূরেও। তাই তো
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, من عرف نفسه فقد عرف ربه (মান্ আরাফা নাফসাহু,
ফাকাদ্ আরাফা রাব্বাহু) অর্থাৎ, “যে নিজের নফসকে চিনেছে, সে তার প্রভুকেও
চিনেছে।” অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ্্র সত্তাগত নূর বিদ্যমান, সেখানেই মানব
সত্তা দৈহিক মানুষের সাথে সহাবস্থান রত। নিম্নোক্ত হাদিস শরীফ এরই
দৃষ্টান্তÑ هم جليس الله (হুম্ জালিছাল্লাহ) অর্থাৎ, আল্লাহ্্প্রেমিকগণ
আল্লাহ্্র সাথে এক স্থানে অবস্থানকারী, আলাপকারী এবং উভয় পক্ষই স্বীয়
প্রেমের মাধুর্যস্বাদ আস্বাদনকারী, যেমন আস্বাদন গ্রহণ করে কোনো সুস্বাদু ও
মজাদার বস্তু আহারকারীর মুখ ঐ বস্তুর স্বাদ ও মজা।
মুখ একটি বিশেষ
অঙ্গ। এর একটি স্বাদ গ্রহণকারী শিরা রয়েছে। তা না থাকলে কোনো বস্তুর স্বাদ
গ্রহণ করাই সম্ভব হত না। প্রকৃতপক্ষে স্বাদ আস্বাদনকারী শিরার মূলেই রয়েছে
মিঠা, খাট্টা ও বিভিন্ন অবস্থা নির্ণয়ের উৎসস্থল। আসমান ও জমিনে যত বস্তু
রয়েছে সব বস্তুর সঙ্গেই রয়েছে রঙ-বেরঙের স্বাদ। কিন্তু এসব কিছুর স্বাদ
আস্বাদন করার শক্তি একই স্বাদ আস্বাদনকারী শিরার মূলে নিহিত রয়েছে। এর
দ্বারাই বিভিন্ন প্রকার স্বাদ উপলব্ধি করা যায়। উক্ত শিরার এক স্থান
দ্বারাই মিঠা খাট্টা প্রভৃতির স্বাদ অনুভূত হয়। যেমন ‘আলিফ’ একটি অক্ষর। এক
হিসেবে তা কোনো দোয়াতের কালি এবং সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে একটি সংখ্যা, অন্য
হিসেবে তা একটি নকশা এবং এর অর্থের বিচারে বহু অর্থবোধক। অনুরূপভাবে উক্ত
রগ বা শিরা এক হিসেবে রক্ত ও মাংস, আরেক হিসেবে জায়গা বা স্থান, এক হিসেবে
সমুদ্র বা নদী, অন্য হিসেবে তা ঊর্ধ্বলোক ও অধঃলোক, এক হিসেবে তা চার
পদার্থ (আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস) এবং তার সার। কোনো অবস্থায় তা নিকটে এবং
দূরে, আবার কোনো অবস্থায় হাজের ও গায়েব। এক হিসেবে তা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও
বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। এক হিসেবে তা পাক ও নাপাক অন্য হিসেবে তা তৃপ্ত ও অতৃপ্ত।
এক হিসেবে তা গুণ ও বিকাশ, অন্য হিসেবে তা নূর ও সত্তা, এক হিসেবে তা বহুর
সমাহার, এক হিসাবে তা স্থায়ী ও অস্থায়ী। কোনো বিচারে তা এক ও একক এবং কোনো
বিচারে তা আশিক ও মাশুক। এ রহস্য অদ্ভুত ও সীমাহীন। কিন্তু যে বিষয়টি
সূক্ষ্ম ও জটিল তা উপলব্ধি ও অনুধাবন করাও জটিল। বস্তুত প্রত্যেক বস্তুর
সৃষ্টি দুভাগে বিভক্ত। যথাÑ স্থূল ও সূক্ষ্ম, অর্থাৎ মোটা ও মিহিন। এত হল
মুখ ও জিহ্বা দ্বারা গৃহীত স্বাদের বিবরণ। তবে চোখেরও ঠিক একই অবস্থা।
চোখের মধ্যে একটি পর্দা ও শিরা রয়েছে। তাই চোখ উপভোগ ক্ষমতা ও দৃষ্টি
শক্তির উৎস। এসব হয় পর্যায়ক্রমে যেমন বহির্দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি ইত্যাদি।
অর্থাৎ জাহেরী চোখ দ্বারা দেখা ও অন্তরের চোখ দ্বারা দেখা। অন্তর্দৃষ্টি
দ্বারা দেখাকে হাজার হাজার রকমে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন এর মধ্যে রয়েছে
খাব, কাশফ, বোধি ও ইলহাম, বিশ্বাস ও ঈমান, এরফান, আধ্যাত্মজ্ঞান ও
আত্মজ্ঞান। যাকে আরবিতে বলে ‘আনা’, ফারসিতে ‘মান’ এবং হিন্দিতে ‘ম্যায়’।
এ
সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় সামগ্রিক সত্তাই আমি ও আমাদের মূল সত্তা বলে প্রমাণিত
হয়েছে। অতএব যেখানে মূল সত্তা বর্তমান সেখানে তার গুণাবলিও যথারীতি
বর্তমান। আর যেখানে গুণাবলি থাকে সেখানে মূলের প্রেক্ষিতে তার ছায়াও থাকে।
সুতরাং যেখানে ছায়া সেখানে তার কর্মও রয়েছে। এজন্য আল্লাহ্্্ কালামে পাকে
এরশাদ করেন, والله على كل شئ محيط (ওয়াল্লাহু আলা কুল্লি সাইয়িম মূহীত)
অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্ তায়ালা সকল বস্তুতে পরিব্যাপ্ত।” এখানে বস্তু অর্থ
সাময়িক বা অস্থায়ী বস্তু। আল্লাহ্্্ পাক বলেন, كل شئ فان (কুল্লু শাইয়িন্
ফান্) অর্থাৎ “সাময়িক সমস্ত বস্তুই ধ্বংসশীল।” এখানে উল্লেখ্য যে, হাস্তির ও
নিস্তির তথা স্থায়ী ও অস্থায়ীর সম্পর্ক শাব্দিক ও প্রেক্ষিক। কারণ
ধ্বংসশীল শব্দটিও সাময়িক। আসলকে বোঝা গেলে তা জাতে হাকিকী দ্বারা
পরিব্যাপ্ত বোঝা যাবে। অর্থাৎ, সত্তাগত নূরকেই কখনো সত্তা আবার কখনো নূর
বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের রূহ্ ইত্যাদি সত্তাগত নূর। কিন্তু কোনো
হিসেবে তা নূর আবার অন্য হিসেবে তা বীর্য, কখনো তা রক্ত, কখনো অস্থিমাংস
এবং বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নামে আখ্যায়িত। কিন্তু রূহ্ যখন ইন্দ্রিয়াদি ও
সব রকম গুণাবলিসহ বিদ্যমান থাকে তখনই তাকে রূহ্ বলা হয়। অনুরূপভাবে রূহ্
সকল জৈবিক গুণের সমষ্টি। অর্থাৎ ভাল মন্দ উভয় প্রকার গুণাবলি রূহে বর্তমান
থাকার নামই রূহ্। বস্তুত তা-ই-নূর। এ থেকেই সকল বস্তুর জীবন ও স্থায়ীত্ব। এ
জন্য তাঁর নাম হয়েছে ‘হাইউন’ ও ‘কাইয়ুমুন্’ অর্থাৎ চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।
সুতরাং জাতে পাকের সত্তায় সদা মজুদ নেই এমন কোনো বস্তু নেই। অতএব জাতে
পাকের সত্তা ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই এবং জাতেপাকই সত্য। তাই لا اله
الا الله (লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্) এর অর্থ হচ্ছেÑ আল্লাহ্্্ ছাড়া কোনো সত্তা
নেই, তিনিই একমাত্র সত্তা। প্রাধান্যতার কারণে সব কিছুর মধ্যেই ‘জাতেহক্ব’
বর্তমান রয়েছে। অতএব কোনো কিছুই আল্লাহ্্র সত্তার বাইরে রইল না। কিন্তু
যারা এর বিপরীত অর্থ বুঝেছে তারা ভুল বুঝেছে এবং ভুল করেছে। প্রকৃতপক্ষে
এরূপ ব্যক্তি মোমেনই নয়। কালেমার ‘লা’ শব্দ ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছুকেই
মিটিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু এ অস্তিত্ব মিটানো তাও কাল্পনিক অর্থে।
অন্যথায় প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্্র কোনো শরীক থাকলে নিছক ‘লা’ শব্দের ভয়ে কোনো
অংশীদার তার অধিকার ছেড়ে দিত না। কালেমার আসল প্রতিপাদ্য এবং উদ্দেশই এর
অর্থ। কোনো অক্ষর বা শব্দ এর উদ্দেশ নয়। কারণ কাগজে খচিত কালেমাকে কেউই
গ্রহণ করে না বরং এর প্রতিপাদ্য ও সারই সকলের নিকট গ্রহণীয়।
আধ্যাত্মিক তথা পরকালের অভিভাবক
আল্লাহ্্্
তায়ালা বলেন, والمؤمنون والمؤمنات بعضهم اولياء بعض يأمرون بالمعروف
وينهون عن المنكر (ওয়াল্ মোমিনুনা ওয়াল্ মোমিনাতি বা’জু হুম্ আউলিয়াউ
বা’জিন্ ইয়া’মুরুনা বিল্ মা’রুফি অয়ানহাওনা আ’নিল মুনকার) অর্থাৎ, “মোমেন
নরনারীগণ একে অন্যের বন্ধু ও অলী বা অভিভাবক। নিজেদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার
খাতিরে তাঁরা একে অন্যকে সৎকর্মের আদেশ করেন এবং অন্যায় কাজ হতে বিরত
রাখেন।” অলীদের আন্তরিক প্রতিফলন দ্বারা অনুপ্রাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারও
মধ্যে সৎকর্ম করা এবং অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকার ক্ষমতা জন্মায় না। এ
আন্তরিক প্রতিফলনশক্তিকেই বেলায়েত বা আধ্যাত্মিক অভিভাবকত্ব বলা হয়। এতেই
নিহিত রয়েছে, আল্লাহ্্্র প্রেম ও মহব্বত এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য
ঐশীজ্যোতি প্রভৃতি। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ও সাধারণ তথা মুর্শিদ ও মুরিদ
রয়েছে। যিনি এদের মধ্যে বিশিষ্ট তিনিই অলী। বিশিষ্টদের প্রতি সাধারণদের
বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ থাকা ওয়াজিব বা কর্তব্য। আর সাধারণদের জন্য বিশিষ্ট
অলীদের বন্ধুত্ব থেকেই বেলায়েতের সূত্রপাত হয়। এ জন্যই সকল বেলায়েতের উৎস
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন, لايؤمن احد كم حتى أكون احب اليه من نفسه وما له
و ولده و والده الناس أجمعين (লাইউ’মিনু আহাদুকুম্ হাত্তা আকুনা আহাব্বু
ইলাইহি মিন্ নাফ্সিহি ওয়া মালিহি ওয়া ওয়ালাদিহি ওয়া ওয়ালিদিহি অন্নাছি
আজমাঈন) অর্থাৎ, “তোমরা কেউই মোমেন হবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের
জানমাল, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং সমস্ত মানব গোষ্ঠী হতে আমার সাথে
অধিক বন্ধুত্ব রাখ।” এতেই প্রমাণিত হয় যে, বিশিষ্ট অলীদের প্রতি বন্ধুত্ব ও
শ্রদ্ধাবোধই সাধারণ অলীদের জন্য বেলায়েত স্বরূপ। এজন্য আল কোরানে এরশাদ
হচ্ছে Ñ كونو امع الصادقين (কুনূ মাআ’সসাদিকীন) অর্থাৎ,“সৎ তথা অলীদের সাথী
হয়ে যাও, তাঁদেও সাথে বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তোল এবং তাঁদের
অনুগত হয়ে যাও।” এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত খাজা আহারার কুদ্দুস
ছেররূহু স্বীয় ‘ইছবাতে রাবেতা’ পুস্তকে ‘কুনু’ শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন
‘কুনু’ আদেশাত্মক ক্রিয়া। আর আদেশ দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। এখন কুনু
‘হয়ে যাও’ এ আদেশটি দুভাবে পালন করা যেতে পারেÑ প্রথমত তাঁদের প্রকাশ্য
প্রশংসিত গুণাবলির অনুসরণের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত আধ্যাত্মিক গুণাবলি আয়ত্ত
করা এবং তাঁর সুরত দৃষ্টিতে ধারণ করার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে আরও জানতে চাইলে
পরবর্তী আয়াত লক্ষ করুন। আল্লাহ্্্ বলেন, واصبر نفسك مع الذين يد عون ربهم
بالغد اوة والعشى يوريدون وجهه (ওয়াছবির নাফ্-সাকা মাআল্লাজিনা ইয়াদউনা
রাব্বাহুম্ বিল্ গুদুওয়াতি ওয়াল আশিয়্যে ইউরিদুনা ওয়াজহাহু) অর্থাৎ, ‘যারা
সকাল সন্ধ্যা তথা সব সময় নিজেদের প্রতিপালকের স্মরণে লিপ্ত এবং তাঁর
সন্তুষ্টিবিধানের চেষ্টায় রত; তোমরা নিজেদেরকে তাঁদের সাথে সম্পর্কযুক্ত
কর।’ দেহ-মনে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে সকল বিষয়ে তাঁদের গুণাবলি দ্বারা
গুণান্বিত হও এবং তাঁদের সত্তা ও গুণাবলির আলোকে নিজেদের সত্তা ও গুণাবলিকে
আলোকিত কর। তবেই সম্ভব হবে অভিভাবকত্ব। সত্তার জন্য সত্তার, গুণাবলির জন্য
গুণাবলির, দেহের জন্য দেহের এবং আত্মার জন্য আত্মার। এভাবে যখন এক পলকের
জন্যও পরস্পরের মাঝে দূরত্ব ও বিস্মৃতি ঘটবে না, তখনই পূর্ণতা পাবে সৎ
ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উক্ত আদেশটি।
প্রকৃতপক্ষে মুুর্শিদের এ
রূপক অস্তিত্বেই মৌল হাকিকত নিহিত রয়েছে। কারণ রূপক অস্তিত্ব মাত্রেরই
অন্তর অস্তিত্ব আবশ্যক আর অন্তর অস্তিত্বের জন্য হাকিকত আবশ্যক। সুতরাং
হাকিকতের ধারকও নিঃসন্দেহে হাকিকত। অতএব অলীদের প্রতি প্রেম মূলত
আল্লাহ্্্রই প্রতি প্রেম। আল্লাহ্্্ বলেন, من يطع الرسول فقد اطاع الله
(মাইউতিউর রাসূলা ফাক্বাদ আতা আল্লাহ্্্) অর্থাৎ, আল্লাহ্্র রাসূলের
আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্্রই আনুগত্য। আর আনুগত্য তখনই পূর্ণতাপ্রাপ্ত
হয়, যদি অলীর জাহেরের সাথে নিজের জাহেরকে, অলীর বাতেনের সাথে নিজের বাতেনকে
এবং হাকিকতকে মূলের সাথে ফানা বা বিলীন করা যায়। প্রথমটি দৈহিক ফানাÑএটাকে
বলা হয় ‘ফানা ফিশ্ শাইখ’, দ্বিতীয়টি বাতেনী ফানা তথা ‘ফানা ফির রাসূল’ এবং
তৃতীয়টির নাম ‘ফানায়ে রূহ্’ তথা ‘ফানাফিল্লাহ্’। সংখ্যায় ফানা তিন, চার বা
যতই হোক না কেন ফানার লক্ষ্যবিন্দু যাতে ফানাহ্ সম্পন্ন হবে, শাইখে
নূরানীর মধ্যে তাঁর উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘শাইখে নূরী’ তথা
নূরময় মুর্শিদ ‘পয়গম্বরেনূরীর’ই নূর। এটাই আল্লাহ্্্র নূর। এ জন্যই
আল্লাহ্্্ ও নবীর এক নাম নূর। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে নিজ নিজ জাতিতে শাইখগণ
নবী স্থানীয় বটে। হাদিস শরীফে আছেÑ الشيخ فى قومه كالنبى فى أمته (আশ্
শাইখু ফি কাউমিহি কাননাবিয়্যে ফি উম্মাতিহি) অর্থাৎ, “শাইখ তার জাতির
মধ্যেÑ যেমন নবী তাঁর উম্মতের মধ্যে।” প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদের মধ্যে
আল্লাহ্্্ ও রাসূলের নূরী সত্তা সদা বিদ্যমান, অন্যথায় ফানা সম্ভব নয়।
মাওলানা রুমী বলেন,
“চুঁ কে জাতে পীরেরা কারদি কবুল,
হাম খোদা দর জাতাশ আমদ হাম রাসূল।”
অর্থাৎ,
পীরের অন্তরই মুরিদের ঈমানের স্থান, সেখানে জাহেরী গুণাবলি ও সত্তাগত
বৈশিষ্ট্যসমূহ স্বরূপে বিদ্যমান। এগুলো ঈমান স্থানের প্রতিক্রিয়া। এ
প্রতিক্রিয়া দ্বারাই মুরিদের অন্তর ও সর্বসত্তা প্রভাবিত হয়। আল্লাহ্্্
বলেন, بعضهم اولياء بعض (বা’জুহুম্ আউলিয়াউ বা’জিন্) অর্থাৎ, “তারা একে
অপরের বন্ধু।” এখানে “বা’জ” শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। এ শব্দ দ্বারা
নারী-পুরুষ সকলকে বোঝানো হয়েছে। নারীর জন্য পুরুষ এবং পুরুষের জন্য নারী
মুর্শিদ হওয়াতে কোনো বাধা নেই। এ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই আন্তরিক যোগ
সম্পর্ক থাকা প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচ্য। অর্থাৎ স্বীয় অন্তর হতে
দ্বিতীয় সম্প্রদায় (মুরিদ) প্রথম সম্প্রদায়ের (মুর্শিদ) মহব্বত কোনো
অবস্থাতেই বিচ্ছিন্ন করবে না এবং স্বীয় দৃষ্টি হতে তাঁর সুরতকে দূরে সরাবে
না। কেননা দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের বেলায়েত হচ্ছে প্রথম সম্প্রদায়ের মহব্বত ও
তাজিম করা এবং তার সত্তা ও সুরতকে পবিত্র নজরে দেখা গোস্তাখী বা অসম্মানের
দৃষ্টিতে কোনো অবস্থাতেই না দেখা। কেননা অসম্মানের দৃষ্টি গোনাহগার ও
অকৃতকার্য বানায়, আর যে ব্যক্তি সুলতানী বা পবিত্র নজরে অবলোকন করে সে
পুণ্যবান ও সৌভাগ্যের অধিকারী হয়। যেমন মা-বোনদের প্রতি পবিত্র দৃষ্টিতে
দেখাকে সুলতানি নজর বলে। সুলতানি নজরের নিকট গোস্তাখী নজর পরাজয় বরণ করে
এবং এ কারণে নফ্সানি চোখ সুলতানি নজরের নিকট বেকার হয়ে যায়। হযরত মা হাওয়া
বেহেশতের অন্যতম শ্রেষ্ঠা হুর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নাম শুনলে কোনো নিকৃষ্ট
ব্যক্তিরও অসৎ ইচ্ছা জাগে না। অনুরূপভাবে উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা
সিদ্দিকা (রাঃ) এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও অনুরূপ অন্যান্যদের নাম শ্রবণ
করলেও যে অবয়ব ও চেহারা খেয়াল হয় তা নিচু ব্যক্তিত্বের খেয়ালকেও দূষিত করে
না, বরং এ সময় যে আকৃতি ও চেহারা খেয়াল হয় তা উৎকৃষ্টতর হয়। আর তাঁদের
প্রতি কারও অকৃত্রিম আন্তরিক মহব্বতের কারণে তাদের কেউ যদি গায়েব হতে কাকেও
দর্শন দান করেন তাহলে তা সৌভাগ্য আনয়ন করে এবং এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে
পারে না।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি তাদের কাউকে স্বপ্নে দেখে তা হারাম নয়
বরং সৌভাগ্যের বিষয় এবং শুভ লক্ষণ। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি তাদের কাউকে
স্বপ্নে দেখে যে, তাঁরা তাকে নিজ স্তন থেকে দুধ পান করাচ্ছেন, তাহলে সে
ব্যক্তি রুগ্ন থাকলে রোগ থেকে মুক্তি পাবে অথবা মহা বিপদ থেকে মুক্ত হবে
অথবা অলী বা কামেল হয়ে যাবে। দেখা তিন প্রকারÑ চক্ষু দ্বারা দেখা, স্বপ্নে
দেখা এবং কাশ্ফ দ্বারা দেখা। চোখের দেখা হলে তখনই হারাম যদি তাতে অপরাধের
আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে মা, বোনকে দেখাও হারাম, অন্যথায় হারাম নয়। যেমন
কোনো ছোট শিশু বা বৃদ্ধ পুরুষ যারা ফেৎনা হতে পাক এবং কামমুক্ত, তাদের কোনো
বেগানা নারীর প্রতি নজর করা দোষের নয়। স্বপ্ন বা কাশ্ফ দ্বারা দেখা হারাম
নয় কিন্তু অপরাধ মনে দেখা অন্যায়। তবে কাশ্ফের অবস্থায় অপরাধ চিন্তা থাকেই
না।
এছাড়া প্রয়োজনে অপরিচিত কোনো নারীর মুখোমুখি হওয়া বা কথা বলা বৈধ।
যেমন কোনো নারী যদি ওস্তাদের কাছে নামাজ, রোজা, কোরান প্রভৃতি শিখতে চায়,
তাহলে তার উচ্চারণ ও বাগধারা শিক্ষার জন্য তাকে উচ্চঃস্বরে ওস্তাদের সাথে
কথা বলতেই হবে। তা না হলে তার পড়া শুদ্ধ হবে না। অনুরূপ পাক-পবিত্র, মাসিক ও
গর্ভ, মণি-মজি এবং সাবালকত্ব ও নাবালকত্ব সম্পর্কে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া
জায়েয। অনুরূপভাবে কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য হাকিম বা শালিসের দরবারে
হাজির হওয়া ও মুখোমুখি কথা বলা বৈধ। তেমনি পরকালের অভিভাবক বা নিজ
মুর্শিদের সামনাসামনি হওয়া কোনো অন্যায় নয়। কারণ শিক্ষার্থী সর্বদাই পীরের
সামনে থাকে। শারীরিক-মানসিক কোনো অবস্থাতেই বাতেনী অলীর দৃষ্টি থেকে আড়াল
হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং জাহেরী দৃষ্টিতে দেখা কেন অপরাধ হবে? দেখো! সকল
দৃষ্টির আড়াল হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদই হলেন পরকালের অভিভাবক
এবং হাকিকী পিতা। জন্মদাতা পিতা অপেক্ষা হাকিকী পিতা তথা মুর্শিদের মর্যাদা
অনেক বেশি। তোমাদের মধ্যে দুনিয়াদার বহু মুত্তাকি ও পরহেজগার আছে, কিন্তু
এমন কেউ নেই যে, খেয়ালের দৃষ্টিতে সব কিছুর চিন্তা করে না। সুতরাং চোখের
দৃষ্টিকে তখনই অন্যায় জ্ঞান করা হবে যখন সে দেখার সাথে বদখেয়াল সংযুক্ত
থাকে। এটাই “হল্লত-এ-গাই” বা দোষের কারণ। সূফীদের জন্য অন্যায় চিন্তা
মরণবিষতুল্য। জাহেরী শরিয়তের বিধানে এটা নিষেধ ও হারাম। এজন্য নিজ বিবির
সাথে সহবাস করার সময় যদি স্বীয় স্ত্রীকে অপর কোনো স্ত্রীলোকের মতো খেয়াল
করে তাহলে তাও হারাম।
আওয়াজমাত্রই হারাম নয়। কোনো কোনো সময়ে আরবে নারীরা
উলুধ্বনি প্রদান করে এবং অসংখ্য পুরুষ তা শোনে, এটাকে তো হারাম করা হয়নি।
স্বয়ং হযরত মা ফাতেমা (রাঃ) থেকে উলুধ্বনি প্রমাণিত। বোখারী শরীফে এর
প্রমাণ রয়েছে। মুত্তাকিদের জন্য হৃদয়গ্রাহী এবং মধুর আওয়াজ প্রয়োজনীয়।
যদি
নারীর সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী আওয়াজ পরিত্যাজ্য হয়ই, কিন্তু উলুধ্বনি ও
অয্দের আওয়াজে তা নেই। আর থাকলেও অয্দের অবস্থা শোরগোলের আকারে এবং
উলুধ্বনি হয় সম্মিলিতভাবে, এ জন্য ব্যক্তিগত সুন্দরের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে
না। আর ধরা পড়লেও উলুধ্বনি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। নারী পুরুষ উভয় হতেই
অপরাধ ঘটে এবং এ উভয়ের কামভাবই অপরাধ ঘটায়। সুতরাং নারীদের জন্য উচ্চ আওয়াজ
করা হারাম হলে তাদের জন্য অন্য পুরুষের আওয়াজ শোনা হারাম হবে না কেন? অপর
পুরুষের প্রতি তাকানোও তো নারীদের জন্য হারাম হবে।
এর উত্তর কী? তাহলে
কি পুরুষের জন্যও পর্দা ফরজ হবে, না কু-প্রবৃত্তি হতে বাঁচা ফরজ হবে?
কিন্তু পুরুষদের জন্য লজ্জা নিবারণ ছাড়া অন্য কোনো পর্দা ফরজ নয়। তেমনি
আল্লাহ্্র অলীদের জন্যও নিয়ম আলাদা চাই সে অলী নারী বা পুরুষ হোক। জাহেরী
শরিয়তের দৃষ্টিতে তাঁদের কোনো কাজ যথা উচ্চ আওয়াজ নিষিদ্ধ বলে মনে হলেও
মূলত এগুলো নিষিদ্ধ নয়। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্্্র মহব্বতে অথবা পরকালীন
শাস্তির ভয়ে নামাজে উহ্-আহ্ শব্দ করে অথবা উচ্চস্বরে কাঁদে তাহলেও নামাজ
নষ্ট হবে না। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। এতে কারোরই গুনাহ্ হবে না বা
নামাজ বাতিল হবে না বরং বিশেষ পুণ্য হবে এবং নামাজ হবে পরিপূর্ণ। সুতরাং
আল্লাহ্্্র জিকির ইত্যাদিতে অনুরূপ কাজ হলে কী ক্ষতি আছে? যারা বলে যে,
নারীদের উচ্চ আওয়াজ করা নিষিদ্ধ, এ কারণে তাদের জন্য আজান ও এক্বামত
প্রয়োজনীয় হয়নি। তাদের স্মরণ থাকা উচিত, প্রকৃতপক্ষে পুরুষদের জন্যও
আজান-এক্বামত সর্বদা ওয়াজিব নয়। শুধু জামাতের জন্যই তা ওয়াজিব এবং জামাত
ছাড়া মুস্তাহাব মাত্র। আর মুস্তাহাব ফরজ ও ওয়াজেবের মোকাবিলায় দলিল হতে
পারে না। বরং এ থেকে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করা শরিয়ত বিরোধী, ধোকা এবং
আল্লাহ্্র প্রেমিকদের বিভ্রান্ত করার শামিল।
ঈমানের বর্ণনা
ঈমান
অন্তরের এক অবিচ্ছেদ্য প্রত্যয় বা বিশ্বাস। এ বিশ্বাস ঈমানদারের অন্তর থেকে
কখনও বিচ্ছিন্ন হয় না। যে প্রত্যয় বা বিশ্বাস হৃদয় থেকে আলাদা বা
বিচ্ছিন্ন হয় তা ঈমানের সংজ্ঞার আওতা বহির্ভূত। ঈমানদারের হৃদয় ও অন্তরই
ঈমানের স্থান। এখানেই বিশ্বাস ও ঈমান অবস্থান করে। ঈমানের স্থানেই সব রকম
বিশ্বাস বিকাশ লাভ করে। বিশ্বাসের বিকাশের পরিপূর্ণতার পার্থক্যের দরুনই
ঈমানের স্তরে মানসগত পার্থক্য অনুভূত হয়। বিশ্বাস ঈমানের স্থানে আবর্তিত
হলে তাকে ঈমানভুক্ত বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈমান একটি পবিত্র বিশ্বাস। এতে
অজ্ঞতা ও বিস্মৃতির কোনো অবকাশ নেই। ঈমান তৌহিদে বিশ্বাসী মো’মিনের অন্তরকে
‘যাতে ইলাহী’র বা ‘ঐশী সত্তা’র সঙ্গে মিলনে মিত্রতা ও বন্ধুত্বময় করে
তোলে। এটা না কোনো কলেমা ও বাক্য, আর না কোনো মৌখিক স্বীকৃতি, না কোনো
কোরান-কিতাবের নাম না কোনো ইজমা-কিয়াছও। এর বৃদ্ধি কম হয় না। বরং ঈমান একটি
‘তাওহীদী’ নূর। জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থাতে তা ঈমানদারের সঙ্গে অবস্থান করবে
এবং হাশরেও তা তার সাথেই থাকবে। তার স্বীয় কৃতকর্ম এরই সাথে যুক্ত হবে।
কিন্তু হাশরে যে আমলনামা আবেদদেরকে দেয়া হবে তা বিচারের নিয়ম অনুযায়ী,
দ্বীনদারীর নিয়ম অনুযায়ী নয়। দ্বীনদারী প্রমাণের জন্য যদি আমলনামা প্রদান
করা হত তাহলে নবী ও অলীগণকে তা দেওয়া হত। হিসাব কিতাবের জন্য আমলনামা
প্রয়োজন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নবী-অলীগণ হিসাব থেকে মুক্ত। আমলনামা হোক আর
নাই হোক বরং সুরক্ষিত ফলকে অলৌকিক অক্ষরে সমস্ত কর্ম বিস্তারিত লিপিবদ্ধ
রয়েছে। কাগজ ও কিতাব হচ্ছে এর অবয়ব ও পরিচিতি। অক্ষর ও শ্রুতলিপি হচ্ছে এর
চরিত্র ও গুণাবলি। ঈমানদার ব্যক্তি নিজের মধ্যেই তাঁর ঈমান ও আমলের সন্ধান
পাবে। কাগজ ও কিতাব ঈমান দ্বারা তাঁর কোনো বিশ্বাস লাভ হবে না এবং শ্রবণ
করে বা সাক্ষীর দ্বারাও ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। বরং বান্দা তার স্বীয় সত্তা ও
তৎক্রিয়াদির দ্বারাই ঈমানদার হবে। মৌখিকভাবে স্বীকার করা, অন্তরে তা’ সত্য
জানা ঈমানের রোকন নয়। কেননা তাসদিক (আন্তরিক বিশ্বাস) নিজেই ঈমানের
সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। তা হলে কী করে তা ঈমানের রোকন হতে পারে? এ অসম্ভব।
এখন অবশিষ্ট রইল মৌখিক স্বীকৃতি, এটাও ঈমানের কোনো সম্পর্কের সাথে সংযুক্ত
নয়। লক্ষ করুন, যার মৌখিক স্বীকৃতি আছে কিন্তু আন্তরিক বিশ্বাস নেই সে
আল্লাহ্্র নিকট কাফের। সুতরাং মৌখিক স্বীকৃতি কী করে ঈমানের রোকন হতে পারে?
অতএব রহস্যময় অবস্থাসমূহ ও কামালিয়াত বা পরিপূর্ণতাই ঈমানের রোকন হিসেবে
গণ্য।
তাস্দিক বা আন্তরিক বিশ্বাস দু প্রকার। প্রথমত আল্লাহ্্র প্রতি
বিশ্বাস করা। এ তাস্দিক বা বিশ্বাস আল্লাহ্্্র গুণাবলির সাথে সংযুক্ত হলে
ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে দৃঢ় জ্ঞানের অধিকারী হয়। এ সময়ে সে মুমেন।
বিশ্বাসের জ্ঞানের সিফাতের বৃত্তের মধ্যে সে অবস্থান করে। একারণেই এ ধরনের
ঈমানকে ‘তাসদিকে ইল্লাল্লাহ্’ বা আল্লাহ্্্র প্রতি বিশ্বাস বলা হয়। এ সময়
আল্লাহ্্্ তায়ালার মহিমার সাথে এ ঈমানের পরিপূর্ণতা লাভ হয়। এ জন্য এ
ঈমানকে, ‘ঈমান বিল গা’য়েব-এ-শুহুদী’ বলা হয়। আল কোরানে ঈমান বিল গায়েবের যে
বর্ণনা আছে তার দ্বারা ‘ঈমান বিল গায়েব-এ-শুহুদী’ বোঝানো হয়েছে। এটা ‘ঈমান
বিল গায়েব-এ-তাকলিদীর’ বিপরীত। তাকলিদী ঈমানের ভিত্তি শোনা খবর। সত্য
সংবাদদাতার আহ্বানের ভিত্তিতে ঈমান গঠিত। সে সংবাদে আল্লাহ্্্ তায়ালার ওপর
ঈমান লওয়ার জন্য ইশারা করা হয়েছে। এ জন্যই একে তাকলিদী ঈমান বলা হয়। অথচ
ঈমানে তাকলিদী যথার্থ ঈমান নয়। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্্্র সাথে তাস্দিক। এ
তাস্দিক একাত্মতার ভিত্তিতে অর্জিত এবং তা স্বয়ং সত্তায় প্রতিষ্ঠিত। সত্তার
সঙ্গে গুণাবলি থাকলেও স্বয়ং সত্তাই এর লক্ষ্য।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে,
উক্ত বক্তব্যের দ্বারা কেবল স্বয়ং সত্তার ওপরই ঈমান আনার কথা বোঝানো হচ্ছে
তা নয় বরং ঐকাত্ম ঈমানের মধ্যে অনুভূত ও অননুভূত উভয় জগৎ অন্তর্ভুক্ত।
কোরান শরীফ এবং অলীদের কিতাবও এর মধ্যে শামিল। কারণ এ দৃঢ় ঈমান সঠিক
বিশ্বাসসূত্রে অর্জিত।
একাত্মতা প্রাপ্তির পর ঈমানের স্তর অতিক্রম করে
যায় এবং একীন অবশিষ্ট থাকে। এ স্তরেই হাকীকতপন্থীদের ইবাদত শেষ হয়ে যায়।
আল্লাহ্্্ বলেন, وأعبد ربك حتى يأ تيك اليقين(ওয়া’বুদু রাব্বাকা হাত্তা
ইয়া’ তিকাল ইয়াক্বীন) অর্থাৎ “বন্দেগি কর তোমরা রবের একীন অর্জিত হওয়া
পর্যন্ত।” এর পর ‘র্ইফান’ তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের স্তর। আরিফদের জন্য ইরফান
ব্যতীত কোনো ইবাদত নেই। আরিফদের কোনো কাজ, বাহ্যত ইবাদত মনে হলেও তার
মর্মার্থ তাওহীদ। আর তাওহীদ অর্জনের পর ইবাদত করা কুফ্রী। (নাউযুবিল্লাহ্
মিন্হা)। এ জন্যই হযরত গাউছুল আজম বলেন, من اراد العبادة بعد الوصال
فهوكافر (মান্ আরাদাল ইবাদাতা বা’দাল্ বিছালি ফাহুয়া কাফিরূন্)। আবেদদের
ইবাদাতের লক্ষ্য অজ্ঞাত অজানা আল্লাহ্্্। এজন্য আবেদদের নাম জাহেল বা
মূর্খ। আরিফদের লক্ষ্য মা’রেফাত বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও তাওহীদ বা ঐকাত্মতা। এ
জন্য তাদের আরিফ বলা হয়।
শরিয়তের বর্ণনা
শরাহ্ বা ধর্মের
রীতিনীতি তিনটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যথাÑ ঈমান, ইসলাম ও এহ্সান। ঈমান হল
এমন এক ধরনের প্রত্যয় বা বিশ্বাস যাতে কোনো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ
নেই। ইসলাম হল দ্বীনের বহু শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট বাহ্যিক রূপ। অর্থাৎ ইসলাম
বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উল্লেখিত ইসলাম দ্বারা বাহ্যিক
রীতিনীতি বোঝায়। এ ইসলাম মুসলিমদের বিভিন্ন মাজহাব দ্বারা বিভক্ত। কিন্তু
মূল ইসলামে কোনো দ্বিধা-বিভক্তি নেই। একেই এহ্সান বলা হয়। এখানেই ইসলামের
পূর্ণতা ও মহত্ত পরিস্ফুটিত। এর বিষয়বস্তু হল, অন্তর ক্রিয়া। তাই অন্তর
ক্রিয়া দ্বিধামুক্ত এবং সন্দেহের অতীত। কারণ এর লক্ষ্য তাওহীদ এবং তাওহীদের
প্রকৃতি হল তাকওয়া। সুতরাং এ পথে দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের স্থান নেই। এর স্তর ও
পদ্ধতিতে বিভিন্নতা পরিদৃষ্ট হলেও এহ্সানই হচ্ছে এর মূল। এহ্সানের সমগ্র
ভূমিকাই কল্যাণকর এবং পবিত্র। এরই নাম কামালিয়াত ও বুজুর্গি। সুতরাং এতে
দ্বিধার স্থান নেই। তবে এ ক্ষেত্রে স্তরে স্তরে পার্থক্য হতে পারে। এ কারণে
এহ্সানওয়ালাদের মৌল উপাদান অভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা আপসে একই ব্যক্তি
তুল্য। এহ্সান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কর্ম বিশুদ্ধ হতে পারে না। তাই
প্রত্যেক ব্যক্তির ওপরই এহ্সান ‘ফরজে ওয়াজিবী’। যাতে করে ইসলামের দ্বিধা
বিভক্ত বিদূরিত হয়ে যায় এবং এতে পূর্ণতা প্রতিষ্ঠিত হয়, মানুষ বিভ্রান্তি
থেকে মুক্তি পায় এবং গূঢ় সত্তাকে সে নিজের মধ্যে অনুভব করে। এ জন্যই ‘শামী’
প্রভৃতি কিতাবে এহ্সান শিক্ষাকে ফরজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ শিক্ষা থেকে
বঞ্চিত ব্যক্তি কাফের হয়ে মরার আশঙ্কা রয়েছে, এবং যে তা অস্বীকার করে সে
ব্যক্তিও কাফের। জিব্রাঈলের এ বাণী দ্বারাও এর ফরজ প্রমাণিত হয়। যথাÑ ان
تعبد الله كانك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك (আন্ তা’বুদাল্লাহা কা
আন্নাকা তারাহু ফাইঁল্লাম্ তাকুন তারাহু ফাইন্নাহু ইউরাকা) অর্থাৎ, “তুমি
এমনভাবে আল্লাহ্্্র বন্দেগি কর যেন তাঁকে প্রত্যক্ষ করছ।” এর অর্থ হল
বান্দা যখন ছায়ারূপে আল্লাহ্্্র নৈকট্য গুণের সান্নিধ্যে পৌঁছে তখন
কাশ্ফের দৃষ্টি দিয়ে সে যেন স্রষ্টাকে অবলোকন করে, আর এ দৃষ্টি মৌল, অমৌল
কোনোটাই নয়। আর তা না হলে তিনি তো তোমাকে দেখছেনই। অর্থাৎ, বান্দা যখন মগ্ন
অবস্থায় থাকে তখন কাশ্ফ শক্তি তাকে আল্লাহ্্্র বৈশিষ্ট্যের দিকে আকৃষ্ট
করে। এ অবস্থায় বান্দার প্রতি যখন আল্লাহ্্্র দয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, তখন
যে ব্যক্তি অযোগ্য সে এ মহাক্ষণকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। আর বান্দা যখন
ইবাদতের স্তর অতিক্রম করে যায়, তখন আল্লাহ্্্র সত্তার সঙ্গে শুধু তাঁর
‘নজরে নফ্সি’ বাকি থেকে যায়, যা ঈমান ও এহ্সানের বহির্ভূত। এর নামই
মুত্তাহিদ বা ঐকাত্ম্য।
ঈমানে তাকলিদী ও ঈমানে তাহ্কিকী
ঈমানে
তাকলিদীকে ঈমানে ইসলামি বলা হয়। এটা নামের ঈমান, আসল ঈমান নয়। এ সম্বন্ধে
আল্লাহ্্্ বলেন, Ñ قالتالا عراب امنا قل لم تؤ منوا (কালাতিল আ’রাবু আমানা
কুল্লাম্ তু’মিনু) (২৬ পারা, সূরায়ে হিজরত) অর্থাৎ, “বেদুঈনরা বলে, আমরা
ঈমান এনেছি; বলে দিন, তোমরা ঈমান আননি।” কেননা ঈমান শুধু মৌখিক স্বীকৃতি নয়
বরং আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাসই ঈমান। সুতরাং তোমরা মৌখিক স্বীকৃতি দিয়েছ,
কিন্তু আন্তরিক বিশ্বাস করনি। অথচ বল যে, ঈমান এনেছ। ولكن قولوا اسلمنا
(অলাকিন কূলু আস্লামনা) অর্থাৎ, “বলুন যে, তোমরা বল ইসলাম গ্রহণ করেছ।”
জাহেরী শরার নিয়মকানুন অনুযায়ী তোমরা ঈমানদার। কিন্তু কতিপয় মুসলমানী
চাল-চলন, কিছু হারাম-হালালের মসলা শিক্ষা করা অথবা বাহ্যিক ইবাদত দ্বারা
ঈমানদার হওয়া যায় না। মুসলমান ছাড়াও হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায় রয়েছেÑ
যারা অনেক মুসলমান রীতিনীতি অনুসরণ করে। বহু নাপাক ও হারাম বস্তু পরিহার
করে চলে এবং অনেক ভালো কাজ করে। যেমনÑ দান খয়রাত করা, অনাথ ও বন্দীদের
প্রতি দয়া দেখানো, মিথ্যা কথা না বলা, ন্যায়ের লক্ষ্যে কাজ করা, অন্যায়কে
ঘৃণা করা, চুরি, ব্যভিচার পরিহার করে চলা এবং অহঙ্কার ও মিথ্যা প্রবঞ্চনা
না করা প্রভৃতি। অনুরূপ পানাহারের ক্ষেত্রেও বহু সাদৃশ্য রয়েছে। যেমনÑ
মুসলমানদের মতো তারাও শূকর, কুকুর প্রভৃতি খায় না। এভাবে পাক নাপাকের
ব্যাপারেও তারা মুসলমানদের অনুসারী। যেমনÑ নাপাক দূরীকরণের সাবানের ব্যবহার
করা এবং অপবিত্র অবস্থায় গোছল করা, পায়খানা-পেশাব করে শৌচ করা,
পোশাক-পরিচ্ছদ পাক পবিত্র রাখা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা প্রভৃতি। মুসলমানরা
যা খায় তারাও তা খায়। যেমনÑ রুটি, দুধ, ঘি, তরিতরকারি, ডাল, ফল-মূল
ইত্যাদি। এমন কি মুসলমান যে যে মাছ খায় তারাও সে সে মাছ খায়। বিবাহশাদির
ক্ষেত্রেও মুসলমানদের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মুসলমানদের জন্য যে সকল
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহশাদি নিষিদ্ধ তারাও সে সকল আত্মীয়দের
বিবাহশাদি করে না। মুসলমানরা যেমন জবানি কিতাব বা আম্বিয়া ও রাসূলদেরকে
উত্তম জ্ঞান করে, তারাও তাঁদেরকে উত্তম জ্ঞান করে এবং মুখে কলেমা পাঠ করে।
সুতরাং তোমরাও অনুরূপ ইসলাম গ্রহণ করেছ। কেননা ولما يدخل الايمان فى قلوبكم
(অলাম্মা ইয়াদ্ খুলুল্ ঈমানু ফি কূলূবিকুম) অর্থাৎ, “তোমাদের অন্তরে ঈমান
প্রবেশ করেনি।” অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান অন্তরে প্রবেশ না করবে, ততক্ষণ
পর্যন্ত সে শুধু মুসলমান নামে আখ্যায়িত হবে, মোমেন হবে না। সুতরাং ঈমান ও
ইসলামের মধ্যে ব্যবধান অনেক। ‘ঈমান বিল গায়েব’ তথা অদৃশ্যে বিশ্বাসকে ঈমানে
ইসলামী বলা হয়। তাই এ সম্পর্কে আল্লাহ্্্ বলেনÑ يا ايها الذين امنوا امنوا
(ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানু আমিনু) অর্থাৎ “হে লোক সকল! যারা ঈমান এনেছ ঈমান
লও।” তথা ‘ঈমান-এ-তাকলিদী’ অতিক্রম করে ঈমান-এ-তাহ্কিকী তথা আসল ঈমান
অর্জন কর। কেননা অদৃশ্যে বিশ্বাসী প্রাথমিক মোমেন, সে এখনও চূড়ান্ত সীমায়
পৌঁছেনি। এ কারণেই আল্লাহ্্্ বলেন,هدى للمتقين الذين يؤمنون بالغيب
(হুদাল্লিল্ মোত্তাকী নাল্লাজিনা ইউ’মিনুনা বিল্গায়িব) “অর্থাৎ, সে সকল
মুত্তাকী তথা সাবধানীদের জন্য হেদায়েতকারী বা পথ প্রদর্শক, যারা অদৃশ্যে
ঈমান এনেছে।” সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে অদৃশ্যে বিশ্বাসীগণ এখনও হেদায়েত
পায়নি। কারণ অদৃশ্যে বিশ্বাসীদের অন্তরে আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস নেই। কোরানের
সাহায্যে তারা হেদায়েত বা পথের সন্ধান পাবে-কি করে ঈমান অন্তরে প্রবেশ
করাতে হয়, অন্তর কি, অন্তরের বিশুদ্ধতার জন্য কোন জ্ঞান প্রয়োজন ইত্যাদি। এ
কথার সমর্থনে আল্লাহ্্্ বলেন, قد افلح من تزكى (ক্বাদ আফলাহা
মান্তাজাক্কা) “অবশ্যই কল্যাণ লাভ করেছে সে ব্যক্তি, যে স্বীয় নফ্সকে
পবিত্র করেছে।” অর্থাৎ, হুজুরী ইল্মে সরঞ্জাম দ্বারা স্বীয় কল্ব তথা
অন্তরকে পরিষ্কার ও প্রশস্ত করে, তাতে ইল্মে আহওয়াল ও কাশ্ফ হাছিল করেছে,
সে-ই কল্যাণ লাভ করেছে। তাই আল্লাহ্্্ বলেন, ومن تزكى فانما يتزكى لنفسه
(অমান্ তাজাক্কা ফাইন্নামা ইয়াতাজাক্কা লিনাফ্ছিহি) অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি
পবিত্র হয়েছে গুনাহ্ ও অন্ধকারাচ্ছন্নতা হতে, সে তা হয়েছে শুধু নিজের
নফ্সের জন্য।” আল্লাহ্্্ বলেনÑ الى الله المير (ইলাল্লাহিল্ মাছীর) অর্থাৎ,
“আল্লাহ্্্র দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” একেই বেলায়েত তথা সাধকের পথ
বলে। এ পথে পরম সত্তার প্রতি নিমগ্ন হতে হয়। কিন্তু এতে সাধনা ও কর্মাদির
প্রয়োজন রয়েছে, যথাÑ নফ্সের বিশুদ্ধায়ন অর্থাৎ নফ্সের মধ্যে আনুগত্যের
চরিত্র সৃষ্টি করা এবং নফ্সের প্রকৃতি হতে সাবধান হয়ে যাওয়া। আর এরই নাম
নফ্সকে মেরে ফেলা। এটাই ত্বরিকতের জাহেরী বিধানের আসল ও বাতেন। সব
ভিত্তিহীন ও তাৎপর্যহীন কাজই নিষ্ফল। তাই আল্লাহ্্্ তায়ালা বলেনÑ فاذا فرغت
فانصب والى ربك فارغب (ফাইজা ফারাগ্তা ফান্ছাব্, অইলা রাব্বিকা র্ফাগাব্)
অর্থাৎ, “হে মুহাম্মদ (সাঃ)! আইন কানুনের প্রচার হতে অবসর হলে চিত্তকে
স্থির করে তোমার প্রতিপালকের দিকে মনোযোগী হও।” অর্থাৎ আল্লাহ্্্র প্রতি
নিবিষ্ট ও নিমগ্ন হয়ে যাও। এটাই ত্বরিকতের পথ। এ আয়াতে “ইল্লা” শব্দ দ্বারা
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অভ্যন্তরীণ গুণাবলির দিকে নির্দেশ করা হয়েছে, যাতে
প্রেম, ভালোবাসা, জয্বা, মা’রেফাতের চেতনা ও দোজাহানের কাশ্ফ বিকশিত।
অন্তরের জ্ঞান এবং নবীদের উত্তরাধিকার ও পরকালীন সম্বল এটাকেই বলা হয়। এর
চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিপালক। অর্থাৎ, “ফানাফিল্লাহ্” এবং
“বাক্বাবিল্লাহ্” বা আল্লাহ্্্তে অধিষ্ঠান।
অতএব জাহেরী শরীয়তের যেখানে
শেষ, সেখান থেকেই ত্বরিকতের শুরু। অন্যের সমাপ্তি বা শেষান্ত থেকে যার
সূচনা তার সীমানা অনেক ব্যাপক ও বিশাল। ভূকেন্দ্রের সীমা যেখানে শেষ আকাশের
সীমা সেখান থেকে শুরু। এ জন্যই দুনিয়ার তুলনায় আকাশ অনেক প্রশস্ত। এ
নিকটস্থ আকাশের তুলনায় তার উপরের আকাশ আরও অনেক বড় ও বিশাল। এ সকল আকাশের
তুলনায় র্আশে আজিম আরও বিশাল ও প্রশস্ত। প্রকৃতপক্ষে আরশ, কুরসী, আকাশ,
পৃথিবী এবং যা কিছু আকাশে রয়েছে এসব মিলিয়েই সৃষ্টিজগৎ। আরশের সীমা যেখানে
শেষ, সেখান থেকেই শুরু হল আলমে আমর যাকে ‘আলমে মালাকুত’ তথা ফেরেশ্তার জগৎ
বলে। এর তুলনায় আলমে খালক্ তথা সৃষ্টিজগৎ একটি বিন্দুর মতো। এরপর শুরু
হচ্ছে আলমে জব্রূত তথা রূহের জগৎ। রূহের জগতের তুলনায় ফেরেশ্তার জগৎ একটি
বিন্দুর মতো। অনুরূপভাবে যে জগৎ যত বড় তার আকৃতি প্রকৃতি ততই ব্যাপক ও
বিশাল হবে। আর তার কর্মকান্ড, নিয়ম-কানুন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদিও ব্যাপক
এবং বিস্তৃত হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলেনÑ (শেখ সাদীর ভাষায়)
আগার একছের মোয়ে বরতরাম,
ফরুগেতাজাল্লি বছুজাদ পরাম।
অর্থাৎ,
উক্ত স্তরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এরও প্রবেশের অধিকার নেই এবং অধিকার নেই
তাঁর ঐশী জ্যোতির এলাকাকে অতিক্রম করার আর তথাকার অবস্থা জানার। তাই
জিব্রাঈল (আঃ) থেকে গেলেন এবং অগ্রসর হতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। অতএব
জাহেরী নবুয়ত ও তার আদেশ নিষেধ সম্পর্কে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) অবগত আছেন,
যাকে ‘নবুয়তে জিব্রাঈল’ বলে। তাই ইল্মে ছফিনার সঙ্গে সংযোগ রাখে। নবুয়ত,
বেলায়েতের শাখা- প্রশাখা। বেলায়েতের তুলনায় ‘নবুয়তে জিব্রাঈল’ একটি রূপক
বিন্দু বিশেষ। এ কারণেই বেলায়েতের দ্বারা অন্যান্য নবী, রাসূল এবং অন্যান্য
পয়গম্বরদের কিতাব রহিত হয়ে যায়। কিন্তু বেলায়েত রহিত বা মানসুখ হয় না।
কেননা বেলায়েতই হল নবুয়তের মূল ও হাকিকত। তাই নির্দেশ হলÑ اهد نا الصرط
المستقيم صراط الذين انعمت عليهم (ইহ্দিনাছ্ ছিরাতাল্ মুছ্তাকীমা
ছিরাতাল্লাজিনা আন্আম্তা আলাইহিম্) অর্থাৎ, “দাও আমাদেরকে এমন সরল ও উত্তম
পথ, যে পথে আমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে নিয়ামত দান করেছ, যে পথ পরিত্যক্ত ও
বাতিল হয় না বেলায়েতের দিক হতে।” কেননা এটাই তাওহীদ। আর তাওহীদের ক্ষয় লয়
নেই। সকল নবী ও অলীদের তাওহীদ একই এবং এ পথেই ঈমানে হাকিকী তথা প্রকৃত ঈমান
অর্জিত হয়। এ জন্যই ইল্মে একীন এবং ইল্মে ঈমানের ক্রিয়াদির যথার্থ স্থান
হচ্ছে অন্তর। অন্তরের বিশুদ্ধায়ন ছাড়া আন্তরিক কর্মতৎপরতা অসম্ভব। আর অন্তর
বিশুদ্ধ না হলে তাতে ঈমান প্রবেশ করতে পারে না। অপর দিকে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও
সরঞ্জাম ছাড়া অন্তরের বিশুদ্ধায়ন ও পবিত্রকরণ অসম্ভব। আর মুর্শিদের উছিলা ও
শিক্ষা ব্যতীত উপকরণ ও সরঞ্জামাদি পাওয়া যায় না। তাই তো আল্লাহ্্্ তায়ালার
নির্দেশ হলÑ فا سنلو هل الذكر انكنتم لا تعلمون ফাস্আ’লু আ্হলিজ জিক্রি
ইন্কুন্তুম লা তা’লামুন) অর্থাৎ, “যদি তোমরা না জান তাহলে জিকিরকারীদের
কাছে জিজ্ঞাসা কর।” এতে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্্্র জিকিরই হল অন্তরের
বিশুদ্ধায়ন ও পবিত্রকরণের উপকরণ এবং সরঞ্জাম। রাসূল পাক (সাঃ) এরশাদ
করেছেন, لكل شئ صيقلة وصيقلة القلب ذكر الله লিকুল্লি শাইয়িন ছাইক্বালাতুন অ
ছাইক্বালাতুলÑ ক্বলবি জিক্রুল্লাহ) অর্থাৎ, “প্রত্যেক বস্তু পরিষ্কার করার
জন্য রেত রয়েছে। অন্তর পরিষ্কার করার রেত হল আল্লাহ্্্র জিকির।” যেহেতু
কোরানে আল্লাহ্্্ বলেছেন, জিকিরকারীদের কাছে জিজ্ঞেস করার জন্য সেহেতু
তাঁদের নিকট জিজ্ঞাসা ব্যতিরেকে নিজ ইচ্ছায় জিকির করাও যথেষ্ট নয়। এখানে
জিজ্ঞাসা করার অর্থ তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তাঁদের মধ্যে বিলীন হয়ে
যাওয়া। অলী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। মুর্শিদের
প্রতি আকৃষ্ট হলে তিনি তাকে পথ দেখাবেন এবং ঈমানে তাকলিদী থেকে উতরিয়ে নিয়ে
যাবেন।
অন্তরের গভীরে অবস্থিত ঈমানের স্থানে ঈমান প্রবিষ্ট না হলে তা
চিরস্থায়ী হয় না। স্থানে স্থানে ঈমান বাতিল হয়ে যায় এবং কখনো কুফরির
পর্যায়ে পৌঁছে। ঈমান সম্পর্কে অজ্ঞতাই এর কারণ। আর এ কারণেই মোকাল্লিদ তথা
জাহেরি ঈমানদারেরা ঈমান নষ্ট হওয়া ও কুফরির মাছলাসমূহ জোরেসোরে বর্ণনা
করেছেন।
আক্ষেপ! ঈমান যাওয়া সহজ কথা নয়। অন্তর ভ্রান্ত ধারণা মুক্ত হলে
ঈমান নষ্ট হওয়ার চিন্তাও আসতে পারে না। এ জন্যই আল্লাহ্্্ তায়ালা বলেন,
ولايشرك بعبادة ربه احدا (অলা ইউশ্রিক্ বিÑ ইবাদাতি রাব্বিহি আহাদা)
অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্র ইবাদতে অন্যকে শরীক করো না।” তোমরা যখন জেনে গেছ যে,
আল্লাহ্্্র কোনো শরীক নেই, তখন তাঁর শরীক হবে কী করে? শরীক হতে হলেতো
সমকক্ষ ও সমশক্তিসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। এমতাবস্থায় অত্যন্ত দুর্বল ও অসহায়
সৃষ্টি যাকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন সে কি করে স্বয়ম্ভু সত্তার তথা
আল্লাহ্্্র শরীক হতে পারে? এটা তো সম্ভব নয়। যদি মন থেকে বল যে, আল্লাহ্্্র
শরীক হওয়া সম্ভব, তাহলে তুমি জাহান্নামী। তা না হলে মুখে বললেই শরীক হয়
না।
সৃষ্টির এমন কোনো শক্তি নেই যা দিয়ে নিজের শক্তিবলে আল্লাহ্্্কে
পরাজিত করবে। এটুকু যে বোঝে না কী করে সে আবেদ হয় এবং ইবাদত করে, এটাই
আশ্চর্যের কথা। ইবাদতে শরীক করার অর্থ হচ্ছে, ঈমানের স্থানে ভ্রান্ত ধারণার
অনুপ্রবেশÑ যাকে শরিয়তের ভাষায় অন্ধকার, রোগ ও পাপ বলে। এদের অন্তর্দৃষ্টি
তথা ঈমানের স্থানটি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তাই এদের মধ্যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা
পাওয়া যায় না। এ জন্য তারা অন্ধ হয়ে রয়েছে। যার চক্ষু নেই তার কাছে আলোময়
বিশ্বও অন্ধকারাচ্ছন্ন। এজন্যই আল্লাহ্্্ বলেন, وما أمروا آلا ليعبد الله
مخلصين له الدين (অমা উমিরু ইল্লা লি ইয়া’বুদুল্লাহা মুখ্লিছীনা লাহুদ্দীন)
অর্থাৎ, “তাদেরকে কি হুকুম করা হয়নি? তারা যেন আল্লাহ্্্র ইবাদত করে।”
এখলাছ তথা আন্তরিকতার সহিত যারা ইবাদত করে তাদের জন্যই ধর্ম। এ জন্য নিষ্ঠা
ব্যতিরেকে কোনো ইবাদত সঠিক হয় না। যদিও বাহ্যদর্শীরা তা জায়েজ তথা সঠিক
মনে করে। তাদের কোনো পার্থক্য বোধ নেই। কেননা তারা ইরফান তথা মারেফাত থেকে
বঞ্চিত। গোটা বিশ্ব সৃষ্টি অবলোকন করে অসংখ্য সৃষ্টির প্রতি তাকিয়ে তারা
মনে করে যে, এতে তাওহীদ অর্জিত হয় এবং কিতাব পাঠে আল্লাহ্্্ পাওয়া যায়। এটা
ভুল, কারণ সকল বস্তু থেকে দৃষ্টি ও চিন্তাকে মুক্ত না করতে পারলে একের
ধ্যান করা যায় না। আর একক সত্তার উপলব্ধির জন্য এক এর খেয়ালই যথেষ্ট। আর
এটাই তাওহীদ। এতে করে এক প্রতিষ্ঠিত হবে। এককে চেনা যাবে এবং এক-ই পরিদৃষ্ট
হবে। অতঃপর তা থেকে শত সহস্র দৃষ্টি প্রসারিত হবে। কেননা একের সত্তা থেকে
সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠা। তাই এক থেকে বহুর প্রমাণই তাওহীদ। বহু
দ্বারা এক প্রমাণিত হয় না। কারণ সমস্ত বস্তুই ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর। সুতরাং
যে ব্যক্তি বহু দ্বারা এককে প্রমাণ করে একেশ্বরবাদী হতে চায় সেও নশ্বর তথা
ধ্বংসশীল। এ কারণেই এক নশ্বর অন্য নশ্বরকে অনন্ত অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না।
এখানে লক্ষণীয়, আল্লাহ্্্ যদি অন্য কোনো বস্তু সৃষ্টি না করে কেবল মানুষ
সৃষ্টি করতেন অথবা চক্ষুহীন অন্ধ মানুষ সৃষ্টি করতেন তাহলে কী দেখে কিভাবে
তারা আল্লাহ্্্র ওপর ঈমান আনতো! চিন্তা করুন ইব্রাহীম (আঃ) যখন বিভিন্ন
বস্তু দেখছিলেন এবং বলছিলেন لا أحب الافلين (লা উহিব্বুল আফিলীন) অর্থাৎ,
“আমি এসব চাই না, যা ধ্বংস হয়ে যায়।” অতঃপর একের সন্ধান পেয়ে তিনি বললেন,
এসবই তোমার সৃষ্টি। এখন চিন্তা করা প্রয়োজন, যারা বস্তুসমূহের খেয়ালে
নিমগ্ন তাদের ঈমান ও একীন উভয়ই বরবাদ হয়ে যায়। তাদের ঈমান হাওয়ায় ভাসমান ও
সদা পরিবর্তনশীল, যখন তখন যত্রতত্র উড়ে বেড়ায়, অসংখ্য চিন্তায় আক্রান্ত এবং
গ্রন্থরাজির মধ্যে বিচরণশীল। তারা কী করে একের সন্ধান পাবে? তাদের তো কোনো
চেতনাই নেই। এ কারণেই জাহেরী মুসলমানদের কোনো প্রকৃত তাওহীদ নেই। আর
থাকলেও তা রূপক। এ কারণে এ সব নিরস মুসলমানগণ তাওহীদের কথা শুনলেই জ্বলে
উঠে।
জিকিরের বিবরণ
প্রথমত জিকির দু প্রকারÑ মৌখিক জিকির ও অন্তরের জিকির। মৌখিক জিকির আবার দু প্রকার, যথাÑ জলী তথা সরব ও খফি তথা নীরব। সরব জিকির হল জোরে জোরে মুখে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে জিকির করা। জলী তথা সরব জিকির আবার দু প্রকারÑ প্রথমত যথাসাধ্য উচ্চস্বরে জিকির করা। দ্বিতীয়ত মৃদু শব্দে জিকির করা। খফী তথা নীরব জিকিরও দু প্রকারÑ প্রথমত শব্দ মুখের ভিতর রেখে এমনভাবে উচ্চারণ করা যাতে কেবল জিকিরকারী নিজেই শুনতে পায় এবং অন্যে শুনতে না পায়। আর দ্বিতীয় হল নিজেও যেন শব্দ না শোনে। অন্তরের জিকিরও দু প্রকারÑ প্রথমত ‘হালী’ তথা আধ্যাত্মিক অবস্থাপ্রসূত। অর্থাৎ অন্তরের ভাষায় জিকির করার ফলে সৃষ্ট অবস্থার ঝংকারে দেহ ও মুখ প্রকম্পিত হওয়ার মাধ্যমে শব্দ উচ্চারিত হবে। এর ফলে কখনো কখনো বিভিন্ন ধরনের শব্দ শোনা যায়। প্রেম, জজ্বা এবং আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণাই এর উৎস। দ্বিতীয়ত ‘গায়ের-এ-হালী’ যা আধ্যাত্মিক অবস্থা প্রসূত নয়। এ জিকিরও অন্তরে হয়, তবে জিকিরকারী তা নিজে শোনে ও বোঝে। এজন্যই এ জিকিরের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেম যুক্ত থাকে এবং জিকিরকারী নিজের হাল সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। তবে সাধারণভাবে জিকিরের অর্থ স্মরণ করা। মন ও অন্তরই স্মরণের স্থান। আর মুখ হল বক্ষের দরজা ও নির্গমন পথ। অন্তরের উপরের আবরণকে ছদর তথা বক্ষ বলা হয়। যখন সজোরে ছদরের জিকির করা হয় তখন মুখ থেকে তার উত্তাপ বা প্রেমাবেগ বের হয়। এ কারণেই অনেক সময় শাব্দিক তথা মৌখিক জিকির কষ্টকর হয়। ‘জিকিরে ছদরিয়া’ তথা বক্ষের জিকির মুখ দ্বারা নিঃসৃত হয় বলে এ ক্ষেত্রে জলী তথা সরব জিকিরই উত্তম। এ জিকির দ্বারা অন্তরের উপরের আবরণ খুলে যায়, তাই এর কোনো সীমা নেই। কেননা বক্ষের অবস্থার সাথে মুখের আওয়াজ উচ্চ ও তীব্র হবে আর আওয়াজ অনুযায়ী শক্ত ও কঠিন মনে হবে। কারণ সকলের আওয়াজ এক প্রকার নয়। যেমন যার আওয়াজ মোটা ও ভারী সে যদি আস্তেও জিকির করে তবুও তা জোওে শোনা যাবে। কিন্তু অন্তরের উপাদান স্তরক্রমে ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানের জন্য নির্ধারিত। এ জন্য অন্তরই হল সমস্ত কাজ ও নির্দেশাবলীর নির্ধারিত লক্ষ্য। সুতরাং অন্তর ছাড়া কোনো ইবাদত ও জিকির হতে পারে না। আল্লাহ্্্ বলেন, ان فى ذالك لذ كر لمن كان له قلب اوالقى السمع وهو شهيد (ইন্না ফি যালিকা লাজিক্রুল্ লিমান্ কানা লাহু ক্বাল্বুন আও আল্ক্বাস্ সামা’অহুয়া শাহীদ) অর্থাৎ, “যার অন্তর আছে অবশ্যই কোরান তার জন্য জিকির। তার কান খোলা আছে এবং আন্তরিকতার সহিত হাজির আছে।” অর্থাৎ জাগ্রত অন্তরসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য কোরান হচ্ছে প্রকৃত জিকির ও দলিল। অনুরূপভাবে জাগ্রত অন্তরসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য নামাজও হচ্ছে জিকিরÑ الصلوة لذكرى (আচ্ছালাতু লিজিক্রি) অর্থাৎ “নামাজ আমার জিকিরের জন্য” আল্লাহ্্্র এ বাণীর মর্মার্থ উপরের বক্তব্যকেই প্রমাণিত করে। নামাজের মূল লক্ষ্য আল্লাহ্্্ তায়ালাকে পাওয়ার উছিলা হচ্ছে, কল্বে তথা অন্তরে স্মরণ করা। তা কোনো মৌখিক কালেমা ও বাক্য নয়। যদিও নামাজের মধ্যে মৌখিক ক্বেরাত প্রভৃতি পড়া হয়। কিন্তু কোরানের প্রত্যেক শব্দ আল্লাহ্্্র নাম নয়। সুতরাং কোরানের ক্বেরাত পড়া নিতান্তই বিশ্বাসের জন্য। কেননা সম্পূর্ণ কোরান জিকির নয়। কোরান পাকে হাজারো জিনিসের নাম ও বিবরণ রয়েছে। কেউ যদি সে সব নামের কোনো নাম জপ করে, তাহলে কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ্্্র জিকির বা আল্লাহ্্্র স্মরণ বলে গণ্য হবে না। উদাহরণস্বরূপ, কোরানে গাভী ও পিঁপড়ার কথা রয়েছে। এখানে কেউ যদি হে গাভী, হে পিঁপড়া বলে আল্লাহ্্্র নামের মতো জপ করতে থাকে এবং নিজের খেয়ালে গাভী ও পিঁপড়ার ধ্যান করতে থাকে তাহলে এগুলো কোরানের শব্দ হওয়া সত্ত্বেও এতে তার কোনো পুণ্য তো হবেই না বরং সে কঠিন শাস্তির মধ্যে ডুবে যাবে। কোরানের মধ্যে তো শয়তানের নামও রয়েছে। তবে কোরান আল্লাহ্্্র বাণী, এ চিন্তা করে তা পাঠ করলে তা আনুষ্ঠানিক ও রূপক জিকির হবে। প্রকৃতপক্ষে এটা রূপকেরও রূপক। কারণ সমস্ত কোরান বার বার পাঠ করা বাকপটুতার বাহাদুরী এবং সময়ের অপচয়ও বটে। এ জন্যই আল্লাহ্্্ বলেন, الصلوة لذكرى (আচ্ছালাতু লিযিক্রি) অর্থাৎ, “নামাজ আমার স্মরণের জন্য।” এর অর্থ হল নামাজের লক্ষ্য বা উদ্দেশ যে আল্লাহ্্্, জিকিরের মাধ্যমে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া তথা ‘আল্লাহ্্্’ অথবা ‘হু’ জপ করতে করতে এর লক্ষ্য স্বয়ম্ভু সত্তায় মিশে যাওয়া এবং নিজ অন্তরের প্রজ্ঞার সাহায্যে সত্তার বৈশিষ্ট্য অর্জন করা ও তাকে জানা, এরই নাম জিকির। আর উক্ত সত্তার সঙ্গে যুক্ত গুণাবলি ও ক্রিয়াদির প্রতি মনোনিবেশ করার নাম ফিকির বা ধ্যান। সুতরাং জিকিরের সঙ্গে যুক্ত ফিকিরই যথার্থ ক্রিয়া কর্ম। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর বাণী মোবারকÑ تفكر الساعة خير من عبادة سبعين سنة (তাফাক্-কারুস্সাআতা খাইরুম্ মিন্ ইবাদাতি সাব্ঈনা সানাতান্) অর্থাৎ, “এক ঘণ্টা ধ্যান করা সত্তর বৎসর ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” কারণ উক্ত ইবাদত রূপক। আরও অন্যান্য হাদিস শরীফে আছে, এক রাকাত নফল নামাজে দশ অথবা বিশ হজের পুণ্য পাওয়া যায়। অবশ্য এরও দুটি রূপ রয়েছে। যদি ঐ নফল নামাজ প্রকৃত হয় তা হলে দশ হজ কেন একশত হজের পুণ্যলাভ করাও অসম্ভব নয়। কিন্তু নামাজ যদি এ’তেবারী তথা রূপক হয়, তা হলে পুণ্যও রূপক হবে। ছওয়াব বা পুণ্য অর্থ ফজল বা মর্যাদা। এর বহু বচন, ফাজায়েল বা মর্যাদাসমূহ। এর অধিক অর্থবোধক ক্রিয়া আফজাল তথা উচ্চ মর্যাদা। সুতরাং মর্যাদা কখনো আইন হতে পারে না। যদি আইন হত তাহলে এক রাকাত নামাজে দশটি হজ সম্পন্ন হত এবং হজে যাবার প্রয়োজন হত না। অনুরূপভাবে কোরান পাঠ ও আনুষ্ঠানিক নামাজও রূপক জিকির, প্রকৃত জিকির নয়। সারারাত কোরান তেলাওয়াত ও নফল নামাজে লিপ্ত থাকলেও প্রকৃত জিকির হবে না।
প্রকৃত জিকির
প্রকৃত
জিকিরের উপকারিতা এবং প্রকৃত জিকির ব্যতীত নামাজ প্রতিষ্ঠিত হয় নাÑ এ
সম্পর্কে আল্লাহ্্্তায়ালা সূরা নেছার চৌদ্দ রুকুতে বলেন, فا ذا قضيتم
الصاوة فاذكرو الله قيا ما وقعوداو على جنوبكم فاذا اطما نتم فاقيموا
الصلوة ان الصلوة كانت على المؤمنين كتاب موقوتا (ফাইজা কাজাইতুমুচ্ছালাতা
ফাজ্কুরুল্লাহা কিয়ামা’উ অকুয়ুদাও অআ’লা জুনুবিকুম ফাইজ ইত্মানান্তুম্ ফা
আক্বীমুচ্ছালাতা, ইন্নাচ্ছালাতা কানাত আলাল মো’মিনীনা কিতাবাম্ মাওকুতা)
অর্থাৎ, “তোমরা নামাজ সম্পন্ন করে, দাঁড়ানো, বসা ও পার্শ্ব অবস্থায়
আল্লাহ্্্র জিকির কর। যখন ইত্মিনানে কল্ব অর্থাৎ, হৃদয়ের প্রশান্তি হাসিল
হল তখন তুমি নামাজ কায়েম তথা প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয় সময়মতো নামাজ ফরজ। নামাজ
আদায়ের পর জিকিরের যে হুকুম রয়েছে তারও নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছেÑ দাঁড়ানো ও
বসা, জাগ্রত ও নিদ্রিত, আহার-বিহার এমন কি পায়খানা-পেশাবের অবস্থাতেও তোমরা
আল্লাহ্্্র জিকির কর। তবেই ইত্মিনান কল্ব তথা প্রশান্ত হৃদয় লাভ করতে
পারবে। সুতরাং প্রশান্ত হৃদয় লাভ করার জন্য ‘দায়েমী’ তথা সর্বক্ষণ অন্তরের
জিকির প্রয়োজন। তা এমনই জিকির যে, নিদ্রাও তাকে ব্যাহত করতে পারে না এবং
পেশাব-পায়খানাও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এ জিকিরই ‘জিকির-এ-কল্বি’ তথা আন্তরিক
জিকির। অন্তরের শক্তিশালী বাকশক্তিকে রোধ করার ক্ষমতা কোনো বস্তুরই নেই।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, কল্বের সাতটি মোকাম রয়েছে। এতে বোঝা যায় যে,
প্রত্যেকটি গুপ্ত মোকামেরই আলাদা অস্তিত্ব, ভিন্ন ভিন্ন বাকশক্তি, ভাষা ও
বিদ্যা এবং বিদ্যার জন্য স্বতন্ত্র বিষয়বস্তু রয়েছে। অন্তঃকরণের এসব
উপকরণাদির সমন্বয়েই অন্তরের জিকির সম্পাদিত হয়। আর এ কল্ব তথা অন্তরই
প্রশান্তির কেন্দ্র। আল্লাহ্্্ বলেনÑ الا بذكر الله تطمئن القلوب (আলা
বিযিক্রিল্লাহি তাত্মা ইন্নাল্ কুলুব) অর্থাৎ, “হুঁশিয়ার হয়ে যাওÑ
আল্লাহ্্্র জিকির দ্বারা ইত্মিনান কল্ব তথা প্রশান্ত হৃদয় অর্জিত হয়।”
অন্যত্র বলা হয়েছে, فاذا اطما ننقم فاقيمو االصلوة (ফাইজা ইত্মানান্তুম ফা
আকীমুস সালাতা) অর্থাৎ, “তোমাদের অন্তর যখন শান্ত হয় তখন তোমরা নামাজ
প্রতিষ্ঠা কর।” তাই নামাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তরের প্রশান্তি বা শান্ত মন
আবশ্যক। এ জন্য কোরানে বিরাশি বার “আকিমুছ্ সালাত” তথা নামাজ প্রতিষ্ঠার
তাগিদ দেয়া হয়েছে। যখন তুমি নামাজ আদায় করেছ, এখন এ নামাজকে প্রশান্ত
হৃদয়ের সাথে পড়। এরই নাম হচ্ছে নামাজ প্রতিষ্ঠা। অতএব নামাজ ও অন্যান্য সকল
ইবাদতের জন্য মনের প্রশান্তি প্রধান স্তম্ভ এবং সার্বক্ষণিক ফরজ। এ জন্যই
উক্ত আয়াতে ‘ক্বাজাইতুম’ শব্দটিকে ‘কেয়ামে নামাজ’ বাতিল করে দিয়েছে এবং
‘মিছদাককেও’ নামাজের শর্ত হতে বের করে দিয়েছে। অর্থাৎ ‘ক্বাজাইতুম’ দ্বারা
আদায় করার যে অর্থ বোঝা যায়, অতঃপর নামাজ কায়েম করার হুকুমের ফলে তাকে
অর্থহীন করে দিয়েছে। কেননা এ আদেশটি নব মুসলিম ও মুসল্লিদের জন্য। যেমন
ছোটদের জন্য অ, আ। আর ওটাকে নামাজে ইসলামি বলা হয়। অর্থাৎ তারা এখনও মোমেন
হয়নি। সুতরাং এটা আদেশী নামাজ। আর যারা মোমেন তাদের নামাজ হচ্ছে হাকিকী তথা
প্রকৃত। সুতরাং আদেশী নামাজ সার্বক্ষণিক নয়। তা অতিক্রম করে আসল নামাজে রত
হওয়া ফরজ। এছাড়া নিস্তার নেই। আসল নামাজ এমন এক মূল্যবান কর্ম যা
প্রতিষ্ঠা করতে পারলে কোনো মন্দই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এমন কি তা
প্রতিষ্ঠাকারীকে সব রকম মন্দ হতে রক্ষা করে ও পবিত্র করে। সূরা আনকাবুতে
বলা হয়েছেÑ واقيموا الصلوة ان الصلوة تنهى عن الفحشاء والمنكر (ওয়া
আকীমুচ্ছালাতা ইন্নাচ্ছালাতা তান্হা আনিল্ ফাহ্শায়ি ওয়াল্ ম্ন্কুার)
অর্থাৎ, “নামাজ প্রতিষ্ঠা কর; অবশ্যই নামাজ পাপ হতে বিরত রাখে।” এর বিস্তৃত
ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ক্বল্ব, রূহ্্, ছের, খফি ও নফ্স প্রভৃতির
জন্য পৃথক পৃথক নামাজ রয়েছে। আর সে নামাজই অন্যায় থেকে বিরত রাখে। দেহের
নামাজ পাপ, খেল ও তামাসা থেকে, অন্তরের নামাজ অলসতা থেকে, নফ্সের নামাজ
মন্দ কথাবার্তা ও মন্দ স্বভাব থেকে এবং মাথার নামাজ আল্লাহ্্্ ভিন্ন অন্য
কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখে। এটাই আল্লাহ্্্ওয়ালাদের নামাজ। আর
এ অন্তরওয়ালার নামই যাকের। জিকির ছাড়া অন্তর প্রসারিত হয় না। অন্তর
প্রসারিত হওয়াকে ‘নূর-এ-ইসলাম’ বলা হয়। আর এ নূরের দ্বারাই ইসলামের
প্রতিষ্ঠা ও ভিত্তি পরিপূর্ণ হয়। আল্লাহ্্্ বলেনÑ افمن شرح الله صدره
للاسلام فهو على نور من ربه (আফামান শারাহাল্লাহু ছাদরাহু লিল্ ইস্লামি
ফাহুয়া আলা নূরিম্ র্মি রাব্বিহি) অর্থাৎ, “যার বক্ষকে ইসলামের জন্য
প্রসারিত করা হয়েছেÑ এটাই মারেফতের নূর।” যে ব্যক্তি জিকিরকারী নয়, তার মন
কালিমাযুক্ত ও অন্ধকার থাকার দরুন ইসলামের নূর হাসিল করতে পারে না। তাই
আল্লাহ্্্ সূরা জমরের দ্বিতীয় রুকুতে বলেনÑ فويل للقاسية قلوبهم من ذكر
الله اولئك فى ضلل مبين (ফাওয়াইলুললিল্ ক্বাসিয়াতি কুলূবিহিম্ মিন্
যিক্রিল্লাহি উলায়িকা ফী দলালিম্ মুবীন) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্র জিকিরবিমুখ
কঠিন অন্তরের ধ্বংস অনিবার্য। কারণ তারা স্পষ্ট ভ্রান্ত পথে রয়েছে।” এজন্যই
তাদের নামাজ তাদেরকে অন্যায় থেকে বিরত করে না। পথভ্রষ্ট অবস্থায় নামাজ
পড়াতে কোনোই উপকার নেই। এ পথভ্রষ্ট লোকদের নামাজের নিন্দা প্রসঙ্গে সূরা
নেছার কুড়ি নম্বর রুকুতে বলা হচ্ছেÑ واذاقاموا الى الصلوة قاموا سالى يراؤن
الناس ولا يذكرون الله الاقليلا (অইজা ক্বামু ইলাচ্ছালাতি ক্বামু কুসালা
ইউরাউনান্নাছা অলা ইয়াজ কুরুনাল্লাহা ইল্লা ক্বালীলা) অর্থাৎ, “তারা
অলসভাবে নামাজে দাঁড়ায় লোকদের দেখাবার জন্য। কিন্তু কিছু সংখ্যক ছাড়া কেউই
আল্লাহ্্্র জিকির করে না। সুতরাং জানা গেল যে অলসতার সাথে কোনো ইবাদত হয়
না। কারণ অলসতা একটি অন্ধকার, এর ফলে অন্তরচক্ষুর দৃৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে
যায়। চোখে পর্দা পড়লে যেমন চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে যায়, তেমনি অলসতা ও
একাগ্রহীনতায় অন্তরের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে থাকে। এ অলসতার বীজ থেকে
উৎপাদিত গাছের ডালপালা থেকে যে ফল হয় প্রকৃতপক্ষে তা ফল নয় বরং প্রাণনাশক
বিষ। তা বেহেশ্তের পরিবর্তে দোযখই খরিদ করে। জাহেরপন্থী আলেমগণ অলসতা অর্থে
অসময়ে বা সংকীর্ণ সময়ে নামাজ আদায় করা বোঝান। ‘লোক দেখানো’ কথা দ্বারা
আল্লাহ্্্ তায়ালা নামাজীদের হীনম্মন্যতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু যদিও
নামাজী নিজেদেরকে শুদ্ধ মনে করেÑ এটা শুধু তাদের অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্নতার
কারণে। যদি দুনিয়ার সকল মুসল্লিকে প্রশ্ন করা হয় তোমরা কি আল্লাহ্্্র
উদ্দেশে ইবাদত করছ, না মানুষকে দেখাবার জন্য? তখন সবাই বলবে যে, আমরা
আল্লাহ্্্র উদ্দেশে ইবাদত করছি। অথচ স্বয়ং আল্লাহ্্্ বলছেন, “ইউরাউনান্
নাছা” অর্থাৎ, “মানুষকে দেখবার জন্য।” তাহলে এখানে মিথ্যাবাদী আল্লাহ্্্ না
মুসল্লি? কিন্তু আল্লাহ্্্ তায়ালা তো আর মিথ্যাবাদী হতে পারেন না। এসব
লোকদের যদি প্রকৃত জ্ঞানের অংশবিশেষও আয়ত্ত থাকত, তাহলে আত্ম ও মা’রেফতের
রহস্য তাদের কাছে উদ্ঘাটিত হত। তারা জানতে পারত, তাদের ক্রটি কোথায়, তারা
বুঝতে পারত, তাদের এ অহংকারের পোশাকের আড়ালে এবং জায়নামাজে বসার মধ্যে
নিহিত তাদের অধঃপতন অবস্থার কথা। আর তা থেকে পরিত্রাণ পেত, নিজেদের বর্তমান
আত্মতুষ্টিমূলক অবস্থাকেও পদদলিত করত এবং এ দলনকে আল্লাহ্্্র রহমত হিসেবে
গ্রহণ করত।
জিকিরের ফলে সৃষ্টি প্রতিক্রিয়া ও অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে
সূরা আন্ফালের প্রথম রুকুতে বলা হয়েছে,واذاقاموا الى الصلوة قاموا كسالى
يراؤن الناس ولا يذكرون الله الاقليلا (ইন্নামাল মো’মিনুনাল্লাজিনা ইযা
জিক্রাল্লাহু ওয়াজিলাত কুলুবুহুম) অর্থাৎ, “সে-ই মোমেন; আল্লাহ্্্র জিকির
শুনলে যার হৃদয় ভীত হয়।” অর্থাৎ, আল্লাহ্্্র নাম শুনলে অন্তর ভীত হবেÑ
আল্লাহ্্্র জ্যোতি ও মহত্ত্ব অথবা তাঁর সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহের প্রবল
আকাক্সক্ষা এবং অন্তরে বিদ্যমান প্রেমাকর্ষণ এবং আল্লাহ্্্র সত্তার সাথে
সদা সর্বদা যুক্ত থাকার কারণে। তাই মাশুকের নাম শোনামাত্র তার প্রেমরশ্মি
প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। উক্ত রশ্মি, বা নূরের মোকাবিলায় প্রেমিকের অন্তর
নেহায়েত দুর্বল ও হালকা হয়ে পড়ে। তখন অবস্থার প্রেক্ষিতে অন্তরে ভাবের
সৃষ্টি হয়। এ সময় যদি উক্ত মোমেন শারীরিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে তাহলে এ
ভীতিকে পাপ ভীতি বলা হয়। আর যদি সে আশিক অন্তরের বিনয়ী অংশের সঙ্গে সংযোগ
রাখে তাহলে সে ভীতিকে রশ্মি বা জ্যোতি এবং প্রেম উন্মাদনা বলা হয়। এটা
প্রেমযুক্ত ভীতি, অর্থাৎ সে ভয় পায় এ জন্য যে, এত মহব্বত সত্ত্বেও মিলন ও
দর্শনতৃষ্ণার আকাক্সক্ষাতে কোনো অবসর মিলে না।
আল্লাহ্্্প্রেমিক যদি
অন্তরের বাতেনের সঙ্গে সংযোগ রাখে তাহলে তার মধ্যে যে ভীতি সঞ্চার হয়,
সে-অবস্থার নামই “রাহাতুল ক্বল্ব” তথা হৃদয়ের প্রশান্তি অর্থাৎ আশিক ও
মাশুকের দিক হতে নূরের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়ে একে অপরকে আকর্ষণ করে। যাকে
জয্বা ও এন্জেবাব তথা আকর্ষণ করা ও আকর্ষিত হওয়া বলে। আল্লাহ্্্র প্রতি
আশিকের আসক্তি বা মোহকে জয্বা আকর্ষণ বলে। আর প্রেমিকের প্রতি মাশুক বা
আল্লাহ্্্র যে আসক্তি তথা মোহ তাকে এন্জেবাব বা আকর্ষণ করা বলে। আল্লাহ্্্ ও
তাঁর বান্দার মধ্যে এ আকর্ষণ, সার্বক্ষণিক হলেও অবস্থার পরিবর্তনে এ
আকর্ষণ বা হালত বিভিন্ন রূপ লাভ করে, যা ভাষায় বর্ণনাতীত। প্রতি মুহূর্তে
হাজার হাজার অবস্থার সৃষ্টি এবং নতুন নতুন নানা রকম ভাবের উদয় হয়। আর এ
ভাবের প্রভাবে আশিকের সমস্ত শরীরে প্রকম্পন, দাহ, উত্তাপ, অস্থিরতা, আহ ও
বিরহশ্বাস, অশ্রুসিক্ত, ঘর্মযুক্ত, প্রেমনৃত্য, হুতাশন ও বেহুঁশী আর তালি
বাজান প্রভৃতি অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরই নাম ‘গালবাহ্’ তথা অভিভূত হওয়া।
কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াসমূহ একই রূপ হয় নাÑ সূরা জমরের দ্বিতীয় রুকুতে বলা
হয়েছেÑ تقشعر منه جلود الذين يخشون ربهم ثم تلين جلودهم وقلوبهم الى ذكر
الله (তাক্শাইরু মিন্হু জুলুদুল্লাজিনা ইয়াখ্শাওনা রাব্বাহুম ছুম্মা তালিনু
জুলুদুহুম অকুলূবুহুম ইলা জিক্রিল্লাহ্) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্্কে যারা ভয়
করেন তাদের লোম শিহরিত হয়Ñ আবার জিকির শুনলে তাদের ত্বক ও অন্তর বিগলিত ও
নরম হয়ে যায়।” তথা সারা শরীর প্রকম্পিত হয়। আবার অনেক সময় এমন কম্পন সৃষ্টি
হয় যেন সে জ্বরে আক্রান্ত এবং তার দেহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সে
অত্যন্ত তৃপ্তি অনুভব করে, তার অন্তর নরম হয়ে যায় ও আল্লাহ্্্র প্রতি ঝুঁকে
পড়ে। সূরা হাদীদের রূকুতে আল্লাহ্্্ বলেনÑالم يعن للذين امنوا ان تخشع
قلوبهم لذكر الله (আলাম ইয়ানি লিল্লাজিনা আমানু আন্তাখ্শায়া কুলূবুহুম
লিজিক্রিল্লাহ্) অর্থাৎ, “ঈমানদারদের জন্য সে সময় কি আসেনি যে, তাদের অন্তর
আল্লাহ্্্র জিকিরের জন্য ভয়ে নরম হয়ে যাবে?” এখানে ভয় অর্থ আল্লাহ্্্র
সম্পর্কে জ্ঞান, যা ভয়যুক্ত প্রেম সৃষ্টির কারণ। সুতরাং যেখানে ভয় সেখানেই
সন্তুষ্টি। যদি সন্তুষ্টি না থাকত তাহলে ভয় দ্বারা কী লাভ হত? আর যেখানে
সন্তুষ্টি রয়েছে সেখানে পুরস্কারও রয়েছে। যেখানে পুরস্কার রয়েছে সেখানে
তৃপ্তিও রয়েছে। যেখানে তৃপ্তি আছে, সেখানে উদ্দেশ ও মাকছুদ তথা লক্ষ্যও
রয়েছে। আর তাই হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ্্্। যেখানে আল্লাহ্্্ আছেন জ্ঞানও আছে।
আর সত্তার জ্ঞান থেকেই জ্ঞানের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে। হাজার
হাজার শাখা প্রশাখা আবার এ জ্ঞানে বিদ্যমান। এ জ্ঞান অনন্ত অসীম। কারণ
সত্তা যখন অসীম তখন সত্তার জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাও অসীম। আল্লাহ্্্ বলেন, قل
ربى زدنى علما (কুল্ রাব্বি জিদ্নী ইল্মা) অর্থাৎ, “হে নবী বলুনÑ প্রভু
আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।” অর্থাৎ তোমার সত্তা হতে আমার সত্তা যে জ্ঞান
লাভ করে তার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দাও। এ জন্যই এ জ্ঞানকে নফ্স-তত্ত্বের জ্ঞান
বলা হয়। এ নফ্স-তত্ত্বের জ্ঞান ও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য
অনুধাবনের জন্য বিশেষ উপলব্ধি এবং তা অবলোকনের জন্য বিশেষ দৃষ্টিশক্তি
প্রয়োজন। এ দৃষ্টিশক্তি যা কিছু দেখবে তা নিজের মধ্যে দেখবে এবং নিজের
মধ্যেই সব কিছুর অস্তিত্ব পাবে আর যা কিছু জানবে তা নিজের মধ্য দিয়েই
জানবে। যেমন সূরা আনআ’মের দ্বাদশ রুকুতে আছেÑقد جائكم بضائر من ربكم فمن
ابصر فلنفسه ومن عمئ فعليها (ক্বাদজায়াকুম্ বাছায়িরুম্ র্মিরাব্বিকুম ফামান
আব্ছারা ফালিনাফ্ছিহি অমান্ আময়া ফাআলাইহা) অর্থাৎ, “তোমার দৃষ্টিশক্তি
তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে, তোমরা যদি দর্শন কর তাহলে তা তোমাদেরই জন্য।
আর যদি অন্ধ হয়ে থাক তার পরিণামও তোমাদেরই জন্য” অর্থাৎ, সে নিজের নফ্সকে
জানতে পারবে না, যে পর্যন্ত ইলমে হক্ব তথা সত্য জ্ঞান হতে বঞ্চিত থাকবে।
হযরত মাওলানা রুমি বলেন,
ইলমে হক্ব দর ইলমে সূফীগম শাওয়াদ
ইঁ সোখান কায় বাওরি মরদাম শাওয়াদ
আল্লাহ্্্
বলেনÑ وما انا عليكم بحفيظ (অমা আনা আলাইকুম বিহাফিজ) অর্থাৎ, “আমি কি
তোমাদের ওপর নেগাহ্বান নই? হাদীস শরীফে এর বিশদ ব্যাখ্যা মিলে। من عرف نفسه
فقد عرف ربه (মান্ আরাফা নাফ্সাহু ফাকাদ্ আরাফা রাব্বাহু) অর্থাৎ, “যে
নিজের নফ্সকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে।” প্রভুত্ব পরিচয়লাভকারী স্বীয়
নফ্সে যতটুকু প্রভুত্ব বিকশিত হয় তথা উপলব্ধি করতে পারে, অন্য কারো মধ্যে
ততটা পারে না। যেমনÑ নিজের চোখ দ্বারা যেভাবে কোনো জিনিসকে অবলোকন করা যায়
সেরূপ অন্য কারো চোখ দ্বারা অবলোকন করা যায় না। অনুরূপভাবে নিজের কান ও
নাকের ব্যাপারে তাই মনে করা উচিৎ। আসল কথা হলো, আল্লাহ্্্ তাঁর নিজ সত্তা
সম্পর্কে জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে নিজ বন্ধুর বক্ষকে মনোনীত করেছেন। এ জন্যই
এ জ্ঞনকে ইল্মে সিনা তথা বক্ষজ্ঞান বলা হয় এবং এ জ্ঞান এক বক্ষ হতে অন্য
বক্ষে প্রসারিত হয়। খেলাফতের পদ্ধতিতে প্রেমিকের বক্ষ আরশ হিসেবে গণ্য।
হাদীস শরীফে আছেÑ قلوب المؤمنين عرش الله (কুলূবুল্ মো’মিনীনা র্আশিল্লাহ্)
অর্থাৎ, ‘মোমেনের কল্ব আল্লাহ্্্র আরশ।” আল্লাহ্্্র সত্তার ভান্ডার আরশ
বলে গণ্য এবং ঐ আরশ তথা অন্তরই আসল ও স্থায়ী আরশ। দ্বিতীয় স্তরে খেলাফতের
পদ্ধতিতে যে কল্ব বা অন্তর, তাও প্রকৃত এবং খাছ। এজন্য খলিফার অর্থ হচ্ছে
পরবর্তী অনুগামী ব্যক্তি। ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিÑ আসনে
অধিষ্ঠিত ব্যক্তির যোগ্যতার সমপর্যায়ের হওয়া আবশ্যক। এতে করে ‘ইলমে জাতি’
তথা সত্তার জ্ঞান একে অপরকে সম্বন্ধযুক্ত করে রাখে। সুতরাং উভয়ের ইল্মে
জাতি যখন একই পর্যায়ের হয় তখন জাত বা সত্তার রূপও একই হয়। একইভাবে সত্তার
অবস্থার অনুরূপ অবস্থা তাদের চোখ ও দৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এজন্যই
আল্লাহ্্্ তায়ালা বলেনÑ قد جائكم البصائر (ক্বাদ জায়াকুমুল বাছায়েরু)
অর্থাৎ, যে বিশিষ্ট চোখ তুমি লাভ করেছ, সে চোখ দ্বারা নিজের নফসের দিকে নজর
করেছ, তখন নিজের হাকিকত, আল্লাহ্্্ তায়ালার হাকিকত উভয়কে চিনে নিয়েছ। এ
স্থানটিতে কোরান শরীফের অনেক ব্যাখ্যাকারী ‘বাছায়ের’ অর্থে দলিলসমূহ বলে
লিখেছেন। তারা ভুল বুঝেছেন।
এ সত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান থেকে নিঃসৃত জ্ঞানই
ফিকির, গাওর ও মাকাশেফা নামে পরিচিত। যদিও সালেকগণের ফিকির ও কাশ্ফের পরেই
সত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান অনুভূত হয়। যেমন মানুষ জন্মগ্রহণের পর নফসের
জ্ঞানের মাধ্যমে নিজের সম্পর্কে অবহিত হয়। অনুরূপভাবে ধ্যানকারীর প্রসারিত
অন্তরে বিদ্যমান কাশ্ফ প্রভৃৃতির সমর্থনে আল্লাহ্্্ বলেনÑ يتفكر ون فى خلق
السموات والارض (ইয়াতাফাক্কারুনা ফী খাল্কিস্ সামাওয়াতি অল্আরদ) অর্থাৎ,
“আসমান ও জমিন সৃষ্টি সম্বন্ধে যারা চিন্তা করে।” অর্থাৎ, হাকিকত সম্বন্ধে
যখন আহলেদেল মোশাহেদা করেন তখন প্রত্যেক জিনিসের মূল ও সূক্ষ্মতম অংশ
মোশাহেদাকারীর নিকট প্রকাশিত হয়।” তখন প্রার্থনার সুরে তাঁরা বলেনÑ ربنا
ماخلقت هذا باطلا (রাব্বানা মা খালাক্বতা হাযা বাতিলা) অর্থাৎ, “হে আমার
প্রভু! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করনি।” সৃষ্টি বস্তুসমূহের মধ্য হতে কিছু
সৃষ্টিকে মানুষ পবিত্র ও অপবিত্র, খারাপ ও বাতিল প্রতিপন্ন করে। এ বাতিলটা
হচ্ছে অপ্রাকৃত সন্দেহ। এ কারণেই ধ্যানমগ্ন অন্তরের প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে
আল্লাহ্্্ সাধারণ লোকদের জন্য অনুস্মরণীয় করেছেন। যাতে করে জাহেরপন্থীদের
উপলব্ধি হয় যে, তাদের এ অজ্ঞতার কারণ তাদের অন্তরের অন্ধকারাচ্ছন্নতা বা
মালিন্যতা। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, কাশ্ফ অর্জন এবং ধ্যানসাধনা ছাড়া
স্রষ্টার রহস্য কখনো জানা সম্ভব নয়।
সত্যকে অসত্য আর অসত্যকে সত্য মনে
করা মারাত্মক অপরাধ। চিন্তা করুনÑ মানুষের পেটের মধ্যে যা কিছু আছে, সবই
অপবিত্র। অথচ এ অপবিত্র বস্তু থেকেই গোটা দেহের সজীবতা, শক্তি ও শান্তি। এ
পেটের ভিতর হতে যদি এসব অপবিত্র বস্তুসমূহ বের করে দেওয়া হয় তাহলে এ দেহের
কোনো পবিত্র অংশই থাকবে না বরং সঙ্গে সঙ্গে দেহ ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের
বীর্য কি অপবিত্র নয়? তা থেকে কী করে পবিত্র মানুষ সৃষ্টি হয়! সুতরাং
প্রকৃতপক্ষে তা অপবিত্র নয় বরং এর অপবিত্রতা কৃত্রিম বা রূপক। মূলত তা বৈধ ও
পবিত্র। সুতরাং যার ধ্যানশক্তি ও কাশ্ফ নেই, তার প্রকৃত জ্ঞান নেই।
বিভিন্ন কারণের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বস্তু অপবিত্র ও পবিত্র হয়। যেমনÑ
পবিত্র বস্তুর মিশ্রণেই মদ তৈরি করা হয়, পরে মাদকতার কারণে তা হারাম হয়।
কিন্তু এতে লবণ প্রভৃতি মিশ্রিত করলে আবার পবিত্র হয়। এমনিভাবে
আল্লাহ্্্ওয়ালাগণের হেকমতময় সংস্পর্শে অতি তুচ্ছ ও অপবিত্র বস্তু
মহামূল্যবান ও পবিত্র হয়ে যায়। সাধারণের এ পার্থক্য বোধ নেই। কোনো জিনিসের
কারণ জানলেও প্রকৃতপক্ষে এসবের মূল সত্তার পার্থক্য বের করতে পারে না। যেমন
প্রথমে শূকর হালাল ছিল। কিন্তু এখন কেন হারাম হল তারা তা জানে না। সুতরাং
ত্রুটিপূর্ণদের ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞানই প্রয়োজন। তাদের কাছে আসল জ্ঞান প্রকাশ
করলে তারা তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করবে।
চিন্তা করুন, যিনি বক্ষজ্ঞান
এবং নফ্সের জ্ঞানের মাধ্যমে নিজকে চিনেছেন তিনি শ্রেষ্ঠতর নিয়ামতের অধিকারী
হয়েছেন। সুতরাং এখন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। তাই আল্লাহ্্্ বলেনÑ
ومن شكر وانما يشكر لنفسه (অমান্ শাকারা অইন্নামা ইয়াশ্কুরু লিনাফ্ছিহী)
অর্থাৎ, “যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, সে তো কেবল নিজের নফ্সের জন্য তা
করেছে।” অর্থাৎ, নিজের নফ্সের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে সাথে
আল্লাহ্্্র প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। কেননা নফ্সের মূল স্বয়ং
আল্লাহ্্্। সৃষ্টির রহস্যের দিক থেকে স্রষ্টার চিরস্থায়ী হাকিকত বান্দার
মধ্যে বর্তমান। এ কারণেই মুরব্বি শ্রেণীর শাইখগণ বলেছেন, যে নফ্সকে চিনেছে
সে আল্লাহ্্্কে চিনেছে আর যে আল্লাহ্্্কে চিনেছে সে নিজের নফ্সকে চিনেছে।
অজ্দ ও তার উপকারিতা
অজ্দ
বা আল্লাহ্্্প্রেমে আবিষ্ট অবস্থার মধ্যে পরম সত্তার বিশেষ নূর নিহিত
রয়েছে। এতে প্রেমের সম্পর্ক ও তাওহীদের গুপ্ত রহস্য রয়েছে। আর এটাই
আল্লাহ্্্ দর্শনের আয়না এবং জীবনের সান্তনা ও লক্ষ্যে উপনীত হবার সরল পথ।
উক্ত নূর থেকে অজ্দের অবস্থায় একটি দাহিকা নূর তৈরি হয়। তা সব কিছুর উপরে
শক্তিশালী এবং নফ্স ও শয়তানের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ও পাপকে সম্পূর্ণরূপে
চূর্ণবিচূর্ণ করে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেয়। এ কারণেই আহলে অজ্দ তথা
আল্লাহ্্্প্রেমে মোহাবিষ্টদের দেহ সবসময় গরম ও পরিবর্তনশীল থাকে। সালেক তথা
সিদ্ধ-সাধক, এর ফলাফলে সদা সন্তুষ্ট থাকেন। এহেন মহাপুরুষের কাছে দুনিয়ার
আরাম ও লজ্জা তুচ্ছ। অজ্দ আল্লাহ্্্প্রেমিকের বন্ধু এবং তা তাঁকে লক্ষ্যে
পৌঁছায়। আল্লাহ্্প্রেমিকের মূল লক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ্্্্। এ জন্য
আল্লাহ্্্্প্রেমিক অন্য সব কিছু ত্যাগ করে আল্লাহ্্্র সাথে একাকার হয়ে যায়
এবং ভুলে যায় জাহেরী শরিয়ত ও তার কর্মগুলো। কেননা আল্লাহ্্্ ছাড়া সব কিছু
ভুলে যাওয়া মহা গুপ্ত রহস্য। আল্লাহ্্তে আসক্ত হওয়ার গুণাবলির মধ্যে মহব্বত
তথা প্রেম ছাড়া আর কিছুই নেই। এ জন্যই অজ্দের অর্থ হচ্ছে মোহিত এবং
মোহাবিষ্ট হওয়া। এখানে জয্বা ও অজ্দের প্রতিক্রিয়াই এর মর্ম এবং কোনো
শাব্দিক অর্থ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ্্প্রেমিকের প্রেম উন্মাদনা
ব্যতীত প্রভুত্বের প্রভাব অর্জিত হয় না। গোলবা ও ছোকরের জন্য আহওয়াল
প্রয়োজন, আর আহওয়ালই হচ্ছে তার কাম্য। এ অবস্থার নামই ফায়েজ । ফায়েজ অর্থ
পুরস্কার ও জ্ঞানের প্রকাশ হওয়া অর্থাৎ, আল্লাহ্্প্রেমে প্রেমিকের দেহ
ফায়েজের বন্যায় আপ্লুত হয় আর জাত ও সিফাতের মিলনই ফায়েজ বা পুরস্কারের
কারণ। প্রকৃতপক্ষে ফায়েজ হচ্ছে আল্লাহ্্র সত্তা হতে বান্দার ওপর একটি আছর
তথা প্রতিক্রিয়া বা তাছির। যার ওপর এ ফায়েজ বা তাছির আবর্তিত হয় সে
স্পষ্টভাবে তা উপলব্ধি করতে পারে। যদিও ফায়েজ দ্বারা কাশ্ফের উন্মেষ বোঝায়
কিন্তু এর প্রকৃতি অগণন। সালেকের দেহের মোকামগুলো ফয়েজের প্রভাব লাভ করে।
ফলে তিনি তৃপ্তি অনুভব করেন। এ ফয়েজের কারণ হচ্ছে ফেরেশতা ও আমলকারীদের এবং
আউলিয়া আম্বিয়াদের রূহ্ মোবারক প্রভৃতি। অর্থাৎ ছোট বড় সকল বিশ্ব রূহ্ ও
ফেরেশ্তা দ্বারা কুয়াশার মতো ছেয়ে যায়। তবে সে সকল ফেরেশ্তা একইরূপে আবদ্ধ
নন।
এ জগতে সাধকদের উছিলায় অধিকাংশ ফায়েজ বর্ষিত হয় এবং সত্তার জগৎ থেকে
ফায়েজ সত্তার শক্তিতে বর্ষিত হয়। আবার ফায়েজ প্রাপ্তগণ অনেক সময় প্রত্যেক
জীব এবং পোকামাকড় থেকে ফায়েজ প্রাপ্ত হন আর ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তাদের সঙ্গে
কথা বলেন। এজন্য ফায়েজ প্রাপ্তগণ সৃষ্টি জগতের সকলকে নিম্নস্তরের ফেরেশ্তা
বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর অর্থ ফায়েজ আল্লাহ্্র সত্তা থেকে প্রেমিকের
সত্তায়, আল্লাহ্্র গুণাবলি থেকে প্রেমিকের গুণাবলিতে, আল্লাহ্্র বিভিন্ন
অবস্থা থেকে প্রেমিকের বিভিন্ন অবস্থায় বর্ষিত হয়। এটা আকাশ থেকে বর্ষিত
বৃষ্টির মতোই। আকাশে যেমন পানি ছিল, বর্ষিত হওয়ার পরও ঠিক তেমন পানি আছে।
কিন্তু সে আকাশের পানি যার উপর বর্ষিত হয় তাকে সজীবতা দান করে। সুতরাং
ফায়েজ এমন একটি পুরস্কার প্রথমত যার বরকতে মানুষ সকল জাগতিক দিক হতে স্বীয়
মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ, দ্বীনি ও দুনিয়াবি হুকুম আহকাম ও কর্মের কারণে যখন
সে সত্তার মহিমাতে বিস্মৃত হয়েছিল, এখন আবার ফায়েজের বরকতে তা স্মরণ
হয়েছে। অর্থাৎ, তার নিকট প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পেল। এর অর্থ হল, যখন ‘অজ্দ’
হয় তখন পুনরায় স্মরণ হয় যে আমি আমার প্রতিপালককে কেন ভুলে গিয়েছিলাম! এ
জন্যই অজ্দের অর্থে ভুলে যাওয়া বস্তুকে স্মরণ হওয়াও বলা হয়। তাই ‘অজ্দ’ আরও
বেশি লোভনীয় হয়ে উঠে। জয্বা ও গোলবাহ তথা প্রেমাকর্ষণ ও আত্মহারা হওয়ার
মধ্যে যে করুণা রহস্যের সূক্ষ্মতা গোপন রয়েছে সে দিকে আগ্রহান্বিত হওয়ার
নাম তথ্য উদঘাটিত হওয়া। অতঃপর এ গুণও লোপ পায় এবং হালসমূহের দ্বারা বাতেনী
তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। যেমনÑ টেলিগ্রামের ‘তার’ নিজের মধ্য দিয়ে গোপন সংবাদ
সরবরাহ করে কিন্তু ‘তার’ নিজে কিছুই বোঝে না। ‘তারের’ দ্বারা যখন টেলিগ্রাম
করা হয় তা থেকে তখন টক্টক্ শব্দ শোনা যায় এবং এর মধ্যে টেলিগ্রামের
বক্তব্য নিহিত থাকে। অনুরূপভাবে প্রেমিকের অজ্দ তথা ভাবাবিষ্ট অবস্থা
টেলিগ্রাম ও ইঞ্জিনের মতোই। কল-কারখানায় ইঞ্জিনের ভীষণ শব্দ হয় এবং অনেক
ক্ষেত্রেই ভীতিজনক মনে হয়। আবার অনেক দ্রুতগতিতে ও প্রবল শব্দ সহকারে গাড়ি
এবং জাহাজ চলে। তদ্রুপভাবে আল্লাহ্্ প্রেমিক চিৎকার ও শোরগোলের সঙ্গে টেলি ও
বিদ্যুতের মতো পথ অতিক্রম করে যায় জয্বা ও হালতের কারণে। আল্লাহ্্
প্রেমিকগণ আল্লাহ্্র স্মরণে আরাম ও শান্তি অনুভব করেন। এ সম্বন্ধে আল্লাহ্্
তায়ালা সুসংবাদ প্রদান করে সূরা জুমরের দ্বিতীয় রুকুতে বলেন,
تقشعر منه
جلودالذين يخشون ربهم ثم تلين جلودهم وقلو بهم الى ذكر الله (তাক্বশা’য়িরু
মিন্হু জুলুদুল্লাজিনা ইয়াখ্শাওনা রাব্বাহুম ছুম্মা তালিনু জুলুদুহুম ওয়া
কুলুবুহুম ইলা জিক্রিল্লাহ) অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে
তার শরীর শিউরে উঠে এজন্য সে আরাম ও আনন্দ অনুভব করে তার ত্বকে ও অন্তরেÑ
তার প্রভুকে স্মরণ করার জন্য।” অর্থাৎ, যখন অজ্দ অবস্থা হয়Ñ আল্লাহ্্র
মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ভয়ের কারণে অথবা আরাম, প্রফুল্লতা ও উচ্চাশায়
সাধকের ত্বকসহ সর্বশরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। কারণ এ অজ্দের অবস্থায় উভয়
দিকের প্রেমরশ্মির যোগাযোগ স্থাপন হয়। মহব্বত ও আশাহত হওয়ার ভীতির সৃষ্টি
হয় আল্লাহ্্র জালালিয়াত তথা মহত্ত্বের শানে এবং শান্তি ও প্রফুল্লতা হয়
আল্লাহ্্র জামালিয়াত তথা সৌন্দর্যের শানে।
প্রেম একটি ব্যাপক শব্দ। এতে
নিহিত রয়েছে আল্লাহ্্কে পাওয়ার সরল পথ। এতেই ভয়, সন্তুষ্টি, দান, অনুগ্রহ
তথা স্বয়ংসত্তা ও তাঁর গুণাবলি বর্তমান। প্রেম হচ্ছে পবিত্রতার একটি নাম আর
এটাই হচ্ছে মোহাবিষ্ট ও উন্মত্ততার কারণ। এ থেকে অজ্দ প্রভৃতি অবস্থার
উদ্ভব হয়। এ কারণেই ‘ফচুছ’ কিতাবের রচয়িতা ‘আল্লাহ্্’ শব্দের অর্থ বেহুঁশী ও
ভীতি বলে লিখেছেন। অতএব উন্মাদনা বা বেহুঁশী আল্লাহ্্র স্বভাবগত
বৈশিষ্ট্য, এটা কোনো শব্দের প্রভাব নয়। সুতরাং আল্লাহ্্র সত্তার প্রেমিক
সত্তা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং গুণের প্রেমিক প্রভাবিত হয় গুণ দ্বারা। তালেব
অর্থাৎ, প্রেমিক বা সাধক শব্দটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য। প্রার্থনাকারীর যে
প্রার্থনা সেটা তার অন্তরের ক্রিয়া। এ ক্রিয়া মৌলিক। রূহ্ যখন তার মূলের
প্রতি ধাবিত হয় তখন মানবিক বিষয়াদি এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে উভয়ের মধ্যে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়। তাই প্রেমিকের শরীর প্রকম্পিত হয়। কেবল
নফ্সের বাধা ও কালিমার কারণে এ প্রকম্পনের সৃষ্টি হয় না। বরং জীবন রহস্য
উদঘাটিত হওয়ার আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের ফলেই রূহ্ সহকারে সারা শরীর কম্পনের
সৃষ্টি হয়। যেমন অহি তথা প্রত্যাদেশবার্তা প্রাপ্তির সময় হযরত আম্বিয়া (আঃ)
গণের মধ্যেও অনুরূপ কম্পনের সৃষ্টি হত; তাঁদের সমস্ত শরীরে প্রকম্পিত হত
এবং তাঁরা অস্থির হয়ে যেতেন।
অহি প্রাপ্তির সময় আমাদের শেষ নবী
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর যে অবস্থা হত তার বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ। যথা
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট অহি এলে, জিব্রাঈল (আঃ) তাঁকে পেষণ করে একেবারে
দুর্বল করে নিয়ে বললেন, পাঠ করুন। তিনি বললেন, আমি পড়তে জানি না, এভাবে
তিনবার পেষণ করার পর তিনি পড়তে শুরু করলেন। অতঃপর পড়তে পেরেও তিনি গুহা
থেকে ঘরে গিয়ে হযরত খোদেজা (রাঃ)-কে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাওÑ
কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও! তখন রাসূল (সাঃ) জ্বর ও উত্তাপে কাঁপছিলেন। তাঁর উভয়
ঠোঁট মোবারক কাঁপছিল। অতএব জিব্রাঈল (আঃ)-এর পেষণের মধ্যে উম্মতের জন্য
বিরাট শিক্ষা ও অনেক দলিল-প্রমাণ রয়েছে।
প্রথমত জিব্রাঈল (আঃ) এর
স্বেচ্ছাকৃত পেষণের ফলেই বেলায়েতের উৎস রাসূল (সাঃ)-এর অনিচ্ছাকৃত
অস্থিরতার সৃষ্টি হত এবং এ অস্থিরতা তথা ভাবাবিষ্টতার মধ্যে তিনি অহি
প্রাপ্ত হতেন। এ জন্যই নবুয়ত এবং বেলায়েত উভয়ের জন্যই ভাবাবিষ্টতা আবশ্যক।
তা না হলে অহি প্রাপ্তির সময় নবীগণ অস্থির হতেন না। এ কারণেই ভাবাবিষ্টতা
সকল নবী ও অলীদের পথ প্রদর্শক ও মৌলিক বস্তু এবং অহি সংক্রান্ত উত্তরাধিকার
বলে গণ্য। দ্বিতীয়ত, হস্ত সঞ্চালন নফ্সের প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
তৃতীয়ত, এখানে অহি অর্থ কেবল ঐশীবাণী নয়, আত্মার প্রভাব তথা মূল বস্তু এর
অন্তর্ভুক্ত। এ জন্যই যে বস্তু আত্মার প্রতিক্রিয়াকে গ্রহণ করতে নারাজ তাকে
পেষণ করে ঘর্মাক্ত অবস্থায় তা বের করে দেওয়া হয়েছে। রাসূল (সাঃ)-এর বক্ষ
বিদারণের তাৎপর্য এটাই। বক্ষ বিদারণের মাধ্যমে অসামঞ্জস্যপূর্ণ রক্ত বের
করে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে গভীর জ্ঞান ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এর
নাম রাখা হয়েছে ইলমে সিনা তথা বক্ষের জ্ঞান।
এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে যেমন কিছু ঢেলে দেওয়া হয়, এ জ্ঞানও তেমনি এক বক্ষ থেকে অন্য বক্ষে ঢেলে দেওয়া হয়। মুর্শিদ ও মুরিদের মধ্যকার এ যোগাযোগকে অন্তরের যোগাযোগ বলা হয়। অহির অবস্থা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে হলে ‘বোখারী শরীফ’ ও ইতিহাসগ্রন্থ ‘তাজকেরাতুল কিরাম’ প্রভৃতি দেখুন।
মোট কথা কল্ব অন্তর
উত্তেজিত হয়ে প্রকম্পিত হলে চমকিত হয়ে যায়। তাই সমস্ত শরীরে কম্পন সৃষ্টি
হয় এবং তাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্যাদি প্রতিভাত হয়। এর ফলে অন্তর নরম হয়ে
গলে যায় এবং আরাম অনুভব করে ও আল্লাহ্্র প্রতি নিবিষ্ট হয়। ধীরে ধীরে তা
বৃদ্ধি পায়, শক্তিশালী হয়, আর তা থেকে রকমারী অসংখ্য অবস্থা বিকশিত হয়। তবে
সূফীগণ নিজ নিজ অবস্থার আলোকে একে ঊনচল্লিশ বা চল্লিশ ভাগে ভাগ করেছেন এবং
প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন। যথাÑ তাওয়ালে, লাওয়ামে, অযুদ, যুদ,
তাওয়াজ্জু, ছোকর, গোলবাহ, রায় মহাজেরা, মোকাশেফা প্রভৃতি। ‘তায়ারুক’ ও
‘আওয়ারেফ’ প্রভৃতি মারেফতের কিতাবে এর বর্ণনা রয়েছে। এ সমস্ত অবস্থার
প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন। ভাবাবিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা অনুযায়ী
তার অন্তরে এর প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। এ দ্বারা তিনি হাজারো কল্যাণ ও
বরকত লাভ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কল্যাণ সৃষ্টি হয়। যখন কোনো কঠিন
হৃদয় হতে হালত প্রকাশিত হয়, তখন তা থেকে তেলের ফোরঙ্গের ধোঁয়ার মতো
অন্তরের ময়লা বের হয়ে যায়। এতে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে এবং আরাম অনুভূত হয়।
সুতরাং অন্তর জ্বালা একটি উত্তাপ, এটা চিৎকার, আনন্দ ও অশান্তভাবের সঙ্গে
ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এবং হালপ্রাপ্ত ব্যক্তির শরীর হালকা ও নরম হয়ে যায়। এ
নম্রতার ফলেই প্রেমিক অস্থির ও অচেতন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা আট, দশ দিন বা কম
বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে। মোট কথা তার অন্তর প্রশান্ত হয়ে যায়। চিন্তা
করলে এর উপকারিতা কারও না বোঝার কথা নয়। কোনো ব্যক্তি চিন্তাগ্রস্ত বা
দুঃখপ্রাপ্ত হলে কিছু দিন পর্যন্ত দুনিয়ার কোনো কাজ তার কাছে ভালো লাগে না।
জাগতিক চিন্তা যখন জাগতিক কাজকর্ম থেকে মানুষকে নিষ্ক্রীয় করে, তখন
আল্লাহ্্র চিন্তা জাগতিক কাজকর্মকে নিরুৎসাহিত করবে না কেন? কষ্টের কারণে
চিৎকার ও ক্রন্দন দ্বারা কলিজার জ্বালা দূর হয়। এ জন্যই ক্রন্দন অবস্থায়
চিৎকার করে চিন্তার জ্বালাকে বের করে দেওয়া হয়, যাতে কলিজা ফেটে না যায়।
বন্দুকের সাথে তুলনা করে এ অবস্থা বোঝা দরকার। আওয়াজ না হওয়া পর্যন্ত
গোলাবারুদ ভর্তি বন্দুকের অস্থির অবস্থা বৈ আর কি থাকে। বটম টিপার পর
বন্দুকের গুলি বেরুতে না পারলে বন্দুক ফেটে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতো
হল বাহ্যিক উদাহরণ। কিন্তু বাতেনী অবস্থা, হালপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউই
জানে না। এ কারণেই রাসূল (সাঃ)-এর ইন্তেকালের দিন কেঁদে অস্থির হয়নি এমন
কেউ ছিল না। আল্লাহ্্র বান্দারা তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন।
সাহাবাগণ তাদের প্রতি উপদেশ দিয়েছেন এবং কাপড় রুমাল দ্বারা তাদের চোখ মুখ
মুছিয়ে দিয়েছেন। বদর সঙ্গীদেরও রাসূল (সাঃ) এভাবে দয়া প্রদর্শন করেছেন।
কারণ বদরের সাহাবিগণ গভীর প্রেমাসক্ত ছিলেন। আর প্রেমাসক্তদের প্রতি দয়া
দেখানো ওয়াজিব। তাই তো আউলিয়াকেরামগণ বলেন, অজ্দ তথা গভীর প্রেমাসক্ত
ব্যক্তিগণ যদি পাগড়ি, জামা কাপড় খুলে ফেলেন, ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন বা নাচতে
থাকেন তাহলে তোমরাও তাই করো। সম্ভব হলে তোমরাও প্রেমনৃত্য করো। নবী
(সাঃ)-এর ইন্তেকালে বড় বড় সাহাবাগণ এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে অকাতরে
কেঁদেছেন, অনিচ্ছায় ছটফট করেছেন, চুল ও মাথা উলঙ্গ করে কপাল চাপড়িয়ে দুঃখ
করেছেন, মাটিতে মাথা কুটেছেন এবং আপন মনে চিৎকার করে গড়াগড়ি করেছেন ও
নেচেছেন। এমন কি হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমার সামনে কেউ যদি বলে যে, রাসূল
(সাঃ) ইন্তেকাল করেছেন, আল্লাহ্্র কছম আমি তাকে হত্যা করব। হুজুর পাকের
ইন্তেকালের পর বেশ কিছুদিন এ অবস্থা বিরাজ করে এবং তাঁর ইন্তেকালের শোকে
অনেক লোক মারা যায়। ইতিহাসের কিতাবে এর প্রমাণ রয়েছে।
যে সব লোক
কান্নাকাটি করতে একেবারে নিষেধ করে তারা অজ্ঞ। কারণ নবী (সাঃ) বলেছেন,
অনুরূপ কান্নাকাটি থেকে যে বারণ করে সে পাষাণ হৃদয়। আর নারীগণ কোমল প্রাণ
হওয়ার দরুন দুঃখ এবং আঘাত সহ্য করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে কারবালা
সংক্রান্ত হাদিসে প্রমাণ আছে, শোক করা পুণ্যের কাজ। আরও উল্লেখ আছে যে, শোক
ও মাতম কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। তবে নিজের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কথা
বানিয়ে বার বার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটি করতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যথায়
সর্ব অবস্থায় ক্রন্দন করা কল্যাণকর এবং এতে অন্তর সজীব হয়। এ কারণে হাদিস
শরীফে বলা হয়েছেÑ ابكوا فان لم تبكوا فتباكوا (ইব্কু ফাইঁল্লাম্ তাব্কু
ফাতাবাকু) “অর্থাৎ, “কাঁদ, যদি কান্না না আসে কান্নার চেষ্টা কর” এবং মনকে
নরম করার চেষ্টা কর। তাহলে কান্নার সাথে আল্লাহ্্র যে রহমত থাকে তুমি তা
পাবে। শেষ নবী (সাঃ) নিজের অন্তর্ধানের কথা অবগত হওয়ার পর বলেছিলেন যে,
তোমাদের মধ্যে একজন বান্দা আছেন যিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, খুব সম্ভব
তিনি অচিরেই দুনিয়া থেকে চলে যাবেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এ ইঙ্গিত বুঝেছিলেন
এবং তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। বড় বড় সাহাবাগণ ও উপস্থিত সকলেই কেঁদেছিলেন।
রাসূল (সাঃ)ও তাঁদের সঙ্গে কেঁদে কেঁদে জর্জরিত হয়েছিলেন। কান্নায়
আল্লাহ্্র কৃপা যুক্ত না থাকলে হুজুর (সাঃ) কখনো কাঁদতেন না। তিনি তো অযথা
কোনো কাজ করতেন না। কেউ কেউ বলে যে, নবীগণ আল্লাহ্্র ভয়ে কাঁদতেন। এটা
কিসের ভয়? তারা তো অবশ্যই বেহেশ্তবাসী এবং আজাব ও ক্রোধ থেকে মুক্ত। তাঁরা
তো আল্লাহ্্র সন্তুষ্টি পূর্বেই লাভ করেছেনÑ তার পর তো সন্তুষ্টি কামনা ও
শাস্তির ভয় ঠিক নয়। কারণ এতে অনুমোদন নষ্ট হয়ে যায়। অনুমোদন পাওয়ার পর
আজাবের ভয় কুফ্রি মাত্র। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন্হা)। অনুরূপভাবে উম্মতদের
জন্যও আল্লাহ্্র সন্তুষ্টি ও মঞ্জুরি লাভের পর শাস্তির ভয় ঠিক নয়।
কুদ্রত
কুদরত
তথা দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া একটি সত্তাগত শক্তি যা আল্লাহ্্র সত্তার গভীরে
বর্তমান। একে অস্তিত্বহীনও বলা হয়। আল্লাহ্্ তাঁর আপন সুপ্ত সত্তা থেকে
ইচ্ছা ও কুদরত সৃষ্টি করেছেন, একেবারে অস্তিত্বহীন হতেও নয়। কারণ একেবারে
অস্তিত্বহীন কিছুই নেই (সারহুল ফচুছ)। মোট কথা কুদরত আল্লাহ্্র অভ্যন্তরীণ
শক্তি। এটা আল্লাহ্্র সত্তাগত প্রকৃতি। উদাহরণস্বরূপ, উত্তাপ ও উজ্জ্বলতা
আগুনের একান্ত বৈশিষ্ট্য, যা আগুনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আগুন যখন কোনো
বস্তুকে জ্বালাতে উদ্যত হয় তখন তার কুদরত প্রকাশিত হয়। আল্লাহ্্র
বৈশিষ্ট্যও অনুরূপ। তা যখন এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয় তখন তাকে
সৃষ্টি ও জ্যোতি বলা হয়। যথাÑ খনিতে সৃষ্ট সোনা ও রূপা প্রভৃতি। এর অর্থ এই
যে, সমস্ত পদার্থের বাষ্প যখন মাটির নিচে জমা হয় তখন তা থেকে বিভিন্ন
প্রকার ধাতু এবং জমিতে নানা রকম উদ্ভিদ জন্মায়। কোনো কোনো সময় উক্ত বাষ্পে
পরিবর্তন ও রূপান্তর সাধিত হলে ভূমিধস ঘটে এবং আগুন বের হয়। মোট কথা এটা
পদার্থের বৈশিষ্ট্য। ভারী পদার্থের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণের উৎস সূক্ষ্ম
পদার্থ। আর এ সূক্ষ্ম পদার্থই মূল সত্তার বৈশিষ্ট্য। অনুরূপভাবে প্রত্যেক
বস্তুই স্তরে স্তরে বিকশিত হয়। আর এরই নাম রাখা হয়েছে সৃষ্টি। জাহেরপন্থীগণ
কুদরত অর্থে একেবারে শূন্য বোঝাতে চান এবং হাদিস পেশ করেন যে, আল্লাহ্্
প্রথমে এক মুষ্টি সক্রীয় নূর সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে সৃষ্টির নূর এবং
সৃষ্টির নূর দ্বারা সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করেছেন।
আচ্ছা, আল্লাহ্্র সত্তার
বাইরে কি কোনো বস্তু আছে? যদি তাই হবে তাহলে তাঁর ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ তথা
স্বয়ম্ভু হওয়া কী করে সম্ভব? কারণ স্বয়ম্ভু সত্তা থেকেই সমস্ত শক্তি ও নতুন
বস্তু অস্তিত্ব লাভ করে; কোনো সৃষ্টি বস্তু থেকে নয় এবং কোনো অস্তিত্বহীন
জগৎ থেকেও নয়। বরং স্বয়ং সত্তাতে সৃষ্টি করার যে ক্ষমতা নিহিত রয়েছে, তা
অন্যান্য আনুষঙ্গিক কার্যক্রম যুক্ত হলেই উক্ত সত্তায় সৃষ্টিক্রিয়া জাগরিত
হয়। তাকে তাজাল্লী বা রশ্মি বলা হয়। ‘কুন’ শব্দের তাৎপর্য এটাই। এ দ্বারা
‘কুন’ শব্দ উদ্দেশ নয়, বরং এর অর্থের মধ্যে নিহিত তাৎপর্য যা বিশ্ব সত্তার
ইচ্ছার সাথে যুক্ত রয়েছেÑ যার প্রভাবে সারা জগতের সৃষ্টি, তাই এর
প্রতিপাদ্য। তা কোনো বচন বা বাক্য নয়। এখানে ‘কুন’ শব্দ দ্বারা প্রকৃত
কালাম ও আল্লাহ্্র ইচ্ছাকে বোঝানো হয়েছে। কালামে হাকিকী তথা প্রকৃত কালাম
আল্লাহ্্র সত্তার সাথে যুক্ত। সত্তা থেকে গুণের উদ্ভব আর গুণাবলির
সংখ্যানুপাতেই বিভিন্ন বস্তু ও জগতের সৃষ্টি। এ সৃষ্টির অনুপাতেই আল্লাহ্্র
সমস্ত নাম হয়েছে। ক্রমান্বয়ে যা কিছু সৃষ্টি হবে তাও সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত।
কারণ ইচ্ছার জগতে যে সমস্তের অস্তিত্ব নেই তা সৃষ্টি নয়। তাই আল্লাহ্্র
সত্তায় বিদ্যমান লক্ষ কোটি গুণাবলির প্রেক্ষিতে তাঁর অসংখ্য গুণবাচক নাম
রয়েছে। এ কারণেই সকল শাইখ প্রধান হযরত সুলতানুল আশেকীন আকবর (রহঃ) ‘ফসুস’
গ্রন্থে সমস্ত সৃষ্টির প্রেক্ষিতে আল্লাহ্্র নাম বর্ণনা করেছেন। কিন্তু জনক
ও জননীর সৃষ্টি রহমান ও রহিম নাম হতে। আল্লাহ্্র সমস্ত নাম ঐ গুণাবলির
সাথে যুক্ত হবে। সুতরাং গুণ যত হবে, ক্রিয়াও সে অনুপাতে হবে। এ হিসাবে কোনো
বস্তুই তার সত্তার বাইরে নয়। অতএব প্রত্যেক বস্তুর জন্যই প্রকাশ হওয়ার
স্থান প্রয়োজন। সুতরাং স্থানও উক্ত বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। আর স্থানের মধ্যে
সময় বা কালও নিহিত। সুতরাং কালও বস্তুর মধ্যে শামিল। অতএব উক্ত সত্তা থেকে
সমস্ত বস্তু এবং সমস্ত বস্তুর নাম তাতে নিহিত। সকল কর্মেই তাঁর কর্ম এবং
তাঁর কর্মেই সকল কর্ম নিহিত। সুতরাং সকল বস্তুর বৈশিষ্ট্যই তাঁর বৈশিষ্ট্য
এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যই সকল বস্তুর বৈশিষ্ট্য। অনুরূপভাবে তিনি সর্বকালে
বর্তমান এবং সমগ্র কাল তাঁর চিরন্তন সত্তার সাথে সদা যুক্ত। তাই তো
আল্লাহ্্ বলেন, فاينما تولوا فثم وجه الله (ফাআইনামা তুয়াল্লুÑ ফাছাম্মা
ওয়াজ্হুল্লাহ্) অর্থাৎ, “যেদিকেই তাকাও সেদিকেই আল্লাহ্্র মুখ” অর্থাৎ,
আল্লাহ্্র সত্তা সর্বত্র বিরাজমান। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর সত্তার আওতাভুক্ত। এ
কারণেই আল্লাহ্্র জ্ঞান সবকিছুতেই ব্যাপ্ত। আর এটাই গুণগত জ্ঞানের উৎস।
সত্তার জ্ঞান সত্তা থেকে আসে আর গুণাবলির জ্ঞান উৎসারিত হয় গুণাবলি থেকে।
কিন্তু একক সত্তায়Ñ সত্তা ও গুণাবলির জ্ঞান, কুদরতের বিভিন্ন রূপান্তর,
জীবন, মৃত্যু, উত্থান ও পতন, মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য বিলীন ও প্রকাশ এবং
সৃষ্টির সবই এক।
তকদীর
তকদীর তথা ভাগ্য একটি আজলী বা চিরন্তন
পরিমাপ। উভয় জগতে যে সকল বস্তু মজুদ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে জন্মাবে, সব কিছুর
পরিমাপ এতে নির্ধারিত। এ পরিমাপ তিন প্রকার, যথাÑ জিসমী (বস্তুগত), রূহ্ী
(আধ্যাত্মিক) ও হাকিকী (মৌলিক)। এ তিন প্রকার তকদীর বা পরিমাপ সদা
চিরন্তনের সত্তার মূলে সুশৃঙ্খলভাবে বিদ্যমান। এ তকদীর সকল বস্তুর সাথেই
যুক্ত রয়েছে। এমন কি উভয় জগতের সমস্ত দৃশ্য ও অদৃশ্য, সকলের সাথেও এ তকদীর
যুক্ত আছে। অর্থাৎ জড় জগতে জড় বস্তুর সাথে যে তকদীর সম্পর্ক রাখে সে
তকদীরকে জিসমী ও নাসুতী তথা দৃশ্য ও জড় তকদীর বলা হয়। আর অদৃশ্য জগৎ
ইত্যাদির সাথে যে তকদীর সম্পর্কযুক্ত সে তকদীরকে রূহী তকদীর বলে। ‘আলমে
মাশীয়ত’ অর্থাৎ আল্লাহ্্র ইচ্ছা জগতের সাথে যে তকদীর ও বণ্টন প্রক্রিয়া
সম্পর্কযুক্ত সে তকদীরকে তাকদীরে হাকিকী তথা মৌলিক বা আসল তকদীর বলে। অতএব এ
তিন প্রকার তকদীরের নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি দপ্তর বর্তমান ও নির্দিষ্ট
আছে। প্রথমত, বস্তু ও স্থান, দ্বিতীয়ত, লাওহে মাহ্ফুজ তথা সুরক্ষিত দপ্তর,
তৃতীয়ত, আলমে জাত তথা সয়ম্ভু সত্তার জগৎ। সুতরাং মানব ও সমগ্র বস্তু সত্তাই
হলো এ তিন দপ্তরের মূল। অতএব সত্তাসমূহ নিজ নিজ সত্তায় তথা সৃষ্টির জন্য
স্বয়ং সত্তার কৌশল হতে এক একটি সিন্দুক স্বরূপ। অনাদি অনন্ত সকল বস্তুই এ
সিন্দুকের ভিতরে রয়েছে। এর বাইরে কোনো কিছুই নেই। সুতরাং বের হবার সময় যা
তাতে মজুদ রয়েছে তাই বের হয়। অর্থাৎ সে অস্তিত্বের মধ্যে অনুভূত, অননুভূত,
মৌলিক, রূপক, সত্তাগত বা গুণগত সমস্ত বস্তুই গুণগত বৈশিষ্ট্যের সাথে
বাস্তবরূপে রয়েছে। কেননা যাকে আলামত বলা হয়, নিঃসন্দেহে তাকেই অজুদ তথা
অস্তিত্ব বলা যায়। অর্থাৎ হাত, মুখ, পেশানী, শরীর, চোখ ও কানের আকৃতিতে এবং
আঙ্গুলের মসৃণতায় রয়েছে সে আলামত।
এসব তো হল শুধু জাহেরী ব্যাপার।
কিন্তু আধ্যাত্মিক এবং বাতেনী বৈশিষ্ট্যও সে অজুদের মধ্যে সংযুক্ত। যেমনÑ
আস্বাদন শক্তি, স্মৃতি শক্তি, বোধ শক্তি, জ্ঞান ও শিক্ষা, হায়াত-মউত,
শক্তি, কর্ম ও অবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর পরিমাণ, তালিকা ও সংবাদ
অজুদের আওতাভুক্ত। এ জন্যই এগুলো প্রথম দপ্তরের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। বাকি
সব দপ্তরেও অনুরূপ তালিকা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এগুলোকেও লাওহে মাহ্ফুজে
সন্নিবেশিত করা হয়েছে। লাওহে মাহ্ফুজ শুধু নামযুক্ত বস্তুর বাক্যলিপি নয়,
বরং যে বস্তুর হরফ দ্বারা পরিচিতি মিলে না, যেমনÑ ইন্দ্র্রিয়াদি প্রভৃতিও
তাতে রয়েছে। সুতরাং এ সকল বস্তুর পরিমাপ অনুধাবন করার জন্য অলৌকিক অক্ষর ও
নিক্তি রয়েছে। এ সবেরই নাম দেওয়া হয়েছে লাওহ তথা ফলক। কিন্তু যে লাওহে
মাহ্ফুজ আরশের উপর রয়েছে সেটাই প্রসিদ্ধ। সুতরাং প্রথম দপ্তর যা হচ্ছে
অস্তিত্বময় লাওহে মাহ্ফুজ, জড় জগতের মধ্যে জড়জগতিদের তা প্রয়োজন। যেমনÑ
সৃষ্টি এবং মানব ও তার অবস্থার পরিচয় লাভ করা। আলামত দ্বারা ভালোমন্দ অনুভব
করার জন্য র্আশে অবস্থিত লাওহে মাহ্ফুজ দেখার প্রয়োজন হয় না বরং যার যার
নিজের অস্তিত্বের লাওহে মাহ্ফুজ দ্বারাই তা অনুধাবন করা যায়। অন্যান্য
দপ্তরের ব্যাপারও অনুরূপ। অভিজ্ঞ মহলের কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। আয়তন,
আকৃতি ও পরিমাণবিহীন কোনো বস্তু বা কর্ম মজুদ হয় না। কাজেই যদি কোনো
ব্যক্তি মনে করে যে তকদীর নিয়ে তর্ক করা ঠিক নয়, তবে তার সেই মনে করাও
তকদীর হতে আগত। যদি কেউ মনে করে যে, তকদীরে যা আছে তাই হবে, তাহলে এটাও তার
তকদীর হতে। আর যদি কেউ মনে করে বিনা চেষ্টায় কিছু হয় না, তাহলে এটাও তার
তকদীর হতে। যদি কেউ বিশ্বাস করে যে তকদীরের ওপর ঈমান আনা এবং তার ওপর
নির্ভর করার কোনো প্রয়োজন নেই, তবে তার এ বিশ্বাসটিও তকদীর হতে আগত। আবার
যদি কেউ মনে করে যে, ‘তকদীর-এ-মোব্রাম’ অপরিবর্তনীয়, তবে এটাও তার তকদীর
হতে।‘মোবারক-এ-হাকিকী’ কখনো রদ হয় না। যে তকদীর পরিবর্তন হয় তাও হরফে
হাকিকীতে আযলি কিসমতে লেখা আছে। অনেকে তকদীরের পরিবর্তন সম্বন্ধে এ গল্পটি
বলে থাকেÑ হযরত খাজা উস্মান হারুনী (রহঃ)-এর নিকট এক নিঃসন্তান ব্যক্তি এসে
পুত্র সন্তান কামনা করে দোয়া চায়। তিনি মোরাকা’বায় যেয়ে দেখলেন যে,
‘তকদীর-এ-মোব্রাম’ এ তার কোনো সন্তান নেই। এ কথা শ্রবণ করে উক্ত ব্যক্তি
খাজা সাহেবের নিকট বার বার প্রার্থনা করছিল। বারংবার তার অনুরোধে খাজা
সাহেব আল্লাহ্্ তায়ালার নিকট দরখাস্ত পেশ করলেন। দরখাস্তের জবাবে আওয়াজ এল,
যখন তার ‘তকদীর-এ-মোব্রাম’ এ কোনো সন্তান নেই, তখন কী করে সন্তান হবে? তখন
খাজা রাগান্বিত হয়ে অজ্দের হালে মন্দিরে কালির সম্মুখে চলে গেলেন, এ জন্য
যে, কালির নিকট সন্তান চাইবেন। এ সময় কাশ্ফের মাধ্যমে খাতুনে জান্নাত হযরত
ফাতেমা (রাঃ)র সাথে তাঁর সাক্ষাত হল। তিনি হযরত খাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে
বললেন, তুমি অপেক্ষা করÑ আমি তোমার জন্য আল্লাহ্্ তায়ালার নিকট সন্তান
চাচ্ছি। তখন হযরত খাতুনে জান্নাতের দোয়ায় আল্লাহ্্ তাঁকে পুত্র লাভের হুকুম
দিলেন। অর্থাৎ উক্ত ব্যক্তির একটি পুত্র হবে। এ ঘটনা সত্য হলে এর বিবরণ
থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, হযরত খাজা যে তকদীর সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন, আসল
তকদীর তার ওপরে। কেননা হযরত খাজার এ ধরনের রাগ ও অজ্দ হওয়াও তো আল্লাহ্্র
তরফ হতেই, অন্য কিছু হতে নয়। আর তকদীর পরিবর্তন হওয়া এটাও তকদীর হতে।
অর্থাৎ তাকদীরে মোয়াল্লাক তথা পরিবর্তনশীল তকদীর তা প্রকৃত তকদীর নয় বরং
রূপক। এটা তকদীরের অনুরূপ একটি রূপ প্রকাশ করে। যেমন আকাশের মেঘ যখন
অতিরিক্ত বারিসিক্ত হয় তখনই বর্ষণ করে, তা ছাড়া নয়। তেমনই পরিবর্তনশীল
তকদীর সৎ কর্মের দ্বারা পরিবর্তিত হয় তথা মন্দের বদলে পুণ্য ও ভালো হয়।
التقدير لايرد (আত্তকদীরু লাÑইয়ারুদ্দু) অর্থাৎ, “তকদীর পরিবর্তিত হয় না” এ
হাদিস দ্বারা ‘তকদীর-এ-হাকিকী’ বোঝানো হয়েছে। সমগ্র তকদীরের চূড়ান্ত
ফলাফলই তকদীর-এ-হাকিকী। এটাই আসল ও অপরিবর্তনীয় তকদীর। এ তকদীরের কোনো
পরিবর্তন নেই। মূলত আসল তকদীর একটিই, বাকি সব এর শাখা-প্রশাখা বা ডাল-পালা।
সুরের আলোচনা
অন্তরওয়ালাগণ
শুধু গানের সুর শোনেন না বরং এর দ্বারা তাঁরা তাঁদের মনকে প্রসারিত করার
চেষ্টা করেন। এতে তাদের মনে কোনো পর্দা পড়ে না ও তাদের কোনো পাপ হয় না।
অজ্ঞরা সুর ও মধুর কণ্ঠকে পাপ ও অন্তরে আবরণ সৃষ্টির কারণ মনে করে। আবেদ
তথা জাহেরী ইবাদতকারীগণ নিজেদের অবস্থার আলোকে মনে করে যে, মধুর কণ্ঠ তাদের
জন্য পর্দাস্বরূপ বটে। কারণ জাহেরী ভাবে তারা নামাজ, রোজা ও কোরান পাঠে
লিপ্ত থাকে কিন্তু এতে তাদের মনের কালিমা দূর হয় না। অথচ এগুলোকে তারা আসল
ইবাদত বলে মনে করে এবং বিশ্বাস করে যে, কিয়ামতের দিন এর পুণ্য পাবে। কিন্তু
তারা জানে না যে, মধুর কণ্ঠ ও মিষ্টি সুর মনের পর্দা ও কালিমা দূর করে এবং
শ্রোতা মগ্ন চিত্তে তা শ্রবণ করে আর স্রষ্টার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। সে
স্রষ্টার পথের সন্ধান পায় ও তার মন প্রসারিত হয়। এমনকি সে এ সুরের
স্রষ্টাকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। এ মধুর সুরে তার মন নরম হয়ে যায় ও
মানসিক স্বচ্ছতা অর্জিত হয়। হৃদয়গ্রাহী সুর যা অন্তরে ভাবের সৃষ্টি করে তা
কোনো ত্বরিকার জন্য নির্দিষ্ট নয়। যেকোনো আহ্লে দেল তথা অন্তরওয়ালাগণের
জন্যই এ সুর বা গজল। হৃদয়গ্রাহী মধুর আওয়াজ আল্লাহ্্ তায়ালার একটি সূক্ষ্ম
শান এবং নূরী অন্তরের শানও সূক্ষ্ম। তাই উভয় সূক্ষ্ম শানই একে অপরের
প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবের সৃষ্টি করে। অতএব যারা এ
মহামূল্যবান নেয়ামত থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য সুর মাকরূহ্ ও হারাম হওয়াতে
কোনো সন্দেহ নেই। আর এ মহামূল্যবান নেয়ামত যারা পেয়েছেন এবং যারা এ
সম্পর্কে জানেন মধুর সুর তাদের জন্য পরশতুল্য ও অতি প্রয়োজনীয়। ‘এহিয়াউল
উলুম’, ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’, ‘তার্য়ারুফ’ প্রভৃতি গ্রন্থে হাদীস ও অন্যান্য
গ্রন্থ থেকে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ‘তোহ্ফা-এ বর্জখী’ পুস্তিকা
পড়লেও এ সম্পর্কে জানা যেতে পারে। আমরা এখানে মেশ্কাত শরীফ থেকে দু একটি
হাদীস উদ্ধৃত করব, জাহেরপন্থীদের জন্য। অন্তরওয়ালাদের দলিল স্বয়ং সুরের
মধ্যেই নিহিত আছে। তাঁরা নিজেরাই অনুভব করতে পারেন যে, সুর শ্রবণে তাদের
অন্তর আল্লাহ্্র প্রতি নিবদ্ধ হয় কিনা। যদি আল্লাহ্্র প্রতি নিবদ্ধ হয়,
তাহলে তাতে ছওয়াব ও পুণ্য আছে আর যদি নিবদ্ধ না হয়, তাহলে সুর মোবাহ তথা
অনুমোদিত বলে গণ্য হবে। আর এতে যদি কোনো খারাপ ভাবের সৃষ্টি হয় তাহলে শোনা
পাপ। আর এ পাপও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমনÑ মাকরূহ্, হারাম, অথবা
‘গুনাহ-এ-কবীরা’ ইত্যাদি। কিন্তু অন্তরওয়ালাদের এ সব পাপ স্পর্শ করতে পারে
না। মেশ্কাত শরীফে আছেÑ وعن عائشة (ض) قالت ان ابابكر دخل عليها وعندها
جاريتان فى ايام منى تدففان وتضربان وفى روايت تغنيان بما تقاولت الانصار
يوم بعاث والنبى (ص) متغش بثوبه فانتهر هما ابوبكر فاكشف النبى صلى الله
عليه وسلم عن وجهه فقال لدهما يا ابا بكر فانها ايام عيد وفى رواية
ياابابكران لكل قوم عيدا وهذا عيدنا متفق عليه (ওয়া’আন্ আয়েশাতা (রাঃ)
ক্বালাত্ ইন্্না আবাবাক্রিন্ দাখালা আলাইহা ওয়াইন্দাহা জারিয়াতানি ফী
আইয়ামি মিনা তুদাফ্ ফিফানি অতাদরিবানি ওয়াফী রাওয়াইয়াতিন্ তুগান্নিয়ানি,
বিমা তাক্বাওয়া লাতিল আনসারি ইয়াওমা বুয়াছিন, ওয়ান্ নাবীয়্যু (সাঃ)
মোতাগাশ্শিন বিছাওবিহি ফান্তাহারাহুমা আবুবাকরিন ফাকাশাফান্ নাবীয়্যু
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামা আন্ ওয়াজহিহী ফাক্বালা দা’হুমা ইয়া
আবাবাকরিন ফাইন্নাহা আউয়্যামু ঈদিন্ অফী রাওয়াইয়াতিন্Ñ ইয়া আবাবাকরিন ইন্না
লিকুল্লি কাওম্ন্ ুঈদুনÑওয়াহাজা ঈদুনা মোত্তাফিকুন্ আলাইহি) অর্থাৎ, হযরত
আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনÑ একদা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) তাঁর নিকটে
আসেন। তখন আন্সার গোত্রের দুটি যুবতী মেয়ে তাঁর সম্মুখে ছিলেন। দিনটি ছিল
ঈদুজ্জোহা ও আইয়্যামে তাশরীকের দিন। তারা দফ বাজাতে ছিল। দফ বাজানোর স্থলে
গান গাইতে ছিল বলে অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে। তারা বোয়াজ যুদ্ধের গান
গাইতেছিল। রাসূল (সাঃ) কাপড়ে মুখ আবৃত করে ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাদের
ধমক দিলেন, তখন হযরত (সাঃ) মুখের আবরণ খুলে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বললেন,
হে আবু বকর! ওদের ছেড়ে দাও, আজ ঈদ অর্থাৎ খুশির দিন। অন্য বর্ণনায় আছে,
হুজুর (সাঃ) বললেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক কাওমের আনন্দের দিন রয়েছে। আজ
আমাদের আনন্দের দিন (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)। অনেকে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলে
থাকে, তারা নৃত্য ও ভাব বিহ্বলতার সঙ্গে দফ বাজিয়েছিল। এ বাজানো প্রসঙ্গে
দ্বিমত রয়েছে। অনেক বলে, এটা মোবাহ। অনেকে বলে, এটা হারাম। সঠিক মত হল যে,
বিবাহ-শাদী ও অলীমার মধ্যে এটা করা তাঁর হুকুম আর ঈদের দিন মোবাহ। সহি
বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেছেন, ওহে!
পয়গাম্বরের সামনে মেজ্মার বাজাচ্ছ? মেজ্মার এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র যা গায়ক
গানের মধ্যে বাঁশি, দফ এবং রবাবের মতোই বাজিয়ে থাকে। মেজ্মারকে শয়তান এজন্য
বলা হয়েছে যে, তা মনকে খেলতামাসায় লিপ্ত করে এবং আল্লাহ্্র স্মরণ ভুলিয়ে
দেয়। স্মরণীয় যে, গান বাদ্য শ্রবণকারীরা এ হাদীসের ভিত্তিতেই গানের সঙ্গে
বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি বাজানো মোবাহ হওয়ার পক্ষে দলিল পেশ করে থাকেন।
নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে এ হাদীস থেকে যা বোঝা যায় তা হল এই যে, হযরত আবু
বকর (রাঃ) গান বাদ্য করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তিনি ধমক দিয়েছিলেন তার কারণ
ছিল এই যে, তিনি ভেবেছিলেন, নিছক গান বাদ্য ও তামাশা নিষেধ ছিল এবং তিনি
মনে করেছিলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শায়িত বা অন্যমনস্ক থাকার দরুন এ ঘটনার
প্রতি লক্ষ করেননি, তাই তিনি উক্ত কাজ থেকে নিষেধ করেননি। আর হযরত আবু বকর
জানতেন না যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঈদের দিনে সামান্য গান বাজনা করা ও শোনার
অনুমতি দিয়েছিলেন। মোট কথা হযরত আবু বকর (রাঃ) ব্যাপারটি ভালো করে উপলব্ধি
করতে পারেননি। তাই তিনি নিষেধ করেছিলেন। অতএব উক্ত হাদীস দ্বারা ঈদের দিনে
এবং যে সকল স্থানে উৎসব করা অনুমোদিত সেসব স্থানে সামান্য গানবাজনা জায়েজ
প্রমাণিত হয়। এর দ্বারা সর্বতোভাবে গানবাজনা জায়েজ প্রমাণিত হয় না। বুর্জুগ
ব্যক্তিগণ বলেছেন যে, এর দ্বারা গানবাজনা শোনা নিষেধ প্রমাণিত হয় না বরং
এর অনুমোদনই প্রমাণিত হয়। এমন কি তাঁরা রিপুর তাগিদে হলেও গান শোনাকে বৈধ
মনে করেন। কারণ উৎসবের দিনে গানবাজনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং মেয়েদের গান
শোনা রিপুর চাহিদার বাইরে নয়। যেসব মেয়েরা গানবাজনা করে তাদের সুর ও কথা
অবশ্যই হৃদয়গ্রাহী হবে। অতএব খুশির দিনে আত্মতৃপ্তির জন্য মেয়েদের গানবাজনা
শোনা নিষেধ নয়। এমতাবস্থায় মেয়েদের অনুপস্থিতিতে এবং নিছক আত্মতৃপ্তির
উদ্দেশে নয়, এরূপ গানবাদ্য নিষেধ হতে পারে না বরং অধিকতর অনুমোদনযোগ্য।
সুতরাং আত্মার বিশুদ্ধায়ন ও আল্লাহ্্র স্মরণের জন্য গানবাজনা পরকালের
সম্বল।
হযরত আবু বকর (রাঃ) যে বাদ্যযন্ত্রকে শয়তানের হাতিয়ার বলেছেন,
যদি হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়ও কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর হাতিয়ার
ছিনিয়ে নিয়ে তা দিয়ে যদি শক্রকে ঘায়েল করা যায়, তাতে ক্ষতি কী? বরং উত্তম।
শত্রুর তলোয়ারেই শত্রু ধ্বংস হল। সুতরাং আল্লাহ্্ওয়ালাগণ যদি গানের হাতিয়ার
দ্বারা শত্রু ধ্বংস করেন তাতে কোনো ক্ষতি নেই বরং উত্তম। শত্রুর অস্ত্রেই
শত্রু নিধন হল। এভাবেই আল্লাহ্ওয়ালাগণ গান বাজনা দ্বারা শয়তানকে মেরে
থাকেন। এ গানের মাধ্যমে যখন জিকিরের উন্নতি, মহব্বত, মনের নম্রতা,
মোকামাতের উন্নতি, কাশ্ফ ও এল্হাম প্রভৃতি লাভ হয় তখন উক্ত হাতিয়ার তীক্ষè
থেকে তীক্ষèতর হয়। এর ফলে নফ্সও ধ্বংস হয়ে যায়। অতএব যে কাজে নফ্সের কোনো
চাহিদা নেই এবং শয়তানের অনুপ্রবেশ নেই, সে কাজ নিষেধ হবে কেন? এ কারণেই
বাহ্যদর্শী আলেমগণের হারাম, মাকরূহ্ ফতোয়ার প্রতি আল্লাহ্্ওয়ালাগণ কর্ণপাত
করেন না। এ জন্যই হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (রহঃ), হযরত খাজা নিজামউদ্দিন
আউলিয়া (রহঃ) এবং খাজা জুন্নুন মিসরী (রহঃ) গানবাজনার পক্ষে মত দিয়েছেন।
তাঁরা গানকে রূহের খোরাক বলে আখ্যা দিয়েছেন। অনুরূপভাবে হযরত ইমাম গায্যালী
(রহঃ)ও রাগরাগিনীকে রূহের খোরাক বলেছেন। একইভাবে অসংখ্য অলীয়ে কামেলগণ
থেকে গানবাজনা জায়েজ প্রমাণিত রয়েছে। কোরান শরীফ এবং কবিতাদি শুনে
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও কোনো কোনো সাহাবা বেহুশ হয়ে যেতেন, কেহ কেহ মারাও
গিয়েছেন। ‘কাউলুল কেরাম’ গ্রন্থে কোরান হাদিস ও যুক্তি প্রমাণ দ্বারা এ
সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, পড়ে দেখুন।
প্রত্যেক ইবাদতে আনুগত্যের নিয়ত শর্ত
ইবাদতের
জন্য নিয়ত করা প্রয়োজন ও ফরজ। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদত হয় না। নিয়ত ছাড়া
ইবাদাত অর্থহীন। এতে যেমন কোনো পুণ্য নেই তেমনি কোনো পাপও নেই। আল্লাহ্্র
উদ্দেশে ইবাদত করা পুণ্যের কাজ। আল্লাহ্্ ছাড়া অন্যের উদ্দেশে ইবাদত করা
পাপ ও শাস্তিযোগ্য। আর কোনোরূপ উদ্দেশহীন ইবাদতে পাপ-পুণ্য কিছুই নেই। তাই
তো হাদিস শরীফে বলা হয়েছেÑ انما الاعمال بالنية (ইন্নামাল আ’মালু বিন্
নিয়্যাতি) অর্থাৎ, “নিয়ত ব্যতীত কোনো ইবাদত হয় না।” সুতরাং যে কাজে
আল্লাহ্্র প্রতি আনুগত্য নেই, তা ইবাদত হিসাবে গণ্য নয়। নামাজ, রোযা, রুকু,
সিজ্দা, দাঁড়ানো ও বসা সবক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ, যদি
কোনো ব্যক্তি জমিনে মাথা রাখে, তবে সে সিজ্দা ও ইবাদত জমিনেরও হবে না
আল্লাহ্্রও হবে না। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি যদি রুকু অথবা ক্বিয়াম করে
তাতে পাপ পুণ্য কিছুই হয় না। ইবাদতের জন্য নিয়ত শর্ত না হলে, নামাজ পড়লে
লোক কাফের হয়ে যেত। কারণ নামাজে মাটিকে সিজ্দা করা হয়, আল্লাহ্্কে নয়।
অর্থাৎ সিজদাকারীর কপাল মাটিতে ঠেকান হয় আল্লাহ্্তে যুক্ত হয় না। কিন্তু
এতে আল্লাহ্্র আনুগত্যের নিয়ত থাকে বলেই তা ইবাদত বলে গণ্য হয়। এ কারণেই এর
নাম ইবাদত, আর ঐ সিজ্দা আল্লাহ্্ই পেয়ে থাকেন, যদিও তা মাটিতে করা হয়।
কিন্তু জমিন বা মাটি কিছুই পায় না। হাজার হাজার লোক দিনরাত মাটিতে সিজ্দা
করে, কিন্তু তা নিয়তের কারণে আল্লাহ্্তে পৌঁছে। এমন কি মানুষ হাত, মুখ,
নাক ও কপালসহ মাটির নিকটবর্তী হয় কিন্তু কেবলমাত্র নিয়তের ফলে তাতে
আল্লাহ্্র নৈকট্য লাভ হয়। এ জন্য ‘ফতুয়ায়ে তায়াছ্ছুরীতে’ বলা হয়েছে, السجدة
اثنان سجدة العبادة والسجدةا لتحية سجدة العبادة لله تعالى خاصة والسجدة
التحية بد وان الله تعالى لو جه التكريم فى خمسة حال جاز للقوم ان يسحد
للنبى و المريد للشيخ والر عية للملك والو لد الوا لد ين والعبد للمولى فى
كل حال يرخص فتوى سر اجى اذاسجد الانسان سجدة تحية لايكفر وفتوى خانى وان
سجد الرجل للسلطان وكان قصده التعظبم والتحية دون الصلوة لايكفر فتوى كافى
قال صد رالشهيد من سجدبغير لله تعالئ وير يد التحية دون العبادة لايكفر
(আস্সিজদাতু ইছ্নানে সিজ্দাতুল ইবাদাতি ওয়াসসিজ্দাতুত্ তাহিয়্যাতি,
সিজ্দাতুল ইবাদাতিল্লাহি তা’য়ালা খাচ্ছাতুন্ ওয়াস্ সিজ্দাতুত্ তাহিয়াতি
বিদুনিল্ল্াহি তায়ালা, লিওয়াজ্হিত্ তাক্রীমি ফীখাম্ছাতি হালিজাজা লিল্
ক্বাউমি আই ইয়াসজুদা লিন্ নাবীয়্যে ওয়াল মুরিদু লিশ্-শাইখি ওয়ার রায়তুলিল্
মালিকে ওয়াল ওয়ালাদু লিল ওয়ালিদাইনি ওয়াল্ আব্দু লিল্ মাওলা ফী কুল্লিহালি
ইউরখাচ্ছু। ফতুয়ায়ে সিরাজীÑ ইজা সাজাদাল ইন্সানু সিজ্দাতুত তাহ্ইয়াতু
লাইয়াকফুরু। ফতওয়ায়ে খানীÑ ওয়া ইন্ সাজাদার রাজুলু লিস্সুল্তানি অকানা
কাছদুহুত্ তাজিমি অত্তা-হিয়াতু দুনাছ্ ছালাতি লাইয়াকফুরু। ফতুয়ায়ে কাফীÑ
ক্বালা ছাদরুশ্ শাহীদু মান সাজিদা বিগাইরিল্লাহি তায়ালা ওয়াইউরিদুত্
তাহিয়াতু দুনাল ইবাদাতি লাইয়াকফুরু) অর্থাৎ, ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলেন,
সিজ্দায়ে তাহিয়া তথাÑ সম্মানসূচক সিজ্দা সালামের মতোই। ‘যাওহারে গবিতে’ বলা
হয়েছে, সিজ্দা পাঁচ প্রকার। যথাÑ (ক) সিজ্দায়ে অবুদিয়াত (ইবাদতের সিজ্দা)
(খ) সিজ্দায়ে তাহিয়্যাত (সম্মানসূচক সিজ্দা) (গ) সিজ্দায়ে যাওয়াজ (বৈধ
সিজ্দা) (ঘ) সিজ্দায়ে ইবাহাত (অনুমোদিত সিজ্দা) (ঙ) সিজ্দায়ে ফরজিয়ত (ফরজ
সিজ্দা)। সম্মানসূচক, বৈধ ও অনুমোদিত সিজ্দা আল্লাহ্্ ভিন্ন অন্যান্য
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সম্মানসূচক সিজ্দা সালাম হিসেবে গণ্য। অন্য দু প্রকার
সিজ্দা সর্বদা মোবাহ হিসেবে গণ্য। ইবাদতসূচক ও ফরজ সিজ্দা একমাত্র
আল্লাহ্্র জন্য এবং এ সিজ্দার জন্য অজু করা শর্ত। বিনা অজুতে অনুরূপ সিজ্দা
বৈধ নয়। আল্লাহ্্ ছাড়া অন্যান্য সিজ্দার ক্ষেত্রে অজু করা শর্ত নয়। অতএব
অজুবিহীন সিজ্দা ইবাদত নয়।
এজন্য মোজাদ্দেদ আলফেসানী তাঁর মাকতুবাতের
দ্বিতীয় খন্ডে বিরানব্বই পৃষ্ঠায় লিখেছেনÑ “কোনো কোনো ফেকাহ্ শাস্ত্রবিদ
বাদশাহকে সিজ্দায়ে তাহিয়্যা করা জায়েজ বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে বাদশাহদেরও
বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। যেন তারা লোক দ্বারা সিজ্দা গ্রহণে
জোর-জবরদস্তি না করেন।” আবার অনেকে হারাম লিখেছেন। কিন্তু কেউ-ই র্শিক
লিখেননি। অবশ্য যদি কেউ লিখে থাকে, তবে সেটা তার জন্যই র্শিক। এ সিজ্দার
মধ্যে শরীক করার মতো কোনো কারণ সে নিজের জন্য পেয়ে থাকবে। তা না হলে
বিভিন্ন জনে অবনত হয়ে সালাম করা অর্থাৎ মাথা রুকুর মতো করে সালাম করাকে
হারাম লিখেছেন। এটা কেন লিখেছেন? এটা তাদের জ্ঞান ও বুঝ অনুযায়ী লিখেছেন,
তা নইলে কোথায় হারাম আর কোথায় র্শিক। এখানে চিন্তা করা দরকার যে নামাজে
সিজ্দা, রুকু এবং দাঁড়ানÑ এ তিনটি ফরজ। সিজ্দা অথবা রুকুর ন্যায় অবনত হয়ে
সালাম বা আদাব করা যদি র্শিক অথবা হারাম হয়, তাহলে কিয়ামের মতো দাঁড়ানো
অবস্থায় সালাম বা আদাব করাও তো হারাম এবং র্শিক। কারণ নামাজে দাঁড়ানো ফরজ
এবং তা ইবাদতও বটে। নামাজে হাত বাঁধা কোনো ফরজ নয় বরং নামাজে দাঁড়ানো ফরজ
এবং ইবাদত। অতএব দাঁড়িয়ে সালাম করাও তো হারাম এবং র্শিক হবে এবং যে কোনো
কিছুর সামনে দাঁড়ানো তো নিরেট হারাম ও র্শিক হবে। এর উত্তর কী হবে?
প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো র্শিক নয়, শুধু কথার কথা মাত্র। এতে আল্লাহ্্র কোনো
ক্ষতি নেই।
যার মধ্যে ‘সিফাতে উলুহিয়্যাত’ তথা পরম সত্তার শ্রেষ্ঠত্বগুণ
এবং ‘হুইয়াত’ তথা একত্বের জ্ঞান প্রস্ফুটিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার
কোনো ইবাদত নেই। এ জন্য জ্ঞানী ও আল্লাহ্্ওয়ালাদের নিকট র্শিক বলতে কিছু
নেই। ঈমানে তাকলিদী ও ঈমানে তাহ্কিকী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়
বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। কেউ যদি কোনো ওস্তাদ ও পীর কিংবা অন্য কারও আদবের
জন্য জমিনে মাথা রাখে তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন যে, সে কি আল্লাহ্্
ব্যতীত অন্যের ইবাদতের উদ্দেশে মাথা নত করেছে, না সম্মানের জন্য? যদি সে
উত্তরে বলে যে, সে ইবাদতের উদ্দেশে সিজ্দা করেছে, তাহলে তার দুটি দিক
রয়েছে। যদি উক্ত ব্যক্তি জাহেরপন্থী হয়, তাকে মুশরিক বলা যেতে পারে, আর যদি
আরিফ হয়, তাহলে তাকে যে মুশরিক বলবে, সে নিজেই মুশরিক এবং কাফের হয়ে যাবে।
কেননা যে ব্যক্তি কাফের নয় তাকে যে জোর করে কাফের বলে সে-ই কাফের হয়ে যায়।
আরেফ বিল্লাহ জানেন, যে জিনিসের মধ্যে ‘সিফাতে হুইয়াত’ এবং ‘সিফাতে
উলুহিয়াত’ নেই তা আল্লাহ্্ হতে পারে না। আল্লাহ্্র ক্ষেত্রে ‘হওয়ার’ প্রশ্ন
তাঁর মহিমা বহির্ভূত। কারণ আল্লাহ্্ তায়ালা স্বয়ং অনাদি অনন্ত, নূতন
আবিষ্কৃত নন। অতএব কেউ যদি আল্লাহ্্ নন এমন কিছুকে আল্লাহ্্ মনে করে তাহলে
তার এ ধারণা ভুল ও ভ্রান্ত হবে। এতে আল্লাহ্্ বাতিল হয়ে যাবে না বা দ্বিতীয়
কোনো আল্লাহ্্ সৃষ্টি হবে না।
সুতরাং যে ব্যক্তি এ তাওহীদ সম্পর্কে
অবহিত তার কাছে র্শিক এর কোনো আশঙ্কা নেই। কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, আমরা
‘কিব্লামুখী’ হয়ে আল্লাহ্্র ইবাদতের উদ্দেশে মাটিতে সিজ্দা করি। অপরদিকে
পীরকে সিজ্দা করার সময় পীরের দিকে মুখ করেই সিজ্দা করা হয়, এটা কেমন করে
বৈধ হতে পারে? এর উত্তর হল যে, সম্মানসূচক সিজ্দার জন্য কেবলামুখী হওয়া ও
অজু করা শর্ত নয়। কারণ এ সিজ্দা কারও ইবাদতের উদ্দেশে নয়, নিছক সম্মান
প্রদর্শনই এ সিজ্দার উদ্দেশ ও লক্ষ্য। সম্মান প্রদর্শনের জন্য কেউ যদি কারও
সামনে, মাটিতে অথবা চৌকিতে মাথা কিংবা মুখ লাগায় অথবা মাথা ও চোখের দ্বারা
পদধূলি গ্রহণ করে তাতে কোনোই ক্ষতি নেই। কারণ সম্মান প্রদর্শন করা
প্রকৃতপক্ষেই ইবাদত নয়। নামাজের তাশাহ্হুদের মধ্যে যখন “আস্সালামু আলাইকা
ইয়া আইয়্যুহান নাবীয়্যু অরাহ্ মাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু” পড়া হয়, তখন নবী
করীম (সাঃ) এর সুরত সামনে আছে বলে মনে করা অবশ্য প্রয়োজন। অন্যথায় সালাম
সম্বোধন করা প্রতারণা হবে। অনুরূপ ‘এহিয়াউল উলুম’ ও অন্যান্য গ্রন্থে বলা
হয়েছে, “আল্লাহ্্র ইবাদতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনা অবৈধ হওয়া
সত্ত্বেও নামাজের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সম্মুখে উপস্থিত বলে কল্পনা
করা যখন হারাম বা র্শিক নয় বরং পুণ্যের কাজ, তখন নামাজ বহির্ভূত সম্মান
প্রদর্শন নিষেধ হবে কেন?” নামাজের সিজ্দা যদিও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্্রই
উদ্দেশে করা হয় কিন্তু এতে আল্লাহ্্ ভিন্ন অন্যের তাজিমও শর্ত রয়েছে। যেমনÑ
কেবলামুখী হওয়া ও মাটিতে সিজ্দা করা। এখানে আল্লাহ্্ ভিন্ন অন্যের তাজিম
করা হলেও এটাই যথার্থ ছাওয়াব বা প্রকৃত পুণ্যের কাজ। সম্মান প্রদর্শন
পুণ্যহীন কাজ নয়। কিন্তু ইবাদতের ধরনে কারও প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা
অবৈধ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পীরকে সম্মানসূচক সিজ্দা করা কোনো মতেই
পুণ্যহীন কাজ নয়। হযরত ইমামে রাব্বানী মোজাদ্দেদ আলফেছানী (রহঃ) তাঁর
‘মাব্দা ওয়া মা’দ’ গ্রন্থে মুর্শিদের অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, “মুরিদের
জন্য মুর্শিদই হচ্ছে রাসূলে হাকিকী বা প্রকৃত আল্লাহ্্র দূত এবং তাঁর হক
অন্যের হকের সাথে কোনো সম্বন্ধ রাখে না।” পীর বা মুর্শিদের হুকুম-আহকাম এবং
কর্মপদ্ধতি অনুসরণই মুরিদের জন্য প্রকৃত শরীয়ত। মুরিদ যদি পীরে কামেলের
সম্মানার্থে তাঁর সামনে মাথা অবনত করে এবং তিনি যদি তাকে নিষেধ না করেন তবে
তা বৈধ হওয়ার জন্য এ প্রমাণই যথেষ্ট। মুরিদের জন্য দ্বিতীয় কোনো দলিল বা
প্রমাণ সন্ধান করার প্রয়োজন নেই। জাহেরি শরিয়তগ্রন্থে সম্মানসূচক সিজ্দা
প্রসঙ্গে যদিও ভিন্ন মত আছে তবে তা অত্যাচারী শাসক, ধনী ও মাতব্বর
ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। কিন্তু পীরে কামেলকে সম্মানসূচক সিজ্দা প্রসঙ্গে এতে
কোনো নিষেধ উল্লেখ নেই। সুতরাং পীর এবং বাদশাহ্ ও অন্য কারও যদি ইসলামের
ইতিহাসে সম্মানার্থে সিজ্দা হয়ে থাকে, তবে নিঃসন্দেহে তা জায়েজ বলে ধরে
নেওয়া যেতে পারে। এতে কিয়াস করা সম্পূর্ণ ভুল। আর যদি এ কথা সর্বসম্মত হয়
যে, এ সম্মানসূচক সিজ্দা বাদশাহ্ বা অন্যের জন্য জায়েজ নয়, তবে এতে একথা
প্রমাণ হয় না যে, তা পীরের জন্যও জায়েজ নয়। যেহেতু এ সম্মানসূচক সিজ্দাতে
মুরিদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ফায়দা রয়েছে, তাই ত্বরিকতপন্থী মাশাইখগণ এ সিজ্দাকে
জায়েজ বলেছেন।
হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিছে দেহ্লবী (রহঃ) এবং
ত্বরিকতপন্থী অন্যান্য উলামাগণও এ সিজ্দাকে জায়েজ বলে মত প্রকাশ করেছেন।
মাওলানা সাহেব তাঁর স্বরচিত ‘ইন্তিবাহু ফি সালাসিলে অলীআল্লাহ্্’ গ্রন্থে
উল্লেখ করেছেন যে, ‘মুর্শিদের আকৃতিকে নিজের সামনে কল্পনা করে অতঃপর জিকির
করবে।’ অনুরূপভাবে হযরত কাজী ইউসুফ নাসেহ্ (রহঃ) মুর্শিদের সুরতকে
‘জালুয়ায়ে হক্ব’ বা ‘আল্লাহ্্র তাজাল্লি’ বলেছেন।
সিজ্দার বিবরণ
আল্লাহ্্র
ইবাদতের উদ্দেশে আপাদমস্তক অবনত করার নাম সিজ্দা। কারণ আল্লাহ্্র দিকে
আকৃষ্ট হওয়াই ইবাদতের উদ্দেশ, নিছক মাথা নত করা ইবাদতের উদ্দেশ নয়। অতএব
আল্লাহ্্র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবনত করার নামই সিজ্দা।
শুধু যদি মাথা অবনত হয় এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবনত না হয় তথা এর
বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে তাকে আল্লাহ্্র ইবাদত বলা যায় কী করে? সুতরাং সমস্ত
অঙ্গের জন্যই সিজ্দার নির্দেশ, আর সিজ্দার দ্বারা উদ্দেশ একাগ্রতা অর্জন।
দেহ মন ও দৃষ্টি ধ্যানের সমন্বয় ছাড়া প্রকৃত একাগ্রতা অর্জন অসম্ভব। আর
একাগ্রতা ছাড়া ইবাদত শুদ্ধ হয় না। এ জন্যই সিজ্দায় প্রত্যেক অঙ্গ ও দেহের
একাগ্রতা থাকা বাঞ্ছনীয় এবং এটাই এর প্রকৃত উদ্দেশ। এ কারণেই প্রত্যেক
অঙ্গের জন্য আলাদা সিজ্দার বিধান রয়েছে তা মাথার মতো মুখ, পা ও বক্ষ
প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ভিন্ন ভিন্ন সিজ্দা রয়েছে। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই
সিজ্দায় স্ব-স্ব মাথা অবনত করে। এ সব সিজ্দা শেষ হয় মাটিতে। কিন্তু যে সব
সিজ্দায় পূর্ণ একাগ্রতা বিদ্যমান তাকে ‘সিজ্দায়ে তাজাল্লি’ বলা হয়। সে
সিজ্দায় আল্লাহ্্র জ্যোতি বিকশিত হয় এবং সিজ্দাকারীর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
একাগ্র হয়ে আল্লাহ্্র প্রতি অবনত হয়ে পড়ে। তখন সে ব্যক্তি মাটিতে অথবা
নিজের অবস্থায় দাঁড়িয়ে বা বসে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন তাকেই সিজ্দা বলা
হয়। রুকুসহ সব ক্ষেত্রেই অনুরূপ একাগ্রতা প্রয়োজন। কিন্তু স্তরে ও পূর্ণতায়
বিভিন্নতার কারণের জন্য বিভিন্ন অবস্থার নাম আলাদা আলাদা তথা রুকু, দাঁড়ান
ও বসা প্রভৃতি রাখা হয়েছে। এ সব কিছুরই উদ্দেশ হচ্ছে আদব, তা’জিম, ইবাদত ও
ইরাদাত। অভিধানে সিজ্দার অর্থে লেখা হয়েছে মাথা মাটিতে রাখা ও আল্লাহ্্র
সম্মুখে মাথা ঝুঁকানো। এর বৈশিষ্ট্যও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য হতে আলাদা নয়।
সালামের বিবরণ
সালাম
একটি প্রশংসাসূচক শব্দ। শাব্দিক অর্থের বিচারে তা আশীর্বাদজ্ঞাপক বাক্য।
ভাবার্থের ক্ষেত্রে এর শাব্দিক অর্থ বিবেচ্য নয়। ভাবের বিচারে এর তাৎপর্য
আলাদা। এ অর্থে সালামের মধ্যে দোয়া, প্রশংসা, অভ্যর্থনা ও সম্মান অবশ্যই
নিহিত রয়েছে। এ সবই সালামের অন্তর্ভুক্ত। আর এর অন্তর্ভুক্ত সব কিছুর প্রতি
নিষ্ঠা ওয়াজিব। প্রকৃতপক্ষে সালামের মধ্যে অনিবার্যরূপে অন্তর্ভুক্ত সব
কিছু এর লক্ষ্যের মধ্যে শামিল। এটা ওয়াজিব। সালামের জবাব দেওয়া যেমন
ওয়াজিব, তেমনি ওয়াজিব হচ্ছে আদব ও সম্মানের স্থানে সালাম করা। দাড়ি রাখা
যেমন সুন্নত, তেমনি সালাম দেওয়াও সুন্নত। উভয় কর্মেরই মূল ব্যাপার হচ্ছে
আদব বা সম্মান প্রদর্শন। আম্বিয়া ও আউলিয়া এবং পিতা-মাতার প্রতি আদব তথা
সম্মান প্রদর্শন সর্বসম্মত ওয়াজিব।
অতএব যা সম্মানীয় তার প্রতি যত্নবান
হওয়াও ওয়াজিব। প্রকৃতপক্ষে শাব্দিক সালামের সম্মানীয় ক্ষেত্র রয়েছে। এ
কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রধান সাহাবাগণ তাঁর আগমনে দাঁড়িয়ে যেতেন,
এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করতেন, নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ করতেন এবং পিছিয়ে যেতেন
বা এক পাশে সরে যেতেন। এ সব কর্মাদি সম্মানসূচক কাজ বলে গণ্য করা হয়। এর
মধ্যে যে উদ্দেশ ও অর্থ রয়েছে তাই সালামের মূল লক্ষ্য। সুতরাং ‘আস্সালামু
আলাইকুম’ এ দোয়াসূচক বাক্যটি অনেক উদ্দেশ ও অর্থবোধক। সালাম একটি
প্রশংসাসূচক শব্দ হলেও কখনো এর ভাবার্থ হয় দোয়া, কখনো এর উদ্দেশ প্রশংসা ও
অভিবাদন, কখনো সম্মান প্রদর্শন ও মর্যাদা প্রদান। ছোটদেরকে সালাম ও তার
জবাব দানের অর্থ হচ্ছে দোয়া এবং প্রশংসা। বুজুর্গ ও মুরুব্বী দের জন্য এর
অর্থ হচ্ছে আদাব, সম্মান ও তাজিম এবং বন্ধু বান্ধব, সহপাঠী ও সমবয়সীদের
জন্য এর অর্থ হচ্ছে সম্ভাষণ ও ভদ্রতা। মোট কথা অবস্থার প্রেক্ষিতে
সালামসূচক বাক্যটি উচ্চারিত হবে। যদিও হাদিস শরীফে সালাম শব্দের পূর্বে বহু
বচনের আলিফ ও লাম যুক্ত হয়েছে, কিন্তু কোরান শরীফের দোয়া ও সুসংবাদ
প্রসঙ্গে আলিফ ও লাম ছাড়াই এসেছে এবং সালামুন আলাইকুম বহু বচন ব্যবহৃত হওয়া
ব্যাকরণ দৃষ্টে কোনো ভুল নয়। সালামের ভাষা বা শব্দ আরবি না হলেও তা হারাম
কিংবা দোষণীয় হবে না। বরং যে শব্দ দ্বারা সালামের উদ্দেশ অর্জিত হয় তাই
সালাম হিসেবে গণ্য হবে। সালাম আরবি ভাষাতেই হতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই।
কারণ আল্লাহ্্র বাণী সকল ভাষাতেই প্রচলিত। এমন কি আল্লাহ্্ তায়ালা
ফেরেশ্তাদের অনেককে নিজের তরফ থেকে সত্তর হাজার ভাষা প্রদান করেছেন, আর
অনেককে তার চেয়েও বেশি। হযরত আদম (আঃ)-কে আল্লাহ্্ যে জ্ঞান ও ভাষা
শিখিয়েছিলেন তা কোনো ফেরেশ্তাও জানে না। বর্তমানে আদম সন্তানদের মধ্যে যেসব
জ্ঞান ও ভাষা প্রচলিত, তা সবই আদম (আঃ) থেকে; সুতরাং সকল ভাষাই পৈতৃক
ভাষা। কেবল অজ্ঞরাই তা অস্বীকার করে। এ বিষয়ে চিন্তা করা দরকার যে, সব
আসমানী কিতাবই কি আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, না অন্য ভাষায়ও অবতীর্ণ হয়েছে।
তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর এবং অন্যান্য সমস্ত গ্রন্থই যার যার এলাকার ভাষায়
অবতীর্ণ হয়েছে। যেমনÑ তাওরাত ইব্রানী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং গঠন পাঠনও
ইব্রানী ঢংয়ে সম্পাদিত হয়। আমাদের আরবি কোরান শরীফে আজও কিছু কিছু ইব্রানী
শব্দ দেখা যায়। সুরা ফাতিহার শেষে আমিন শব্দটিও ইব্রানী। এতে কি ক্ষতি
হয়েছে? যে ব্যক্তি যে ভাষায়, যে ঢংয়ে কথা বলে তার ব্যাকরণ ও রচনা শৈলীও সে
ভাষার নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী তৈরি হয়। এতদসত্ত্বেও কোরান মাজীদে বহু
অনারবী নাম রয়েছে যথাÑ ইব্রাহীম, মূসা ইত্যাদি। এতে ক্ষতি কি? বক্তব্যের
উদ্দেশ তো ঠিকই আছে। আসল কথা হচ্ছে সম্মানীয়কে সম্মান প্রদর্শন করা।
আদব
বা শিষ্টাচার দু প্রকারÑ জাহেরি ও বাতেনী। বাতেনী আদাবের জন্য বাতেনী
অবস্থা আবশ্যক। যাকে ইল্হা তথা অনুনয় বিনয় বলে। এ এমন একটি সূক্ষ্ম অবস্থা
যাতে উক্ত অবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তি মুরুব্বী ও সম্মানীয় ব্যক্তিদের
সান্নিধ্যে তৃপ্তি, বিনয় ও নম্রতা অনুভব করে এবং সমবয়সীদের সঙ্গে প্রীতি ও
ভালোবাসা বোধ করে। কোনো ব্যক্তির সারা দেহ যদি অনুরূপ অবস্থা দ্বারা আবিষ্ট
হয়, তাহলে তার গোটা দেহে এর ফলশ্রুতি প্রকাশ পায় এবং তার হাত-পা নাড়াচাড়া
থেকে আরম্ভ করে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে আদব অথবা শিষ্টাচার পরিলক্ষিত
হয়। এটাই বাতেনী অবস্থা। অনুরূপ অবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ আদাবসম্পন্ন ও
শিষ্টাচারী হন। প্রকাশ্য ইল্হাম প্রাপ্ত ব্যক্তিও ভদ্র হন। আহ্লে আদব তথা
শিষ্টাচারী ব্যক্তিদের এটাই স্বভাব। এজন্য ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ
সালাম শব্দের পরিবর্তে এর সমার্থবোধক ও একই ভাব প্রকাশক ভিন্ন ভিন্ন শব্দ
ব্যবহার করে থাকেন। যথাÑ আদব, তাসলিমাত, বন্দেগি ইত্যাদি। বর্তমান যুগে
সালামকে শুধু দোয়া হিসেবেই গণ্য করা হয়। অথচ অভিধানে সালামের স্থলে আদাব
শব্দ লেখা হয়েছে। তাছাড়া দরখাস্ত ও চিঠিপত্রে সব সময়ই আদাব, তাকরীম, নিয়াজ,
বন্দেগি প্রভৃতি লেখা হয়। এতে কোনো পুণ্যহানি হয় না। অথচ নিছক সালামের সময়
‘আস্সালামু আলাইকুম’ না বললে যদি পুণ্যহানী ও পাপ হয়, তাহলে চিঠিপত্রে
সালাম শব্দের পরিবর্তে উক্ত শব্দাবলি ব্যবহারে পাপ বা পুণ্যহানী হবে না
কেন? সালামের জবাবে মুরব্বিগণ যদি বলেন, বেঁচে থাক, সুখে থাক ইত্যাদি
তাহলেও সালামের জবাব হয়ে যাবে। কারণ অনুরূপ কাজ শরিয়তের বহির্ভূত নয়। সালাম
ও এর জবাবের কতিপয় ভালো আনুষঙ্গিক দিক রয়েছে। যথাÑ হাত উঠানো, হাত দ্বারা
ইশারা করা অথবা দেহ ও মাথা অবনত করা ইত্যাদি। এ সব আনুষঙ্গিকতা পালন না করে
সালামের বিধান ও রীতি এবং আদাব পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে মাথা নত
করার সময় রুকু, সিজ্দা তথা আল্লাহ্্র ইবাদতের নিয়ত করা চলবে না। কারণ
ইবাদতের জন্য নিয়ত শর্ত। সুতরাং উক্ত ক্ষেত্রে আল্লাহ্্ ভিন্ন অন্যের
ইবাদতের নিয়ত করার কারণে এ সমস্ত ক্রিয়াকর্ম প্রকাশ্য অন্যায় ও কুফ্রি হবে।
অন্যথায় ইবাদত ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে হাত উঠান বা দেহ অবনত করা শরিয়তে
নিষিদ্ধ নয়। কারণ বহু ক্ষেত্রেই এ সব কাজ করতে হয়। এসব ক্রিয়াকলাপ ব্যতীত
ইহ ও পরকালীন কোনো কাজ করাই সম্ভব নয়। তাহলে সালামের সময় মাথা নত করলে তা
কেন রুকু, সিজ্দা অথবা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে এবং হারাম ও মাকরূহ্্ বলে
সাব্যস্ত হবে?
প্রকৃতপক্ষে এরূপ বাধা-নিষেধারোপ করা শরিয়ত বিরোধী কাজ।
এতে ধর্মীয় মূলনীতির সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। তবে হাত উঠানো বা ইশারা করার সময়
হাতে কোনো হাতিয়ার বা লাঠি প্রভৃতি যেন না থাকে, তাতে বেয়াদবী হবে। দূর
থেকে ইশারা করার সময় রুমাল এবং অন্য কোনো প্রতীক দ্বারা ইশারা করাÑ যাতে
সালামের জবাব বোঝা যায়, তা জায়েজ। আর এক ধরনের সালাম রয়েছে যাকে প্রচলিত
সালাম বলে। এ সালাম সব সময়ের জন্য انما المؤمنون اخواة (ইন্নামাল্
মো’মিনুনা ইখ্ওয়াতুন্) অর্থাৎ “মোমেনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” উক্ত বাণী দ্বারা এ
সালাম প্রমাণিত। দেশি-বিদেশি, চেনা-অচেনা যে কোনো লোকের সঙ্গে দেখা হলে
একে অন্যকে সালাম করবে এবং ইসলামি রীতি অনুযায়ী তার জবাব দেবে। অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই এ শ্রেণীর সালামে ছোট-বড় পার্থক্য করা হয় না। কেবল ইসলামি রীতি ও
সওয়াবের প্রতি লক্ষ রেখে মুসলিম মুসলিমকে ইসলামের মহত্ত্বের জন্য প্রথম
সালাম করা অনেক পুণ্যের কাজ। এ সালামের জবাবদানকারী অবশ্যই কম পুণ্যের
অধিকারী। কারণ সালামদাতা এর মাধ্যমে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করে থাকেন,
এজন্যই এতে দ্বিগুণ পুণ্য পাওয়া যায়।
সমজাতিত্বের আরও এক ধরনের সালাম
রয়েছে যাকে সামাজিক সালাম বলা চলে। সহচর ও সহাবস্থানকারীদের মধ্যে এ সালাম
প্রচলিত। এ সালামেও পুণ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কারও যদি অন্য কোনো ব্যক্তির
সঙ্গে কোনো মাঠে ময়দানে বা পাহাড়ে জঙ্গলে, অথবা একই গন্তব্যস্থলের কোনো
ভ্রমণকারী হিসেবে সাক্ষাৎ হয়ে যায়, যেখানে সচরাচর মানুষের যাতায়াত নেই অথবা
জায়গাটি অত্যন্ত ভয়াবহ, তাহলে উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার বেশ সৌহার্দ ও
ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। সে ব্যক্তি যদি ভিন্ন জাতির তথা হিন্দু, খ্রিষ্টান
অথবা মগও হয়, তাহলেও তাদের মধ্যে স্বভাবতই ভালোবাসা জন্মে। এ ভালোবাসাকে
মানবতা বা সমজাতিত্বের ভালোবাসা বলা হয়। এ সমজাতিত্বের উপাদান অনেক।
তন্মধ্যে হৃদয়াকর্ষণ, করুণা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, শক্তি, প্রজ্ঞা অন্যতম। এ
সকল জৈবিক প্রভাবে একে অপরকে আপন ভাবে। প্রকৃতপক্ষে উক্ত প্রভাব সময়ের
প্রেক্ষিতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে তা সাধারণভাবে বর্তমান।
একেই মানুষের মনুষ্যত্ব বলা হয়। এ জৈবিক প্রভাবে জঙ্গল অথবা প্রান্তরে
একের সঙ্গে অপরের প্রেম ভালোবাসা ও শুভাকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়, তখন তাদের
পরস্পর সালাম ও সম্মানবোধ জন্মায় আর তা সর্বদাই শুভ। এতে কোনো দোষ নেই।
অনুরূপভাবে সম শ্রেণীর মুরব্বি ও পরিচিতদেরকেও সালাম করা প্রয়োজন। কারণ
এক্ষেত্রে জাতিত্ব, মানবিকতা ও সম্পর্কসূত্রই প্রধান বিবেচ্য। ইহলৌকিক ও
পারলৌকিক সকল প্রকার ওস্তাদ ও মুরব্বিকে সর্বদা সমজাতিত্বের সম্মান
প্রদর্শন করা উচিত। কেউ যদি কোনো হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যদের কাছে শিক্ষা
লাভ করে, যেমনÑ কোরান বা দ্বীনি এলেম প্রভৃতি শিক্ষা লাভ করে তাহলে তাকেও
সমজাতিত্বের আদাবের ভিত্তিতে সালাম ও তাজিম করা প্রয়োজন। অন্যথায় শিক্ষার
মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে নিজের বাদশাহ্ ও মহাজন এবং মা-বাবাকেও
সম্মান দেখানো প্রয়োজন। তারা বিজাতি ও বিদেশি হলেও তাদের সম্মান করতে হবেÑ
যেমন ইংরেজ, হিন্দু প্রভৃতি। এ কারণে বাদশাহ্র অধিকারের সমর্থনে হাদিস
শরীফে বলা হয়েছেÑ السلطان ظل الله فمن اكر مه اكرمه الله ومن اهانه فاهانه
الله ( (আস্সুলতানু জিল্লুলাহি ফামান্ আকরামাহু আকরামাহুল্লাহু অমান্
আহানাহু ফাআহানাহুল্লাহ্) অর্থাৎ, “বাদশাহ্ আল্লাহ্্র ছায়া, তাকে সম্মান
করা আল্লাহ্্কেই সম্মান করা এবং যে তাকে অপমান করে আল্লাহ্্ তাকে ধ্বংস
করেন।” যেহেতু বাদশাহ্ আল্লাহ্্র ছায়া, সেহেতু তাঁর থেকে কোনোরূপ অভদ্র
আচরণ প্রকাশ পেতে পারে না। অনুরূপ গর্হিত কাজ আল্লাহ্্ওয়ালা ব্যক্তির
মর্যাদার পরিপন্থী। ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ পিতৃতুল্য। প্রজাদের উচিত আপন
বাদশাহ্কে বাপের মতো সম্মান করা এবং বাদশাহ্র উচিত প্রজাদেরকে সন্তানের মতো
ভালোবাসা। তাহলে আল্লাহ্্ আপন পরিবারের সদস্যদের উভয়কেই শান্তিতে রাখবেন।
আর
এক ধরনের সালাম রয়েছে যা কুফ্রি। এ সালাম কাফেরদের আবিষ্কার, এ সালামে
কুফ্রি করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এবং এ সালামে আল্লাহ্্ ভিন্ন অন্যের
ইবাদতের প্রেরণা রয়েছে। এ সালামে ভিন্ন জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য বিদ্যমান।
নিম্নোক্ত হাদিস তার প্রমাণÑ من تشابه بقوم فهو منهم (মান্ তাশাব্বাহা
বিক্বাউমিন্ ফাহুয়া মিন্হুম্) অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি অন্য জাতির অনুকরণ করে
সে তাদেরই দলভুক্ত।” এখানে শর্ত হল, এ কাজে তার স্বধর্ম ত্যাগের নিয়ত থাকতে
হবে। কুফ্রি পদ্ধতিতে সালাম দেওয়া এবং নেওয়া কুফ্রি ও হারাম বা অনুরূপ। এ
ধরনের সালামের প্রচলন বর্তমানে খুবই বিরল। এ ধরনের সালাম এবং সম্মান করায়
মুসলিমদের জন্য অবশ্যই ক্ষতি রয়েছে। সকলকেই তা পরিহার করা উচিত। শোনা যায়,
হিন্দু আমলে কোনো কোনো সময় হিন্দুরা মুসলমানদেরকে ধরে নিয়ে কুফ্রি পদ্ধতিতে
নিজেদের দেবতাকে সিজ্দা ও সালাম করাতো, অন্যথায় দেবতার সামনে তাকে বলি দিত
তথা তাকে হত্যা করত।
খেলাফতের বিবরণ
আল্লাহ্্ তায়ালা হযরত আদম (আঃ) ও
তাঁর সুযোগ্য কামেল সন্তানদেরকে স্বীয় পবিত্র গুণাবলিমন্ডিত করে দোজাহানের
রত্নভান্ডাররূপে সৃষ্টি করেছেন। উভয় জগৎ তাঁদের দ্বারা সমৃদ্ধ এবং পৃথিবীর
সমস্ত কল্যাণ ও অকল্যাণ তাঁদের দ্বারাই প্রকাশিত হয়। সময়ের পরিবর্তনে
মাটির উপরে রকমারী বৃক্ষ ও ফলফলাদি এবং নানা প্রকার জীবজন্তু পোকামাকড়
সৃষ্টি হয়। স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে এগুলো অস্তিত্ব লাভ করে। কিন্তু এ সকল বস্তু
চার পদার্থের (পানি, আগুন, মাটি ও বায়ু) মাধ্যমে প্রকাশিত ও সৃষ্টি হয়। এ
কারণেই এগুলোকে সময়ের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সময় আল্লাহ্্র
অন্যতম সত্তাগত বৈশিষ্ট্যেরই নাম। এ বৈশিষ্ট্য থেকেই অন্যান্য রঙ বেরঙের
বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পূর্ণ মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে এবং তাঁর অসীম সত্তায়
দোজাহানের হেকমত তথা রহস্য বর্তমান। উভয় জগতের ভালো-মন্দ, দয়া-নির্দয়া,
শক্তি, আহার্য সব কিছুই কামেল মানুষের সত্তা থেকে উৎসারিত হয়।
কাশ্ফওয়ালাদের নিকট এ সত্য মোটেই গোপন নয়। এমন কি সকল মানুষ ও বস্তুসত্তার
আবেষ্টনকারী মহা সত্তাও উক্ত কামেল মানুষের সত্তাবৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। খলিফার
সম্পর্ক খেলাফত দাতার সাথে অবশ্যই এক সূত্রে সম্পর্কযুক্ত থাকতে হয়।
সুতরাং খলিফাকে প্রকৃতপক্ষেই খেলাফত দাতার সমজাতীয় হওয়া প্রয়োজন। ‘এক
সূত্র’ কথাটি সমজাতীয়তার মধ্যমণি ও মূলেরই ইঙ্গিত বহন করে।
মোটকথা
আল্লাহ্্র সত্তাতে উভয় জগতের সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব বিদ্যমান। ‘আকলে হাকিকী’
তথা প্রকৃত জ্ঞান ব্যতীত অন্য জ্ঞান বুদ্ধি ও অনুভূতি এখানে অকার্যকর। এ
প্রকৃত জ্ঞান আপন সকল বৈশিষ্ট্যে সচেতন। একজন নিদ্রিত ব্যক্তি অচেতন থাকলেও
তার অন্তর সচেতনভাবে রূহের জগতে বিচরণ করে, স্বপ্ন দেখে এবং সে অনেক
রহস্যের সন্ধান লাভ করে; কেবল নশ্বর দেহটি নিদ্রার সুখ অনুভব করে। এ
অবস্থায়ও প্রকৃত জ্ঞান সতেজ এবং সচেতন থাকে। অন্যথায় তার সামনে কোনো রহস্য
উদ্ঘাটিত হত না।
এক কথায়, তাওহীদি চিন্তায় সকল বস্তুই অবশ্যম্ভাবীরূপে
এক ও অভিন্ন। যখন এ সম্পর্কে উপলব্ধি হবে, যার আল্লাহ্্ তত্ত্বের জ্ঞান
নসীব নেই, সে প্রতারক যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে সত্যানুসন্ধানীদের সত্তর
তার সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। অন্যথায় তাঁদের ওপর ঐ হতভাগার সাথে মেলামেশার
কারণে তার প্রভাব পড়বে। এ কারণেই এ যুগে মানুষ আল্লাহ্্ওয়ালাদের চিনতে পারে
না এবং আল্লাহ্্ওয়ালাগণের সান্নিধ্য লাভের পরম সৌভাগ্য দুনিয়াদারদের নসীব
হয় না। বাণী ও ইঙ্গিত ইশারার গূঢ় অর্থ তারা বোঝে না এবং গুপ্ত বিষয়ে কথার
তাৎপর্য কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু আশিক ও আরিফগণই কেবল তা
উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ নূরানী অন্তরকে নূরানী কথায় আলোকিত করে আর
মরমীপন্থীদের জন্য এটা খোরাক অর্থাৎ এর দ্বারাই তাঁরা আল্লাহ্্কে লাভ করেন।
আল্লাহ্্কে লাভ করার এটাই সরল পথ। আশিকানদের প্রেম উন্মাদনাই তাঁদের জন্য
কোরানের মর্মার্থ বা এর চেয়েও অধিক। কেননা খনি বা ভান্ডার হতে যা বের হয়
সেটাই তার অর্থ, অর্থাৎ মণি, মুক্তা, সোনা, রূপা, যা বের হয় সেটাই তার
অর্থ। এর থেকে যদি কোনো অসার পদার্থ বের হয় তাও তারই অর্থ। আর যদি কিছুই না
বের হয় তা হলে তা অর্থহীন। অনুরূপভাবে যে বাক্যে আল্লাহ্্র স্মরণ ও আবেগ
সৃষ্টি হয় সেটাই সে বাক্যের অর্থ। আর যে বাক্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তা
অর্থহীন প্রলাপ, যদিও তা কোরান হয়। মোটকথা ‘তাওহীদের অজুদী’ এবং ‘তাওহীদের
ইত্তেহাদী’ থেকেই আশিকের হৃদয়গ্রাহী বাণী উত্থিত হয়। বাহ্যত এ সব কথা
অর্থহীন মনে হলেও গূঢ়ত এগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও রহস্যপূর্ণ। যার বদৌলতে
আশিক মাশুকের মধ্যকার গুপ্ত রহস্যের সারতত্ত্ব উদ্ঘাটিত হয়। এ সব অদ্বিতীয়
বাণীর বর্ণনা সম্ভব নয় বরং এর এক একটি অক্ষর মুক্তার চেয়েও মূল্যবান।
কিন্তু অজ্ঞান লোকেরা এ মহামূল্যবান বাণীর অর্থ ও তাৎপর্য না বুঝে, নিজেদের
আত্মঅহংকারবশত যে সব মহাপুরুষ এ সব কথা বলেন, তাঁদের কুৎসা করে এবং
লাঞ্ছনা দেয়। ফলে তারা আল্লাহ্্ ও রাসূলের তরফ থেকে গজবে পতিত হয়। আল্লাহ্্
তায়ালা পৃথিবীর হেফাজতের জন্য আদম (আঃ) ও তাঁর আওলাদদেরকে খলিফা করেছেন।
হযরত শাইখ আকবর ইব্নুল আরাবী (রহঃ) স্বীয় ‘ফচুছ’ কিতাবে বর্ণনা করেছেনÑ فا
ستخلفه فى حفظ العالم فلا يزال العالم محفوظا مادام فيه هذه الانسان الكامل
(ফাস্তাখ্লাফাহু ফি হেফ্জিল্ আলামে ফালইয়াজালুল্ আলাম মাহ্ফুজান মা দামা
ফীহি হাজিহিল ইন্ছানুল্ কামিল) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্ পৃথিবীর হেফাজতের জন্য
বুজুর্গ তথা কামেল মানুষকে খলিফা বানিয়েছেন। যতদিন এ পৃথিবীতে কামেল মানুষ
বর্তমান থাকবেন ততদিনই এ পৃথিবী হেফাজত ও নিরাপদে থাকবে।” কামেল মানুষগণ
দুনিয়া ও আখেরাতের সম্পদ এবং আখেরাতের রত্নভান্ডারের স্থায়ী মোহর। এ জন্যই
বলা হয়েছে, فكان ختما علئ خزانته الاخرة ختما ابديا (ফাকানা খাতামা আলা
খাজানাতিহিল্ আখিরাতি, খাতামা আবাদিয়া)। এর পরে বলা হয়েছেÑ فظهر جميع مافى
الصورة الالهية من الاسماءفى هذه النشاته الانسانية (ফাজাহারা জামিউ মাফীহ্
ছুরাতিল ইলাহিয়াতি মিনাল আছমায়ি ফীহাজিহিন্ নিশায়াতিহিল্ ইন্ছানিয়াহ) এর
দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, “মানব দেহে তাই আছে যা এলাহির সুরতে ছিল।” এর
নিদর্শন আলা হযরতের লেখায়ও পাওয়া যায়, فها زةر تبة الاحاطة والجمع بهذه
الوجود (ফাহাজাত রুত্বাতুল আহাতাতে ওয়াল্জামিউ বিহাজিহিল্ অজুদ) “এলাহির
অবয়ব (ছুরত) ও গুণাবলি, এ ইন্দ্রিয়ের দেহে সঞ্চিত ও পরিবেষ্টিত।” অর্থাৎ,
এলাহিয়াতের সমস্ত গুণে গুণান্বিত হয়ে বুজুর্গ ও কামেল মানুষ প্রকৃত গুণের
অধিকারী হয়েছেন। অধস্তন ফেরেশ্তা এ বুজুর্গির রহস্য অবগত নয়। আল্লাহ্্ যখন
আদম সৃষ্টির কথা ফেরেশ্তাদের জানান, তখন ফেরেশ্তাগণ তাতে আপত্তি করে এবং
বলেন যে, কোনো প্রতিনিধির প্রয়োজন নেই, আমরাই তোমার গুণগান ও পবিত্রতা বয়ান
করব। এ ক্ষেত্রে ফেরেশ্তাগণ মানব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অজ্ঞ এবং আল্লাহ্্র
রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞাত। ‘তাবিলুল মাহকাম’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছেÑ অধস্তন
ফেরেশ্তারা যেরূপ অজ্ঞতাবশতই মানুষ সৃষ্টির প্রতিবাদ করেছিল, সেরূপ
অজ্ঞতাবশতই একদল লোক তথা জাহেরি শরিয়তপন্থীরা শরাকেই ধর্ম মনে করে এবং উক্ত
মহাপুরুষ তথা আল্লাহ্্ওয়ালাগণের বিরোধিতা করে এবং তাঁদের সম্পর্কে
প্রতিবাদ তোলে। তাদের এ প্রতিবাদের কোনো মূল্য নেই। এ প্রতিবাদ করা হারাম
এবং বড় কুফরী। কারণ জাহেরি বিদ্যা দ্বারা অর্জিত জ্ঞান একটা ধারণা মাত্র
এবং ধারণাই হচ্ছে সত্যের বাধাদানকারী পর্দা। আল্লাহ্ওয়ালাগণ এ জ্ঞানকে
নশ্বর মনে করেন এবং ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন। তখন তাঁদের সামনে কোনো বাধা থাকে
না বলেই আল্লাহ্্র নিরাকার সত্তা তাঁদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। কারণ সত্য
জ্ঞান দ্বারা সত্যকে চেনা যায়। তাই শেখ মহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (রহঃ) তাঁর
ফচুছ গ্রন্থে বলেন, ان العلم تابع للمعلوم (ইন্নাল ইল্মা তাবিউল্ লিল
মা’লুম) অর্থাৎ, “জ্ঞান ধারণার অধীন।” সুতরাং যে জ্ঞান ধারণা ও
অনুমানপ্রসূত তা ক্ষণস্থায়ী ও যবনিকা আচ্ছাদিত। একে কাল মাকাল তথা তর্ক
বিতর্ক বলে। তাবিলাতের চতুর্থ শিক্ষায় আছেÑ বর্ণনাকারী হিসেবে জাহেরি
বিদ্যা ও হাদীছ শরীফের রাবি ছিলেন হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)। এ বর্ণনা থেকে
যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা বাহ্যিক জ্ঞান। আর এ বাহ্যিক জ্ঞান দ্বারা প্রকৃত
অবস্থা, যা নবী-রাসূলদের মিরাছ তা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় নাÑ যা দ্বারা
রূহ্্ জীবিত হয়। রাস্লূ (সাঃ) এর কারামাত, চরিত্র ও সৃষ্টির সুপারিশের
ক্ষমতা এর মধ্যে নিহিত এবং এ থেকেই প্রকাশিত হয়। এর নামই বেলায়েত। হযরত
শাইখ কুদ্দেসা র্সিরূহুল আজিজ বলেন, وكذ الك خاتم الاولياء ما كان وليا الا
بعد تحصيل شر ائط الولاية من الاخلاق الالهية فى اتصاف بها من كونه
الالهية يسمئ بالولى الحميدة – (অকাজালিকা খাতিমুল আউলীয়াই, মাকানা অলীয়ান
ইল্লা বা’দা তাহছিলি শারায়িতিল্ বেলায়েতে মিনাল্ আখ্লাকিল্ ইলাহিয়াতি, ফী
ইত্তেছাফি বিহা মিন্ কাওনিহিল্ ইলাহিয়াতি ইউছাম্মা বিল্ অলীয়্যিল্ হামিদ)
অর্থাৎ, “এভাবে খাতেমুল আউলিয়া অলী ছিলেন যখন আদম পানি ও মাটির মধ্যে ছিলেন
এবং তিনি ব্যতীত কোনো অলী ছিলেন না। কিন্তু আখলাকে ইলাহী ও বেলায়েতের
শর্তাদি লাভ করে সৎ আখলাকের অধিকারী হওয়ায় তাকে অলীয়ে হামিদ তথা প্রশংসিত
অলী নামে আখ্যায়িত করা হয়।” কিন্তু ঈসা মসীহ্ বেলায়েতের সমাপ্তকারী। অর্থাৎ
হযরত মেহদী (আঃ) এর যুগে হযরত ঈসা মসীহ্ আকাশ থেকে অবতরণ করবেন এবং
মানুষকে বেলায়েত জ্ঞানে সমৃদ্ধ করবেন। এটা হবে তাঁর বিশেষ আহ্বান। এর পর
বেলায়েতের ধারা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রে
তাওহীদের রহস্যাবলি এক ও অভিন্ন। আখেরাতে আল্লাহ্্র অলীদের কাছে যে সব
রহস্য ও অবস্থা উদ্ভাসিত হবে দুনিয়াতেও তাঁদের কাছে তা প্রকাশিত হয়ে যায়।
কেননা আদম রহস্যই আল্লাহ্্র রহস্য। সুতরাং নফস্তত্ত্বের জ্ঞান প্রকৃতই
তাওহীদের জ্ঞান। তাই তো আল্লাহ্্ তাঁর বিশিষ্ট বান্দাদের লক্ষ করে বলছেন,
قد جائكم البصائر من ربكم فمن ابصر فلنفسه ومن اعمى فعليها (ক্বাদ
জায়াকুমুল্ বাছায়েরু র্মি রাব্বিকুম ফামানÑআব্ছারা ফালিনাফ্ছিহী অমান আ’মা
ফা আলাইহা) অর্থাৎ, “তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে দৃষ্টিশক্তি এসেছে, যে
এর দ্বারা দেখেছে সে নিজের জন্যই দেখেছে, আর যে অন্ধ হয়ে রয়েছে তার ফলও
সে-ই ভোগ করছে।” অর্থাৎ, যে নিজের নফসের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে নি,
তার দৃষ্টিতে রয়েছে আত্মগৌরবের কালো যবনিকা, যার জন্য দৃষ্টি বক্রপথে গমন
করে ভ্রষ্ট হয়ে যায়। পুণ্যাত্মা সাহাবায়ে কেরাম, যারা স্বীয় গুণে সত্তা
সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়েছেন এবং উপলব্ধি করেছেন এ বাণীর তাৎপর্য Ñ يدالله فوق
ايد يهم (ইয়াদুল্লাহি ফাওকা আইদিহিম) অর্থাৎ, “তাঁদের হাতের উপর রয়েছে
আল্লাহ্্র হাত।” Ñ তারা সত্যিই কত ভাগ্যবান।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে
স্পষ্টরূপে জানা যায় যে, স্বীয় নূরের ঝলকে মহামানবদের পাক রূহ্্সমূহ
দোজাহানের সমস্ত এলাকা উজ্জ্বল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, নবী ও অলীদের আত্মা
স্বীয় সত্তা ও জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন। তাই
হাদিসে কুদসীতে মহানবী (সাঃ) বলেন, “সকল সৃষ্টির মৌল সত্তা এক ও অভিন্ন”
এবং জল ও কাদা কোনোটাই স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যের বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা নয় বরং
অদ্ভুতরূপে এক। خلق الله ادم على صورته (খালাক্বাল্লাহু আদামা আলা
ছুরাতিহী) অর্থাৎ, “আল্লাহ্ আদমকে স্বীয় রূপে সৃষ্টি করেছেন।” এ হাদিসটি
উক্ত তত্ত্বেরই সমর্থক। এর অর্থ হল, আদম সত্তার সারই আল্লাহ্্র সামগ্রিকতা।
মানুষের বিভিন্ন গুণাবলি তথা ভ্রান্তি ও নিদ্রার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত দাবি
অযৌক্তিক বা ভ্রান্ত মনে হতে পারে। কারণ এগুলো আল্লাহ্্র শানের সাথে
বেমানান। কিন্তু এটাও সত্তারই এক গুণের নাম। তবে ভুল ইত্যাদি তাঁর সত্তার
সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইহ-পরকালে যা কিছু বর্তমান সবই ‘যাতে-ইলাহি’ থেকে
উদ্ভুত, অন্য কিছু হতে নয় (নাউজুবিল্লাহ্)। যেমনÑ সাপের মুখে বিষ রয়েছে
কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজে সুস্থ রয়েছে, অন্য দিকে স্তনে দুগ্ধ থাকে এবং
তা শিশুর আহারের জন্য কিন্তু দুগ্ধধারিণীর নিজের জন্য নয়। তবে দুগ্ধবতী তার
দুগ্ধ উপভোগ করে ভিন্ন পদ্ধতিতে। স্তনের দুধ থেকে সে উপকৃত হয় এভাবেÑ দুুধ
থেকে মাখন, মাখন থেকে ঘি, আর তা থেকে শক্তিশালী রক্ত, যা দেহের মৌল শক্তি
এবং উৎস রূহ্্। রূহ্্ সর্বগুণে জীবিত এবং এতে সমস্ত বস্তুর উপভোগ ক্ষমতা
বিদ্যমান এবং নিজ গুণাবলি উপভোগের ক্ষমতাও এতে রয়েছে। পরিবর্তিত অবস্থার
প্রেক্ষিতে নিজেকেই যেন ভিন্নতর মনে করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আয়নায় নিজের
হাত, মুখ ইত্যাদি দেখে নিজের চক্ষু খুশি অনুভব করে এবং নিজের স্বর বা কণ্ঠ
শুনে কান আনন্দিত হয়, অনুরূপভাবে নিজের গুণাবলিতে নিজেই আনন্দিত হতে দেখা
যায়। এমনিভাবে আল্লাহ্্র সত্তার মধ্যে সব কিছু বিদ্যমান এবং স্রষ্টা ও
সৃষ্টির সবেরই অস্তিত্ব উক্ত সত্তায় বর্তমান। স্বয়ং সত্তার তুলনাহীনতা শানে
কুদ্সী তথা পবিত্র মহিমার একটি নাম, যা নির্দিষ্টভাবে প্রত্যেক বস্তু
সত্তায় রয়েছে। যেমনÑ বীজ ও দানায় যে পর্যন্ত গুল্ম ও শাখা বের না হয় সে
পর্যন্ত এ অবস্থাটাকে ‘শানে কুদ্সী’ বলা হয়। এ মর্যাদা তার পবিত্রতার
মর্যাদার দিকে ইশারা করে। এ পবিত্রতার দিকে সংযুক্ত করাকে পবিত্রতার বর্ণনা
বলে। আসল কথা হচ্ছে, প্রত্যেক বস্তুর মূল সর্বদাই পাক। তাই আল্লাহ্্
তায়ালা যেহেতু সমস্ত বস্তরই পবিত্র মূল, সুতরাং এ পবিত্রের শাখা-প্রশাখার
দিক থেকে তাঁর সৃষ্টি ও সৃষ্ট বস্তু দ্বিতীয় স্তরে। কিন্তু প্রথম স্তরের
জন্য দ্বিতীয় স্তর প্রয়োজন। দ্বিতীয় স্তর প্রথম স্তরের রহস্য ও বাতেন।
অনুরূপ দ্বিতীয় স্তরের জন্য প্রথম স্তরের প্রয়োজন এবং এটাই তাঁর রহস্য ও
বাতেন। সুতরাং বান্দার মধ্যে যা ঘটে সেটা আল্লাহ্্র রহস্য ও বাতেন হতে এবং
আল্লাহ্্র সত্তায় যা ঘটে সেটা বান্দার রহস্য ও বাতেন হতে।
সৃষ্টি রহস্যের বিবরণ
সৃষ্টির প্রেক্ষিতে আল্লাহ্্ তায়ালার প্রত্যেকটি কাজই বিস্ময়কর ও রহস্যময় এবং প্রত্যেকটি মাখলুক সত্তা ও গুণের প্রেক্ষিতে বিস্ময়কর। রূহ্ আরেক বিস্ময়কর তার রহস্য ও মহিমা নিরূপণের দিক থেকে। এ কারণেই এর নাম আমরে রব তথা প্রভুর আজ্ঞা রক্ষাকারী। মূল সত্তায় যে সব গুণ ও শান রয়েছে দ্বিতীয় স্তরে রূহের মধ্যেও তা রয়েছে। যা মহিমাময় গভীর রহস্য ও মহাবিস্ময়। এ রহস্যময়তার মধ্যে পবিত্র মহাসত্তা বিদ্যমান। যা সকল সময় ও মহিমায়, প্রত্যেক সত্তায় ও গুণে, আকৃতি ও চেহারায় প্রত্যেক আরম্ভ ও শেষের মূল বা অঙ্কুর। উভয় জগতে যা কিছু বর্তমান সবই সে জাতের বিকশিত রূপ। এ সত্তার ক্ষেত্রে নিকট বা দূর কথাটি প্রযোজ্য নয়। কেননা স্থানের প্রেক্ষিতে নিকট বা দূর নির্ধারিত হয়। যিনি সর্বত্র বিরাজিত তার কাছে দূরত্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ক্ষুদ্র ও মহা জগতের বাইরে যখন কোনো স্থানই নেই, যা তার আওতাভুক্ত নয়, তখন তার ক্ষেত্রে নিকট বা দূরের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সবকিছুতেই তিনি এবং তিনিতেই সবকিছু। অনুরূপ রহস্যে রূহুও বিশ্ব থেকে বিশ্বময়। তার জন্য সত্তা ও গুণাবলি, আকৃতি ও অবয়ব, প্রকাশ ও অপ্রকাশ, নিকট ও দূর, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণীত ও অনির্ণীত সব স্বীয় সত্তা ও নফ্সের মহিমা ও বিকাশ। তাই মহানবী (সাঃ) হাদিসে কুদ্সীতে যথার্থই বলেছেন, من رانى فقد راءالحق (মান রায়ানী ফাক্বাদ রায়াল হাক্কা) অর্থাৎ, “যে আমাকে দেখেছে অবশ্যই সে হক্বকে দেখেছে।” এর অর্থ হল, রূহ্গত উপলব্ধি দ্বারা দেখার অর্থ নবীকে দেখা আর সত্তাগত উপলব্ধি দ্বারা দেখার অর্থ হবে স্বয়ং আল্লাহ্্কে দেখা। আর সামগ্রিক উপলব্ধির দ্বারা দেখার অর্থ হবে আল্লাহ্্ ও রাসূলকে দেখা। সাধারণভাবে হক্ব অর্থ ঠিক ও যথার্থ। সুতরাং এখানে যে নবীকে দেখেছে সে হক্ব বা ঠিকই দেখেছে। তার অর্থ হল নবীকে যে দেখেছে সে যদি পাপী বা মিথ্যাবাদী হয় তাহলেও সে নবীকে দেখে থাকলে তা ঠিকই দেখেছে। কারণ নবী (সাঃ) এর রূহ্ মোবারক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিকশিত। সুুতরাং খাব বা কাশ্ফ অথবা জাগ্রত যে অবস্থায়ই তাঁকে দেখা যাক না কেন, তাই সত্য। এ জন্য ভাবাবিষ্টগণ স্বীয় সাদৃশ্যময় নূরের আলোকে তাঁদের মাহ্বুবকে অবলোকন করেন। যে মাহ্ফিলে মাশুকের আলোচনা হয়, সেখানে তিনি প্রেম শক্তির নূরের সাথে সকল রহস্যময়তা নিয়ে হাজির হন। মিলাদ মাহ্ফিলে যখন ধ্বনিত হয় “খোদ বদৌলত জরুর হ্যায় শামিল মাহ্ফিলে মিলাদ মে।” এখানে মিলাদ অর্থ পয়গম্বরী সুবাস, এ দ্বারা নবীর পূর্ণতা বোঝানো হচ্ছে। এটা বুঝতে অন্তরের প্রসারতা প্রয়োজন। মূক ও বধির অন্তরের পক্ষে এটা উপলব্ধি করা মোটেই সম্ভব নয়।এক্ষেত্রে অন্তরওয়ালাদের জন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অনভিজ্ঞদের উচিত সর্বদাই অন্তরবানদের অনুসরণ করা, নিজেদের গোঁড়ামির প্রশ্রয় না দেওয়া এবং পয়গম্বরী উপস্থিতিকে নেয়ামত মনে করা।
ব্যর্থতার বিবরণ
যে পর্যন্ত
মানুষের বেসালে কামাল তথা পূর্ণ মিলন নসীব না হয়, সে পর্যন্ত মানুষের মধ্যে
কোনো না কোনো কথায় অস্বীকৃতি, সন্দেহ ও অহংকার থেকে যায়। এর কারণ হচ্ছে
যে, মানুষ এমন বিশ্বাস চায়, যার মাধ্যমে ‘জাত-এ-হক্ব’ এর সৌভাগ্য লাভ হয়।
কিন্তু এ জাত পর্যন্ত পৌঁছুতে মঞ্জিল তথা গন্তব্য স্থল ও চলার পথের মধ্যে
বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ঊর্ধ্বারোহণ ও পথ অতিক্রমের সময় আবর্জনা, ধূলিকণা ও
অন্ধকার তাকে গ্রাস করে। এ সম্বলহীন সময়ে ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় তার নফ্স
নিম্নগামী ও অহংকারী হয়ে যায়। এটা ঘটে তার বাহাদুরী, আত্মগরিমা ইত্যাদির
কারণে। কাফের ও ফাসেকের প্রকৃতমূলে আবর্জনাময় কঠিন পর্দা থাকার কারণে তার
সৎ ক্রিয়াদি জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয় না। যে শিক্ষার্থী লালসা ক্রোধ হতে সংশোধন
হয়, সে বেঁচে যায়। লোভ-লালসার উৎস মোহ ও মায়া এমন একটি সূক্ষ্ম ও গোপন
অবস্থা, যাকে আলাদা করে চেনা খুবই কঠিন। দ্বীনদারদের জন্য এটা অত্যন্ত
মারাত্মক। তারা মনে করে যে, তারা আল্লাহ্্র সস্তুষ্টির জন্য কাজ করছে এবং
নিজকে দ্বীনদার ও পবিত্র ব্যক্তি বলে মনে করে। তখন আদাজল খেয়ে অন্যকে উপদেশ
দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধারণার পোশাকে সজ্জিত হয়ে
মোহ-মায়ার লবণ চাটতে থাকে অর্থাৎ কেউ পোশাকে সজ্জিত, কেউ সিজ্দা তাছবীহ্ ও
নামাবলির ভক্ত, কেউ পরহেজগার আলেম, কেই সুন্নাতের অস্বীকারকারী, কেউ ধর্ম ও
জ্ঞানের অন্বেষণকারী, কেউ কম কথা বলে, কেউ শিশুদেরকে শিক্ষাদানে রত, আর
কেউ পীর সেজে আল্লাহ্্র ধ্যান শিক্ষা দেয়। কিন্তু এরা নিজেদের বিরুদ্ধে
কাউকে দেখলে প্রত্যকেই বাঘের মতো গর্জন করে উঠে। এটা তার আত্মগরিমা ও
নফ্সের প্রবঞ্চনা তাই এর স্বাদ অপরিবর্তনীয়। কিন্তু নফসে আম্মারা এতে
বিভিন্ন রকম স্বাদ পায়। নফ্সের বিরোধী ব্যক্তি এখানে চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু
যে এটা বোঝে না সে বলবে যে, সত্য কথায় নীরব হয়ে যাওয়া ব্যক্তি অবশ্যই
শয়তান। দুঃখের বিষয় জাহেরি ইবাদতকারী আজও হক্ব কথার অর্থ কি তা বোঝে নি।
কেননা বেসাল বা মিলনের পরই হক্ব-নাহক্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। যে ব্যক্তি
নিজেকে আল্লাহ্্ওয়ালা বলে দাবি করে অথচ এখনও তার অহংকার এবং মন্দ স্বভাব
বর্তমান রয়েছে, সে একজন অজ্ঞানী ছাড়া কিছুই নয়। সন্দেহ বা দ্বিধাই তার
পছন্দ।
কলন্দরিয়া, নিজামিয়া, আবুআলি ও খিজিরিয়া প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ যত
ত্বরিকা প্রচলিত রয়েছে, প্রত্যেকের একই মত যে, গোটা বিশ্ব এক আল্লাহ্্রই
বিকশিত রূপ এবং সে একই বীজ থেকে এসব ফলফলাদি। এর মধ্যে আম্বিয়া ও আউলিয়াগণ
হলেন তাঁর নূরের বিকশিত রূপ ও প্রভু কর্তৃক নির্ধারিত। যাঁদের অন্তর আছে
কেবল তাঁরাই তাঁদের চিনেছেন ও পেয়েছেন। যারা তাঁদের অস্বীকার করে তারা
একেবারেই অবুঝ শিশুর মতো অথবা তারা জাহেল, ফাসেক এবং কাফের। ধর্মকে ধ্বংস
করাই এদের লক্ষ্য। সৃষ্টির এককতা কামেল অলীর সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য। আমাদের
নবীসহ সকল নবী ও বিশিষ্ট সাহাবাদের এ একই বৈশিষ্ট্য ছিল। পূর্বে এর আলোচনা
হয়েছে। যে ব্যক্তি নামও জানে না কাজও করে না সে ব্যক্তি মূর্খ। প্রবাদ আছেÑ
“মূর্খ পশুর সমান।” এহ্সানকে যে অস্বীকার করে সে কাফের। কেননা এটা একত্বের
আইন বা তাওহীদের বিধান।
‘র্উস’ এর বিবরণ
বুজুর্গদের ছাওয়াব
রেসানীর জন্য ‘র্উস’ একটি নির্ধারিত দিন ও পর্ব। এতে দেশ বিদেশ থেকে বহু
সাধারণ ও অসাধারণ লোক এসে একত্রিত হয়। এক সাথে মিলেমিশে শিন্নি ও হাদিয়া
প্রভৃতি বণ্টন করে। কেউ দোয়া ও অজিফা পাঠে লিপ্ত থাকে এবং নিজের বুজুর্গদের
থেকে ফায়েজ বা অনুপ্রেরণা লাভের চেষ্টা করে। কেননা, এ দিনটি অত্যন্ত
রহমতের দিন। কারণ, যে স্থানে কোনো অলীআল্লাহ্্র সওয়াব রেসানী করা হয়, সে
স্থান আল্লাহ্্র নৈকট্যপ্রাপ্ত মহিমান্বিত রূহ্সমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে
যায়। এটা আউলিয়াদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মহিমা। এটা হয় সহাবস্থান ও নূর
নৈকট্যের কারণে। অপর দিকে তাঁদের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টি উৎসের পবিত্রতা। যা
সততা, দয়া ও রহমতের লক্ষ্যবিন্দু। এ জন্যই নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত আকিদাবান
জনতা অশেষ ফজিলত লাভ করেন। কারণ সেদিন আল্লাহ্্র নৈকট্যপ্রাপ্ত মহিমান্বিত
রূহ্্সমূহ আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ফায়েজ বর্ষণ করেন। এমন কোনো জায়গা বাকি
থাকে না যেখানে সেদিন ফায়েজ বর্ষিত না হয়। যেন মুর্শিদের ফায়েজের সূর্য
বিশ্বে উদিত হয় এবং সে নূরের টানে ফেরেশ্তাগণ কবুতরের মতো তথায় অবতরণ করেন।
অর্থাৎ, ফেরেশ্তাগণ উক্ত নূরের ঝলকে আত্মহারা হয়ে সে মাহ্ফিলে অবতরণ করেন।
এজন্যই নবী (সাঃ) বলেছেন, “জ্ঞান সাধকের সম্মানার্থে আকাশ থেকে ফেরেশ্তা
অবতরণ করেন।” এখানে জ্ঞান অর্থ নূরী জ্ঞান। অতএব যে জিনিসের ওপর বা যে
স্থানে আউলিয়াগণের দোয়া ও সওয়াব রেসানী হয়, সেখানে স্বর্গীয় প্রেমের নূরের
ঝলক সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে ফেরেশ্তা ও রূহ্্সমূহ তথায় এসে হাজির হয়। এটাই
রহমত বর্ষণের কারণ। এর বরকতেই অন্তরবান ব্যক্তি নববধূর মতো পবিত্র ও
পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেন। আর র্উস এর অর্থও পরিণয়। র্উস এর স্থান যখন রহমতের
বর্ষণে প্লাবিত হয়ে যায় তখন এর মাছগুলো এতে বিচরণ করতে থাকে এবং নতুন নতুন
রকমারি স্বাদ উপভোগ করতে থাকে। যাদের স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা আছে, তাঁরা এর
স্বাদ সম্বন্ধে যথেষ্ট অবগত। অভিনব নূতন নূতন নেয়ামত এতে থাকার দরুন যদি
কেউ একে বেদ’আত বলে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। বরং যার অন্তরে নূতন অবস্থান
সৃষ্টি না হয়, সে তো মৃত। আর নূতন নূতন হালই হচ্ছে আম্বিয়াদের মিরাস বা
উত্তরাধিকারÑ كل يوم هو فى شان (কুল্লু ইয়াওমিন হুয়া ফি শান) অর্থাৎ,
“প্রত্যহ তিনি নূতন অবস্থায় বিদ্যমান।” এ কথার সারমর্ম এটাই।
প্রত্যেক
যুগে নূতন নূতন অলী, আওতাদ, আম্বিয়া, গাউছ, ইমাম ও মোজাদ্দেদ আবির্ভূত হন,
নূতন নূতনভাবে যুগকে পরিপূর্ণতা দান করেন এবং ধর্মকে নূতনভাবে ঔজ্জ্বল্য
দান করেন। এসব কোনো কথার কথা নয় বরং তা বিশেষ হালের অর্জিত নেয়ামত। এটাকেই
বেদ’আত-এ-হাসানা বলা হয়। ধর্মে এ ধরনের রীতি না থাকলে ধর্ম নষ্ট হয়ে যেত।
যেমনÑ বৃক্ষে প্রত্যেক মৌসুমে নূতনভাবেই ফলন হয়। ধর্মের হুকুম আহ্কাম বা
ফিকাহ্ আকায়েদ তাসাউফ প্রভৃতি নামে পরিচিত এবং এর সংকলনকে বর্তমানে কিতাব
নামে আখ্যায়িত করা হয়। এও ঐ গুলোর একটা নূতন অবস্থা। যদি নূতন নামের সাথে
সত্যতা বর্তমান থাকে, সেটা নেয়ামতস্বরূপ। যুগপত্রে এ পরিবর্তনের ইঙ্গিত ও
নির্দেশনা সূচিত ও খচিত হয়। যারা এ নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেন তারা সহজেই এর
উপকারিতা ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেন। নূতন নিয়ামত ও নূতনত্বের সাথে
হাকিকতযুক্ত বিধায় তা বেদাতে হাসানারূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ভিত্তিতেই অলীয়ে
কামেলগণ র্উস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করেন। এটা আল্লাহ্্ এবং নবী (সাঃ) এর
খেলাপ কিছু নয় এবং এতে ধর্মেরও কোনো ক্ষতি নেই, বরং এতে আল্লাহ্্ ও রাসূলের
সন্তুষ্টি পাওয়া যায় এবং যুগের চাহিদার সাথে সম্পর্ক থাকে। এটা কোনো
কিতাবী বা সমালোচনার বিষয় নয়। যার মিলন নসীব নেই তথা এ বিষয়ে জ্ঞান নেই তার
তো কিছুই নেই।
কিতাবপন্থীরা কিতাব ছাড়া কিছুই বোঝে না। এ জন্যই তাদের
কাছে তর্ক-বিতর্ক ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। অন্যথায় র্উসÑ عرف الله كل
لسانه (আরাফাল্লাহু কুল্লুলিসানিহি) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্ সব ভাষা শিখিয়েছেন” এ
বক্তব্যের পরিপন্থী নয়। হযরত শাহ্ আব্দুল আজিজ সাহেব (রাঃ) হাদিস দ্বারা
উরসের মৌলিকত্ব প্রমাণ করেছেন। সে হাদিস ‘দাররে মানসুর’, ‘তফ্ছিরে কবীর’ ও
অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ আছে। হাদিসটি নিম্নরূপÑ وعن رسول الله صلى الله
عليه وسلم انه كان يأتى قبو راشهداء على رأس كل حول فيقول سلام عليكم بما
صبرتم فنعم عقبى الدار والخلفاء الاربعة هكذا يفعلون (ওয়াআন রাসূলিল্লাহি
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম ইন্নাহু কানা ইয়াতি কুবুরাশ্ শোহাদায়ি আলা
রা’সে কুল্লু হাওলিন ফাইয়াকুলু ছালামুন আলাইকুম বিমা ছার্বাতুম ফানে’মা
উ’ক্বাদ্দার, ওয়াল খোলাফাউল র্আবাআতু হাকাজা ইয়াফআলুন) অর্থাৎ, বর্ণিত আছে
যে, “হযরত রাসূল (সাঃ) প্রতি বৎসরে (নির্দিষ্ট) দিনে শহিদদের কবরে এসে
তাঁদের প্রতি সালাম প্রেরণ করতেন এবং তার পর চার খলিফাও অনুরূপ করতেন।”
তাছাড়া শাহ্ সাহেব তাঁর পিতা শাহ্ অলিউল্লাহ সাহেবের র্উস করতেন। এতে মৌলভী
আব্দুল করিম পাঞ্জাবী সাহেব লিখেছেন যে, আপনারা র্উসকে ফরজ মনে করেছেন এবং
প্রতি বৎসর র্উস এর আয়োজন করেন। এর উত্তরে শাহ্ সাহেব ‘জুব্দাতুন্
নাছেয়েহ্’ গ্রন্থে (৪৪ পৃঃ ১২১৬ সন) লিখেছেন যে, “এ অভিযোগ ঠিক নয়। আমরা
র্উসকে ফরজ করিনি আমরা একটি বিশেষ দিনে বুজুর্গদের মাজারে সমবেত হই, কোরান
তেলাওয়াত করি, দোয়া করি, শিন্নি ও খানা বিতরণ করি এবং সওয়াব রেসানী ও বরকত
হাসিলের চেষ্টা করি। এটা তাবেঈন এবং বিশিষ্ট ওলামাদের দ্বারা আমরে
মুস্তাহাসান তথা বিশেষ বরকতময় কাজ বলে সমর্থিত। বিশেষ দিন সেটাই, যে দিন
বুজুর্গগণ ইহজগৎ থেকে পর জগতে পদার্পণ করেন, এটাই র্উসের দিন।”
মনে
রাখতে হবে যে, র্উস মাহ্ফিলে সমাগত সকলের কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে
খানা না পৌঁছে এবং খানার আয়োজনকারী যতক্ষণ পর্যন্ত খাওয়ার অনুমতি না
দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খাওয়া আরম্ভে অপেক্ষা করা উচিত। কারণ এটাই নবী (সাঃ)
এর আদর্শ। এমনিভাবে অনেক সময় অপেক্ষা করায় আহার ঠান্ডা হয়ে যেত আর এটাই
সুন্নত এবং বরকত। এভাবে যে পর্যন্ত সাহেবে কেবলা ও স্বীয় মুর্শিদ কোনো শুভ
কাজে অনুমতি না দেন, সে পর্যন্ত সে কাজে বরকত হয় না, বরং সে কাজের মধ্যে যে
সব বরকত ও ফজিলত গুপ্ত রয়েছে তা থেকে মুরিদ বঞ্চিত থেকে যায়। এ জন্য এ
ধরনের মানুষের কোনো ফজল ও বরকতও নসীব হয় না। এটা একটা অধঃপতনের লক্ষণ।
খাবার সময়, খাবার পূর্বে বুজুর্গদের উদ্দেশে সওয়াব রেসানীপূর্বক
‘বিসমিল্লাহ্’ বলে আহার শুরু করাতে বরকত রয়েছে। নিজের হাতের দিক থেকে খাওয়া
ও ছোট লোকমায় খাওয়ার মধ্যেও বরকত রয়েছে। মুখ বেশি বড় করে হা করা উচিত নয়,
কারণ পশু ও ভূত-প্রেতরা এরূপ করে। এ কারণে এতে বরকত নষ্ট হয়ে যায়। অভাবী ও
ফকির-মিসকিনদের প্রতি যত্ন নেওয়া এবং আউলিয়াদের উদ্দেশে সওয়াব রেসানী করাও
উত্তম এবং বরকতের কাজ যাকে লোকেরা ফাতেহা বলে আখ্যায়িত করেছে। এটা মোটেই
কোনো মন্দ কাজ নয়। যাদের কাশ্ফ লাভ হয়েছে তাদের কাছে এ বিষয়টি অত্যন্ত
পরিষ্কার।
শাইখে কামেল পাপ হতে পবিত্র, মহাসাগর তুল্য ও তাদের পাপের
প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার বর্ণনা
আল্লাহ্্র
আশিক ও কামেল ব্যক্তি যখন আল্লাহ্্র ‘সিফাতে কুদ্সী’ তথা মহা পবিত্রতা
গুণের সংগে মিশে যান তখন বাইরের কোনো আকস্মিকতা ও অন্যায় তাকে প্রভাবিত
করতে পারে না। অর্থাৎ পাপ ও অপবিত্রতা দ্বারা তিনি কলুষিত হন না। কেননা
পবিত্রতা গুণের এটাই বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং আল্লাহ্্ তায়ালাও এ
পবিত্রতা গুণের বদৌলতেই সব কিছু থেকে পবিত্র আছেন। আর এ পবিত্রতা গুণ
আল্লাহ্্র অন্যান্য গুণের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। এ পবিত্রতা গুণকে
আগুনের সাথে তুলনা করা যায়। এতে যতই ইন্ধন নিক্ষেপ করা হোক না কেন সাথে
সাথে সবই জ্বলে ভস্ম হয়ে যাবে অথবা এটি একটি সাগরের মতোÑ যত অপবিত্রতাই এতে
নিক্ষিপ্ত হোক, সবই তাতে বিলীন হয়ে যাবে এবং এর সাথে মিশে যাবে। কেয়ামত
পর্যন্ত যদি এমনিভাবে নাপাক বস্তু নিক্ষেপ করতে থাকে তাতেও সাগর অপবিত্র
হবে না বরং যা কিছু তাতে নিক্ষিপ্ত হবে তা সবই সাগর জলে মিশে সাগরে
পরিবর্তিত হবে। হাদিস শরীফে এর প্রমাণ মিলেÑ “কোনো মোমেন পাপ করে না, যে
পাপ করে সে কি মোমেন?” এর সারমর্ম এই যে, প্রকৃত মোমেন তথা আশিক তাঁর
মাশুকের পবিত্রতা গুণে একীভূত হয়ে যান। তাই তিনি সর্বদাই পবিত্র। আর তিনি
অপবিত্র হলে আল্লাহ্্র পবিত্রতা গুণটির তৎপর্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে।
(নাউজুবিল্লাহ মিনহা)। এর দ্বারা রেযা, তাসলিম এবং র্ইফান বাতিল হয়ে যায়
এবং এটা অসম্ভব। কারণ এটা স্বয়ং আল্লাহ্্র সত্তারই বাতিলের শামিল। কেননা
‘সিফাতে কুদসিয়া’ তথা মহাপবিত্রতা গুণ সকল গুণের উৎস বা মূল। তা থেকে
‘সিফাতে হুব্বি’ বা মহব্বত উৎসারিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উভয় গুণই এক। এ
বিষয়ের বিশদ বর্ণনা নূরের প্রকৃতি অধ্যায়ে পাওয়া যাবে। বস্তুত
‘ফানাফিল্লাহ’র মাধ্যমে আশিক-মাশুক একীভূত হয়ে যান। ফানাফিল্লাহ হলে
আশিক-মাশুকের আলাদা অবয়ব বা অস্তিত্ব বহাল থাকে না। তাইতো মাওলানা রুমীর
একটি কবিতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাজী এমদাদ উল্লাহ (রহঃ) বলেন, “তুমি যদি
ফানাফিল্লাহ হতে না পার, তাহলে ফানাফিশ্ শাইখ হও, এতে করে ফানাফিশ্ শাইখ
হওয়ার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহর গৌরব অর্জন করতে পারবে।”
কেরামতের একটি ঘটনা
হযরত বুআলী কলন্দর একজন আরিফ ও বেলায়েতপ্রাপ্ত আউলিয়া ছিলেন। তিনি প্রায়ই জাহেরি শরিয়ত বিধান গন্ডিতে আবদ্ধ থাকতেন না। যেমনÑছতর না ঢাকা এবং গোঁফ না কাটা ইত্যাদি। সে সময় জাহেরি শরার কাজীদের গভর্নরের মতোই ক্ষমতা ছিল। শরার কাজী হযরত কলন্দরের লম্বা গোঁফ দেখে গোশশা হয়ে যায় এবং তাঁর গোঁফ কাটার জন্য জনতাকে নির্দেশ দেয়। কারণ ঐ ধরনের গোঁফ রাখা জাহেরি শরিয়তে নিষেধ ছিল। কিন্তু কেউই কাজীর নির্দেশে হযরত কলন্দরের গোঁফ কাটতে এগিয়ে আসে নি। অতঃপর কাজী তার আদরের ছেলেদের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পেয়ে তার এক ছেলে কাঁচি হাতে হযরত কলন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। হযরত কলন্দর তাকে বললেন, অগ্রসর হবে নাÑ মারা যাবে। তবুও সে অগ্রসর হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। বর্ণিত আছেÑ এভাবে তার সাত ছেলে মতান্তরে আঠারো ছেলে মৃত্যুবরণ করে। সব শেষে কাজী স্বয়ং কাঁচি দ্বারা হযরত কলন্দরের গোঁফ কাটতে আরম্ভ করে কিন্তু এক একটি গোঁফ কাটার সঙ্গে সঙ্গে দরদরিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। রক্ত দেখে কাজী গোঁফ কাটা থেকে বিরত হয়। তখন হযরত কলন্দর কাজীকে লক্ষ করে বললেন, তোর মতো কুকুরের গোঁফ আমার নয় বরং আমার গোঁফ জীবিত। কাজী তাও অগ্রাহ্য করল। এক বা দুছেলে মারা যাবার পর কাজী নিজেই বুঝতে পেরেছিল যে, এরপর যে যাবে সেও মারা যাবে। এর পরও তার এরূপ জেদ করা হারাম নয় কি? এ অন্যায় খুনের জন্য কাজীর ফাঁসি হওয়া উচিত নয় কি? তাহলে শরিয়ত কী চায়, ন্যায় না অন্যায়? শরিয়তের বিধান কি অন্যায়কে সমর্থন করে? এর জবাব কী? বর্তমানে যে সব জাহেরপন্থী কাজীরা এ অন্যায় নির্দেশকে অবলম্বন করে শরা তৈরি করেছে এবং ফকীর তথা আল্লাহ্্ওয়ালাদের তুচ্ছজ্ঞান করে, এটা কোন শরিয়ত?
সূফী পরিভাষা (জাওহারে গো’বী)
সূফী
পরিভাষায় আরেফ-এ-কামেলকে বুতকাদাহ, বুতখানা, সারাবখানা, দায়ের, খারাবাত
এবং আলম বলা হয়। মুর্শিদকে পীর মগাঁ, পীরে খারাবাত, খাম্মার ও বাদাহ ফরুশ
বলা হয়। সমস্ত দোষ থেকে মুক্ত রূহানী অবস্থাকে তরছামরদ্ এবং ওয়ারেদাতে
গাইবীকে তরছা-এ-বাচ্ছা বলা হয়। যিনি একত্ববাদের সাগরে নিমজ্জমান অর্থাৎ
একত্ববাদীকে গোবরাহ ও কাফের বলা হয়। জওককে বলা হয় মায় ও সারাব অর্থাৎ আবেগ ও
অনুরাগ তা সাধকের অন্তরের প্রেমাগ্নি-স্ফুলিঙ্গ দ্বারা রিপুকে দোষত্রুটি ও
কদর্যমুক্ত করে। অদৃশ্য নূরের অবলোকন এবং আধ্যাত্মিক স্তরের উপলব্ধিকে
ছাগের ও পায়মানা বলা হয়। একই উদ্দেশ ও এক রঙে রঙিনকে ষুন্নার বলা হয়।
গুণাবলির বিচ্ছুরণকে ইয়ার, দিলবর, মাহ্বুবে সনম ও দোস্ত বলা হয়। বাতেনী
জয্বাকে গম্যাহ্, বুসা ও ফায়েজ বলা হয়। জীবন বৈশিষ্ট্যকে লব্বে দাহান বলা
হয়। এল্হামের বাণীকে ‘চেস্মে আবরু ও জামাল’ বলা হয়। আহলে তুয্ক্ তথা
বিশুদ্ধ ও পবিত্রকে কালাশ ও কলন্দর বলা হয়। জয্বা ও অনুরাগপন্থীদের শায়দা
বলে। প্রেমকে সারাব ও বাদাহ্ বলা হয়। আশিকের খুন তথা মহব্বত বা
প্রেমাশ্রুকে মায়লাল বলা হয়। “এস্তেগ্রাক”কে মস্তি ও খারাব বলে। প্রেমকে
একামতে গোলবাহ বলা হয়। নিয়মের বাইরে সব কিছু পরিত্যাগ করে কঠিন হয়ে যাওয়াকে
রুজায়াত বলে। সাফা, তুয্ক্ ও ফানাপন্থীদেরকে কলন্দর ও কালাশ বলা হয়।
‘নূরে-হক্ব’কে শামা তথা প্রদীপ বলা হয়। দীলে মুতাজাল্লা বা আলোকিত অন্তরকে
কা’বাব ফরুশ বলা হয়। বিচ্ছেদকে ছাবুহী, মহাদেছা এবং ইন্ফেরাক বলা হয়।
প্রকৃত কাজের উপযুক্ত সময়কে ছুবেহ্ তুলু বলা হয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে
না পারাকে বে-এমদাদে মোকাম বলা হয়। অন্ধকারকে কুফর বলা হয়। প্রেমাস্পদের
বাসনাকে বুত, মোশাহেদা ও মুয়ানী বলা হয়। আল্লাহ্্র প্রকৃত স্তরকে কাশ্ফ ও
শহুদ বলা হয়। তাবায়ে তথা স্বভাবকে চলিপা বলা হয়। মনুষ্যজগৎকে দায়ের বলা হয়।
আলমে ছওদা তথা লাভের জগৎকে কুল্লিয়া বলা হয়। আরিফদেরকে তোয়ামাত বলা হয়।
প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে একাত্ম হয়ে যাওয়া এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে
“জাফায়ে জামাল” বলা হয়। জালাল, কলক ও প্রত্যাবর্তন করাকে যুদে তাজাল্লিয়াত
বলা হয়। তাজল্লিয়ে বাছেদ ও সিফাতে বাছেদকে দিলদার বলা হয়। সিফাতে কাবেজীকে
দিলবুর বলা হয়। অদৃশ্য সত্তাকে জুলফ্ বলা হয়। জাহেরপন্থীকে গেছুবি বলা হয়।
আল্লাহ্্র জগৎকে মায়খান বলে। প্রেমকে বাদাহ্ বলে। স্বয়ং নূর প্রত্যক্ষণের
মাধ্যমে মূল সত্তার প্রাপ্তিকে অছলুন বলা হয়। এনায়েতে আজলিকে ‘ওফা’ বলা হয়।
সফ্ফে রহমানী ও তাজাল্লীয়ে জামালিকে ‘গমগেছারী’ বলে। ‘খালেছিয়াহ’ এলমে
গায়েবকে বলা হয়। আল্লাহ্্ ব্যতীত সব কিছু হতে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে ‘তাফাররুদ’
বলা হয়। ইবাদাতে আল্লাহ্্র দিদার লাভ করা ও পবিত্র হওয়াকে ‘এত্তেহাদ’ বলে।
আল্লাহ্্ বিমুখতাকে ‘সাকওয়াত’ বলে।
বিবিধ উপকারিতা
‘কল্বে
সানুবরী’র সাতটি অংশ ও পেট রয়েছে। যথাÑছদর, নশর, শামছী, নূরী, র্কুব, মকীন ও
নফ্সী। উপরের অংশের নাম ছদর এবং এর মগজের নাম নশর এবং এর বাতেনী অংশকে
শামসী বলা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সমস্ত অংশই শয়তানের শয়তানি থেকে মুক্ত এবং
নিরাপদ। তবে ছদরে শয়তানের প্রভাব রয়েছে। এ জন্যই আল কোরানে বলা হয়েছে,
يوسوس فى صدور الناس من الجنة والنا্র (ইউওয়াছবিছু ফী ছুদুরিন্নাছ মিনাল
জিননাতি ওয়াননাছ) অর্থাৎ, “জ্বীন ও মানুষ, মানুষের বক্ষে প্ররোচনা দেয়”।
অর্থাৎ, বক্ষকে কেন্দ্র করেই খান্নাছ ও শয়তানের শয়তানি চলে। এ মোকাম তথা
বক্ষ সত্য ও অসত্যের নিকটবর্তী স্থান। এটা মানব প্রকৃতির সংলগ্ন।
দুনিয়াদারদের বক্ষ সর্বদা সত্য-মিথ্যা বেষ্টিত থাকে তথা সত্য ও অসত্য
বেষ্টন করে আছে মানব প্রকৃতিকে। “ছাহেবে নাছুত” বা দুনিয়াদার সর্বদাই
আত্মকলহে লিপ্ত থাকে। বায়ুর প্রভাবে সাগর যেমন তরঙ্গায়িত হয় তেমনিভাবে
দুনিয়াদার নফ্স এবং শয়তানের অসত্য জ্ঞানের কার্যক্রমের পর্দার মধ্যে
তরঙ্গায়িত হয়। সালেক বা সাধকগণ যখন এ স্তর অতিক্রম করেন, তখন তিনি শয়তানের
প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ফেরেশ্তার মর্তবা ও রহমানী প্রভাবের হেফাজতে চলে
আসেন। তখন তাঁর মধ্যে রহমানী স্বভাব প্রকাশ পেতে থাকে এবং জাহের হতে থাকে
তাঁর কাছে স্তরে স্তরে গোপন রহস্য ভান্ডার। মোট কথা কাশ্ফের অভিজ্ঞতার উপরই
‘মোকামে নশরী’র গতিবিধি নির্ভরশীল। অর্থাৎ এ মোকামে সাধক খালেকে হাকিকী বা
স্বয়ং সত্তার ছামাদ নামে রহস্যজ্ঞান উপলব্ধি করতে পারে। এর পর মোকামে
শামসীর অবস্থান বা স্তরÑ যাকে বলে মোকামে ‘কলবে তনদুর’। এর মধ্যে জালালী
ফায়েজের আগমনে আল্লাহ্্র সত্তার প্রতিচ্ছায়া বিকশিত হয়।
এরপর সাধক
মোকামে নূরীতে প্রবেশ করেন। এখান থেকেই পরম সত্তার কাশ্ফ তথা জ্ঞান লাভ
শুরু হয়। নূরানী কাশ্ফের নজরে এ স্তরে যা কিছু উপলব্ধি হবে তা পরম সত্তার
প্রতিচ্ছবি বা অস্তিত্বের প্রমাণ। এ স্তরে সাধক ফানা-ফিল্লাহ্ তথা
আল্লাহ্্তে আত্ম বিলুপ্তির মাধ্যমে পরম সত্তায় অবস্থান করেন। এ স্তরেই
আল্লাহ্্র সাধকের অন্তর আলো ও উজ্জ্বল হয়। এমনকি নূরময় অন্তর আলোকে ও
উজ্জ্বলতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অতঃপর সাধক আল্লাহ্্র অনুগ্রহসিক্ত হয়ে
নৈকট্য স্তরে সহাবস্থান করেন। অর্থাৎ বন্ধুত্বের বন্ধনে আমিত্ব ও তুমিত্বের
অবসান ঘটে এককার হয়ে যায় এবং এটাকে ‘র্কুব’ বা নৈকট্য বলা হয়। এটা ‘ফানায়ে
তাজাল্লী’র শান বা মহিমা, যার নাম হচ্ছে ‘মকীন’। এ স্তরে পৌঁছলেই মানুষ
মোমেন হয় এবং এটাকে ঈমানে প্রবেশ বলে। অর্থাৎ এ স্তরেই ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ
করে, এর পরই সাধক মানুষ আরিফ হয়। অর্থাৎ এর পর সাধক ঈমানদার থাকে এবং
ঈমানের স্তর অতিক্রম করে যায়। এ জন্য পাক কালামে বলা হয়েছেÑ واعبد ربك حتى
يأتيك اليقين (ওয়াবুদ রাব্বাকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াক্কীন্) “অন্তরে দৃঢ়
বিশ্বাস অর্জিত হওয়া পর্যন্তই ইবাদত করো।” অতঃপর বিশ্বাসের প্রশ্ন নেই এবং
ইবাদতের প্রয়োজন নেই। একীন তথা বিশ্বাসের ফল হলো ইত্তেহাদ ও এরফান এবং এটাই
একীনের মূল। এর দ্বারাই সন্তুষ্টি ও সমর্থন লাভ হয়। তাই কেউ কেউ বলেছেন,
الايمان بين الخوف والرضاء (আল্-ঈমানু বাইনাল্ খাওফি র্অরিদায়ি) অর্থাৎ,
“ভীতি ও সন্তুষ্টি এ দুয়ের মধ্যস্থলে ঈমানের অবস্থান।” এখানে মোকামে
কুরবকেই খাওফ বা ভীতির স্থান বলা হয়েছে। কারণ ‘র্কুবত’ বা নৈকট্য অর্জিত
হওয়ার সময় অস্থিরতার সৃষ্টি হয় এবং স্থিরতা আসে। একেই খাওফ তথা ভয় বলা
হয়েছে। মকীন বা মোকামে ঈমানের উপরে মোকামে নফ্সী অবস্থিত। এখানে পূর্ণ
তৃপ্তি ও তুষ্টি বিরাজমান। সন্তুষ্টি লাভের পর কোনো ভয়-ভীতি ও আজাব সম্ভব
নয়। যদি অস্থিরতা ও আজাবের ভয় থাকে তবে তাসলিম বা সন্তুষ্টি বাতিল হয়ে যায়।
এর পর মোকামে নফ্সীতে পৌঁছলে বান্দার সকল কামনা পূর্ণ হয় এবং পরম সত্তার
সাথে সে একাত্ম হয়ে যায়। অর্থাৎ এ
মোকামে বান্দার শান হচ্ছে আল্লাহ্্র
‘সত্তা’ আর আল্লাহ্্র শান হচ্ছে বান্দার ‘সত্তা’। এরই নাম ইত্তেহাদ অর্থাৎ
একীভূত হওয়া তথা পরিপূর্ণ মিলন। এ স্তরে ‘আনা’ বা আমি অর্থ সমস্ত
পরিপূর্ণতা ও যাবতীয় সৃষ্টি। এ ‘আনা’ তথা আমিত্বে উপাসক ও উপাস্যের মধ্যে
শানের পার্থক্য থাকে না। এটা ‘কল্ব’ তথা অন্তরের উন্নত অবস্থা। একেই
‘কলবে-সানুবরী’ বলা হয়। এর আকৃতি অনেকটা সানুবর বা দেবদারু বৃক্ষের মতো।
লোকের কাছে এটা বিছ্মিল্লাহ্ নামে পরিচিত। এতে নিম্নরূপ স্তরসমূহ রয়েছেÑ
এ কল্ব বা অন্তরের ঊর্ধ্ব মোকাম থেকেই ‘আনা’ বা আমি কথাটি উচ্চারিত হয়। কলবের এক পার্শ্বে রসুনের কোষের মতো এক টুকরা মাংস আছে, এটাই খান্নাছ বা শয়তানের স্থান। যত শয়তানি তথা কুপ্রবৃত্তির এখান থেকেই উৎপত্তি হয়। কিন্তু এর গভীরে ছদর বা বক্ষের মূল অবস্থিত, সেখান থেকে নয়।
মোকামসমূহের বিস্তারিত বিবরণ
‘মুজাদ্দেদিয়া’
ও ‘মাছুমিয়া’ ত্বরিকার অনুসারীদের লতিফাসমূহ নিম্নরূপÑ কল্ব, রূহ্, র্সি,
খফী, আখফা, নফ্স, আব, আতশ, খাক ও বাদ। কলবের স্থান বাম স্তনের দু আঙ্গুল
থেকে সামান্য নিচে ঝুলানো। রূহ্-এর অবস্থান কলবের ঠিক বিপরীত দিকে ডান
পার্শ্বে। র্সি বাম ছাতির দু আঙ্গুল উপরে। খফী ঠিক তার অনুরূপ ডান দিকে
অবস্থিত। আর আখফা বক্ষের মধ্যখানে অর্থাৎ বুকের কড়ার নিচু স্থানে অবস্থিত
এবং নফ্ছ নাকের উপরে ভ্রুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। আব, আতশ, খাক ও
বাদ এই চার পদার্থ সমগ্র দেহে মিশে রয়েছে। এগুলোর জন্য দেহে নির্দিষ্ট কোনো
স্থান নেই। যখনই এতে মুর্শিদের তাওয়াজ্জু পতিত হয় সঙ্গে সঙ্গে তা কারখানার
ইঞ্জিনের মতো প্রকম্পিত, গরম ও আলোকিত হয়ে যায় এবং সাধক স্তম্ভিত ও অভিভূত
হয়ে ভাবতে থাকে, তার একি অবস্থা হলো! সে যেন কোনো বারুদের প্রতিক্রিয়ার
মতো আশ্চর্য বস্তু দেখছে। তাওয়াজ্জুর এ প্রতিক্রিয়ায় সত্যানুসন্ধানী অস্থির
ও পাগলের মতো হয়ে যায় এবং এ অবস্থাটি তাকে বেশ আনন্দ ও তৃপ্তি দান করে এবং
রকমারি অবস্থার ফলে তার অন্তর শান্ত ও নরম থাকে। অবস্থার প্রকৃতিগতভাবে
অস্থিরতা হলেও এ অস্থিরতা নিগূঢ় অর্থপূর্ণ। অনুরূপ প্রভাবের সামান্যতেই
সত্যানুসন্ধানী প্রভাবিত হয়। এটা কোনো দমবন্ধ জিকিরের প্রভাব নয়।
রুদ্ধশ্বাস জিকিরকারী পরিশ্রম করে বটে কিন্তু এর দ্বারা কিছুই হাসিল হয় না।
কারণ মুর্শিদের তাওয়াজ্জু বা দৃষ্টি আগুনের মতো। যে শুধু দম বন্ধ করে
জিকির করে, সে ব্যর্থ পরিশ্রমী যদিও তা মুর্শিদের সুরতের ধ্যানে হয়। অর্থাৎ
যে ব্যক্তি দম বন্ধ করে জিকির ও অজিফায় মশগুল থাকে সে ব্যক্তি ব্যর্থ
পরিশ্রমী ও উপাসক ছাড়া কিছুই নয়। তাওয়াজ্জু বা মুর্শিদের দৃষ্টি সম্পূর্ণ
ভিন্ন ব্যাপার।
মোটকথা তাওয়াজ্জুর ফলে সাধকের অন্তর যখন আল্লাহ্্র দিকে
ঝুঁকতে থাকে তখন জিকিরের শব্দ ও অর্থ আপনাআপনি তার বোধগম্য হতে থাকে এবং তা
থেকে প্রেমও উৎসারিত হতে থাকে। আর তখন হতে আল্লাহ্্ প্রেমিকের রঙ বদলাতে
শুরু করে। লাতায়েফে ‘আনাচারিয়া’ অর্থাৎ আব, আতশ, খাক ও বাদ লতিফাসমূহের
মূলে মুর্শিদের শক্তি যখন প্রভাব বিস্তার করে তখন প্রত্যেকটির প্রভাব ও শান
সত্যানুসন্ধানীর শরীরে প্রকাশ পায় এবং সত্যের সাধক তা ভালোভাবেই অনুভব
করতে পারে। যেমনÑ আব ও আতশ যথাক্রমে ঠান্ডা ও গরম। তাওয়াজ্জুর প্রতিক্রিয়া
মগ্ন ও সাধারণ অবস্থায় শিক্ষার্থী নিজের মধ্যে অবশ্যই অনুভব করবে এবং
লালিমা, আলো ও আগুন ইত্যাদি যা প্রকাশ হবে শিক্ষার্থী তা কলবে অনুভব করে।
একই
সঙ্গে দশ লতিফায় জিকির হলে তাকে সুল্তানুল আয্কার বলা হয়। তখন মনে হয়
পৃথিবীর সব কিছু যেন তাঁর সাথে জিকির করছে। এ জিকিরের পরিক্রমণতায় নূরময়
বক্ষের স্ফুলিঙ্গ বিজলী অথবা চন্দ্র সূর্যের আলোর মতো দেখায়। কখনো সে নিজের
মধ্যে সাড়া শব্দ অনুভব করে, ধীরে ধীরে তাঁর সমস্ত ঘটনা ও অবস্থার জ্ঞান
লাভ হয়। আর বস্তু ও আধ্যাত্ম উভয় জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে সে যথারীতি
অবহিত হয়। এ সবই শাইখের প্রভাবের ওপর নির্ভর করে, কিতাব পাঠে কিছুই হাসিল
হয় না।
নক্শবন্দিয়া ত্বরিকার লতিফাসমূহ
নক্শবন্দিয়া ত্বরিকার
লতিফা তথা সূক্ষ্ম স্থানসমূহ নিম্নরূপÑ কল্ব ও রূহের স্থান মুজাদ্দেদিয়া
ত্বরিকার অনুরূপ। র্সিরের স্থান পেশানী তথা কপালের যে স্থান হতে চুল গজাতে
আরম্ভ করে সেখানে। খফির অবস্থান বক্ষে। আখফা হলো একেবারে মাথার তালুতেÑ
শিশু বয়সে যে স্থানটি নরম থাকে। আর নফ্ছ হলো নাভিতে। এর ছয় লতিফা ব্যতীত
‘কালিয়া’ নামে আরও একটি লতিফা রয়েছেÑযা আব, আতশ, খাক ও বাদ এ চার পদার্থ
সমন্বয়ে গঠিত। কেননা এ চারটি পদার্থ মিলেই দেহ ও শরীর গঠিত এবং এ জন্যই একে
‘লতিফায়ে কালিয়া’ বলা হয়। অতএব এক হিসেবে লতিফা সাতটি, অন্য হিসেবে দশটি।
ছয় লতিফায় জিকির জারী হওয়ার পরে ‘লতিফায়ে কালিয়া’য় এক সঙ্গে জিকির জারী হয়।
অতঃপর সত্যদর্শন ও আধ্যাত্মিক ভ্রমণের মহড়া শুরু হয়। কিন্তু নক্শবন্দিয়া
ত্বরিকার মতেÑ ‘লতিফায়ে আখ্ফা’ মাথার তালুতে অবস্থিত এবং মুজাদ্দেদিয়া মতে
তা বক্ষে অবস্থিত, তবে শিরার মাধ্যমে উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে অর্থাৎ
মাথার তালুতে যে হেক্মত আছে তা হযরত মুজাদ্দিদ (রহঃ) সাহেব নাকের উপরি ভাগ
হতে বের করেছেন। অনুরূপভাবে র্সি ও খফিকেও অন্য স্থান থেকে প্রকাশ করেছেনÑ
এটা তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাব।
ঊর্ধ্ব জগতের পাঁচ লতিফা তথা কল্ব, রুহ্,
র্সি, খফি ও আখফার মূল ঊর্ধ্বজগতে আরোহণ, ভ্রমণ ও স্থিতি স্থান লাভের
নক্শবন্দিয়া পদ্ধতি হল এই যে, প্রত্যেকটি লতিফা যথারীতি এক এক করে অতিক্রম
করতে হবে। যেমন কল্বের আসল থেকে আসলের কার্যক্রম যথারীতি সম্পন্ন করে
রূহ্-এর নীতিমালা ও ধাপগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এমনিভাবে র্সি, খফি ও আখফায়
আরোহণ ও অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু মুজাদ্দেদিয়ায় এ নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম
রয়েছে। ঊর্ধ্ব জগতের পঞ্চ লতিফার ভ্রমণ পথের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ স্থান
রয়েছে। সেসব স্থানে বিশ্রাম ও আরাম গ্রহণের মাধ্যমে ঊর্ধ্বারোহণ করতে হবে।
অর্থাৎ কল্ব স্ব-স্থানে শান্তি গ্রহণরত থাকা অবস্থায় রূহের ছায়ের তথা ভ্রমণ
শুরু হয়। কিন্তু তার স্থান কলবের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ এর স্তর উচ্চে এবং কলবের
মূল স্থান হতে রূহ্ এক দাওরা ঊর্ধ্বে অবস্থিত। অনুরূপভাবে র্সি-এর মূল
রূহের উপরে এবং খফি সিরের উপরে ও আখফা খফির উপরে অবস্থিত। মোটকথা যখন এ সকল
লতিফাসমূহের ছায়ের হবে অর্থাৎ ঐশীজ্যোতি দ্বারা আলোকোজ্জ্বল হবে, তখনই
পরমসত্তা ও গুণাবলির ছায়াকায়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ লতিফাগুলোকে বেষ্টন করে
উদ্ভাসিত হবে, যেমন প্রতিভাত হয় আয়নায় ছায়াসমূহ। তবে মনে রাখতে হবে,
প্রতিভাত ছায়া মূল থেকে আলাদা নয়Ñ ছায়া মূলের একটি রূপ মাত্র। হাকিকতে মূল ও
তার প্রতিবিম্ব এক ও অভিন্ন।
মোটকথা কল্ব, রূহ্, র্সি, খফি ও আখ্ফা
প্রত্যেকটির আসলের আসলে ঊর্ধ্বারোহণে বিশ্রাম নিয়ে যাবে। মুজাদ্দেদিয়া মতে
এগুলোকে দাওয়ায়ের, সুলুকে আউয়াল ও সুলুকে ছানী বলা হয়। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন
শ্রেণীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যথাÑ দায়রায়ে ইম্কান, দায়রায়ে জালাল, দায়রায়ে
কুরবিয়্যাত, দায়রায়ে বেলায়েত ইত্যাদি। বেলায়েতে ছানী তথা বেলায়েতের
দ্বিতীয় স্তরে কোরান, ছাওম, কা’বা, নবী এবং শ্রেষ্ঠ পয়গম্বরগণের হাকিকত
সহজবোধ্য হয়। এটা কিতাবী তথা পড়া শোনা জ্ঞানে লাভ হয় না, বরং এটা
আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ফায়েজের বিশদ বিবরণ
কল্বে
‘সিফাতে আফ্আলিয়া’র তাজাল্লি বা ফায়েজ দীপ্ত হয়। অর্থাৎ কর্মগুণের
ফলশ্রুতির নূর কলবে প্রদীপ্ত হয়। রূহ্ মোকামে ‘সিফাতে সবুতিয়া’র তাজাল্লি
বা ফায়েজ প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ রূহে ফায়েজ ও নূর পতিত হয়ে সব নূরকে প্রমাণ
করে। সিরে পরম সত্তার তাজাল্লি বিকশিত হয়, অর্থাৎ আল্লাহ্্র সত্তাগত নূর ও
আহদিয়াত তথা একত্বের নিশান প্রতিফলিত হয়। খফিতে ‘সিফাতে সলবিয়া’র তাজাল্লি
প্রতিফলিত হয়। এর অর্থ নিজেকে বের করে দেওয়া বা আমিত্বের খোলস ত্যাগ করা।
আর আখ্ফা লতিফায় সিফাতে ‘শান-এ-জাম’ এর তাজাল্লী প্রতিফলিত হয়। এর অর্থ
সর্বসমন্বিত মহিমার বহিঃপ্রকাশ।
দৃষ্ট নূরের বিবরণ
কল্বের নূরের
রঙ র্জদ তথা হলদে। রূহের নূর র্ছোখ তথা লাল। র্সিরের নূর ছিয়া তথা কালো।
খফির নূরের রঙ ছফেদ তথা শুভ্র। আখ্ফার রঙ সব্জ তথা সবুজ। নফ্সের নূর বেগুনি
তথা নীলাভ নক্ষত্রের ন্যায়। আর অবশিষ্ট চার লতিফার নূরসমূহ যথাক্রমে খাক
ধানী বা বাদামী, আব নীল, আতশ কালোর মতো, বাদ প্রায় সবুজ বর্ণ।
বেলায়েতের বিবরণ
প্রধান
লতিফাসমূহ তথা কল্ব, রূহ্, র্সি, খফি ও আখফার বেলায়েত বিশিষ্ট পয়গম্বরদের
পদতলে। কল্ব আবুল বাশার হযরত আদম (আঃ)-এর পদতলে। রূহ্ হযরত নূহ্ ও হযরত
ইব্রাহিম (আঃ)-এর পদতলে। র্সি হযরত মূসা (আঃ)-এর পদতলে। খফি হযরত ঈসা
(আঃ)-এর পদতলে। আখ্ফা শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুয্তাবা
সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলা আলিহী ওয়া আস্হাবিহী আস্সালাতু
ওয়াস্সাল্লাম-এর পদতলে।
জানা দরকার যে, বেলায়েতের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেয়ামত
পর্যন্ত সকল নবীই আমাদের নবী, তাঁরা কোনো অবস্থাতেই পৃথক নন। প্রকৃতপক্ষে
তাঁদের ও আমাদের ধর্মের মূল একই। পূর্ববর্তী ধর্মের কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়
বাতেল হলেও মূল বস্তু আজও এক এবং অপরিবর্তিত রয়েছে। কারণ বেলায়েত তাঁদেরই
কদম পাকের নিচে। হযরত আদম (আঃ)-এর নূরে কল্ব আবাদ হয় এবং আদম (আঃ)-এর
দ্বারাই তওবার দ্বার খুলে যায়, তখন মানবপ্রেম সকল প্রকার প্রেমের ওপর
প্রাধান্য লাভ করে এবং মুর্শিদের থেকে পথপ্রদর্শক নূরসমূহ ও স্রষ্টার জাতের
তাজাল্লীর বিকাশ ঘটে। যার দ্বারা সাধক সঠিক স্থায়ী ও অমূল্য সম্পদের
অধিকারী হন। এমনিভাবে ‘নূরে ছোরখ্-ছোবুতি’ হযরত নূহ্ (আঃ)-এর তরফ থেকে
শিক্ষার্থীর ‘লতিফায়ে-রূহে’ আসে এবং যা কিছু পাওয়া যায় তাঁদের নিকট থেকেই
পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রধান লতিফাসমূহের মুরব্বি হলেন বিশিষ্ট পয়গম্বরগণ
এবং দ্বীনের মূলনীতির ক্ষেত্রে আমাদের নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে
তাঁদের সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই আমাদের ধর্মকে দৃঢ় করার জন্য হযরত ঈসা (আঃ)
পুনরায় অবতীর্ণ হবেন। তিনি বিশেষ করে বাতেনী জ্ঞান প্রচার করবেন। হযরত
ইমাম মেহদী (আঃ) এরও কাজ হবে বাতেনী জ্ঞান সংরক্ষণ। সুতরাং যে ব্যক্তি
বাতেনী সম্পর্ক থেকে বিমুখ ও অস্বীকারকারী, সে ধর্মেরই অস্বীকারকারী বরং সে
কাফের। তাই যে ধর্মের সারবস্তুকে নষ্ট করে সেও কাফেরই বটে। সুতরাং ঈসা
(আঃ)-এর অনুসারীদের উচিত ধর্মের মূল বস্তুকে নষ্ট না করা। কারণ আমাদের নবী
তাদেরও নবী, যেমনÑ তাদের নবীও আমাদের নবী। মোটকথা, কিতাবধারীদের উচিত
পয়গম্বরদেরকে অস্বীকার ও ঘৃণা করা থেকে বিরত থাকা এবং সকল গোত্রের অলীদের
সাথেই বিশ্বাস ও ভক্তির সম্পর্ক বহাল রাখা।
কাদেরিয়া ত্বরিকার পার্থক্য
কাদেরিয়া
ত্বরিকার সাধনা কোনো লতিফার সাথে যুক্ত নয় এবং সাধকের যে স্থানে আল্লাহ্্
শব্দের ভাব জাগরিত হয়, সে স্থান থেকে জিকির শুরু হয়ে গোটা দেহে প্রসারিত
হয়। এর ফলে বিভিন্ন অবস্থা ও নূর সৃষ্টিপূর্বক সাধক আলোকদীপ্ত ও তৃপ্ত হন।
ফলে এতে এমন সব গূঢ় তাৎপর্যময় অবস্থাদি সৃষ্টি হতে থাকে যা বর্ণনা করা
সম্ভব নয়। কিন্তু যথাযোগ্য কামেল মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ্ ব্যতীত কারো পক্ষে এ
পথে ফল লাভ করা কঠিন। উপরোক্ত অবস্থাসমূহের স্তর থেকে স্তরে উন্নতির
পর্যায়ে মুর্শীদ তাঁর শিষ্যগণকে নিজ ক্ষমতায় পথ ও লক্ষ্যস্থলগুলো নির্দেশ
করে থাকেন এবং মৌল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। এতে ধীরে ধীরে নূরময়
অবস্থা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে ভয়ানক ও বিশাল বিশাল সমুদ্র পার হতে থাকবে।
অতঃপর পরম সত্তার প্রভাবে মাকামে ফানা তথা আত্মবিলুপ্তির স্তর বিকশিত হয়,
তখন সে পরম সত্তার মূল মহাসাগরে নিমজ্জিত হবে। এখানে সে মূলেরও মূল এবং তার
শাখা-প্রশাখার বিভিন্ন কেন্দ্রস্থলে ও তার সূক্ষ্ম অস্তিত্বের অলিগলিতে
ভ্রমণ করবে। এর পর সে প্রধান পর্দার উন্মোচন ঘটিয়ে তার মধ্যে আত্মপ্রকাশ
করবে, সে স্থানের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এখানে সে কিয়ামত পর্যন্ত পাবে
বিভিন্ন মহিমা বা শান। অর্থাৎ এ স্তরে সে যেদিকেই যায় সর্বত্রই পরমসত্তা আর
পরমসত্তা, আর যেদিকেই দেখে কেবল নূর আর নূর। মোটকথা অস্তিত্ব বা
অস্তিত্বহীন অথবা দৃশ্য বা অদৃশ্য, সম্ভাব্য বা অসম্ভাব্য যা-ই হোক, সবই
মূলের আওতায় এক ও অভিন্ন।
চিশ্তিয়া ত্বরিকার কতিপয় লতিফার বিবরণ
চিশ্তিয়া
ত্বরিকার ছয় লতিফা নক্শবন্দিয়া ত্বরিকার মতোই। তবে, চিশ্তিয়া ত্বরিকায়
দৈহিক মোকামসমূহে প্রথম থেকেই উভয় জগতের অন্বেষণ করা হয়। যেমন নাসুত,
মালাকুত, জাবরূত ও লাহুত ইত্যাদি সমস্তই স্বীয় দেহের আওতাভুক্ত ও
সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ দৈহিক বস্তু দেহের সাথে এবং রূহানী বস্তু রূহের সাথে
বিদ্যমান। যেমন চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, অমাবশ্যা-পূর্র্র্ণিমা,
জোয়ার-ভাটা, পাহাড়-নদী, বন-জঙ্গল, পশু-পাখি, জ্বীন-ইন্সান, আলো-আঁধার,
পয়গম্বর, কুতুব, আবদাল, রুজি-রেজেক, হায়াত-মউত, শত্রু-মিত্র, দান-দয়া,
বিপদ-আপদ, গজব-কাহার, সন্তান-সন্ততি, নেকী-বদী, বেহেশ্ত-দোযখ, মক্কা-মদিনা,
ধর্ম-অধর্ম সবই দেহে বর্তমান এবং প্রকৃতপক্ষে এটা বাস্তব ও সত্য। কারণ
আল্লাহ্্র মহামহিম শান ও সত্তা থেকে কোনো বস্তুই দূরে তথা বাইরে নয়। এজন্য
হাদিস শরীফে বলা হয়েছেÑ من عرف نفسه فقد عرف ربه (মান্ আরাফা নাফ্ছাহু
ফাক্কাদ্ আরাফা রাব্বাহু) অর্থাৎ, “যে নিজেকে চিনছে সে নিজের প্রভুকে
চিনেছে।” অর্থাৎ আরিফের নফ্সে আল্লাহ্্র অসীম মহিমার সমস্ত কার্যক্রম ও
অভিব্যক্তি বিদ্যমান। এর উপমা আগুনের মতোÑ যার কোনো সীমা ও শেষ প্রান্ত
নেই।
মোটকথা দেহের অংশসমূহকে দশটি মোকাম ও আঠারোটি মঞ্জিলে বিভক্ত করা
হয়েছে। বিশেষ করে বুরুজের হিসাব অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতিনিয়ত ঘুরছে
এবং উভয় নাক চাঁদ ও সূর্যস্বরূপ। নাকে বারোটি প্রস্রবণ তথা পানি বেরুবার পথ
ও অংশ রয়েছে এবং দিনরাত তা দ্বারা হাজারও শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে। আর এর
মধ্যেই বর্তমান রয়েছে মন্ত্রপূত। বস্তুত এরই মধ্যে সমস্ত রহস্য বিদ্যমান। এ
বারোটি বুরুজের সাথে বিভিন্ন দরজাও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এর উপরিভাগে সাতটি
পথ রয়েছে; যথা দুটি কান, দুটি চক্ষু, দুটি নাক ও একটি মুখ আর তার নিচে
রয়েছে পাঁচটি স্থান যথা দুটি স্তন, নাভি, পেশাব ও পায়খানার অঙ্গ, সর্বমোট
বারোটি পথ। মূলের বিচারে এসব বুরুজ এক একটি জগতের অন্তর্ভুক্ত যথা নাসুত,
মালাকুত প্রভৃতি দশটি আলম রয়েছে এবং আর দুটি আলম রয়েছে তার অন্তরে। তবে
প্রত্যেক দ্বারে এক এক জন করে ফেরেশ্তা নিয়োজিত রয়েছে। আলমে নাসুত তথা মানব
প্রকৃতির দ্বার হলো মুখ, কলিজা হল এর বক্ষ আর এর প্রহরী হলেন হযরত জিবরাঈল
(আঃ)। ‘আলমে-মালাকুত’ তথা ফেরেশ্তার জগতের দ্বার হল চোখ, ফেপড়া
(শ্বাসযন্ত্র) হল এর বক্ষ, এর প্রহরী হলেন হযরত মিকাঈল (আঃ)। দরজায়ে জবরুত
তথা রূহানী জগতের দরজা হল নাক, এর বক্ষ হল নাভি এবং প্রহরী হলেন হযরত
ইস্রাফিল (আঃ)। দরজায়ে লাহুত তথা আল্লাহ্্র সত্তা জগতের দ্বার হল কান, এর
বক্ষ হল পেট এবং প্রহরী হলেন আজরাঈল (আঃ)। সাধকের এসব মোকাম ও স্তরই ভ্রমণ ও
অতিক্রম করতে হয় এবং আল্লাহ্্র স্মরণ রূপ চাবিই হচ্ছে তার অবলম্বন। এ
ত্বরিকার সাধক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাইখের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং যা কিছু
লাভ করে তাঁর দ্বারাই লাভ করে। আর যা কিছু দর্শন করে তা শাইখের সুরতের
মধ্যেই দর্শন করে। এজন্যই শাহ্ অলী আহাম্মদ (রহঃ) সাহেব ‘কাউলুল জামিল’
গ্রন্থে একটি বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন, তা হল, وينظر بين عينى الشيخ فاذا
افض منه شيئ فليتبع بما جمعوا قلوبه (অইয়ান্জুরু বাইনা আইনাশ্ শাইখি ফাইজা
আফাজা মিন্হু শাইউন ফালইয়াত্তাবে বেমা জামিয়ে ক্বাল্বিহি) অর্থাৎ,
“মুর্শিদের উভয় চক্ষুর মধ্যস্থলে দৃষ্টি নিবদ্ধ কর। যখন কোনো ফায়েজ
প্রতিভাত হবে তখন একাগ্রতার সাথে তা হেফাজত কর।” অর্থাৎ, পীরের উভয় চক্ষু
তথা উভয় ভ্রুর মধ্যস্থলে নাকের শেষ প্রান্তস্থিত স্থানটি সামগ্রিক নূর
রহস্যের খনিস্বরূপ; আকাক্সক্ষার চাবি দ্বারা যে এর তালা খুলতে পেরেছে, সে
উভয় জগতের সমস্ত সম্পদ লাভে সমৃদ্ধ হয়েছে। এটাই আশিকের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, একে
‘মোকামে মাহ্মুদা’ বলা হয়। এর স্তর অতিক্রমকারী অসীমত্ব লাভ করেন; তাঁর উভয়
চক্ষুর নূরসমূহ সুদৃঢ় হয় এবং এ বেলায়েতপ্রাপ্তগণ আউলিয়াদের দলভুক্ত হন।
পরবর্তী লতিফা চক্রে সর্বসাধারণের বোধগম্যের জন্য আরও বিশদ বর্ণনা দেওয়া
হল।
দশ আলমের চিত্র বা নকশা
আসলÑ আসল আখফা পরম সত্তা পর্যন্ত উৎস
আসলÑ আসল খফি প্রসারিত, পরম সত্তায়ও পরিভ্রমণ হয়
আসলÑ আসল র্সি তবে তা বিভিন্ন রকমের হতে পারে।
আসলÑ আসল রূহ্্
আসলÑ আসল কল্ব
আসল আখফা
আসল খফি
আসল সির
আসল রূহ্
আসল কল্ব
উৎসসমূহ
কেবল উপরের দিকেই রয়েছে, নিচের দিকে নেই, তা নয়। বস্তুত উপর নিচ
চতুর্দিকেই উৎসসমূহ ও শাখা-প্রশাখা রয়েছে। আরশ থেকে পাতাল পর্যন্ত সবটাই
নশ্বর জগৎ। এটা ‘আলমে-মালাকুত’ (ফেরেশ্তার জগৎ) এর বাতেন এবং পীঠ।
আলমে-মালাকুত ‘আলমে-জাবারুত’ এর বাতেন এবং পীঠ। অনুরূপভাবে জাবারুত লাহুতের
এবং লাহুত ইয়াহুতের বাতেন এবং পীঠ। এমনিভাবে একটিকে অন্যটির বাতেন এবং পীঠ
বলা হয়। অনুরূপভাবে ‘আলমে-নাসুত’ অন্য সব আলম তথা জগতের শেষ পীঠে অবস্থান
করছে এবং একটি অপরটিকে ডিমের খোসার মতো আবৃত করে আছে। সাধক এগুলো অতিক্রম
করার সময় নূরী উপলব্ধি ক্ষমতার সাহায্যে বিদ্যুৎযাত্রীর মতো স্তরে স্তরে
সফরকালে দৃশ্য-অদৃশ্য, জ্ঞেয়-অজ্ঞেয় বহু বস্তু ও দৃশ্য অবলোকন করেন। এমন কি
সত্তার জগৎ সফরকালে সাধক স্বয়ং ‘আল্লাহ্্র সত্তা’ যা সকল সৃষ্টির উৎস, সে
সম্পর্কেও অবহিত হন। এ স্তরে আরোহণকারী হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান,
গাব্রাহ, ফিরিঙ্গী ও মগ সবাই সমান। অর্থাৎ উক্ত স্তরে উপনীত ব্যক্তি মাত্রই
আল্লাহ্্র অলী নামে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য। তাই প্রত্যেক নবী সমর্থকদের
মধ্যে অলী জন্মগ্রহণ করেনÑ যদিও প্রকাশ্য কার্যকলাপ অন্য রকম হয়, তাতে
আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কারণ হিন্দুদের মধ্যে অনেক বড় বড় সাধু-ফকির
রয়েছেন, যারা মৌল ধর্মের খাতিরে আল্লাহ্্ ছাড়া সমস্ত বস্তুর পূজা সম্পূর্ণ
ত্যাগ করেছেন এবং বলেন যে, আল্লাহ্্ওয়ালাদের অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। তাঁরা
কোরান ও নবীদের মান্য করেন। বস্তুত মূর্তিপূজকদের সকল দলই গোপনে দ্বীনে
মোহাম্মদীর অনুসরণ করে এবং মৃত্যু নিকটবর্তী হলে বৈতরণী পার করিয়ে দেওয়া
তথা কালেমা এ মোহাম্মদী পড়ে শোনানো হয়। কেউ কেউ এ কলেমা এভাবে বর্ণনা
করেছেন, যথাÑ “লায় লং আবদুলং সু পুত্র মলং” এর অর্থ ‘কলেমায়ে তৈয়ব’। এটাকে
কলেমায়ে অথর্ব বলা হয়। অর্থাৎ চারি বেদের সর্বশেষ বেদ অথর্ববেদ, এটাই
কোরান। তা পাঠ করলে মানুষ মুসলমান হয়ে যায়, এ কারণে তাকে আর নিজেদের
সম্প্রদায়ের মধ্যে দাখেল করা হয় না।
মহাদেব বলেন, “কোনো ধার্মিক ব্যক্তি
যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে প্রভুসত্তায় বিলুপ্ত না করে ততক্ষণ তার জন্য কোনো
ধর্মই নেই।” দাল শাস্ত্রেও এ কথা বলা হয়েছে। তাদের গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে
যে, দ্বীন বা ধর্ম চার প্রকার। যথাÑ রাজসিক, তামসিক, অলিক ও মানসিক।
হিন্দু, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই ধার্মিক, কাফের ও পাপী
রয়েছে। তবে মুসলমানদের মধ্যে আউলিয়ার সংখ্যা বেশি। কিন্তু ইমাম মেহ্দী
(আঃ)-এর সময়ে সবাই ঈমানদার ও একাচারী তথা সকলের এক ধর্ম হয়ে যাবে। অধিকাংশ
ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে এ কথা উল্লেখ রয়েছে এবং এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে আবার
সত্যকাল প্রতিষ্ঠা পাবে। হিন্দু ধর্মেও এ কথা বলা হয়েছে এবং তা অতি সত্য।
ধর্মের শৃঙ্খলা
যুগ
পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায়ও পরিবর্তন এবং
রূপান্তর ঘটে। এটা ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা সৌন্দর্য। কারণ শাখা-প্রশাখার
মাধ্যমেই বৃক্ষ বৃদ্ধির ক্ষমতা লাভ করে, মূলের শক্তির জোরেই ডালপালাগুলো
চতুর্দিকে প্রসারিত হয়, এর দৃশ্যকে মনোরম করে তোলে আর সমৃদ্ধ করে তাকে
ফলে-ফুলে। এতে কখনো বসন্ত বা সুসময় আসবে তাতেই বা ক্ষতি কি? কিন্তু ধর্মের
হেফাজতকারীগণ মূল রশিকে হাতছাড়া করেন না। প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে সচেষ্ট
থাকেন। জাহেরপন্থীগণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেও এ ব্যাপারে নি®ীŒয় থাকে না।
ফিকাহ্র কিতাব ও নীতিগ্রন্থ ধর্মের কল্যাণে উদ্ভাবিত ছোট বড় নতুন নতুন কথা ও
কাজ তথা নামাজের মৌখিক প্রয়োজনীয়তা অজুর সময় কান ও ঘাড় মুসেহ্ করা, ঈদগাহে
মিম্বর তৈরি করা, মসজিদ সাজানো ইত্যাদি ধর্মের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং ধর্মের
সৌন্দর্য বাড়ায়, এমন সব বিষয়ে আত্মনিমগ্ন রাখে। তাতে ধর্মের কোনো ক্ষতি
নেই বরং ধর্মের সৌন্দর্য বাড়ে। আমাদের নবী (সাঃ) ন্যায়ের খাতিরে তথা ভালোর
জন্য অনেক ব্যবস্থা পরিবর্তন করেছেন যাকে মানসুখ বা রহিত বলা হয়। এ নীতিতেই
রাজা-বাদশাহদেরও রাষ্ট্রের আইন রদ বদল হয় এবং সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন
প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে মৌলভী খান বাহাদুর সাহেবের প্রণীত আইন কোনো
অংশেই খারাপ নয়। কিন্তু ইসলামী শাসকদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে শক্তিশালী
রাজপুত্রই রাজা হয়, শক্তির জোরে। এ জবরদস্তিমূলক কাজের দরুন ইসলামি
রাষ্ট্রের সর্বদাই অধঃপতন হচ্ছে আর সব সময়ই যুদ্ধ লেগে রয়েছে। অন্যান্য যে
সব দেশে চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ধারাবাহিক পদ্ধতিতে যে নেতা নির্ধারিত হয়
সে-ই নেতৃত্ব করে, কেউই এ নিয়ম ভঙ্গ করতে পারে না। এ জন্য সেসব দেশে কোনো
গোলমাল ও কলহ নেই। সুতরাং আমাদেরও এ নিয়ম করা উচিত যে পিতৃগোষ্ঠি বা
সন্তানদের মধ্যে মুরব্বি ব্যক্তি ধারাক্রমিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব লাভ করবেন।
যদিও তিনি বিশেষ জ্ঞানী না হন তা হলেও জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত, তার অনুগত হয়ে
কাজ সমাধা করা। আর এটাই আমাদের দেশের নিয়ম। এতে ধর্মের কোনো ক্ষতি নেই।
কিছু না বুঝে ধর্মের নামে জেহাদ ও গোলমাল সৃষ্টি করা উচিত নয়। জেহাদ নাম
দিলেই তা ফরজ হয়ে যায় না, জেহাদ ফরজ হওয়ার কতিপয় শর্ত রয়েছে। হয়তো আজ
পর্যন্ত অনেকে তা জানেই না। এ জেহাদের ফলেই মুসলিমদের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে
গেছে। কেবল জাহেরপন্থী আলেমগণের ফতুয়ার ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করা
উচিত নয়। রাজ্য শাসনের জ্ঞান ভিন্ন জিনিস। যে ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারী
তাকে সে ধর্ম থেকে বিচ্যুত করা রাষ্ট্রের পক্ষে বৈধ নয়। মূর্তিপূজক অথবা
ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তির প্রতি তার আইন অনুযায়ী ন্যায় বিচার করা উচিৎ। যে
ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারী, সে ধর্ম অনুযায়ীই তার চালচলন হবে, আর এ
ব্যাপারে কেউ সহযোগিতা চাইলে তাকে সহযোগিতাও দিতে হবে। অন্যথায় অধঃপতন
অবশ্যম্ভাবী এবং রাজত্বে মহাসংকট দেখা দিবে। দ্বীনদার ব্যক্তির উচিত কৌশলে
স্বীয় ধর্মের প্রচার করা যাতে তার ধর্মের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য নষ্ট না হয়।
ওয়াজকারী ও ফতুয়া দানকারীর সংযতভাবে কথাবার্তা বলা উচিত। যা মুখে আসে তা-ই
বলা উচিত নয়। তাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, কোরান ও হাদিসের জ্ঞান কেবল
গ্রন্থ পাঠে হয় না বরং তা প্রকৃত সত্য জ্ঞান ও হেকমতের ওপর নির্ভরশীল।
উদাহরণস্বরূপ,
জাহেরপন্থীগণ পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীর দূরত্ব ও প্রশস্ততা সম্পর্কে বলে থাকে
যে, পৃথিবীর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পাঁচশত বছরের পথ এবং পৃথিবী থেকে প্রথম
আকাশের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ এবং প্রতিটি আকাশের ঘনত্বও পাঁচশত বছরের পথ।
অনুরূপভাবে সাতটি আকাশের প্রত্যেকটির দূরত্ব ও ঘনত্ব পাঁচশত বছরের পথ।
বস্তুত পৃথিবীর প্রথম স্তর, যেখানে আমাদের বসবাস, তা প্রথম আকাশের
মধ্যবর্তী স্থানে ঝুলন্ত। সুতরাং দেখা যায়, পৃথিবী থেকে প্রথম আকাশের
দূরত্ব উপরের দিক থেকে পাঁচশত বছরের এবং নিচের দিক থেকেও পাঁচশত বছরের পথ
আর পৃথিবীর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ঘনত্ব প্রত্যেকটি পাঁচশত বছরের পথ। অতএব
পৃথিবীর মোট দূরত্ব দাঁড়াল পনেরো শত বছরের পথ। এমতাবস্থায় কী করে এক আকাশ
থেকে অপর আকাশের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ হয়? প্রথম আকাশটি পরিধিই তো হল
পনেরো শত বছরের পথ। বস্তুত প্রথম আকাশটি দ্বিতীয় আকাশের অভ্যন্তর ভাগে
অবস্থিত এবং দ্বিতীয় আকাশের তুলনায় অতিশয় ক্ষুদ্র। দ্বিতীয় আকাশটি তৃতীয়
আকাশের তুলনায় আরও ক্ষুদ্র। অনুরূপভাবে, প্রত্যেকটি ঊর্ধ্বাকাশ দূরত্ব ও
ঘনত্বে প্রত্যেকটি নিম্নাকাশ অপেক্ষা অতি বৃহৎ। এমতাবস্থায় বৃহৎ ও ক্ষুদ্র
নির্বিশেষে সকল আকাশের দূরত্বই পাঁচশত বছরের পথ এটা কেমন কথা? আক্ষেপ!
মুসলিম সম্প্রদায় এমনি চালাক ও জ্ঞানী হয়েছে যে, একটি সাধারণ কথাও তারা
বুঝতে পারে না। এজন্য প্রত্যেকেরই ইল্মে হেকমত বা বিজ্ঞান শিক্ষা করা অবশ্য
কর্তব্য, এটা কোরান দ্বারা প্রমাণিত। ইল্মে হেকমত. বাংলাভাষা প্রভৃতি যা
বিশেষ প্রয়োজনে আসে এবং যে সবের কারণে ইহ ও পরকালীন কল্যাণ অর্জিত হয় তা
আয়ত্ত করা প্রয়োজন। অন্যথায় অমূলক কথাবার্তা বলে জ্ঞানীদের নিকট বোকা সাজতে
হয়।
দুনিয়াদার আলেমের পরিচয়
হযরত হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গায্যালী
(রহঃ) ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদেরকে দুনিয়াদার আলেম শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করেছেন।
কারণ তারা কেবল হারাম, হালাল, বৈধ, অবৈধ প্রভৃতি বাহ্যিক বিষয়াদির
আলোচনাতেই লিপ্ত থাকেন। এরা বাদশাহ্ ও তলোয়ারধারীদের মতো। বাদশাহ্ তার
রাজত্ব আর যুদ্ধবিজয়ী গাজী তার তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত; পরকাল সম্পর্কে অজ্ঞ
লোকদের শাসন করার জন্য দৃঢ় সংকল্প এবং এটাকেই তারা ধর্ম ও পরকালের কর্ম মনে
করে।
প্রকৃতপক্ষে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) উক্ত জাহেরপন্থীদেরকে অন্তরের
রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তিকে ইসলামের কলেমা পাঠ করা
সত্ত্বেও হত্যা করা হয় এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-কে যুক্তি দেখানো হয় যে, সে
তলোয়ারের ভয়ে কলেমা পাঠ করেছিল। তখন হযরত (সাঃ) সে হত্যাকারীকে জিজ্ঞেস
করেছিলেন, তুমি কি তার অন্তর ভেদ করেছিলে? অর্থাৎ তুমি কি তার হৃদয় চিরে
দেখেছিলে যে, সে অন্তর থেকে কালেমা পাঠ করে নি? ফকীহ্ তথা আইনবিদ তলোয়ারের
আশ্রয়েই ইসলামের বিশুদ্ধতা নিরূপণ করে। অথচ সে জানে যে, তলোয়ারের সাহায্যে
সকল সন্দেহ দূর করা যায় না বা সন্দেহ দূর হয় না এবং তলোয়ারের সাহায্যে
অন্তর থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণও সম্ভব নয়। তবুও যে ব্যক্তি মুখে কলেমা
পাঠ করে না সে ব্যক্তিকে তারা হত্যার নির্দেশ দেয়। অপরদিকে তাদের হস্ত
যুদ্ধসম্পদের দিকে প্রসারিত। কিন্তু কোনো ব্যক্তি মৌখিক কলেমা পাঠ করে
আইনবিদের আদেশে দুনিয়াতে তার জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে পারে। যতদিন সে জীবিত
থাকবে কলেমার বদৌলতে দুনিয়াতে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ থাকবে এবং কেউই তার
প্রতিবাদ করবে না। তাইতো মহানবী (সাঃ) বলেন, ان افاق الناس حتى يقول لا
اله الا الله فاذا قالوا فقد عصموا من دماء هم وامو الهم (ইন্না
আফাকান্নাছা হাত্তা ইয়াকুলা লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ফাইজা ক্বালু ফাক্বাদ্
আসামু মিন্ দামায়াহুম ওয়া আম্ওয়াল্হুম) অর্থাৎ, “আমরা লোকের সাথে হানাহানি
করব যতক্ষণ তারা কলেমা পাঠ না করে, যদি কলেমা পাঠ করে তা হলে তাদের ধন
প্রাণ রক্ষা করতে হবে। উক্ত হাদিস দ্বারা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) মৌখিক কলেমার
উপকারিতা জীবন ও সম্পদের হেফাজত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু
পরকালের ব্যাপারে মৌখিক কলেমার কোনোই কার্যকারিতা নেই। অন্তরের বিশুদ্ধতা,
বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রই পরকালের কার্যকর এবং এ আন্তরিক কার্যাদি ফিকাহ্ বা আইন
শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। যদি কোনো আইনবিদ কর্তৃক মানসিক কার্যাদির
আলোচনা করা হয়, তবে তা হবে কথা শাস্ত্র ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোচনার মতোই।
কারণ এটা তার ফিকাহ্ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি
যদি বাহ্যিক শর্তাদি মোতাবেক নামাজ সম্পন্ন করে আর তার মনে একাগ্রতা না
থাকে এবং নামাজরত অবস্থায় সে তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে
ভাবতে থাকে, তাহলে ফেকাহ্বিদ বলবে যে, তার নামাজ ঠিক হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ
নামাজের কোনোই কার্যকারিতা নেই। যেমন মৌখিক কলেমা পাঠের পরকালীন কোনো মূল্য
প্রকৃত ইসলামের মধ্যে নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জাহেরপন্থী আইনবিদ যথার্থতার
ফতুয়া দিবে, এই অর্থে যে, মৌখিক স্বীকার উক্তি দ্বারা তার হুকুম তামিল করা
হয়েছে। তাই তাকে হত্যা করা ও শাস্তির আদেশ বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু মনের
একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা যা পরকালের কাজ, তা যদিও হয় নি। যে সব কাজে জাহেরি
কর্মের প্রকৃত সাফল্য ও কার্যকারিতা নির্ভর করে ফিকাহ্শাস্ত্র সে সব বিষয়
নিয়ে মাথা ঘামায় না। যদিও সেসব বিষয়ে আলোচনা করে, তবে তাহলেও সে সব আলোচনা
ফিকাহ্ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে, যাকাত সংক্রান্ত আইন দ্বারা
ফিকাহ্বিদদের উদ্দেশ হল সরকারি আইন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা। কেউ যদি বাহানা
করে যাকাত দিতে অস্বীকার করে এবং সরকার তাকে গ্রেফতার করে, তাহলে ফিকাহবিদ
হুকুম দিবে যে, তার ওপর যাকাত প্রযোজ্য নয়। বর্ণিত আছে যে, কাজী আবু ইউসুফ
বৎসরের শেষে নিজ সম্পদ স্ত্রীকে হেবা করে দিতেন এবং তার সম্পদ নিজের নামে
হেবা (দানপত্র) করে নিতেন। আর এভাবে তিনি যাকাত এড়িয়ে চলতেন। এটা হলো
জাগতিক আইনের বাহানা। কিন্তু পরকালের বিচারে এটা জঘন্যতম পাপ। এ কারণে
জাহেরি শাস্ত্রের ইমাম হযরত সূফীয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন যে, বাহ্যিক জ্ঞান
অর্জনে পরকালের সম্বল লাভ হয় না। হুজ্জাতুল ইসলাম ‘এহিয়াউল উলুম’ গ্রন্থে
লিখেছেনÑ যখন থেকে গ্রন্থাদি রচনা শুরু হয় এবং যুদ্ধবিগ্রহ ও ব্যবহারিক
বিষয়ে অধিক পরিমাণে নিষ্ফল গবেষণা আরম্ভ হয়, মানুষ কাহিনী ও ওয়াজের দিকে
আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, তখন থেকেই “ইলমে ইয়াকীন” তথা প্রকৃত জ্ঞান লুপ্ত হতে থাকে।
হৃদয়ের জ্ঞান, নফ্সের গুণাবলির জ্ঞান ও শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ
করা অনেকের কাছে অদ্ভুত মনে হয় এবং মাত্র কয়েকজন ব্যতীত সকল লোকই তা বর্জন
করে। বর্তমানে যারা তর্ক-বিতর্ক করতে পারে অথবা ওয়াজের সময় রসালো করে
কাহিনী বলতে পারে বা ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে, তাদেরকে আলেম বলা হয়। এর
কারণ হচ্ছে শ্রোতারা অধিকাংশই সাধারণ মানুষ এবং মারেফত সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা
জানে না যে, প্রকৃত জ্ঞান কোনটি। তারা সাহাবাদের কার্যক্রম ও জ্ঞান
সম্পর্কেও অজ্ঞ। তা না হলে, এরা তাদের কার্যক্রম থেকে বুঝতে পারত অথবা
স্বীয় মুর্শিদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারত এবং ওয়াজের ভিতর কোথায় তাদের
ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে, তারা তাও বুঝতে পারত। তারা উপলব্ধি করত যে, যে জ্ঞানে
বাতেনী জগতের শিক্ষা নেই, সে জ্ঞান বৃথা আর পরিচিত হত তারা সে সব বক্তব্যের
সাথে যেগুলোকে বর্তমান যুগে সাধারণভাবে মানুষ পরকালের সম্বল মনে করছে এবং
তারা তা পরিহার করত। হযরত ইব্নে মাসউদ (রাঃ) ঠিকই বলেছেন যে, “তোমরা এমন
যুগে আছ যেখানে বিবেক জ্ঞানের অধীন এবং তোমাদের ওপর এমন এক দিন আসবে যখন
জ্ঞান বিবেকের অধীন হবে।” মালেক বিন আনাস (রাঃ) বলেন, “অতীতে সাধারণ মানুষ
আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং স্রষ্টার রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইত এবং আলেম সমাজ
হারাম-হালাল বর্ণনা করতেন না, কিন্তু বর্তমানে হারাম-হালালের চর্চাই করা
হয়।” অতএব যে সব ফিকাহ্বিদ আধ্যাত্মিক রহস্যাদি সম্পর্কে অজ্ঞ তারাই
দুনিয়াদার আলেম। দুনিয়াদার ব্যক্তি যেমন দুনিয়ার কাজকর্ম ও হিসাব-নিকাশ
নিয়ে ব্যস্ত থাকে, জাহেরপন্থী আলেমও তেমনি জাগতিক বিষয়াদি আলোচনায় সদা
লিপ্ত থাকে। তাই জাহেরি আলেমও দুনিয়াদারদের অন্তর্ভুক্ত। আধ্যাত্মিক ও
আখেরাতের জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার কারণেই সাহাবাগণ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী
হয়েছিলেন, কালামশাস্ত্র অথবা ফিকাহ্শাস্ত্রের জ্ঞানের জন্য তাঁরা উচ্চ
মর্যাদার অধিকারী হন নি। তাই আল্লাহ্্ তায়ালা কোরানে বলেন,الذين جاهدو
افينا لنهد ينهم سبلنا وان الله مع المحسنين (আল্লাজিনা জাহাদু ফীনা
লানাহ্- দিয়ান্নাহুম্ সুবুলানা ওয়া ইন্নাল্লাহা মাআল মুহ্সিনীন্)
অর্থাৎ,“যারা আমাকে জানার জন্য চেষ্টা করেছে, অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার সকল
পথ প্রদর্শন করেছি এবং আল্লাহ্্ নিশ্চয় কল্যাণকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।”
অর্থাৎ, আল্লাহ্ মৌল সত্তা যা সকল গুণের উৎস, একে জানাই আসল জ্ঞান এবং এ
জ্ঞান লাভের জন্য যে চেষ্টা করে তাকেই আল্লাহ্্ তাঁর পথের দিশা দেন।
ফিকাহ্শাস্ত্র অথবা কালামশাস্ত্র কিংবা তর্কবিদ্যা দ্বারা সে পথ পাওয়া যায়
না, এ জন্য অধ্যাত্মজ্ঞান অপরিহার্য। এ অধ্যাত্মজ্ঞানের কারণেই সাহাবাগণ
সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম বলেন, “সাহাবাদের উচ্চ
মান ও মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা উদাসীন হয়ো না, তোমরা যাদের কথা বলছ,
সাহাবাদের মর্যাদা তাদের সকলের উপরে। ধর্ম বিষয়ে তাঁদের মতো জীবন যাপন করা
কারও পক্ষে সম্ভব নয়, কেউ তাঁদের কাছেও পৌঁছুতে পারবে না।” প্রকৃতপক্ষে
তাঁদের এ মর্যাদা কালাম শাস্ত্র ও ফিকাহ্শাস্ত্রের কারণে হয় নি বরং পরকালের
জ্ঞান এবং তদনুযায়ী পথ চলার দরুনই তাঁরা এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হযরত
আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) সকলের ওপর মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। এর কারণ এ নয় যে,
তিনি অধিক রোজা রাখতেন বা অধিক নামাজ পড়তেন অথবা অধিক রাওয়ায়েত করতেন অথবা
অধিক ফতুয়া দিতেন বা তর্ক-বিতর্ক ও কালামশাস্ত্রে অধিক চর্চা করতেন বরং
তাঁর বক্ষে নিহিত বস্তুই এ মর্যাদার কারণ। “উক্ত রহস্যের অনুসন্ধানে
তোমাদেরও আগ্রহী হওয়া উচিত।” মহানবী (সাঃ) এর বাণীও তাই প্রমাণ করে। তিনি
বহু সাহাবি রেখে গেছেন, যারা আল্লাহ্্প্রেমে, অধ্যাত্মজ্ঞানে অদ্বিতীয়
ছিলেন। রাসূল (সাঃ) নিজে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মধ্যে দশ জন ছাড়া
আর কেউই জাহেরি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। তবে তাঁরা নিজেরা কখনো ফতুয়া
দিতেন না। হযরত ইব্নে উমর (রাঃ)-এর নিকট কেউ ফতুয়ার জন্য গেলে তিনি অন্য
বিচারকের নিকট পাঠিয়ে দিতেন। হযরত উমর (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর হযরত ইব্নে
মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, জ্ঞানের নয়-দশ ভাগই মরে গেছে। লোকে প্রশ্ন করল, আপনি
কী করে এ কথা বলছেন? আমাদের মধ্যে তো বড় বড় সাহাবি এখনও রয়েছেন। তিনি উত্তর
দিলেন যে, আমি ফতুয়া এবং আইন-কানুন সংক্রান্ত জ্ঞানের কথা বলি নি। আমি
আল্লাহ্্র জ্ঞান তথা ফানা ও বাকাহ অর্থাৎ আল্লাহ্্তে বিলীন ও অধিষ্ঠান যা
নবী অলীদের প্রকৃত উত্তরাধিকার সে জ্ঞানের কথা বলেছি। বস্তুত হযরত উমর
(রাঃ) তর্ক-বির্তকের পথ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘এহিয়াউল উলুম’
গ্রন্থে এর বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুচার কথা লেখা হল।
মোট
কথা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জাহেরি বিদ্যা অর্থাৎ ফতুয়া ও আইন কানুন
সংক্রান্ত জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। এ বাহ্যিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি
করে কোনো নবী বা রাসূল পথ প্রদর্শকরূপে আবির্ভূত হননি। আল্লাহ্্ তায়ালা
স্বয়ং ঘোষণা করেন,هو الذى بعث فى الا مين رسولا منهم يتلوا عليهم ايته
ويزكيهم ويعلم هم الكتاب والحكمة (হুয়াল্লাজি বা,আছা ফিল উম্মিয়ীনা
রাসূলাম্ মিন্হুম্ ইয়াত্লু আলাইহিম্ আইয়াতিহি ওয়া ইউজাক্কিহিম্
ওয়াইউআল্লিমু হুমুল্ কিতাবা ওয়ালহিক্মাহ্) “অর্থাৎ, আল্লাহ্্ তায়ালা, যিনি
তাদের নিরক্ষরদের মধ্য থেকে তাদের জন্য রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁরা তাদের
কাছে তাঁর নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেন এবং তাঁদের শুদ্ধিকরণ করেন আর তাদেরকে
কিতাব ও বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দেন।” অসৎ আলেমদের জন্য কঠোর সতর্ক বাণী রয়েছে,
কিয়ামতের দিন তাদেরকে সকলের চেয়ে অধিক শাস্তি প্রদান করা হবে। সুতরাং অসৎ
আলেমদের পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। এখানে অসৎ আলেম বলতে সে-সব
বাহ্যিক দুনিয়াদার আলেম বোঝানো হয়েছে, যাদের জ্ঞনের উদ্দেশ হল জাগতিক
মর্যাদা ও সম্মান লাভ করা। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে আলেম তার জ্ঞান থেকে
উপকৃত হয় নি, কেয়ামতের দিন তার শাস্তি সবচেয়ে বেশি হবে। রাসূল (সাঃ) আরও
বলেছেন, যে আলেম স্বীয় জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করে না, বস্তুত সে আলেম বা
জ্ঞানীই নয়। অন্যত্র তিনি বলেছেন, العلم علمان علم على اللسان فذللك حجة
الله تعلى على ابن ادم وعلى القلب فذلك علم النافع (আল্ ইলমু ইল্মানে,
ইল্মুন্ আলাল্ লিছানি ফাজালিকা হুজ্জাতুল্লাহি তা’আলা আলা ইব্নি আদামা
ওয়াআলাল্ কাল্বি ফাজালিকা ইল্মুন্ নাফি’) অর্থাৎ, “জ্ঞান দু প্রকার।
প্রথমত, মৌখিক জ্ঞান, যা মানুষের কাছে আল্লাহ্্র প্রমাণপত্র, দ্বিতীয়ত,
কাল্ব বা অন্তরের জ্ঞান, এটাই কল্যাণের জ্ঞান”। ইমাম তিরমিজি খতিব হযরত
জাবের (রাঃ) থেকে এ মোরসাল হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করেছেন। প্রকৃত
আলেম আল্লাহ্্ ওয়ালাদের সাথে অহংকার করার, মূর্খদের সাথে তর্ক করার এবং
মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশে জ্ঞান অর্জন করে না। যে এ নিয়তে
জ্ঞান অর্জন করবে সে জাহান্নামী হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের
জ্ঞানকে গোপন রেখেছে, আল্লাহ্্ তায়ালা তাকে অগ্নিশৃঙ্খলে আবদ্ধ করবেন। তিনি
আরও বলেছেন যে, আমি দাজ্জালের চেয়েও যারা দাজ্জাল নয়, তাদের জন্য তোমাদের
ব্যাপারে বেশি শঙ্কিত। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন, তা কী? হযরত (সাঃ) উত্তর
দিলেন, আমি পথভ্রষ্টকারী ইমামদেরকে ভয় করি। এটাই সে যুগ।
বাংলাদেশের এক
শ্রেণীর বে-আমল আলেম ধর্মকর্মহীন জনসাধারণের ইমাম হয়ে গেছে এবং তারা অমূলক
কথার দ্বারা হৃদয় সংক্রান্ত বিষয় থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত বাহ্যিক
অনুষ্ঠানপ্রিয় সাধারণ মানুষকে নিজেদের ভক্তে পরিণত করেছে। কোনো এক সুযোগে
ইমামগণ বাংলার গরিব মানুষের ওপর তাদের বাহু বিস্তার করে। অতঃপর অন্ধ, মূক ও
বধির সকলেই সে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে অন্ধ আরও অন্ধ হয়ে গেছে,
বধির হয়েছে আরও বধির এবং মূক হারিয়েছে তাদের অবশিষ্ট বাক্শক্তি। বর্তমানে
তারা এমন পাকা প্রাণহীন ইবাদতকারী, সূফী, মুত্তাকি এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী
আলেম হয়ে গেছে যে, তারা প্রশংসা ও তাক্লীদ বা আনুগত্যেও চিন্তা ছাড়া অন্য
কিছুই ভাবতে পারে না। এ জন্যই হযরত উমর (রাঃ) বলেছেন, “এ উম্মতের মধ্যে
মুনাফিক আলেমকে আমি বেশি ভয় করি।” লোকে প্রশ্ন করল, মুনাফিক আলেম হয় কি
করে? উত্তর দিলেনÑ “মৌখিক আলেম অন্তর ও কাজের বিচারে সে জাহেল ও মূর্খ।
হযরত সূফীয়ান ছাত্তারী (রহঃ) বলেছেন, জ্ঞান তার প্রয়োগ চায়, জ্ঞান প্রয়োগ
না করলে সে জ্ঞান লোপ পায়।” ইব্নে মুবারক (রহঃ) বলেন, “ব্যক্তি যতক্ষণ
জ্ঞানের সন্ধানে থাকে ততক্ষণই সে জ্ঞানবান থাকে, যখন সে নিজেকে জ্ঞানী বলে
ভাবে তখন সে অজ্ঞান ও মূর্খ হয়ে যায়।” অজ্ঞতা ও বিস্মৃতি থেকে মুক্ত থাকার
নাম জ্ঞান। কোনো লোক বিস্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হলে সে আলোহীন প্রদীপের মতো
হয়ে যায়। তাই যে আলেম অপরকে উপদেশ দেয় অথচ সে নিজে উপদেশ গ্রহণ করে না, সে
আল্লাহ্্র নূর থেকে শূন্য, তাওহীদ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এবং
কর্মবিমুখ মৃতপ্রাণ। তার সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন,انا لعالم ليعذب عذابا
لطيف به اهل النار استطاما شعوة عذابه (ইন্নাল আ’লিমা লাইউয়াজ্জাবা আজাবান্
লাতিফুম্ বিহি আহ্লিন নার ইজ্তাতামা শা’ওয়াতা আযাবিহি) “অনুরূপ আলেমকে এতই
কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে যে, তা দেখার জন্য দোযখের অন্যান্য অধিবাসীরা
তার নিকট জড় হবে।” হযরত রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, يوتى بالمعالم يوما القيا مة
فيلقئ فى النار فتنديق افتابه فيدر وبها يدر الحماربالر فيطوف به اهل
النار فيقولن كنت امر با لخير اولدينه والنهى عن الشر واءيه (ইউতা বিল্
আ’লিমি ইয়াওমাল্ ক্বিয়ামাতে, ফা ইউল্কা ফিন্নারি, ফা তান্দিকু অফ্তাবাহু
ফাইয়াদূররু বিহা ইয়াদুররুল হিমারু। বিররাফিতুফা বিহি আহ্লূন্নারি
ফা-ইয়াকূলূনা, কুন্তা আ-মেরান্ বিল্ খাইরি ওয়াদ্-দ্বীয়ানাতি ওয়া নাহা আনিশ্
র্শাওয়াইহি) অর্থাৎ, “কেয়ামতের দিন একদল আলেমকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে,
তাতে তাদের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে এবং তাদেরকে গাধার মতো ঘোরানো হবে আর
দোযখের অধিবাসীরা বলবে, তোমরা কি নিজেরা কাজ না করে অন্যকে উপদেশ প্রদান
করেছ?” বোখারী এবং মুসলিম আলেম শব্দের পরিবর্তে রাজুল তথা ব্যক্তি শব্দ
ব্যবহার করে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এ অর্থেই আল্লাহ্্ তায়ালা কোরান পাকে
ঘোষণা করেছেন, اتامر ون الناس بالبر وتنسون انفسكم (আতা’ মুরুনান্নাসা
বিল্-র্বিরি অতান্সাওনা আন্ফুসাকুম) অর্থাৎ “তোমরা কি অপরকে সৎকাজের
নির্দেশ দিচ্ছÑ অথচ নিজেদের কথা ভুলে গেছ?” এ কারণে আল্লাহ্্ পাক বলেন, ان
المنا فقين فى الدركـ الاسفل من النار (ইন্নাল্ মুনাফিকীনা ফিদ্দারকিল্
আস্ফালি মিনান্নার) অর্থাৎ, “মুনাফিক দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান পাবে।” এ
জন্যই আল্লাহ্্ পাক তাদেরকে ইহুদি ও নাসারাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর বলে
আখ্যায়িত করেছেন। অসৎ আলেমদের ধোঁকা এবং চাতুরির সংস্পর্শে যাবে না। কারণ
তারা ধর্মের জন্য শয়তানের চেয়েও ক্ষতিকর। শয়তান তাদের সাহায্যেই মানুষের
মনে ন্যায় ও সত্য সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করে। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি যদি
দুনিয়ার সব কিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে আল্লাহ্্ এবং রাসূল (সাঃ) এর সন্তুষ্টি
এবং পরকালের মুক্তির আশায় জিকির ও মোরাকা’বা করেÑ তার পথে যে বাধার সৃষ্টি
করে বা বাধা দেয়, সে ব্যক্তিই শয়তানের কাজ করছে। কারণ সে ভালো কাজকে মন্দ
কাজের সাথে মিশিয়ে হালালকে হারাম করে দিচ্ছে এবং নবুয়তের পথকে ইবলিসের পথে
রূপান্তরিত করে সে নিজেই ইবলিসের পথ গ্রহণ করছে (আল্লাহ্্ ক্ষমা করুন)।
বস্তুত সে দোযখকেই বেহেশ্ত মনে করছে। রাসূল (সাঃ)-কে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন
করেন, হে আল্লাহ্্র রাসূল (সাঃ)! সবচেয়ে নিকৃষ্ট চরিত্র কোনটি? “আল্লাহ্্
তুমি ক্ষমা কর” বলে রাসূল (সাঃ)-এর জবাব দিতে অস্বীকার করেন। বার বার
প্রশ্ন করার পর রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন যে, “অসৎ আলেম।”
অসৎ আলেমের
পরিচয় প্রথমেই বর্ণনা করা হয়েছে। অসৎ আলেম সে-ই, যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও
প্রকৃত বিশ্বাস থেকে বঞ্চিত, যদিও অন্যান্য বিষয়ে তার কিছু কিছু জ্ঞান
থাকে। হযরত ইমাম গায্যালী (রহঃ) তাঁর ‘এহিয়াউল উলুম’ গ্রন্থে লিখেছেন, জনৈক
শাইখ কোনো এক আলেমকে স্বপ্নে জিজ্ঞেস করেছেন, “যে জ্ঞানের সাহায্যে তোমরা
ঝগড়া ও তর্ক-বিতর্ক করতে, সে জ্ঞানের অবস্থা কী? আলেম হাত উন্মুক্ত করে
তাতে ফুঁক দিয়ে বলে যে, “সে সব জ্ঞান এমনি ধূলার মতো উড়ে গেছে।” হাদিস
শরীফে আছেÑ ما اضل قوم بعد هدئ كانوا عليه الا اوتو الجد ال ثم قرأ ما مربه
لك الاجدا لابل هم عضمون (মা আদাল্লা কাউমুম্ বা’দা হুদা কানু আলাইহি
ইল্লা উতুল্ জিদালা ছুম্মা কারাআ মা র্মারা বিহি লাকা ইল্লা জিদালা বাল্হুম
আদামুন) অর্থাৎ, “হেদায়েত লাভের পর কেউই পথভ্রষ্ট হয় না, কিন্তু তাদের
মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তারা পথভ্রষ্ট হবে।” তাই কোরান পাকের উপদেশ হলো-
هم اهل الجدال الذين عناهم الله تعا ائ يقوله واحذرهم ان يفتنوك (হুম
আহ্লুজ্ জিদালিল্লাজিনা আন্নাহুমুল্লাহু তায়ালা ইয়াকুলাহু ওয়াহ্জার হুম্
আইয়্যাঁফতানুকা) অর্থাৎ, “যারা তোমাদেরকে ঝগড়ার দিকে ডাকে, তোমরা তাদের
পরিহার কর, তাদের কাজই হল ঝগড়া বাঁধানো।” তিরমিজি শরীফে আছে এবং কোনো
বুজুর্গও বলেছেন যে, “শেষ যুগে এমন একদল লোক হবে যাদের জন্য আমলের পথ বন্ধ
হয়ে যাবে আর ঝগড়ার পথ খুলে যাবে।” কোনো কোনো হাদিস শরীফে আছেÑ “আমরা এমন
যুগে রয়েছি যখন কাজের ইলহাম হচ্ছে এবং অচিরেই এমন একটি সম্প্রদায় হবে যাদের
মন ঝগড়ায় পরিপূর্ণ থাকবে। বোখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে, بعض الخلق الى
الله تعالي الد الخصيم (বা’জুল্ খাল্কে ইলাল্লাহি তায়ালা আলাদ্দুল্ খাছিম)
অর্থাৎ, “ঝগড়াকারী আল্লাহ্্র বড় দুশ্মন।” তাই আল্লাহ্ কোরান পাকে ঘোষণা
করেছেনÑ من يجادل فى الله بغير علم فهو يتبع كل شيطان مريد (মাইউজাদিলু
ফিল্লাহি বিগাইরি ইল্মিন্ ফাহুয়া ইয়াত্তাবিউ কুল্লা শাইতোয়ানিম্ মারীদ)
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্্র সত্তা সম্পর্কে অর্থাৎ ফানাফিল্লাহ্র এবং
বাকাবিল্লাহ্র বিষয়ে ঝগড়া করে অথচ সে এ বিষয়ে কিছুই জানে না, সে বড় অবাধ্য
শয়তানের মুরিদ বা অনুসারী।” এখানে লক্ষণীয় যে, না জেনে কোনো একটি ক্ষুদ্র
বিষয়েও কোনো প্রকার মতামত প্রদান করা হারাম, তা যদি সঠিকও হয়। আর যদি ভুল
হয় তা হলে তো কথাই নেই। এর জবাব কী? কোনো ক্ষুদ্র বিষয়ের ব্যাপারে না জেনে
কথা বলা যখন হারাম তখন কিছুই না জেনে তাওহীদ সম্পর্কে কথা বলা কী করে বৈধ
হতে পারে? তাওহীদপন্থী, তাওহীদের ভিতরে হাবুডুবু খেয়ে প্রকৃত মাবুদের সাথে
যুক্ত ও একাত্ম, তাঁর সংস্পর্শে সে দুনিয়ার সব কিছু থেকে বিমুখ, আর নিজের
মাবুদ ছাড়া অন্য কিছুই তাঁর খেয়ালে নেই। প্রকৃতপক্ষে তাওহীদপন্থী জিকির ও
ধ্যানে সদা মশগুল থেকে বিভিন্ন অবস্থার জ্ঞান ও পরিপূর্ণ সত্তার সাক্ষাতে
লিপ্ত এবং নিমজ্জিত। সেখানে নফ্স ও শয়তান বিধ্বস্ত, কুফরি ও মুনাফেকী
পর্যুদস্ত। এখানে রয়েছে আল্লাহ্্র জিকির এবং জিকিরকারীদের বিভিন্ন অবস্থা। এ
জিকির মুনাফিকদের ওপর কঠিন আঘাতস্বরূপ এবং জিকিরকারীদের মগ্ন অবস্থার
আকর্ষণ ও তেজষ্ক্রীয়তা এবং মুর্শিদের ধ্যানপ্রভাব জাহেরপন্থীদের জন্য
মরণবিষতুল্য। হারাম, র্শিক প্রভৃতি অন্যায় কাজ থেকে মানুষ যেভাবে বিরত
থাকে, এ জাহেরপন্থীরাও তেমনি জিকির এবং ধ্যান তথা আধ্যাত্মিক সাধনা থেকে
বিরত থাকে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্্ বলেন, ومن يمش عن ذكر الر حمن تقيد له
الشيطانا فهوله قرين وانهم ليصدون هم عن السبيل ويحسبون انهم مهتدون (অ মাই
ইয়াই’শু আন জির্ক্রি রাহমানি নুক্বাইয়্যেদ লাহুশ্ শাইতোয়ানা ফাহুয়া লাহু
কারিনুন্ অ আন্নাহুম লাইউছুদ্দুনা হুম আনিস্সাবিলি অইয়াহসাবুনা আন্নাহুম
মুহ্তাদুন) অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্্র জিকিরকে প্রত্যাখ্যান করে,
আল্লাহ্্ শয়তানকে তার উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন। শয়তান তার সাথীকে সৎপথ
থেকে দূরে রাখে অথচ তারা মনে করে যে, তারা ঠিক পথেই রয়েছে।” অতএব যার ওপর
শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, জিকিরের প্রতিক্রিয়া তার জন্য কঠিন
আঘাতস্বরূপ তো হবেই। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, “জিকির শুনলে শয়তান
জিকিরকারীর কাছ থেকে পলায়ন করে আবার যখন জিকির ভুলে যায় তখন শয়তান তার নিকট
আসে এবং প্ররোচনা দেয়।” সুতরাং জানা গেল যে, আল্লাহ্্র জিকির দ্বারা অন্তর
পরিষ্কার হয় এবং শয়তান ও নফ্সের ধ্বংস হয়। তাই শয়তান জিকির শুনলে
জিকিরকারীদের প্রাণের শত্রু মনে করে। সুতরাং যে শয়তান ও নফ্সের অধীন সেও
শয়তানের দলভুক্ত। আল্লাহ্্ তায়ালা সূরা মুজাদালার দ্বিতীয় রুকুতে বলেন,
استحوز عليهم الشيطان فانسهم ذكر الله اولئك حزب الشيطان الا ان حزب
الشيطان هم الخاسرون (ইস্তাহাওয়াজা আলাইহিমুশ্ শাইতোয়ান্ ফাআন্সাহুম
জিক্রাল্লাহি উলাইকা হিজ্বুশ্ শাইতোয়ানি আলা আন্না হিজ্বাশ্ শাইতোয়ানি
হুমুল্ খাসিরুন) অর্থাৎ, “শয়তান তাদের ওপর জয়ী হয়েছে এবং ভুলিয়ে দিয়েছে
তাদেরকে আল্লাহ্্র নাম। অবগত হও যে, তারা শয়তানের সেনাদল এবং তারা অবশ্যই
বিপর্যস্ত।” এ শ্রেণীর লোকেরা আল্লাহ্্র জিকির শুনলে কষ্টতো পাবেই। কারণ
শয়তান তাদের অন্তরে এমন ব্যাধি ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, ভাল কথা তাদের কাছে
অত্যন্ত মন্দ ও বিরক্তিকর মনে হয়। শয়তান বড় জ্ঞানী বটে। কিন্তু বাতেনী
জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এ জন্য জাহেরি বিদ্যার আলেমরাই শয়তানের
অধিকাংশ শিষ্য। এ কারণে অসহায় জনসাধারণই আজ তাদের অনুগত ও অনুসারী হয়েছে।
আল্লাহ্্ভক্ত কোনো লোকই জাহেরি আলেমদের কথায় আখেরাতের সম্বল কখনো ত্যাগ
করেননি।
হযরত মনসুর হাল্লায্ (রহঃ)-কে শূলে চড়ান হয়েছে, হযরত শামস
তিব্রিজি (রহঃ) এর শরীরের চামড়া তুলে নেওয়া হয়েছে, হযরত শীর মাস্ত (রহঃ)-কে
আলমগীরের সময় হত্যা করা হয়েছে, হযরত বু-আলী কলন্দর (রহঃ), হযরত জুন্নুন,
হযরত শাহ্ মাদার, হযরত মানিক পীর, হযরত বাউন পীর, হযরত উস্মান হারুনী, হযরত
হাফেজ সিরাজ, হযরত মঈনউদ্দিন চিশ্তি (রহঃ), হযরত পীরানে পীর দস্তগীর
আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ), হযরত শাইখ আকবর মহিউদ্দীন ইব্নুল আরাবী, হযরত
খাজা নকশবন্দ, হযরত শাহ্ নেয়ামত বিন শকন, হযরত শাহ্ মানেরী ওরফে মানেরী
ফকীর বাঙালী, হযরত শাহ্ ফতেহ্ আলী (রহঃ), হযরত কাশেম শাহ্ এবং শাহ্ আহম্মদ
উল্লাহ্ ইসাপুরী (রহঃ) প্রমুখ এবং তাঁদের অনুসারী সকলকে জাহেরপন্থীরা
কুফরির ফতুয়া দিয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ এর প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেন নি।
শয়তানের অনুসারীরা যে সব ফকীর ও আল্লাহ্্ ওয়ালাদেরকে কুফরির ফতুয়া দিয়েছে
তাঁদের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন কি হযরত গাউছুল আজম (রহঃ) অন্যান্য
বুজুর্গদেরকেও কাফের ফতুয়া দিয়েছে। চিন্তা করা প্রয়োজন, যারা হযরত গাউছে
পাককে কাফের ফতুয়া দিয়েছে, তারা ভালো করেছে না মন্দ করেছে? যদি বল যে, তারা
ভালো করেনি, তাহলে এখন যারা কাফের ফতুয়া দিচ্ছে তাদেরকে কী বলবে? তাই,
আল্লাহ্্ তোমাদেরকে বার বার সতর্ক করে দিচ্ছেন এবং তাদেরকে পরিত্যাগ করতে
বলছেন। আল্লাহ্্ বলেন, وان يكا دالذ ين كفروا ليز لقونك بابصارهم لما سمعوا
الذكر ويقولون انه لمجنون وما هو الا ذكر للعالمين (ওয়াইঁয়্যাকাদুল্লাজিনা
কাফারু লাইউজ্ লিকুনাকা বি আব্সারিহিম্ লাম্মা ছামিউয় লি-যিকরি অইয়াকুলুনা
আন্নাহু লামাজ্নুনা অমা হুয়া ইল্লা জিক্রুল্লিল আলামীন) অর্থাৎ, “সত্য
প্রত্যাখ্যানকারীরা জিকিরের শব্দ শুনলে তোমাদের প্রতি ভ্রুকুটি দিয়ে তাকাবে
এবং বলবে, অবশ্যই সে পাগল হয়েছে। অথচ তা আল্লাহ্্র জিকির ব্যতীত কিছুই
নয়।”
এখন চিন্তা করুন, নবী (সাঃ) জিকির করতেন এবং কোরান শোনাতেন, তখন
কাফেররা তাঁকেও ঠাট্টা করেছে, পাগল আখ্যা দিয়েছে এবং আল্লাহ্্র গজবের
আশঙ্কা সত্ত্বেও কাফেররা নবী (সাঃ)-কে রেহাই দেয়নি। তাহলে আজ তাঁর উম্মতÑ
যারা নবী নয়, কী করে তা থেকে রেহাই পাবে? যদি বলা হয়, বর্তমানে তো সে যুগের
মতো কাফের নেই। উত্তরে বলা যায়, এ যুগে কাফের না থাকলেও সকলেই তো আর
বেহেশ্তে যাবে না। অপর দিকে নবী (সাঃ)-এর যুগটা উত্তম ছিল আর এটা ফেতনার
যুগ। হাদিস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে
কেয়ামত পর্যন্ত যেমন অলী আব্দাল, গাউস, কুতুব ও ভালো মানুষ থাকবেন, তেমনি
কাফের এবং মুনাফেকও থাকবে। তাই কোরান মজীদে বলা হয়েছে, وان يكاد الذين
كفروا (অইঁয়াকাদুল্লা-জিনা কাফারু) অর্থাৎ, “কুফরকারীরা নিকটেই রয়েছে।”
উক্ত আয়াতের সত্যতা কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
নবুয়তের পর বেলায়েতের
ধারা কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং হাশর নশর তথা সর্বদাই বেলায়েত বহাল
থাকবে। যেহেতু কেয়ামত পর্যন্ত বেলায়েতের ধারা চলতে থাকবে সেহেতু আউলিয়াগণও
বেলায়েতের ধারায় কেয়ামত পর্যন্ত থাকবেন, তা বন্ধ হয়ে যাবে না। যেমনই
আল্লাহ্্ওয়ালা থাকবেন, তেমনই কাফের, ফাসেক এবং মুনাফেকও থাকবে। কারণ
বেহেশ্ত যেমন আছে, দোযখও তেমনি আছে; সুতরাং আউলিয়া থাকলে কাফের ফাসেকও
থাকবে। এমনিভাবে একাদিক্রমে যত অলী-আল্লাহ্্ পৃথিবী থেকে পর্দা নিয়েছেন, সে
সঙ্গে তাঁদের সময়ে কাফের-ফাসেকও দুনিয়াতে ছিল। তাই এসব অসৎ ব্যক্তিদের
দ্বারা উক্ত বুজুর্গ ব্যক্তিগণ ফেতনাগ্রস্ত তথা অত্যাচারিত হয়েছেন। স্মরণীয়
যে, মনসুর হাল্লায যখন ‘আনালহক্ব’ বললেন এবং জলসা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন
তখন এ জাহেরপন্থীরাই অলী দরবেশদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। এটা
কোন শরিয়তে আছে যে, এক ব্যক্তি অন্যায় করলে তাকে না পাওয়া গেলে ক্রোধের বশে
অন্যদের ওপর অত্যাচার করতে হবে? অথচ হযরত মনসুর হাল্লায কোনো অন্যায়ই
করেননি। এ আলোচনায় আশেকদের মনে অবশ্যই ব্যথা লাগবে।
মোটকথা, যখন
জাহেরপন্থীরা আল্লাহ্্ ওয়ালাদেরকে কাফের ও মুরতাদ আখ্যা দিতে শুরু করল, তখন
ইব্লিস দেখল যে, সাধারণ মানুষ ফতুয়া ও দলিল প্রমাণের প্রতি যথেষ্ট
আস্থাশীল, তখন সে আলেমের বেশ ধারণ করে। কারণ শয়তান নিজে জাহেরিবিদ্যার
সাগর; সারা পৃথিবীর আলেমদের জ্ঞান শয়তানের জ্ঞানের তুলনায় সাগরের এক বিন্দু
জলতুল্য। এমনিভাবে শয়তান তাদের জাহেরি জ্ঞান বাড়িয়ে দিতে লাগল এবং
আল্লাহ্্র ইশারায় সে জ্ঞান সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। তবে সে জ্ঞান দ্বারা
শয়তানের দুরবস্থার কথাও বর্ণনা করা শুরু হয়। এতে শয়তানের দুটি উদ্দেশ সফল
হয়। প্রথমত, শয়তানের একটি দোষের বর্ণনা করার সাথে সাথে বর্ণনাকারীর শত শত
ত্রুটি প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যথা দোষ বলা এবং যা দোষণীয় তার প্রতি দৃষ্টি
দেওয়া এবং তা এমন যে, মেথর ময়লা পরিষ্কার করতে করতে এমন হয় যে, তার আর কোনো
গন্ধ বোধই থাকে না এবং এ কাজে তার কোনোই অস্বস্তিবোধ হয় না বরং সদা সে এ
কাজে সানন্দে লিপ্ত থাকতে পারে। অনুরূপভাবে দোষের কথা বলতে বলতে তা তাদের
অন্তরে স্থায়ী হয়ে যায়। ময়লা যেমন গ্লাসকে মলিন করে তেমনি এটাও তাদের
অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যেমন পরিমাণের বেশি লবণ কোনো কিছুতে মিশ্রিত
করলে তা মরণবিষতুল্য হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং যারা পরনিন্দাকে
বৈধ মনে করে, তাদের জন্য এ উদাহরণ প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, যার দোষ বর্ণনা করা
হয়, তার সে দোষের সমস্ত পাপ দোষ বর্ণনাকারীর ওপর বর্তায় এবং দোষী সে-পাপ
থেকে মুক্ত হয়ে যায়। তাই শয়তানের সমস্ত পাপ যখন বর্ণনাকারীরা ভাগাভাগী করে
নিয়ে যায়, তখন শয়তান বলে انابرى من عذاب الله (আনাবারিউম্-মিন-আজাবিল্লাহ)
অর্থাৎ, “আমি আমার বন্ধুদের মেহেরবানীতে সমস্ত পাপ থেকে বেঁচে গেলাম।”
এভাবে
শয়তান বহু লোককে পথভ্রষ্ট করে, যাতে তারা তার সহগামী হয়। যদি বলা হয় যে,
আল্লাহ্্ স্বয়ংই তো শয়তানের দোষ বর্ণনা করেছেন। তার উত্তর হলÑ আল্লাহ্্ এবং
তাঁর বন্ধু আপন রহস্য বর্ণনা করেছেন, তোমরা আজও তা বোঝনি। দ্বিতীয়ত,
শয়তানী করার দরুনই আল্লাহ্্ তায়ালা তার অধঃপতনের কথা বর্ণনা করেছেনÑ বিনা
কারণে আল্লাহ্্ শয়তানের কুৎসা করেননি। মনে করুন, যে জায়গায় অপরাধ হয়, শয়তান
যদি তথায় উপস্থিত নাও থাকে এবং সে অপরাধের সংবাদও না রাখে, তাহলেও উক্ত
অপরাধের জন্য শয়তানকে মিছেমিছি দোষী করা কী করে বৈধ হয়! হযরত আদম
শফিউল্লাহর জামানায় তাঁকে সিজ্দা না করার ফলে সে সময়ই শয়তান কাফের হল। তা
হলে হযরত আদম (আঃ)-এর পূর্বে পৃথিবীতে যারা ছিল তারা কেন পাপ করল? সে পাপ
তো শয়তান করাত না বরং তখন সে পাপ থেকে বিরত করাত। এ পাপের জন্যই তাদেরকে
দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। মনে করুন, হিন্দু ও অন্যদেরকে শয়তান
পথভ্রষ্ট করেছে এবং মূর্তিপূজা শিখিয়েছে। তাহলে পূজাকে তারা অবহেলা করে
কেনÑ কেন তারা পূজার সময় নিদ্রা যায় আর কেন তাতে তাদের মন বসে না? এমন কি এ
ব্যাপারে এক পয়সাও খরচ করতে চায় না। লোকে তাদের ধমকায় এবং দান-দক্ষিণা
প্রভৃতি বন্ধ করতে মোটেও তাদের বিবেকে বাধে না। এ সব প্রশ্নের উত্তর কী? এ
প্রসঙ্গে জনৈক কবি বলেন, “হাসি পায় আমার মানুষের কথা ভাবতেÑ অপরাধ করে
নিজে, দোষ দেয় শয়তানকে।”
পীর ও বুজুর্গদের নাম নিজের সঙ্গে বা ঘরে বা
কিতাবে রাখায় বরকত ও উপকার রয়েছে। দরগাহ্ ও খানকা তৈরি করা এবং এর প্রতি
সম্মান প্রদর্শন করা অলী ও ফেরেশ্তাদের সন্তুষ্টি এবং উভয় জগতে শান্তির
বিধায়ক। অলীদের নামে যে শিন্নি ও পশু মানতের প্রচলন রয়েছে তা বহাল রাখায়
দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি লাভ হয়। এ জন্যই এটা না করা নিজের জন্যই
অমর্যাদাকর। অলীদের জন্য মানত করার অর্থ আল্লাহ্্র জন্য মানত করাÑ এর পুণ্য
অলীদের প্রতি পৌঁছে দেওয়াই অলীদের মানত। নিজের মুর্শিদের ব্যবহৃত কোনো
বস্তুকে অমর্যাদাকরভাবে ব্যবহার করা অথবা তাঁর পালিত কোনো পশুকে কষ্ট দেওয়া
দুঃখের ও বিপদের লক্ষণ এবং কারণ। মুর্শিদের সঙ্গে নাফরমানী করা উভয় জগতে
ধ্বংসের কারণ। বুজুর্গদের ছায়া মাড়ানো বিপদের লক্ষণ। নিজ মুর্শিদের এবং
তাঁর সন্তান-সন্ততিদের সম্মান করা এবং প্রত্যেক মৌসুমের শুরুতে নতুন নেয়ামত
নজর দেওয়ার প্রচলন রাখা উভয় জগতে মুক্তির লক্ষণ। এর বিপরীত ক্রিয়াকলাপ
নিজের জন্য ধ্বংসের কারণ। পীরদের অমর্যাদা ও অশ্রদ্ধা করা নিজেরই ক্ষতির
কারণ। আল্লাহ্্র অলীগণ পৃথিবীতে তারকার মতো ঝলসায় এবং আকাশের অধিবাসীগণ সে
ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করেÑ যেমনিভাবে পৃথিবীর অধিবাসীগণ আকাশের তারকার
ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করে। আউলিয়াদের দুঃখ-যাতনা দেওয়া জগতবাসীদের বিপদের কারণ।
রাসূল (আঃ)দের পদচিহ্ন অথবা অলীদের আসন যদি কোনো বৃক্ষের নিচে, মাটি, পাথর
বা অন্য কিছুর উপর পতিত হয় এবং তা যদি পরম্পরায়ও পাওয়া যায়, তবে যে
ব্যক্তি তাকে সম্মান করবে ও ভালো জানবে তাতে তার বুজুর্গি প্রমাণিত হবে। এ
সম্মানকারী হিন্দু কি অন্য সম্প্রদায়ের তাতে কিছুই আসে যায় না।
প্রত্যেক
মুর্শিদের প্রভাবই দৃঢ় তথা শক্তিশালী। বিশিষ্ট মুর্শিদের প্রভাব তড়িৎ পতিত
হয়। মুর্শিদ তিনিÑ যিনি নফ্স তথা আত্মার প্রভাব সম্পর্কে অবহিত। কামেল
তিনিÑ যাঁর ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত। মোকাম্মেল তিনিÑ যিনি অন্যকে কামালিয়াত দান
করতে সক্ষম। যে মুর্শিদ অজিফায় লিপ্ত থাকার নির্দেশ দেন, তিনি আরিফ নন বরং
জাহেদ। তাঁর প্রভাবে বক্ষ প্রসারিত ও আলোকিত হওয়া সম্ভব নয়। তবে, الا ماشاء
الله (ইল্লা মাশাআল্লাহু) অর্থাৎ, “আল্লাহ্্ যাকে যা চাহেন তাঁর তা হতে
পারে।” পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি এর কিছুকেই অস্বীকার করতে পারেন না। এর
অস্বীকৃতি অপক্বতা ও নেয়ামতহীনতার লক্ষণ। মুরিদের ওপর ফায়েজ তথা অদৃশ্য
প্রভাব বিস্তারের জন্য ‘ওয়াইসী’ শক্তির প্রয়োজন। মুর্শিদ যাকে কখনো দেখেননি
তাকেও দূর থেকে তা দান করতে পারেন। আমার মুর্শিদ কিবলা ইন্তেকালের সময় এক
ছেলে এবং এক মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁরা সম্পর্কে ভাই ও বোন। তাঁরা দুজনই অনাথ
ছিলেন। ভাইয়ের নাম সাহেব ফায়েজেমাআব জুব্দাতুল আরেফিন কুদ্ওয়াতুসালেকীন
মিয়া সূফী মোহাম্মদ মোস্তফা সানাউল্লাহ্ তায়ালা। বর্তমানে তিনি কলিকাতা
শহরে সরকারি চাকুরীতে ‘মীর মুন্সি’ পদে অধিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, আমার বোন নিজ
পিতাÑ যিনি ‘ছরিউল আছর’ ছিলেন তাঁর প্রভাবে পূর্ণতার সকল স্তর অতিক্রম করে
একজন সুবিখ্যাত ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না।
তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, এ জন্য আলাদা গ্রন্থের
প্রয়োজন।
এখানে আমার কতিপয় সহপাঠী পীর ভাইয়ের নাম উল্লেখ করছি। তাঁরা
হলেন ঢাকার জনাব মাওলানা শাহ্ ফকীর আমজাদ আলী, হুগলীর জনাব মাওলানা সূফী
শাহ্ গোলাম সুলেমানি ও জনাব মাওলানা শাহ্ আবুবকর সাহেব এবং জনাব মাওলানা
শাহ্ বাকা উল্লাহ (মরহুম মগ্ফুর)। ফরিদপুরের জনাব মৌলভী শাহ্ ওয়াজেদ আলী
সাহেব, চট্টগ্রামের ‘জনাব মুন্সি শাহ্ সোলায়মান ও জনাব হাফেজ শাহ্
ইব্রাহিম। সিলেটের জনাব মুন্সি দিদার বক্স সাহেব ও জনাব মৌলভী মোহাম্মদ
আকবর আলী (মরহুম)। আসামের জনাব মৌলভী আব্দুল খালেক ও জনাব মৌলভী আব্দুল
বারী। চট্টগ্রামের জনাব মৌলভী মোহাম্মদ আব্দুল আলী সাহেব। এ ছাড়া আরও অনেক
ভাই রয়েছেন, যাঁদের নামের পুরো তালিকায় একটি গ্রন্থ হতে পারে।
আমার
জন্মদাতা বুজুর্গ পিতার নাম সূফী সাফি হাজীউল হারমাইন্ শরীফাইন মোহাম্মদ
মেহেরুল্লা সাহেব। তিনি জনাব আখন নিয়ামত উল্লাহ্ সাহেবের অন্যতম সুসন্তান।
আল্লাহ্্ তাঁদের জান্নাতবাসী করুন।
-তামাম শোধ-
No comments:
Post a Comment