সূচি
র্মযিয়াদের শব্দ বিকৃতি আর ওহাবীদের বিকৃত ব্যাখ্যার জবাব ৫০৪
একটি ইশতেহার ৫২৯
অন্যান্য প্রসঙ্গ ৫৩২
দ্বিতীয় উপকারিতা ৫৩৪
অন্য একটি উপকারী কাজ ৫৩৬
আর একটি উপকারী বিষয় ৫৩৭
তৃতীয় উপকারিতা ৫৩৮
‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’তে দলিল হিসেবে গৃহীত গ্রন্থাদির তালিকা ৫৪৪
ফাতেহার তাক্বীর ৫৪৯
হযরত রাসূল (সাঃ)-এর ফাতেহার নিয়ম ৫৪৯
হযরত আলী (রাঃ) এর ফাতেহার নিয়ম ৫৪৯
খাতুনে জান্নাত বিবি ফাতেমা (রাঃ)-এর ফাতেহা ৫৪৯
ফাতেহা-এ-কান্দুরী ৫৫০
দুই ইমামের ফাতেহা ৫৫০
হযরত মীর মহিউদ্দীনের ফাতেহা ৫৫০
ফাতেহা-এ-হযরত শাহ্ শরফ বু আলী কলন্দর ৫৫০
হযরত খাজা খিজিরের ফাতেহা ৫৫০
হযরত কাজী শাহবুদ্দিনের ফাতেহা ৫৫১
হযরত শাহ্ মাদারের ফাতেহা ৫৫১
শবে বরাতের প্রদীপসমূহের উদ্দেশে ফাতেহা ৫৫১
কোরান খতমান্তে ফাতেহা ৫৫১
কবরে মৃতের জন্য উপদেশ ৫৫২
বুজুর্গ আলেমদের মন্তব্যাদি ৫৫২
র্মযিয়াদের শব্দ বিকৃতি আর ওহাবীদের বিকৃত ব্যাখ্যার জবাব
আল্লাহ্্র
অসংখ্য প্রশংসান্তে দৃঢ়বিশ্বাসী এবং যাঁদের সামান্যতম হলেও ইসলামের
সৌন্দর্যবোধ আছে, বিশেষ করে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নদের নিকট এবং সাধারণভাবে
সকল বিশ্বাসীর নিকট এ ফকিরের বিশেষ নিবেদনÑ অধুনা হিন্দুস্তান এবং বাংলার
বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী বিষয়সমূহ দলাদলিতে পরিণত হয়েছে। বেলায়েত এবং হাকিকত
তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সঠিক পথ নির্দেশনামূলক পারলৌকিক বিষয়াদির আলোচনায়
কিছু লোক নিজেদের মনগড়া কথা এবং অজ্ঞতার কারণে ঝগড়ার পথ অবলম্বন করেছে।
কারণ মরহুম মৌলভী কেরামত আলী জৌনপুরী সাহেব রফিকুস্সালেকীন, যাদুত্
তাক্ওয়া, নূরুল হুদা, কাওলুছ্ ছাবেত, রদ্দুল বেদাআ’, হক্কুল ইয়াক্কীন,
ইসতেকামাতে ফায়েজে আম, নূরুন্ আলা নূর প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলোর
অনেক কথাই সঠিক নয়। বোধদৈন্যের কারণে তিনি অনেক নৈতিক ও ব্যবহারিক বিষয়ে
উল্টাপাল্টা লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ দরগোশ অর্থ কানের ভিতর আর তিনি করেছেন
‘দরাজ গোশ’ অর্থাৎ লম্বা কান। আর ‘দম’ অর্থ নিশ্বাস। আর তিনি করেছেন ‘দুম’
অর্থাৎ ‘লেজ’ ইত্যাদি। এ কারণে জনগণের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। তার
অজ্ঞতাপ্রসূত সৃষ্ট কুফলসমূহ এবং এর ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট গণপ্রতিবাদসমূহ
পাঠকবৃন্দের কাছে তুলে ধরা হল। উদ্দেশ হল, হক্বপন্থীগণ যেন তাকে ইনসাফের
সাথে পর্যালোচনা করেন এবং এ ফকিরের কোনো ভুল পেলে তা এড়িয়ে না গিয়ে সংশোধন
করে দেন। এটাই ধর্মের সৌন্দর্য এবং উত্তম ধর্মপন্থা। ধর্মকে অজ্ঞতা ও ওহাবী
চিন্তার কালো পোশাকে আবৃত করাকে নূর ও কাশ্ফ ধারণা করা ধর্মসম্মত নয়।
গ্রন্থকার
জনাব কেরামত আলী সাহেব এমন কতিপয় বিষয়কে সঠিক বলে দাবি করেছেন যেগুলোর
পক্ষে ‘আহলেহক্ব’দের কোনো উদ্ধৃতি নেই। উদাহরণস্বরূপ ওহাবীদের বিরুদ্ধে যে
সব হাদিস-দলিল উদ্ধৃত করেছেন তার দু একটা দলিল আবার রদ্দুল মুখতার, তৃতীয়
খন্ডের বিদ্রোহ পরিচ্ছেদের বরাত দিয়ে ‘কাওলুছ ছাবেত’-এর অষ্টম পৃষ্ঠায়
উল্লেখ করেছেনÑ তা হল এই যে, খারেজীরা যাদের উপর লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়
তাদেরকে তারা কাফের মনে করে একথা বলে উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে,
আমাদের সময়ে আবদুল ওহাব নজদীর অনুসারীরা যারা মক্কা-মদিনা দখল করে, তারা
প্রতারণামূলকভাবে নিজেদেরকে হাম্বলী মায্হাবের অনুসারী বলে দাবি করে।
অপরদিকে তাদের বিশ্বাস হল যে, তারা মুসলিম এবং তাদের বিশ্বাসের বিরোধীরা
মুশরিক। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তারা সুন্নী সম্প্রদায় ও তাদের নেতাদের
হত্যা করা বৈধ মনে করে, যতদিন না আল্লাহ্্ তাদের দর্পচূর্ণ করেন এবং তারা
তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
প্রতিরোধের মুখে ভীত ব্যক্তিরা তাদের দল
ত্যাগ করে, অনেকে মারা যায়, আল্লাহ্ তাদের শহরগুলো ধ্বংস করেন এবং ১২৩৩
হিজরিতে সমাপ্ত যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
হেজাজের
এলাকা বাদে অবশিষ্ট আরব অঞ্চলকে নয্দ বলা হয়। ‘মিশকাতুল মাসাবিহর’ ইয়ামেন ও
সিরিয়া অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদের শেষাংশে ইবনে ওমর (রাঃ) এর বরাত ও
বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, নযদে
হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা হবে এবং নয্দ থেকে শয়তানের সেনা ও তার সহযোগীদের উদ্ভব
হবে। এ অধমের কথা হল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুজেযা হিসেবে এ ভবিষ্যদ্বাণী
করেছেন এবং তা-ই হয়েছে। অতএব মুসলিমদের চিন্তা করা উচিত এবং ইনসাফের সাথে
ভেবে দেখা দরকার যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীর পর ওহাবীরা
ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কি উদ্ভব হয়েছে যারা বিশেষ করে মক্কা-মদিনার
মুসলিমদের ওপর ওহাবীদের মতো অত্যাচার করেছে এবং যাদেরকে শয়তানের সেনা আখ্যা
দেওয়া ঠিক মনে হবে, আর নর-নারী নির্বিশেষে সকল মানুষ তা পাঠ করবে। আর এ
পাঠ করাকে ওহাবীদের বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে মুক্ত করা,
মানুষের মন থেকে ওহাবীদের সৃষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করা ইতোমধ্যে যারা
অন্যায় অপরাধ ও বেদ’আতের মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেছে এবং ধর্মের বিধানাবলি পালনের
ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে, তাদেরকে হুঁশিয়ার করার জন্য যথেষ্ট?
অতঃপর
প্রথমে ‘রফিকুস্ সালেকীন’ গ্রন্থ থেকে উদাহরণস্বরূপ কিছুটা আলোচনা করা
যাক। উক্ত গ্রন্থের ১৩১৬ হিজরির সংস্করণের অষ্টম পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে الله
نور السموة والارض (আল্লাহু নূরুচ্ছাসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্) অর্থাৎ, আল্লাহ্্
আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর নূর বা জ্যোতি। এ আয়াত অনুযায়ী আল্লাহ্র নূর তথা
জ্যোতি সর্বত্র বর্তমান যেমনই আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও সত্তা সর্বত্র বিরাজিত।
কারণ আল্লাহ্র নূর তাঁর পবিত্র সত্তার সাথে যুক্ত এবং তাঁর সত্তায়
অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান। অতএব যেসব স্থানে তাঁর সত্তা বর্তমান সেসব স্থানে
তাঁর নূরও অবশ্যম্ভাবীরূপে বিরাজমান এবং যেমনই তাঁর সত্তা সবকিছুকে
আবেষ্টিত করে রেখেছে তেমনই তাঁর নূর দ্বারাও সবকিছু পরিবেষ্টিত ও পরিপুষ্ট,
ইত্যাদি ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় গ্রন্থকার
সর্বত্র আল্লাহ্র নূর শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন যে, আল্লাহ্র নূর
সর্বত্র বিরাজিত। প্রশ্ন হল, উক্ত আয়াতে কোন শব্দের অর্থ ‘আল্লাহ্র নূর’? এ
আয়াত দ্বারা ‘আল্লাহ্র নূর’ বোঝায় না। বরং তাতে বোঝায় যে, আল্লাহ্-ই
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর। অর্থাৎ, আল্লাহ্ স্বীয় সত্তা ও গুণাবলিতে
গুণান্বিত অর্থাৎ সত্তারূপে প্রকাশিত এবং সত্তা গুণাবলিরূপে বিরাজিত ও
গুণান্বিত। এখানে গুণাবলি ও সত্তা একে অন্যের ফলশ্রুতি। অর্থাৎ, গুণাবলি
যেমন সত্তার ফল তেমনই সত্তাও গুণাবলির ফল। হাকিকতের জগতে তথা চূড়ান্ত মূলে
যা সত্তারূপে গুণ তা-ই গুণরূপে সত্তা হিসেবে বর্তমান এবং কেউ কারও
স্থলাভিষিক্ত বা উৎস নয়। এর অর্থ হল আল্লাহ্ আপন সত্তা ও গুণ, পবিত্রতা ও
প্রজ্ঞা এবং শক্তি ও রহস্য সহকারে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর তথা জ্যোতিরূপে
বিরাজমান। তা না হলে, দৃশ্যমান বস্তুগুলোর উৎস কী এবং কোথা থেকে এগুলোর
সৃষ্টি? অতএব মূল উৎসের বিচারে দৃশ্যমান বস্তুগুলোও সে নূরই। তা হলে কোন
নূর আবার এগুলোকে বেষ্টন করবে? যেখানে নূর থাকে সেখানে তার সত্তাও থাকে।
সুতরাং সকল সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার সত্তা রয়েছে। এর আরও ব্যাখ্যা আল্লাহ্
জ্ঞাননির্ভর। হাদিসে নূরের পর্দার কথা উল্লেখ আছে। এটা মৌল সত্তার বিকাশের
বর্ণনাত্মক ও প্রশংসাত্মক উপস্থাপনা।
উক্ত গ্রন্থকার সাহেব এর গূঢ়
অর্থ এখনও বোঝেননি। শুধু তা-ই নয়। এর পরবর্তী আলোচনায় আল্লাহ্র সত্তার
প্রমাণের ভিত্তিকেই তিনি অস্বীকার করেছেন। উক্ত গ্রন্থের ২৭ পৃষ্ঠায় তিনি
লিখেছেন, আল্লাহ্ শব্দ দ্বারা এমন এক ব্যাপক এবং নিরেট নিভৃত ও একাকী
সত্তাকে বোঝায় যা রঙ-রূপ, আকার-আকৃতি এবং স্থান প্রভৃতি থেকে পবিত্র
ইত্যাদি। অপরদিকে ঐ একই গ্রন্থের ৭ম পৃষ্ঠায় লেখক আল্লাহ্কে সর্বত্র
বিরাজমান বলে বর্ণনা করেছেন। তার এ স্ববিরোধী বক্তব্যের ব্যাখ্যা কী? তার
পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল যে, আল্লাহ্র কোন অবস্থাকে সব কিছু থেকে মুক্ত
এবং একাকিত্ব বলে আখ্যা দেওয়া যায়? অথবা তিনি বলুন যে, আল্লাহ্ একাকী হলেন
কী করে? এভাবে কল্পিত গালগল্প শুনিয়ে কত সম্প্রদায়কে বিভ্রান্তির অন্ধকারে
নিক্ষেপ করা হয়েছে, তার আরও উদাহরণ আছে।
উক্ত গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় মৌলভী
কেরামত আলী সাহেব লিখেছেন যে, দৃষ্টিগোচর নূরকে চিন্তাশক্তির সাহায্যে
এমনভাবে সম্প্রসারিত ও বিস্তৃত করতে হবে যেন সে নূর সবকিছুকে নিজ বেষ্টনীর
মধ্যে আনয়ন করে স্থানিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে অসীমে ব্যাপ্ত বলে মনে
হয়। অর্থাৎ, মনে হবে আকাশ ও জমিন কিছুই নেই; সবই নূর আর নূর ইত্যাদি।
গ্রন্থকার এখানে স্থানিক বস্তুকে অস্থানিক মনে করেছেন। অর্থাৎ, দৃষ্টিগোচর ও
উপলব্ধ নূরকে স্থানিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে মনে করেছেন। এজন্যই তিনি
দৃষ্টিগোচর নূরকে চিন্তাশক্তির সাহায্যে স্থানিক সীমার বাইরে সম্প্রসারিত
করার কথা বলেছেন। অথচ দৃষ্টি ও চিন্তার সাথে স্থানও সম্পৃক্ত এবং যা
অস্থানিক তা রঙ-রূপ থেকে মুক্ত। তাহলে নূর কী করে অস্থানিক হবে? বস্তুত এসব
অজ্ঞতার ফলশ্রুতি বৈ কিছু নয়।
উক্ত গ্রন্থের ২২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন
গুণগত তাওহীদের সার কথা এই যে, অস্তিত্ববাদী ভাবুক মনে করে যে, বিশ্বের
সমস্ত বস্তু এবং সৃষ্টি সবই আমাদের ভিতর থেকে উদ্গত। এ চিন্তা তার মধ্যে
এমনভাবে উদ্রেক হয় যে, সে নিজ দেহকে অনেক বিশাল ও প্রশস্ত মনে করে এবং ভাবে
যে, তার দেহের বিশালত্ব ও বিস্তৃতি বিশ্বের সমস্ত বস্তু থেকে আরশ পর্যন্ত
ব্যাপ্ত এবং বিশ্বের সমস্ত বস্তু তার অন্তর্ভুক্ত। সৌরজগৎ, বস্তুজগৎ,
পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, জীবজন্তু ও মানবমন্ডলী সবকিছুকেই সে তার দেহের অংশ
মনে করে এবং এমতাবস্থায় কাশ্ফ অর্থাৎ রহস্যোদ্ভেদরূপে আকাশমন্ডলের অবস্থাদি
সম্পর্কে অবহিত হয়, তার থেকে বহু দূরে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তার ভ্রমণ
লাভ হয় এবং তার কাশ্ফ তথা রহস্যোদ্ভেদ বাস্তবের সাথেও মিলে যায়। কিন্তু পরম
সত্যকে সম্পূর্ণরূপে নিজের মধ্যে এবং বিশ্বকে নিজের অংশ মনে করবে না। বরং
প্রত্যয় রাখবে যে, আমার এ ধারণা অবাস্তব এবং এ আমার মোরাকা’বা ও ধ্যানের
প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
এখানে বিচার্য বিষয় হল যে, গ্রন্থকার যাকে
কাশ্ফে’র ফল এবং বাস্তব বলে উল্লেখ করেছেন, সে ধারণা কী করে অসঙ্গত হয়?
বিশ্বসৃষ্টিকে আপন দেহের অংশবিশেষ মনে করতে নিষেধ করার অর্থ কি এ নয় যে,
উক্তরূপ ভাবনা সঙ্গত নয়। এমতাবস্থায় উক্ত অসঙ্গত ধারণা ‘কাশ্ফ’র যথার্থ ও
সঠিক ফলশ্রুতি কী করে হয়? এটাকে যদি মোরাকা’বা ও ধ্যানের প্রতিক্রিয়া বলা
হয়ও তাহলেও প্রশ্ন থাকে যে, যে মোরাকা’বার ফল সত্য নয় এবং যে মোরাকা’বা
আত্মম্ভারতায় আচ্ছন্ন সে মোরাকা’বার কাশ্ফ বা রহস্যোদ্ভেদ হয় কি? যদি বলা
হয় যে, এটা একমাত্র পরম সত্তার বিশ্বাসের ফল, তাহলে তাকে অসত্য ও অবাস্তব
ভাবা যায় কীভাবে? এরূপ ক্ষেত্রে উহাকে অবাস্তব এবং অনুমানভিত্তিক ধারণা মনে
করা তো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা অসত্যেরই শামিল। বস্তুত মোরাকা’বা
অবস্থাদির ফলশ্রুতিতে প্রতিফলিত সবকিছুই সত্য, যদিও ফলিত অবস্থার উৎস ও
মর্ম সম্পর্কে সাধক সম্যক জ্ঞাত নন। সাধকের অন্তরে নিক্ষিপ্ত সবই সত্য,
কারও কারও অন্তরে অবাস্তব প্রতিফলনও ঘটে। এটা ভীতি ও ধ্যানভঙ্গের কারণে হয়।
তবে এটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। বিশ্বকে নিজ দেহের অংশবিশেষ মনে হওয়া আদি বীজের
ফসলের মতো বৃক্ষ এবং এর ফল যেমন বীজ থেকে হয় তেমনই সকল বস্তুই আদি উৎসে
বর্তমান। তাই হাদিসে আছে, দেহে যে বস্তুর অস্তিত্ব নেই তা কখনো দেহকে
প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন করে না। মানুষের মনের ঠিক-বেঠিক এবং বাস্তব-অবাস্তব সব
প্রতিক্রিয়াই সত্য, কারণ বিশ্বে যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই, কখনো তার কোনো
প্রভাব কারও ওপর পড়বে না।
উক্ত গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, রূহ্
বা আত্মা যখন আকাশ ও আরশ পরিভ্রমণ করে তখন আত্মার তথায় অবস্থান কষ্টকর বোধ
হয়। এর কারণ হিসেবে উদাহরণস্বরূপ তিনি লিখেন যে, ভারী বস্তু নিম্নগামী,
এজন্য তার পতন ঠেকা’বার উপায় হল আত্মার ঊর্ধ্বারোহণের সময়ে আকাশে একটি পথ
চিন্তা করতে হবে এবং ঊর্ধ্বারোহণের পর আকাশে আত্মার অবস্থান ও স্থিতি
নিশ্চিত করার জন্য চিন্তাশক্তির সাহায্যে উক্ত পথ বন্ধ করে দিবে, ইত্যাদি।
মোদ্দাকথা,
মোরাকা’বা অবস্থায় থেকেই মোরাকা’বায় রত ব্যক্তিকে আত্মা যাতে আকাশ থেকে
ফিরে আসতে না পারে সে চিন্তা ও পথ বন্ধ করতে হবে। প্রশ্ন হল, মোরাকা’বা
অবস্থায় আত্মার ফিরে আসার চিন্তা-ভাবনায় বিব্রত ও বিভ্রাটে থাকলে
গ্রন্থকারের মোরাকা’বা ও মোশাহেদা কী করে সার্থক হবে? মৌখিক যিকিরের সাথে
(আলমে নাছুত) মানব জগতের সম্পর্ক। অতএব শয়তানের নষ্টামি ও অহঙ্কার থেকে তার
গত্যন্তর নেই। কারণ সে সাধক হিসেবে নবিশ এবং আধ্যাত্মিক বিষয়াদির ব্যাপারে
তার সম্যক জ্ঞান নেই। কারণ এখনও সে এক ‘জরবী’ ও দুই ‘জরবী’ যিকিরে রত।
যদিও কারও কারও কল্পনায় আকাশ ভ্রমণের চিন্তা আছে, সে চিন্তাও তাকে (আলমে
নাছুত) মানবজগৎ ভ্রমণের মাধ্যমেই করতে হয় বলে তাতে অহঙ্কার অবশ্যম্ভাবী ও
অবধারিত। এমতাবস্থায় অনুরূপ আচরণ বোধ করা কোনো অলীর (আহলে বেলায়েত) পক্ষেই
কি সম্ভব? আফসোস! মানব ও ফেরেশতার রূহানী জগতের মধ্যে রূহের জন্য আলমে
নাছুত ও আলমে মালাকুতের মধ্যে কোনো পর্দা নেই। কারণ আমলে জাবারুতে রূহের
অবস্থান; বরং তদূর্ধ্বেও রূহের অবস্থান রয়েছে।
উক্ত মৌলভী কেরামত আলী
সাহেবের লেখা ‘কাওলুছ ছাবেত’ ছাপা ১৩১৮ হিজরি-এর ৩৬ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,
পীরের সাথে যুক্ত ভক্তের আন্তরিক ভক্তিকে সূফীগণ শাইখ বা মুর্শিদের সাথে
মনোসংযোগ বলে থাকেন। অজ্ঞরা এর ভুল অর্থ বুঝেছে এবং অন্যকে ভুল বুঝিয়ে
পথভ্রষ্ট করছে। এরা তাদের শিখিয়েছে যে, যিকিরের সময়ে আপন পীরের অবিকল ছবি
নিজের সামনে মনে করে যিকির করতে হবে। এটাকে তারা পীরের চেহারায় নিমগ্নতা
বলে। অথচ কোনো পুস্তকে এরূপ বর্ণিত নেই। অথচ কাওলুল জামিল, সাবিলুর রেশাদ
এবং নূরুন আলা নূর প্রভৃতি গ্রন্থে উক্ত বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
আপনারা দেখতে পারেন।
প্রসঙ্গক্রমে কাওলুল জামিলের বক্তব্য লক্ষ করুন।
তাতে বলা হচ্ছেÑ শাইখ বা মুুর্শিদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হল,
শাইখের সাথে সুদৃঢ় মনোসংযোগ স্থাপন করতে হবে এবং সর্বক্ষণ তাঁকে স্মরণে
রাখতে হবে। অতঃপর মুর্শিদের সঙ্গলাভ করে, অন্য সব চিন্তা-ভাবনা থেকে নিজেকে
মুক্ত করতে হবে এবং কেবল তাঁর মহব্বত ও ফায়েজ লাভের প্রক্রিয়ায় রত থাকবে, এ
সময়ে উভয় চক্ষু বন্ধ রাখবে অথবা উভয় চক্ষু খোলা অবস্থায় মুুর্শিদের দু
চক্ষুর মধ্যবর্তী স্থানে নিবদ্ধ রাখবে। এমতাবস্থায় কোনো প্রকার ফায়েজ বা
প্রেরণা ও প্রভাব অনুভূত হলে আন্তরিক মহব্বতের সাথে তা অনুসরণ করবে এবং এ
ফায়েজ কে ধারণ করে রাখার জন্য যত্নসহকারে সচেষ্ট থাকবে। মুর্শিদ যদি ভক্তের
সম্মুখে সশরীরে হাজির না থাকেন, তা হলে আপন চক্ষুদ্বয়ের মধ্যস্থলে তাঁর
চেহারা কল্পনা করবে মহব্বত ও ভক্তিপূর্ণ অন্তরে। তা হলে তাঁর কল্পিত চেহারা
থেকে সে উপকারই পাওয়া যাবে যা তাঁর সঙ্গ ও সাহচর্য থেকে পাওয়া যায়।
এখানে
লক্ষণীয় যে, উক্ত গ্রন্থকার (মৌলভী কেরামত আলী) লিখেছেন যে, মুর্শিদের
চেহারা কল্পনা করার কথা কোনো গ্রন্থে উল্লেখ নেই, তা যদি সত্য হয়, তা হলে
কাওলুল জামিল ও সাবিলুর রেশাদ-এ যে শাইখের ধ্যান ও তাঁর সাথে মনোসংযোগ
স্থাপন এবং মুর্শিদের দু চক্ষুর মধ্যবর্তী স্থানে ধ্যান নিবদ্ধ করার অর্থ
কী? এর অর্থ কি মুর্শিদের চেহারায় নিমগ্ন হওয়া নয়? বলবেন কি, এ মুর্শিদ কে
এবং মুর্শিদে ধ্যান নিবদ্ধ করা বলতে কী বোঝায়? মুর্শিদ যদি দূরে অবস্থান
করেন, এমনকি সশরীরে বর্তমান ও জিন্দা নাও থাকেন তা হলেও মুর্শিদ থেকে ফায়েজ
পাওয়া যায় এবং নবিশ আপন চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে মুর্শিদের কল্পিত
চেহারা থেকেও তাঁর সশরীর সঙ্গ এবং সাহচর্যের মতোই ফায়েজ পায়। এর অর্থ কী? এ
কারণেই ‘কাওলুল জামিল’-এ আধ্যাত্মিক সাধনায় মুর্শিদের ধ্যান এবং তাঁর সাথে
মনোসংযোগ করাকে পূর্বশর্ত এবং প্রধান স্তম্ভ করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে
হযরত আবদুর রহমান জামী বলেন, যিকির করে উপকার পাওয়ার জন্য মুর্শিদের ধ্যান
করাই যথেষ্ট। আর এটাই সকল সাধনার সর্বোত্তম ও সহজতর পথ। পুনঃপুনঃ
মুর্শিদের চেহারার ধ্যান করলে যিকির ও মনের শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। সকল
যিকিরের জন্য এর চেয়ে উত্তম কোনো পথ নেই। ঐশী রহস্যজ্ঞান সমৃদ্ধ আল্লামা
নামে খ্যাত মাওলানা জয়নুদ্দীন খানী তাঁর ‘উপদেশ’পুস্তকে হযরত জুনায়েদ
বাগদাদী (রঃ) থেকে নির্জন ধ্যান সাফল্যের আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন। শাইখের
সাথে সদা মনোসংযোগ রক্ষা করা এর অন্যতম। অনুরূপভাবে ‘জাওহারুস সলুক’,
‘কাশকুলু শরীফ’, ‘মাক্তুবাতে মুজাদ্দিদে আলফেসানী’, ‘মাকতুবাতে মিজি’,
‘হেদায়েতুত তালেবীন’ এবং হযরত খাজা আহরার (রঃ)-এর পুস্তক ‘এসবাতে রাবেতা’
এবং অনুরূপভাবে হযরত কাজি ইউসুফ নাছেহ্ (রঃ) প্রভৃতি গ্রন্থেও মুর্শিদের
ধ্যান ও মনোসংযোগের কথা উল্লেখ রয়েছে। এমতাবস্থায় মৌলভী কেরামত আলী সাহেব
কী করে লিখলেন যে, মুর্শিদের চেহারার ধ্যান করার কথা কোনো কেতাবে নেই। শুধু
তা-ই নয়, নিজের পীর ও দাদা পীরকেও রেহাই দেননি। জ্ঞানের অভাবে যা তার মনে
এসেছে, তাই লিখেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তাও লিখেছেন।
উদাহরণস্বরূপ উক্ত গ্রন্থের ৩৭ পৃষ্ঠায় ‘আখবারুল আখ্ইয়ার’ থেকে গ্রন্থকারের
উদ্ধৃত প্রমাণগুলোর দু একটি সম্পর্কে আমি এখানে আলোচনা করছি।
ধ্যান
প্রসঙ্গে ‘আখবারুল আখইয়ার’ গ্রন্থের বক্তব্য উদ্ধৃত করার ধারায় তিনি লিখেন,
পঞ্চমত আপন শাইখের সাথে সদা মনোসংযোগ রক্ষা করে যিকির করতে হবে। এ
মনোসংযোগ অর্থ মুর্শিদের অন্তরের সঙ্গে মুরিদের অন্তর সম্পূর্ণরূপে স্থাপন
করা। অর্থাৎ হাদিস পাঠ করার সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে এবং ফেকাহ্
গ্রন্থ পাঠ করার সময়ে ইমাম আজম (রহঃ)-এর সাথে যেমন একটি বাতেনী প্রেম ও
শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, ধ্যানের সময়ে তেমনই মুর্শিদের সাথেও একটি
মানসিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটাই হল শাইখের সাথে মনোসংযোগ স্থাপন। সবটাই
আলোচ্য গ্রন্থকারের (মৌলভী কেরামত আলী) কথা।
এখন প্রশ্ন হল, হাদিস পাঠ
করার সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে এবং ফেকাহ্ গ্রন্থ পাঠ করার সময়ে ইমাম আজম
(রহঃ)-এর সাথে পাঠকের যে মানসিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, শাইখের সাথে মুরিদের
মনোসংযোগও তা-ই; এটা উক্ত লেখক কোথায় পেলেন? যে শিক্ষকের কাছে হাদিস-ফেকাহ্
শিক্ষা করা হয়, তার সাথে মনোসংযোগ অবশ্য প্রয়োজন; যিনি পরবর্তী পর্যায়ে
রয়েছেন তাঁর সাথে মনোসংযোগ আবশ্যকীয় নয়। অর্থাৎ কোনো গ্রন্থের লেখকের সাথে
পাঠকের মনোসংযোগ জরুরি নয়। যিনি যে জ্ঞানের সরাসরি গুরু বা মুর্শিদ সে
বিষয়ে তাঁর সাথে মনোসংযোগ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু জ্ঞান তো মনের মুর্শিদ
বা গুরু নয়, সে ক্ষেত্রে এ মনোসংযোগকে মুর্শিদের সাথে মনোসংযোগ কী করে বলা
যায়, আর কীভাবেই বা একে মনোসংযোগ মনে করব? এ ধরনের মনোসংযোগের ফলে কী ধরনের
যিকির বা জ্যোতি লাভ হয় অথবা এর উপর কিরূপ কার্যক্রম নির্ভরশীল, তা জানার
উপায়ই বা কী?
প্রসঙ্গক্রমে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মুর্শিদের চেহারা
আল্লাহ্র সত্তাগত গুণে পরিপূর্ণ। তাঁর সত্তা ও গুণাবলি দ্বারা আল্লাহ্র
সাধকের সত্তা ও গুণাবলি রূহানী চুম্বকের আকর্ষণে আলোকিত হয়। অর্থাৎ সঠিক
পথের সন্ধানে ধ্যানমগ্ন সাধকের মনমন্ডলে মুর্শিদের চেহারা বিকশিত হলে সঙ্গে
সঙ্গে তাঁর রূহানী আকর্ষণ অগ্নিময় সীসার মতো হয়ে তার সামনে উদ্ভাসিত হবে
এবং তাঁর রূহের মধ্যে বিজলীর মতো চমকাতে থাকবে। এটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও
অভিজ্ঞতার কথা, ধারণা মাত্র নয়। নিছক ধারণা বা অনুমানের সাথে মুর্শিদের
ধ্যানস্থ অন্তর ও উপলব্ধির কোনোই সম্পর্ক নেই।
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে
যে, আলোচ্য গ্রন্থকার গ্রন্থের এক স্থানে মন্তব্য করেছেন যে, অজ্ঞরা
মনোসংযোগ-এর ভুল অর্থ বুঝেছে এবং যিকির করার সময়ে পীরের হুবহু চেহারা
কল্পনায় নিজের সামনে রাখার জন্য মুরিদদের পরামর্শ দেয় ইত্যাদি। এখন
গ্রন্থকারের জ্ঞানের বহর দেখুন। এখানে ‘কল্পনা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর
কল্পনায় যে, ছবি বা চেহারা আসবে তা অবশ্যই কল্পিত ছবি হবে। তা কখনো মূল
ছবি হতে পারে না। কল্পনা শব্দ দ্বারাই তো বোঝা যায় যে এটা কেবল মনে
ধারণাকৃত ছবি। তবুও গ্রন্থকার ধ্যানে শাইখের চেহারা কল্পনা করতে নিষেধ
করেছেন। তা হলে তিনি নিজে ধ্যানে কামানের কল্পনা করার পরামর্শ কেন দেন? এ
ফকিরের মনে পড়ে, তিনি তার কোনো এক পুস্তকে ধ্যানে সরাসরি কামানের কল্পনা
করার উল্লেখ করেছেন এবং ধ্যানে তথা যিকিরের মোরাকা’বায় কামানের ধ্যান করাকে
অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলেছেন। কামানের কল্পনা করার অর্থ হল, সাধক ধ্যানে কল্পনা
করবে যে, তার বক্ষে কামানের একটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে। তাতে তার বক্ষে একটি
ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে এবং সে ছিদ্রটি ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়ে গোটা দেহে
সম্প্রসারিত হয়ে গেছে ইত্যাদি।
লক্ষণীয় যে, যে মুর্শিদের মধ্যে
হেদায়েতের নূর এবং ঐশী প্রেরণা বর্তমান যাঁর প্রভাব পয়গম্বরী প্রভাবের সম
মর্যাদাপূর্ণ এবং শয়তানের নষ্টামি থেকে সুরক্ষিত সে মুর্শিদের ধ্যান
নিষিদ্ধ করে উক্ত গ্রন্থকার (মৌলভী কেরামত আলী) মুরিদকে তা থেকে বঞ্চিত
করেছেন এবং এর উপকারিতার বিপরীত কথা লিখেছেন। অপরদিকে অসার লোহানির্মিত
কামানের ধ্যান ও কল্পনা শেখান। অথচ তিনি জানেন না যে, শয়তান কামানের রূপ
ধরতে পারে এবং এক গুলিতে পন্ড করে দিতে পারে সব সাধনা। আর তিনিও হতে পারেন
এর শিকার। বস্তুত তিনি তার শিকার হয়েই আছেন। এজন্য নূরময় মুর্শিদের ধ্যান
করা তার অপছন্দ। অপরদিকে পছন্দ হল তার কামানের রূপ কল্পনা।
বলা বাহুল্য
যে, আল্লাহ্র পথে যারা নেহায়েত মন্দ এবং সঠিক পথবঞ্চিত তারা নিজেরাই
নিজেদের সর্বনাশ করে। এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মিথ্যাচার ও
বিশ্বাসহীনতার সৃষ্টি হয়। আর মিথ্যাচার ডেকে আনে আধ্যাত্মিক মৃত্যু,
কামানের কল্পনা করা, এর বারুদ ও আগুনের তোড়ে এর গুলি বক্ষভেদ করা, সে
কল্পিত গুলির কল্পিত ছিদ্র দ্বারা কল্পনায় নিজ বক্ষকে নষ্ট করা, ক্রমান্বয়ে
তা প্রসারিত হয়ে সমগ্র দেহে তা সম্প্রসারিত করা এবং তাকে ‘ফানা ফিল্লাহ’
মনে করা কতই না দুঃখজনক। আল্লাহ্র সাধনার ক্ষেত্রে এরূপ মিথ্যাচার এবং
উ™£ান্ত ধারণার দ্বারা আপন আধ্যাত্মিক অবস্থার বিনষ্ট সাধন আবার তাকে ‘ফানা
ফিল্লাহ’ মনে করা কোন ধরনের বেলায়েতের কাজ? এদের মনোভাব হল, মূর্দা যথা
ইচ্ছা যাক, মোল্লার হালুয়া রুটি ঠিক থাক।
একটু ভাবুন। এ ধরনের আকিদা ও
স্তরের লোকরা নূরী মুর্শিদের সমান কী করে হয়? বলুন তো, লোহার শিবলিঙ্গে কি
জ্যোতি পতিত হয়? গুণগত জ্যোতি, না সত্তাগত জ্যোতি? সঠিক পথপ্রদর্শক জ্যোতি,
না বাসেত্ব জ্যোতি? না অন্য কোনো জ্যোতির্ময় কিছুর জ্যোতি? যদি এর কোনোটাই
না হয়, তা হলে কী কারণে আল্লাহ্র সাধনপথে অযথা চিন্তা করতে হবে, অবাস্তব ও
মিথ্যা বা মিথ্যা কল্পনার দ্বারা আপন মনকে বিভ্রান্ত করতে হবে এবং নূরী
মুর্শিদের মহব্বত ও ধ্যান, যা আল্লাহ্র সাথে মিলনের সার্থক ও ফলপ্রসূ
পরীক্ষিত উপায়, তা ত্যাগ করতে হবে? বস্তুত যারা আল্লাহ্র সাধন পথে নূরী
মুর্শিদের সাথে মনোসংযোগ স্থাপন করেনি, শয়তান তাদের মুর্শিদ সেজে তাদেরকে
গোমরা করে। প্রবাদ আছেÑ“যার মুর্শিদ নেই তার মুর্শিদ হল শয়তান।” আল্লাহ্
সাধনে পীরই হলেন সত্য ও সঠিক পথের দিশারী এবং হাদী, এ ক্ষেত্রে কামান
কল্পনার কোনোই প্রয়োজন নেই। কামানের এমন কোনো রূপ নেই যা শয়তান ধারণ করতে
পারে না। অপরদিকে শয়তান মুর্শিদের রূপ ধারণ করতেই পারে না। এসব বিষয়ে আমার
‘জামে নূর’ দ্বিতীয় খন্ডে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক তা
দেখে নিতে পারেন।
ধ্যানে কামান কল্পনার দ্বিতীয় দোষটি এই যে, নিজের ওপর
কামান, গুলি অথবা তলোয়ারের আঘাত কল্পনা করা খারাপ ও অশুভ লক্ষণ। শুভ
লক্ষণের পরিপন্থী। এর প্রতিক্রিয়া অশুভ। চুম্বকের প্রতিক্রিয়ার আলোকে
চিন্তা করলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। জ্ঞানীদের কাছেও বিষয়টি গোপন নয়।
উক্ত কথার সাথে যাদুকরেরও তেমন একটা তফাৎ নেই। একটি ঐতিহাসিক ঘটনাÑ একদা
পিঠেপিঠে সংযুক্ত অবস্থায় দুটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। জনৈক ব্যক্তি তলোয়ার
দ্বারা উভয়কে আলাদা করে দেয়। তা দেখে জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি ভবিষ্যদ্বাণী করেন
যে, তারা সর্বদা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকবে। অবশেষে তা-ই হয়েছে। তারা উভয়ই
যুদ্ধক্ষেত্রে তলোয়ারের আঘাতে মারা গেছে। এজন্যই নিয়ম হল যে, সন্তান জন্ম
হলে লোহা বা কোনো অস্ত্র দ্বারা নবজাতকের নাড়ি কাটা হয় না। কারণ তা হলে
ভবিষ্যতে সন্তানের অমঙ্গল হতে পারে।
১৩০০ হিজরিতে কলকাতার মোহাম্মদী প্রেসে ছাপা ‘হুক্কুল ইয়াক্কীন’
পুস্তিকার
২৬ পৃষ্ঠায় লেখক (মৌলভী কেরামত আলী) লিখেছেন যে, যে ব্যক্তি ফাতেহার
অনুষ্ঠানে মাতম করা বৈধ বলে হাদিস শোনাবে অথবা কোনো বেদ’আত কাজের বৈধতার
সমর্থনে হাদিস বর্ণনা করবে সে ব্যক্তি দাজ্জালÑ উক্ত গ্রন্থের ২৭ পৃষ্ঠায়
তিনি লিখেছেন। অতএব কারও কবরে বাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা করা, চাদর ও
শামিয়ানা টাঙানো, গম্বুজ নির্মাণ করা, কবর পাকা করা, তাতে কিছু লেখা বা
পাথরে লিখে কবরে স্থাপন করা ইত্যাদি সবই বেদ’আত। তারই অন্য পুস্তিকা ১২৮১
হিজরিতে কলকাতা থেকে ছাপা ‘রদ্দুল বেদ’আত’-এর ১২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, এ
দেশে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতদের মধ্যে ফাতেহার অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো
বেদ’আত দেখা যায় না। এর উদ্যাপনকারীরা এটাকে ন্যায় ও পুণ্যের কাজ মনে করে
এবং তা থেকে তওবা করার কোনো ইচ্ছা তারা পোষণ করে না। ‘উরস’ ইত্যাদি এরই
অন্তর্ভুক্ত।
লক্ষণীয় যে, উক্ত লেখকের দাদা পীর হযরত শাহ্ আবদুল আজিজ
(রঃ) সাহেব সব সময়ই ফাতেহা ও উরস-এর অনুষ্ঠান করতেন। ফতুয়া আজিজী প্রভৃতি
গ্রন্থে এর বিবরণ রয়েছে। শাহ্ সাহেব মরহুম হাদিস দ্বারা ‘উরস’ এর মৌলিকত্ব
প্রমাণ করেছেন। ‘দোররে মনসুর’ ও ‘তফসীরে কাবরী’ প্রভৃতি গ্রন্থে উক্ত হাদিস
উদ্ধৃত রয়েছে। সে হাদিসটি হল এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রত্যেক বছরের
শেষে শহীদদের কবরস্থানে যেতেন এবং বলতেন, “তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ তার
বিনিময়ে তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমাদের পরিণাম কতই সুন্দর।” চার
খলিফাও অনুরূপ করেছেন। উক্ত শাহ্ সাহেব প্রত্যেক বছর তাঁর পিতা হযরত শাহ্
ওয়ালীউল্লাহ (রঃ)-এর ‘উরস’ করতেন। তাঁকে লক্ষ করে মৌলভী আবদুল করীম
পাঞ্জাবী সাহেব লিখেছেন যে, তোমরা উরসকে ফরজ করে ফেলেছ। শাহ্ সাহেব এর
জবাবে লিখেন, (১৩০০ হিজরিতে মুদ্রিত) ‘জুবদাতুল নাসায়েহ’ কেতাবের ৪৪
পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, যাঁদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হচ্ছে তাঁদের
আধ্যাত্মিক অবস্থা সম্পর্কে অভিযোগকারীদের অজ্ঞতাই এ অভিযোগের ভিত্তি।
শরিয়ত দ্বারা নির্ধারিত না হলে কোনো কিছুকে কেউ ফরজ মনে করে না।
পুণ্যবানদের কবরে কোরান পাঠ, দোয়া খায়ের ও শিন্নী বিতরণ যেমন পুণ্যের কাজ,
কল্যাণের উদ্দেশে তাঁদের কবর যিয়ারত তেমনই শুভ ও উত্তম কাজ। আলেমদের মতে
উরস উদ্যাপনের কারণ এই যে, ঐ দিন পুণ্যবান ব্যক্তিটি কর্মজগৎ থেকে
প্রতিফলের জগতে প্রত্যাগমন করেছেন। তা ছাড়া শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ সাহেব এবং
তাঁর পূর্বসূরিগণও উরস করতেন। গ্রাম-গঞ্জে পাওয়া যায় এমন অনেক কেতাবে এসবের
প্রমাণ রয়েছে। আমাদের সময়ের কামেল ও হাক্কানী আলেম সমাজও এর পক্ষে রয়েছেন।
মরহুম মাওলানা আবদুল হাই লক্ষেèৗভীর মাজমুউল ফতুয়া, কেতাবে নাতিজা, ফতুয়া
আজিজী, ফতুয়া ওদুদী, কুল্লিয়াতে এমদাদিয়া ও আনোয়ারে সাত্বেয়াহ প্রভৃতি
‘উরস’ এর সমর্থনে বহু কেতাবে উদ্ধৃতি রয়েছে। এসব কেতাবের মধ্যে সিরাতে
জাল্লি, গুনিয়াতুত তালেবীন, শরহে মায়ানিউল আছার, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ,
মুজমারাও, তাতার খানিয়া, মুলতাকাত, মাকতুবাতে মুজাদ্দিদে আলফেসানী, তফসীরে
মুদারেক, তফসীরে বাইজাবী, তফসীরে কবীর, তফসীরে রূহুল বয়ান, তাহতাবী,
আলমগীরী এবং শামী ইত্যাদি প্রধান প্রধান কেতাবগুলো উল্লেখযোগ্য। যে সব
কেতাবের সাহায্যে ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ্’ লেখা হয়েছে এ পুস্তকের পরিশিষ্টে
সেগুলোর তালিকা দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, মিলাদের অনুষ্ঠান, তাতে কেয়াম করা,
প্রচলিত উরস ও ফাতেহার অনুষ্ঠান করা, কবরে সৌধ ও গম্বুজ নির্মাণ, মৌলুদ ও
অন্যান্য অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জা, সদকা খয়রাতের পুণ্য মৃতের কাছে পৌঁছা,
তৃতীয়, চতুর্থ ও দশম ফাতেহা, বাৎসরিক ও অর্ধ বাৎসরিক চেহ্লাম, বিভিন্ন
তারিখে স্ব স্ব স্থানে রূহের আগমন, বেদ’আতের প্রকারভেদ ইত্যাদি বিষয় আলোচনা
ও প্রমাণ করার উদ্দেশেই ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ্’ কেতাবটি লেখা হয়। তাতে
মক্কা-মদিনাসহ দেশ-বিদেশের অনেক আলেমের মন্তব্য ও দস্তখত রয়েছে। তাদের
মধ্যে মরহুম শাহ্ হাজী এমদাদুল্লাহ সাহেব, জনাব মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব
এবং জনাব মাওলানা আবদুল হক সাহেব, হিন্দুস্তানের অধিবাসী হিজরত করে মক্কা
গিয়ে বসবাস করেন। তাঁর খুবই পরিচিত এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ্ চাহে
তো এ পুস্তকের শেষাংশে মক্কা-মদিনার কয়েকজন মহান আলেমের মন্তব্যও উদ্ধৃত
করা হবে। অন্যান্য আলেমদের মন্তব্যগুলো ‘আনোয়ারে সাত্বেয়া’য় দেখতে পারেন।
তাতে মিশর, বাগদাদ, ইস্তাম্বুল, পারস্য, ভারতবর্ষ, মাদ্রাজ, বাংলা, বিহার
প্রভৃতি দেশের আলেমদের উক্ত বিষয়াদি সমর্থনে এবং ওহাবিয়াত ধরনের বিষয়াদির
বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মন্তব্য সহ দস্তখত রয়েছে।
এ অধম ‘সফিনায়ে সফর’ পুস্তকে
সমকালীন মানুষদের উপকারার্থে পনেরোটি বিষয় গ্রহণ করেছি এবং সত্যসন্ধানীদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মন্তব্যসহ কয়েকজনের দস্তখত তাতে নিয়েছি। উক্ত
বিষয়গুলো হল :
১. দৈহিক ও আর্থিক ইবাদতের পুণ্য অন্যকে পাঠালে পৌঁছে।
২. খাওয়া-দাওয়ার পর্বে বা শিন্নী উপলক্ষে ফাতেহা ও দোয়া-দরুদ পাঠ করা জায়েজ ও পুণ্যের কাজ।
৩. নির্ধারিত দিনটি ও তা উদ্যাপনের স্থান পবিত্র হওয়া প্রয়োজন।
৪. ধর্মীয় মুরব্বিদের নামে ফাতেহা পাঠ করা জায়েজ ও পুণ্যের কাজ।
৫. অলীদের জন্য মানত করা, খাবার খাওয়া ধনীদের জন্যেও জায়েজ।
৬. ফাতেহা পাঠ করার সময়ে হাত তোলা বৈধ।
৭. বাৎসরিক ফাতেহা অনুষ্ঠান এবং এজন্য দিন নির্ধারণ করা খারাপ নয়।
৮. মোস্তাহাব কাজ কখনো কখনো ওয়াজিব ও ফরজ হয়ে যায়।
৯. বৃহস্পতিবারে ফাতেহা পাঠের অনুষ্ঠান করার প্রমাণ আছে।
১০. দুই ঈদ, শবেবরাত, আশুরা প্রভৃতি যেসব দিবসে রূহ্ স্ব স্ব ঘরে প্রত্যাবর্তন করে সে সব দিবসে ফাতেহার অনুষ্ঠান করার প্রমাণ।
১১. মৌলুদের অনুষ্ঠানে কেয়াম করা সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর।
১২. ‘উরস’ এর প্রমাণ।
১৩. বেদ’আতের প্রকারভেদ।
১৪. সামাজিক রীতি-প্রথা পালন করা মন্দ নয়।
১৫. অধিক আলোকসজ্জা করায় দোষ তো নেই-ই বরং তাতে পুণ্য ও যথেষ্ট বরকত রয়েছে।
লক্ষেèৗর
ফখরুল মাতাবে ছাপাখানায় মুদ্রিত পুস্তক ‘যাদুত্ তাকওয়া’-এর ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায়
মৌলভী কেরামত আলী সাহেব লিখেছেন, প্রকৃত তাসাওফ অর্থ নিষ্ঠার সঙ্গে
আল্লাহ্তে মনোনিবেশ করা অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের সান্নিধ্যে নিমগ্ন হওয়া এবং
নিবদ্ধ থাকা। ত্বরিকতপন্থী শাইখ সম্প্রদায় তাসাওফের এরূপ অর্থই করেছেন।
ফেকাহ্, তাসাওফ ও কালাম শাস্ত্র পরস্পর নির্ভরশীল এবং সম্পৃক্ত। একটা ছাড়া
অন্যটা সম্পূর্ণ হয় না এবং পূর্ণতা লাভ করে না। ফেকাহ্্ ছাড়া তাসাওফের অবয়ব
তৈরি হয় না কারণ ফেকাহ্ ছাড়া আল্লাহ্র নির্দেশ জানা যায় না। অপরদিকে
ফেকাহ্ও তাসাওফ ছাড়া পূর্ণতা পায় না। কারণ সনিষ্ঠ মনোনিবেশ ছাড়া কোনো কাজ
সুসম্পন্ন হয় না। তবে তাসাওফ ও ফেকাহ্ কোনোটাই ঈমান ছাড়া শুদ্ধ হয় না। যেমন
রূহ্ ও দেহ কোনোটাই একে অন্যটি ছাড়া অস্তিত্ব পায় না এবং পরিপূর্ণতা অর্জন
করে না। এ জন্য ইমাম মালেক (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তাসাওফ গ্রহণ করেছে
কিন্তু ফেকাহ্ গ্রহণ করেনি, নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি কাফের। আর যে ব্যক্তি
ফেকাহ্ গ্রহণ করেছে কিন্তু তাসাওফ গ্রহণ করেনি, নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি
ফাসেক। তবে যে ব্যক্তি উভয়টাকেই গ্রহণ করেছে সে ব্যক্তি অবশ্যই সঠিক পথে
রয়েছে বা সত্যপ্রাপ্ত হয়েছে…ইত্যাদি।
এখন লেখক সাহেবের বক্তব্যের ধরনটা
লক্ষ করুন। তিনি লিখেছেন যে, ফেকাহ্, তাসাওফ এবং কালাম শাস্ত্র পরস্পর
নির্ভরশীল এবং সম্পৃক্ত। একটা ছাড়া অন্যটা সম্পূর্ণ হয় না এবং পরিপূর্ণ
রূপলাভ করে না …ইত্যাদি। অতঃপর তিনি লিখেছেন যে, ফেকাহ্ ছাড়া তাসাওফ বোঝা
যায় না এবং তাসাওফ ছাড়া ফেকাহ্ পূর্ণ হয় না। আর ফেকাহ্ ও তাসাওফ কোনোটাই
শুদ্ধ হয় না ঈমান ছাড়া। যেমন রূহ্ ও শরীর কোনোটাই একটা অন্যটাকে ছাড়া
অস্তিত্ব পায় না এবং পরিপূর্ণতা অর্জন করে না। এ কারণেই ঈমাম মালেক (রাঃ)
বলেন যে, যে ব্যক্তি তাসাওফ ধারণ করেছে কিন্তু ফেকাহ্ ধারণ করেনি সে
ব্যক্তি কাফের, যে ব্যক্তি ফেকাহ্ ধারণ করেছে কিন্তু তাসাওফ ধারণ করেনি সে
ব্যক্তি ফাসেক। এ থেকে বোঝা যায় যে, ফেকাহ্-ই হল ঈমান ও বিশ্বাস। কারণ যে
জিনিস না থাকলে মানুষ কাফের হয় তা ঈমান ছাড়া আর কিছু নয়। অপরদিকে লেখক
নিজেই তাসাওফকে ফেকাহ্র মূল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, তাসাওফ
ছাড়া ফেকাহ্ পূর্ণ হয় না। কারণ নিষ্ঠা ও মনোযোগ থাকলেই তো যে কোনো কাজ
শুদ্ধ ও পরিপূর্ণ হয়। এটাও তো উক্ত ইমামের বক্তব্যের পরিপন্থী হল। কারণ
উক্ত ইমাম সাহেবের বক্তব্য তো এর বিপরীত।
উক্ত ইমাম সাহেবের এরূপ
অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা কি বিশ্বাসযোগ্য? আর লেখকও কেনইবা নিজে বলতে অপারগ
হলেন? অথচ এর পরই তিনি লিখেছেন যে, ফেকাহ্ এবং তাসাওফ ঈমান ছাড়া শুদ্ধ হয়
না; যেমন রূহ্ ও শরীর… ইত্যাদি। এখানে ঈমাম সাহেবের বক্তব্যে ইমানের কোনো
আলোচনা নেই; আছে ফেকাহ্ ও তাসাওফের কথা, আমরা যদি মেনে নেই যে, তাসাওফ ধারণ
করার পরও কেউ কাফের হতে পারে তাহলে আহওয়াল অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অবস্থাদি
তাসাওফের বিষয়বস্তু কী করে হয়? অথচ লেখক হাল ও আহওয়ালকে ঈমান বলে উল্লেখ
করেছেন। লেখক আবার ‘নূরুল হুদা’ পুস্তকের ১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, তাসাওফের
আলোচ্য বিষয় হল আহওয়াল তথা সাধকের আধ্যাত্মিক অবস্থাদি। ঈমান, তাসদিক ও
ইয়াকীন সবই আহওয়ালের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, আহওয়াল যদি তাসাওফের মূল
বিষয়ববস্তু হয় আর আহওয়ালই যদি হয় ‘ঈমান’ তাহলে ঈমান আহওয়ালের ওপর নির্ভরশীল
আর কর্ম নির্ভরশীল ঈমানের উপর। সুতরাং ঈমান ছাড়া কোনো কর্ম শুদ্ধ নয়।
অপরদিকে উপরে বলা হয়েছে যে, আহওয়াল ছাড়া ঈমান ও ইয়াকীন তথা দৃঢ় বিশ্বাস হয়
না। যেহেতু তাসাওফ ও ঈমান উভয়ই আহওয়ালের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু যে ব্যক্তি তা
ধারণ করবে, তিনি কাফের হবেন এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক কথা ইমাম মালেক
(রহঃ) বলবেন তা কী করে বিশ্বাসযোগ্য হয়?
তবে গ্রহণযোগ্য হত যদি বলা হত
যে, যে ব্যক্তি তাসাওফ ধারণ না করে কেবল ফেকাহ্ ধারণ করে সে কাফের হবে।
কারণ আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থা তাসাওফ ও ঈমান দুয়েরই মূল বিষয়বস্তু।
মূল বস্তু ছাড়া তো ঈমান হতে পারে না। সুতরাং তাসাওফ ধারণ করেনি এরূপ
ব্যক্তি তো কাফের হওয়ারই যোগ্য। বে-ঈমানকে যিন্দিক বা কাফের ও বিপথগামী বলা
অন্যায় নয়। তাছাড়া তাকলিদি ঈমানদার অর্থাৎ নকল বিশ্বাসী ব্যক্তিও যিন্দিক
বা কাফের হতে পারে। কারণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাকলিদ বৈধ বা গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং তাকলিদপন্থীর উচিত তাসাওফ ধারণ করে তাকলিদি ঈমান থেকে মুক্তি লাভ
করা। তা না করলে সে ব্যক্তি অবশ্যই যিন্দিক ও কাফের হবে। কারণ ফেকাহ্্
শাস্ত্রে কাফের হওয়ার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে এবং যে ‘কুফর’ থেকে কাফের
প্রমাণিত হয়, সে ব্যক্তি কে? যার মধ্যে ঈমান ও ঈমানের মূল বর্তমান সে কাফের
না যে তা থেকে বঞ্চিত অর্থাৎ তাকলিদপন্থী সে কাফের? তবে, ফেকাহ্পন্থীরা কি
তাকলিদি ঈমানদার? যদি তা হয়, তাহলে তা যে শুধু ঈমান নয়, তা তো
ফেকাহ্পন্থীরাই বলেন। এমতাবস্থায় ইমাম মালেক (রহঃ) কী করে ঈমানদারকে কাফের
আর কাফেরকে ঈমানদার হওয়ার ধারণা পোষণ করতে পারেন? এটা হতেই পারে না। সম্ভবত
কোনো অর্বাচীন তাঁর বক্তব্যকে উল্টা লিখেছে। আর যদি সত্যই তিনি তা বলে
থাকেন, তাহলে আল্লাহ্ তাঁকে ক্ষমা করুন।
জনাব মৌলভী কেরামত আলী জৌনপুরীর
১২৮৬ হিজরিতে ছাপা ‘নূরুল হুদা’ পুস্তিকার ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,
মুকাল্লিদ তথা নকল বিশ্বাসী যখন তাসদিক তথা প্রত্যয় অর্জন করে তখন সে মুমিন
হয়। কেবল মৌখিক স্বীকারোক্তিতে মুমিন হয় না। যে ব্যক্তির তাসদিক তথা
প্রত্যয় অর্জিত হয়নি সে আহলে সুন্নতদের মতে মুমিন নয়। তার দলিল হল, আহলে
সুন্নতদের মতে বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য তাসদিক শর্ত। অপরদিকে মারেফাত ছাড়া
তাসদিক অর্জিত হয় না। আর মারেফাত অর্জিত হয় না প্রমাণাদি ছাড়া… ইত্যাদি।
অপরদিকে
উক্ত লেখক ইরফান তথা চাক্ষুষ পরিচয় দলিল তথা প্রমাণনির্ভর করেছেন। এটা
অসঙ্গত ও অবান্তর। কারণ মারেফত অর্থ জ্ঞাত হওয়া। আর প্রমাণ দ্বারা
প্রমাণসাপেক্ষ বিষয় প্রমাণ করাও দুষ্কর, তা দ্বারা কিছু সম্পর্কে জানা যেতে
পারে, পরিচিত হওয়া যায় না। অতএব ইরফান ও দলিলের ব্যাখ্যাগত সম্পর্ক
দ্বান্দ্বিক। বস্তুত গুণাবলিসহ সত্তাজ্ঞান বলতে যা বোঝায় কোনো বস্তুর
সম্পর্কে সে স্বরূপ ও গুণাগুণ সম্পর্কে সে জ্ঞান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সে
বস্তুকে চেনা সম্ভব নয়, আর যখন উক্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও সেরা হবে তখন ইলমে
ইরফান দালিলিক প্রমাণের পরও যে অস্পষ্টতা থাকে তা দূর করে প্রমাণিতকে চিনতে
পারে। এটাকে ইরফান বলা হয়। তা হলে সাধক আল্লাহ্র সত্তার সাথে পরিচিত হয়।
অতএব
গ্রন্থকার লিখেছেন, কোনো ব্যক্তির যখন চাক্ষুষ জ্ঞান হল যে, তার একজন
নির্মাতা আছেন এবং তিনিই সারা বিশ্বের নির্মাণকর্তা তখন সে তার তাকলিদের
গন্ডির মধ্যে থাকে না। এখানে গ্রন্থকার ঠিকই লিখেছেন যে, কোনো ব্যক্তি যদি
তার নির্মাতার পরিচয় পেয়ে যায়, তাহলে তিনি তার নিকট নির্দিষ্ট এবং পরিচিত
হয়ে যান তখন সে ব্যক্তি তাঁকে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকলিদের গন্ডি
পেরিয়ে যায়। কারণ এক্ষেত্রে তার বিশ্বাসের ভিত্তি হল পরিচয় এবং প্রত্যয়
যাতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে তিনি যে লিখলেন, ‘কোনো নির্মাতা
আছে’ এটা তো একটি অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট কথা। বস্তুত এ ধরনের উপলব্ধি দ্বারা
তো ইরফান, মারুফ ও স্পষ্টতার গন্ডিতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাহলে সে
ব্যক্তি তাকলিদের চৌহদ্দি পার হল কী করে? এটা অসঙ্গত বক্তব্য। অতঃপর তিনি
এর ব্যাখ্যাও করেন এবং বলেন যে, এর উদাহরণ হল, কোনো এক ব্যক্তিকে প্রশ্ন
করা হল, তোমাদের স্রষ্টা কে? সে ব্যক্তি উত্তর দিল, আল্লাহ্তা’য়ালা। আবার
তাকে প্রশ্ন করা হল আকাশ ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে? সে উত্তর দিল,
আল্লাহ্তা’য়ালা। তা হলে সে মুকাল্লিদ অর্থাৎ নকল বিশ্বাসী হবে না। অতএব
লেখকের এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কোনো প্রশ্নের উত্তরে জিজ্ঞাসিত
ব্যক্তি থেকে যা বেরিয়ে আসে তা-ই ইরফানের মূল বিষয় এবং মর্মার্থ, তার
ধারণা মোটেই সঠিক নয়। কারণ শ্রবণকর্তার শোনার উপর কারও ঈমান নির্ভরশীল নয়।
কেননা শ্রবণ আর স্বীকারোক্তি দুটি ভিন্ন জিনিস। স্বীকারোক্তির জন্য শোনা
শর্ত হলে ঈমানের জন্য অবশ্যই সাক্ষ্য শর্ত হত। লেখক স্বীকারোক্তিকে ঈমানের
শর্ত থেকে বাদ দিয়েছেন। কেননা ঈমান হল আধ্যাত্মিক অবস্থা যা বলা ও শোনার
ঊর্ধ্বে। তবে এখানে শ্রবণকারীর ঈমান আলোচ্য বিষয় নয় বরং জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির
ঈমানের বিষয়টাই এখানে আলোচ্য। শ্রবণকারীর শোনার ওপর কারও ঈমান নির্ভরশীল
নয় বরং ঈমান ‘তাসদিক’ এর ওপর নির্ভরশীল, যা ঈমানদারের আধ্যাত্মিক অবস্থা
এবং যা ঈমানদারের অন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপতিত হয়। স্বয়ং ঈমানদারই এ
অবস্থা সম্পর্কে জানেন এবং বোঝেন। অতএব শ্রবণকারীর শোনার ফলে
স্বীকারোক্তিকারী কী করে তাকলিদের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে? এটা অপ্রাসঙ্গিক
কথা।
অতএব বলা উচিত যে, প্রত্যেক ঈমানদারের ঈমান কোনো দলিল সাক্ষী ছাড়াই
অন্তর্¯ি’ত তাসদিকের নির্ধারিত স্থানে আপতিত হয়। এটা কোনো স্বীকারোক্তির
ওপর নির্ভরশীল নয়। কারণ ইকরার অর্থাৎ স্বীকারোক্তির পূর্বেই তাসদিক তথা
মানসিক স্বীকৃতি হয়। সুতরাং তাসদিকের পর হাজার বার ইকরার করা হোক বা একবার
করা হোক অথবা না-ই করা হোক, তাতে কোনো পরোয়া নেই। তবে তাসদিক একবারই
যথেষ্ট, দ্বিতীয় বারের কোনো প্রয়োজন নেই। ঈমানের জন্য যদি ইকরার শর্ত হয়,
তা হলে তা কতবার করতে হবে এবং আল্লাহ্র মাখলুকাতের সামনে যদি করতে হয় তা
হলে পৃথিবীব্যাপী কী করতে হবে? অবশ্যই তা নয়। এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার যে,
তাসদিকের বিষয়বস্তু জ্ঞাত না হলে তাসদিক হবে না। অজ্ঞাত বস্তুর প্রতি
বিশ্বাসটাই তাকলিদ। উল্লেখ্য, তাসদিকের জ্ঞান ও তা সংরক্ষণের জন্য আহওয়াল
অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতা অর্জন প্রয়োজন। উক্ত লেখক এখনও তাসদিক আর তাকলিদের
মর্মার্থই বোঝেন নি। বিভিন্ন পুস্তক দেখে দেখে এসব লিখে থাকবেন। ফলে এর
সীমা ও আদব রক্ষা করতে পারেন নি। একটু লক্ষ করুন, কোনো কোনো স্থানে তিনি
নিজেই নিজের কথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। উক্ত পুস্তিকার ৭ পৃষ্ঠায় তিনি
লিখেছেন,
উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, অন্তর জ্যোতির্ময় না
হলে নিজের এবং অন্যান্য বিশ্বের স্রষ্টার ক্রিয়াকর্ম, গুণাবলি এবং সত্তার
অস্তিত্বের যথার্থ পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। অতএব মনে রাখতে হবে যে, ঈমানের
ক্ষেত্রে তাকলিদ বৈধ নয়। কারণ ঈমানের জন্য তাসদিক তথা অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়
শর্ত। অথচ মুকাল্লিদের একটি শক্ত ধারণা হয় মাত্র। এটা সত্য যে, মুকাল্লিদের
শক্ত ধারণা হয়। এ জন্য এটাকে তাকলিদ বলব। কিন্তু লেখকেরই কথা যে, ঈমানের
স্বীকৃতির জন্য নিশ্চিত প্রমাণ আবশ্যক। এটাও তারই কথা যে, আধ্যাত্মিক বিশেষ
অবস্থা অর্জিত না হলে তাসদিক হয় না। এমতাবস্থায় তার কোন কথাটা ঠিক?
জিজ্ঞাসিত ও জবাবদাতার জবাব থেকে জানা যাচ্ছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা
হলেন আল্লাহ্। এটা যদি ঈমান হয় তা হলে হিন্দু ও অগ্নিপূজক প্রমুখ তো প্রকৃত
ঈমানদার। কারণ তারাও তো এ কথার বাইরে নয়। আফসোস! লেখক মুমিন ও মুকাল্লিদকে
একই মানে উল্লেখ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে মুমিন ও মুকাল্লিদ সমার্থক নয়। কারণ মুকাল্লিদের ঈমান হল অন্যের কাছ থেকে শোনা কথার ওপর অনুমানভিত্তিক ধারণা।
আল্লাহ্
এক, সর্বপ্রকার উপমা, বন্ধন, কারণ ও স্থান সবকিছু থেকে পবিত্র এবং আকাশ ও
পৃথিবী তিনিই সৃষ্টি করেছেন, মুকাল্লিদ এ সব কীভাবে জানবে! তার তো না আছে
আহওয়াল অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অবস্থিতি, না আছে ইরফান তথা আত্মপরিচিতি। সে তো
নিছক একটি অনুমানভিত্তিক ধারণার মুখাপেক্ষী। আর তাও তো সুস্থ বুদ্ধির ফসল
নয়। কারণ যার ঈমানি ধ্যানে যে জিনিসের অবস্থিতি নেই সে জিনিসের কল্পনা করা
অজ্ঞতা। অর্থাৎ যা অজানা, যার ধারণা, কল্পনা সম্ভব নয় এবং যা অজ্ঞাত সে
বিষয়ে কীভাবে দৃঢ়বিশ্বাস হবে? বরং কোন জিনিস সংক্রান্ত বিশ্বাসের আপন দৃঢ়
অবস্থানে আপতিত হওয়ার জন্য সে জিনিস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যাদিসহ জ্ঞাত হওয়া
দরকার। তা না হলে কিসের ওপর ঈমান আনবে; তা তো কোনো বস্তুই নয়Ñ যেমন ঘোড়ার
আন্ডা।
বস্তুত আল্লাহ্র সগুণসত্তা যা আপন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত তার জ্ঞান
আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া কখনো তাসদিক হতে
পারে না। অর্থাৎ, ঈমানদারের জন্য ঈমানের জ্ঞান আবশ্যক। আর তা-ই আহওয়াল
অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অবস্থিতি। অতএব, আহওয়ালে উত্তম-অধম স্তর হিসেবে ঈমানের
স্তরে তারতম্য হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি শক্তিশালী আহওয়ালের অধিকারী তার ঈমানও
শক্তিশালী এবং যথার্থ আর যে ব্যক্তি নিম্নস্তরের আহওয়ালের অধিকারী তার
ঈমানকে বিলগাইব তথা অদৃশ্যে ঈমান বলা হয়। তবে তা-ও ঈমানে আহওয়াল বহির্ভূত
শুহদী ঈমান অর্থাৎ চাক্ষুষ বিশ্বাস হলেও উহা অদৃশ্যে ঈমানের মতোই তাকলিদি
ঈমান।
উল্লেখ্য, শহুদ নিকট, প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ প্রভৃতি অবস্থার নাম।
শহুদের ক্ষেত্রেও উত্তম-অধম স্তর হিসেবে ঈমানের তারতম্য হয়। ‘জামেনূর’-এ
তার
সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। মানসিক অবস্থা যে ঈমান, আল্লাহ্র ঘোষণা মোতাবেক তাও তাওলিদ এবং ইসলাম। বলা হচ্ছে-
قالت الاعراب امنا قل لم تؤمنوا ولكن قولو اسلمنا ومايد خل الايمان فى قلوبكم –
(“ক্কালাতিল আ’রাবু আমান্না, ক্কুল লাম তু’মেনু, ওয়ালাকিন ক্কূলু আস্লাম্না অমা ইয়াদ্খুলুল্ ঈমানা ফী ক্কুলুবি কূম্।”)
অর্থাৎ,
আরবরা বলে, আমরা ঈমান এনেছি; বলুন, তোমরা ঈমান আননি, তবে তোমরা বল যে,
আমরা আত্মসমর্পণ করেছি বা ইসলাম এনেছি। কারণ, তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ
করে নি। (সূরা হুজরাত-১৪)। মোদ্দাকথা আরবরা যখন বলল যে, আমরা ঈমান এনেছি
তখন প্রতিবাদ করে আল্লাহ্ বলেন, হে মুহাম্মদ আপনি ওদের বলে দিন যে, তোমাদের
এখনও ঈমান আনা হয়নি; বরং তোমরা আত্মসমর্পণ করেছ মাত্র, এখনও তোমাদের
অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। অর্থাৎ তোমরা কেবল মুসলিম হয়েছ, ঈমানদার হওনি।
কারণ তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। আসলে অন্তরে প্রবেশ না করলে তা
ঈমানই নয়। তবে তাতে ইসলাম হয়। এ কথা দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, মুসলিম
মুকাল্লিদ বিল ঈমান অর্থাৎ ঈমানের ক্ষেত্রে পরানুসারী। সুতরাং বোঝা গেল যে,
ঈমানকে অন্তরে প্রবেশ করানোর জন্য যে জ্ঞান প্রয়োজন, তাও ঈমানের অন্যতম
শর্ত। তবে তকলিদ তথা কেবল শ্রুতি অথবা প্রশংসা ও মর্যাদা সংক্রান্ত
কাল্পনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস অর্জিত হয় তা বক্ষপটে আপতিত হয় এবং
স্থায়ী হয় না; শঙ্কা, বিপদ অথবা অনিশ্চয়তার সময় তা উঠে যায়। যেমন হাঁড়ির
পিঠে কোন জিনিস রাখলে থাকে না। আর ক্ষণিকের থাকাও কোনো থাকা নয়। একটু
নাড়াতেই তা পড়ে যায়। অথবা রৌদ্রে তা শুকিয়ে যায়। এজন্য মুকাল্লিদদের ধর্ম ও
ঈমান সদা টলটলায়মান। বস্তুত তাকলিদ এক প্রকার লবণাক্ত রসের মতো যা খাওয়ার
যোগ্য নয়। ঈমানদার এ তাকলিদি অবস্থা অতিক্রম করার পর তাকলিদের অবসাদ থেকে
নিষ্কৃতি লাভ করে এবং তখন সে আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ এ
অগ্রহণযোগ্য তাকলিদের কারণেই শত শত মুসলিম খ্রিষ্টান ও ব্রাহ্মণ ধর্ম গ্রহণ
করেছে। এসব লোক জানেই না যে, ধর্ম কি, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং খ্রিষ্টবাদ আর
হিন্দু ও মুসলিম কাকে বলে? এদের ঈমান, ঈমান নয়, তাকলিদ মাত্র। তারা জানে
যে, শরিয়তে ঈমানের ক্ষেত্রে তাকলিদ বৈধ নয়। তা সত্ত্বেও তারা তা মানে না।
উক্ত
গ্রন্থকারের আরও কিছু বক্তব্যের ধরন লক্ষ করুন। ‘মেফতাহুল জান্নাত’
পুস্তকে ঈমানের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন তার সারমর্ম হল- ঈমানের
মূল উপাদান দুটি। যথাÑ (১) মৌখিক স্বীকারোক্তি ও (২) অন্তরের বিশ্বাস। তবে
মুখে স্বীকার করে অন্তরে বিশ্বাস না করলে সে ব্যক্তি আল্লাহ্র নিকট কাফের
এবং আমাদের কাছে মুনাফেক। আর স্বীকার ও বিশ্বাস দুই করে সে ব্যক্তি প্রকৃত
মুমিন। এমতাবস্থায় গ্রন্থকারের কোন কথাটি সত্য? এখানে তিনি মৌখিক
স্বীকারকারীদের কাফের ও মুনাফেক বানিয়েছেন। অর্থাৎ তার মতে যার অন্তরের
বিশ্বাস নেই, কেবল মৌখিক স্বীকারোক্তি আছে সে ব্যক্তি কাফের মুনাফেক। আর
যার অন্তরে বিশ্বাস আছে সে ব্যক্তি আল্লাহ্র নিকট মুমিন। অতএব যে জিনিসের
দ্বারা আল্লাহ্র কাছে মুমিন হয়, মানুষের কাছে সে ব্যক্তি মুমিন নয়, এ কথার
ভিত্তি কী? তাহলে কি কাজ ও ঈমান মানুষকে জানানো ও প্রচার করা ঈমানের শর্ত ও
মূল উপাদান? কারণ তার মতে স্বীকারোক্তি দ্বারাই ঈমানের যথার্থতা প্রমাণিত
হচ্ছে। অর্থাৎ তার বর্ণনা মতে বিশ্বাসজাত ঈমানটি কাল্পনিক বা ধারণামাত্র।
তার অবশিষ্ট যথার্থতা স্বীকারোক্তি দ্বারা পূর্ণ হল। এ হিসেবে বোঝা যায়,
মৌখিক স্বীকারোক্তিই ঈমানের মূল ও মানদন্ড। এজন্য তিনি অন্তরের দৃঢ়
বিশ্বাসজাত ঈমানকে কল্পিত আখ্যায়িত করেছেন।
গ্রন্থকারের অনুরূপ বক্তব্য
জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে। তার রচনা ‘মেফতাহুল জান্নাত’ পুস্তকে তার
বক্তব্যের লক্ষণীয় বিষয়টি হলÑ তিনি লিখেছেন প্রথম পরিচ্ছেদ ঈমানের বর্ণনায়,
হে বন্ধুগণ, তোমরা সকলেই অবগত হও যে, ঈমান হল সব পুণ্যকর্মের মাথা এবং সকল
ইবাদতের মূল। আর বিশুদ্ধ ঈমান ছাড়া কোনো ইবাদত ও পুণ্যকর্ম বিশুদ্ধ হয় না
এবং ঈমানের মূল উপাদান দুটি ইত্যাদি। গ্রন্থকার এখানে ঈমানের বর্ণনা
করেছেন। কিন্তু তিনি ঈমানের এমন কোনো পরিচয় তুলে ধরেননি যা দ্বারা ঈমানের
কর্মস্থলের পরিচয় ও মর্মার্থ প্রতীয়মান হয়। কোনো বস্তুর সুস্পষ্ট জ্ঞান না
হওয়া পর্যন্ত সে বস্তুর বিভাজন এবং বিবরণ দেওয়া কী করে সম্ভব হয়? সম্ভবত
তার ঈমানের বিমূঢ়তাই তার মুখে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি তার ‘নূরুল হুদা’
পুস্তকের ১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেনÑ হাত, পা প্রভৃতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজকে
যেমনই কাজকর্ম বলা হয়, অন্তরের কাজকে তেমনই হাল ও আহওয়াল বলা হয় এবং ফেকাহ্
শাস্ত্রে যেভাবে কার্যাদির বর্ণনা করা হয় সেভাবেই তাসাওফে আহওয়াল সম্পর্কে
আলোচনা করা হয়। আহওয়াল তাসাওফের আলোচ্য বিষয়। ঈমান, তাসদিক, ইয়াকীন সবই এক
এবং সবই আহওয়ালের অন্তর্ভুক্ত। উক্ত গ্রন্থকারের এ আলোচনা থেকে বোঝা
যাচ্ছে যে, অন্তরের কার্যাদি তথা আহওয়ালই ঈমান ও তাসদিক। তার এ বক্তব্য
সঠিক। কারণ কার্যাদি সম্পাদন ও হুকুম পালন করা মনোযোগ ছাড়া সম্ভব নয়। বরং
মনের ওপরই কর্ম নির্ভর করে ঈমানের ন্যায়। ঈমান কর্মের ওপর নির্ভর করে না।
বরং কর্মই ঈমানের ওপর নির্ভরশীল। এবার লক্ষ করুন, লেখক সাহেব কীভাবে এ
আকিদা থেকে আবার সরে যাচ্ছেন।
উক্ত পুস্তকের ১৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,
ত্বরিকতের পথে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত অর্জিত হয়। ফলে শরিয়তের
নির্দেশাবলি পালনে দৃঢ়তা আসে। অতএব ত্বরিকত শরিয়তের কোঠায় প্রবেশের
সিঁড়িস্বরূপ এবং ত্বরিকত শরিয়তের খাদেম। দরবেশী ও তাসাওফের মূল উদ্দেশও
এটাই।
এখন চিন্তার বিষয় হল এই যে, যা ঈমান ও বিশ্বাস তথা আহওয়াল তা কী
করে শরিয়তের কোঠায় প্রবেশের সিঁড়ি ও খাদেম হয়? বরং যা মূল ও লক্ষ্য তা-ই
সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হয়ে থাকে যেখানে আরোহণের জন্য সিঁড়ি প্রয়োজন হয়।
আগে কামরা পরে সিঁড়ি এবং আগে প্রভু পরে তাঁর খাদেম প্রয়োজন। অর্থাৎ কর্মের
পূর্বে ঈমান দরকার। গ্রন্থকার যাকে আহওয়াল এবং অনন্ত প্রভাব বলে উল্লেখ
করেছেন। তা কী করে শরিয়তের কোঠায় গিয়ে ঠেকে গেল? তা হলে শরিয়তের সংজ্ঞা কী?
একি
বিপদ যে, বার বার আহওয়ালে শহুদ অর্থাৎ সাধকের তত্ত্বে মগ্ন অবস্থাকে
ইত্তেহাদ অর্থাৎ অদ্বিতীয় সত্তায় একীভূত ভাবা হচ্ছে। আক্ষেপ, তাওহীদ
অহ্দাতে অজুদ অর্থাৎ অদ্বিতীয় সত্তায় একীভূত হওয়ার ব্যাপারে যার
বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই সে অজুদ, শহুদ, তাওহীদ এবং ইত্তেহাদ এর অর্থ কী করে
বুঝবে? সাধনার ধারায় প্রথম হল সংকল্প বা ইচ্ছা, অতঃপর সাধনা, তারপর আহওয়াল,
এরপর শহুদ এবং সর্বশেষ হল ইত্তেহাদ অর্থাৎ একীভূত হওয়া। যার চূড়ান্ত
পরিণতি ও মর্মার্থ হল স্থবির ও নিশ্চলতা।
উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যক্তি
নিজেকে সাগরে উৎসর্গ করার ইচ্ছা করল এটা তার সংকল্প। অতঃপর সে সাগরের কূলে
গেল, এটা তার চেষ্টা বা সাধনা। অতঃপর সে নৌকাযোগে সাগরের বুকে পৌঁছাল, এটা
তার সাগর অবলোকন বা মুখোমুখি হওয়া। অতঃপর সাগরে হারিয়ে যাওয়াটা তার
প্রাপ্তি এবং সব শেষে সাগরের সাথে হিম হয়ে জমে যাওয়াটা তার একাত্মতা। অতএব
সাধনার ধারায়, এ বিভিন্ন অবস্থায়, যখন যে জ্যোতি প্রকাশিত হবে সে অনুযায়ী
তার নামকরণ করা হবে। যথা কর্মজ্যোতি, ছায়াজ্যোতি, গুণজ্যোতি, সত্তাজ্যোতি
এবং অনুরূপ হাজারো জ্যোতি জ্ঞান ও রকমারি অবস্থা তার থেকে প্রকাশিত হতে
থাকবে। তবে এগুলোকে আল্লাহ্র গুণগত জ্যোতি বলা হলেও বস্তুত গুণের উৎস
আল্লাহ্র সত্তা মূল থেকে ভিন্ন নয়।
সূফীদের পরিভাষায় ‘শহুদ’ একটি
অবস্থার নাম যা গুণজ্যোতির প্রভাব ও প্রকাশ। কিন্তু ফানা তথা
আত্মবিলীনান্তে যে অস্তিত্বটুকু অবশিষ্ট থাকে তা পরম সত্তারই প্রথম
ক্ষেত্র। অতঃপর স্থবির নিশ্চলতা। এটা মোকামে বাক্কা অর্থাৎ স্থিতাবস্থার
সারকথা। এখানে ফানা এবং বাক্কার কোনো অবকাশ নেই। এ পর্যায়ে অস্তিত্ব আর
অস্তিত্ব তথা জীবন আর জীবন। কেউ যদি হাজার বছরও চেষ্টা করে, তাহলেও এ
অস্তিত্ব ফানা বা বিলুপ্ত হবার নয়। যে সত্তার অস্তিত্ব চিরন্তন কে তাকে
ফানা করে? এটা পারে এমন কোনো প্রমাণ তো আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ের জ্ঞান একবার নিজের মধ্যে ধারণ
করে এবং তারপর যদি সে তা নিজে থেকে মুছে ফেলতে চায়, তা হলে সে কখনো তা
পারবে না। হ্যাঁ, সে যদি কখনো তা ভুলে যায়, তাহলে সেটা হবে আলোর পরে
অন্ধকারের মতো অর্থাৎ জ্ঞানের পর অজ্ঞতা, এটা বিলুপ্ত করা নয়। অতএব যে সাধক
সত্তা প্রাপ্ত ও একীভূত হতে পারে নি, সে তো সাধকই নয়। সে তো জ্ঞানশূন্য
মূর্খমাত্র। বরং তাওহীদে ইত্তেহাদ অর্থাৎ একীভূত হওয়ার অস্বীকারকারী হিসেবে
সে কাফের। কারণ সে স্রষ্টার সত্তার অস্বীকারকারী। আর পরম সত্তা ও তাঁর
গুণাবলির অস্বীকারকারী আহওয়াল অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অবস্থার অস্বীকারকারীও
বটে। তবে সত্তার পরিচয় পাওয়া গেলে গুণাবলি যা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য
এমনিতেই পরিচিত হয়ে যায়। অপরদিকে গুণাবলির পরিচয় ধরে সত্তার পরিচয় পাওয়া
যেতে পারে কেবল তখনই যদি তার ধ্যানে কামিল মুর্শিদ বর্তমান থাকেন। অন্যথায়
হাজার বছরও যদি গুণাবলিকে ধারণ করে রাখে এবং নিজেকে ফানা না করে তাহলে কখনো
পরম সত্তার সন্ধান লাভ হবে না। এজন্য সাধক ব্যক্তিগণ তাজাল্লি অর্থাৎ
জ্যোতিসমূহকে বিলুপ্ত করতে থাকেন। আবার যখন সত্তাপ্রাপ্ত হন তখন সেসব
গুণাবলি তাঁর সামনে আবার ভেসে ওঠে। তখন আর এগুলোও বিলুপ্ত করা বা পরিহার
করা সম্ভব হয় না। অপরদিকে তখন এ গুণাবলির মধ্য দিয়েই পরম সত্তা প্রকাশিত ও
প্রমাণিত হয় এবং তখন তাঁকে বিলুপ্ত করার জন্য হাজার চেষ্টা করলেও তা
বিলুপ্ত হবার নয়। যে বস্তুর বিলুপ্তি ঘটানো সম্ভব, তা সত্তা-ই নয়। অতএব যে
ব্যক্তিসত্তা অস্তিত্বপ্রাপ্ত হয়ে গেছে সে অস্তিত্ব আল্লাহ্র, আল্লাহ্র
সত্তার সাথে মজুদ তথা রক্ষিত হয়ে গেছে। তাঁকে নিত্য ও স্থায়ী বলাই যথার্থ
হবে। কারণ অনুরূপ পরম সত্তায় পরিপূর্ণ একীভূত হওয়াই সকল অলীর লক্ষ্য এবং
উৎস। এমন কোনো অলী বা নবী নেই যার তাওহীদ ইত্তেহাদ তথা পরম সত্তায় মিলন হয়
নি। কোরানের ঘোষণাটি লক্ষ করো; বলা হচ্ছেÑ وهو معكم اين ماكنتم (ওয়া হুয়া
মাআ’কুম আইনামা কুন্তুম্) অর্থাৎ তিনি তোমাদের সাথেই আছেন, তোমরা যেখানেই
থাক। (হাদীদ : ৪) কোরানের ঘোষণাকে এ গণিমত অর্থাৎ অনায়াসলব্ধ মহাসম্পদ মনে
করো। এটা কালামে ইত্তেহাদি অর্থাৎ মিলন বাণী। তোমাদের যদি পছন্দ হয়, তাহলে এ
মিলনমান যা নবী-অলীগণ লাভ করেছেন, তোমরাও নিজেদের সে সাথে সংযোগ স্থাপনের
চেষ্টা করতে পার। তাহলে তোমাদের জন্যও এ মর্যাদা লাভ করা সহজ হবে। আর তোমরা
যদি তা না পার তাহলে এ সংক্রান্ত যেসব রচনাবলি পাওয়া যায় তা গভীরভাবে
অনুধাবন কর, তা হলে বুঝবে যে, এ বক্তব্য সেসব কবিতা ও কথার পিঠে লবণস্বরূপ
যা মানুষ বুঝতে অক্ষম। তাঁদের উক্ত অসাধারণ বাক্যগুলো আমার অজানা হলেও আমি
তাঁর সৌজন্যবোধ থেকে বঞ্চিত নই। সে যাহোক, যারা লেখালেখি করেন অন্যের কথাকে
নিজের বলে চালান, আবার তাতে হস্তক্ষেপ করেন, স্থানে স্থানে নিজ যোগ্যতা
মোতাবেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন, আমার বুঝে আসে না, কেন তাদের মধ্যে এরূপ
আটা বা ময়দা দেখবার মনোবৃত্তি প্রবেশ করল। আক্ষেপ, পীর হওয়ার জন্য আল্লাহ্র
প্রতি অনুরূপ ভয়শূন্য হওয়া কি বৈধ? হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রা.) এবং
হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী প্রমুখদের বক্তব্যকে নিজের ভ্রান্ত পথের
সমর্থনে পেশ করা এবং ধূলাবৃত আবরণকে আকাশের মেঘ বলা কেমন কথা?
লক্ষণীয়
যে, উক্ত গ্রন্থকার অজ্ঞ খরিদ্দারদের কাছে নকল স্বর্ণ বিক্রির মতো নিজ
মুরিদদের জন্য বয়আ’ত নামে একটি মনগড়া শব্দ চালু করেছেন। এটাকে ‘বয়আ’ত গ্রহণ
বলা হয়। আবার তাকে ‘অজীফা’র মতো পাঠ করান। তা এ রকমÑ আমি অমুক, অমুকের
হাতে হাত রেখে চিশ্তিয়া, কাদরিয়া, নক্শবন্দিয়া, মুজাদ্দেদিয়া এবং
মোহাম্মদিয়া ত্বরিকা মতে বয়আ’ত করলাম। অমুকের হাতের স্থলে যিনি বয়আ’ত করান
তার নাম বলা হয়। বলবেন কি এ বাক্যটি কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত? গ্রন্থকার
তো হাদিসপন্থীদের বেদ’আতী এবং নিজের দাদাপীরকে দাজ্জাল বলেছেন। দাজ্জাল তো
কাফের। এমতাবস্থায় বয়আ’তে উচ্চারিত নিষ্ফল কথাগুলো যাতে কাি ঙ্খত
ত্বরিকাসমূহের নাম রয়েছে, সেসব ত্বরিকার কোন খলিফা অথবা খলিফার খলিফা
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে পাঠ করান। এখন বলুন, এ দাজ্জাল কিনা? তওবা বা
কাক্সিক্ষত বস্তু লাভ করার জন্য কোনো ছলনার প্রয়োজন আছে?
গ্রন্থকার
‘নূরুল হুদা’ পুস্তকের ১৩ পৃষ্ঠায় লিখেন, দরবেশি কোনো গ্রাস নয় যে, মুর্শিদ
মুরিদের গলার ভিতর ঢেলে দিবেন। তিনি ‘কওলুচ্ছাবেত’ পুস্তকে লিখেছেন, যে
ব্যক্তি শরিয়ত ও মারেফত উভয় প্রকার জ্ঞানে জ্ঞানী নয় তার কাছে বয়আ’ত গ্রহণ
করা এবং তাকে খেলাফতনামা প্রদান করা বৈধ নয়। অনুরূপ ওহাবী, অমাযহাবী,
ফরাজী, খারেজী এবং বেদ’আতী পীরজাদা যদি উভয় জ্ঞানে এবং মাশায়েখের
মর্যাদাবঞ্চিত হয় তাদের কাছেও বয়আ’ত করা বৈধ নয়। বরং কেউ যদি অনুরূপ
জাহেলের কাছে বয়আ’ত করেও থাকে তা হলে ঐ বয়আ’ত থেকে তওবা করা এবং তার
সম্পর্ক ছিন্ন করা তার ওপর ওয়াজিব। সূরা আ’রাফে আল্লাহ্ বলেন, واعرض عن
الجاهلين (ওয়া আ’রাদু আ’নিল জাহিলীন) (আয়াত নং ১৯৯) অর্থাৎ, জাহেলদের থেকে
নিবৃত্ত হও। এ ফকিরের মনে পড়ে আলোচ্য লেখক তার কোনো এক পুস্তকে লিখেছেন যে,
যে ব্যক্তির তাসাওফের জ্ঞান নেই সে যন্ত্রপাতিহীন ক্ষৌরকারের মতো এবং এ
প্রসঙ্গে একটি ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। এখন প্রশ্ন হল, লেখকের উক্ত নিষ্ফল
বয়আ’ত বাক্যটি কি কোনো গ্রাস যে, দ্রুত তার সঙ্গে চার/পাঁচ ত্বরিকার বয়আ’ত
সম্পন্ন করা হল? সাবাশ, এক দমে পাঁচ ত্বরিকা গলাধঃকরণ হয়ে গেল। অথচ বছরের
পর বছরব্যাপীও এর যে কোনো একটি ত্বরিকার সফর ও সাধন শেষ করা দুষ্কর আর তা
একদমে চূড়ান্ত। ভালো পীরজি তো বহুদিন থেকেই এ কাজ করছেন। তবে যে মুরিদকে
আজই বয়আ’ত গলাধঃকরণ করানো হল সে এটাকে বাসি হতে না দিয়ে বরং অবিলম্বে অন্য
লোকদের বয়আ’ত দ্বারা সম্মানিত করায় লিপ্ত হয়ে গেল। আচ্ছা দশটা লোক হাত করাই
যদি উদ্দেশ হয় তাহলে চারটি ত্বরিকার নামই তো যথেষ্ট ছিল। মোহাম্মদিয়া আবার
কোন ত্বরিকার নাম, এর কার্যক্রম কী বা কোথায়, আমাদের দেখাবেন? আমার মনে
পড়ে লেখক ‘মোহাম্মদিয়া ত্বরিকা’ নামকরণের এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, জনগণ
জনাব সৈয়দ আহাম্মদ সাহেবকে মোহাম্মদিয়া ত্বরিকার নামকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, প্রচলিত চারটি ত্বরিকাকে আমরা একত্রে
মোহাম্মদিয়া ত্বরিকা নাম রেখেছি। কারণ, ঐ চারটি ত্বরিকার ওপর আমরা এভাবে
আমল করি যেন চারটি ত্বরিকাই এক। আফসোস! যে যে ত্বরিকা স্ব স্ব রূপে
বর্তমান, তা চারটি মিলে একটি হয় কী করে? তাহলে যার মাত্র দুটি ত্বরিকা
হাসিল হয়েছে, তার নাম কি অর্ধ মোহাম্মদিয়া ত্বরিকা রাখা হবে? আর যার চারের
অধিক ত্বরিকা হাসিল হয়েছে তার নাম কি ডবল মোহাম্মদিয়া ত্বরিকা রাখা হবে?
আসলে
এটা একটা তামাশা। মূল কথা হল যে, ওহাবীরা নিজেদের ‘মোহাম্মদিয়া’ বলে থাকে।
তারা প্রচার করে যে, আমাদের ত্বরিকা হল ‘মোহাম্মদিয়া’। যাদের সন্দেহ হয়
তারা ‘তোহ্ফায়ে মোহাম্মদিয়া’ ইত্যাদি দেখতে পারেন। অথচ তাতে না
ক্রিয়াকর্মের কোনো পার্থক্য আছে, না তাদের নিজেদের নতুন সংযোজন আছে। অযথা
ত্বরিকার নাম নিয়ে কী লাভ! প্রকৃতপক্ষে এটা যদি তাদের আবি®কৃত নতুন কোনো
ত্বরিকা হয়ে থাকে, তাহলে লেখকের মতে তা তো হারাম এবং এর অনুসারীগণ
দাজ্জালের উত্তর কী? কারণ এটা কোনো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই এটা
বেদআ’ত এবং বেদ’আত কাজ যে করে তাকে তিনি দাজ্জাল বলে উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া
উল্লিখিত লেখকের সবগুলো পুস্তিকাই পরচর্চা, গালমন্দ ও বেহুদা কথায়
পরিপূর্ণ। তাসাওফ ও বেলায়েতের আলোচনায় অন্যের দোষত্রুটির দিকে দৃষ্টি যায়
কী করে? সময়টা তো এরূপ নয়। বস্তুত আরেফ ও কামেল ব্যক্তিগণ যখন কিছু লেখেন
বা বর্ণনা করেন, তখন তাঁরা নিজেকে সব ভালো-মন্দের থেকে আলাদা করে নেন এবং
কেবলমাত্র আল্লাহ্র অনুকম্পার প্রতি নিবিষ্ট থাকেন। কাজটি যদি ফানা ফিল্লাহ
ও বাক্কা বিল্লাহর মোকামের হয় তাহলে প্রত্যেকটি অক্ষরের মিলনের ফলে এবং
বাস্তব লিপিরীতির ফলশ্রুতিতে তা থেকে তাওহীদ তথা ঐক্যের রচনাই বেরিয়ে আসবে।
অথচ উক্ত লেখক সাহেবের জনৈক মুরিদ মুন্শি আবদুল আজিজ মুল্ফত্গঞ্জী সাহেবের
বাংলা ভাষায় রচিত রুদ্দুল মুফসেদীন পুস্তিকায় যাতে আলোচ্য গ্রন্থকার
জৌনপুরী সাহেবের কতিপয় মতামতসহ দস্তখত রয়েছে এবং যাকে তারা ফতুয়া বলে
থাকেন, তাতে কলন্দরিয়া, মাজহারিয়া, শাদিয়া, মাদারিয়া, অজুদিয়া, শহুদিয়া
প্রভৃতির মতো বড় বড় ত্বরিকার লোকদেরকে দোযখী, কাফের ও ফাসেক বলে উল্লেখ করা
হয়েছে। তবে তারা তা নন। তাহলে আলোচ্য গ্রন্থকার ও তার মুরিদ কোন স্তরের
বেলায়েত হাসিল করেছেন? শহুদ তো এক প্রকার সূক্ষ্ম প্রেম, যা মা’শুকের গুণগত
প্রতিফলনের মাধ্যমে ছায়া ও উপস্থিতরূপে মুখোমুখি হয়। তবে এটা আহওয়ালের
মর্ম আর শহুদ হল তারই ফলন পর্যায়। এরপর সাধকের আহওয়ালের উৎস যখন বাস্তব হয়ে
আসবে, তাঁর নাম হবে ‘অজুদ’ অর্থাৎ পরম সত্তা। অতএব ইতোমধ্যে যার সে ‘অজুদ’
অর্জিত হয়েছে, যে তার বিরুদ্ধে বলে সে মিথ্যাবাদী অথবা কাফের। কারণ সে
প্রতিষ্ঠিত তথা যা প্রকৃত সত্যের অস্বীকারকারী এবং বিরোধী। এখানে সত্য অর্থ
স্বতঃসিদ্ধ সত্যের প্রকাশ যা স্বতঃসিদ্ধ সত্তার উৎস ও সার এবং মুর্শিদের
একমাত্র মক্সুদ হলো তাতে নিজের প্রকাশ ঘটানো। মক্সুদ হিসেবে পরম সত্তায় যখন
প্রেমিকের সত্তা প্রকাশ পায় তখন তা ফানা ফিল্লাহর মানে পৌঁছে। আর পরবর্তী
সত্তা যখন আদি সত্তায় প্রকাশিত হয় তখন তা হয় প্রকৃত বিকাশ। অর্থাৎ
স্বতঃসিদ্ধ সত্তার বিকাশক্ষেত্র বান্দা আর বান্দার বিকাশক্ষেত্র হল
স্বতঃসিদ্ধ সত্তা। এটাই হল স্বতঃসিদ্ধতার সূত্র। অর্থাৎ, মূলসমূহের স্থিতি
এবং নশ্বর বস্তুসমূহের প্রকাশ আদিস্তরে স্বতঃসিদ্ধ সত্তা থেকে না হলে এমন
কোনো নাস্তিজগৎ থাকে না আল্লাহ্ ছাড়া, যা থেকে কোনো বস্তু প্রকাশ হতে পারে।
অধিকন্তু এমন কোনো স্থান বা জায়গাও নেই যেখানে স্বতঃসিদ্ধ সত্তা মূলরূপে
বর্তমান নেই। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, দ্বিতীয় তথা নশ্বর বস্তুটি পূর্ব
থেকেই অনাদি সত্তায় থাকা অপরিহার্য এবং অনাদি সত্তারও সবকিছুই আদি উৎস
হওয়ার কারণে পরবর্তী বস্তুসমূহে প্রকাশ ও অবস্থান অনিবার্য। এটা কখনো ফানা
বা বিলীন হবার নয়। অর্থাৎ বান্দার বিলীনান্তে যা অক্ষুণ্ন থাকে তা মূল
স্বতঃসিদ্ধর ফসল এবং গোপনীয় অংশ; যেমন রূহ্ এবং রূহের রূহ্ অনাদি সত্তা। তা
না হলে যে বস্তু আল্লাহ্ থেকে অস্তিত্বশীল নয় তা কোথা থেকে অস্তিত্ব লাভ
করবে? বিশেষ করে স্রষ্টা এবং তাঁর খাস মাখলুকের মধ্যে একটি আদি রহস্যময়
বিভেদ রয়েছে যা প্রেমরবিতে মনোযোগ প্রদানের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য সে উভয়
পক্ষের এক পক্ষকে আশিক ও অপর পক্ষকে মা’শুক বলা হয়। এ কারণে একে অন্যের
মাহবুব এবং প্রকাশস্থল হিসেবে গণ্য। গ্রন্থকার এর কাছেও যায় নি।
উক্ত
পুস্তিকার ৩৩ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার লেখেন, যখন বোঝা গেল যেসব আহওয়াল তথা
আধ্যাত্মিক অবস্থাদি তাঁর সিফাত তথা গুণাবলি থেকে প্রকাশিত তখন কর্মসমূহে
দৃষ্টি পড়ে না তাঁর গুণাবলির প্রতি দৃষ্টি যায় গুণাবলি উন্মুক্ত হয়ে যায়
এবং বান্দার গুণাবলিকে আল্লাহ্র গুণাবলির ছায়া মনে করা হয়। এতে বিবরণটা
প্রায় সঠিক হয়। এটাকে গুণাবলির জ্যোতি বলা হয়। এ সময়ে সাধক তুষ্ট ও সমর্পিত
অবস্থা ধারণ করে… ইত্যাদি।
এখন লেখকের উপলব্ধি, যোগ্যতা এবং সাধনা
সিদ্ধি সম্পর্কে চিন্তা করুন; তিনি লিখেছেন, যখন বান্দার ওপর আল্লাহ্র
গুণাবলি প্রকাশিত হয় সে অবস্থায় বান্দার গুণাবলিকে আল্লাহ্র গুণাবলির ছায়া
মনে করা হয়। এখানে মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার মূলের
অনুরূপই হয়। এ কারণে মূলের হুবহু প্রতিচ্ছায়াই আয়নাতে প্রতিবিম্বিত হয়।
অতএব বান্দার গুণ যদি আল্লাহ্র গুণের ছায়া হয় তাহলে সত্তা ও মূলও একে
অন্যের ছবি ও ছায়াই হবে। অর্থাৎ আল্লাহ্র সত্তার ছায়া বান্দার সত্তা এবং
মূলের ছায়া মূল। যখন আল্লাহ্র ছায়া থেকেই সব সৃষ্টি এবং সৃষ্টিজগৎ হয় তাহলে
তার উৎসমূল হবে ছায়া। এমতাবস্থায় কোনো বান্দা যদি উহাতে ফানা ও মিলিত হয়
তার নাম ফানা ফিল্লাহ হবে না, হবে ‘ফানা ফিল আক্স’ অর্থাৎ ছায়াতে বিলীন
হওয়া। সুতরাং এটাও বলা সঙ্গত হবে না যে, যেখানে আল্লাহ্র নূর আছে সেখানে
সত্তাও আছে। নূরে যদি সত্তাও থাকে তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, নূর সূর্যের
মতোই মৌলিকবস্তু উত্তপ্ত সীসা বা আয়না সূর্যরশ্মির বিপরীতে ধরলে তৎক্ষণাৎ
তা থেকে আগুন বেরিয়ে আসবে। এতে জানা যায় যে, সূর্যের প্রকৃতি অগ্নিময় এবং
এর সত্তায় আগুন বর্তমান। তা না হলে এর ছায়া থেকে কী করে আগুন বের হবে!
এমতাবস্থায় ছায়া ও আগুন উভয় বস্তুর একই উৎসের সাথে সম্পর্কিত হওয়া আবশ্যক।
তা না হলে তা থেকে আগুন বের হওয়া সম্ভব হত না। এ মৌল উৎসের ব্যাখ্যার প্রতি
আল্লাহ্তা’য়ালা ইশারা করছেন, سترهم ايا تنا فى الا فاق وفى انفسهم
(সাতুরীহিম আয়াতিনা ফিল্ আফাক্কি ওয়া ফি আন্ফুসিহিম) অর্থাৎ, অচিরেই আমরা
বিশ্বময় এবং তাদের নিজেদের আমাদের নিদর্শনাদি দেখাব। (সূরা হামিম
সেজদা-৫১)। অর্থাৎ, তোমরা যেমনই দেখছ যে, সূর্যরশ্মি তোমাদের আশেপাশে
চমকাচ্ছে তেমনই অচিরেই তোমাদের উত্তপ্ত আয়নারূপ আত্মায় আমাদের নিদর্শনাদি
উদ্ভাসিত করব। এ ব্যাপারে তোমাদের সৌকর্য না থাকলে এ বিষয়ে যাঁদের
প্রত্যক্ষ বিশ্বাস অর্জিত হয়েছে তাঁদের শরণাপন্ন হও। তাহলে এটা বোঝা
তোমাদের জন্য কঠিন হবে না। আল্লাহ্ বলেন, وفى الارض ايات للموقنين وفى
انفسكم افلا تبصرون – (ওয়াফিল আরদি আয়াতিলিল্ মূক্কেনীন ওয়াফী আন্ফুসিকুম
আফালা তুবছিরুন) অর্থাৎ, নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে এবং তোমাদের
নিজেদের মধ্যে নিদর্শনাদি বর্তমান তোমরা কি তা অবলোকন করো না। (সূরা
বারায়াত-২০) তোমরা যদি এটা মান তাহলে এ বিষয়ে রাসূলের বাণীতে তোমাদের জন্য
সুসংবাদ রয়েছে। তিনি বলেন, من عرف نفسه فقد عرف ربه (মান্ আ’রাফা নাফ্সাহু
ফাক্বাদ আ’রাফা রাব্বাহু) অর্থাৎ, যে নিজেকে চিনেছে, সে তাঁর প্রভুকেও
চিনেছে। এ বাণীতে বিশ্বাসীদের কাছে প্রমাণিত এবং মূলনীতির বিচারে যথার্থ।
আল্লাহ্র নূর ও ছায়ার মধ্যে যেরূপ সম্পর্ক আহলে ইয়াকীন তথা
প্রত্যক্ষবিশ্ববাসীদের ছায়ার সাথেও একই রূপ সম্পর্ক। উত্তপ্ত কাচের ছায়া
থেকে যেহেতু আগুনের প্রমাণ পাওয়া যায়, সেহেতু সূর্যের ছায়া থেকে কাচে
আগুনের অস্তিত্বের প্রমাণ অনস্বীকার্য। যেহেতু কাচের ছায়াটি সূর্যের ছায়ারই
ছায়া, সেহেতু বস্তুত একই ছায়া দুভাবে পতিত হয়েছে মাত্র। এ হিসেবে ‘ফানা
ফিশ্ শাইখ’ অর্থাৎ মুর্শিদে আত্মবিলীন ফানা ফিল্লাহ তথা আল্লাহ্তে বিলীন
হওয়ারই প্রতিবিম্ব এবং সংমিশ্রণ। মাওলানা রুমী বলেনÑ چونكه ذات چير راكر دى
قبول هم خدادرزاتت امد هم رسول – (চুকে জাতে পীরেরা কারদি কবুল। হাম খোদা
দর জাতাত আমদ হাম রসূল।) অর্থাৎ, পীরের সত্তা তুমি যবে করিলে গ্রহণ
প্রবেশিল তোমাতে আল্লাহ্ রাসূল উভয় অনুক্ষণ। অতঃপর মাওলানা রুমী আরও স্পষ্ট
করে বলেন, এর আরও বিশ্লেষণে কলম স্তব্ধ হয়ে গেছে। সাধক জ্যোতিস্তর অতিক্রম
করে সয়ম্ভুমূলে অধিষ্ঠিত হলে তাঁর মধ্যে আত্মসমর্পণের ভাব উদয় হয়। এটা এ
সোপানের চূড়ান্ত পর্যায়। অতপর আল্লাহ্র কৃপা লাভের সৌভাগ্য হলে মূলের পথে
তার যাত্রা শুরু হবে।
গ্রন্থকার লিখেছেন যে, গুণজ্যোতি থেকে আত্মতুষ্টি ও
সমর্পণ লাভ হয়। তিনি যিল্লুন্ শব্দের যে অর্থ লিখেছেন তা তো বোঝা গেল।
কিন্তু প্রতিবিম্ব বা ছায়ার অর্থ সত্তা আয়ত্ত হলেই কেবল বোঝা যেতে পারে।
অপরদিকে এটাও বোঝা গেল যে, আল্লাহ্ সত্তা ও গুণ উভয়রূপেই সৃষ্টিতে আবিষ্ট
এবং বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং প্রত্যেক বস্তুই স্ব স্ব রূপে আল্লাহ্র সত্তায়
বর্তমান। যেমন আগুনের দহন শক্তি আগুনের মধ্যে বর্তমান থাকার নামই আগুন।
তাছাড়াও আগুনের অনেক গুণ রয়েছে। সেগুলোকে ছায়া, প্রতিরূপ অথবা সত্তার
বৈশিষ্ট্য যা-ই বলুন, যথার্থ হবে। উদাহরণস্বরূপ দাহ, ধুঁয়াচ্ছন্নতা, আলো
এবং রঙ ইত্যাদি সবই আগুনের সত্তা থেকে প্রকাশিত হয়। একভাবে নয়; হাজারও ভাবে
তা প্রকাশিত হয়। আগুনকে অন্য কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত করা হলে উভয়েরই
রঙ-রূপ অবশ্যই বদল হবে। কখনো বদল হবে তার রঙ আবার বিভিন্নতা দেখা যাবে তার
দাহিকা শক্তিতে। এমনকি কোনো কোনো সময়ে আগুনের তাপও বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং
তাতে সৃষ্টি হয় শীতলতা। তখন তার গুণাগুণ ও ছায়াতেও পরিবর্তন সাধিত হয় এবং
তার প্রকৃতিতেও আসে তারতম্য।
মুহিত্ব বা বেষ্টনকারী অথবা আবিষ্ট অর্থ
সমস্ত সৃষ্টির উৎসে আল্লাহ্ সত্তায় যুক্ত এবং সৃষ্টি বিলুপ্ত হলেও আল্লাহ্র
পবিত্র সত্তা বর্তমান থাকে। والله بكلى شى محيط – (ওয়াল্লাহু বিকুল্লি
শাইয়িন মুহিত) অর্থাৎ বর্তমান, অবর্তমান, নতুন, পুরাতন, ভারী, হালকা,
ব্যক্তি, নূর বা আগুন নির্বিশেষে সমস্ত বস্তুর মধ্যেই আল্লাহ্তায়ালার আপন
পবিত্র সত্তাসহ বর্তমান (সূরা নিসা-৪) এ বিষয়ে অধিক আলোচনা বা বিতর্কের
কোনোই অবকাশ নেই। এ বিষয়ে কেউ কিছু লিখে থাকলে তিনি তার যোগ্যতা অনুসারেই
লিখেছেন। তাই বলে যে কেউ কেউ এ বিষয়ে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হবে কেন? তবে
যিনি আহলে হক্ব অর্থাৎ পরম সত্যের ধারক, এ বিষয়ে তিনি যা বলবেন এবং যেভাবেই
বলবেন, সকলেই তা বুঝবে। এজন্য তাঁরা মুখ বন্ধ করে রাখেন। তাই তো রাসূল
(সাঃ) বলেন, من عرف الله كا لسانه (মান আরাফাল্লাহু কালিছানাহু) অর্থাৎ,
যিনি আল্লাহ্র পরিচয় পেয়েছেন তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। আপন আধ্যাত্মিক
অবস্থাই বলে দেয় যে, এ স্তরটি আলোচনার ঊর্ধ্বে।
একটি ইশতেহার
ফকিরের
রচনা ‘সফিনায়ে সফর’ এবং ‘জামেনূর’ পুস্তকে কোরানের আয়াত। كل شئ اليه ترجعون
(কুল্লি শাইয়িন ইলাইহি তুরজাঊন)-এর স্থলে كل شئ يرجع الى اصله (কুল্লু
সাইয়িন ইয়ার জিউইলা আছলিহি) লিখা হয়েছিল। এটা ফকিরের ভুল হয়েছে। প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য, মৌলভী কেরামত আলী জৌনপুরীর কয়েকটি কেতাবের একটি ইশতেহার বাজারে
ছাড়া হয়। ইশতেহারটির নাম দেওয়া হয় ‘তোহ্ফায়ে কেরামতি’। তাতে লেখকের কয়েকটি
বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়, যা তিনি তাসাওফের ব্যাখ্যা এবং এর প্রতি উৎসাহ
প্রদান প্রসঙ্গে তার কেতাবে উল্লেখ করেছেন। উক্ত কেতাবগুলো কোন প্রেসে ছাপা
হয়েছে, ইশতেহারটিতে তা উল্লেখ নেই। এজন্য এখানেও প্রেসের নাম উল্লেখ করা
হল না। এখানে তার বাক্যগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে।
‘তাযকিয়াতুল আকায়েদ’-এর
৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, আল্লাহ্্ তায়ালা বলেন, قل كل يعمل على شاكلته
(ক্কুল কুল্লুয়্যা’মালু আ’লা শাকেলাতিহি) অর্থাৎ হে রাসূল আপনি বলে দিন যে,
প্রত্যেকেই নিজের মতো কাজ করে। অর্থাৎ বেলায়েতের মর্যাদা এক রকম আর
নবুয়তের মর্যাদা আর এক রকম। এর দ্বারা কোনো আহাম্মক যেন বেলায়েতের
মর্যাদাকে খাটো মনে না করে। কারণ আল্লাহ্র প্রেমের নাম হল ‘বেলায়েত’। অতঃপর
তিনি লিখছেন যে, বেলায়েতিপ্রাপ্ত অবস্থায় সাধক আল্লাহ্র প্রেমে ও মহব্বতে
এমনই বেহুঁশ হয়ে যান যেমনই বেহুঁশ হয়ে যায় কাফের দুনিয়ার মহব্বতে।
সুব্হানাল্লাহ! এটা কি খাঁটি মহব্বত?
‘যাদুত্ তাক্ওয়া’র ১৭ পৃষ্ঠায়
লিখেছেন, সূফীদের জ্ঞানের বিবরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, আহওয়াল অর্থাৎ,
আধ্যাত্মিক অবস্থাদিই হল সূফীদের জ্ঞান। অর্থাৎ, তাসাওফ শাস্ত্রে আহওয়ালের
আলোচনাও বর্ণনা হয়। যেহেতু আহওয়ালই মূল সেহেতু তা উত্তরাধিকারও বটে।
তাসাওফের কেতাবসমূহে যে সব ইঙ্গিতমূলক বাক্যাদির বর্ণনা করা হয়, যথাÑ মিলন,
বিচ্ছেদ, জ্যোতিভেদ, নির্জনতা, একাকীত্ব, জযবা, সত্তা প্রভাব, প্রত্যক্ষণ,
বেহুঁশি, ইল্মুল ইয়াক্কীন, হাক্কুল ইয়াক্কীন, সময়, অনুপস্থিত, উপস্থিত,
সুুধার স্বাদ, মুখোমুখি, আধ্যাত্মিক দৃষ্টি, পরস্পর প্রত্যক্ষণ ইত্যাদি সব
আহওয়ালে কলবি অর্থাৎ মনের বিভিন্ন অবস্থা। যাদুত্ তাকওয়ার ৩৩৩ পৃষ্ঠায় লিখা
হয়Ñ তারই বক্তব্য, শোনোÑ কাশ্ফ এবং মোশাহেদাহ্ মূলত এই যে, অলী আব্দালগণের
উপর জ্যোতির্ময় আল্লাহ্র কার্যাদি থেকে এমন সব বস্তু প্রকাশিত ও উন্মোচিত
হয়, যা বুদ্ধিকে পরাজিত করে দেয় এবং সমস্ত স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি ও
রীতি-পদ্ধতিকে করে দেয় ছিন্নভিন্ন। অর্থাৎ উক্ত অবস্থাদিতে স্বাভাবিক
নিয়ম-নীতি ও রীতি-পদ্ধতির কথা স্মরণই থাকে না। অর্থাৎ সে অবস্থায় মাহবুবের
শোভা দর্শন ছাড়া অন্য কিছুর খেয়াল ও হুঁশই থাকে না। উল্লেখ্য, আল্লাহ্র
উক্ত কার্যাদি দু প্রকার জালাল অর্থাৎ তেজষ্কর এবং জামাল অর্থাৎ স্নিগ্ধ ও
শোভাকর। আল্লাহ্তা’য়ালার জালাল ও আজমত গুণের প্রকাশকে ‘কাশ্ফ্’ বলা হয়। এ
থেকে ভয়, অস্থিরতা ও অস্বস্তি সৃষ্টি হয় এবং এমন ভীতির সঞ্চার হয় যে, তার
হুঁশ থাকে না। তার মনকে আল্লাহ্র জালাল ও আজমত দখল করে ফেলে। ফলে তার সমস্ত
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভয় ও অস্থিরতা প্রকাশ পায়। যেমন হাদিস থেকে বর্ণিত আছে
যে, রাসূল (সাঃ) এর বক্ষ মোবারকের ভিতর থেকে রান্নার উত্তপ্ত হাড়ির মতো
শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যেত। মাসায়েল তিরমিজির মা যাআ ফিল বাকাই রাসূল (সাঃ)
পরিচ্ছেদে হাদিসটি দ্রষ্টব্য।
লেখক তার ‘কাওলুচ্ছাবেত’ পুস্তিকায় ১৫
পৃষ্ঠায় মাকতুবাতে মুজাদ্দেদির বরাত দিয়ে লিখেছেন, العلما وارث انبيا (আল
উলামা ওয়ারিছু আম্বীয়া) অর্থাৎ, যে আলেম ইল্মে আহকাম অর্থাৎ, জাহেরী বিদ্যা
এবং ইলমে আসরার অর্থাৎ বাতেনী বিদ্যা উভয় বিদ্যায় বিদ্বান তিনি নবীর
ওয়ারেছ; উক্ত উভয় বিদ্যায় যার জ্ঞান নেই সে আলেমই না। আর যেহেতু সে আলেম
নয়, তার মুর্শিদের মর্যাদাও নেই।
কিন্তু যে ব্যক্তি পাঠ্য কেতাবাদি পাঠ
করেনি, তবে উভয় বিদ্যায় বিদ্বান মুত্তাকি আলেমের সাথে থেকে প্রয়োজনীয়
বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছেন তিনি মুর্শিদ হতে পারেন এবং তাঁকে আলেম
বলা হয়। এরূপই মনে হয়, বাকিটা ‘কাওলুল জামিল’-এ দেখুন।
‘কাওলুচ্ছাবেত’-এর
৪১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, যে ব্যক্তি উভয় বিদ্যার আলেম নয় তার কাছে বয়’আত
গ্রহণ করা এবং তাকে খেলাফতনামা প্রদান করা জায়েজ নেই। অনুরূপ ওহাবী, লা
মাযহাবী ফরাজী, খারেজী, বেদ’আতী, পীরজাদাও যদি উক্ত উভয় প্রকার বিদ্যায়
আলেম না হয় এবং শাইখের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তাদের কাছেও বয়’আত
গ্রহণ বৈধ নয়। বরং কোনো ব্যক্তি অনুরূপ জাহেলের হাতে বয়’আত করে থাকলে তা
থেকে তওবা করা ওয়াজিব এবং বয়’আতকারীকে তার থেকে দূরে থাকতে হবে।
আল্লাহ্তা’য়ালা সূরা আ’রাফে বলেন, واعرض عن الجاهلين (ওয়া আ’রদা আনিল্
জাহেলীন) অর্থাৎ, জাহেলদের থেকে নিবৃত্ত হও।
উক্ত পুস্তিকার ১৮৬ পৃষ্ঠায়
উল্লেখ আছে যে, ইল্মে মোকাশেফা দ্বারা অদৃশ্য বস্তু দেখা যায়। আমরা আইনুল
ইল্ম এর ভূমিকা থেকে এর বর্ণনা দিচ্ছি; শোনোÑ তাতে বলা হয়েছে, পরকালের জন্য
উপকারী গ্রহণযোগ্য বিদ্যা দু প্রকার। এর একটি ইল্মে মোকাশেফা। এটা এক
প্রকার নূর যার ভিতর বাহির পবিত্র মুমিনের অন্তরে বিকশিত হয় এবং
আল্লাহ্তা’য়ালা তা মুমিনের অন্তরে ঢেলে দেন। ফলে এমনকি তিনি হযরত আবু বকরের
(রাঃ) ঈমানের সমমানে পৌঁছে যান। তখন তিনি উক্ত নূরের দ্বারা অদৃশ্যকে
দেখতে পান। এমনকি তাঁর মধ্যে আল্লাহ্তা’য়ালার নূর প্রকাশিত হয় এবং তাঁর
সত্তা ও কার্যাদির প্রকৃত পরিচয় ও আখেরাতের প্রকৃত অবস্থাদি তার কাছে
এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে যায় যেন তিনি তা চাক্ষুষ দেখছেন। ইল্মে মোকাশেফা
প্রমাণিত বিদ্যা। হাদিসে আছেÑ যখন মানুষের অন্তরে নূর প্রবেশ করে তখন তাঁর
অন্তর প্রসারিত হয়ে যায়। এর পর তিনি লিখেছেন, ইল্মে মোকাশেফার ব্যাখ্যা করা
যায় না। কারণ এর ব্যাখ্যায় কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। হাদিসে এতটা উল্লেখ
আছে, এমন কিছু বিদ্যা রয়েছে, আল্লাহ্র মারেফতওয়ালাগণ ছাড়া কেউই তা জানে না।
ইল্মে মোকাশেফা উত্তম ইল্ম এবং এ ইল্মই মকসুদ। কারণ ইল্মে মোকাশেফা
আল্লাহ্র জাত, সিফাত এবং কার্যাদির সাথে সম্পৃক্ত।
উক্ত ‘কাওলুচ্ছাবেত’
এর ১২৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, দেখো! চিশ্তিয়া ও কাদ্রিয়া ত্বরিকার অগ্রজগণ
যিক্রেজলি গ্রহণ করেছেন। মুর্শিদ-ই বরহক্ব-এর ‘মলফুজাত সিরাতুল
মুস্তাক্কীম’-এ বিস্তারিতভাবে তার উল্লেখ রয়েছে। এ অধম স্বল্প অবসরের
লোকদের জন্য উচ্চস্বরে যিকির পদ্ধতি চালু রেখেছি। আমি নিজে যেসব শিষ্যকে
যিকির চর্চা করাই তা নক্শবন্দিয়া ত্বরিকা অনুসারে করিয়ে থাকি এবং আমি নিজে
তিনটি ত্বরিকাতেই মুরিদ ও মুরিদ করিয়ে থাকি। সুতরাং শিষ্যগণের উচিত
উচ্চস্বর এবং নিঃশব্দ উভয় পদ্ধতির যিকিরকে বৈধ এবং উত্তম মনে করা এবং
মুর্শিদ যেভাবে তা’লিম দেবেন সেভাবেই যিকির করা এবং মোরাকা’বায় মশগুল থাকা।
অন্যান্য প্রসঙ্গ
বিশেষভাবে
লক্ষ্যণীয়, প্রতারক লোকদের অন্যের বক্তব্য বিকৃত করা এবং অদলবদল করে
দেওয়ার মাত্রা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে; উদ্ধৃতি করে এবং বাক্য বাদ দিয়েই তারা
ক্ষান্ত নয়, অনেক কেতাবের পরিচ্ছেদ ও উপ-পরিচ্ছেদ পর্যন্ত তারা কেতাব থেকে
সরিয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ‘হেদায়েতুল ইসলাম’ পুস্তকটির কথা আলোচনা করা
যায়। এটা জনাব মরহুম মাওলানা আমানতুল্লাহ দেহলবীর হিন্দি ভাষায় লেখা একটি
পুস্তক। সম্ভবত তিনি হযরত শাহ্ আবদুল আজিজ সাহেবের পৌত্র। তাতে মহান অলীদের
উদ্দেশে ফাতেহার উল্লেখ ছিল। যেমন ফাতেহা-ই-কন্দরী অর্থাৎ পয়গম্বর (সাঃ)
এর ঘরানা সাত পুণ্যবতী তথা হযরত বিবি ফাতেমা, আয়শা, হাফসা, হনুফা, জয়নব
প্রমুখ এবং মহান অলীদের ফাতেহার নাম এবং তাতে নামাজের নিয়তের মতো নিয়ত করার
কথা লেখা ছিল। সেসব নিয়তই তারা উক্ত কেতাব থেকে গায়েব করে দিয়েছে। এ
শতাব্দীর পূর্বে যখন কেতাবাদি হিন্দি অক্ষরে ছাপা হত তখনকার অর্থাৎ ১২১৮
সনে ছাপা উক্ত কেতাবের একটি কপি বর্তমানে এ ফকিরের নিকট রয়েছে। তাতে
ফাতেহার নিয়তের উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানের বদলাবদলির সামান্য নমুনা
এখানে উল্লেখ করা হল।
জনাব মরহুম হাজী এমদাদুল্লাহ সাহেবের কতিপয় রচনার
একটি সংকলনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কুল্লিয়াতে এম্দাদিয়াহ্’। এতে তাঁর লেখা
‘রেসালা-ই-অহ্দাতে অজুদ’ এবং ‘রেসালা-ই-হাফ্তে মাসায়েল’ দুটি পুস্তিকাই
ওহাবীরা মুদ্রণের সময়ে উক্ত সংকলন থেকে বাদ দিয়েছে। কারণ এ দুটি কেতাবই
ওহাবীদের মতের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তাতে অহদাতে অজুদকে বেলায়েতের মূল ও উৎস
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রেসালায়ে হাফ্তে মাসায়েলেও কয়েকটি বিষয় তাদের
বিরুদ্ধে রয়েছে। যেমন তাতে মিলাদ অনুষ্ঠান, মিলাদে কেয়াম, ফাতেহা এবং উরস
প্রভৃতির পক্ষে ফতুয়া রয়েছে। এ কারণে উক্ত দুটি পুস্তিকাই উক্ত সংকলন থেকে
বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংকলনের নামটি পূর্বে যা ছিল তা-ই রাখা হয়েছে। যার
ইচ্ছা সংকলনটির প্রথম মুদ্রিত কপির সাথে ওহাবীদের মুদ্রিত কপি মিলিয়ে
দেখতে পারেন।
তাছাড়া তাদের সমালোচনার শেষ নেই। অসংখ্য স্থানে তারা কোরান
ও হাদিসের তোয়াক্কা না করেই নিজেদের মতলব পেশ করেছে। তারা তাদের মতলব ও
উদ্দেশ প্রমাণ করতে গিয়ে হীনরূপে নিজেদের জেদ ও আত্মগর্বের পরিচয় দিয়েছে।
লক্ষণীয় যে, তারা কোরানের সর্বত্র আরবি ض দোয়াদকে আরবি উচ্চারণে পাঠ করে।
কিন্তু সূরা ফতেহার ضالين (‘দা-ল্লিন’ এর ض) দোয়াদকে হিন্দি উচ্চারণে (জাদ)
পড়ে থাকে। তাদের এ জেদ তারা নামাজেও বহাল রাখে। এ হল তাদের জেদ ও ঝগড়ার
নমুনা। এবার তাদের প্রজ্ঞার কিছু নমুনা লক্ষ করুন। কোরানের বেশ কিছু আয়াত ও
কয়েকটি হাদিসকে তারা নিজেদের ভ্রান্ত ধারণার পক্ষে ব্যবহার করেছে। ফলে
সাধারণের ধারণা হতে পারে যে, তাদের বক্তব্যগুলো যথার্থ কোরানের আয়াত এবং
হাদিসের অনুরূপ এবং এর অন্যথা করা কোরান ও হাদিসবিরোধী কাজ। তাদের লেখায়
এসব হাদিসের ব্যাখ্যায়Ñ স্থান, কাল অথবা প্রেক্ষিত মোটেই বিবেচনা করা হয়নি।
রাসূলের অনেক বাণীই বিভিন্ন সময় ও অবস্থার সাথে যুক্ত। যেমন সম্মানার্থে
দাঁড়ানো থেকে রাসূল (সাঃ) কখনো কখনো সাহাবিদের বারণ করেছেন। এর উদ্দেশ
সম্মানের পুনরাবৃত্তি না করা, সালামের জবাব দেওয়ার মতো। অর্থাৎ কেউ একজনকে
সালাম প্রদান করল, আর সেও সালাম দ্বারাই যদি এর জবাব দেয় তাহলে এক্ষেত্রে
সালামের পুনরাবৃত্তি হল। অনুরূপ সম্মান প্রদর্শন ও এর জবাব প্রদানের
সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। কথা ও কাজ দু ভাবেই এর প্রকাশ হতে পারে যাতে
সঠিক সম্মান প্রদর্শন বোঝায়। রাসূল (সাঃ) নিজেও হযরত ফাতেমা জোহরা (রাঃ) এর
সম্মানার্থে দাঁড়াতেন। অনুরূপ বহু হাদিস রয়েছে যা রাসূল (সাঃ) এর
ব্যক্তিত্ব ও অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত এবং এমনও অনেক হাদিস রয়েছে যেগুলো তাঁর
পারিবারিক অবস্থার সাথে যুক্ত। তাছাড়া কোরান ও হাদিস বিভিন্ন অবস্থা ও
সময়ের প্রেক্ষিতেই অবতীর্ণ ও উচ্চারিত হয়েছে এবং সমগ্র সৃষ্টির পরিচয় এর
আওতাভুক্ত। বস্তুত প্রত্যেক বক্তব্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশটাই আসল। সুতরাং সে
আলোকেই তার বিশ্লেষণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো বক্তব্যের লক্ষ্য ঠিক না থাকলে সে
ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় এবং কেউই অনুরূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে পাত্তা দেয়
না। প্রকৃতপক্ষে কোরান ও হাদিসের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা সর্বাধিক, যদি তা
উহার যথার্থ উদ্দেশ ও লক্ষ্য ঠিক রেখে ব্যবহৃত হয়। এমতাবস্থায় কেউ যদি
কোরানের আয়াত অথবা কোনো হাদিসকে নিজের মেকি মতলবে ব্যবহার করে এবং তা
দ্বারা জনমনে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়, তাতে কিছুই
আসে যায় না।
দ্বিতীয় উপকারিতা
মোরাকা’বাতে মুর্শিদের চেহারা ধ্যান
করলে উপকার হয়। কারণ মুরিদ যখন ধ্যানে আপন মুর্শিদের চেহারার মুখোমুখি হয়
তখন তার ভিতর বিশ্বাস, প্রেম এবং ধ্যান শক্তিÑএ তিনটি মনাকর্ষক ও মহৎগুণ
সৃষ্টি হয়। এ তিনটি গুণ একই সঙ্গে যখন মুর্শিদের নূরী অন্তর এবং প্রেমের
দৃঢ় ধ্যান রাজ্যের আওতায় প্রবেশ করে এবং এর প্রতিক্রিয়া মুরিদের অন্তরে এক
প্রকার চুম্বক ও আকর্ষণ শক্তি জন্মলাভ করে এবং এর প্রতিক্রিয়া মুরিদের
আত্মার মধ্য দিয়ে তার সমগ্র দেহে তরঙ্গায়িত হয়। তখন আত্মাসহ মুরিদের সারা
দেহ তা দ্বারা আলোকোদ্ভাসিত হয়। তাতে দিশারীরূপ ধ্যানের চাবির বদৌলতে
মহামূল্যবান সম্পদ মুর্শিদের ইচ্ছার ভান্ডার খুলে যায় এবং মুর্শিদের ভিতর
যে অনন্ত সম্পদ নিহিত রয়েছে মুরিদ তা থেকে অংশ পেতে শুরু করে। আতরের সুবাস
দূর থেকেই পাওয়া যায় এবং অনুভবও করা যায়। অনুরূপভাবে বারুদ ও দিয়াশলাইর
মধ্যে সুপ্ত আগুনের মতো মুর্শিদের ভিতরও নেয়ামতসমূহ মজুদ রয়েছে। এ কারণে
যথাযোগ্য মুর্শিদের সত্তাও বারুদেরই মতো তেজদীপ্ত। এর সাথে প্রেমাগুন যুক্ত
হলে তা আতশবাজির ন্যায় স্বীয় শক্তিতেই অন্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে এবং
পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে। ধ্যানের দ্বারা প্রেমাগুন প্রজ্বলিত হয়। যে
ধ্যান করে না সে প্রেম থেকে বঞ্চিত। প্রেমাগ্নি যখন মা’শুকের বারুদগ্নির
সাথে মিলিত হয় তখনই প্রেমিক আতশবাজির আনন্দ অনুভব করে। আতশবাজির সময় যেমন
রঙ-বেরঙ-এর ঝাড়ফুল এবং আলো বিচ্ছুরিত হয় তেমনই মুর্শিদের ধনাগারেও নানারূপে
ইশ্কে এলাহীর নূর প্রজ্বলিত হয়। এটা মুর্শিদের রূহের প্রভাব এবং
বৈশিষ্ট্য। কোরানে আল্লাহ্র নামের সাথে সাথে যে সব অনুকম্পার কথা বর্ণিত
হয়েছে, ঠিক সে রকম মুর্শিদের সত্তাও আল্লাহ্র সে সব মহত্ত্ব, পূর্ণতা এবং
মহব্বত দ্বারা পরিপূর্ণ। অতএব মুর্শিদের সত্তার ধ্যান ও চর্যা করা হলে
পবিত্র সূক্ষ্ম রূহের সূক্ষ্ম প্রভাব মুরিদের রূহ্ বা আত্মাকে প্রভাবিত
করতে থাকে, যেমনই সিক্ত হয় ও ভিজে যায় জিহ্বা টক জিনিসের কথা স্মরণ হলে।
অথবা যেমনই অশ্রুসিক্ত হয় চক্ষু প্রিয় সন্তানের মৃত্যু সংবাদে, প্রেম
আন্দোলিত হয় মাশুকের স্মরণে এবং ক্রোধ বেড়ে যায় কারও প্রতি গোশশা হলে।
এভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রেমে নিমগ্ন হয় তাঁর আত্মা প্রেম আগুনে দগ্ধ
হয় এবং এর ফলে মাশুকের নূরী রঙ তাঁর মধ্যে চমকাতে থাকে। আশিক ও মাশুকের
মধ্যে এরূপ একাত্মতার সম্পর্ক অবশ্যই বর্তমান রয়েছে। তাঁদের মধ্যে
দ্বন্দ্বমূলক ভাব থাকতেই পারে না। এটা কারও কাছেই গোপন নেই যে, মূলের
বিরোধী হয়ে মূলে পৌঁছা যায় না। প্রত্যেক বস্তুই স্ব স্ব মূলের সাথে
সম্পর্কযুক্ত এবং মূলের দিকেই আকৃষ্ট। ইশ্কে এলাহীর উৎস স্বয়ং আল্লাহ্ ও
পরমসত্তা বিধায় ইশ্ক বা প্রেম উক্ত সত্তারই গুণ ও ফল। সুতরাং যে ব্যক্তি
আল্লাহ্ ভক্ত তাঁর থেকে তিনি যে শক্তি সামর্থ্য, জ্ঞান গুণাবলি ও চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হন তা সবই তাঁর সেই প্রেমাস্পদ আল্লাহ্র উদ্দেশে
নিবেদিত হয়। মাশুক সত্তার আকর্ষণ গুণেই এরূপ হয়। আল্লাহ্র সত্তার এ
বৈশিষ্ট্যকে ‘শরাফতে হক্ব’ অর্থাৎ সত্যের সৌজন্য বলা হয়। যে ব্যক্তি এ
‘শরাফতে হক্ব’ প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি অতি সৌভাগ্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যের
অধিকারী। হযরত আদম (আঃ) এ সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। এ ‘শরাফতে হক্ব’ এর
প্রভাবে যার অন্তর আলোকিত হয়, তাঁর জ্ঞান গরিমা, গুণাবলি ও সত্তা সবই নূরময়
রূপ ধারণ করে। ফলে তাঁর দেহও নূরময় হয়। এটাই মাশুকের প্রেমের মর্ম ও
রূপায়ণ। অর্থাৎ আল্লাহ্র সত্তা ও বৈশিষ্টাবলি তাঁর প্রেমিকের সত্তায়
রূপান্তরিত হয়। এ কারণেই তাঁকে ‘ফানা ফিল্লাহ’ অথবা ‘বাকা বিল্লাহ’ বলা হয়।
অর্থাৎ তার দেহ-মন মাশুকের সাথে লীন হয়ে স্থিতিপ্রাপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায়
তাঁর ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছা, তাঁর জ্ঞান আল্লাহ্র জ্ঞান ইত্যাদি। আল্লাহ্
বলেন, والذين جهدو افينا لنهد ينهم سبلنا (ওয়াল্লাযীনা জাহাদু ফিনা
লানাহ্দিয়ান্নাহুম সুবুলানা) অর্থাৎ, ‘যারা আমাতে সাধনা করে আমরা তাদের
আমাদের পথগুলো প্রদর্শন করি’। (সূরা আন্কাবুত-৬৯)। অতএব মুর্শিদও অবশ্য
আল্লাহ্র সে সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির অধিকারী হবেন। এমতাবস্থায় যেহেতু
মুর্শিদ পরিপূর্ণরূপে তাওহিদি সত্তায় একাত্ম সেহেতু মুর্শিদের স্মরণ করলে
আল্লাহ্রই স্মরণ হয়। এ জন্য ফানা ফিশশাইখ মুরিদের জন্য বেলায়েত। তাই তো
মাওলানা রুমী বলেন, ,چونكه ذات پير راكر دى قبول هم خدادر زاتت امد هم رسول
– (চুকে জাতে পীরেরা কারদি কবুল। হাম খোদা দর জাতাত আমদ হাম রসূল।)
অর্থাৎ, পীরের সত্তা যখন তুমি করলে কবুল, এসে গেছে তোমার সত্তায় আল্লাহ্ ও
রাসূল। আল্লাহ্, রাসূল এবং আপন শাইখ বা মুর্শিদের চূড়ান্ত অবস্থা এক ও
অভিন্ন। তাই তো হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী বলেন, پيرتواست اول معبد تست
(পীরে তুয়াসত্ আওয়াল মাবুদ তাসত্) অর্থাৎ, তোমার পীরই তোমার প্রথম মাবুদ।
হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ তাঁর ‘কাওলুল জামীল’ পুস্তকে লিখেছেন, الركن العظيم
ربطل القلب باشيخ وملاحظه صورته – قلت ان الله مظاهرة كثيرة مما من عابد
غبيا اوزكيا وقد كان بهزاله صار معبود اله – (আররুকুনুল আযীমু রাবাতাল
ক্কল্বে বিশ্শাইখি ওয়ামালা হাযাহু ছুরাতিহি ক্কালাত ইন্নাল্লাহা মাযাহিরাতু
কাছিরাতু মিম্মা মান আ’বিদু গাবীয়া আওজাকিয়া ওয়াক্কাদ কানা বিহাযাআহু
ছোয়ারা মা’বুদালাহু।) অর্থাৎ, প্রধান শর্ত হল, শাইখের সাথে মনোসংযোগ স্থাপন
এবং তাঁর চেহারা নিরীক্ষণ। আমি বলি, আল্লাহ্র বহু প্রকাশ মাধ্যম আছে; তবে
বোকা বা বিচক্ষণ আবেদ নয়। অথচ শাইখ তাঁর জুতাসহ মুরিদের মা’বুদ হয়ে আছেন।
অন্য একটি উপকারী কাজ
আপন
পীর নিজ উদ্দেশ ও লক্ষ্যের বিচারে মুরিদের আসল রাসূল, কারণ পীরই মুরিদের
প্রকৃত পথ প্রদর্শক। আল্লাহ্র মূলতত্ত্বের পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পীর
রাসূলের স্থলাভিষিক্ত। রাসূল অর্থ প্রেরিত। অর্থাৎ সঠিক পথ প্রদর্শক।
সুতরাং যার সামনে রাসূলের স্থলাভিষিক্ত উপস্থিত তার জন্য পথ প্রদর্শনকারী
রাসূল হলেন মুর্শিদ। আর নবী-রাসূলের স্থলাভিষিক্ত বর্তমান নেই সে হেদায়েত
তথা আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও প্রজ্ঞা বা পরিচয় জ্ঞান যা আল্লাহ্তা’য়ালার
সত্তাগত দীপ্ত ও ফসল তা থেকে সে বঞ্চিত। কারণ, সে রাসূলের প্রত্যক্ষ
হেদায়েত থেকে বঞ্চিত। কেননা কালের ব্যবধান তাঁর হেদায়েতের পথে বাধা হয়ে
রয়েছে। যেমন হযরত আদমের পিতৃত্ব। মূলত আদম (আঃ) সকল মানুষের পিতা হলেও
সময়ের ব্যবধানে মানুষ তাঁর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত। অতএব নিজের বর্তমান পিতাই
আপন প্রকৃত পিতার স্থলাভিষিক্ত। অতএব বান্দার হেদায়েতের জন্য মূর্শীদ
বর্তমান এবং তাঁর সত্তা ও গুণাবলির দ্বারা বান্দার হেদায়েত হচ্ছে অর্থাৎ,
আল্লাহ্র মূলত্ব সম্পর্কে অবগত ও তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং
নবী-রাসূলের হাকিকত অবহিত হচ্ছে যে, তাঁরা আমাদের পূর্বেকার পথ প্রদর্শক
এবং সে ধারা আমাদের সাথে যুক্ত; ইতোপূর্বে আমরা কেবল তার নাম জানতাম।
বর্তমানে যে তোমাকে পিতৃত্ব দিয়ে দুনিয়াতে হাজির করেছে, সে-ই তোমার আসল
পিতা, পরম্পরার আদি পুরুষ নন। সুতরাং প্রত্যক্ষ সম্পর্কসূত্রে তোমার আপন
পিতা যেমনই তোমার প্রকৃত পিতা তেমনই তোমাদের পূর্বে মুর্শিদ নবী-রাসূলের
স্থলাভিষিক্ত বর্তমান মুর্শিদই তোমার প্রকৃত রাসূল। অতএব প্রকৃত রাসূল হলেন
মুর্শিদ, সেহেতু সাবেক নবী-রাসূলগণ হলেন পরোক্ষ নবী-রাসূল। তাই তো
মুজাদ্দিদে আলফেসানী তাঁর মাকতুবাতে লিখেনÑ چير تورسول حقيقى است كه حقوق
او حقوق باديگران نسبت ندارند (পীরে তু-রাসূল হাক্কিক্কী আসত্ কিহ্
হুক্কুক্ক আও হুক্কুক্ক বাদিগারানে নেসবতে নাদারান্দ) অর্থাৎ, তোমাদের পীর
তোমাদের প্রকৃত রাসূল, তাঁদের অধিকারের সাথে অন্যদের অধিকারের সম্পর্ক নেই।
কারণ মুর্শিদের অধিকার তাদের চেয়ে অধিক এবং অলঙ্ঘনীয়। এতে মনে হয় রাসূলও
মুর্শিদের অবস্থানেই ছিলেন। অর্থাৎ উম্মতের নবী-রাসূলগণ আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও
হেদায়েতের বিচারে মুর্শিদও বটেন। শুধু সংবাদ শোনানোর জন্য তাঁদের পাঠানো
হয়নি। সংবাদ শোনানোতেই যদি ধর্ম সীমাবদ্ধ হত তা হলে ঈমান ও ইহ্সানের জ্ঞান
প্রয়োজন হত না। আর আবশ্যক ছিল না উদ্দেশ নির্ধারণ যা সকল কর্মের বিশুদ্ধতা ও
বৈধ্যতার পূর্বশর্ত। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, আপন আপন মুর্শিদ রাসূলদের
মর্যাদায় স্থলাভিষিক্ত।
আর একটি উপকারী বিষয়
বাতি উজ্জ্বল হোক বা
অনুজ্জ্বল, মসজিদে হোক অথবা ঘরে, নৌকাতে হোক অথবা গলি, রাস্তা বা ময়াদানে
যদি তা কল্যাণ বা উপকারের উদ্দেশে স্থাপিত হয় তাহলে তা রাখা বৈধ ও পুণ্যের
কাজ। সেহেতু তা কবর বা মাজারে স্থাপন করাও বৈধ ও পুণ্যের কাজ। কারণ, হাদিস
শরীফে আছে, অধিক আলোকিত স্থানে রহমতের ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়। হযরত গাউছে আজম
তাঁর ‘গুনিয়াতুত্ তালেবীন’-এ এ হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন। আমার ‘সফীনা’
পুস্তকে সে হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে স্মরণীয় যে, ফেরেশতার অবতরণ
রহমত বর্ষণের নিদর্শন। রাসূল (সাঃ) স্বয়ং আলোকসজ্জাকারীকে দোয়া করেছেন।
তিনি বলেন, তুমি প্রদীপ দ্বারা মসজিদকে আলোকিত করেছে, আল্লাহ্ তোমাকে
আলোকিত করুন। হযরত আলী (রা.) হযরত উমরকে দোয়া করেছেন, “হে ইবনে খাত্তাব,
আপনি প্রদীপ দ্বারা মসজিদ আলোকিত করেছেন, আল্লাহ্ আপনার কবরকে আলোকিত
করুন।” সুতরাং আলোতে আল্লাহ্র রহমত ও বরকত বর্ষিত হয়, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন
ব্যক্তিদের নিকট এটা আর গোপন নেই। তা ছাড়া বাহ্যিকভাবেও এর উপকারিতা সকলের
কাছে সুস্পষ্ট। আলো দ্বারা সব রকম দৈহিক ও মানসিক ভয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মহামারির সময়ে রাতের অন্ধকারে অধিকতর আলোক জ্বালিয়ে রাখা শুভ লক্ষণ। যে
স্থানের উপর রহমত থাকে তার অভ্যন্তরে এর বরকত প্রকাশিত হয় এবং যার ভিতরে
বরকত আছে তার উপরেও তা পরিলক্ষিত হয়। অনুরূপ সত্তা ও আত্মার কল্যাণ দেহে
প্রতিভাত হয়। এ জ্ঞান চরিত শাস্ত্র একাত্মচর্চার উপর নির্ভরশীল। এ জ্ঞানের
সার-সংক্ষেপ কোরআন ও হাদিছের মগজ ও মর্মার্থ।
তৃতীয় উপকারিতা
জনাবে
মরহুম মৌলভী রশিদ আহমদ গঙ্গোহী সাহেব ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র প্রতিবাদে
‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’ নামে একখানা কেতাব লিখেন। তবে মক্কা-মদীনাসহ বিভিন্ন
শহর, ও দেশের আলেমবৃন্দ ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁরা
অকপটে উক্ত কেতাবের বিশুদ্ধতার প্রশংসা করেন এবং সুন্দর সুন্দর মন্তব্য
লিখে উহার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেন। এঁদের মধ্যে ‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’র
লেখকের মুর্শিদ জনাব মরহুম হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী সাহেবও
‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’র অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ছটি সমালোচনা মন্তব্য
লিখেছেন। তা থেকে দুটি এখানে উল্লেখ করা হল। এখানে এটা উল্লেখ করার উদ্দেশ
এই যে, অধুনা তাঁর মুরিদ এবং মুরিদদের মুরিদ অনেকেই বাংলার বিভিন্ন স্থানে
তাঁর বিরুদ্ধে, যা ধর্মেরও বিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। যথা মিলাদ, কেয়াম,
তস্বিহতাহ্লিল, কবর যিয়ারত এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদির নানান বাহানা ও কিছু
মনগড়া দলিল দ্বারা এই বলে দোষারোপ করছে যে এসব কার্যাদি উদ্দেশমূলক এবং
প্রচার করছে যে, এসব কাজের মধ্যে কোরান-হাদিসের বাইরে তাঁদের নিজস্ব মতলব
হাসিলের উদ্দেশ রয়েছে। এখন দেখুন উক্ত ‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’র লেখক এবং তার
সহযোগীদের সম্পর্কে তাদের মহান পীর কি বলেন। তিনি লিখেছেন, আমি এমদাদুল্লাহ
আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা ও পথের সন্ধান প্রার্থনা এবং আমার প্রিয়তম পীরজি
মৌলভী খলিল আহমদ আবনন্দি সাহেব এবং আমার প্রিয় মৌলভী হাসান দেওবন্দি
সাহেবের খেদমতে সালাম ও বরকত নিবেদনান্তে হিন্দুস্থানের সব শহর-বন্দর,
বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, দক্ষিণ গুজরাট, বোম্বে, পাঞ্জাব, রামপুর, রাজপুতনা,
বাহওয়ালপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে যে সব বিভ্রান্তিকর ও দুঃখজনক সংবাদাদি
আমার কাছে আসছে তা শুনে আমি বিশেষভাবে মর্মাহত। দ্বিতীয়ত, ‘বারাহীনে
কাত্বেয়াহ’ লিখে ‘আনোয়ারে সাত্বেয়া’র বিরোধিতা করার কারণে ফেৎনার আগুন আরো
জ্বলে ওঠেছে, এবং সব আলেম ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন।
আল্লাহ্তা’য়ালা উক্ত কেতাবকে এমনই গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন যে, দেশের
আলেমবৃন্দ এবং মুফতীগণ কেতাবটিকে সামগ্রিকভাবে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছেন এবং
এ ব্যাপারে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ।
বর্তমানে হিন্দুস্তানে অসংখ্য কুফরী মাযহাব
এবং ইসলামের বিনাশকারী ধর্মবিরোধী বাতেল চিন্তাধারা আত্মপ্রকাশ করছে।
এসময়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে এসব বাতেলের প্রতিবাদ করা উচিৎ। এবং এ
ক্ষেত্রে কোরান শরীফের বৈশিষ্ট্য ও ফজিলতসমূহ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রশংসা ও
চরিত্র মাধুর্য প্রচারের লক্ষ্যে সর্বত্র মিলাদের অনুষ্ঠান করা অতি উত্তম
উপায় এবং প্রশংসনীয় মাধ্যম… ইত্যাদি।
মাওলানা মোহাম্মাদ আবদুল হক
সাহারানপুরী সাহেবের প্রশংসাপূর্ণ অভিমত, ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ সম্পর্কে
দয়ালু দয়াময় আল্লাহ্র নামেÑ সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য এবং দরুদ ও সালাম
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য; আহলে ইসলাম, কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্ যাদের বহাল
রাখবেন, তাদের সেবায় নিয়োজিত আমি অধম আবদুল হকের নিবেদন এই যে, আমলদার
সুযোগ্য আলেম মৌলভী মোহাম্মাদ আবদুস সামী রামপুরী রচিত অপ্রতিদ্বন্দ্বী
গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ এ অধমের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উক্ত
লেখক প্রকৃতই ধর্মের জন্য পরিশ্রম করার প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ্ প্রদত্ত
অনুগ্রহের বদৌলতে এমনভাবে কেতাবাদি রচনা করেছেন যা পাঠ করলে ঈমানদারের চোখে
নূর ও অন্তরে ঈমান বৃদ্ধির সুখ অনুভূত হয়। তবে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী এবং
অসত্যের পূজারীরা এটাকে অবজ্ঞা করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো অনুরূপ
বাঁকা দৃষ্টির লোকেরা চাইলেই সূর্য কালো হয়ে যাবে না। তবে নূরের ঔজ্জ্বল্যে
তাদের চোখের উপকার হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের অন্তরে আসবে পবিত্রতা।
এমতাবস্থায় কোনো বাগ-বহুল ব্যক্তি যদি ফালতু বকবক করে আর লিখে কাগজ ময়লা
করে তার নাম জবাব তাতে বিশ্বে তারই বাচালতা ও অসারতাই প্রমাণ হবে।
জ্ঞানীগুণী এবং ধীমান ব্যক্তিদের উক্তরূপ দৃষ্টিহীনদের বিরুদ্ধে কোনো
অভিযোগ নেই। এরা নিজেদের বাতিল বক্রত্ব ও অজ্ঞতার বশে আলোকে অন্ধকার এবং
সুন্নতকে বেদ’আত আখ্যা দেয়। ইসলামের আলো নিভিয়ে দিতে চায় এবং ন্যায়কে
নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। والله مقم نوره ولوكره القفرين وصلى الله تعاعلى
على خير خلقه محمد واله واصحابه اجمعين – (ওয়াল্লাহু মুক্কিমু নুরূহু
ওয়ালাউ কারিহাল কাফিরীন ওয়াছাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলা খাইরি খালক্কিহি
মুহাম্মাদিন ওয়া আলিহি ওয়া আছহাবিহি আজমাইন।) অর্থাৎ, কাফেরেরা অপছন্দ
করলেও আল্লাহ্ তাঁর নূর পরিপূর্ণ করবেন। আল্লাহ্র প্রশংসান্তে তাঁর সৃষ্টির
সেরা ও তাঁর পরিবারবর্গ ও সাথীদের ওপর রহমত বর্ষিত হোক।
হাজী
এমদাদউল্লাহ বলেন, ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র অনেক বিষয়ে মনের থেকে একমত হয়ে আমি
আল্লাহ্র কাছে এই বলে প্রার্থনা করছি যে, আমি যদি উক্ত বিষয়ে অভ্রান্ত এবং
ন্যায়ের পক্ষে থেকে থাকি তাহলে দেশ-বিদেশের আলেম সমাজ এবং আহলে ইসলাম
সম্প্রদায় যেন তা গ্রহণ করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আল্লাহ্তা’য়ালা সে
প্রার্থনা কবুল করেছেন। মক্কা-মদিনা ও অন্যান্য ইসলামী দেশের আলেম সমাজ এতে
আলোচিত বিষয়সমূহ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন এবং সামগ্রিকভাবেই কেতাবটি তাঁরা
পছন্দ করেছেন। এটা আল্লাহ্র অনুগ্রহ যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে তিনি এরূপ
গ্রহণযোগ্যতা দান করেন।
লাহোরের কাসুর জেলার প্রখ্যাত সূফী কোরান ও
সুন্নাহ শাস্ত্রের মহান গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ মহাজ্ঞানী মহাজন মাওলানা আবু
মোহাম্মাদ আবদুর রহমান গোলাম দস্তগীর সাহেব এ প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তার
অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত করা হল :
আল্লাহ্র প্রশংসা ও নবীর প্রতি দরুদ
এজন্য যে তাঁরা এ অধমের অন্যতম ধর্মীয় বন্ধুর লেখা ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র
বর্ণিত মিলাদ ও ফাতেহার অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে মতামত লেখার জন্য দয়া করে
আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন। তবে এখন আমি অমৃতসরের জনৈক আর্য পন্ডিত রচিত ‘তাকযিবে
বারাহীনে আহমদিয়া’ নামক পুস্তকে আরোপিত মিথ্যাচার ও অপবাদের জবাব লেখায়
ব্যস্ত এবং সম্পূর্ণরূপে তাতে নিমগ্ন। অতএব আলোচ্য কেতাবটি সম্পর্কে আপাতত
এটুকু লিখতে পারি যে, আমি অধম আরবি সংবাদপত্র ‘শাফাউন সদুর’ ৫ ডিসেম্বর
১৮৮০ সংখ্যায় জনাব মরহুম মগফুর সাহারানপুরী সাহেবের এ সংক্রান্ত লেখাটি
পড়েছি। তিনি উক্ত কেতাবের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমার মতে উক্ত মরহুম
মাওলানা হিন্দুস্তানের শ্রেষ্ঠ আলেমদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি অনেক সূফী সাধকের
আধ্যাত্মিক দয়ার দানে সমৃদ্ধ ছিলেন। উক্ত কেতাবটির বিশুদ্ধতা ও
গ্রহণযোগ্যতার জন্য তাঁর প্রশংসা-ই যথেষ্ট এবং এর পর আমার মতো অভাগা অধমের
প্রশংসা এক্ষেত্রে আর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া অধম নিজেও মিলাদ করি এবং রূহের
প্রতি ‘ইসালে সওয়াব’কে আমি পাপ সংহারক মনে করি। আল্লাহ্তায়ালা যুগনবীদের
মতভেদ দূর করুন। আমীন! হে মহাপ্রভু, সৃষ্টির সেরা মহানবী এবং তাঁর সকল
প্রিয়জনদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। ইতি- গোলাম দস্তগীর কাসুরী।
প্রকাশ
থাকে যে, ইনিই সেই মৌলভী গোলাম দস্তগীর সাহেব যাঁর প্রশংসায় ‘বারাহীনে
কাত্বেয়াহ’র লেখক ভাওয়ালপুরের শাসনভার থাকা অবস্থায় লিখেছেন যে, ‘ধর্মের
সহায়ক এবং বেদ’আতী ও গোমরাহদের দমনকারী মাওলানা মৌলভী আবদুর রহমান গোলাম
দস্তগীর কাসুরী সাহেবের দৃঢ় অবস্থান আল্লাহ্ কেয়ামত পর্যন্ত বহাল রাখবেন।’
ফরীদ কোট থেকে ছাপা ‘তাসরীহুল বাহাছ’ পুস্তিকায় পৃষ্ঠা নং ১০ এ উক্ত
উক্তিটি রয়েছে। এমতাবস্থায় ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র বক্তব্যের বিরোধিতা করা
‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’র লেখকের জন্য অন্যায়। কারণ যাঁকে তিনি আলেমে রাব্বানী
হিসেবে মানেন এবং নিজের লেখায় ধর্মদরদী বলে উল্লেখ করেন তিনিই ‘আনোয়ারে
সাত্বেয়াহ’কে অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করেছেন এবং এ নিয়ে ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে
ভাওয়ালপুরে অনুষ্ঠিত তর্কযুদ্ধে ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’র পক্ষাবলম্বন করেন ও
‘বারাহীনে কাত্বেয়াহ’র লেখক, তাঁর সমর্থক দেওবন্দী এবং অন্যান্য আলেমদের
পরাস্ত করেন। রামপুরের সব পত্রপত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছে।
সুদক্ষ
অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সুগভীর তত্ত্বজ্ঞ এবং বিশিষ্ট তথ্যবিশারদ প্রখ্যাত
মাওলানা মোহাম্মাদ এ’জাজ হোসেন ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ সম্পর্কে লিখেছেন, সকল
প্রশংসা তোমার; তোমার ক্ষমতা প্রদীপ্ত, সত্তা সুমহান সৃষ্টি নৈপুণ্য
সুস্পষ্ট, শক্তি অনন্য এবং তুমি সৃষ্টির কল্যাণে দিবাকরের মতো সুস্পষ্ট
আহ্বানকারী রাসূল প্রেরণ করেছ এবং তুমি তাঁর আলোচনাকে সমুচ্চ করেছ বলে
মিলাদ মাহফিলকে কল্যাণের উসিলারূপে বৈধ করেছ আর অপমানিত করেছ মিলাদে কেয়াম
বর্জনকারীকে। অথচ তা দলিল দ্বারা প্রমাণিত, যদিও কেউ তা পালন করে আর কেউ
করে না এবং সালাম ও রহমত বর্ষিত হোক কেয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টির সেরা মহামানবের
প্রতি এবং তাঁর সম্ভ্রান্ত সাথীবৃন্দ ও সম্মানিত পরিবারবর্গের ওপর। অতঃপর
সৃষ্টির সেরা মহামানবের মহাজ্ঞানী আশিকদের প্রতি ভক্তি প্রকাশান্তে
উল্লেখ্য যে, আমলদার আলেম, যুগজ্ঞানী, বেদ’আত দমনকারী সুন্নাতের অনুসারী
মহাজ্ঞানী সূক্ষ্মতত্ত্ব ও তথ্যজ্ঞ, সাধকমনি, কামেলশ্রেষ্ঠ সেরা আলেম মৌলভী
মোহাম্মাদ আবদুস্ সামী সাহেবের (আল্লাহ্ তাঁকে শান্তি দিন) মিলাদ ও ফাতেহা
সম্পর্কিত রচনা ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ একখানা অত্যন্ত কার্যকর ও হৃদয়গ্রাহী
গ্রন্থ। বিষয়বস্তুর দিক থেকে গ্রন্থটি অনন্য, আলোচনা সারগর্ভ এবং পূর্বাপর
নির্বাচিত গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এ গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি বিশেষ ও
নির্বিশেষ সকলকে আপন অনুগ্রহ ফায়েজ দ্বারা উপকৃত করেছেন। এর একটি কপি আমার
হাতে এসেছে এবং আমি তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। কি অদ্ভুত তাঁর জবাব
দান পদ্ধতি এবং বর্ণনারীতি। তিনি জবাবের ক্ষেত্রে বিরোধীদের গুরুজন যাঁদের
বিরোধিতা করা তাদের জন্য হারাম, তাদের এ শ্রেণীর অনুসরণীয় ব্যক্তিদের বাণী
দ্বারা দলিল দিয়েছেন। গ্রন্থকার দাঁতভাঙা জবাবের মাধ্যমে ‘আনোয়ারে
সাত্বেয়াহ’কে নূরের সাগরে পরিণত করেছেন এবং উন্মুক্ত করেছেন এর বহু
প্রস্রবণ। এরপরও যদি বিরোধীদের তৃপ্তি না হয় তাহলে তাদের আল্লাহ্র হাতে
ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। تهيدستن قسمت راچه – سرد از ار مبر كامل
– كه خضر ازاب حيات تشاه مبدار دسكندررا – (তাহিদাস্তান ক্কিস্মতরা চেহ্
ছরদ আজ আরম্বর কামেল। কিহ্ খিজির আজ আবেহায়াত তাশাহ মুবদারাদ সেকান্দররা।)
অর্থাৎ, দুর্ভাগার কী লাভ হবে কামেলের পথ প্রদর্শনে, বাদশাহ-ই পিপাসার্ত
খিজিরের আবেহায়াত পানে।
আল্লাহ্ই উত্তম জবাব গ্রহণকারী। এক্ষেত্রে এটাই
আমাদের তরফের বিরল জবাব। আমাদের শেষ নিবেদন সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য এবং
দরুদ ও সালাম শেষ নবী ও তাঁর সাথীদের জন্য। ইতিÑ
আমি বান্দা আবু নোমান
মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ এজাজ হোসাইন মুজাদ্দেদী আল্লাহ্ তাকে, তাঁর মাতা-পিতা ও
সকল মুসলিমকে শেষ নবীর অসিলায় ক্ষমা করুন।
ফেরেঙ্গি মহলের জনাব মাওলানা
আবদুল হাই লাক্ষ্মৌভী সাহেবও উক্ত গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন। তাঁর শিষ্য
সাঈদুদ্দিন সাহেব সে কথা লিখেছেন। তিনি বলেন, মাগফুর মাওলানা আবদুল হাই
লাক্ষ্মৌভী সাহেবের প্রধান সত্যপরায়ণ শিষ্যদের অন্যতম সাহারানপুর জেলার
রামপুর শহরের বাখিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা পরহেজগার সুযোগ্য আলেম মাওলানা
সাইদুদ্দিন আহমদ লিখেছেনÑ
দয়ালু দয়াময় আল্লাহ্র নামেÑ সকল প্রশংসা সেই
আল্লাহ্র যিনি তাঁর শেষ বান্দা মোহাম্মাদ (সাঃ) কে পাঠিয়ে মানুষের প্রতি
কৃপা করেছেন এবং তাঁর আবির্ভাবকে করেছেন নয়নাভিরাম ও মনোমুগ্ধকর। দরুদ ও
সালাম বর্ষিত হোক তাঁর ও তাঁর সাহাবাদের ওপর। একমাত্র এ সালাম ও দরুদই
সেদিন আমাদের উপকারে আসবে যেদিন পিতা-মাতাগণ সন্তানদের উপকারে আসবে না এবং
নবীগণও দায়িত্ব নেবেন না তাঁদের পূর্বপুরুষদের। অতঃপর আমি অধম বান্দা
মোহাম্মাদ সাইদুদ্দিন বলছি যে, সুসাহিত্যিক মাননীয় মৌলভী মোহাম্মাদ আবদুস
সামী রচিত ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ নামক পুস্তকটি অত্যন্ত উপকারী। সুতরাং আলেম
সমাজ পুস্তকটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি সমর্থন
করেছেন। তাদের মধ্যে আমাদের গুরু প্রখ্যাত মৌলভী মোহাম্মাদ আবদুল হাই
লাক্ষ্মৌভী প্রধান। আমি নিজে তাঁকে পুস্তকটি দিয়েছি। তিনি পুস্তকটির
প্রশংসা করেছেন এবং এর আলোচনাকে সঠিক পথ নির্দেশনামূলক বলে উল্লেখ করে
বলেন, “এ কেতাবখানা আলোচ্য বিষয়ে সমুদয় বক্তব্যের সার সংকলন। গ্রন্থকার এতে
সঠিক পথ ও লক্ষ্য অনুসরণ করেছেন এবং অন্যায় বক্তব্য ও বাড়াবাড়ি পরিহার
করেছেন। নবী ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
আলোচ্য কেতাব সম্পর্কে দিল্লির প্রখ্যাত আলেমগণ বলেন :
১।
আকায়েদুল ইসলাম ও তাফ্সীরে হাক্কানী’র প্রণেতা তর্কশাস্ত্র ও কালাম
শাস্ত্রের উন্নয়নকারী, আকায়েদে ইসলামের প্রবর্তক প্রখ্যাত মোফাস্সেরে কোরান
মৌলভী আবু মোহাম্মাদ আবদুল হক সাহেব লিখেছেনÑ “আল্লাহ্র প্রশংসা ও রাসূলের
দরুদান্তে, দয়ালু দয়াময় আল্লাহ্’র নামেÑ আমি ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ দেখেছি
এবং এর কিছু অংশ পাঠ করেছি। বস্তুতই এর লেখক পূর্ণ দক্ষতা এবং অত্যন্ত
যোগ্যতার সাথে বিষয়াদি আলোচনা করেছেন। যদি অতিরঞ্জিত মনে না করেন তা হলে
বলতে পারি, আলোচ্য বিষয়ে কেতাবটি অদ্বিতীয়।”
২। অনুরূপ দিল্লি থেকে হযরত
আবদুল আজিজ দেহ্লভী (রঃ)-এর সুযোগ্য সাগরেদ জ্ঞানের ভান্ডার মাওলানা
করিমুল্লাহ সাহেবের পুত্র আল্লাহ্র বিধান ও নবীর সুন্নাহর নিষ্ঠাবান
অনুসারী বিখ্যাত লেখক ও দূরদর্শী মাওলানা ইয়াকুব আলী সাহেব লিখেছেনÑ “আমি
শ্রদ্ধেয় ও মান্যবর প্রাজ্ঞ মাওলানা আবদুস সামী প্রণীত মিলাদ ও ফাতেহা
সংক্রান্ত কেতাব ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’ পর্যালোচনা করেছি। আমার মতে, কেতাবটি
বিশুদ্ধ, সুন্নী মাযহাবের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য
দলিলাদিতে পরিপূর্ণ। সুতরাং এর সাথে যাঁরা একমত তাঁরা আমাদের দলভুক্ত। আর
যে এর বিরোধী সে পথভ্রষ্ট এবং তার বক্তব্য সঠিক নয়। তারা তো সঠিক হতেই পারে
না। কারণ আলোচ্য কেতাবটি সুস্পষ্ট দলিলাদি, অকাট্য প্রমাণাদি, মহান
বুজুর্গদের বর্ণিত আত্মিক লক্ষ্যসমূহ, আল্লাহ্র আশীর্বাদপুষ্ট উদ্দেশাদি
দ্বারা সমৃদ্ধ। প্রার্থনা করি, আল্লাহ্ আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করার ক্ষমতা
দিন। অবশেষে সব প্রশংসা বিশ্বস্রষ্টা প্রভুর জন্য এবং দরুদ ও সালাম শ্রেষ্ঠ
নবী মোহাম্মদ (সাঃ), তাঁর সাহাবাগণ এবং পরিবারবর্গের জন্য। ইতিÑ
৩।
বোম্বে থেকে আবেদ আরেফ বহু সাধকের গুরু, আত্মোৎসর্গকৃত অনেকের মুর্শিদ সূফী
সাইয়েদ ঈমাদুদ্দীন আল-রেফায়ী, আমি আশা করি যার অনুপ্রেরণা আল্লাহ্ কেয়ামত
পর্যন্ত বহাল রাখবেন, তিনি লিখেছেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য যিনি রাসূল
(সাঃ) আল-আলামীনকে প্রেরণ করেছেন, সকল নবীর ওপর তাঁর সম্মান দিয়েছেন, তাঁর
মিলাদকে বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ করেছেন, অবতীর্ণ করেছেন মুমিনদের ‘ফাতেহা
শাফিয়াহ’ এবং দরুদ ও সালাম আমাদের নেতা পাপীদের সুপারিশকারী মোহাম্মদ,
তাঁর হেদায়েতপ্রাপ্ত সাহাবাগণ ও পবিত্র পরিজনদের জন্য, অতঃপর আমি মহাজ্ঞানী
মৌলভী মোহাম্মদ আবদুস সামী রচিত মূল্যবান গ্রন্থ ‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’
দেখেছি। এটি মিলাদ ও ফাতেহা সম্পর্কে লেখা। গ্রন্থটি মজবুত দলিলাদি ও
ফেকাহ্ভুক্ত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ সংবলিত। আল্লাহ্ তাঁর শ্রম গ্রহণ করুন এবং
তা মুসলিমদের জন্য উপকারী হোক। যারা মিলাদ মজলিসে বসে অথচ ফাতেহাকে
অস্বীকার করে তারা পথভ্রষ্ট এবং ওহাবী। উত্তম তওবা গ্রহণকারী আল্লাহ্ তাদের
তওবা গ্রহণ করুন। অবশেষে সব প্রশংসা বিশ্বস্রষ্টা প্রভুর জন্য…।”
‘আনোয়ারে সাত্বেয়াহ’তে দলিল হিসেবে গৃহীত গ্রন্থাদির তালিকা
১। রদ্দে মোখ্তার।
২। রিসালাহ মা আহলুল গাইরিল্লাহ।
৩। খাযানাতুর রাওয়াইয়াত্।
৪। সহীহ্ বুখারী।
৫। এহ্ইয়াউল্ উলুম।
৬। তাওজিহ্।
৭। তাফ্সীরে বাইজাভী।
৮। বাহ্রে জান্নাত।
৯। ফতুয়া আলমগীরি।
১০। মাসায়েলে আরবাঈ’ন।
১১। মাদারেজুন নবুয়্যাত।
১২। মাদ্খাল।
১৩। গুফনিয়াতুত্ তালেবীন।
১৪। তাম্বিয়াতুল গাফেলীন।
১৫। শরহে মায়া’নিউল আছার।
১৬। হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা।
১৭। শরহে মুসলিম নবুবী।
১৮। আক্দুল জাওহার।
১৯। তাক্ভিয়াতুল ঈমান।
২০। তাফ্সীরে আজিজী।
২১। মাক্তুবাতে মুজাদ্দিদে আলফেসানী।
২২। র্দরুল মাফিয়াহ।
২৩। তাফ্সীরে মাদারিক।
২৪। ফাতাওয়া সিরাজিয়াহ।
২৫। মাক্সাদে আশের।
২৬। সিরাতে জ্বলি।
২৭। মুহিম্মাতুল মায়ারিফ।
২৮। ফাওয়াইদুস্ সালেকীন।
২৯। ফতুয়ায়ে কাজী খান।
৩০। মুদেররাত।
৩১। তাতার খানিয়া।
৩২। ফাতাওয়া হুজ্জাত।
৩৩। মল্তা কাত।
৩৪। মাযরাউল হাসানত শরহে দালায়েলুল খায়রাত।
৩৫। কাশফুয যুফুন।
৩৬। সীরাতে মুস্তাকীম।
৩৭। শরহে সফরুস্ সা’দাত।
৩৮। সাবীর্লু রেশাদ।
৩৯। আনোয়ারে মুহাম্মদী।
৪০। শামী।
৪১। কাশ্ফে আনোয়ার।
৪২। তায্কিরুল এখওয়ান।
৪৩। তাফ্সীরে রূহুল বয়ান।
৪৪। তাফ্সীরে কবীর।
৪৫। শরহে মাওয়াহেব।
৪৬। মায়ালেম।
৪৭। জামে’ তিরমিজী।
৪৮। হুস্নুল মাক্সাদ ফি আমলিল মৌলুদ।
৪৯। মাওরাদুর রাবী ফি মৌলুদিন্নবী।
৫০। ফায়েযুল হারমাইন।
৫১। সীরাতে শামী।
৫২। উ’রফুত্ তা’রীফুল্ মৌলুদুশ্ শরীফ।
৫৩। মায়াতু মাসায়েল।
৫৪। মাজ্মুয়াহ রাসায়েলে আশারাহ।
৫৫। মাযাযানে আহ্মাদী।
৫৬। খোদা কি রহমত।
৫৭। ফাত্হুল মুবীন।
৫৮। সাফাদুস্ সায়েল।
৫৯। মৌলুদে কবীর।
৬০। মুস্লিম শরীফ।
৬১। বাহ্রুররায়েক।
৬২। মিশ্কাতুল মাসাবীহ্।
৬৩। সুনানে আবু দাউদ।
৬৪। হেদায়াহ্ প্রভৃতি।
পবিত্র মক্কা ও দেশ-বিদেশের যেসব আলেম উক্ত গ্রন্থের সত্যয়নকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের নাম।
উল্লেখ্য,
প্রত্যেকেই মন্তব্য সহকারে নিজ নিজ স্বাক্ষর করেছেন। তা উল্লেখ করলে এ
গ্রন্থটি বড় হয়ে যাবে। এজন্য তাঁদের মন্তব্য ও বক্তব্য বাদ দিয়ে কেবল
নামগুলো দেওয়া হল।
১। হানাফী মুফ্তি আবদুর রহমান সিরাজ।
২। হাসান তৈয়ব হানাফী।
৩। ইব্রাহীম আল ফাতান।
৪। আবদুর রহমান আফেন্দী।
৫। আবদুল মতলব।
৬। সাইয়েদ আবদুল্লাহ কোশক।
৭। শাফেয়ী মুফতি আহমদ দাহলান।
৮। মালেকী মুফ্তি মোহাম্মদ শারকী।
৯। মোহাম্মদ জারুল্লাহ।
১০। আহাম্মদ আবুল খায়ের।
১১। আহাম্মদ কামাল।
১২। হোসাইন গরীব।
১৩। হাসান হাম্বলী।
১৪। সালমান ঈসা।
১৫। আহাম্মদ আল দাগেস্তানী।
১৬। আবদুল কাদের শাখিনী।
১৭। মোহাম্মদ সাঈদ আল আদীব।
১৮। ইব্রাহিম তুমুসী।
১৯। আবদুর রহমান জামাল হানাফী।
২০। আবদুল কাদের খোকের।
২১। আবদুল কাদের শাম্্স্।
২২। মোহাম্মদ সাঈদ।
২৩। আলী জাওদাহ।
২৪। আহাম্মদ আমীন।
২৫। শেখ ফেরদৌস।
২৬। মোহাম্মদ বিস সাইল।
২৭। আবদুল্লাহ জাওয়ারী।
২৮। সাইয়েদ উমর শাত্তি।
২৯। মান্শাভী।
৩০। আবদুল জাব্বার।
৩১। সাইয়েদ মোহাম্মদ আলী।
৩২। আলী হারিরী।
৩৩। আলী-বিন-আবদুল্লাহ।
৩৪। মোহাম্মদ বিন-আবদুল্লাহ।
৩৫। আহাম্মদ বিন মোহাম্মদ বিন খলীল।
৩৬। আবদুর রহমান সিরাজ।
৩৭। রাজী আঃ রহিম খালফবিন-ইব্রাহীম।
৩৮। মোহাম্মদ আবদুল হক।
৩৯। আবদুর রহমান আজমী।
৪০। আবদুল্লাহ মাশাত।
৪১। আবদুল্লাহ কামাশী।
৪২। মোহাম্মদ সয়ূতী।
৪৩। মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।
৪৪। আঃ মজিদ আল দাগেস্তানী।
৪৫। মোহাম্মদ রাজী।
৪৬। সাইয়েদ জামালুদ্দিন।
৪৭। সাইয়েদ আবদুল্লাহ বিন সাইয়েদ আহমদ।
৪৮। সাইয়েদ মোস্তফা।
৪৯। মোহাম্মদ বিন সালেম আয়েশ।
৫০। মোহাম্মদ বিন দাউদ।
৫১। আবদুর রহমান।
৫২। আবদুর রহমান বিন হাজারী।
৫৩। হাজী আবু বকর বাসিয়ূনী।
৫৪। আব্বাস বিন জাফর।
৫৫। আবুল বারাকাত।
৫৬। আলী রাহেস্তী।
৫৭। আহাম্মদ হাজারী।
৫৮। মোস্তফা আফিফী।
৫৯। মোহাম্মদ আমীন।
৬০। ইব্রাহীম বিন খেয়ার।
৬১। মোহাম্মদ বিন আহাম্মদ রেফাগী।
৬২। আহাম্মদ সিরাজ।
৬৩। মোহাম্মদ বিন ইব্রাহীম হাশিরী।
৬৪। আলী বিন ইব্রাহীম আল জোবাইদী।
৬৫। মোহাম্মদ সালেহ।
৬৬। মোহাম্মদ বিন শেখ হোসাইন।
৬৭। আবদুল কাদের বিন মোঃ আলী।
৬৮। আবদুল কাদের মাশাত্ব।
৬৯। মোহাম্মদ সালেহ জাওয়ারী।
৭০। সোলেমান ওক্বাহ্।
৭১। মোহাম্মদ মুনসুর।
৭২। জাফর হোসাইনী আল র্বজন্জী।
৭৩। সাইয়েদ ইউসুফ।
৭৪। উমর বিন আলী।
৭৫। হাসান আদীব।
৭৬। আলী তাহান।
৭৭। আলী বিন মোহাম্মদ হাব্বাব।
৭৮। মোঃ সাঈদ বিন বছিল।
৭৯। মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ।
৮০। সাইয়েদ সালেম।
৮১। আহাম্মদ আল হানিফী।
৮২। মোহাম্মদ কাশেম।
৮৩। মোবারক বিন সাঈদ।
৮৪। আবদুর রহমান হাজারী।
৮৫। মোহাম্মদ সোলায়মান।
৮৬। মোহাম্মদ নূরে সোলেমানী।
৮৭। আবদুল আজিজ হাশেমী।
৮৮। মোহাম্মদ হামেদ।
৮৯। আলী বিন আহাম্মদ বাসেরীন।
৯০। আহাম্মদ আব্বাস।
৯১। আবদুর রহীম আল বারায়ী।
৯২। ইউসূফ রূমী।
৯৩। মোহাম্মদ হাশেম বিন হোসাইন আব্বাস বিন-জাফর বিন সিদ্দিক।
৯৪। মোহাম্মদ সালেহ।
৯৫। মোহাম্মদ উ’স্মান কুদ্দী।
৯৬। মোহাম্মদ মুহ্সিন।
৯৭। আবদুল্লাহ বিন আলী।
৯৮। আহাম্মদ ফাত্তাহ্।
৯৯। আহাম্মদ উস্মান।
ফাতেহার তাক্বীর
আল্লাহু আক্বার, আল্লাহু আক্বার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার, ওয়া লিল্লাহিল্ হাম্দ।
হযরত রাসূল (সাঃ)-এর ফাতেহার নিয়ম
হে!
জগৎ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির গৌরব বিশ্বের রহমত মানবকুলের সার শেষ নবী আহ্মাদ
মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) এবং তাঁর বংশধর, তাঁর সাহাবা, তাঁর আহলে
বাইয়াতগণ দয়া করে আমাদের এ নিয়াজ অর্থাৎ প্রার্থনা ও উৎসর্গ কবুল করুন Ñ
বলে সূরা ফাতেহা ও সূরা এখলাস পাঠ করতে হবে।
হযরত আলী (রাঃ)-এর ফাতেহার নিয়ম
হে!
সৃষ্টির সর্বোচ্চ শিখর, প্রকৃতি গ্রন্থের শৃঙ্খলা, মহাকাশের চন্দ্র,
অন্ধকার বিতাড়ক প্রধান নক্ষত্র, আপাদমস্তক মর্যাদার অধিকারী, অসাধারণত্বের
সিঁড়িতে আসীন, ইমামত বেদী দিশারী, শরিয়তের শাহী মহলের কর্তা, ত্বরিকত
সাগরের মাঝি, নবুয়তের জ্যোতিলোকের সৈন্য শক্তির প্রধান, নির্জন এককের নিকট
সঙ্গী, বিকশিত এককের সাথী, ত্বরিকতপন্থীদের গুরু, কষ্টের উপশমকারী এলমে
লাদুনীর শিক্ষক। দৈবজ্ঞান বিশারদ, উদয়াচলের অপূর্ব শুভ্রতা, অলৌকিকতার
প্রকাশপট, জয় বিজয়ের জনক প্রধান দশ জনের দ্বিতীয় ইমাম, হাওযে কাওছারের
সাকীদের সরদার, উচ্চ প্রশংসার অধিকারী মানবশ্রেষ্ঠ আমীরুল মুমেনীন ইমামূল
মুত্তাক্কীন আলী ইবনে আবি তালেব আল্লাহ্র বিজয়ী সিংহ এবং সকলের কামনার ধন
আমার এ উৎসর্গ গৃহীত হোক Ñ বলে সূরা ফাতেহা ও সূরা এখলাস পাঠ করতে হবে।
খাতুনে জান্নাত বিবি ফাতেমা (রাঃ)-এর ফাতেহা
খাতুনে জান্নাত বিবি ফাতেমা জোহরা (রাঃ) এর যুগস্বীকৃত অসামান্য দরগাহে আমাদের মানত ও উৎসর্গ কবুল হোক Ñ এ কামনা করে ফাতেহা পাঠ করতে হবে।
ফাতেহা-এ-কান্দুরী
পর্দানশীন
মহিলাদের ভূষণ অবগুণ্ঠিত নারীদের মুকুট সর্ব হযরত বিবি ফাতেমা জোহরা, বিবি
কামাল, বিবি রোকেয়া, বিবি হোনায়ফা, বিবি খুদিজা, বিবি হাফসা, বিবি জয়নব,
বিবি আয়েশা, বিবি খাচ্ছা (রাঃ) সহ রাসূলের সব জান্নাতবাসিনী বিবিদের নিয়তে
সূরা এখলাস এবং সূরা ফাতেহা পাঠ করা।
দুই ইমামের ফাতেহা
নিষ্পাপ
নিরপরাধ মজলুম দুই শহীদ হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন এবং তাঁদের দুই
পুত্র মোহাম্মদ হাসান ও আবদুল্লাহ হোসাইন যাঁরা কারবালা প্রান্তরে শহীদ
হয়েছেন নেয়াজ কবুল করেন বলে তাঁদের উদ্দেশে সূরা এখলাস সহ সূরা ফাতেহা পাঠ
করা।
হযরত মীর মহিউদ্দীনের ফাতেহা
প্রার্থনাকারীদের কল্যাণের
নিয়তে সাইয়েদ সুলতান খাজা মাখদুম গরীব বাদশাহ শাইখ দরবেশ অলী মাওলানা মীর
মহিউদ্দীন, তাঁর পিতা সাইয়েদ সালেহ জঙ্গী, তাঁর মা বিবি দ্বিতীয় ফাতেমা
তাঁর স্ত্রী বিবি নসীবাহ, তাঁর ভাই আবদুর রাজ্জাক এবং আবদুল ওহাব স্মরণে
একবার সূরা ফাতেহা, পনেরো বার সূরা এখলাস এবং এগারো বার দরুদ পাঠ করা।
ফাতেহা-এ-হযরত শাহ্ শরফ বু আলী কলন্দর
সুলতানুল
আশিক্কীন সেরা দার্শনিক হযরত শাহ্ শরফ আবু আলী কলন্দর এবং হযরত শাহ্
শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মুনীরী, হযরত আহাম্মদ খান, হযরত মোবারক খান প্রমুখ
আল্লাহ্র পরিশুদ্ধ ব্যক্তিদের উসিলাতে মানত ও উৎসর্গাদি কবুলের নিয়তে সূরা
ফাতেহা পাঠ শেষে আয়াতুল কুরসী তিনবার, সূরা আল ইন্শিরাহ তিনবার, সূরা
ফাতেহা তিনবার, সূরা এখলাস দশবার এবং দরুদ দশবার পড়তে হবে।
হযরত খাজা খিজিরের (আঃ) ফাতেহা
অভাবপূরণকারী
এবং সৃষ্টির বিপদ ত্রাতা হযরত খাজা খিজিরের (আঃ) পবিত্র সত্তার শান্তি
কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা। অপরাধ ক্ষমাকারী রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা
(সাঃ) ও অমুক অমুক পবিত্র আত্মাসমূহ এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত নূরুল্লাহগণের অছিলায়
সকল মৃতদের, হকদারদের এবং প্রার্থীদের তথা সকল মুসলিম কবরবাসীদের রূহে এর
সওয়াব পৌঁছে দিন বলে সূরা এখলাসসহ সূরা ফাতেহা পাঠ করা।
হযরত কাজী শাহবুদ্দিন (রঃ) এর ফাতেহা
হযরত
কাজী শাহবুদ্দীন, হযরত কাজী মালেকুদ্দীন, হযরত কাজী মঈনদ্দীন, হযরত কাজী
ইমামুদ্দীন, হযরত কাজী হামিদুদ্দীন, হযরত কাজী ফরীদুদ্দীন এবং হযরত কাজী
বোরহানুদ্দীন প্রমুখদের পবিত্র রূহে মানত ও উৎসর্গাদির পুণ্যসমূহ সসম্মানে
পৌঁছানোর নিয়তে তিনবার সূরা ফাতেহা, তিনবার আয়াতুল কুরসী, তিনবার সূরা
ইন্শিরাহ, তিনবার সূরা এখলাস এবং দশবার দরুদ পাঠ করা।
হযরত শাহ্ মাদার (রঃ) এর ফাতেহা
হযরত
শাহ্ মাদারের আশেকিনদের পবিত্র রূহের ওপর তালেবে মাদার, মাদারে নূরানী,
মাদারের হুরানী, মাদারে জহুরানী পীর বদিউদ্দিন জিন্দাশাহ মাদার (কুঃ ছেঃ)
পবিত্র রূহ্ মোবারকে এবং পিতা আলী চাপি মাতা বিবি হাজেরার উপর উৎসর্গাদি
পৌঁছানোর নিয়তে সূরা ফাতেহা একবার, সূরা এখলাছ তিনবার, দরুদ শরীফ তিনবার
পাঠ করতে হবে।
শবে বরাতের প্রদীপসমূহের উদ্দেশে ফাতেহা
হে আল্লাহ্!
হযরত নূর নবী রাসূল (সাঃ)-এর সম্মানার্থে ঈমান ও অন্তর উজ্জ্বলকারী শবে
বরাতের প্রদীপগুলোকে কেয়ামতের দিনে নাজাতের উসিলা করুন এবং এদের জান্নাতে
দাখেল করুনÑএ প্রার্থনায় সূরা এখলাস ও সূরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে।
কোরান খতমান্তে ফাতেহা
হে
আল্লাহ্! কোরান খতম, সূরা এখলাস ও সূরা ফাতেহা পাঠের সমস্ত পুণ্য হযরতে
আরবি উম্মী নবী অন্ধকারের রবি, হেদায়েতের নূর উভয় কা’বার মালিক, সকল রাসূল,
সকল মুমিন, পাপী-তাপীর সুপারিশকারী আমাদের নেতা, আমাদের মাওলা, আমাদের
অলী, আমাদের অন্তরের পবিত্রতা, আমাদের অপরাধ ক্ষমার সুপারিশকারী, আমাদের
চোখের মণি আবুল কাসেম মোহাম্মদ (সাঃ), তাঁর সাহাবাগণ, তাঁর স্ত্রীগণ, তাঁর
অনুসারীগণ, তাঁর বংশধর এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতদের সহ সকল নবী-রাসূলগণের
অছিলায় অমুকের রূহে পৌঁছে দিন এবং আপনার আপন দয়া ও করুণায় তাঁকে
জান্নাতবাসী করুন।
কবরে মৃতের জন্য উপদেশ
হে আল্লাহ্র বান্দা!
আল্লাহ্র দু ফেরেশতা এলে ভয় পাবে না, চিন্তিত হবে না এবং বিশুদ্ধ ভাষা ও
দৃঢ় প্রত্যয়ে বলবেÑ আমি সাক্ষ্য দিতেছি যে, এক আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য
নেই এবং তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিতেছি যে, মোহাম্মদ আল্লাহ্র
বান্দা ও রাসূল। আর বল যে, আল্লাহ্ আমার রব বা প্রভু, ইসলাম হল আমার
দ্বীন, হযরত মোহাম্মদ আমার নবী, কোরান আমার ইমাম, কা’বা আমার ক্বিব্লা,
মুমিনগণ আমার ভাই, আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন তাতে রয়েছে পুণ্য, আর যা হারাম
করেছেন তাতে রয়েছে শাস্তি, পুণ্যে বেহেশত আর শাস্তি হল দোযখ, কেয়ামত আসন্ন
এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং কবরবাসীদের আল্লাহ্ উঠাবেন।
এছাড়া অনেক ফাতেহা
আছে। এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃত করা হল। ইচ্ছা হলে অন্যান্য কেতাব দেখতে
পারেন। তাহলে আল্লাহ্র ইচ্ছায় আরও জানতে পারবেন।
বুজুর্গ আলেমদের মন্তব্যাদি
মর্যিয়াদের
শব্দ বিকৃত আর ওহাবীদের বিকৃত ব্যাখ্যার জবাবে লিখিত ‘লাতায়েফে শাফিয়া’র
বিশুদ্ধতা সমর্থনে বিজ্ঞ বুজুর্গ সত্যনিষ্ঠ আলেমদের দস্তখতসহ প্রশংসামূলক
মন্তব্যাদি নিম্নে উল্লেখ করা হল :
আমি ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবখানা
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়েছি। এতে জনাব মৌলভী আলী জৌনপুরীর
পুস্তকাদির জবাবে কিছু লেখা হয়েছে নিঃসন্দেহে তা সঠিক। প্রকৃতপক্ষে মৌলভী
জৌনপুরী সাহেব তাঁর রচনাবলি তথা ‘যাদুত তাকওয়া’, ‘রাদ্দুল বেদাআ’,
‘কাওলুচ্ছাবেত’ প্রভৃতির অধিকাংশ স্থানেই সত্যের বিপরীত কথা বলেছেন এবং
আল্লাহ্র ভয়কে উপেক্ষা করে বিকৃত ও মনগড়া কথা নিয়ে আপন কেতাবসমূহে
বাকবিতন্ডা করেছেন।
স্বাক্ষর : বান্দা ফজলুল হক সুধারামী আফিআনহু।
‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবে যা কিছু লেখা হয়েছে, সবই সঠিক।
স্বাক্ষর : আবদুল গণি শাহ্ শাহবাজপুরী।
- উক্ত
স্বাক্ষরকারী জনাব মৌলভী শাহ্ চৌধুরী আবদুল গণি সাহেব একজন বিশিষ্ট আলেম,
নেতৃস্থানীয় দরবেশ এবং অলী, তিনি অত্যন্ত সাধু সূফী এবং হুঁশিয়ার
ব্যক্তিত্ব। তিনি বরিশালের শাহবাজপুরের বাসিন্দা। তিনি মরহুম ওরমজান
চৌধুরীর জামাতাও বটেন। উক্ত লাতায়েফে শাফিয়াহ সম্পর্কে উক্ত হযরত চৌধুরী
সাহেব যে মন্তব্য করেছেন সর্বৈব সঠিক।
স্বাক্ষর : ফকীর তোফায়েল আহাম্মদ শাহ্ বাজপুরী। - মৌলভী আলী জৌনপুরীর রচনাবলির জবাবে ‘লাতেয়েফে শাফিয়াহ’তে এর প্রণেতা যা লিখেছেন নিঃসন্দেহে তা সঠিক এবং এটা প্রকাশ করা ওয়াজিব।
‘স্বাক্ষর : সাখাওয়াতুল্লাহ-বিন মরহুম জনাব হযরত শাহ্ আবদুল্লাহ সাহেব রায়পুরী। - ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ একটি মৌলিক রচনা এবং প্রশংসনীয়।
স্বাক্ষর : ফকীর মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। - ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ একটি প্রেরণাদায়ক কেতাব। এর বক্তব্য নিঃসন্দেহে সঠিক।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ আমিনুদ্দীন ফরিদপুরী। - জনাব মৌলভী কেরামত আলী সাহেবের জবাবে ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবে যা লেখা হয়েছে তা সম্পূর্ণ যথার্থ ও সঠিক হয়েছে।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ, নিবাস- জাফরাবাদ।
স্বাক্ষর : আমীরুদ্দীন আহাম্মাদ, নিবাস- কালিকাপুর, মাদারীপুর।
স্বাক্ষর : আবদুল জাব্বার আফিআনহু/ নাসেরপুরী/ ফরিদপুরী। - জনাব
মাওলানা শাহ সাইয়েদ আবদুল খালেক সাহেব শ্যামপুর দরবারের পীর সাহেবের ছেলে।
হোসাইন বংশের সূর্য শ্যামপুরে উদিত হয়েছে। সোবহানাল্লাহ! তাঁর বুজুর্গি কত
বর্ণনা করব! তাঁর মহৎ গুণাবলি হিন্দুস্তান ও বাংলায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল।
প্রকৃতপক্ষে হোসাইনের বংশধর ব্যক্তিসত্তা বেলায়েতের আলোয় আলোকিত এটা এ
বংশের বৈশিষ্ট্য। তিনি কেতাবি বিদ্যায় অদ্বিতীয়, তাঁর যোগ্যতার কাছে গোটা
বাংলার জ্ঞান বিন্দুতুল্য। তিনি আলোচ্য ‘লাতায়েফে শাফিয়া’ কেতাবখানা শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে শুনেছেন এবং আলী জৌনপুরীর ভূমিকাও মনোযোগ সহকারে
দেখেছেন। কিন্তু বর্তমানে ক্ষীণদৃষ্টির কারণে অন্যকে নিম্ন বক্তব্যটি লিখতে
বলেনÑ আমি আলী জৌনপুরীর রচনাবলির জবাবে লেখাÑ ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’
কেতাবখানা পড়িয়ে শুনেছি, এর বক্তব্য সঠিক।
স্বাক্ষর : সাইয়েদ আবদুল খালেক শ্যামপুরী। - জনাব
মাওলানা মৌলভী শামসুল আলম সাহেব একজন বিরাট যোগ্যতাসম্পন্ন উচ্চ বংশীয়
লোক, তিনি ছিলেন সমাজে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তাঁর সম্ভ্রান্ত পিতা একজন
আল্লাহ্ভক্ত সূফী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবটি মনোযোগ
সহকারে পড়েন এবং আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার
পর জবাব সঠিক হয়েছে লিখে স্বাক্ষর করেন।
স্বাক্ষর : শামসুল আলম অফিয়া আন্হু, শাহবাজপুুরী দৌলত খান নামে পরিচিত। - ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’-এর জবাবগুলো সম্পূর্ণ সঠিক।
স্বাক্ষর : ফাদবী হাবিবুল্লাহ্ অফিআনহু মিরপুরী। - আলোচ্য ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবে পীর সাহেব যা লিখেছেন, ঠিকই লিখেছেন।
স্বাক্ষর : ফাদবী আহাম্মদ শাহবাজপুরী। - আমি ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবখানা পাঠ করেছি। এর জবাবে আলোচনাটি সঠিক এবং বিধানসম্মত।
স্বাক্ষর : ফাদবী মোহাম্মদ সা’দুল্লাহ্ সুধারামী। - মুর্শিদ যেমন খাঁটি, জবাবও দিয়েছেন খাঁটি এবং যথার্থ।
স্বাক্ষর : ফকীর আবদুল্লাহ মক্কী-বিন হারুন সাহ্। - আল-‘শাফিয়াহ’ কেতাবে জবাব হিসেবে যা লেখা হয়েছে, তা সঠিক।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, শমসেরাবাদ নিবাসী। - নিঃসন্দেহে জবাবটি সঠিক হয়েছে।
স্বাক্ষর : শামসুদ্দীন আহাম্মদ লামচরী। - আমি ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ পড়েছি, তা নিয়ে চিন্তা করেছি এবং তাতে লেখা জবাবগুলো সম্পূর্ণ সঠিক বলে আমার নিকট প্রমাণিত হয়েছে।
স্বাক্ষর : ফাদবী আবদুল জাব্বার, কাটাখালী নিবাসী। - এতে যা লেখা হয়েছে নিঃসন্দেহে তা অভ্রান্ত।
স্বাক্ষর : ফাদবী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, রাজাকুরশিউর নিবাসী। - ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবের জবাব সঠিক।
স্বাক্ষর : ফাদবী আহসানল্লাহ (অফিয়া আন্হু)। - জবাব সঠিক।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ চন্ডিপুর। - জনাব
পীর দস্তগীর জামানার হাদী জনাব মরহুম মাওলানা কেরামত আলী সাহেবের যে সব
ভুলভ্রান্তি নির্দেশ করেছেন তা ঠিক করেছেন এবং ফাতেহা কলন্দরী এবং বিন্নরী
সম্পর্কে ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’তে যা লিখেছেন পূর্ববর্তী অনেক কেতাবে তা
যথার্থই উল্লেখ আছে, আমি নিজে তা দেখেছি।
স্বাক্ষর : ফাদবী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মোমেনপুরী। - জনাব পীরে কামেল ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’ কেতাবে যে সব দোষত্রুটি নির্দেশ করেছেন তা সঠিক এবং তুলনাহীন।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, শ্যামপারায়ী। - অনন্য হাদী পীর সাহেব ‘লাতায়েফে শাফিয়াহ’তে যা লিখেছেন তা সম্পূর্ণ সত্য এবং অপূর্ব।
স্বাক্ষর : মোহাম্মদ আবদুল মজিদ গাওহারবাগী। - লেখক যা লিখেছেন ঠিকই লিখেছেন।
স্বাক্ষর : ফকীর মুকবুল আহামাদ, চট্টগ্রামী, খাদেম নওয়া পাড়া দরগাহ্। - আল্লাহ্ গ্রন্থকারকে পুরস্কৃত করুন।
স্বাক্ষর : ফকীর মোহাম্মদ আবদুল আজিজ আলীপুরী।
Ñ তামাম শোধ Ñ
No comments:
Post a Comment